Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বিনিদ্র রজনীর গ্লানি-অরুণিত-নেত্ৰে উল্কা শয্যায় উঠিয়া বসিতেই একজন সখী আসিয়া বলিল–বৈশালী হইতে পত্ৰ আসিয়াছে-বলিয়া লিপি হস্তে দিল।

জতুমুদ্রা ভাঙ্গিয়া ক্লান্ত চক্ষে উল্কা লিপি পড়িল। শিবমিশ্র লিখিয়াছেন—

কন্যা, চণ্ডের মৃত্যু-সংবাদ পাইয়াছি, তোমার মাতৃঋণ শোধ হইল। কিন্তু শিশুনাগবংশ এখনও নিঃশেষ হয় নাই। স্মরণ রাখিও।

অন্যমনে পত্র ছিন্ন করিতে করিতে উল্কা পাংশু হাসিয়া বলিল—সখি, জানিস, পিতা একটি কথা ভুলিয়া গিয়াছেন। আমার দেহেও যে শিশুনাগবংশের রক্ত প্রবাহিত, এ কথা তাঁহার স্মরণ নাই।

সকলে উল্কাকে শিবামিশ্রেীর কন্যা বলিয়া জানিত, এই রহস্যময় কথার অর্থ বুঝিতে না পারিয়া সখী অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল।

উল্কা শয্যা ত্যাগ করিয়া বলিল-ভাল, তাহাঁই। হইবে। শেষ করিতে না পারি, শিশুনাগবংশকে ক্ষীণ করিয়া যাইব। কল্য রজনী যে সঙ্কল্প তাহার মনে ছায়ার মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, শিবামিশ্রের পত্রে তাহা দৃঢ় হইল।

স্নান সমাপন করিয়া উল্কা যথারীতি বেশভূষা পরিধান করিল। কিন্তু আজ তাহার প্রসাধনে উৎকণ্ঠা নাই, সখীরা যেমন সাজাইয়া দিল তেমনই সাজিল। একবার দর্পণে মুখ দেখিল—দেখিয়া নিজেই শিহরিয়া উঠিল। সে ভাবিয়াছিল, তাহার বুকের মধ্যে যে অগ্নি সারা রাত্রি জুলিয়াছে, তাহাতে তাহার রূপও পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছে। কিন্তু কই—দেহে তো তাহার একবিন্দু আঁচ লাগে নাই। বরং নয়নের অলস অরুণ চাহনিতে, গণ্ডের হিমশুভ্ৰ পাণ্ডুরতায়, সবাঙ্গের ঈষৎক্লান্ত শিথিলতায় যেন রূপ আরও অলৌকিক হইয়া উঠিয়াছে। বিষকন্যাদের বুঝি এমনই হয়, ভিতরের আগুনে রূপের বর্তিকা আরও উদ্দীপ্ত হইয়া উঠে।

প্রসাধন শেষ হইলে উল্কা একজন সখীকে দুইখানি তরবারি আনিতে আদেশ করিল। সখী বিস্মিতভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, কিন্তু প্রশ্ন করিতে সাহস করিল না, নিঃশব্দে প্রস্থান করিল।

তরবারি। আসিলে উল্কা তাহাদের কোষমুক্ত করিয়া পরীক্ষা করিল। তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল খরধার অস্ত্ৰ—উল্কা বাহুবল্লারী বিলোলিত করিয়া তাহদের ঊর্ধ্বে তুলিল; মনে হইল, যেন কক্ষের ভিতর এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল।

এতক্ষণে একজন সখী সাহসে ভর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল—প্রিয় সখি, আমাদের বড় ভয় হইতেছে, তরবারি লইয়া কি করিবে?

উল্কা অল্প হাসিল—মহারাজের অস্ত্ৰ-কৌশল পরীক্ষা করিব। তারপর গম্ভীর মুখে বলিল—আমি উদ্যানে যাইতেছি, তোমরা কেহ সেখানে যাইও না। যদি মহারাজ আসেন, তাঁহাকে বলিও আমি মাধবীকুঞ্জে তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতেছি। বলিয়া তরবারি হস্তে উদ্যান অভিমুখে প্ৰস্থান করিল।

সখীরা ভীতনির্বাক কাষ্ঠপুত্তলির মতো দাঁড়াইয়া রহিল।

মহারাজ সেনজিৎ মাধবীকুঞ্জের লতাবিতানতলে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, দুই হস্তে স্থির বিদ্যুতের মতো দুইখানি তরবারি লইয়া উল্কা দাঁড়াইয়া আছে, তাহার চোখে নবীন আষাঢ়ের দলিতাঞ্জন মেঘ, আসন্ন মহাদুযোগের প্রতীক্ষায় দেহ স্থির।

তিনি থমকিয়া দাঁড়াইলেন; উত্তপ্ত আরক্ত চক্ষু তরবারির প্রতি নিবদ্ধ হইল। বলিলেন—উল্কা, এ কি?

উল্কা রক্তধরে ক্ষীণ হাসিল, বলিল-এই আমার উত্তর।

কিসের উত্তর?

কাল যে কথা জানিতে চাহিয়াছিলেন, তাহার উত্তর।

সেনজিৎ অধীরপদে উষ্কার দিকে অগ্রসর হইয়া গেলেন। তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বজ্ৰগৰ্ভকণ্ঠে বলিলেন—উল্কা, আজ আবার এ কি নূতন ছলনা? হৃদয় লইয়া বার বার ক্রীড়া পরিহাস ভাল লাগে না-বল, কাল কেন আমাকে বঞ্চনা করিলে? আমাদের মিলনে কিসের বাধা?

তাঁহাই তো বলিতেছি মহারাজ। আমাদের দুজনের মধ্যে এই তরবারি ব্যবধান।

অৰ্থাৎ?

অর্থাৎ আমাকে অসিযুদ্ধে পরাজিত না করিলে লাভ করিতে পরিবেন না।

মহারাজ যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন, বলিলেন—সে কি?

উল্কা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল—ইহাই আমার বংশের চিরাচরিত প্রথা।

এইবার মহারাজের মুখে এক অপূর্ব পরিবর্তন হইল; মুহূর্তমধ্যে ক্লেশ-চিহ্নিত রেখা অন্তর্হিত হইয়া মুখ আনন্দের আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন—এই বাধা!—কিন্তু তুমি নারী, তোমার সহিত অস্ত্ৰ যুদ্ধ করিব কিরূপে?

উল্কা গ্ৰীবা বঙ্কিম করিয়া চাহিল—মহারাজ কি আমাকে অস্ত্রবিদ্যায় সমকক্ষ মনে করেন না?

সেনজিৎ হাসিলেন, বলিলেন—তাহা নয়। তোমার অস্ত্রবিদ্যার পরিচয় পূর্বেই পাইয়াছি, এখনও এ বক্ষ তোমার অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত। কিন্তু যদি আমি যুদ্ধ না করি?

তাহা হইলে আমাকে পাইবেন না।

যদি বলপূর্বক গ্রহণ করি?

তাহাও পরিবেন না, এই তরবারি বাধা দিবে।

ভাল—বাধা দিক—বলিয়া মহারাজ সহাস্যমুখে বাহু প্রসারিত করিয়া অগ্রসর হইলেন। কম্পিত স্বরে উল্কা বলিল—মহারাজ, কাছে আসিবেন না–নচেৎ–বলিয়া তরবারি তুলিল।

নচেৎ—? মহারাজ অগ্রসর হইয়া চলিলেন। তরবারির অগ্রভাগ তাঁহার বক্ষঃস্থল স্পর্শ করিল, তথাপি তাঁহার গতি রুদ্ধ হইল না। তখন উল্কা ক্ষিপ্ৰপদে সরিয়া গিয়া তরবারি নিজ বক্ষে স্থাপন করিয়া বলিল—আর অধিক আছে আসিলে এই আসি নিজ বক্ষে বিধিয়া দিব।

মহারাজ হাসিয়া বলিলেন—আমি জানিতাম, তুমি আমার বক্ষে আসি হানিতে পরিবে না—সেজন্য অন্য অস্ত্ৰ আছে–বলিতে বলিতে বিদ্যুদ্বেগে তিনি উল্কার হস্ত হইতে তরবারি কড়িয়া লইলেন, তাহার বাহু ধরিয়া কপট কঠোর স্বরে বলিলেন—আজ তোমাকে কঠিন শাস্তি क्रेिट्।

উল্কা কাঁদিয়া বলিল—নিষ্ঠুর! অত্যাচারী! তোমার কি কলঙ্কের ভয় নাই? অসহায়া নারীর উপর পীড়ন করিতে তোমার লজ্জা হয় না?

মহারাজ পরিতৃপ্ত হাস্যে তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া বলিলেন—না—হয় না। এবার এস, যুদ্ধ করি। বলিয়া একখানি তরবারি তুলিয়া লইয়া তাহার হাতে দিলেন।

এইবার উল্কা বুদ্ধি ভ্ৰষ্টের মতো সজল বিস্ফারিত নেত্ৰে চাহিয়া রহিল। সেনজিৎ কহিলেন—পাছে তুমি মনে কর, নারীর সহিত যুদ্ধ করিতেও আমি ভয় পাই—তাই আসি ধরিলাম। —এস। দ্বিতীয় তরবারি তুলিয়া লইয়া মৃদুহাস্যে বলিলেন—কিন্তু উল্কা, যদি সত্যই তোমার হাতে পরাজিত হই? তবে আর তুমি আমার হইবে না?

উল্কার অধর কাঁপিতে লাগিল, সে উত্তর দিতে পারিল না। মনে মনে বলিল—আর না, আর না! এত লোভ আমি সংবরণ করিতে পারিব না। আমাকে মরিতে হইবে।–মরিতে হইবে। —কিংবা যদি পরাজিত করিতে পারি—পারিব কি?

অসংযত কণ্ঠস্বর সবলে দৃঢ় করিয়া উল্কা বলিল—প্ৰতিজ্ঞা করুন, পরাজিত হইলে আর আমাকে সম্পর্শ করিবেন না?

ঈষৎ গর্বের সহিত সেনজিৎ বলিলেন—প্ৰতিজ্ঞা করিলম, যদি পরাজিত হই। কখনও স্ত্রীজাতির মুখ দেখিব না।

তারপর সেই মাধবীবিতানতলে দুই প্রেমোন্মাদ নরনারীর অসিযুদ্ধ আরম্ভ হইল। পুরুষ যুদ্ধ করিল নারীকে লাভ করিবার জন্য, আর নারী যুদ্ধ করিল। তাহাকে দূরে রাখিবার জন্য। উভয়ের হৃদয়েই দুর্দম ভালবাসা, উভয়েই জয়ী হইতে চায়। এরূপ যুদ্ধ জগতে বোধ করি আর কখনও হয় নাই।

অসিযুদ্ধ আরম্ভ করিয়া সেনজিৎ দেখিলেন, উল্কার অসি-শিক্ষা অতুলনীয়। তাহার হস্তে ঐ অসিফলক যেন জীবন্ত বিষধরের মূর্তি ধারণ করিয়াছে। সেনজিৎ সাবধানে সতর্কভাবে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। শুধু বিজয়ী হইলে চলিবে না, উল্কার বিরতনু অনাহত অক্ষত রাখিয়া তাহাকে পরাস্ত করিতে হইবে।

কিন্তু উল্কার হাত হইতে ঐ বিদ্যুৎশিখাটাকে কাড়িয়া লওয়াও অসম্ভব। তিনি লক্ষ্য করিলেন, উল্কাও অপূর্ব নিপুণতার সহিত তাঁহার দেহে আঘাত না করিয়া তাঁহাকে পরাস্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে; আঘাত করিবার সুযোগ পাইয়াও আঘাত করিতেছে না। বায়ু-কম্পিত পুষ্পের চারিপাশে লুব্ধ ভ্ৰমরের মতো উল্কার অসি তাঁহার দেহের চতুর্দিকে গুঞ্জন করিয়া ফিরিতেছে।

এইভাবে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলিল। সেনজিৎ বুঝিলেন, সহজ পন্থায় উল্কাকে পরাজিত করিতে সময় লাগিবে। তাহার দেহে এখনও ক্লান্তির চিহ্নমাত্র দেখা যাইতেছে না, নিশ্বাস স্বাভাবিকভাবে বহিতেছে; কেবল নাসাপুট অল্প স্ফুরিত হইতেছে মাত্র। তখন তিনি মনে মনে হাসিয়া এক কৌশল অবলম্বন করিলেন।

সহসা যেন অসাবধানতাবশতঃই তাঁহার একটু পদস্থলন হইল। উল্কার অসির নখ তাঁহার বক্ষের নিকট আসিয়াছিল, পদস্থলনের ফলে পঞ্জরে একটা অচিড় লাগিল। উল্কা সত্ৰাসে নিশ্বাস টানিল, তাহার তরবারির বিদ্যুৎগতি সঙ্গে সঙ্গে শিথিল হইল। সেই মুহূর্তে মহারাজ সেনজিৎ এক অপূর্ব কৌশল দেখাইলেন, তাঁহার অসি উল্কার অসির সঙ্গে জড়াইয়া গেল, তারপর তিনি উর্ধর্বদিকে একটু চাপ দিলেন। অমনি উল্কার হস্তমুক্ত আসি উড়িয়া গিয়া দূরে পড়িল।

মহারাজ বলিলেন–কেমন, হইয়াছে?

বিস্ময়-বিমূঢ় মুখে সভয়ে দ্রুত পন্দিতলক্ষে উল্কা চাহিয়া রহিল; তারপর থরথর-দেহে কাঁপিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল। এক দিকে নিজ দেহ-মন প্রিয়তমের বুকের উপর নিঃশেষে বিসর্জন করিবার দুনিবার ইচ্ছা, অপর দিকে প্রিয়তমের দৃষ্টির সম্মুখ হইতে নিজেকে নিশ্চিহ্ন করিয়া মুছিয়া ফেলিবার বাসনা—অন্তরের মধ্যে এই সূরাসুর দ্বন্দ্ব যখন চলিতে থাকে, তখন নারীর কাঁদিবার শক্তিও। আর থাকে না। তখন গর্ব ও দীনতা, আকাঙক্ষণ ও নৈরাশ্য, চরম ব্যর্থতা ও পরম সিদ্ধি একসঙ্গে মিশিয়া প্ৰেম-নিমথিত নারীচিত্তে যে হলাহল উখিত হয়, তাহা বোধ করি এ জগতের বিষকন্যারাই আকণ্ঠ পান করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে পারে।

উল্কা দুই বাহুতে ভর দিয়া নতমুখে বসিয়া রহিল। সেনজিৎ তরবারি ফেলিয়া তাহার পাশে নতজানু হইয়া বসিলেন, পৃষ্ঠে হস্ত রাখিয়া স্নেহ-ক্ষরিত কণ্ঠে বলিলেন—উল্কা, আর তো বাধা নাই।

শুষ্ক চক্ষু তুলিয়া উল্কা বলিল—না, আর বাধা নাই।

দীর্ঘকাল সে অপালক দৃষ্টিতে মহারাজের মুখ নিরীক্ষণ করিল, যেন রাক্ষসীর মতো তাঁহার প্রতি অবয়ব দুই চক্ষু দিয়া গিলিতে লাগিল। মহারাজও মুগ্ধ তন্ময় হইয়া উল্কাকে দেখিতে লাগিলেন। তাঁহার মুখ হযোৎফুল্ল-বক্ষে রোমাঞ্চ। তিনি ভাবিলেন—প্রেম। এত মধুর! এত দিন জানিতাম না, উল্কা, তুমি আমাকে ভালবাসিতে শিখাইলে! উল্কা-প্রেয়সী!

উল্কার চোখের দৃষ্টিতে যে কত কি ছিল, মহারাজ তাহা দেখিতে পাইলেন না। উল্কা তখন ভাবিতেছিল-পাইলাম না—পাইলাম না! প্ৰিয়তম, তোমাকে পাইয়াও পাইলাম না!

কুঞ্জ-বাহিরে উৎকণ্ঠিত সখীর কঙ্কণধ্বনি শুনিয়া দুজনের বাহ্য চেতনা ফিরিয়া আসিল। উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইল; চোখ দুটি মহারাজের মুখের উপর পাতিয়া একটু হাসিল। তারপর অনুচ্চ অতি অস্ফুট স্বরে বলিল—আজ নিশীথে বাসকগৃহে আমি মহারাজের প্রতীক্ষা করিব।

দীপের তৈল ফুরাইয়া আসিতেছে; আকাশে চন্দ্ৰও ক্ষয়িষ্ণু। বিষকন্যা উল্কার বিষাদগ্ধ কাহিনী শেষ হইতে আর বিলম্ব নাই।

নিশীথ প্রহরে মহারাজ আসিলেন। উল্কা পুষ্প-বিকীর্ণ বাসকগৃহের মধ্যস্থলে একাকী দাঁড়াইয়া ছিল। তাহার হস্তে এক গুচ্ছ কমল-কোরক।

সেনজিৎ তাহাকে দুই বাহু দিয়া জড়াইয়া লইলেন। কমল-কোরকের গুচ্ছ উভয়ে বক্ষের মাঝখানে রহিল।

উল্কা—প্ৰণময়ি–বিপুল আবেগে উল্কার বিরতনু মহারাজ বক্ষে চাপিয়া ধরিলেন। তাঁহার বক্ষে ঈষৎ বেদনা অনুভূত হইল। ভাবিলেন—আনন্দ-বেদনা!

উল্কা তাঁহার বক্ষে এলাইয়া পড়িল, মধুর হাসিয়া বলিল—প্রিয়তম, তোমার বাহুবন্ধন শিথিল করিও না। এমনিভাবে আমায় মরিতে দাও।

সেনজিৎ তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন; পূর্ণ মিলনের অন্তরায় কমল-কোরকগুলি ঝরিয়া পড়িল। তখন মহারাজ দেখিলেন, সূচীবৎ তীক্ষ্ণ ছুরিকা উল্কার বক্ষে আমূল বিদ্ধ হইয়া আছে। তাঁহারই বক্ষ-নিষ্পেষণে ছুরিকা বক্ষে প্রবেশ করিয়াছে।

সেনজিৎ উন্মত্তের মতো চিৎকার করিয়া উঠিলেন—উল্কা! সৰ্ব্বনাশী! এ কি করিলি?

উল্কা তাঁহার কণ্ঠ জড়াইয়া ধরিয়া অনির্বচনীয় হাসি হাসিল, বলিল—এখন অন্য কথা নয়, শুধু ভালবাসা। প্ৰিয়তম, আরও কাছে এস, তোমাকে ভাল দেখিতে পাইতেছি না।

সেনজিৎ তাহাকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া বলিলেন—কিন্তু কেন—কেন উল্কা? কেন এমন করিলে?

উল্কার মুখের হাসি ক্রমশ নিস্তেজ হইয়া আসিল, চোখ দিয়ে দুই বিন্দু জল গড়াইয়া পড়িল —সে অতি ক্ষীণ নিবাপিত স্বরে বলিল–প্ৰাণাধিক, আমি বিষকন্যা—

সেবারে শিবামিশ্রের প্রতিহিংসা পূর্ণ সফলতা লাভ করিল না। সার্ধশত বৎসর পরে একজন কুটিল ব্ৰাহ্মণ তাঁহার প্রারব্ধ কর্ম সমাপ্ত করিয়াছিলেন।

বহুদূর অতীতের এই বিয়োগান্ত নাটিকায় আমি–এই জাতিস্মর—কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছিলাম, তাহা উল্লেখ করি নাই; করিবার প্রয়োজনও নাই। হয়তো বিদূষক হইয়া অবতীর্ণ হইয়াছিলাম, হয়তো রাজটীকা ললাটে ধারণ করিয়াছিলাম, কিংবা হয়তো শৃগালের দংষ্ট্রক্ষিত গণ্ডে বহন করিয়াছিলাম। পাঠক যেরূপ ইচ্ছা অনুমান করুন, আমি আপত্তি করিব না।

শুধু একটা প্রশ্ন এই সংস্কার-বর্জিত বিংশ শতাব্দীতে বসিয়া মাঝে মাঝে মনে উদয় হয়। উল্কা যদি প্রিয়প্রাণহন্তী বিষকন্যাই ছিল, তবে সেনজিৎ না। মরিয়া সে নিজে মরিল কেন।

৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪২

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 6 of 6 ): « পূর্ববর্তী1 ... 45 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *