Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বৃষ্টি ও মেঘমালা (২০০১) || Humayun Ahmed » Page 2

বৃষ্টি ও মেঘমালা (২০০১) || Humayun Ahmed

লীনার মা সুলতানা

লীনার মা সুলতানা সন্ধ্যা সাতটা থেকে বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছেন। মেয়ে অফিস থেকে ফিরতে এত দেরি করছে কেন? এত দেরি তো কখনো হয় না। ঢাকা শহরের অবস্থা ভালো না! ছেলেরাই সন্ধ্যার পর বের হয় না, সেখানে লীনা একটা মেয়ে। বাইশ বছর বয়েসী বাচ্চামেয়ে।

টেনশানে সুলতানার মাথা ধরে গেছে। এখন সামান্য ধরেছে। লীনা আসতে যত দেরি করকে মাথাধরা ততই বাড়তে থাকবে। একসময় ব্যাথাটা মাইগ্রেনে চলে যাবে। তখন দরজা জানালা বন্ধ করে বিছানায় ছটফট করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তার মাইগ্রেন জগৎবিখ্যাত। একবার ব্যথা উঠলে তিন-চারদিন থাকে।

সুলতানার ছোটমেয়ে বীনা বারান্দায় এসে মার পাশে দাঁড়ায়। হাসিমুখে বলল, মা তুমি একবার ঘরে যাচ্ছ একবার বারান্দায় আসছ— এই করে মোট একুশ বার ঘর-বারান্দা করে ফেলেছে। আমি বসে বসে শুনলাম।

সুলতানা বললেন, তাতে তোর কী সমস্যা?

বীনা বলল, বিরক্তি লাগছে মা। একই জিনিস কেউ দুবার করলেই আমার বিরক্তি লাগে, তুমি একুশ বার করছ,— বিরক্তি লাগবে না? তারচে একটা কাজ কর— আমি মোড়া এনে দিচ্ছি, তুমি বারান্দায় বসে থাকো।

সুলতানা বললেন, চুলায় গরম পানি দিয়ে রাখ। লীনা এসেই গরম পানিতে গোসল করে। পানিটা রেডি থাকুক।

আপাকে আসতে দাও মা। আগেই গরম পানি কীজন্যে? এমনওতো হতে পারে আপা আসবেই না।

সুলতানা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আসবে না মানে?

বীনা বলল, ঠাট্টা করলাম মা।

আর কখনো এরকম ঠাট্টা করবি না।

আচ্ছা যাও করব না। একটা বেবিটেক্সি এসে থেমেছে মা। আপার মতো দেখতে একটা মেয়ে নামছে। এই দেখ তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। একটু হাতটা নাড়োতো মা।

সুলতানার মাথাধরা দূর হয়েছে। তাঁর এই আনন্দ লাগছে যে চোখে পানি এসে যাচ্ছে। অথচ এত অনিন্দিত হবার কিছু নেই। মেয়ে তো ঘরে ফিরবেই। চাকরি করে যে মেয়ে সে দু-একদিন দেরি করে ফিরবে এটাও তো স্বাভাবিক।

লীনা ধুপধাপ শব্দে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। সুলতানা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গম্ভীর থাকার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। মুখে হাসি এসে যাচ্ছে। ধুপধাপ শব্দটা তাঁর আনন্দ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা সব কাজে এত শান্ত, শুধু সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় দৌড়ে উঠবে। কোনো একদিন পা পিছলে একটা ঘটনা না ঘটায়। মেয়েটাকে ধমক দিতে হবে। আজ না অন্য কোনোদিন।

লীনা ঘরে ঢুকেই বলল, রান্না কী মা?

সুলতানা বললেন, সিমের বিচি দিয়ে শিং মাছ, করলা ভাজি, ডাল। ঘরে বেগুন আছে তুই চাইলে বেগুন ভেজে দেব।

লীনা বলল, সব রান্না নর্দমায় ফেলে দাও তো মা। সব ফেলে দিয়ে হাঁড়ি পাতিল ধুয়ে ফেল।

সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, কেন?

আজ বাইরে থেকে খাবার আসবে। স্যার খাবার পাঠাবেন।

সুলতানা বললেন, খাবার পাঠাবেন কেন?

লীনা বলল, আজ আমরা বিরাট এক কাজ পেয়েছি মা। এই উপলক্ষে খাবার আসবে। খুবই রোমাঞ্চকর ঘটনা। গোসল করে এসে তোমাকে বলব। গোসলের পানি কি গরম আছে মা?

সুলতানা লজ্জিত হয়ে রান্নাঘরে ছুটে গেলেন। তাঁর মেয়েটা অফিস থেকে এসেই গরম পানি দিয়ে গোসল করতে চায়। এটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন, তার পরেও পানিটা গরম থাকে না। এই দোষটা তার। সুলতানা মনে মনে ঠিক করে ফেললেন— এই ভুল আর হবে না।

লীনা বাথরুমে গোসল করছে।

বাথরুমের দরজা অর্ধেক খোলা। দরজার ওপাশে মোড়া পেতে বীনা বসে আছে। গোসল করতে করতে বীনার সঙ্গে গল্প করা লীনার অনেকদিনের পুরানো অভ্যাস। গল্পগুজবের এই অংশে সুলতানা থাকেন না। কারণ তিনি লক্ষ্য করেছেন তাকে দেখলেই দুই মেয়ে গল্প থামিয়ে দেয়। এতে তিনি খুবই মনে কষ্ট পান। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তাদের ব্যক্তিগত গল্প থাকতেই পারে। যে গল্প মাকে শোনানো যায় না। সুলতানার মন তীতে শান্ত হয় না। দুই বোনের গল্পের এই অংশে তিনি মন খারাপ করে রান্নাঘরে বসে থাকেন।

বীনা বলল, তোমাদের কোম্পানি বড় একটা কাজ পেয়েছে তাতে তুমি এত খুশি কেন? তুমি তো মাসের শেষে বেতনটাই শুধু পাবে। বাড়তি কিছু তো পাবে না।

লীনা বলল, আমাদের কোম্পানি কাজ পেয়েছে এইজন্যেই আমি খুশি। আমাদের অবস্থা যে কী খারাপ যাচ্ছিল। স্যার শুকনোমুখে অফিসে বসে থাকতেন। কী যে মায়া লাগত।

তোমার তো আপা মায়া বেশি। মায়ার বস্তা নিয়ে ঘুরবে না। একসময় বিপদে পড়ে যাবে। তোমার জন্যে একটা আনন্দ-সংবাদ আছে আপা।

কী আনন্দ সংবাদ।

ফিরোজ ভাই রাতে খেতে আসবে। কাজেই গোসলের পর ভালো একটা শাড়ি পরো আপা। যে শাড়ি তুমি পরবে বলে এনেছ, এই শাড়ি পরলে তোমাকে কাজের বুয়ার বোন বলে মনে হবে।

লীনা লজ্জিত গলায় বলল, মনে হলে মনে হবে। ও আসবে বলে ইস্ত্রি করা শাড়ি পরে বসে থাকতে হবে না-কি?

বীনা বলল, ফিরোজ ভাই তোমাকে যে শাড়িটা দিয়েছে ঐটা পরো। ফিরোজ ভাই খুশি হবে।

লীনা বলল, তোর কি ধারণা ও কী শাড়ি দিয়েছে মনে করে বসে আছে? এইসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। শাড়ি দিয়েছে কি-না এটাও তার মনে নেই।

বীনা বলল, মনে না থাকলে তুমি মনে করিয়ে দেবে। কায়দা করে একসময় বলবে –তুমি যে শাড়িটা দিয়েছিলে ঐটা পরেছি। আপা শাড়িটা নিয়ে আসি?

নিয়ে আয়।

তোমার স্যার আজ কী খাবার পাঠাবে?

জানি না কী পাঠাবেন। ভালো কিছু অবশ্যই পাঠাবেন। উনার নজর খুব উঁচু।

বীনা গম্ভীরগলায় বলল, আপা তুমি তোমার স্যারের যে-কোনো প্রসঙ্গ উঠলেই বেশ গদগদ ভাব কর। এটা আমাদের সামনে কর খুব ভালো কথা। ফিরোজ ভাই-এর সামনে কখনো করবে না। ছেলেরা এইসব জিনিস নিতে পারে না।

লীনা বলল, তোকে জ্ঞান দিতে হবে না।

বীনা বলল, এখন তোমাকে একটা দামী উপদেশ দেব। উপদেশটা শুনলে তোমার ভালো হবে।

কী উপদেশ?

দেরি না করে ফিরোজ ভাইকে বিয়ে করে ফেল। ব্যাপারটা অনেক দিন থেকে ঝুলছে। আর ঝােলা ঠিক হবে না।

লীনা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। এই নিশ্বাস তৃপ্তি এবং আনন্দের। তার ছোটবোনটা উপদেশ দিতে ভালোবাসে। উপদেশ দেবার এই স্বভাব সে পেয়েছে বাবার কাছ থেকে। বাবা উপদেশ দিতে খুব পছন্দ করতেন। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও তিনি গম্ভীর ভঙ্গিতে উপদেশ দিতে চাইলেন আমার দুই মেয়ে কোথায়? তোমরা আমার কয়েকটা কথা শোনো। উপদেশ ভাবলে উপদেশ, আদেশ ভাবলে আদেশ। এই বলেই তিনি মাথা চুলকাতে লাগলেন। লীনার ধারণা কোনো উপদেশ তার মনে আসছিল না।

যত দিন যাচ্ছে, বীনা বাবার ফটোকপি হয়ে যাচ্ছে।

হাসান বাড়ি ফিরল রাত সাড়ে দশটায়। মিস্তিরীকে গাড়ি দেখিয়ে ফিরতে দেরি হল। তার ইচ্ছা ছিল গোলাপ কিনবে। পান্থপথের সিগন্যালে গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়ায়। ফুল বিক্রি করা মেয়েরা ছুটে আসে। শস্তায় খুব ফুল পাওয়া যায়। দুশ টাকার ফুলে গাড়ির পেছনের সিট ভর্তি হয়ে যাবার কথা। বেছে বেছে আজই কোনো সিগন্যাল পড়ল না। হাসান একটানে চলে এল। গ্যারাজে গাড়ি রেখে কলিংবেলে হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। হাসানের স্ত্রী নাজমা মনে হয় দরজা ধরেই দাঁড়িয়েছিল। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। হাসান ভেবে পেল না নাজমা এত রেগে আছে কেন? রাগের কোনো কারণ কি সে ঘটিয়েছে? নাজমার কোনো আত্মীয়ার বিয়েতে তাদের দুজনের যাবার কথা ছিল–সে ভুলে গেছে। নাজমার বাবা বেলায়েত হোসেন চিটাগাং খাকেন, তিনি খুবই অসুস্থ। তার কি কোনো খারাপ খবর এসেছে?

নাজমা বলল, কটা বাজে জানো?

হাসান হাসিমুখে বলল, জানি না। সঙ্গে ঘড়ি নেই। ঘড়ি ফেলে গেছি।

অনুমান করতে পার কটা বাজে? সাড়ে নয়, কিংবা দশ।

হাসান শার্ট খোলার জন্যে বোতামে হাত দিয়েছে। নাজমা বলল, শার্ট খুলবে না।

হাসান বলল, ব্যাপার কী?

ব্যাপার কি তুমি জানো না?

হাসান তার মুখের হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সে তার স্ত্রীকে ভালো একটা খবর দেবে। তার জন্যে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নাজমা রাগে গনগন করছে এই অবস্থায় তাকে বিশাল কাজ পাবার আনন্দময় খবর দেয়া যায় না।

হাসান বলল, ঘটনাটা কী বল তো?

অফিসে যাবার সময় তুমি দেখে যাওনি অন্তুর একশ দুই জ্বর।

জ্বর বেড়েছে না-কি?

তুমি বলে গিয়েছিলে– বিকেলে এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। বলেছ কি বলনি?

ভুলে গেছি। জরুরি একটা কাজ ছিল।

দেখে গেলে ছেলে জ্বরে ছটফট করছে তারপরেও ভুলে গেলে?

এখন জ্বর কত?

একশ চার পর্যন্ত জ্বর উঠেছিল, এখন একশ দুই।

তাহলে তো মনে হয় কমা শুরু করেছে।

কমা শুরু করেছে কি করেনি এই ডাক্তারি কথা আমি তোমার কাছে শুনতে চাচ্ছি না। এক্ষুনি অন্তুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও।

এত রাতে ডাক্তার পাব? নটার দিকে তো ডাক্তাররা ক্লিনিক বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়।

বাড়ি চলে গেলে তুমি ডাক্তারের বাড়িতে যাবে।

আচ্ছা যাচ্ছি।

আমি তোমার অফিসে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম পাওনি?

আমি বিকেলে অফিসে ছিলাম না।

তুমি যে অফিসে ছিলে না। সেই খবর আমাকে অফিস থেকে দেয়া হয়েছে। তুমি তোমার পি. এ-কে নিয়ে বের হয়েছ তিনটার সময়। এতক্ষণ কি তার সঙ্গেই ছিলে? সারাক্ষণ গায়ে মেয়েমানুষের বাতাস না লাগালে ভালো লাগে না?

হাসান কিছু বলল না। অন্তু ঘুমুচ্ছিল। ঘুমন্ত অবস্থাতেই চাদর পেঁচিয়ে তাকে গাড়িতে নিয়ে তুলতেই সে চোখ মেলে হাসানকে দেখে হেসে ফেলে বলল বাবা। তার গা-ভর্তি জ্বর, চোখ লাল, ঠোঁট ফুলে গেছে–ঠোঁটের কোনায় হাসি চিকমিক করছে। অন্তুর বয়স আট, বয়সের তুলনায় সে খুবই গম্ভীর। শুধু বাবা আশেপাশে থাকলে তার গাম্ভীর্য থাকে না।

জ্বর বাধিয়েছিস নাকি রে ব্যাটা?

হুঁ।

খুব ভালো করেছিস।

অন্তু আগ্রহ নিয়ে বলল, খুব ভালো করেছি কেন বাবা?

অন্তু জানে তার বাবা উল্টাপাল্টা কথা বলে, কথা শুনলে মনে হয় ভুল কথা। আসলে ভুল না। বাবা যখন বলেছে জ্বর হয়ে ভালো হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। ভালোটা কী তা সে বুঝতে পারছে না।

হাসান গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, জ্বর বাঁধিয়ে ভালো করেছিস, কারণ জ্বর হবার কারণে সবাই তোকে নিয়ে ব্যস্ত। কেউ পানি ঢালছে, কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, স্কুলে যেতে হচ্ছে না।

আমার স্কুল ভালো লাগে না বাবা।

আমারো লাগে না। আমার ক্ষমতা থাকলে সব স্কুল আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতাম।

অন্তু আনন্দে হেসে ফেলল। সে আগেও লক্ষ্য করেছে একমাত্র বাবাই তার মনের কথাগুলি জানে। আর কেউ জানে না। অন্তু বলল, বাবা তুমি সুপারম্যান হলে ভালো হত।

কীরকম ভালো?

সুপারম্যানদের পাওয়ার থাকে। পাওয়ার দিয়ে তারা সব জ্বালিয়ে দিতে পারে। টিভিতে দেখেছি।

কোন্ চ্যানেলে?

কার্টুন চ্যানেলে।

আমি সুপারম্যান হলে তুই কী হতি? সুপারম্যানের ছানা?

ধ্যাৎ সুপারম্যানদের কোনো ছানা থাকে না। বাবা আমার নাক দিয়ে সর্দি পড়ছে। গাড়িতে টিসু আছে?

টিসু ফিসু নেই। শার্টের কোনায় সর্দি মুছে ফেল।

মা বকবে।

মা জানলে তবেই না বকবে। নাকে সর্দি হয় কেন বাবা?

নাকটা হল নদীর মতো। বর্ষার সময় নদীতে যেমন পানি আসে, নাকে সেইভাবে সর্দি আসে। নাকে সর্দি আসিলে বুঝতে হবে শরীরে বর্ষা নেমেছে।

ধ্যাৎ, বাবা তুমি মিথুক হয়ে যাচ্ছ।

তা একটু একটু হচ্ছি। অন্তু, ডাক্তারের কাছে না গেলে কেমন হয়?

অন্তু উৎসাহের সঙ্গে বলল, খুব ভালো হয় বাবা।

হাসান বলল, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার চেয়ে চল দুজন খানিকক্ষণ রাস্তায় ঘুরি। আইসক্রিমের দোকান থেকে দুটা কোন-আইসক্রিম কিনে খাই।

বাবা আমি চকলেট ফ্লেভার খাব। তুমি কোন্‌টা খাবে?

হাসান বলল, আমি খাব ভ্যানিলা। তবে তোর চকলেট-কোনে একটা কামড় দেব।

ছোট করে কামড় দিও বাবা।

আমার মুখের যে সাইজ আমি সেই সাইজেই কামড় দেব। এরচে ছোট করে কামড় দেব কীভাবে? আমার মুখ কি তোর মতো ছোট?

অন্তু বলল, বাবা আমি কি তোমার ভ্যানিলা আইসক্রিম কোনে একটা কামড় দিতে পারি?

হাসান বলল, না। আমি সবকিছু শেয়ার করতে রাজি আছি। আইসক্রিম শেয়ার করতে রাজি না।

অন্তু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বাবা যা বলছে তা হল অন্তুর একেবারে মনের কথা। অন্তুও বাবার মত আইসক্রিম শেয়ার করতে পারে না। অন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না— পৃথিবীতে শুধুমাত্র বাবা কী করে তার মনের কথাগুলি বুঝে ফেলে, আর কেউ তো বুঝতে পারে না।

বাবা।

কি রে ব্যাটা?

শরীর খারাপ লাগছে বাবা।

মাথা যন্ত্রণা করছে?

হুঁ।

দেখি মাথাটা আমার কাছে নিয়ে আয়ত। জ্বর দেখি।

অন্তু মাথা এগিয়ে দিল। হাসান জ্বর দেখল। অনেক জ্বর। একজন ডাক্তার আসলেই দেখানো দরকার। হাসপাতালগুলি সারারাত খোলা থাকার কথা। শিশু-হাসপাতালে নিয়ে গেলে কেমন হয়। শিশু হাসপাতাল কোনদিকে তাও তো মনে পড়ছে না।

অন্তু বলল, বাসায় যাব বাবা।

হাসান বলল, তোর জ্বর বেড়েছে রে ব্যাটা। একজন ডাক্তার দেখিয়ে তারপর চল বাড়ি যাই। কোনটা আগে করব? ডাক্তার না আইসক্রিম?

আইসক্রিম খাব মা বাবা। আমাকে কোলে নাও।

গাড়ি চালাতে চালাতে কোলে নেব কীভাবে? তুই বরং এক কাজ কর। আমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাক্।

ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে হাসানের পৌনে বারোটা বেজে গেল। ডাক্তার কোনো ওষুধ দেয়নি। প্রথমদিনের জ্বরে কিছু বোঝা যায় না। জ্বর কমানোর জন্যে সাপোজিটরি দিয়েছে। প্রচুর তরল খাবার খেতে বলেছে।

হাসান ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে এল। সিগারেট খাবে, দেয়াশলাই নেই। রান্নাঘর থেকে দেয়াশলাই নিতে হবে।

নাজমা বলল, খবরদার এখন সিগারেট খাবে না। হাতমুখ ধুয়ে আসো, ভাত খাবে। রাত বারোটা পর্যন্ত আমি খাবার নিয়ে বসে থাকতে পারব না।

খাবারের কথায় হাসানের মনে পড়ল— লীনার বাসায় তার খাবার পাঠানোর কথা। ওরা সবাই নিশ্চয়ই না-খেয়ে অপেক্ষা করছে। খুবই ভুল হয়েছে। এত রাতে খাবারের কোনো দোকান কি খোলা আছে? পুরনো ঢাকার কিছু রেস্টুরেন্ট সারারাত খোলা থাকে। ওদের মোঘলাই খাবার খেতে ভালো।

নাজমা বলল, কী হল দাঁড়িয়ে আছ কেন? কী চিন্তা করছ?

হাসান বলল, আমাকে এখন একটু বের হতে হবে।

কোথায়?

হাসান চুপ করে আছে। সে অন্য এক বাসার জন্যে খাবার কিনতে যাবে, এটা বলা মোটেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। কী বলা যায় হাসানের মাথায় আসছে না।

কী হল, কোথায় যাবে?

জরুরি কাজ আছে—একজনকে খবর দিতে হবে।

পরিষ্কার করে বল তো। ঝেড়ে কাশো।

ঝেড়ে কাশার কিছু নেই। আমার খুবই জরুরি কাজ।

নাজমা শান্ত গলায় বলল, রাতে ফিরবে?

হাসান বলল, রাতে ফিরব মানে? রাতে কোথায় থাকব?

রাত বারোটার সময় জরুরি কাজে যাচ্ছ। দুটার সময় ফেরার চেয়ে না ফেরা ভাল না?

তুমি শুধু শুধু রাগ করছ নাজমা।

আমি মোটেই রাগ করছি না। আমি একটা সুন্দর সাজেশান দিলাম। আচ্ছা শোননা তোমার জন্যে একটা ভালো খবর আছে। ভালো খবরটা। এখন শুনবে নাকি রাত দুটার সময় যখন বাসায় ফিরবে তখন শুনবে?

ভালো খবরটা কী?

নীতুরও জ্বর এসেছে। একশ দুই।

এটা ভালো খবর ইল কীভাবে?

আমাদের অসুখবিসুখ হলে তুমি তো মনে হয় আনন্দিতই হও, এইজন্যে বলছি ভালো খবর।

হাসান সিগারেট ধরাল। খুব ক্লান্তি লাগছে। তারপরেও সে গাড়ি নিয়ে বের হল। গাড়ির তেল একেবারে শূন্যের কোঠায়। কোনো পেট্রলপাম্প থেকে তেল নিতে হবে।

ফিরোজ ঘড়ি দেখে বলল, লীনা বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। আমার তো মনে হয় না খাবার আসবে। ঘরে যা আছে তাই দিয়ে দাও। খিদে লেগেছে।

লীনা রান্নাঘরে গেল। সুলতানা বুদ্ধি করে ভাত চড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বেগুন ভাজতে বসলেন। বেসনে বেগুন ডুবিয়ে ভাজা। বেগুন বিসকিটের মতো শক্ত থাকে। ফিরোজ খুব পছন্দ করে।

সুলতানা লীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই এমন মুখ কালো করে আছিস কেন? খাবার আসেনি এই অপরাধ তো তোর না। উনি ভুলে গেছেন।

লীনা বলল, স্যার ভুলে যাবার মানুষ না। খাবার ঠিকই আসবে। সবাই যখন খেতে বসবে তখন আসবে।

সুলতানা বললেন, খেতে খেতে খাবার যদি চলে আসে তাহলে তো ভালোই। তুই রান্নাঘরে বসে আছিস কেন— যা ফিরোজের সঙ্গে গল্প কর।

আমার গল্প করতে ইচ্ছা করছে না। মাথা ধরেছে।

বেশি মাথা ধরেছে?

হুঁ।

তুই অতিরিক্ত টেনশান করিস। তোর হয়েছে আমার মতো স্বভাব টেনশান করা।

লীনা বলল, মা আমার একটা ব্যাপার নিয়ে দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। আমার ধারণা স্যার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন–গাড়ি আবার নষ্ট হয়েছে। স্যারকে

আমি বলব— এবার যেন অবশ্যি উনি একটা নতুন গাড়ি কেনেন।

বলিস।

ভাঙ্গা একটা গাড়ির মধ্যে উনি কী যে পেয়েছেন কে জানে।

ফিরোজ বীনার সঙ্গে ভূতের গল্প শুরু করেছে। বীনার খুবই বিরক্তি লাগছে। তারপরেও ভাব করছে যেন আগ্রহ নিয়ে শুনছে। সিক্স-সেভেনে পড়া মেয়েদের কাছে এই গল্প ভালো লাগতে পারে। বীনা এবছর অনার্স ফাইন্যাল দেবে। তার সাবজেক্ট ফিজিক্স। ফিজিক্সের একজন ছাত্রীর কাছে ভূতের গল্প করাটাও তো ক্রাইম।

বুঝলে বীনা, আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম প্ল্যানচেট করব। তবে নরম্যাল যে প্ল্যানচেট করা হয়–সেরকম না। একটু অন্যরকম। হিন্দুয়ানি মতে মৃত আত্মাকে আহ্বান করা। এটাকে প্ল্যানচেট বলে না বলে চক্র। গোল করে হাতের উপর হাত রেখে বসতে হয়। মানুষ লাগে বেজোড় সংখ্যক। একজনের বাঁ হাতের উপর অন্যজনের ডান হাত থাকে। সবাইকে পাক পবিত্র হয়ে বসতে হয়। শুদ্ধ মনে আত্মাকে আহ্বান করতে হয়।

বীনা বলল, ফিরোজ ভাই, খাবার দেয়া হয়েছে। খেয়ে তারপর গল্পটা শেষ করুন।

ফিরোজ বলল, খেয়ে গল্প করা যাবে না। বারোটা বাজে। আমাকে মেসে ফিরতে হবে।

তাহলে গল্পটা অন্য আরেকদিনের জন্যে ভালো থাকুক।

তুমি কি গল্পটায় ইন্টারেস্ট পাচ্ছি না?

খুবই ইন্টারেস্ট পাচ্ছি। আসুন খেতে আসুন। খেতে খেতে গল্প করুন। আপাও শুনবে। আপা আবার ভূতের গল্প খুবই পছন্দ করে।

সে কোথায়?

আপা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আপার এখনো ধারণা— তার স্যার খাবার পাঠাবে।

ফিরোজ বিরক্ত গলায় বলল, পাঠালে পাঠাবে। তার জন্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নাকি! লীনার চরিত্রের মধ্যে বাড়াবাড়ির ব্যাপার আছে। বাড়াবাড়ির ব্যাপারটা আমার পছন্দ না।

বীনা বলল, খেতে আসুন ফিরোজ ভাই। আরেকটা কথা আপার কোনো বদনাম আমার সামনে করবেন না। এটা আমি খুবই অপছন্দ করি। আপার মতো ভালো মেয়ে এই পৃথিবীতে তৈরি হয়নি। কোনোদিন হবে বলেও মনে হয় না। আপার বদনাম শুনলে এইজন্যই ভালো লাগে না।

ফিরোজ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, বাড়াবাড়ির প্রবণতা তোমার মধ্যেও আছে।

বীনা বলল, থাকুক। সব মানুষ তো একরকম হয় না। আমরা দু বোন একটু আলাদা।

ফিরোজ বলল, আমার কেন জানি খিদে মরে গেছে। খাবার সময় পার হয়ে গেলে আমি খেতে পারি না। তোমরা খেয়ে নাও আমি বরং চলি। সাড়ে বারোটায় মেসের গেট বন্ধ করে। ডাকাডাকি করে দারোয়ান ডাকতে হয়। মেসের ম্যানেজার বিরক্ত হয়।

আপনি খাবেন না?

খেতে চাচ্ছি না।

ফিরোজ ভাই আপনি অকারণে রাগ দেখাচ্ছেন। রাগ দেখাবার মতো কিছু হয়নি। আপনি না-খেলে আপা খুব কষ্ট পাবে। মা কষ্ট পাবে। আমার কিছু যাবে আসবে না। আমি সহজে কষ্ট পাই না।

ফিরোজ খেতে বসল। ফিরোজের সঙ্গে খেতে বসল বীনা। লীনা খাবে। তার হঠাৎ মাথাধরা এমন বেড়েছে যে সে মাথা তুলতে পারছে না। সে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে।

রাত একটার মতো বাজে।

সুলতানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন এবং নিচুগলায় গল্প করছেন। লীনা যখন ছোট ছিল তখন সে কী করত— সেই গল্প। লীনা চুপ করে আছে। সে মার কথা শুনে যাচ্ছে। নিজ থেকে একটা কথাও বলছে না। সুলতানা একসময় বললেন, কাজটা তুই ভুল করেছিস মা।

লীনা বলল, কী ভুল করলাম?

ফিরোজ তোকে এতবার খেতে ডাকল, তুই খেতে এলি না। বেচারা একা একা খেয়েছে।

একা তো খায় নি। বীনা সঙ্গে ছিল।

বীনার থাকা আর তোর থাকা কি এক হল?

আমার মাথা ধরেছিল মা। আমি মাথাই তুলতে পারছিলাম না।

ফিরোজ হয়তো ভেবেছে— তোর স্যার খাবার পাঠায়নি এই দুঃখে তুই খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিস।

ভাবলে ভেবেছে। আমার দুঃখ হওয়াই তো স্বাভাবিক।

কলিংবেল বাজছে। লীনা চমকে উঠল। কেউ কি এসেছে? স্যার আসেননি তো! লীনা ধড়মড় করে উঠে বসল। বীনা এসে ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাল।

সুলতানা বললেন, কে এসেছে রে?

বীনা বলল, আপার স্যার এসেছেন। একগাদা খাবার নিয়ে এসেছেন।

সুলতানা তীক্ষ্ণচোখে বড়মেয়ের দিকে তাকালেন। লীনা কাঁদছে। তার গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সুলতানার বুক ধ্বক করে উঠল। চোখে পানি আসার মতো কোনো ঘটনাতো ঘটে নি। মেয়ের চোখে পানি কেন?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress