বৃত্তের বাইরে (Britter Baire) : 09
আজ রাতটা খুব ভাল ঘুমোলেন বিজন। কদিনের প্রচণ্ড খাটাখাটুনি শেষ। শমিতের ব্যাপারটার বেশ ভালভাবে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সব কিছু অরিন্দম দত্ত বলে একজন অ্যাডভোকেটের হাতে তুলে দিয়ে এসেছেন। তাঁর নিজের লিগ্যাল অ্যাডভাইসার সুখেন্দু। কিন্তু এ ব্যাপারে সুখেন্দুর কাছে তিনি যাননি। অরিন্দমকে দিয়েও খুব মাঝে মাঝে তিনি কাজ করিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারটা অরিন্দমই যা করার করবে। শমিত এখন একরকম মুক্ত। দু-একটা পার্টি খুব হম্বিতম্বি করছিল, কিন্তু অরিন্দম সেটা সামলে নিতে পেরেছে। দিদির কাজ উপলক্ষে খুকি-টুকি উভয়েই আসছে। শমিত বাড়ির ব্যাপারে ওদের সঙ্গে বোঝাপড়া করুক। তিনি তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন— এ নিয়ে যেন অনর্থক ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে সে না যায়। দিদিরা যদি ভাগ চায়, ন্যায্য ভাগ তাদের দিতে হবে। তবে আপাতত যে বাড়ি মর্টগেজ দিয়ে সে তার ব্যবসায়ে ক্ষতির টাকাটা জোগাড় করতে বাধ্য হয়েছে, এটাও যেন সে দিদিদের বলে। এবং সবকিছু থেকে ছোটমামার নামটা তারা উহ্য রাখবে— এ প্রতিশ্রুতি আদায় করে এসেছেন। এটাতে শমিতের না হলেও রত্নার আপত্তি ছিল খুব। ‘বাঃ আপনিই সব করলেন, কাউকে কিছু বলব না! কাজেতেও আসবেন না? কেন? আমাদের এত পাপের ভাগী করে যাচ্ছেন মামাবাবু?’ তার চোখ ছলছল করছে। এ কদিনে সম্পর্কটা অনেক সহজ হয়ে গেছে, বিশেষত রত্নার সঙ্গে। বিজু তাকে হাসাবার জন্য বললেন—‘শমিতও তো কত মাস ছুপিয়ে ছিল, এ ব্যাপারটা তো অন্তত তোমার জানার কথা বউমা। আমিও কিছুদিন যে কারণেই হোক ছুপকে ছুপকে থাকতে চাইছি।’
হাসার বদলে রত্না গম্ভীর, বিষণ্ণ হয়ে গেল। তখন বিজু রায় বুঝতে পারলেন তিনি বেফাঁস বলেছেন, এবং তিনি বিজু রায়। শুধু বিজু নন। শেষে বললেন, ‘বউমা যা হবার হয়ে গেছে, অতীত নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না একদম। সবসময়ে পাপ-পাপ করবে না। আমি বিশেষ কারণে বাইরে যাচ্ছি। ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাই। তোমরা মন দিয়ে দিদির কাজ করো। আমি কাজ শেষ হলেই আবার আসব।’ শ্রাদ্ধের বাজার টাজার রত্নাকে নিয়ে অনেকটাই করে দিয়ে এলেন বিজন। পর দিনই কাজ। তিনি এবার ডুব মারবেন।
কদিন পর রাত্রে মেসে ফিরতে হরিহর একটা ভারী প্যাকেট দিল। বেশ ভারী। বলল— রফিকের লোক দিয়ে গেছে। কেমন একরকম চোখে বিজুর দিকে তাকাল হরিহর। বিজু বললেন— ‘হরিহর তোমার টাকাটা রাখো। পার্সে আলাদা করে ছহাজার টাকার একটা প্যাকেট রেখেছিলেন তিনি।
‘এত টাকা, বাবু?’
‘তুমি যে ধার দিয়েছিলে নলিনীদাকে! সুদসুদ্ধ ফেরত দিলাম।’ হতভম্ব হরিহরের চোখের সামনে দিয়ে বিজু রায় ওপরে উঠে গেলেন। কিন্তু ঘরে ঢুকে রফিকের দেওয়া প্যাকেটটা খুলে দেখে তিনি হরিহরের চেয়েও হতভম্ব হয়ে গেলেন। নলিনী করের ট্রাঙ্কের মধ্যে রেখে দিলেন প্যাকেটটা। তারপর আর দাঁড়াতে পারলেন না। ভয়ানক ঘোরাঘুরি, খাটুনি যাচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লেন। এত দিনে ভাল শীত পড়েছে। এ রকম জাঁকিয়ে শীত পড়লে তাঁর ঘুম ভাল হয়। টেনশন সত্ত্বেও।
সকালে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন। একে একে মণিময়, নিতাই ভটচাজ, চাঁদু মিত্তির আর প্রতুল বিশ্বাস এসে ঢুকলেন।
‘আরে আসুন আসুন’— খুশির গলায় বললেন বিজন।
তক্তাপোশের ওপরে বসল ওরা চারজন।
—‘কী ব্যাপার?’ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল বিজন।
মণিময় মাথা চুলকেচ্ছে।
‘কিছু বলবেন মনে হচ্ছে?’ বিজন অবাক হয়ে বললেন।
‘হ্যাঁ, মানে এ-ভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না বিজনদা!’
‘কীভাবে? কী ব্যাপার?’
‘আমরা আপনাকে জাস্ট আউট অফ কার্টসি নলিনীদার ঘরখানা দিয়েছিলুম, তার মানে এই নয় যে…’ মণিময় চুপ করে গেল।
‘কী আবার? আপনি জানেন না?’ তেরিয়া হয়ে নিতাই ভটচাজ বললেন, ‘দিনের পর দিন এখানে বসে বসে নলিনীদার টাকা আত্মসাৎ করছেন?’
‘ও।’ বিজু রায়ের ভেতরটা কেমন নিভে গেল। এ কদিন যা-ই করুন, যেখানেই যান, যত পরিশ্রমই হোক কেমন একটা চোরাস্রোতের মতো আনন্দধারা বইছিল। বইছিল যে সেটা তিনি সচেতনভাবে বুঝতে পারেননি, এখন সেটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বুঝতে পারলেন। তিনি নিজের ভাবান্তর যথাসাধ্য গোপন করে বললেন— ‘আমাকেই তো আপনারা নলিনীদার ওয়ারিস সাব্যস্ত করেছিলেন, সমবেত ভোটে। করেননি?’
‘সেটা তো ঠাট্টা, জাস্ট কার্টসি।’
‘তাই বুঝি? আমি সেটা তলিয়ে বুঝিনি। তা নলিনীদার টাকা আত্মসাৎ করছি, কে বললে?’
‘সে যে-ই বলুক, সাইমন বলে বেঁটেমতো লোকটা ঘাঘু পেনসিলার ছিল, সবাই জানে, নলিনীদা সাট্টা ফাট্টা, রেস-টেস করে জীবনধারণ করতেন। আমরা সবাই জানি।’
‘ও, জানতেন?’
‘আপনি ওরকম ব্যঙ্গ করে কথা বলছেন কেন?’ নিতাইবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন। ‘আমরা সবাই ভদ্দরলোক মশাই।’
‘আমিও কিন্তু নিজেকে ভদ্রলোক বলেই মনে করি।’
‘আমরাও করেছিলুম, এখন আর করছি না। নলিনীদার পাওনা-গণ্ডা সব ওই সাইমন আর রফিক চুকিয়ে দিয়ে গেছে। মোটা টাকা। আপনি নিঃশব্দে হজম করেছেন, তারপর থেকে আপনাকে আর ভদ্দরলোক ভাবতে ইচ্ছে করছে না।’
মণিময় বলে উঠল— ‘আহা হা হা, কী করছেন নিতাইদা, অত উত্তেজিত হলে কী করে চলে? বিজনদা আপনার কিছু বলার থাকলে নিশ্চয়ই শুনব। বলুন।’
বিজন বললেন— ‘যখন আপনারা ঠাট্টা করেই হোক, কার্টসি করেই হোক আমাকে নলিনীদার ওয়ারিস বললেন, আমি কিন্তু জিনিসটাকে গুরুত্ব দিয়েছিলুম। ঠাট্টা ভাবিনি। এখন ওয়ারিস যেমন সম্পত্তি পায়, তেমনি বকেয়া ঋণ-টিনও তাকেই মেটাতে হয়— এটা জানেন তো? তা সবচেয়ে বেশি অঙ্কের যে ঋণটা সেটা কিন্তু আমি গতকালই মিটিয়ে দিতে পেরেছি। আর উত্তরাধিকারসূত্রে যা পেয়েছি— তা-ও আপনাদের সামনে রাখছি। হরিহরকে ডাকুন, সে-ই একমাত্র সাক্ষী।’
হরিহর এসে দাঁড়াল। তার মুখে আজ একটা উদ্ধত ভাব। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মুখচোখের ভাবের এমন পরিবর্তন হতে পারে বিজন কল্পনাও করেননি। তিনি বললেন— ‘হরিহর তুমি আমাকে সাইমনের দেওয়া প্যাকেটটা দিয়েছ?’
‘হ্যাঁ, আপনি বলেছিলেন কাউকে না বলতে।’
‘কাউকে না বলতে বলিনি। সাইমন আর রফিক নামে এই লোকগুলিকে চট করে নলিনীদার মৃত্যুর খবরটা দিতে বারণ করেছিলুম।’ হরিহর গোঁজ মুখে চুপ করে রইল।
ট্রাঙ্কটা তক্তাপোশের তলা থেকে বার করে আনলেন বিজন। প্যাকেট দুটো বার করে সবাইকার মাঝখানে বিছানার ওপর রাখলেন, বললেন —‘কোনটা সাইমনের দেওয়া, কোনটা রফিকের দেওয়া বুঝতে পারছ তো?’
‘কেন পারব না!’ হরিহর গোঁজ হয়েই বলল, ‘ওই তো বালি কাগজের প্যাকেটটা সাইমন এনেছিল, আর ওই চটের ভারীটা কাল রফিক…।’
‘ঠিক আছে চিনতে পেরেছ। আচ্ছা মণিময়, তুমি কাইন্ডলি প্যাকেটগুলো খোলো তো। পাতলাটাই খোলো না হয় আগে!’
মণিময় ইতস্তত করতে লাগল। বিজন বললেন— ‘নলিনীদার ওয়ারিস তো আমি তোমরা বললেও হতে পারি না মণিময়, এক হতে পারো তোমরা সবাই, তাঁর এতদিনের প্রতিবেশী, আর হতে পারে সে যাকে তিনি দিয়ে গেছেন। খোলো, খুলে দ্যাখো।’
নিতাইবাবু সাগ্রহে বললেন, ‘আমি খুলছি।’ প্যাকেট খুলে তিনি টাকার গোছাটা বিজয়ীর মতো বার করে আনলেন। চোখ চকচক করছে।
‘ওতে পঞ্চাশ হাজার আছে। গুনে দেখুন।’ বিজন বললেন, ‘নলিনীদা সাট্টা খেলতেন। একটা রিস্ক নিয়েছিলেন পাত্তি টু পাত্তি খেলেছিলেন, পাঁচ টাকার। লাক ফেভার করল, কিন্তু মৃত্যুর পর। ওপ্নের খেলায় পাঁচ পাঁচশ হয়ে গেল। ক্লোজের খেলায় পাঁচশ ইনটু একশ হল পঞ্চাশহাজার। খুব রেয়ার লাক। কিন্তু ঘটল। আপনারা অনুধাবন করতে পারছেন নিশ্চয় ব্যাপারটা।’
সবাই চুপ। বিজন বললেন। ‘যাক পুরো সংখ্যাটা যোগ দিয়ে কী দাঁড়ায় সেটা দেখাই আমাদের উদ্দেশ্য। অন্য প্যাকেটটা খুলুন নিতাইবাবু। ওতে কত আছে…।’
নিতাইবাবু অসহিষ্ণুভাবে খুলতে লাগলেন প্যাকেটটা। বললেন, ‘ওইটুকু পাতলা প্যাকেটে যদি পঞ্চাশ হাজার ধরে থাকে, তা’লে এটাতে পাঁচ লাখ, কিংবা হয়ত তারও বেশি। … তা এটা তো আপনি ভাল করে খোলেনইনি দেখছি।’ পোস্ট অফিসের পার্সেল যেমন হয় তেমন চটের থলের ভেতর প্রচুর কুচো কাগজ, তুলে ফেলতে লাগলেন নিতাইবাবু। তারপরে তিনি হঠাৎ হিঁক করে একটা ভয়-পাওয়া আওয়াজ করে পিছিয়ে এলেন। সবাই ঝুঁকে দেখল একটা নীলচে রিভলভারের নল যেন তাঁদের দিকে তাক করে আছে।
বিজন বললেন— ‘এই হল নলিনীদার উত্তরাধিকার। পঞ্চাশ হাজার প্লাস একটি থার্টি এইট অটোম্যাটিক কোল্ট। যোগ করুন কী দাঁড়ায়। এছাড়া ঋণ ছিল হরিহরের কাছে পাঁচ হাজার। সেটা কবে নিয়েছিলেন জানি না, পুরো ছহাজার করে দিয়ে দিয়েছি কাল রাত্রে নিজেরই পকেট থেকে। কী হরিহর? দিইনি!’
হরিহরের মুখটা হঠাৎ ঝুঁকে পড়ল।
‘কী হরিহর, নলিনীদা তোমার কাছ থেকে পাঁচ হাজার ধারতেন?’ মণিময় জিজ্ঞেস করল।
‘আমাদের তো ব্যাটা চাইলে অনেক ভ্যানতাড়া করে তবে দেড়শো দুশো দিস কি না দিস। কাবলিঅলার মতো সুদ কাটিস। নলিনীদার শুকনো কাঠামোয় কী রস পেলি? যে একেবারে পাঁচ হাজার?’ নিতাই ভটচাজ খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলেন।
হরিহর গোঁজ মুখ করে বলল, ‘বাবু যে আমায় ছহাজার টাকা দিয়েছেন তার প্রমাণ কী? বাজে কথাও তো বলতে পারেন!’
‘অস্বীকার করছ না কি?’ বিজন আশ্চর্য হয়ে বললেন। আশ্চর্য হবার শক্তি মানুষের চট করে ফুরোয় না। ‘তুমি যে নলিনীদাকে পাঁচ হাজার কর্জ দিয়েছিলে তারই বা কী প্রমাণ আছে, হরিহর?’
মণিময় বলল, ‘অফ কোর্স। তারই বা কী প্রমাণ আছে? আশ্চর্য বিজনদা কোনও প্রমাণ ছাড়াই আপনি অতগুলো টাকা ব্যাটাকে গ্যাঁট গচ্চা দিয়ে দিলেন? অদ্ভুত মানুষ তো!’
বিজন বললেন, ‘কী? পঞ্চাশ হাজার প্লাস রিভলভারের যোগফলটা করতে পারলেন নিতাইবাবু?’
‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এই ব্যাটা হরিহর, তুই নিশ্চয়ই কিছু জানিস।’
হরিহর কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল— ‘রফিক মাগলার, খুব ডেঞ্জার লোক, আমি আর কিছু জানি না বাবু। সাইমন পেনছিলারের সিলিপ করবাবু বেরোবার সময়ে আমার হাতেই দিয়ে যেতেন। কিন্তু রফিকের কোনও সিলিপের কারবার ছিল না।’
মণিময় বলল, ‘বিজনদার ছহাজার টাকা গেঁড়িয়েছিস, স্রেফ মিছে কথা বলে। শিগগির যা, ফিরিয়ে দে।’
‘না না। থাক।’ বিজন বললেন, ‘নলিনীদার প্রাপ্য পঞ্চাশ হাজার কিন্তু ও নিয়ে নিতে পারত। নেয়নি। ওকে কিছু দিতে হবে না। তবে একটা কাজ করতে হবে। এটা আমরা যেমন ছিল আবার প্যাক করে দিচ্ছি। এটা ওকে ওর কাছেই রাখতে হবে।’
হরিহর একেবারে হাঁউমাউ করে উঠল। ‘না বাবু না, ট্যাকা আমি ফেরত দিয়ে দিচ্ছি, ও জিনিস আমি রাখতে পারব না। দয়া করুন বাবু।’ সে বিজনের পায়ে পড়ে গেল।
বিজন বললেন, ‘তোমাকে শাস্তি দেবার জন্যে এটা করছি না হরিহর। বুঝে দ্যাখো, নলিনীদা মারা যাওয়ায় রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ তোমার ছাড়া তো আর কারওই নেই!’
‘রফিকের সঙ্গে আমার কিচ্ছু নেই বাবু, বিশ্বাস করুন। নলিনীবাবু না থাকলে স্রেফ দরজার ওপাশ থেকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে— ‘নলিনীবাবু এলে দিয়ে দিবি, খবর্দার বেইমানি করে খুলবি না, যাঃ শালা ভাগ্।’
‘ভালই তো হল। ও আবার আসবে। তখন প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলবে, নলিনীবাবু নেই, মারা গেছেন। প্যাকেট নিয়ে যাও।’ বিজন বললেন।
‘কিন্তু যদি বলে কবে বাবু মরেছে, আগে বলিসনি কেন?’
‘বলিস, ঘুমচোখে খেয়াল ছিল না।’ মণিময় বলল।
বিজন বললেন, ‘নিজের জিনিস ফেরত পেয়ে গেলে ও আর তোমাকে বিরক্ত করবে না।’ তিনি যত্ন করে প্যাকেটটা যেমন ছিল তেমন করে রাখলেন; তারপরে হরিহরের হাতে দিয়ে বললেন— ‘যাও।’
প্যাকেট হাতে, চোখ মুছতে মুছতে হরিহর চলে গেল। মণিময় বলল, ‘ব্যাপারটা কিন্তু সত্যিই আমরা বুঝতে পারলুম না, আপনি পেরেছেন বিজনদা?’
বিজন বললেন, ‘নাঃ। স্মাগলিং-এর জিনিস যদি নলিনীদার কাছে রাখতে এসে থাকে, তো মাত্র একটা কেন? আবার হতেও পারে, ছোট স্মাগলার। হয়ত সময় সুযোগমতো ওটা বিক্রির সুবিধে পেলেই নিয়ে যেত। তখনই রাখবার মজুরি হিসেবে নলিনীদাকে কিছু পেমেন্ট করত। বুঝতে পারছি না ঠিক। আবার এ-ও হতে পারে খুনে গুণ্ডা। খুন-টুন করে অস্ত্রটা ওঁর জিম্মায় রেখে যেত। এইভাবে উঞ্ছবৃত্তি করেই পেট চালাতেন মানুষটা!’ সবাই চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর বিজন বললেন, ‘যাক, ওই পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে কী করব তার একটা নির্দেশ আমি নলিনীদার নোটবুকে পেয়েছি। উনি দাদু কাকে বলতেন, কেউ জানেন?’
‘ওই তো, পাশের বাড়ির বাচ্চাটাকে?’ দু-তিনজন বলে উঠলেন।
নোটবুকের লেখাটা মণিময়কে চেঁচিয়ে পড়তে বললেন বিজন। পড়ে মণিময় বলল, ‘বিজনদা এর থেকেই ধরলেন, নলিনীদা কিছু টাকা পেতে পারেন, না?’
‘হ্যাঁ।’ বিজন হেসে বললেন, ‘আর তা-ই দাদার মৃত্যুর খবরটা হরিহরকে চেপে রাখতে বলেছিলাম। সাইমন টের পেয়ে গেলে কি আর টাকাটা দিত? মাঝখান থেকে নলিনীদার দাদু ফাঁকে পড়ত।’
সবাই হাসতে লাগল। প্রতুলবাবু বললেন, ‘কিন্তু বিজনবাবু, অভাবের সংসারে ও পঞ্চাশ হাজার টাকা আর কদ্দিন, দেখবেন হয়ত নেশা-ভাং করেই উড়িয়ে দিল।’
‘করে নাকি? নেশা ভাং?’ বিজন বললেন।
‘কে না করে? আমি আপনি ভদ্দরলোক ছোটলোক, কে বাদ আছে নেশা করতে আজকালকার দিনে সেটাই বলুন না মশায়! কী আছে এই শালার জীবনে, স্বস্তি নেই, শান্তি সুখ নেই, আনন্দ নেই, কলুর বলদের মতো খালি ঘুরেই মরছি, ঘুরেই মরছি! নেশা কে না করে?
‘তা অবশ্য’, বিজু চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘তবে বাচ্চাটা বা তার মা তো নেশা করবারও সুযোগ পায় না। আপনাদের যদি অনুমতি থাকে তাহলে আমরা টাকাটা খাটিয়ে তার ইন্টারেস্টটা দিয়ে খুকিদের সংসারে একটু সচ্ছলতা আনতে পারি। না হয় ওরা না-ই জানল সবটা। খুকি বড় হলে এটা পাবে। কী বলেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো করাই যায়।’ মণিময় খুশি হয়ে বলল।
‘তা হলে খামটা মণিময় তোমার হেফাজতে রাখো এখন, আমি দেখছি কী করা যায়।’
‘আমার হেফাজতে কেন? বেশ তো ছিল!’
বিজন হেসে বললেন ‘তা হবে না। একবার যখন সন্দেহভাজন হয়েছি, ও টাকাটা আমি আর রাখতে পারব না। আপনারা যেখানে নিরাপদ মনে হয় রাখুন, পরে ব্যবস্থা করে আপনাদের জানালে আপনারা যদি অ্যাপ্রুভ করেন তো নিয়ে যাব।’
মণিময়ও কিছুতে নেবে না। বিজনও কিছুতেই রাখবেন না। অবশেষে বিজনই জয়ী হলেন। প্যাকেটটা নিয়ে ওরা নীচে নেমে গেল। মেসমালিক প্রফুল্লবাবুর কাছে জমা রইল জিনিসটা। তিনি রীতিমতো রসিদে সই-সাবুদ করে দিলেন।
ভাল করে চান করে, দুপুরের খাওয়াটা একা একা সারলেন বিজন। সবাই যে যার অফিস চলে গেছে। শূন্য মেসবাড়ি। বিজন তেতলার কুঠুরিতে এসে চিঠিপত্রের তাড়া খুলে বসলেন।
“মা,
বিজুর সাফল্যের খবর শুনে গর্বে আনন্দে আমার বুক ভরে যায়। খালি মনে হয় একবারটি যদি দেখতে পেতুম! বিজু, সেই ফাজিল, স্কুল পালানো, গোঁয়ার বিজু আজ এত বড় হয়ে তোমাকে এত সুখে রেখেছে, এর জন্য কী বলে কাকে ধন্যবাদ জানাব ভেবে পাই না। কারণ মা, বিজুর যতই কৃতিত্ব থাক, লাক-ফ্যাক্টর একটা থেকেই যায়। তুমি লিখেছ বিজুর সংসার, তার ছেলে মেয়ে বউ আমার দেখতে ইচ্ছে করে কি না। দুঃখ পেয়ো না মা। করে না। আমার জগতে তো ওরা ছিল না। আমি আমার সেই বাঁধাঘাটের ছাদের রোগা হাফ প্যান্ট পরা, বড়-বড় দুষ্টু ভিতু চোখ বিজুকে দেখতে চাই। তাকে আর দেখতে পাব না মা। সেই দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কাউকে দোষ দিচ্ছি না। যা ঘটবার তা সব ঘটে যায়। আর ফেরে না। আর কখনোই ফেরে না। এই না ফেরা যে কী ভয়ঙ্কর যাকে অল্পবয়স থেকে নির্মূল হয়ে আসতে হয়, সে জানে। যে দেখতে পায় না ভাই কী করে বড় হল, মা-বাবা কী করে বুড়ো হল, দাদা-দিদিরা কীভাবে আরও বড়, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ হল। সে বড় অভাগা মা। তার জীবন থেকে অনেকটা সময় চুরি হয়ে যায়। এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়। তোমার জামাই, নাতি-নাতনি ভাল আছে। নাতি-নাতনির নাম জানতে চেয়েছ? একজনের নাম স্বপ্নেন্দু, আরেকজন ঈপ্সিতা। ওই বলেই ডাকি। প্রণাম নিয়ো।’
অনেক উল্টে-পাল্টে দেখলেন বিজু, ঠিকানা তো নেইই। পোস্ট অফিসের ছাপও নেহাতই অস্পষ্ট। অনেক কষ্টে, নলিনী করের ড্রয়ার থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা বার করে জানলায় আলোর ধারে নিয়ে গিয়ে গঞ্জ শব্দটা বুঝতে পারলেন। কিন্তু এ বালিগঞ্জ বা টালিগঞ্জ না করিমগঞ্জ, না সাহেবগঞ্জ? গঞ্জ তো একটা নয়!
এই একইভাবে বয়ে যাচ্ছে ছুটকির সকল চিঠির ধারা। মায়ের অসুখের খুঁটিনাটি, সুলতা ও শিবানীর কথা, আর ছুটকির একটা প্রশান্ত আকুলতা ভাইবোনেদের জন্যে, মায়ের জন্যে, বিশেষত বিজুর জন্যে। অবশেষে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে একদিন একটা চিঠির পোস্ট-অফিসের নাম উদ্ধার করতে পারলেন বিজন। চিনসুরা। বাস, শুধু এইটুকু! এইটুকু তথ্য সম্বল করেই কি তিনি বেরিয়ে পড়বেন? বিজু ভেবে দেখলেন তিনি যখন অল্প বয়সে সৌভাগ্য খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন, তাঁর এই কুটোটুকুও সম্বল ছিল না। ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। দ্বিতীয়বার বি-কম-এ বসতে হবে, বাড়ির এই অবধারিত নিয়মে ক্ষুব্ধ হয়ে, ছুটকি ফিরে আসবে বা কোনও খবর দেবে এই রকম একটা আশাকে শেষ পর্যন্ত ছলনা, মায়া, মোহ বলে চিনতে পেরে, একদিকে বাড়ির প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণায় আরেক দিকে উপার্জন করবার, অনেক অনেক উপার্জন করবার তীব্র আকাঙক্ষায় তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন। ফল খারাপ হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, তিনি নিজেকে একজন ভাগ্যের সুনজরের মানুষ বলে চিনতে পারেন আজকাল। যখন যেটাতে হাত দিয়েছেন, সফল হয়েছেন। মনের সুখ-শান্তির কথা আলাদা। স্বতন্ত্রভাবে তা খোঁজেনওনি তিনি কোনওদিন। বিপুল পরিমাণ কর্ম ও কর্মের মোহ, মোহই তো? তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। আর একটা জিনিস তাঁর খেয়াল হল, এই দ্বিতীয়বার তিনি বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। পালিয়ে দিদির সঙ্গে দেখা হল, দিদি যাবার সময়ে তাঁকে বড় ভালবেসে ডেকে গেল। দিদির ছেলেটির হয়ত একটা সুরাহা করে দিতে পারবেন, দীপিকার সঙ্গে ভাব হল, এই মেসবাড়ির মানুষগুলির কাছে সততার অগ্নিপরীক্ষায় পাস করে গেলেন তিনি সসম্মানে, এই সমস্তই কিন্তু সাফল্য। নিঃসন্দেহে। হরিহরকে তিনি চিনতে পারেননি, সে বিশ্বাসঘাতকতার কাজটা করল। কিন্তু সাফল্যের তুলনায় এটুকু ব্যর্থতা কিছুই না। তাহলে তাঁর যে আসল লক্ষ্য, ছুটকিকে খুঁজে বার করা তাতেই বা তিনি বিফল হবেন কেন? অন্তত চেষ্টা করতে দোষ কী?
পরের দিন দশটা পনেরোর ব্যাণ্ডেল লোকালে চেপে পড়লেন বিজন। যথেষ্ট ভিড়। সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে মোটামুটি একটা সিট পেলেন। বসেই গোটা মুখটা বাইরের দিকে ফিরিয়ে বসলেন। আরও সকালের ট্রেনে যেতে পারলে বেশি নিরাপদ হতে পারতেন, কিন্তু পোস্ট অফিস খোলবার পরে তাঁকে যেতে হবে। পোস্ট অফিসই আপাতত তাঁর গন্তব্য। কেউ দেখে ফেললে একটু মুশকিল, ঠিকই। কিন্তু কী করা যাবে! এই ঝুঁকি নিয়েই তিনি কদিন আগে আটাত্তর নম্বরে সুখচর গেছেন।
একটা সাইকেল রিকশা নিলেন বাইরে বেরিয়েই।
‘কোন্ দিকে যাবেন বাবু? হুগলির দিকে যাব? না এদিকে?’ বিজু ইতস্তত করছেন দেখে রিকশাচালক বলল ‘ঠিকানাটা বলুন? দেখছি।’
বিজু বললেন, ‘পোস্ট অফিসটা কোনদিকে?’
‘কোন পোস্টাফিস? চুঁচুড়া মেন?’
বিজু বললেন— ‘হ্যাঁ।’
তাঁর ‘হ্যাঁ’-এর মধ্যে দ্বিধার ভাব টের পেতে দেরি হল না রিকশাঅলার। এসব বিষয়ে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অনুকম্পনের সঠিক ব্যাখ্যা করা এদের কাছে কিছুই না। সে বলল, ‘বাবু কি এদিকে নতুন? চলুন না চুঁচড়ো শহর ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। ডাকাতে কালী, ক্লক-টাওয়ার, জজের বাংলো, কমিশনারের বাংলো, ডাচ বাংলো, লঞ্চ ঘাট, ভূদেব মুখুজ্জের বাড়ি, অনেক দেখবার আছে এখানে। তিরিশটা টাকা দেবেন। বাস।’
বিজু বললেন—‘পোস্ট অফিস খুব দূরে!’
‘আজ্ঞে না তো! এই তো ঘড়ির মোড় পেরোলেই…’
‘ওখানেই নিয়ে চলো।’
শন শন করে হাওয়া দিচ্ছে। যদিও রোদও যথেষ্ট! হুডটা এতক্ষণে নিশ্চিন্তে খুলে দিলেন তিনি। উল্টো দিক থেকে সারে সারে সাইকেল আসছে। এখান থেকে যারা ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে তাদের অনেকেই নিশ্চয় সাইকেলে যায়। স্টেশনের বাইরে বোধহয় কোথাও সাইকেল জমা রাখে। ফেরবার সময়ে আবার নিয়ে নেয়। যারা যাচ্ছে বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। ছাত্র গোছের। মেয়েও আছে। আরও বড় চাকুরে জাতীয় লোকও আছে। যুবক তরুণ যারা যাচ্ছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বিজনের মনে হচ্ছিল এদেরই কেউ হয়ত স্বপ্নেন্দু। ছুটকির ছেলে। ছেলে কত বড়? ছেলে বড় না মেয়ে বড় এসব ছুটকি লেখেনি। যদি তার সেই বয়সের আশেপাশেই জন্মে থাকে, তা হলে স্বপ্নেন্দু আজ দিব্য-টিব্যর চেয়েও বড়, উপযুক্ত উপার্জনশীল যুবক। কিন্তু কেন কে জানে তাঁর ভাবতে ভাল লাগছে ছুটকির ছেলেমেয়ে তাঁরই চিন্টু-তিতির বয়সী। বেশি বড় নয়। ছেলেটার সবে দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে। নরম-নরম। এই রকম বয়সের ছেলের ওপর কি তাঁর দুর্বলতা আছে? এ দুর্বলতা আগে কখনও টের পাননি তো! চিন্টুকে কতদিন দেখেন না। চিন্টুটা ছোটবেলায় তাঁর ভীষণ ন্যাওটা ছিল। এখন চিন্টু কী রকম হয়েছে? কী অদ্ভুত! তিনি চিন্টুর ছেলেবেলার মুখটা আবছা আবছা মনে কতে পারলেও এখনকার মুখটা ঠিকঠাক স্মরণ করতে পারছেন না। তিতির মুখটা বরং এক একবার চমক দিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। ওরা কোনও খবর কাগজে দিল না কেন? এটা খুব অদ্ভুত! তনুশ্রী! তনুশ্রীর মুখটাও ভাল করে মনে করতে পারলেন না তিনি। কী ভাবছে ওরা? পুলিশে খবর-টবর দিয়েছে তো? নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে নেই নিশ্চয়! তবে ওদের কারও বুদ্ধির ওপরই কোনও ভরসা নেই তাঁর। তনুশ্রীটা তো একেবারে গাড়ল! আর ছেলেমেয়ে দুটো? কী পড়ছে? তা পর্যন্ত মনে করতে পারলেন না বিজু রায়। স্কুল পেরিয়ে গেছে। কলেজে তো নিশ্চয়ই! কিন্তু ঠিক কোন পর্যায়ে! জানতে হলে তাঁকে এখন এদের বয়স হিসেব করে দেখতে হয়।
রিকশাঅলা বলল, ‘পোস্ট অফিস এসে গেছে বাবু।’
বিরাট হলুদ রঙের বিল্ডিংটার সামনে নেমে ভাড়াটা মিটিয়ে দিলেন তিনি। গেট ঠেলে ঢুকলেন। অনেকগুলো কাউন্টার। বেশ সরগরম চুঁচড়ো পোস্ট অফিস। তিনি টিকিটের কাউন্টারে দাঁড়ালেন। এঁদের কাছে কী বলে খোঁজ নেবেন তিনি? ঠিকানা নেই। পদবিটা কী? সেটা পর্যন্ত তিনি জানেন না। কোনওদিন বলা হয়নি তাঁকে।
‘আচ্ছা দাদা, একটা খবর দিতে পারেন?’ বিজু রায় কপাল ঠুকে জিজ্ঞেস করলেন।
শুকনো মতো বুড়ো ভদ্রলোকটি কিছু গোনাগাঁথা করছিলেন, একটু পরে মুখ তুলে বললেন, ‘বলুন!’
‘আমাকে দশটা খাম দেবেন?’ বিজু রায়ের হঠাৎ মনে হল এটাই প্রশস্ত।
ভদ্রলোক বললেন, ‘খাম তো অতগুলো হচ্ছে না, চারটে ইনল্যান্ড দিয়ে দেব নাকি?’
‘তাই দিন।’
‘আচ্ছা কেয়া, মানে শ্রীমতী কেয়ার নামে কোনও চিঠি…’
‘কেয়া রায় তো? এই গোবিন্দ! গোবিন্দ!’ তিনি একজনকে ডাক দিলেন। পিওনের পোশাক পরা লোকটি। ‘বাঁ দিকের সর্টিং আপিসে যান এর সঙ্গে আমি বলে দিচ্ছি।’ ভদ্রলোক বললেন।
গোবিন্দর পেছন পেছন বেরিয়ে বাঁ দিকে একটি বড় ঘরে অবাক হয়ে ঢুকলেন বিজন। ভেতরে কয়েকটা বড় বড় টেবিলে বসে বেশ কয়েকজন কাজ করছেন। একদম বাঁ দিকে খোপ খোপ কাটা একটা আসবাব। চিঠিপত্র ঢোকানো হচ্ছে সেখানে।
গোবিন্দ নামধারী হেঁকে বলল— ‘কেয়া রায়ের কোনও চিঠি এসেছে কিনা খোঁজ করছেন ইনি।’
টেবিলে-বসা একজন মুখ তুলে বললেন, ‘রয়েছে দুটো। ওঁর কী হল? নিজেই তো নিয়ে যান। অসুখ-বিসুখ নাকি?’
বিজু সম্মোহিতের মতো বললেন, ‘হ্যাঁ, জ্বরে পড়ে আছেন।’
‘আপনি? লেটার অফ অথরিটি এনেছেন?’
ভদ্রলোক নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেলেন।
বিজু ভাবলেন— ‘ছুটকি নিজে আসে? এই পোস্ট অফিস থেকে নিয়ম করে এসে চিঠিপত্র নিয়ে যায়! যদি এখন, এই মুহূর্তে ছুটকি আসে? গয়নাগাঁটি পরা দোহারা চেহারার চওড়া পাড়-টাড়ের শাড়ি-পরা ছুটকি? ছুটকি কি তাঁকে চিনতে পারবে? রোগা-প্যাংলা সেই বিজুকেই ছুটকির মনে আছে। কিন্তু তিনি? ছুটকিকে দেখবামাত্র চিনতে পারবেন। তিনি ঠিক জানেন।
‘কেন? মানি-অর্ডার-টর্ডার কি রেজিস্টার্ড কিছু এসেছে না কী? সেসব দিতে হবে না। সাধারণ চিঠি যদি কিছু থাকে তো দিন না। তার জন্য আবার অথরিটি লেটার-ফেটার কী হবে?’ বিজন বললেন খুব সপ্রতিভভাবে, হেলাফেলার সঙ্গে। ভেতরে ভেতরে উল্লাসে তিনি ফেটে পড়ছেন। একেই বলে স্ট্রাইকিং পে ডার্ট। এখন শেষ রক্ষা হলেই হয়।
ভদ্রলোক নিঃশব্দে দুটো চিঠি এগিয়ে দিলেন। একটা ছাপানো পোস্ট কার্ড। কোথায় কোন সাধুর জন্মোৎসবের নিমন্ত্রণ। আরেকটা ইনল্যান্ড। পত্রপ্রেরকের নামের জায়গায় নিজের সল্ট লেকের বাড়ির ঠিকানা দেখে চমৎকৃত হয়ে গেলেন বিজু রায়। হাতের লেখাটা অচেনা। কিন্তু ঠিকানাটা তাঁরই। চিঠি দুটো নিয়ে পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটেই অদূরে দেখলেন বিরাট পাঁচিল ঘেরা বাগান। গাছে গাছ। মনে হয় সরকারি বাংলো-টাংলো হবে। নিমেতে কাঠটগরেতে মিলে একটু ছায়া করেছে। পাঁচিলের ধারে সেইখানটায় দাঁড়িয়ে ইনল্যান্ডটা খুলে ফেললেন তিনি। কোন রকম বিবেক দংশনই হল না।
“সাবিত্রীসমানেষু মা ছোটখুকু,
নিজের হাতে লেখার শক্তি নেই, তাই শিবানী আমার নার্স মেয়েটি বড় ভাল মেয়ে তাকে দিয়ে লেখাচ্ছি মা। ওরাই আমার চিঠি ফেলে। কন্যার অধিক সেবা-যত্ন করে। তোমার সেবা পাব সে ভাগ্য করে তো আসিনি মা সব কিছুই অত সহজ নয়। আমার কর্মফলে আমি ভুগছি তোমার দোষের চেয়ে বেশি দোষ আমার। পেটে ধরলেই মা হওয়া যায় না মা, তুমি তোমার ভালবাসার ডালি নিয়ে এসেছিলে মা, আমি তোমার পাপটাই দেখেছিলুম। আজ সর্বান্তঃকরণে বলে যাচ্ছি মা আমাকে মাপ কোরো আমি পাপ-পুণ্যের কিছু বুঝি না, জীবনে অনেক দেখলুম তোমাকে তোমার ছেলে-মেয়েকে আমার ছোট জামাইকে দেখবার সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল। সামনাসামনি আশীর্বাদ করবার সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল। একটু তোমায় বুকে টেনে চুমু খাবার জন্যে প্রাণটা আমার আঁকু পাঁকু করছে মা। সারা জীবনই করেছে। তোমার বাবা তোমার নাম মুখে নিয়ে স্বর্গে গেছেন। আমিও তাই যাব ছোটখুকু। তোর ঠিকানাটা মাকে কোনওদিনও দিলি না। ভালই করেছিস। আমার কর্মফল। খুকু মরতে বড় দেরি হয়ে গেল মা। যদি ফিরে আসি যেন তোর মেয়ের কোলে ফিরে আসি আবার। নাতনিকে বুকে নিয়ে মনে করিস তোর হতভাগিনী মা তোকে বুকে করছে।
ইতি, আঃ মা।”
চিঠিটা শেষ করে বিজন পাঁচিলের গায়ে হেলান দিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর হাত এত দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, পা দুটো এত শক্তিহীন, তাঁর কোথাও বসে পড়তে ইচ্ছে করছিল। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি কাঁদেননি। ঊননব্বই নব্বুই বছরের মায়ের মৃত্যুতে আটান্ন ঊনষাট বছরের ছেলের হয়ত কাঁদবার কিছু নেই। কিন্তু তিনি বড় শোকার্ত হয়েছিলেন। জীবনের সবচেয়ে বড় স্নেহের ভালবাসার বাঁধন ছিঁড়ে গেল টের পেয়ে তিনিও ভেতরে ভেতরে ছিন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু সে শোক তাঁর ভেতরেই বসবাস করছিল। আজ মফঃস্বল শহরের এক ছায়াময় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তাঁর চোখ দিয়ে ভীষণ গরম জল অনর্গল বেরোতে লাগল। এবং একবার কাঁদতে আরম্ভ করে তিনি দেখলেন তিনি কিছুতেই কান্না থামাতে পারছেন না। গোঙানির মতো শোকের হাহাকার বেরিয়ে আসছে। বুক ব্যথা করছে তাকে মুক্তি দিতে না পারলে।
‘আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? পেছন থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করল। ‘বুকে ব্যথা?’ আরেকজন।
কী বলবেন তিনি? চোখের জলে সমস্ত ঝাপসা দেখছেন। কোনওমতে চিঠিটা দেখিয়ে বললেন, ‘মায়ের… মৃত্যু সংবাদ…।’
‘আমরা কি আপনাকে একটু ধরব? একটু কোথাও বিশ্রাম করবেন? জল খাবেন?’
‘না, এখুনি সামলে যাব।’ এবার একটু স্পষ্ট করে বললেন বিজু রায়। রুমাল বার করে চোখ মুখ ভাল করে মুছলেন। কার্ডের চিঠিটাতে দেখলেন ঠিকানা লেখা রয়েছে স্পষ্ট অক্ষরে।
একটা খালি রিকশা যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি সেটা ধরে ঠিকানাটা বললেন তিনি। খুব লজ্জা পেয়েছেন। কত জনে তাঁকে এভাবে বেসামাল অবস্থায় দেখল কে জানে! কী দেখল? একটা আধবুড়ো লোক গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। প্রকাশ্য রাস্তায়। কিন্তু তিনি তো এভাবে নিজেকে দেখেন না! দেখছেন না আর। তিনি তো আসলে বিজন, বিজু। একটা কুড়ি-একুশ বছরের ছেলে, গালে অল্প কুচো দাড়ি। এখনও ক্ষুর পড়েনি। যেসব বন্ধুর তাড়াতাড়ি দাড়ি গজিয়েছে তারা বলত— মাকুন্দ। সেই বিজু একেবারে কাঁচা, যার সদ্য ভগ্নীবিয়োগ হয়েছে, সে একরকম আত্মবিয়োগও তো বটে! মা বাবা দাদা দিদি সবাইকে ছেড়ে অচেনা-অজানা দুনিয়ার পথে একলা যাত্রী। বিজন।
মায়ের চিঠিটাতে তারিখ তেসরা অক্টোবরের। মা শিবানীকে দিয়ে চিঠি লিখিয়েছে। এতকাল পরে সেই চিঠি! পোস্টের গণ্ডগোল! এইরকম! অক্টোবরের চিঠি আসতে আসতে বছর ফুরিয়ে গেল? তিনি আবার পোস্টের ছাপটা পরীক্ষা করতে লাগলেন, পোস্ট করবার তারিখটা ভালই পড়া যাচ্ছে। সতেরো, বারো, বিরানব্বই। তার মানে? এ চিঠি মা শিবানীকে পোস্ট করতে দিয়েছিল। পোস্ট হয়েছে সতেরো বারোয়। মানে প্রায় আড়াই মাস পরে? আরে! বিজনের মনে পড়ল তেসরা রাত থেকেই মায়ের বুকের কষ্টটা শুরু হয়। তারপর দুটো দিন আর নিঃশ্বাস ফেলবার ফুরসত ছিল না। শিবানীর তো নিশ্চয়ই ছিল না। মা মারা গেল, কাজের দিন অবধি শিবানী ছিল। তার পরেই বোধহয় মাইনে চুকিয়ে দিয়েছিলেন। চলে গেল চোখের জল মুছতে মুছতে। শিবানী কি ভুলে গিয়েছিল চিঠি ফেলতে? তার ব্যাগেই পড়েছিল চিঠিটা এতদিন! না কি বিজুর ভাগ্যই তাকে ভুলিয়ে রেখেছিল, তাকে দিয়ে পোস্ট করিয়েছিল ওই সতেরো বারো তারিখে যাতে বিজু পায়, বিজু হদিশ পায়। মায়েরও। ছুটকিরও।
রিকশাঅলা বলল, ‘এ তো অনেক দূর। নতুন সব ঘরবাড়ি হয়েছে এদিকে। জলা-জঙ্গল ছিল বাবু। ওসব মিউনিসিপ্যাল এরিয়া নয়। পঞ্চায়েতের। তবে সুন্দর সুন্দর বাড়ি উঠেছে আজ্ঞে। একতলা, দোতলা স্টেশন থেকে কাছে পড়বে।’
দূর থেকে পাড়াটা চোখে পড়ল। স্টেশন রোড থেকে ডাইনে নেমে যেতে হবে। একসার দোকান। তারপর মাটির রাস্তা। উঁচু দোতলা বাড়ি। ছকোনা জলের ট্যাঙ্ক। আরও বাড়ি রয়েছে। এদিক ওদিক। তারাও সুন্দর। কিন্তু এটি যেন সগর্বে মাথা তুলে আছে। রিকশাঅলা বলল, ‘বাতিঘর। ওই বাড়িই আমাদের নিশানা বাবু।’
চমৎকার বাড়িটি। ঢালু টালির ছাদ। এগুলো আসলে টালি নয়। সিমেন্ট জমিয়ে ওইভাবে করা। আজকাল করে। ফিকে লাইল্যাক রং বাড়িটাতে। জানলা-দরজাগুলো বন্ধ। ঘিয়ে রঙের। কার্নিসেও মেটে লাল রং। বাড়ির পাশ দিয়ে একতলার জমি থেকে দোতলার ছাদ বেয়ে ট্যাঙ্কের পাশে পর্যন্ত উঠে গেছে চমৎকার ঝিরিঝিরি লতা। ফুল নেই। কিন্তু লতাটিরই বাহার খুব। আশেপাশে অল্পস্বল্প জমি। রিকশাঅলা বাড়িটার কাছাকাছি হতে বিজন অবাক হয়ে দেখলেন— এই ঠিকানাই। “বাতিঘর”। নামটা দেওয়া নেই। কিন্তু ঠিকানা এটাই। তাই তো! তিনি অবাক হচ্ছিলেন কেন? বাতিঘর! অথই জলে নিরুদ্দেশ, কূলহারানো নাবিক ওই বাতিঘর দেখেই তো ভরসায় ফিরবে!
তিনি নেমে আগে রিকশাটিকে বিদায় করলেন। এখন অনেক চমক, চেনাচেনি, জানাজানি। অনেক অপ্রস্তুত নীরবতা। হিল্লোলিত আনন্দ। বাইরের কেউ সাক্ষী না থাকে। তিনি সন্তর্পণে বেলটা একবার বাজিয়েই হাত নামিয়ে নিলেন।
বাড়ির ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বেলের আওয়াজ। নিবিষ্টমনে শুনছে বিজু। দরজা খুলে গেল। বেগুনি পাড় একটা সাদাসিধে শাড়ি পরা রোগামত মহিলা দরজা খুলে দিলেন। অনেক কালো চুলের মধ্যে অনেক সাদা চুল। কপালের ওপর দুটো সমান্তরাল রেখা। আনুভূমিক। ছোট্ট নাক, ঢেউ খেলানো ঠোঁট। মাজা কালো রঙের এক পাতলা মিষ্টি প্রৌঢ়া। বিজন হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে।
‘কাকে চান?’ কোনও কথা বলতে পারছে না বিজন। হাঁ করে দেখছে, সে যেন মিলিয়ে যাবে এখুনি ওই সাদা-কালো চুলের ঢালে, ওই বড় বড় পল্লব ঘেরা চেরা চোখের সাদায়, ওই ছোট্ট নাকটিতে।
‘কাকে চান?’
বিজন বলল, ‘ছুটকি, আমি বিজু রে!’
প্রৌঢ়া তার দিকে তাকিয়ে যেন পাথরের প্রতিমা হয়ে গেলেন। অনেক, অনেকক্ষণ পরে বিজন বলল, ‘তোর বাড়িতে আমায় ঢুকতে দিবি না? ছুটকি?’
নীরবে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন প্রৌঢ়া।
বিজন ঢুকল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। একটা মস্ত চৌকো দালান। কয়েকটা চমৎকার বেতের সোফা সাজানো, কয়েকটা মোড়া। দালানের ওদিক থেকে দোতলার সিঁড়ি উঠে গেছে। চকচকে পেতলের পাত দিয়ে মোড়া তার ওপরটা। যতটা দেখা যায়, ওপর থেকে একটা পেতলের পাত্র থেকে অর্কিড ঝুলে রয়েছে।
‘বসতে বলবি না, ছুটকি?’
‘বোস’—বোজা গলায় প্রৌঢ়া বললেন।
‘তুই বসবি না?’
দূর থেকে একটা মোড়া টেনে এনে বসলেন প্রৌঢ়া।
‘ছুটকি, তুই খুশি হোসনি?’
প্রৌঢ়া দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললেন। আঙুলের ফাঁক দিয়ে জল গলছে। দু হাতের ঢাকার মধ্যে মুখটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বিজন বুঝল এ কোনও প্রৌঢ়া নয়, ঊনষাট বছরের। এ সেই কুড়ি একুশ বছরের তরুণী, যে তার মা-বাবা- দাদা-দিদি বিশেষত যমজ ভাই বিজুকে সাংঘাতিক ভালবাসত, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আরও বেশি ভালবেসে ফেলেছিল এমন একজনকে যাকে তার ভালবাসা উচিত নয় আদৌ। স্বাভাবিকও নয়। বয়সে অনেক বড়, সম্মানে ঐশ্বর্যেও অনেক অনেক বড়, ভিন্ন জাত। যাকে বলে ছোট জাত এবং বিবাহিত। অমোঘভাবে বিবাহিত। একটা সন্তানের জনক। বিজু আজও তাঁর নাম জানে না। পরিচয় জানে না। তার বাড়ির লোকেও জানত কি না সন্দেহ। ছুটকি জানত কেউ মেনে নেবে না। কেউ ক্ষমা করবে না। তাই ছোট্ট একটা চিঠি লিখে রেখে চলে গিয়েছিল। সে লিখে গিয়েছিল— তার ভালবাসার মানুষটির বয়স চল্লিশের ওপর, তিনি ষোলো সতের বছরের একটি পুত্রের পিতা। বিশাল ধনী। কিন্তু তিনি খুবই অসুখী। ছুটকিতেই তার সব সুখ। তিনি ছুটকিকেই বিয়ে করবেন। মা-বাবা যদি মেনে নেন এ ভালবাসা, যদি ক্ষমা করেন, তাহলে তার নির্দেশক হিসেবে অন্তত একমাস যেন প্রতিদিন তার হলুদ কালো খড়কে ডুরে শাড়িটা ছাদে মেলে রাখেন। সে তখন স্বামীর সঙ্গে এসে সবাইকে প্রণাম করে যাবে।
স্তম্ভিত পরিবারের সবাই। বজ্রাহত। কখনও এমন ঘটে, ঘটতে পারে কেউ ভাবেনি পর্যন্ত। কে এ লোক? কোথায় এর সঙ্গে পরিচয় ছুটকির? চল্লিশ বছুরে। বাড়িতে বউ ছেলে মেয়ে সব আছে! তাকে ছুটকি! ছি, ছি, ছি! প্রথমে ঠিক হল ছুটকি যেমন বলেছে তেমনি হবে। হলদে-কালো ডুরে শাড়িটা ছাদে মেলে রাখা হবে। ছুটকি আসবে, তারপর তাকে ঘরে আটকে রাখা হবে। চোরের মার দেওয়া হবে। আর সেই লোকটিকে? সে যদি আসে? আসবেই। ছুটকি একা আসবে না। বিরাট ধনী যে! নাকি কোটিপতি! তাকে অত সহজে মার খাওয়ানো যাবে? রাইটার্সের ছাপোষা কেরানি বঙ্কুবিহারীবাবুর দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে ভাবতে গিয়ে। এমন সময় মা ছুটে গিয়ে সেই হলুদ-কালো খড়কে ডুরে শাড়িটা এনে উঠোনের মাঝখানে স্রেফ দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে সেটাকে কুটি-কুটি করে ফেলল। বলল, ‘ওর নাম আর কেউ তোমরা আমার সাক্ষাতে উচ্চারণ করবে না। ও মরে গেছে। মরে গেছে ধরে নাও।’ মায়ের চোখ-মুখ ভয়ঙ্কর। পাগলিনীর মতো।
ছুটকির মুখ থেকে হাত সরে গেছে। চোখ বোজা। সে বুকের কাছটা আঁকড়ে ধরেছে। ভিজে মুখ এখন মড়ার মতো ফ্যাকাশে, ভেতরের যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। বিজু বুঝতে পারল ছুটকি এখন তার সেই পাওনা মারটা খাচ্ছে। সেই চোরের ঠ্যাঙানি যা দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনবার কথা ভাবা হয়েছিল।
‘ছুটকি! তোর বড় কষ্ট হচ্ছে?’ কুড়ি বছরের তরুণ বিজু এখন। তার গলা বুজে যাচ্ছে।
প্রাণপণে নিজেকে সংবরণ করে ছুটকি বলল, ‘তুই কী করে এলি?’
বিজন হেসে বলল— ‘আমি বিজু, যা অন্যে পারে না, তা পারি। এই নে তোর চিঠি। মায়ের চিঠিটা খুলে পড়েছি। তার জন্য যা শাস্তি ইচ্ছে হয় দিস।’
চিঠি দুটো নিল ছুটকি। মায়ের চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে সে প্রাণপণে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে বুঝতে পারে বিজু। কিন্তু পারছে না, ছুটকি পারছে না। সে বসে বসে টলছে। যেন তার ভার্টাইগো হয়েছে। বিজু উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ধরল। কতদিন পরে সেই প্রিয় স্পর্শ। বিজন উপবিষ্ট ছুটকির মাথাটা নিজের কোলের মধ্যে নিল। ছুটকি বলল, ‘কেন এলি, বিজু, কেন এলি?’ তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে একরকম দৌড়ে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন আবার এসে দাঁড়াল বিজু দেখল চোখ মুখ সে ভাল করে ধুয়ে এসেছে। কিন্তু মুখটা ফুলে গেছে। সে বলল, ‘আমাদের গত সাতাশে অক্টোবর আটান্ন পার হয়ে ঊনষাট হল। ভুল করিসনি ছুটকি, এখন আর মান-অভিমানের দিন নেই। জামাইবাবু কোথায়? তুই ডাকবি না আমি যাব?’
‘নেই রে।’
তখন ছুটকির পোশাকের দিকে তার চোখ পড়ল। মাথায় সিঁদূর নেই। হাতে কিচ্ছু নেই। সাদা, সরু পাড় শাড়ি। বিজু মুখ নিচু করল, তারপর একটু পরে বলল ‘এ জীবনে দেখা হল না, আমার দুর্ভাগ্য, ছুটকি, ছেলেমেয়েরা কোথায়?’
‘নেই, বিজু।’
‘মানে? কোথায়?’
‘নেই। কোনওদিন ছিল না।’
‘স্বপ্নেন্দু, ঈপ্সিতা… মাকে লিখেছিস যে!’
‘ভোলাতে।’
আশ্চর্য হয়ে বিজু বলল, ‘ভোলাবার কী আছে? জামাইবাবুর চলে যাওয়ার খবর দিসনি ভালই করেছিস। কিন্তু ছেলে মেয়ে না হওয়া— এমন কী ব্যাপার, যে বানিয়ে বলতে হবে?’
ছুটকি চুপ করে রইল।
বিজু বলল, ‘আজ কিন্তু তোর বাড়িতে থাকব, নড়ছি না এখান থেকে সহজে। তোর হাতে খাব।’
‘তা হয় না বিজু!’
‘সে কী? আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছিস?’
তখন ছুটকি মুখ নিচু করে বলল, ‘বিজু, এ আমার বাড়ি নয় ভাই, আমি এ বাড়ির রাঁধুনি।’