Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বৃত্তের বাইরে || Bani Basu » Page 12

বৃত্তের বাইরে || Bani Basu

রাত্তির প্রায় দশটার কাছাকাছি। পথঘাট সুনসান। শীতের হিম-কুয়াশায় পথ-আলোর পেছনে বাড়িগুলো জলের তলার ছবি বলে মনে হয়। রায়-ভবনের বিরাট গ্রে হাউন্ড কঙ্ক পল্লী বিদীর্ণ করে চিৎকার করে উঠল। বাগানের পেছনের কোণ থেকে সে জকিবিহীন রেসের ঘোড়ার মতো অপরূপ তীব্র ভঙ্গিতে দৌড়ে আসছে। দৌড়ে আসছে। কঙ্ক বাগানময় ঘোরাফেরা করে। পেছনের কুকুর-ঘরে ঘুমোয়। তাকে বড় একটা বাড়ির ভেতরে ঘুরতে দেওয়া হয় না। সারারাত সে রায়-ভবনের গোটা খোলা এলাকাময় ঘোরে। বিরজু ঘুমিয়ে পড়লেও কঙ্ক আছে। কঙ্ক আছে। বিজু রায়ের পায়ের কাছে এসে সে পেছনের পা ছড়িয়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল, গরররর, গরররর করছে এখন, লেজটা বিদ্যুদ্বেগে নড়ছে, ডাইনে-বাঁয়ে। সে যেন তার মালিককে প্রণাম করছে, কিংবা জানাচ্ছে তার আকুল অভিমান। নিচু হয়ে তার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিলেন বিজু রায়, মৃদু গলায় বললেন—‘ঠিক আছে, ঠিক আছে কঙ্ক। সব ঠিক হ্যায়।’ বিরজু এসে সেলাম করে দাঁড়াল। বীরখা ঘুম ভেঙে ছুটে আসছে। কঙ্ক ছুটে যাচ্ছে ওপরে। দু-চার সিঁড়ি উঠছে আর পেছন ফিরে ফিরে দেখছে তার ইউলিসিস আসছে কি না। বিজু উঠছেন। ধীরে ধীরে। তাঁর পায়ে অদ্ভুত জড়তা, অনেক দিন আগে যখন নিরুদ্দিষ্ট পুত্র বাড়ি ফিরেছিলেন তার চেয়েও দ্বিধাগ্রস্ত, এ যেন অন্যের বাড়ি। কিংবা বলা যায় ভীষণ দুষ্টু ছেলের লজ্জা তাঁকে পেয়ে বসেছে। তবু তিনি উঠে যাচ্ছেন এবং উঠতে উঠতে সাহস সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। যা করতেই হবে তা করাই ভাল। বিজু রায় উঠছেন, মাঝখানে সামান্য ফাঁক রেখে তাঁর পেছন পেছন নিঃশব্দে সিঁড়ি উঠতে থাকছে নীল জীনস্‌-এর একজোড়া পা, একবুক ধূসর উলের সোয়েটার। কালো চশমা এখন মাথায়। সিঁড়ির প্রথম ল্যান্ডিং পর্যন্ত উঠে বিজু রায় আস্তে পেছন ফিরে তাকালেন, চকমকে চোখে হেসে বললেন—‘তাহলে টিকটিকি মশাই! আপনি ধরে ফেলবার আগেই যদি হারানিধি ফিরে এল তো পুরস্কারটা আপনি পান কেমন করে?’

নীল জীনস চট করে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল—‘আমি টিকটিকি নই তো মেসোমশাই! আমি তিতির বন্ধু অর্জুন। সকালে কলেজে আসতে আপনাকে চুঁচড়ো পোস্ট অফিসের কাছে ডিস্ট্রিক্ট জাজের বাংলোর গাছের তলায় দেখতে পেয়ে গেলুম দৈবাৎ। তখন থেকেই…’

—‘দৈবাৎ!’ বিজু রায় হেসে উঠলেন, ‘তবে তো তুমি কামালই করেছ হে!’ একেবারে দৈবাৎই না কি?

ওরা আওয়াজ পেয়েছে। কঙ্কর। বিজুর। ওরা ছুটে আসছে। ঘাউ ঘাউ করতে করতে আসছে কঙ্ক। পেছন পেছন চিন্টু, তিতি, প্রমীলা, বদন। একদম শেষে, পা টেনে টেনে ফ্যাকাশে, মড়ার মতো মুখে তনুশ্রী।

চিন্টু বলল—‘ড্যাড, ড্যাড, ড্যাড এসে গেছে। ওহ্ ড্যাড! ওহ্‌ মাই ড্যাড্‌ড! ওহ্ হো!’ সে চোখের জল ভেতরে পাঠাবার প্রবল চেষ্টায় ক্রমাগত মাথাটা ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে পেছনে হেলাচ্ছে। বিজু ডান হাতটা বাড়িয়ে—তাকে আলিঙ্গন করে ধরলেন। বললেন—‘দেয়ার দেয়ার দ্যাটস অল রাইট মাই বয়, অল রাইট।’ চিন্টু মুখ ঢেকে ফেলল। তিতির মুখে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি, সে তার লম্বা কালো স্কার্ট আর পাতলা সাদা উলের ব্লাউজ পরে বাবার বুকের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার চুলগুলোয় আদর করতে করতে বিজু বললেন—‘তুই যদি চাস তোকে ওই ছেলেটার সঙ্গেই বিয়ে দেব। দেখিস!’

—‘কোন ছেলেটা?’ তিতি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

বিজু তার মাথাটা পরম মমতায় বুকের ওপর চেপে ধরে বললেন—‘ওই যে তোর ঘরে টিভি-র ওপর যার ছবি যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছিস?’

তিতি বাবার বুক থেকে মাথাটা একটু তুলে হেসে উঠল, বলল—‘সে কী? ও তো সুকান্ত! আমাদের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য! কোন কালে মারা গেছেন!’

বিজু ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে হার-না-মানা জেদের সঙ্গে বললেন—‘তাই বুঝি? তবে এই অর্জুন, এটাকেই… !’

—‘দূর!’ তিতি আরও জোরে হেসে উঠল—‘ও তো ভাই! চুঁচড়োর মঞ্জুর ছেলে।’

খুব মৃদু গলায় অর্জুন বলল—‘যেমন ছুটকির আপনি!’ বিজু চমকে উঠলেন। তার সঙ্গে চোখাচোখি হল।

তারপর বিজু রায় অশান্ত বালকের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। প্রমীলা লজ্জা-লজ্জা মুখ করে, মাথায় কাপড় টেনে বলল—‘বউদি যে ওদিকে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন!’

চিন্টু হই-হই করে বাবার হাত ধরে মায়ের ঘরের দিকে যেতে চাইছিল। তিতি চোখের ইশারায় তাকে থামতে বলল। পোশাক পরা এবং না-পরা মেয়ে ব্যাপারটার সঙ্গে তার পরিচয় থাকলেও একজন প্রোষিতভর্তৃকা নারী আর বিরহী পুরুষের মাঝখানে তার ভূমিকা কী হওয়া উচিত দেখা গেল তিতি তার চেয়ে ভাল জানে।

একা-একা ঘরে ঢুকে বিজু দেখলেন বিছানার সঙ্গে মিশে কালো, রোগা তনুশ্রী একটা আধময়লা শাড়ি পরে শুয়ে আছেন। চোখ বোজা। তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু হয়ে তনুশ্রীর বাঁ গালে একটা চুমো দিলেন, বললেন—‘এ কী করেছ? কী হয়েছে তোমার? ছি ছি ছি!’ তনুশ্রী কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন—‘আমি… আমি তোমার যোগ্য নই জানি… কিন্তু তোমায় ভালবাসি… তুমি যা বলবে তাই হবে। যা শাস্তি দেবে তাই মাথা পেতে নেব।’

—‘শাস্তি?’ বিজু অবাক হয়ে বললেন, ‘শাস্তি-ফাস্তির কথা উঠছে কেন? যোগ্যতা-অযোগ্যতারই বা কী হল?’ তারপর বললেন—‘আমি… আমিও তোমায়…’ তিনি তনুশ্রীর ডান গালে একটা চুমো দিলেন।

বাইরে থেকে চিন্টু হেঁকে বলল—‘ড্যাড, বসাক কাকা আর শর্মাজি আসছেন।’

‘এসো’—তিনি তনুশ্রীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন।

তনুশ্রী মড়ার মতো ফ্যাকাশে হয়ে প্রায় মৃত গলায় বললেন—‘তুমি যাও, আমি আর পারছি না গো!’

বিজু বললেন—‘তুমি যে গৃহিণী, হোস্টেস। চলো, আমি তোমায় ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি।’

শর্মাজি বললেন—‘আধঘণ্টা আগে ‘রক্সি’ আমায় ফোন করে জানাল বি. বি. রায় হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে তাঁর বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। বসাক বসেছিল। নিয়ে চলে এলাম।’

বসাক দেখল স্বাস্থ্যল, সুঠাম বি. বি. রায় ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে এক মলিন মুখ শ্রীহীন, ক্ষীণদেহ নারীকে নিয়ে আসছেন। তার ভাবীকে চিনতে শরদিন্দু বসাকের খুবই কষ্ট হল। সে বলল—‘কংগ্র্যাচুলেশনস ভাবী। আমরা সব খবরই রাখি বিজুদা, খবর কাকের মুখে ছড়ায়। জানেন তো? তা রিটার্ন অফ দা প্রডিগ্যাল হাজব্যান্ড সেলিব্রেট করার বন্দোবস্ত করতে হয় তো!’

ভাবীর দিকে সে চোখের কোণ দিয়ে তাকাল। এই শ্রীহীন ম্যাড়মেড়ে নারীকে বসাক চায় না। কোনওদিনই চাইবে না আর।

শর্মাজি বললেন—‘রয় তুমি দেখালে বটে! হোয়াটস দা বিগ আইডিয়া?’

বিজু হেসে বললেন—‘মে বি, জাস্ট টু সি হু ইজ এ ফ্রেন্ড অ্যান্ড হু ইজ্‌ন্‌ট্‌?’

শর্মাজি বললেন—‘থ্যাংক গড, আমি সে পরীক্ষায় বোধহয় পাশ করে গেছি।’

চকচকে সাদা কনটেসাটা বড্ড বড়। দিল্লি রোড, জি. টি. রোড কোথাও তাতেও খুব অসুবিধে হয়নি। চুঁচুড়া স্টেশনের তলার জল-ভরা গাড্ডায় ঝপাং করে বসে পড়েছিল। অনেক কষ্টে-সৃষ্টে উঠল। এখন স্টেশন রোড দিয়ে মসৃণভাবে ভেসে চলেছে। বিজন নিজে চালাচ্ছেন। তাঁর পাশে অর্জুন, পেছনে তিতি। বিজু এদের আনতে চাননি। তিনি জানেন তাঁর আর ছুটকির মধ্যে নির্জনতার প্রয়োজন এখনও ফুরোয়নি। কিন্তু তিতি তাঁকে বুঝিয়েছে—‘পিসিমণি আমাদের দেখলে বুঝতে পারবে, শুধু তুমি নও, আমরা সবাই মিলে তাকে কত চাইছি। মাকেও আনা দরকার ছিল। কিন্তু মার শরীরের যা অবস্থা!’

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বাড়িটা। বাতিঘর। মেটে লাল টালি দৃশ্যমান হচ্ছে ক্রমে। মাটি থেকে দোতলার ছাদ পেরিয়ে তরুলতার ঝিরিঝিরি সবুজ। এখন রোদে ম ম করছে চারদিক। নতুন রং করা নতুন বাড়ি সেই রোদ মেখে হাসছে। বিজনের বুক শিরশির করছে বাড়িটা দেখে। কোনও একটা মুহূর্তে বাড়িটাকে দম বন্ধ করা কারাগার মনে হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে একটুকরো স্বর্গ। ওই ঘিয়ে রঙের দরজা খুলে ছুটকি আসবে। তাঁর হারিয়ে-যাওয়া অর্ধাঙ্গিনী। থোকা থোকা চুল উড়বে। চোখের তারায় ঝিলিক। ঠোঁটের হাসিতে স্বপ্ন। ফ্রকের ঘের উড়বে, শাড়ির আঁচল উড়বে। হলুদ-কালো খড়কে ডুরে। তারপর আনন্দ। আনন্দ। পূর্ণ। পূর্ণ সব। যে জীবন এতদিন প্রতিবন্ধী ছিল, সে তার হাত-পা-মস্তিষ্ক সব ফিরে পেয়ে ভাগ্য-বিধাতার জয়গান গাইবে। প্রকৃতপক্ষে, জীবনের হাত থেকে যে তাঁর এত পাওনা ছিল, এত, বিজু রায় কোনওদিন আশাও করেননি। তাঁর অনেক অক্ষমতা, অনেক ত্রুটি, কিন্তু বড় ভাগ্যবান মানুষ তিনি— স্বীকার করতেই হয়।

‘তোরা বোস’—বলে একলা নামলেন তিনি। বেল বাজালেন। ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শব্দটা। ঠিক সেদিনের মতো। একটু পরে দরজা খুলে গেল। একটি তরুণ। এরা এসে গেছে তাহলে? ভালই হল।

বিজু বললেন—‘কেয়া রায়কে ডেকে দিন! আপনাদের বামুন মা।’

—‘আপনার নাম কি বিজনবিহারী রায়?’ তাঁকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে তরুণটি জিজ্ঞেস করল।

—‘হ্যাঁ।’

—‘ও, একটু দাঁড়ান।’ সে ভেতরে চলে গেল। একটু পরেই একটা লম্বা সাদা মুখ আঁটা খাম নিয়ে ফিরে এল। বলল—‘বামুন মা কালই চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। আপনি আসলে এই চিঠিটা দিয়ে দিতে বলেছে।’

তরুণ খামটা বাড়িয়ে দিতে দিতে সসম্ভ্রমে বিজুর দিকে চাইল। কনটেসাটার দিকে তাকাল দ্বিগুণ সম্ভ্রমে। ভেতরে উপবিষ্ট অর্জুন আর তিতির দিকেও পাঠাল তার কৌতূহলী দৃষ্টি। তারপরে একটু ইতস্তত করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। স্খলিত পায়ে বিজন ফিরে এলেন। পেছনের দরজা খুলে, কোনওমতে সিটের ওপর নিজের শরীরটাকে ফেলে দিলেন। চোখ বুজলেন।

তিতি বলল—‘কী হল বাবা? পিসিমণি কই?’

বিজন শুধু মাথা নাড়তে লাগলেন। নেই, নেই, ছুটকি নেই।

—‘নেই?’ তিতি হতাশ গলায় বলল।

—‘ছুটকি কোথায়? কী বলল ওই ছেলেটি?’ অর্জুন জিজ্ঞেস করল—‘চিঠি দিল না একটা? নিশ্চয়ই কোনও কারণে… চিঠিতে লিখে গেছেন নিশ্চয়ই!’

চিঠিটা তিতির দিকে শক্তিহীন হাতে বাড়িয়ে দিলেন বিজু রায়। শুকনো, তেষ্টা-পাওয়া গলায় বললেন—‘তুই পড়।’

বেশ মোটা চিঠি। মুখটা ছিঁড়ে উল্টো করে ধরতেই ভেতর থেকে ঠুক করে কী একটা পড়ে গেল। তিতি নিচু হয়ে দেখল চিকচিক করছে। তুলে ধরল। একটা সোনার হার। মা দিয়েছিল ছুটকিকে। মায়ের শেষ আশীর্বাদ। মেয়ের প্রতি মায়ের ভালবাসা যা সমস্ত সম্পর্কের ধ্রুবপদ, সেই জিনিস ফিরিয়ে নেবার অনপনেয় অপরাধের জন্য ব্যাকুল ক্ষমা প্রার্থনা, অন্তর্দাহ। ক্ষরিত রক্তবিন্দু স্নেহবিন্দু সব স্বর্ণবিন্দু হয়ে জ্বলছে। ছুটকি ফিরিয়ে দিয়েছে। তিতি চিঠি মেলে ধরল। পরপর কাগজগুলো সাজাচ্ছে। তারপর অবাক হয়ে বলল—‘এ কী?’

খামের ভেতরে কয়েকটা ধবধবে শাদা পাতা খালি। একেবারে শূন্য।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
Pages ( 12 of 12 ): « পূর্ববর্তী1 ... 1011 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress