বিষাদ মাতৃত্ব
সোহমের প্রফাইল খুলে ওর পুরোনো ছবিগুলো দেখছিল সঞ্চারী । সব কিছুই যেন বড্ড বেশী ফাঁকা লাগে আজকাল । নিজের কাছে নিজেই বড্ড বেশী বিরক্তির কারণ ।
সঞ্চারী সিনহা , বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট মৈনাক সিনহার স্ত্রী । বছর পাঁচেক হল বিয়ে হয়েছে । কোনো issue হয়নি । বালিগঞ্জে একটা ফ্ল্যাটে স্বামী – স্ত্রী’র সংসার ।মৈনাক অবশ্য সারাদিন ব্যস্ত থাকেন হসপিটাল – রুগি – সেমিনার এই সব নিয়ে । মাঝে মাঝে আবার বাইরেও যেতে হয় কয়েক দিন অথবা কয়েক মাসের জন্য ।
অগত্যা একলাই সময় কাটে সঞ্চারীর । সাথে Facebook , Instagram , twitter আর আসক্তি মুঠোফোন । খুব সুন্দর গানের গলা সঞ্চারীর । একদিন বৃষ্টির দিনে একটা গান নিজের গলায় post করলো । তারপর যা হবার ! Like – comment এর বন্যা বয়ে গেলো । তার মধ্যে থেকে একজন একদম অন্যরকম মন্তব্য করলো ।সোহম রজপুত ।লিখলো ম্যাডাম বেশ জং ধরেছে বোঝা যাচ্ছে । তবে শান দিলেই যে একদম ঝকঝকে হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য ।এভাবেই চলতে থাকে ওদের like – comment এর পালাবদল । ওরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করে messenger তারপর WhatsApp e . গাঢ় হতে থাকে ওদের ঘনিষ্ঠতা ।
সোহম ব্যাচেলার । গ্রামের ছেলে ।কর্মসূত্রে কোলকাতায় থাকে । সঞ্চারী দিন -দিন সোহমের প্রতি বড্ড বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়তে থাকে । তাকে গোগ্রাসে গিলে খাওয়া তার একলা জীবনে সোহমকে খর কুটোর মতো আঁকরে ধরতে চায় । হঠাৎ একদিন সোহম propose করে তাকে ।
সঞ্চারী আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় । তার মৌনতায় কেঁদে ফেলে সোহম । সঞ্চারী তৎক্ষণাৎ তার ভুল ভাঙিয়ে তাকে সাদরে গ্রহণ করে । সোহম তার সঞ্চারীকে কাছ থেকে দেখতে চায় । রাজী হয় সঞ্চারী । একদিন পড়ন্ত বিকেলে বেলুড়ে দেখা হয় দুজনের । লঞ্চ ঘাটে হাতে হাত ধরে দুজন । দমকা হাওয়ায় সঞ্চারীর চুলগুলো উড়ে ওর চোখ – ঠোঁট -চিবুক স্পর্শ করছিল । ওর perfumer মিষ্টি গন্ধটা মাতাল করছিল সোহমকে । হঠাৎ মেঘ করে এল । বৃষ্টি শুরু হল রিম ঝিমিয়ে । সোহম শক্ত করে ধরল সঞ্চারীর হাতটা । চল এই শহরের বুকে তোকে নিয়ে ভিজি একসাথে । চোখে জল এল সঞ্চারীর । এত ভালোবাসা সইবে তো? দূর পাগলি !তুই যে আমায় আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলেছিস রে তোর ভালোবাসায় । সঞ্চারী কাঁদতে কাঁদতে আছড়ে পড়ল সোহমের বুকে । দুজনেই ভিজে হাপুসুটি । ছাড় পাগলি , সবাই যে দেখছে । সঞ্চারী – না ছাড়ব না । সোহম – আচ্ছা বাবু চল এবার । দেখ পুরো ভিজে গেছি । জানিস তো আমার ঠান্ডা লাগার ধাত । আচ্ছা চল তবে । এই বলে সঞ্চারী ও সোহম রওনা দেয় ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে । বৃষ্টি ধরেছে খানিকটা । স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে দুজন । এই সময় একটা ফোন আসে সোহমের । সোহম একটু সরে যায় । এমন সময় সঞ্চারী লক্ষ করে একটা বাস দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে । আর দুটো বাচ্ছা ওদিকে না দেখেই রাস্তা পার হচ্ছে ।ছুটে যায় সে ।
ঠেলে সরিয়ে দেয় বাচ্ছাগুলোকে । কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারে না । গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পড়ে । মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে ।সোহমের কিছু বুঝে ওঠার আগেই এসব ঘটে যায় ।সে দৌড়ে যায় তার সঞ্চারীর কাছে । চিৎকার করে বলে , এটা কি করলি ? আমি তোর কিচ্ছু হতে দেবো না এক্ষুনি তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো । বলে পাগলের মতো করতে থাকে সে । সঞ্চারী কোনোরকমে ওর হাতটা চেপে ধরে বলে , সোনাই, আমি তো মা হতে পারিনি তবে ওই বাচ্ছা দুটোকে বাঁচিয়ে আমি ওদের মায়ের কোল খালি হতে দিইনি।সোহম রক্তাক্ত সঞ্চারীকে বুকে চেপে আর্তনাদ করে বলে ওঠে হ্যাঁ বাবু,তুই পেরেছিস।মাতৃত্বের পরীক্ষায় আজ তুই সেরা , তুই-ই সেরা ……