Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বীরবলের হালখাতা || Pramatha Chaudhuri » Page 10

বীরবলের হালখাতা || Pramatha Chaudhuri

ফরাসি সাহিত্যের বর্ণপরিচয়

রামমোহন লাইব্রেরিতে পঠিত

আমি আপনাদের সুমুখে ফরাসি সাহিত্য সম্বন্ধে বক্তৃতা করতে প্রস্তুত হয়েছি, এ সংবাদ শুনে আমার কোনো শুভার্থী বন্ধু অতিশয় ব্যতিব্যস্তভাবে আমার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন যে, ‘তুমি ফরাসি সাহিত্য সম্বন্ধে এত কম জানো যে, আমি ভেবে পাচ্ছি নে কি ভরসায় তুমি এ কাজ করতে উদ্যত হয়েছ।‘ আমি উত্তর করি, এই ভরসায় যে, আমার শ্রোতৃমণ্ডলী এ বিষয়ে আমার চাইতেও কম জানেন।

এ কথা স্বীকার করতে আমি কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নই যে, ফরাসি সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় অতি যৎসামান্য; কেননা সে সাহিত্য এত বিপুল ও এত বিস্তৃত যে, তার সম্যক্ পরিচয় লাভ করতে একটি পুরো জীবন কেটে যায়। খৃস্টীয় একাদশ শতাব্দী হতে আরম্ভ করে অদ্যাবধি এই ন’ শ বৎসর ধরে ফরাসি জাতি অবিরাম সাহিত্যসৃষ্টি করে আসছে। সুতরাং ফরাসি সরস্বতীর ভাণ্ডারে যে ঐশ্বর্য সঞ্চিত রয়েছে তার আদ্যোপান্ত পরিচয় নেবার সুযোগ এবং অবসর আমার জীবনে ঘটে নি। এর যে অংশের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে, সে হচ্ছে উনবিংশ শতাব্দীর কাব্যসাহিত্য। প্রাচীন ফরাসি সাহিত্যের উদ্যানে আমি শুধু পল্লব গ্রহণ করেছি। কিন্তু এই স্বল্পপরিচয়ের ফলে আমার মনে ফরাসি সভ্যতার প্রতি একটি আন্তরিক অনুরাগ জন্মলাভ করেছে। সে সাহিত্যের এমন-একটি মোহিনীশক্তি আছে যে, যিনিই তার চর্চা করেন তারই মন ফরাসি সভ্যতার প্রতি একান্ত অনুকূল হয়। যিনিই ফরাসি সাহিত্য ভালোবাসেন তিনিই ফরাসি জাতির সুখের সুখী ব্যথার ব্যথী হয়ে ওঠেন। আজকের দিনে ফ্রান্স তার জাতীয় জীবনের অণুপরমাণুতে যে অত্যাচারের বেদনা অনুভব করছে আমরাও তার অংশীদার। জর্মানির দেহবলের নিকট ফ্রান্সের আত্মবল, জার্মানির যন্ত্রশক্তির নিকট ফ্রান্সের মন্ত্রশক্তি যদি পরাভূত হয়, যদি এই যুদ্ধে ফরাসি সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে ইউরোপের মনোজগতের আলল নিবে যাবে। কি গুণে ফ্রান্স অপর জাতির ভক্তি ও প্রতি আকর্ষণ করতে পারে সে বিষয়ে সুবিখ্যাত মার্কিন নভেলিস্ট হেনরি জেমসের কথা নিম্নে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি–

Our heroic friend sums up for us, in other words, and has always summed up), the life of the mind and thc life of the senses alike, taken together, in the most irrepressible freedom of eitlier, and, after that fashioil, 190sitively lives for us, carries on experience for us…

She is sole and single in this, that she takes charge of those of the interests of man which most dispose him to fraternise with himself, to pervade all his possibilities and to taste all his faculties, and in consequency to find and to make the earth a friendlier, an casier, and specially a more various syjourn…

She has gardened where the soil of humanity lias been most grateful and the aspect, so to call it, most toward the suin, and there at the high and yet mild and fortunate centre, she has grown the precious, intimate, the nourishing, finishing things that she has inexhaustively scattered alsroad. (The Book of Face, Macmilal & Co., 1915.) এই কথাগুলি যেমন সুন্দর তেমনি সত্য।

ইহজীবনে আমাদের দেহমনের সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য। আমাদের বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয় পরস্পর-অনুপ্রবিষ্ট। এই সত্যের উপরই ফরাসি সাহিত্যের বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত। ফরাসি জাতি চিন্তারাজ্যে ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানকে মিথ্যা বলে উড়িয়েও দেয় নি, অকিঞ্চিৎকর বলেও উপেক্ষা করে নি; সুতরাং ফরাসি সাহিত্যের ভিতর সায়েন্স এবং আর্টের একত্রে সাক্ষালাভ করা যায়। হেনরি জেম্স বলেছেন যে, ফরাসি জাতি বিশেষ করে সেইসকল মনোভাবের অনুশীলন করেছেন যাতে করে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়তা জন্মায়। এই গুণেই ফরাসি সভ্যতা পরকে আপন করতে পারে। ফরাসি সাহিত্য প্রধানতঃ মানবমনের সাধারণ ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত বলেই তা সর্বলোকগ্রাহ্য এবং সর্বলোকপ্রিয়। বসুধৈব কুটুম্বক ফরাসি সভ্যতার এই বীজমন্ত্র কোনো ধর্মমতের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। আপনারা সকলেই জানেন যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর যে সকল ফরাসি দার্শনিক বিশ্বমৈত্রীর বার্তা ঘোষণা করেন, তারা প্রায় সকলেই নাস্তিক ছিলেন। মানবচরিত্রের প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপরেই ফরাসি মনোভাব প্রতিষ্ঠিত, এবং সে মনোভাব প্রধানতঃ ফরাসি সাহিত্যই গঠিত করে তুলেছে। হেনরি জেমস বলেছেন যে, ফরাসি মনের চোখ চিরদিনই আলোর দিকে চেয়ে রয়েছে। দিনের আলোয় যা দেখা যায় না, ফরাসি মন স্বভাবতই তা দেখতে চায় না। এর ফলে যে মনোভাব অস্পষ্ট ও অস্ফুট, যে সত্য ধরা দেয় না, শুধু আভাসে ইঙ্গিতে আত্মপরিচয় দেয়, সে মনোভাবের, সে সত্যের সাক্ষাৎ ফরাসি সাহিত্যে বড়-একটা পাওয়া যায় না। সরস্বতীদর্শনের কাল, ফরাসি কবিদের মতে গোধূলিলগ্ন নয়। যা কেবলমাত্র কল্পনার ধন, সে ধনে ফরাসি সাহিত্য অনেক পরিমাণে বঞ্চিত। অপর পক্ষে এই আলোকপ্রিয়তার ফলে সে সাহিত্য অপূর্ব স্বচ্ছতা, অপূর্ব উজ্জ্বলতা লাভ করেছে। এর তুল্য স্পষ্টভাষী সাহিত্য ইউরোপে আর দ্বিতীয় নেই। আমরা টস্পষ্টভাষী’ শব্দ সচরাচর যে অর্থে ব্যবহার করি, সে অর্থে এ সাহিত্য স্পষ্টভাষী নয়। যিনি দিবারাত্র অপরকে অপ্রিয় কথা বলতে ব্যস্ত, এ দেশে আমরা তাকেই স্পষ্টবক্তা বলি— ভাষায় যাকে বলে ঠোঁটকাটা। ফরাসি সাহিত্য কিন্তু ঠোঁটকাটা সাহিত্য নয়। ফরাসি জাতির ক্ষাত্রধর্ম জগৎ-বিখ্যাত। ফরাসি লেখকেরা বাক্‌যুদ্ধেও সভ্যতার আইনকানুন মেনে চলেন। সাহিত্যক্ষেত্রেও তাঁরা ধর্মযুদ্ধের পক্ষপাতী। ফরাসি জাতি হাসতে জানে, তাই তারা কথায় কথায় ক্রোধান্ধ হয়ে ওঠে না। তীক্ষ্ণ হাসির যে কি মর্মভেদী শক্তি আছে, এ সন্ধান যারা জানে তাদের পক্ষে কটুকাটব্য প্রয়োগ করা অনাবশ্যক। যার হাতে তরবারি আছে, সে লগুড় ব্যবহার করে না। ভল্টেয়ারের হাসির যে বিশ্বজয়ী শক্তি ছিল, তার তুলনায় পৃথিবীর সকল দেশের সকল যুগের সকল জেরেমিয়ার উচ্চবাচ্য যে ব্যর্থ, এ সত্য পৃথিবীসুদ্ধ লোক জানে।

ফরাসি সাহিত্য এই অর্থে স্পষ্টভাষী যে, সে সাহিত্যের ভাষায় জড়তা কিংবা অস্পষ্টতার লেশমাত্রও নেই। যে বিষয়ে লেখকের পরিষ্কার ধারণা আছে, সেই কথা অতি পরিষ্কার করে বলাই হচ্ছে ফরাসি সাহিত্যের ধর্ম। আমি পূর্বে বলেছি যে, ফরাসি সাহিত্যের ভিতর সায়েন্স এবং আর্ট দুইই আছে। ফরাসি মনের এই প্রসাদগুণপ্রিয় তার ফলে সে দেশের দর্শন-বিজ্ঞানের ভিতরও সাহিত্যরস থাকে। পাণ্ডিত্য না ফলিয়ে অসাধারণ বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় একমাত্র ফরাসি লেখকেরাই দিতে পারেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের ঐকান্তিক চর্চাতেও ফরাসি পণ্ডিতদের সামাজিক বুদ্ধি ও রসজ্ঞান নষ্ট হয় না। প্রকৃত দার্শনিক কি বৈজ্ঞানিক কেবলমাত্র নিজের ব্যবহারের জন্য সত্য আবিষ্কার করতে ব্রতী হন না। মানবজাতির নিকট সত্য প্রকাশ ও প্রচার করাই তার সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য। সুতরাং যে সত্য তিনি আবিষ্কার করেছেন, তা পরিষ্কার করে অপরকে দেখিয়ে দেওয়া বুঝিয়ে দেওয়া, যা জটিল তাকে সরল করা, যা কঠিন তাকে সহজ করা তার পক্ষে একান্ত কর্তব্য। এক কথায় সায়েন্টিস্টের পক্ষে আর্টিস্ট, জ্ঞানীর পক্ষে গুণী হওয়া আবশ্যক। জর্মান পণ্ডিতদের সঙ্গে তুলনা করলেই দেখা যায় ফরাসি পণ্ডিতেরা কত শ্রেষ্ঠ গুণী। জর্মান পণ্ডিতেরা অসাধারণ পরিশ্রম করে যা প্রস্তুত করেন তা অধিকাংশ সময়ে বিদ্যার গ্যাস বই আর কিছুই নয়। অপর পক্ষে ফরাসি পণ্ডিতেরা মানবজাতির চোখের সুমুখে যা ধরে দেন, সে হচ্ছে গ্যাসের আলো। বর্তমান ইউরোপের সর্ব প্রধান দার্শনিক বের্গস-র গ্রন্থসকলের সঙ্গে যার সাক্ষাৎপরিচয় আছে তিনিই জানেন যে, সেসকল গ্রন্থ কাব্য হিসাবেও সাহিত্যের সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করতে পারে। বের্গস-র দর্শন অতি কঠিন, কিন্তু তার রচনা যেমন প্রাঞ্জল তেমনি উজ্জ্বল। দার্শনিকজগতের এই অদ্বিতীয় শিল্পীর হাতে গদ্যরচনা অপূর্ব চমৎকারিত্ব লাভ করেছে। মণিকার যেমন রত্নের সঙ্গে রত্নের যোজনা করেন, বের্গসঁও তেমনি পদের সঙ্গে পদের যোজনা করেন। চিন্তারাজ্যের এই ঐন্দ্রজালিকের লেখনীর মুখে বশীকরণমন্ত্র আছে। এই স্বচ্ছতা এই উজ্জ্বলতার বলেই ফরাসি সাহিত্য যুগে যুগে ইউরোপের অপরাপর সাহিত্যের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে। আলোর ধর্ম এই যে, তা দিগদিগন্তে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে এবং সকল দেশকেই নিজের কিরণে উদ্ভাসিত করে তোলে। এই কারণেই আমি পূর্বে বলেছি, ফরাসি সভ্যতার নির্বাণের সঙ্গেসঙ্গেই মানবের মনোজগতের আলো নিবে যাবে।

২.

এ স্থলে যদি কেউ প্রশ্ন করেন যে, ফরাসি সভ্যতার অধঃপতন হলেও তার পূর্বকীর্তি সবই বিশ্বমানবের জন্য সঞ্চিত থাকবে, অতএব সে সভ্যতার বিনাশে পৃথিবীর এমন কি ক্ষতি হবে। এ প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, এতে পৃথিবীর যে ক্ষতি হবে তা ইউরোপের অপর কোনো জাতি পূরণ করতে পারবে না। এ মতের সপক্ষে হেরি জেমসের আর-একটি কথা উদ্ধৃত করে দিচ্ছি। তিনি বলেন যে, ফরাসি ইতিহাস ও ফরাসি সাহিত্য বিশ্বমানবকে এ আশা করতে শিখিয়েছে যে, ফরাসি সভ্যতা যুগে যুগে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, এবং এ আশা ভঙ্গ করলে ফ্রান্সের পক্ষে মানবজাতির নিকট বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। তাঁর নিজের কথা এই–

And we have all so taken them from her, so expected them from her as our right, to the point that she would have seemed positively to fail of a passed pledge to help us to happiness if she had disappointed us, this lias been because of her treating us to the impression of genius as no niation since the Greeks has treated the watching world and because of our feeling that genius at that intensity is infallible.

সম্প্রতি কোনো কোনো জর্মান প্রফেসার বর্তমান জর্মান জাতির পক্ষ থেকে প্রাচীন গ্রীক জাতির জিনিয়াসের উত্তরাধিকারের দাবি করেছেন; কিন্তু এ দাবি উক্ত জর্মান প্রফেসার সম্প্রদায় ব্যতীত পৃথিবীর অপর কোনো জাতিই মঞ্জুর করেন নি। অপর পক্ষে ফরাসি জাতির জিনিয়াস যে অদম্য, ফন্ ঝুলল। Von Bulow প্রভৃতি জর্মান রাজমন্ত্রীরাও তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন।

জিনিয়াস শব্দের সংস্কৃত প্রতিবাক্য হচ্ছে প্রতিভা। কিন্তু এই প্রতিভা শব্দের অর্থ নিয়ে বিষম মতভেদ আছে। সংস্কৃত আলংকারিকদের মতে প্রতিভার অর্থ নব নব উন্মেষশালিনী বুদ্ধি। এ অর্থে ফরাসি জাতি যে অপূর্ব প্রতিভাশালী, তার প্রমাণের জন্য বেশি দূর যাবার দরকার নেই। গত শত বৎসরের ফ্রান্সের ইতিহাসের প্রতি অধ্যায়ে তার প্রচুর পরিচয় পাওয়া যায়। উনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্স নিরবচ্ছিন্ন শাস্তি ভোগ করে নি। এই এক শ বৎসরের মধ্যে অন্তবিপ্লব ও বহিঃশত্রুর আক্রমণে ফ্রান্স বারংবার পীড়িত ও বিধ্বস্ত হয়েছে, অথচ এই অশান্তি এই উপদ্রবের ভিতরেও ফ্রান্স মানবজীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই তার নব নব উন্মেষশালিনী বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে এসেছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পাস্তুর এবং দর্শনের ক্ষেত্রে বের্গসঁ যুগ প্রবর্তক মহাপুরুষ। আর সাহিত্যক্ষেত্রে হিউগো এবং মুস্‌সে Musset, গোতিয়ে Gautier এবং ভের্‌লেন Vorlaine প্রমুখ কবির, রেনাঁ Renan এবং তেইন Taine প্রমুখ সমালোচকের, স্তদাল Stendlial এবং বালজাক, ফ্লোবেয়র এবং মোপাসাঁ, লোতি Loti এবং আনাতোল ফ্রাঁস প্রমুখ উপন্যাসকারের, বোস্ত। Rostand এবং ব্রিয় Brieux প্রমুখ নাটককারের নাম ইউরোপের শিক্ষিতসমাজে কার নিকট অবিদিত? এঁরা সকলেই কাব্যজগতের নব পথের পথিক, নব বস্তুর স্রষ্টা। এবং এঁদের রচিত সাহিত্য যতই নতুন হোক, এক ফ্রান্স ব্যতীত অপর কোনো দেশে তা রচিত হতে পারত না; কেননা এসকল কাব্যকথা আলোচনার ভিতর থেকে একমাত্র। ফরাসি প্রতিভাই ফুটে উঠেছে। এ সাহিত্য সম্পূর্ণ নতুন হলেও বিজাতীয় নয়, পূর্বপূর্ব যুগের ফরাসি সাহিত্যের সঙ্গে এর রক্তের যোগ আছে। ফরাসি প্রতিভা যে কি পরিমাণে অদম্য, দর্শনে বিজ্ঞানে কাব্যে সাহিত্যে এইসকল নব কীর্তিই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অপর পক্ষে জর্মানির দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা কি দেখতে পাই? উনবিংশ শতাব্দী সাংসারিক হিসাবে জর্মানির সত্যযুগ। এই শত বৎসরের মধ্যে জর্মানি বাণিজ্যে ও সাম্রাজ্যে, বাহুবলে ও অর্থবলে অসাধারণ অ্যুদয় লাভ করেছে। কিন্তু এই অ্যুদয়ের সঙ্গেসঙ্গেই তার কবিপ্রতিভা তার দার্শনিক বুদ্ধি অন্তর্হিত হয়েছে, গ্যেটে-শিলার-কান্ট-হেগেলের বংশ লোপ পেয়েছে। সে দেশে এখন যা আছে সে হচ্ছে ষষ্টি সহস্র বালখিল্য প্রফেসার। এরা সকলেই জ্ঞানরাজ্যের মুটে-মজুর, কেউ রাজা-মহারাজা নয়।

৩.

ফরাসি সাহিত্যের বিশেষ ধর্মটি যে কি, আজকে এ সভায় আমি সংক্ষেপে তারই পরিচয় দিতে চাই।

বর্তমান ইউরোপের দুটি সর্ব প্রধান সাহিত্য হচ্ছে ইংরেজি ও ফরাসি। ইউরোপের অপর কোনো দেশের সাহিত্য ঐশ্বর্যে ও গৌরবে এই দুই সাহিত্যের সমকক্ষ নয়।

ইংরেজি সাহিত্যের সহিত আমাদের সকলেরই যথেষ্ট পরিচয় আছে। সুতরাং ইংরেজি সাহিত্যের সহিত ফরাসি সাহিত্যের পার্থক্যের পরিচয় লাভ করতে পারলে আমরা ফরাসি সাহিত্যের বিশেষত্বের সন্ধান পাব।

এক কথায় বলতে গেলে ইংরেজি সাহিত্য রোমান্টিক এবং ফরাসি সাহিত্য রিয়ালিস্টিক।

রিয়ালিজুম এবং রোমান্টিসিজম বলতে ঠিক যে কি বোঝায় সে সম্বন্ধে সাহিত্যসমাজে বহুকালাবধি বহু তর্কবিতর্ক চলে আসছে। কিছুদিন হল বাংলা সাহিত্যেও সে আলোচনা শুরু হয়েছে।

আজকের এ প্রবন্ধে সে আলোচনার স্থান নেই, তবে সাহিত্যের এ দুই মার্গের মোটামুটি লক্ষণগুলি নির্দেশ করা কঠিন নয়।

রোমান্টিক সাহিত্যের প্রথম লক্ষণ এই যে, তা সাবজেটিভ। রোমান্টিক কবি প্রধানতঃ নিজের হৃদয়ের কথাই বলেন; নিজের সুখদুঃখ, নিজের আশানৈরাশ্য, নিজের বিশ্বাস-সংশয়, এইসকলই হচ্ছে তার কাব্যের উপাদান ও সম্বল। শুধু তাই নয়, খুঁটি রোমান্টিকের কাছে তার ব্যক্তিত্ব হচ্ছে জগতের সার সত্য। বাংলার সর্বপ্রথম কবি চণ্ডীদাসের কবিতা আগাগোড়া সাবজেটিভ, অপর পক্ষে সংস্কৃত কবিতা আগাগোড়া অবজেটিভ। এক ভর্তৃহরি ভিন্ন অপর কোনো সংস্কৃত কবি মানবহৃদয়ের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘অহং জানামি’ এ কথা বলেন নি। সংস্কৃতের ন্যায় ফরাসি সাহিত্যও প্রধানতঃ অবজেটিভ, বাহঘটনা ও সামাজিক মন নিয়েই ফরাসি সাহিত্যের আসল কারবার; এক কথায় ফরাসি জাতির দিব্যদৃষ্টি অপেক্ষা বহিদৃষ্টি এবং অন্তদৃষ্টি ঢের বেশি তীক্ষ্ণ ও প্রখর। সে চোখ মানুষের ভিতর-বাহির দুই সমান দেখতে পায়।

রোমান্টিক সাহিত্যের দ্বিতীয় লক্ষণ এই যে, সে সাহিত্য আধ্যাত্মিক। আমাদের দর্শনে সত্যকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় এক ব্যবহারিক, আরএক তদতিরিক্ত। ফরাসি সাহিত্যে এই ব্যবহারিক সত্যেরই আলোচনা ও চর্চা হয়ে থাকে। যা ইন্দ্রিয়ের অগোচর আর যা বুদ্ধির অগম্য, ফরাসি সাহিত্যে তার বড়-একটা সন্ধান পাওয়া যায় না। The proper study of mankind is man, এই হচ্ছে ফরাসি-মনের মূল কথা। সুতরাং মানবসমাজ মানবমন ও মানবচরিত্রের জ্ঞানলাভ করা ও বর্ণনা করাই ফরাসি সাহিত্যের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ জ্ঞান লাভ করতে হলে সামাজিক মানবের আচারব্যবহার লক্ষ্য করতে হয়, এবং সেই সঙ্গে সেই আচারব্যবহারের আবরণ খুলে ফেলে তার আসল মনের পরিচয় নিতে হয়; তাও আবার সমগ্রভাবে নয়, বিশ্লেষণ করে, পরীক্ষা করে। বৈজ্ঞানিক যে ভাবে যে পদ্ধতি অনুসরণ করে জড়বস্তুর তত্ত্ব নির্ণয় করেন, ফরাসি সাহিত্যিকরাও সেই ভাবে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে মানবতত্ত্ব নির্ণয় করেন। তারা মানবজাতিকে চরিত্র অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেন, মানবের কার্যকারণের আভ্যন্তরিক নিয়মাবলী ও যোগাযোগ আবিষ্কার করতে চান। এই কারণে Moliere মোলিয়েরের নাটক ফরাসি প্রতিভার সর্বোচ্চ নিদর্শন। মোলিয়ের ধর্মের আবরণ খুলে পাপের, বিদ্যার আবরণ খুলে মূখতার, বীরত্বের আবরণ খুলে কাপুরুষতার, প্রেমের আবরণ খুলে স্বার্থপরতার মূর্তি পৃথিবীর লোকের চোখের সুমুখে খাড়া করে দিয়েছেন। কিন্তু এসকল মূর্তি দেখে মানুষের মনে ভয় হয় না, হাসি পায়। মানুষের ভিতর যা-কিছু লজ্জাকর আর হাস্যকর, তাই মোলিয়েরের চোখে পড়েছে, আর যা তাঁর চোখে ধরা পড়েছে তাই তিনি অপরের নিকট ধরিয়ে দিয়েছেন।

ফ্রান্সের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটককারের সঙ্গে ইংলণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটককারের তুলনা করলেই এ উভয়ের প্রতিভার পার্থক্য স্পষ্ট লক্ষিত হবে। শেক্সপীয়রের রিচার্ড দি থার্ড, ইয়াগো প্রভৃতির পরিচয়ে দর্শকের মনে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। শাইলক আমাদের মনে যুগপং করুণা ও ঘৃণার উদ্রেক করে, কিং লিয়রের পাগলামি আমাদের মনকে বেদনা দেয়, এয়ারিয়েল Aeriel আমাদের স্বপ্নরাজ্যে নিয়ে যায়। ফরাসি কবিরা শুধু হাস্য ও করুণ, বীর ও মধুর রসের চর্চা করেন। ইংরেজ কবিদের ন্যায় তারা ভয়ংকর ও অদ্ভুত রসের রসিক নন। ফরাসি জাতির ভিতর কোনো শেপীয়র জন্মায় নি ও জন্মাতে পারে না। পাগল প্রেমিক ও কবি যে এক জাত, এ কথা কোনো ফরাসি কবি বলেনও নি, স্বীকারও করেন নি। কেননা তারা তাদের সংসারজ্ঞান ও তাদের শিক্ষিত ও মার্জিত বুদ্ধির উপরেই চিরকাল নির্ভর করে এসেছেন। ফরাসি জাতির দেহে কিংবা মনে কোনো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নেই এবং তারা কস্মিনকালেও তাদের মগ্নচৈতন্যের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন নি। এই কারণে ফরাসি কবিতা ইংরেজি কবিতার তুলনায় আবেগহীন ও কল্পনার ঐশ্বর্যে বঞ্চিত; সে কবিতা মানবমনের গভীরতম দেশ স্পর্শ করে না।

৪.

অপর পক্ষে এই সচেতন সচেষ্ট মনের উপর নির্ভর করায় ফরাসি গদ্যসাহিত্য যে শক্তি ও তীক্ষ্ণতা লাভ করেছে ইংরেজি গদ্যসাহিত্যে সে শক্তি সে তীক্ষ্ণতা নেই। পৃথিবীর বেশির ভাগ লোকের মন সামাজিক, সুতরাং ব্যবহারিক সত্যের সঙ্গেই তাদের সাক্ষাৎ-পরিচয় আছে। সেই পরিচিত সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত বলে মানবমনের নিকট ফরাসি সাহিত্য এত সহজবোধ্য, এত বহুমূল্য। ইংরেজি কবিতা মানুষের মনকে উত্তেজিত উদ্দীপিত করে, সে মনকে জ্ঞানবুদ্ধির সীমা অতিক্রম করিয়ে কল্পনার স্বপ্নরাজ্যে নিয়ে যায়, কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য। সে কবিতার মোহ আমাদের মনকে চিরদিনের মত অভিভূত করে রাখতে পারে না, আমরা আবার এই মাটির পৃথিবীতে দিনের আলোয় ফিরে আসি। এ কবিতার রেশ যে মনের উপর থেকে যায় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, এবং তার ফলে আমাদের হৃদয়মন যুগপৎ গভীরতা ও উদারতা লাভ করে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ঐ সামাজিক মনই আমাদের চিরদিনের মন, আর ঐ বুদ্ধিবৃত্তিই আমাদের চিরজীবনের সহায়। ফরাসি সাহিত্য মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে মাজিত করে, চিত্তবৃত্তিকে সুশৃঙ্খল করে। সে সাহিত্য মানুষকে দেবতা হিসাবে নয়, মানুষ হিসাবেই চিত্রিত করে। অতএব সে সাহিত্য আমাদের মনে মানুষের প্রতি, ভক্তির না হোক, প্রীতির উদ্রেক করে। কেননা তার চর্চায় আমরা স্বজাতিকে চিনতে ও বুঝতে শিখি, এবং সেই সঙ্গে আমরা ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা, গোঁড়ামি আর হাবড়ামি, মানসিক আলস্য ও জড়তা, হয় পরিহার করতে নয় গোপন করতে শিখি। ফরাসি সাহিত্য মানুষকে দেবতা নয়, সুসভ্য করে তোলে। ফরাসি সাহিত্য সকল প্রকার মিথ্যার সকল প্রকার কপটতার প্রবল শত্রু এবং ফরাসি-মনের এই নির্ভীক সত্যসন্ধিৎসা সে সাহিত্যের সর্বপ্রধান গুণ। এই কারণেই ফরাসি প্রতিভা ইতিহাসে জীবনচরিতে সামাজিক উপন্যাসে এত ফুটে উঠেছে। এবং এই একই কারণে ফরাসি সমালোচকদের তুল্য সমালোচক পৃথিবীর অপর কোনো দেশে জন্মগ্রহণ করে নি। এবং ফরাসি সমালোচনার বিষয় কেবলমাত্র সাহিত্য নয়, সমগ্র মানবজীবন। ধর্মনীতি রাজনীতি সমাজ সভ্যতা এসকলই ফরাসি জাতির হস্তে যুগে যুগে পরীক্ষিত হয়ে আসছে।

অনেকের ধারণা যে, জোলার নভেলই হচ্ছে ফরাসি রিয়ালিজমের চূড়ান্ত উদাহরণ। এ কথা সত্য যে, সত্যের অনুসন্ধানে মনোরাজ্যের হেন দেশ নেই যেখানে ফরাসি লেখকেরা যেতে প্রস্তুত নন, সে দেশ যতই অপ্রীতিকর ও যতই অসুন্দর হোক; এবং সত্যের খাতিরে হেন কথা নেই, যা তারা বলতে প্রস্তুত নন, সে কথা যতই অপ্রিয় যতই অবক্তব্য হোক। কিন্তু আমি রিয়ালিজম শব্দ জোলার অনুমত সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করি নি। লোকে সচরাচর যাকে আইডিয়ালিম বলে থাকে তাও আমার ব্যবহৃত রিয়ালিজম শব্দের অন্তভূত। মানবমন মানবজীবনের উপর আলো ফেলে যা দেখা যায় তাই হচ্ছে ফরাসি সাহিত্যের বিষয়। বলা বাহুল্য, সে আলোয় অনেক সুন্দর, অনেক কুৎসিত, অনেক মহৎ, অনেক ইতর মনোভাব প্রকাশ হয়ে পড়ে। যা হেয় তাও যেমন সত্য, যা উপাদেয় তাও তেমনি সত্য। এর ভিতর কোন্ শ্রেণীর সত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হবে তা লেখকের ব্যক্তিগত রুচি ও দৃষ্টির উপর নির্ভর করে। সুতরাং আইডিয়ালিজুম এবং রিয়ালিজম সাহিত্যে পাশাপাশি দেখা দেয়। ফরাসি লেখকেরা মানবের অন্তরে এমন এক-একটি মূল প্রবৃত্তির আবিষ্কার করতে চান, অপর প্রবৃত্তিগুলি যার বিবাদী সংবাদী অনুবাদী সুর মাত্র। সুতরাং একই মনোভাব থেকে ফরাসি সাহিত্যে মানবের আইডিয়ালিস্টিক এবং রিয়ালিস্টিক উভয় চিত্রই অঙ্কিত হয়ে থাকে। প্রাচীন ফরাসি সাহিত্যে মানবসমাজের আইডিয়ালিস্টিক চিত্র বিরল নয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জোলা প্রভৃতি রিয়ালিস্টগুণ যে অতিমাত্রায় কদর্যতার চর্চা করেন, সে কতকটা ভিক্তর হিউগো প্রভৃতি রোমান্টিক লেখকদের প্রতিবাদস্বরূপে। আর-এক কথা, আমার সহিত যত ফরাসি লেখকের পরিচয় আছে, আমার বিশ্বাস, তার মধ্যে এক জোলার গ্রন্থই বিশেষরূপে ফরাসি-ধর্মে বঞ্চিত; জোলার রচনায় ফরাসিসুলভ লিপিচাতুর্য নেই; জোলার মন সূর্যকরোজ্জ্বল নয়, সে মন নিশাচর; জোলা মানুষকে দেবতা হিসেবে দেখেন নি, মানব হিসেবেও দেখেন নি, তার চোখে আমরা সকলেই ছদ্মবেশী দানব। প্রকৃত পক্ষে জোল। ফরাসি লেখক নন, তিনি ছিলেন জাতিতে ইতালিয়ান।

ফরাসি সাহিত্যের দ্বিতীয় বিশেষত্ব হচ্ছে তার আর্ট। ফরাসি সাহিত্য সম্বন্ধে জনৈক ইংরেজ ঐতিহাসিক বলেন

The one high principle which, througlı so many generations, lias guided like a star the writers of France is the principle of deliberation, of intention, of a conscious search for ordered beauty; an unwavering, an indomitable pursuit of the endless glories of art. (Lytton Strachey, Landmarks in french Literature, Home University Library) এই আর্টের গুণেই ফরাসি রচনা আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে।

এক কথায় এ আর্ট রোমান্টিক নয়, ক্ল্যাসিকাল। কি কি গুণের, কি কি লক্ষণের সভাবে রচনা আর্ট হয়, সে বিষয়ে ফরাসি জাতির মত নিম্নে বিবৃত করছি। ফরাসি রচনার রীতির পরিচয় দেবার পূর্বে ফরাসি ভাষার কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া আবশ্যক, কেননা ভাষার সহিত সাহিত্যের সম্বন্ধ অতি ঘনিষ্ঠ, এত ঘনিষ্ঠ যে এ কথা বললেও অত্যুক্তি হয় না যে, সকল দেশের জাতীয় সাহিত্যের রূপগুণ সেই দেশের ভাষার শক্তির উপর নির্ভর করে। এ স্থলে স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, জাতীয় সাহিত্য রচিত হবার বহু পূর্বে জাতীয় ভাষা গঠিত হয়। যুগযুগান্তরের আত্মপ্রকাশের চেষ্টার ফলে একটি জাতীয় ভাষা গড়ে ওঠে এবং সেই ভাষার অঙ্গে জাতীয় মনের ছাপ থেকে যায় এবং তার অন্তরে জাতীয় চরিত্র বিধিবদ্ধ হয়ে থাকে।

ভাষার সেই সম্বন্ধ, অর্থাৎ ফরাসি ল্যাটিনের অপভ্রংশ অথবা প্রাকৃত। ফরাসি ভাষার শব্দসমূহ ল্যাটিন হতে উদ্ভূত। সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিভাষায় যাকে তদ্ভব বলে, ফরাসি অভিধানের প্রায় সকল শব্দই সেই শ্রেণীভুক্ত, এসকলই ল্যাটিনের তদ্ভব। এ ভাষায় দেশি এবং বিদেশি শব্দের সংখ্যা এত অল্প যে, তা নগণ্য স্বরূপে ধরা যেতে পারে। ফরাসি ভাষা মূলতঃ এক হওয়ার দরুন এ ভাষার ভিতর এমন-একটি ঐক্য ও সমতা আছে যা রচনার একটি বিশেষ রীতি গড়ে তোলার পক্ষে একান্ত অনুকূল। ইংরেজি ভাষা ঠিক এর বিপরীত। অ্যাংলো-স্যাশন এবং নর্মান-ফ্রেঞ্চ, এই দুটি সম্পূর্ণ বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে বর্তমান ইংরেজি ভাষার উৎপত্তি। এর ফলে সে ভাষার অন্তরে বৈচিত্র্য আছে, সমতা নেই। ইংরেজি রচনার-যে কোনো-একটি বিশিষ্ট রীতি নেই, ইংরেজি ভাষার বর্ণসংকর তার অন্যতম কারণ; ইংরেজি লেখকেরা যে প্রত্যেকেই নিজের রুচি অনুসারে রচনার স্বতন্ত্র রীতি গড়ে নিতে পারেন, তার প্রচুর এবং প্রকৃষ্ট প্রমাণ এক উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্য হতে পাওয়া যায়। কার্লাইল এবং নিউম্যান, রাকিন এবং ম্যাথু আর্নল্ড, থ্যাকারে এবং মেরেডিথ, ওয়ার্ডওয়ার্থ এবং শেলি, টেনিসন এবং ব্রাউনিং— একই যুগে এইসকল বিভিন্নপন্থী লেখকের আবির্ভাব এক ইংলণ্ড ব্যতীত অপর কোনো দেশে সম্ভব হত না। উনবিংশ শতাব্দীর ফ্রান্সের রোমান্টিক এবং রিয়ালিস্টিক লেখকদের রচনার ভিতর এরূপ জাতিগত প্রভেদ নেই। ফরাসি ভাষায় এরূপ বৈচিত্র্যের অবসর নেই। সুতরাং ফরাসি লেখকেরা যুগে যুগে রচনার, বৈচিত্র্য নয়, ঐক্যসাধন করে একটি আদর্শ রীতি গড়ে তোলবার জন্য কায়মনোবাক্যে যত্ন করেছেন, এবং সে বিষয়ে কৃতকার্য হয়েছেন। এই যুগযুগান্তরের সাধনার ফলে অধিকাংশ ফরাসি শব্দের অর্থ সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট এবং সুপ্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। এ ভাষার ব্যবহারে অশিক্ষিতপটুত্ব লাভ করবার জো নেই। আমাদের দেশের বাধা ঠাটের বাঁধা রাগিণীর মত এ ভাষা গুণীব্যক্তির হাতেই পূর্ণশ্রী লাভ করে, এবং তার মূর্তি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। একটি, বেপর্দায় হাত পড়লে সুর যেমন আগাগোড়া বেসুরো হয়ে যায়, তেমনি একটি অসংগত কথার সংস্পর্শে ফরাসি রচনা আগাগোড়া অশুদ্ধ হয়ে পড়ে। পরিমিত শব্দে স্পষ্ট মনোভাব ব্যক্ত করবার পক্ষে এ ভাষা যতটা অনুকূল, হৃদয়ের গভীর ও অস্পষ্ট মনোভাব প্রকাশের পক্ষে তাদৃশ অনুকুল নয়। এর ফলে গদ্যরচনার পক্ষে ফরাসি হচ্ছে ইউরোপের আদর্শ ভাষা।

ভাষা হচ্ছে সাহিত্যের উপাদান, কিন্তু কেবলমাত্র উপাদানের গুণে কোনো শিল্পই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে না, যদি না তা শিল্পীর হাতে পড়ে। আর তা ছাড়া অন্যান্য শিল্পের উপাদানের সঙ্গে সাহিত্যের উপাদানের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে।

পাষাণ কি ধাতু, বর্ণ কি স্বর, আমরা বাইরে থেকে যা পাই তাই আমাদের গ্রাহ্য করে নিতে হয়, কেননা ওসকল বাহজগতের বস্তু; আমরা তা সৃষ্টি করি নি, অতএব আমরা তার ধাতও বদলে দিতে পারি নে। কিন্তু। ভাষা হচ্ছে আমাদেরই সৃষ্টি। সুতরাং পূর্বপুরুষদের নিকট যে ভাষা আমরা উত্তরাধিকারী-স্বত্বে লাভ করি, তার অল্পবিস্তর রূপান্তর করা আমাদের সাধ্যের অতীত নয়। আমরা যা পড়ে পাই তা চৌদ্দ আনা, তাকে ষোলো আনা করা -করা, সে আমাদের হাত। বর্তমান ফরাসি ভাষা এবং প্রাচীন ফরাসি ভাষা এই দুই মূলতঃ এক হলেও এ দুইয়ের ভিতর প্রভেদ বিস্তর। যুগের পর যুগের ফরাসি লেখকদের যত্নে ও চেষ্টায় এ ভাষা জাতীয় মনোভাব প্রকাশের এমন উপযোগী যন্ত্র হয়ে উঠেছে। ফরাসী ভাষার এ ইভলিউশন আপনি হয় নি, এ উন্নতি এ পরিণতির ভিতর ফরাসি জাতির সুবুদ্ধি ও সুরুচি, যত্ন ও অধ্যবসায়, এসকলেরই সমান পরিচয় পাওয়া যায়।

৬.

যেদিন থেকে ফরাসি জাতির ধারণা হল যে, সাহিত্যরচনা করা একটি আর্ট, সেইদিন থেকে ফরাসি লেখকেরা কিসে রচনা সুগঠিত হয়, সে বিষয়েও পুরো লক্ষ্য রেখে আসছেন। কি যে আর্ট আর কি যে আর্ট নয়, সে বিষয়ে অদ্যাবধি বহু মতভেদ আছে। সৌন্দর্যের অর্থ যে কি, সে বিষয়ে দার্শনিক তর্কের আর শেষ নেই। তবে আমাদের সহজ মন এবং সাদা চোখ দিয়ে বিচার করতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে, আমরা যাকে বস্তুর রূপ বলি তা অনেক পরিমাণে তার আকারের উপর নির্ভর করে। অন্ততঃ আমরা বাঙালিরা যা কদাকার তাকে সুন্দর বলি নে। মানবমনের এই সহজ প্রকৃতির উপরেই ফরাসি জাতির রচনার আর্ট প্রতিষ্ঠিত। কিসে রচনার অঙ্গসৌষ্ঠব হয় সে বিষয়ে ফরাসি মনীষীরা বহু চিন্তা বহু বিচার করে গেছেন, এবং সেই চিন্তা সেই বিচারের ফলে ফরাসি রচনা এত সাকার, এত পরিচ্ছিন্ন হয়ে উঠেছে।

আমি প্রথমেই বলেছি যে, খৃস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে ফরাসী সাহিত্য জন্মলাভ করে; প্রথম তিন শত বৎসরের ফরাসি সাহিত্য আর্টহীন। কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীদাসের মহাভারত, কবিকঙ্কণচণ্ডী যেমন আর্টহীন, রোমা দ্য রোলা, রোমা দ্য রোজ প্রভৃতি ফ্রান্সের জাতীয় মহাকাব্যও সেইরূপ আর্টহীন। এই যুগের লেখকদের শব্দের নির্বাচন ও পদের যোজনার প্রতি কোনোই লক্ষ্য ছিল না।

তার পর খৃস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে ফরাসি জাতি যখন প্রাচীন গ্রীক এবং ল্যাটিন সাহিত্যের পরিচয় লাভ করলে, তখন হতে লেখা জিনিসটে যে একটি আর্ট এ বিষয়ে ফরাসি কবি এবং ফরাসি গদ্য-লেখকের সজ্ঞান হয়ে উঠল। এই ক্ল্যাসিক-সাহিত্যের আদর্শ ফরাসি লেখকদের নিকট একমাত্র আদর্শ হয়ে উঠল এবং এই কারণেই ক্ল্যাসিসিজম হচ্ছে সে সাহিত্যের সর্বপ্রধান ধর্ম।

৭.

দুই উপায়ে ভাষার রূপান্তর করা যায় : এক, শব্দের যোগের দ্বারা, আরএক, বিয়োগের দ্বারা। ফরাসি লেখকের বর্জনের সাহায্যেই ভাষার সংস্কার করেন। খৃস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে মালেব Malherbe নামক জনৈক কবি এই ভাষা-সংস্কারকার্যে ব্রতী হন। তিনি প্যারি নগরীর মৌখিক ভাষাই সাহিত্যরচনার আদর্শভাষাস্বরূপে গণ্য করেন। কেননা সে ভাষার ভিতর এমন-একটি ঐক্যসমতা প্রসাদগুণ এবং ভদ্রতা ছিল, যা কোনো প্রাদেশিক ভাষার অন্তরে ছিল না। এই কারণে সাহিত্য হতে প্রাদেশিক শব্দসকল বহিষ্কৃত করে দেওয়াই তার মতে হল ভাষাসংস্কারের সর্বপ্রথম এবং সর্ব প্রধান উপায়। মালের্বের মতে এক দিকে যেমন প্রাদেশিক শব্দের ব্যবহারে কুরুচির পরিচয় দেওয়া হয়, অপর দিকে সাহিত্যে পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারেও তেমনি কুরুচির পরিচয় দেওয়া হয়। এক কথায়, গ্রাম্যতা ও পাণ্ডিত্য, এই দুইই কাব্যের ভাষায় সমান বর্জনীয়। কেননা সে যুগের ফ্রান্সের ভদ্রসমাজের মতে নিরক্ষর লোকের ভাষা ও পুঁথিগত বিদ্যার ভাষা এই দুইই সমান : ইতর বলে গণ্য হত। দুয়ের ভিতর পার্থক্য এই যে, এর একটি লজ্জার, অপরটি হাস্যের উদ্রেক করে। এই মত ফ্রান্সের লেখকসমাজে গ্রাহ্য হয়েছিল, কেননা তাদের মতে প্রাচীন ফরাসি সাহিত্যের ভাষা এক ভাষা নয়, একটা জোড়াতাড়া দেওয়া ভাষা। এর ফলে রাবলে Rabelais প্রভৃতি প্রাচীন লেখকদের পাঁচরঙা ভাষার পরিবর্তে ফরাসি গদ্যের ভাষা একরঙা হয়ে উঠল।

উপাদান নির্বাচন হচ্ছে শিল্পীর প্রথম কাজ, কিন্তু সেই উপাদানে মূর্তি গঠন করাই তার আসল কাজ। সুতরাং মালেব প্রমুখ সমালোচকেরা পদনির্বাচনের ন্যায় পদযোজনার প্রতিও লেখকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমরা পদের সঙ্গে পদের যোজনা করে বাক্যগঠন করি এবং বাক্যের সঙ্গে বাক্যের যোজনা করে একটি কবিতা কিংবা প্রবন্ধ রচনা করি। সুতরাং বাক্য এবং রচনা যাতে সুগঠিত হয় সে বিষয়ে ফরাসি লেখকেরা এই যুগ থেকে আরম্ভ করে অদ্যাবধি সমান মনোনিবেশ করে আসছেন। এ গঠনে যাতে রেখার সুষমা থাকে সামঞ্জস্য থাকে, রচনার সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যাতে যথাযথ স্থানে বিন্যস্ত। হয়, এবং পরস্পরের সঙ্গে সুসম্বদ্ধ হয়, যাতে করে একটি রচনা পূর্ণাবয়ব সর্বাঙ্গসুন্দর এবং সমগ্র হয়ে ওঠে–এই হচ্ছে ফ্রান্সের সাহিত্যশিল্পীর যুগযুগের সাধনার ধন। রচনার দেহ সুগঠিত করবার জন্য সকল প্রকার বাহুল্য বর্জন করা আবশ্যক। যারা রাগ আলাপ করেন, চিকারির ঝন্‌ঝনানি তাদের কানে অসহ্য। খৃস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বোয়ালো Boileau নামক বিখ্যাত সমালোচক বিশেষ করে রচনার অমার্জনীয় দোষের সম্বন্ধে সমাজের চোখ ফুটিয়ে দিয়েছিলেন। ভাষার কৃত্রিমতা, বৃথা বাগাড়ম্বর, উপমার আতিশয্য, অনুপ্রাসের ঝংকার প্রভৃতি রচনার দোষের প্রতি তিনি চিরজীবন ধরে এমন তীক্ষ্ণ, এমন অজস্র বাণ বর্ষণ করেছিলেন যে, ফরাসি সাহিত্য হতে সকল প্রকার অত্যুক্তি ও অতিবাদ, কষ্টকল্পনা ও অবোধ পাণ্ডিত্য চিরদিনের জন্য নির্বাসিত হয়েছে।

রচনাকে শব্দাড়ম্বরে গৌরবান্বিত, শব্দালংকারে ঐশ্বর্যবান, পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগে মর্যাদাপন্ন এবং বাচালতায় সমৃদ্ধিশালী করবার লোভ সংবরণ করা যে কি কঠিন, তা লেখক মাত্রই জানেন। ফরাসি লেখকেরা এই সংযম নিজেরা অভ্যাস করেন এবং অপরকে অভ্যাস করতে শিক্ষা দেন। পূর্বোক্ত ফরাসি আলংকারিক কর্তৃক প্রদর্শিত সাহিত্যের ত্যাগমার্গ ফরাসি লেখকেরা যে কেন অবলম্বন করেছিলেন, তার একটু বিশেষ কারণ আছে। প্যাকাল, লা ব্রুইয়ের La Bruyere, বয়ে Bossuet, ফেনেল Fenelon, রাসীন Racine, মোলিয়ের প্রভৃতি সে যুগের ফ্রান্সের প্রথম শ্রেণীর গদ্যপদ্যলেখক মাত্রেই মালের্ব কর্তৃক আবিষ্কৃত এবং বোয়ালো কর্তৃক পরিষ্কৃত রচনার এই নব পথ অবলম্বন করেই সাহিত্যজগতে অমর হয়েছেন। এরা যে বিনা অপত্তিতে এই নব আলংকারিক মত গ্রাহ্য করেছিলেন, তার কারণ তারা যেসকল মনোভাব প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন রচনার এই নবপদ্ধতি সে মনোভাব প্রকাশের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুকূল ছিল। সে যুগের ফরাসি মনোভাবের পূর্ণ পরিচয় Descartes দেকার্তের দর্শনে পাওয়া যায়। সেই দর্শনে ফরাসি প্রতিভা তার আত্মজ্ঞান লাভ করে। আপনারা অনেকেই জানেন যে, যে-আইডিয়া সুস্পষ্ট পরিচ্ছিন্ন ও সুনির্দিষ্ট, তাই হচ্ছে দেকার্তের মতে সত্যের পরিচায়ক। অর্থাৎ যে জ্ঞান আমাদের জাগ্রত বুদ্ধির আয়ত্তাধীন, এবং যা ন্যায়শাস্ত্রবিরুদ্ধ নয়, তাই হচ্ছে যথার্থ সত্য। এবং দেকার্তের মতে একমাত্র অন্তদৃষ্টির সাহায্যেই এই শ্রেণীর সত্যের সাক্ষাৎকার লাভ করা যায়। ফরাসি লেখকেরা মানবমনের ও মানবচরিত্রের সেই সত্য আবিষ্কার করতে এবং প্রকাশ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন, যা জ্ঞানের আলোকে সুস্পষ্ট হবে, যা ন্যায়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। এক কথায়, তারা reasonকে দেবতা করে। তুলেছিলেন, এবং reasonable মনোভাব প্রকাশের পক্ষে যে সুসংযত সুসংহত এবং সুশৃঙ্খল ভাষাই সর্বাপেক্ষা উপযোগী, সে বিষয়ে আর সন্দেহ কি? রিজুনেবল মনোভাব রিনেবল ভাষায় ব্যক্ত করার দরুন ফরাসি ক্ল্যাসিকাল লেখকেরা য়ুরোপের সাহিত্যসমাজে সর্বাগ্রগণ্য হয়ে উঠেছিলেন। এই কারণেই সে সাহিত্যের প্রভাব সমগ্র ইউরোপে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে, ও সকল জাতির মন বশীভূত করে। দেশভেদে কালভেদে জাতিভেদে রিজুনের কোনো ভেদ হয় না, ও-বস্তু সর্বলোকসামান্য। ঐ হচ্ছে মনের একমাত্র ক্ষেত্র, যেখানে সকল মনের মিলন হতে পারে। মানুষ যদি সমবুদ্ধি হয়, তাহলে মানুষের সঙ্গে মানুষের সহানুভূতি জন্মাতে বাধ্য। এই কারণেই হেরি জেম্স বলেন যে, ফরাসি জাতি lives for us। এমনকি, রোমান্টিক ইংলণ্ড এক শতাব্দীর জন্য স্বধর্ম ত্যাগ করে এই ফরাসি সাহিত্যের অধীনতা স্বীকার করেন। অ্যাডিসন এবং পোপ, লকী এবং হিউম, গিবন এবং গোল্ড সমিথ, সকলেই সাহিত্যের এই ফরাসি রীতিই অনুসরণ করেছিলেন। ইংলণ্ডের অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্ল্যাসিসিজম ফরাসি ক্ল্যাসিসিজুমের অনুকরণ ব্যতীত আর কিছু নয়। ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের সময় পর্যন্ত এই রীতি একাধিপত্য করে। ভল্টেয়ারের হাতে ফরাসি ভাষা এত লঘু আর এত তীক্ষ্ণ, এত চোস্ত এবং এত সাফ হয়ে উঠেছিল যে, তার পর সে রীতির আর ক্রমোন্নতি হবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। ভল্টেয়ারের ভাষাই তার চূড়ান্ত পরিণতি। ভাষার ধার এর চাইতে বাড়াতে গেলে যে পরিমাণ শান দিয়ে তার দেহ ক্ষয় করতে হয়, তাতে ভাষার দেহত্যাগ করতে হয়।

৮.

অপর সকল গুণকে উপেক্ষা করে একটিমাত্র গুণের অতিমাত্রায় চর্চা করলে কালক্রমে তা দোষ হয়ে দাঁড়ায়। এই সুমার্জিত ভাষা মানুষের চিন্তাপ্রকাশের জন্য যেমন উপযোগী, মানবহৃয়ের আকাঙ্ক্ষা-আকুলতা আশাভয় সংশয়-বিশ্বাস প্রভৃতি অনির্দিষ্ট ভাব প্রকাশের জন্য তেমনি অনুপযুক্ত। ক্রমান্বয়ে ইতর গণ্যে শব্দের পর শব্দ বর্জন করে এ ভাষা অতিশয় সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। এ ভাষায় কোনোরূপ ছবি আঁকা অসম্ভব। কেননা যে শব্দের গায়ের রং আছে, সে শব্দ এ সাহিত্যিক ভাষা হতে বহিষ্কৃত হয়েছিল। যে শব্দের বস্তুর সঙ্গে বাচ্যবাচক সম্বন্ধ সুস্পষ্ট, সেই শব্দই এ সাহিত্যে গ্রাহ্য হত। কিন্তু যে শব্দের ব্যঞ্জনাশক্তি আছে, অর্থাৎ যার অর্থের অপেক্ষা অনুরণন (suggestiveness) প্রবল, সে শব্দ এ সাহিত্যে উপেক্ষিত হত। ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের পূর্বসভ্যতার সঙ্গেসঙ্গে তার পূর্বসাহিত্যের রীতিনীতিও মর্যাদাভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে নবীন ফ্রান্সে রিজন তার দেবত্ব হারিয়ে বসেছিল। ১৮৩০ খৃস্টাব্দে ফ্রান্সের নূতন সাহিত্য ক্ল্যাসিসিজুমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়। এই সাহিত্যই রোমান্টিক বলে পরিচিত। শাতোব্রিয়। Chateaubriand এর প্রবর্তক, এবং ভিক্টর হিউগো এর নায়ক। ক্ল্যাসিসিজুমের ভাব ও ভাষার বিরুদ্ধে বিদ্রোহই এ সাহিত্যের লক্ষণ ও বিশেষত্ব। রিজনের পরিবর্তে কল্পনা, বাঁধাবাঁধি নিয়মের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা, ভাষাপ্রয়োগে কৃপণতার পরিবর্তে অজস্রতা— রোমান্টিক সাহিত্যে এইসবই প্রাধান্য লাভ করেছিল। রোমান্টিক লেখকেরা ইতর বলে কোনো শব্দকেই বর্জন করেন নি, এদের প্রসাদে এক দিকে শত শত উপেক্ষিত পতিত ও বিস্মৃত শব্দ, অপর দিকে শিল্পবিজ্ঞান হতে সংগৃহীত শত শত পারিভাষিক শব্দ সাহিত্যে প্রবেশ লাভ করলে। আমাদের নব্য আলংকারিক-মতে—

ন স শব্দো ন তদ্বাচ্যং ন স ন্যায়ো ন স কলা
জায়তে যন্ন কাব্যাঙ্গমহো ভারো মহান্ কবেঃ। (রুদ্রট-ধৃত বচন)

ফরাসি নব্য আলংকারিকদেরও এই একই মত। এর ফলে সাহিত্যের ভাষা আবার শব্দসম্পদে বিপুল ঐশ্বর্যবান হয়ে উঠল। এই নূতন ভাষা হৃদয়ের আবেগ প্রকাশের জন্য যেমন উপযোগী, বাহিরের দৃশ্য অঙ্কনের জন্য তেমনি উপযোগী। এ রোমান্টিক সাহিত্য কিন্তু আসলে উচ্ছঙ্খল সাহিত্য নয়। ভিক্টর হিউগো, মুসসে প্রমুখ লেখকের মুখে অবাধ স্বাধীনতা প্রচার করলেও কাজে আর্টের অধীনতা হতে মুক্ত হন নি। এমনকি কোনো কোনো সমালোচকের মতে ভিক্টর হিউগো ফরাসি সাহিত্যের একজন অপূর্ব শিল্পী। তাঁর প্রতি ছত্রে কারিগরের হস্তের পরিচয় পাওয়া যায়। ফরাসি রোমান্টিসিজম অনেকটা বক্তগত। এক কথায়, হিউগো প্রমুখ কবির। শুধু ভাষার পুষ্টিমার্গ অবলম্বন করেছিলেন, কেননা রোমান্টিক মনোভাব এ জাতির মনে কখনোই সম্পূর্ণ অধিকার লাভ করতে পারে নি। মানুষের সমগ্ৰ মন তার বুদ্ধির চাইতে ঢের বড়, এবং যুক্তিতর্কের অপেক্ষা অনুভূতি টের বেশি নির্ভরযোগ্য, এই বিশ্বাসের উপরই যথার্থ রোমান্টিক সাহিত্য দাঁড়িয়ে থাকে। এই দৃষ্ট বিশ্বের পিছনে একটি অদৃষ্ট বিশ্ব আছে, মানবমনের এমন একটি ধর্ম আছে, যার গুণে এই নিগূঢ় বিশ্বের প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া যায়— এই হচ্ছে রোমান্টিক দর্শনের মূল কথা। আর যে বস্তু যুক্তিতর্কের সাহায্যে জানা যায় না, তা যুক্তিতর্কের সাহায্যে অপরকে জানানো যায় না; তাই রোমান্টিক কবিরা নিজে যা অনুভব করছেন, অপরকে তা অনুভব করাতে চান। এ স্থলে ভাষার অর্থের চাইতে তার ইঙ্গিতের মূল্য ঢের বেশি।

ফরাসি রোমান্টিক সাহিত্যের ভাষার প্রলেপ তুলে ফেললে দেখা যায় যে, তার ভিতর রোমান্টিসিজমের খাঁটি মাল নেই।

রোমান্টিসিজ্‌ম ফরাসি জাতির ধাতুগত নয়। সুতরাং ফরাসি মনের উপর এ জোর-করা সাহিত্যের প্রভাব চিরস্থায়ী হল না। এই রোমন্টিসিজমের প্রতিবাদ স্বরূপেই ফ্রান্সের নব রিয়ালিজম জন্মগ্রহণ করে। কল্পনার পরিবর্তে রিজন ফরাসি সাহিত্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফরাসি রিয়ালিস্টরা তাদের জাতীয় বুদ্ধির অনুসরণ করে আবার সত্যের সন্ধানে বহির্গত হয়েছিল। এবং সে সত্য কুৎসিতই হোক আর বীভৎসই হোক, ফরাসি রিয়ালিস্টরা তার ব্যাখ্যা এবং বর্ণনা করতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হয় নি। রোমান্টিক দল ফরাসি সাহিত্যকে যা দান করে গিয়েছে, সে হচ্ছে অগাদ শব্দসম্পদ। রিয়ালিস্টদের নেতা ফ্লোবেয়র সেই নূতন উপাদান নিয়েই পুরাতন রীতিতে সাহিত্য গঠন করেছেন। এর ফলে ক্লোবেয়র এবং তাঁর শিষ্য মোপাসাঁর ন্যায় শিল্পী জগতের সাহিত্যে দুর্লভ।

যে বিরাট সৌন্দর্যে মানুষের মনকে স্তম্ভিত অভিভূত করে, যে সৌন্দর্য অতিজগতের আলো ও ছায়ায় রচিত, সে সৌন্দর্য ইংরেজি সাহিত্যে আছে, ফরাসি সাহিত্যে নেই। কিন্তু শিল্পের সৌন্দর্যে ফরাসি সাহিত্য অতুলনীয়।

আমি ফরাসি সাহিত্যের চর্চায় যে আনন্দ লাভ করেছি, সে আনন্দের ভাগ আপনাদের দিতে পারলুম না। সুতরাং সে সাহিত্য হতে যে শিক্ষা লাভ’ করেছি তারই পরিচয় দিতে চেষ্টা করেছি, যদি তাতে কৃতকার্য হয়ে থাকি, তাহলেই আমার সকল শ্রম সার্থক জ্ঞান করব।

৯.

আমি চাই যে আমাদের শিক্ষিতসমাজে ফরাসি সাহিত্যের সম্যক্ চর্চা হয়। আমার বিশ্বাস, সে চর্চার ফলে আমাদের সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হবে।

আমি বলেছি যে ইংরেজি সাহিত্য মুখ্যতঃ রোমান্টিক, এবং ফরাসি সাহিত্য মুখ্যতঃ রিয়ালিস্টিক। যে দুটি বিভিন্ন মনোভাব থেকে এই দুটি পৃথক্‌ চরিত্রের সাহিত্য জন্মলাভ করে, প্রতি জাতির মনে সে উভয়েরই স্থান আছে। কোন জাতি এর মধ্যে কোনটির উপর ঝোক দেন, তার উপরেই জাতীয় সাহিত্যের বিশেষত্ব নির্ভর করে।

প্রাক্‌ব্রিটিশ যুগের বাংলা সাহিত্যে দেখতে পাই দুটি পৃথক্ ধারা বরাবর পাশাপাশি চলে এসেছে : একটি সম্পূর্ণ সাজেটিভ, অপরটি সম্পূর্ণ অবজেটিভ। যে বাঙালি জাতির মন থেকে বৈষ্ণব পদাবলী জন্মলাভ করেছে, সেই বাঙালি জাতির মন থেকেই কবিকঙ্কণচণ্ডী ও অন্নদামঙ্গল জন্মলাভ করেছে। সুতরাং রোমান্টিক এবং রিয়ালিস্টিক উভয় সাহিত্যই আমাদের হৃদয়-মন সমান স্পর্শ করতে পারে। ইংরেজি সাহিত্য যেমন আমাদের মনের একটি দিক ফুটিয়ে তুলেছে, আমাদের মনের আর-একটি দিক আছে যা ফরাসি সাহিত্য তেমনি ফুটিয়ে তুলতে পারে।

ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে আমাদের সাহিত্যে যে কি সুফল জন্মেছে তা সকলেই জানেন; কিন্তু সেই সঙ্গে যে কি কুফল জন্মেছে তা সকলের কাছে তেমন সুস্পষ্ট নয়।

সংগীতের মত সাহিত্যও যে একটি আর্ট, এবং যত্ন ও অভ্যাস ব্যতীত এ আর্ট যে আয়ত্ত করা যায় না, এ সত্য আমরা উপেক্ষা করতে শিখেছি। ইংরেজি গদ্যের কুদৃষ্টান্তই এর একমাত্র কারণ। কেননা যে জাতির ক্ল্যাসিক্‌স ফরাসি সাহিত্যের বর্ণপরিচয় হচ্ছে সংস্কৃত, সে জাতির পক্ষে রচনার আর্ট সম্বন্ধে উদাসীন হওয়া স্বাভাবিক নয়।

একটি ইংরেজ লেখক বলেছেন—

The amateur is very rare in French literature-as rare as he is common in our own. (G. L. Strachey.)

ইংরেজি সাহিত্যের এই amateurishness আমরা সাদরে অবলম্বন করেছি, কেননা যেমন-তেমন করে যা-হোক-একটা-কিছু লিখে ফেলার ভিতর কোনোরূপ আয়াস নেই, কোনোরূপ আত্মসংযম নেই।

ফরাসি সাহিত্যের উপদেশ ও দৃষ্টান্ত দুইই লেখকদের সংযম অভ্যাস করতে শিক্ষা দেয়। কেননা সংযম ব্যতীত, কি মনোজগতে, কি কর্মজগতে, কোনো বিষয়েই নৈপুণ্য লাভ করা যায় না। সংস্কৃতে একটি কথা আছে যে ‘যোগঃ কর্মসু কৌশলং’। রচনা সম্বন্ধে এই কৌশল লাভ করতে হলে লেখকদের পক্ষে যোগ অভ্যাস করা দরকার। অবস্থা ও প্রকৃতি অনুসারে কোথাও বা হঠযোগ, কোথাও বা রাজযোগ। বাহুল্য আর ঐশ্বর্য, স্ফীতি আর শক্তি যে এক বস্তু নয়, এ সত্য ফরাসি সাহিত্য মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

তার পর সাহিত্যের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক যে কত ঘনিষ্ঠ, সে বিষয়েও উক্ত সাহিত্য আমাদের চোখ ফুটিয়ে দেয়। আমি পূর্বে বলেছি যে, ভাষা সাহিত্যের উপাদান, কিন্তু এ কথা শুধু আংশিক ভাবে সত্য। আসল সত্য এই যে, লেখকদের নিকট ভাষা একাধারে উপাদান ও যন্ত্র। আমাদের দেশে সর্ব শ্রেণীর শিল্পীরা বৎসরে অন্তত একবার যন্ত্রপূজা করে থাকে, একমাত্র একালের সাহিত্য-শিল্পীরাই তাঁদের যন্ত্রকে পূজা করা দূরে থাক্, মেজে-ঘষে পরিষ্কারও করেন না। ফরাসি সাহিত্য আমাদের এই যন্ত্রকে লঘু করতে, তীক্ষ্ণ করতে শেখায়। এ শিক্ষা আমরা সহজেই আত্মসাৎ করতে পারি, কেননা আমার বিশ্বাস, বাংলার সঙ্গে ফরাসি ভাষার বিশেষ সাদৃশ্য আছে। আমাদের ভাষাও মূলতঃ এক, এবং বিদেশি শব্দে তা ভারাক্রান্ত নয়। আমাদের ভাষার অন্তরেও ফরাসি ভাষার গতি ও স্ফুর্তি নিহিত আছে। বিদ্যাসুন্দরের ন্যায় কাব্যগ্রন্থ জর্মানের ন্যায় স্থূলকায় গুরুভার শ্লীপদ ও গজেন্দ্রগামী ভাষায় রচিত হওয়া অসম্ভব। আমার বিশ্বাস, ভারতচন্দ্র যদি ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করতেন তাহলে তাঁর প্রতিভা অনুকূল অবস্থার ভিতর আরও পরিস্ফুট হয়ে উঠত, এবং তাঁর রচনা ফরাসি সাহিত্যের একটি মাস্টারপিস বলে গণ্য হত।

আমরা যে-ভাষায় এখন সাহিত্য রচনা করি, সে ভারতচন্দ্রের ভাষা নয়; ইতিমধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের অনুকরণে আমরা সে-ভাষার গৌরব বৃদ্ধি করেছি, অর্থাৎ তার গায়ে একরাশ মুখস্থকরা শব্দ চাপিয়ে দিয়ে তার ভার বৃদ্ধি করেছি, তার গতি মন্দ করেছি। ফরাসি সাহিত্যের শিক্ষা আমাদের মনে বসে গেলে আমরা আবার বহুসংখ্যক পণ্ডিতি শব্দকে সসম্মানে বিদায় করব এবং তার পরিবর্তে বহুসংখ্যক তথাকথিত ইতর শব্দকে সাহিত্যে বরণ করে নেব। কেননা এই কৃত্রিম ভাষার চাপে আমাদের জাতীয় প্রতিভা মাথা তুলতে পারছে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *