বেদব্যাসের সাহিত্য সাধনা
মহাভারতের রচনাকার ছিলেন মহর্ষি বেদব্যাস। তিনি ছিলেন সরস্বতীর প্রকৃত বরপূত্র। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন বেদবিদ্যার ধারক শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যর একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারত, যেটি দীর্ঘতম লিখিত কবিতা হিসেবে পরিচিত-তাঁকে এর রচয়িতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে এতে তাঁরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সাহিত্য সাধনার জন্য তিনি সত্যিকারের সাধনায় ব্রতী হয়ে মা সরস্বতীর আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস বা সংক্ষেপে বেদব্যাস ছিলেন একজন মহান ঋষি। তিনি বশিষ্ঠের প্রপৌত্র, শক্তির পৌত্র, পরাশরের পুত্র এবং শুকদেবের পিতা। মহাভারতের দুই প্রধান চরিত্র পান্ডু ও ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন বেদব্যাসের অপর দুই পুত্র। তিনি পৌরাণিক মহাকাব্য মহাভারত, বেদান্তদর্শন, প্রভৃতির সংকলক, সম্পাদক ও অবশেষে সমন্বায়ক এক জ্ঞানান্বেষী ঋষি। তাঁর জন্ম ছিল একটি অদ্ভুত ঘটনা বহুল ইতিহাস। যমুনানদীতে খেয়া পারাপারের সময় নৌকার ভিতর পরাশর মুনি সত্যবতীর সাথে মিলিত হলে, সত্যবতী গর্ভবতী হন।
সেই মহিয়সী সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তান মহান ব্যাসদেব।
তিনি তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই কারণে ইনি বেদব্যাস বা ‘ব্যাস’ নামে পরিচিত হন। জন্মের পরপরই তিনি তার মায়ের অনুমতি নিয়ে কঠোর তপস্যার জন্য গভীর বনে যাত্রা করে। তাঁর তপস্যার স্থান ছিল বদ্রিকাশ্রম। মা সরস্বতীকে তুষ্ট করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে সাহিত্য সাধক হয়ে ওঠাই ছিল ব্যাসদেবের প্রধান উদ্দেশ্য।
মহামুনি ব্যাসদেব বদ্রিকাশ্রমে কঠোর তপস্যা শুরু করেছিলেন। শুরুতেই ব্যাসদেবের তপস্যা দেখে স্বয়ং মা সরস্বতী আবির্ভূত হন তপস্যা স্থলে। তিনি ব্যাসদেবকে একটি কঠিন শর্ত দেন। তাঁর তপস্যাস্থলের কাছে একটি কুলের বীজ রেখে দেবী একটি শর্ত দেন। এই কুলবীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড়ো গাছ, বড়ো গাছে ফুল থেকে নতুন কুল হবে। তারপর সেই কুল সময়সাপেক্ষে পরিপক্ক হয়ে যখন ভূপাতিত হবে,সেইদিন পর্যন্ত ব্যাসদেবকে তপস্যা করতে হবে। দেবী বলেন, যে দিন সেই কুল পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হবে, সেই দিন তার তপস্যা পূর্ণ হবে বা দেবী তুষ্ট হবেন। তারপর শুরু হয় কঠোর সাধনা। বছরের পর বছর কাটে তপস্যায়। কিন্তু সেই গাছ বড়ো হয়ে তাতে ফল আসতে অনেক বছর অতিবাহিত হয়। এদিকে ব্যাসদেবও সেই শর্ত অনুযায়ী সাধনার একের পর এক কঠিন স্তর অতিক্রম করতে থাকেন।
ধীরে ধীরে বেশ কয়েক বছরে এই কুল বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড় গাছ, বড় গাছে ফুল থেকে নতুন কুল হয় এবং একদিন তা পরিপক্ক হয়ে হঠাৎ ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হয়। উপস্থিত হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।তখন ব্যাসদেব বুঝতে পারেন যে, সরস্বতী দেবী তাঁর প্রতি তুষ্ট হয়েছেন। ঘটনাক্রমে
সেই দিনটি ছিল শ্রীপঞ্চমী। সে দিন বেদমাতা স্বয়ং সরস্বতীকে বদ্রী অর্থাৎ কুল ফল নিবেদন করে অর্চনা করে তিনি ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করেন। শ্রীপঞ্চমীর সেই দিন সরস্বতী দেবী তুষ্ট হয়েছিলেন।
পূর্বে সমস্ত কিছুই মৌখিক ছিল। মৌখিক পরম্পরায় সবকিছু মনে রাখা হতো স্মরণশক্তির সাহায্যে। তবে কলিযুগ নিকটবর্তী হতেই মানুষের মনের ক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেল। ব্যাসদেব কোনও ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো বিবেচনা করেছিলেন, তাই তিনি বেদ রচনার জন্য একজন দেবতা – গণপতিকে নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর মস্তিস্ক প্রসুত মহাভারত একটি মহান, চিরন্তন সংকলন যা চিরকালের জন্য মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিক।
তবে মহাভারতকে আমরা আজকে যেভাবে জানি – সেটি কেবল তাঁর মহান শিষ্য বৈশম্পায়নের স্মরণে থাকা অংশমাত্র, গণপতি গণেশ যেভাবে লিখেছিলেন সেটা নয়।
একজন লিখে চলেছেন এবং আরেকজন মন দিয়ে শুনছেন। তবে মহাভারতের লিখিত দলিলটি এতটাই আকর্ষণীয় ছিল- এটি এমনই একটি অসাধারণ সাহিত্যের নমুনা ছিল যে দেবতারা এসে সেটি চুরি করে নিয়ে যান। এক অদ্ভুত বাসনা কাজ করেছিল দেবতাদের মনে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বৈশম্পায়ন হস্তিনাপুরের সম্রাট জনমেজয়কে(যিনি যুধিষ্ঠিরের দ্বিতীয় উত্তরসূরি) গল্পটি বলেছিলেন। আমরা আজ যা জানি তা ব্যাস যে কথা বলেছিলেন তার একটি অংশমাত্র। ব্যাসদেব সৃষ্ট মহাভারত এমন একটি সাহিত্যের নমুনা যে তার বিশালতা তার মহত্বের কাছে নস্য, তার বিষয় বিবিধতার কাছে নস্য। তাইতো স্বয়ং ব্যাসদেব শিষ্য বৈশম্পায়ন একবার শুনেই মহাভারত কন্ঠস্থ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে দেবতাদের চুরি করা আসল মহাভারতের সন্ধান বোধহয় দেবতারাই জানেন।।