বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 5
মাসীমা চলতে চলতেই বলতে লাগলেন। তার সার কথা হল, দেবতারা ছুটলেন বিষ্ণুর কাছে, কারণ ব্রহ্মার বর ফেরানো যাবে না।ব্রহ্মা ও দেবতাদের সঙ্গে চললেন। বৈকুন্ঠ ধামে পৌঁছে দেবতারা মুগ্ধ! কি সুন্দর বাতাবরণ! চার দিকে শান্তি বিরাজমান। বৈকুন্ঠপুরী মনিমুক্ত সুশোভিত ও সজ্জিত। দেবতারা ভেতরে প্রবেশ করতে পারলেন না।দ্বার রক্ষী ভেতরে যেতে দিল না।তখন সমস্ত দেবতারা কান্না কাটি শুরু করে দিলেন। কান্না শুনে শঙ্খ, চক্র, গদা ,পদ্মধারী শ্রী বিষ্ণু ছুটে এলেন ভক্তের কাছে। ব্রহ্মাকে প্রশ্ন করলেন, কেন তাঁরা বৈকুন্ঠ পুরী এসেছেন। ব্রহ্মা সব কিছুই খুলে বললেন তাঁকে।বিষ্ণু আশ্বাস দিলেন দেবতাদের। বিষ্ণু তার দ্বাররক্ষী সুমুখকে শাস্তি হিসাবে হিরণ্য কশিপুর পুত্র করে পাঠাবেন, তা বললেন। এও বললেন যে সেই পুত্র প্রহ্লাদের দ্বারাই পিতার বিনাশ হবে। মেশোমশায় বেশ গর্ব ভরেই মাসীমাকে দেখতে দেখতে বললেন———- সে তো বুঝলাম, কিন্তু ঐ সুমুখ এর শাস্তি হল কেন? ———- বাহ্। দেবতাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি যে। তুমি বড্ড বাধা দাও।কি যেন বলছিলাম ? আমি ধরিয়ে দিলাম—— ঐ যে প্রহ্লাদের জন্ম! ———- হ্যাঁ। জন্ম থেকেই প্রহ্লাদ দেব শিশু। ।সে বলতে লাগল যে বিষ্ণুই তার বাবা আর মা লক্ষ্মী দেবী।যতই শেখান হোক না কেন নারায়ণ ছাড়া কিছুই জানে না।বলে এ জগতে নারায়ণ ছাড়া কেউ ।বড় নয়।বিষ্ণুর নামে মোক্ষ লাভ। মাসীমার চোখের তারায় সেই বিশ্বাসের আভা ফুটে উঠেছে।মুহূর্তের জন্য আমিও বিভোর হয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম ,মনমস্কার নমঃ বিষ্ণু।নমঃ বিষ্ণু। নমঃ বিষ্ণু।পার উতার নারায়ণ। হে জগৎতাড়ন পার উতার। এই সমাজের রাক্ষস কুলের উপদ্রব থেকে মুক্তি দাও। মোক্ষ চাই না। শান্তি দাও। সততা দাও। সচ্ছতা দাও। দয়া দাও।যাতে অন্য কে সাহায্য করতে পারি। মনে ভাবি প্রহ্লাদকে যখন সমুদ্রে নিক্ষেপ করে পাহাড় চেপে মারতে চেয়েছিল হিরণ্য কশিপু, তখন বিষ্ণুর বরে দেখা গেল প্রহ্লাদ সমুদ্রে এক প্রাসাদে যোগাসনে বসে আছেন। আর তার বুকে নারায়ণ। সৃষ্টি কর্তা, পালন কর্তা, আর রক্ষা কর্তা, সবই তিনি। দয়াময় দয়া করেছেন সমস্ত প্রাণীকূল কে। মেশোমশায়ের ডাক শুনে আমার ঘোর কেটে গেল। ——–কেষ্টা, তুমি যে কাপ্পা স্তম্ভম এর কথা বলছিলে তাও নাকি পুজো পায়? মাসীমা বললেন——— তা হবে না?প্রহ্লাদ নারায়ণকে বলেছিলেন যে তিনি ঐ স্তম্ভম এই থাকবেন। যখন প্রহ্লাদকে হিরণ্য কোশীপুর বলে —–ঐ স্তম্ভম এর তোর নারায়ণ কে দেখাতে পারিস? এই বলে প্রহ্লাদের চুলের মুঠি এক হাতে আর অন্য হাতে আঘাত হানলেন ঐ স্তম্ভম এ।স্তম্ভে চিড় ধরল। আর সেই চিড় থেকেই বেড়িয়ে এলেন মহাপুরুষ নরসিংহ অবতার। ভীষণ নাদে কেঁপে উঠল প্রাসাদ। আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে নরসিংহ এর চোখ থেকে।হিরণ্য কোশীপুর নানা রুপ বদল করে চলেছে। হিরণ্য কোশীপু সমানে রুপ বদল করে চলেছে।বিষ্ণু ও সমানে যুদ্ধ করেছে। এ ভাবেই একশত বছর চলেছে।তারপর এই সিমহাচলম পাহাড়েই যুদ্ধ শেষ হল।বিষ্ণু বরাহ রুপে তাঁর জঙ্ঘার ওপর হিরণ্য কশিপুকে ফেলে নখের দ্বারা পেট চিরে ফেলে।সেই থেকেই সিমহাগিরিতে দেবতা বিষ্ণু বরাহ নরসিংহ রুপেই পূজা পান। কাপ্পা স্তম্ভ ও পূজো পায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম নারদ মুনি ভগবান বিষ্ণুর নানা অবতারের গুন গেয়ে বেড়াচ্ছিলেন এক স্বর্গীয় নগরের গাঁথা।মন্দিরের চূড়ো সোনার। তার চার দিকে সাগর জলে ফেননীভ ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে।বাগানে সুবাসিত ফুলের সুশীতল বায়ু খেলে। সেখানেই উৎসব হবে। তাঁর নরসিংহ অবতারকে সেবা করার খুব ইচ্ছা।কিন্তু নরসিংহ দেবের ভয়াবহ রুপ দেখে ভয় পেয়ে যান সে কথা ব্রহ্মাকে বলেন। ব্রহ্মার কথা শুনে নারায়ণ বললেন ,হিরণ্য কশিপুকে বধ করতে ওই রকম ভয়ঙ্কর অবতারের দরকার ছিল। কিন্তু এখন তিনি চান সিমহাগিরিতে তাঁর শান্তিময় অবস্থান হোক। আরও বলেন—“-চৈত্র একাদশী তে যারা আমাকে মন দিয়ে ডাকবে তারাই মোক্ষ লাভ করবে”। এরপর এল কলিযুগ। অধর্ম ছেয়ে গেল। নরসিংহ দেব ও অন্তর্ধ্যান করলেন।” অ্যান্ট হিল” ঢেকে দিল নরসিংহ দেবকে। বহুকাল পর চন্দ্র বংশের সম্রাট পুরুরবা উদ্ধার করেন নরসিংহ দেবকে। সমাধিতে ছিলেন তিন দিন। তাকেই স্বপ্নে দেখা দিলেন বরাহ নরসিংহাবতার। বললেন—— তোমার সামনেই আমি আছি।আমার পূজা কর।মধু,ঘি,দুধ, দই, চিনি আর পবিত্র জল দিয়ে আমায় স্নান করাও।নববস্ত্র, মালা চন্দন, গন্ধবস্তু দিয়ে আমায় সাজাও।কিন্তু আমায় সারাবছর চন্দন প্রলেপ দিয়ে লিপে রেখ।এ ভাবেই আমার পূজা কর।পর বৎসর আবার স্নান করিয়ে চন্দনের প্রলেপে মুড়ে দিও আমায়।কথাটা বলেই নরহরি হারিয়ে গেলেন। সেই থেকেই চৈত্র মাসের একাদশী তিথিতে চন্দন যাত্রা চলছে। পুণ্য ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে সিমহাচলম। লাইন ধরে এগোতে লাগলাম। দরজায় টিকিট চেকিং হল। ঘেরাটোপের মধ্যেই চলেছি।আমাদের ডানে বিশাল দরদালান। একেবারেই পাক খেয়ে গেছে দেব মন্দির কে। যত্র তত্র ঘোরার উপায় নেই কারণ আমরা ঘেরাটোপে।কল্যাণ মন্ডপ দাঁড়িয়ে আছে ছিয়ানব্বইটা স্তম্ভের উপরে। বিষ্ণুর প্রতিমূর্তি খোদাই করা।কারুকাজ বিষ্ণু পুরাণের ঢং এর।চূড়োর গঠন বুরজাকৃতি। ফুলের অলঙ্করণ আর দৃশ্যাবলীর প্রয়োগ বৈষ্ণব পুরাণের ঢংএ র।লক্ষ্মীমন্দিরে প্রণাম করলাম। গম্বুজাকৃতি চূড়ো সে মন্দিরের। মেশোমশায় বললেন—— কেষ্টা কালো পাথর গ্র্যানাইট মনে মনে হচ্ছে? মাসীমার গলা শুনলাম——— আমি কাপ্পা স্তম্ভম জড়িয়ে ধরব। মেশোমশায় মাসীমার কানে কানে বললেও সে কথা আমার কানে এল।মাসীমার আরক্ত মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। নাট্য মন্ডপের কাছে যেতেই আমার চোখ খুঁজে চলেছে কাপ্পা স্তম্ভ কে।যেখান থেকে বিষ্ণুর নরসিংহ অবতার বেড়িয়ে এসেছিলেন। বাইরের থেকেই প্রণাম করছে সবাই। ঘেরাটোপে চলতে চলতেই বাঁ হাতে দেখলাম বিশাল এক স্তম্ভ।স্তম্ভের নিচের দিকে উন্মুক্ত। উপর দিকে কাপড় জড়ানো।চলতে চলতে পৌঁছলাম সেখানেই যেখানে বরাহ নরসিংহ স্বামী বিরাজিত। বরাহ নরসিংহর দু’হাত ও মাথা বরাহের। দেহ মানুষের, লেজ সিংহের। ত্রিভঙ্গ রুপে দন্ডায়মান। আলো আঁধারের দেখলাম দূর থেকেই। চন্দনের পরতে মোরা তিনি।এখন নিত্য রুপে আছেন। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন নিজ রুপে দেখা দেন ভক্ত দের। এরপর স্নান করিয়ে আবার সিল্ক শাড়ির পরতে পরতে চন্দনে ঢাকা পড়ে যান। ।এ ভাবেই তাকে নিজ রুপ থেকে নিত্য রুপে ফেরানো হয়। পুরোহিত সোনার মুকুট আমাদের সবার মাথায় ছুঁইয়ে দিলেন। মাসীমা দারুণ খুশি। মন্দাকিনী বলল—–শাড়ির ওপরে চন্দনের প্রলেপ কেন ? উত্তরে অন্য কথা বললাম———- ভয়াবহ রুপ দেখে যদি প্রণাম করতে মন না চায় তাই আসল রুপ চন্দনে ঢেকে রাখা। মন্দাকিনী বলল——– এটা কি তোমার কথা? বললাম———- না।বই ঘেটে বার করেছি।জড়িয়ে ধরলে নাকি মনের আশা মেটে।কেউ কেউ বলেন বরাহ নরসিংহাবতারের রাগ কমাতেই চন্দনের প্রলেপ। রোগ সারাবার অসীম ক্ষমতা এই স্তম্ভম এর।
বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 6
বাঁয়ে কাপ্পা স্তম্ভম ।জড়িয়ে ধরলে নাকি সব রোগ দূর হয়,মনের আশা মেটে। অনেকেই দেখলাম স্তম্ভ কে দু হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। রোগ সারাবার নাকি অসীম ক্ষমতা রয়েছে কাপ্পা স্তম্ভের। হবে না কেন? স্বয়ং হরি যে স্তম্ভের থেকে বের হয়ে এসেছেন, তা কি যেমন তেমন স্তম্ভ? মেশোমশায়কে বললাম—কেউ কেউ বলেন ভেলা-নন্দুর রানী নরসিংহ এর মূর্তি সোনা দিয়ে মুড়ে দেন ।সেই মূর্তিকে চন্দনের প্রলেপে ঢাকা হয়েছে। কারও কারও মতে এক হাজার আটানব্বই ,কি-নিরানব্বইতে চোল রাজার কলিঙ্গ বিজয়ের সময় এই মন্দির তৈরি হয়।সী–লেবেল থেকে আটশো ফুট ওপরে “দেবস্থানম”। মেশোমশায় বলেন—–চন্দন মুড়ে রাখা কি সোনা চুরির ভয়ে? আমি হাসলাম ।বললাম অন্য কথা।——- আগে রাজারা দেখভাল করত।এখন “দেবস্থানম” চালায় । তিরুপতির পরই সিমহাচলম এর স্থান। ভাল অর্থের জোগান হয় এখানে ।বিশাল জমি জমা দেবস্থানম এর। মেশোমশায় আশ্চর্য হয়ে বললেন——তার মানে সবই ভক্তের থেকে আমদানি। ———এ সবই আছে। সোনা ছাড়া ও নানা রকম রত্ন ভান্ডার এখানে আছে।দশ মাইল দূরে একসময় গোলাপ বাগ ছিল। বিজয় নগরের রাজারা ছিল সেই গোলাপ বাগের রক্ষক। সেই গোলাপ বাগের তখনকার দিনের আয় ছিল তাক লেগে যাবার মত। মন্দাকিনী বলল——কত আয়? বললাম—–তখনকার দিনের তিরিশ হাজার টাকা। ভাবতে পার তখনকার তিরিশ হাজার টাকার কত টাকার তখন কত দাম ভাবতে পার? মেশোমশায় বললেন—–সেকি গো?সে সময়ের তিরিশ হাজার তো অনেক টাকা!!! বললাম—–হ্যাঁ, শুধু তাই না।মন্দিরের পথে উপত্যকায় রকমারী ফলের গাছ ছিল। মন্দাকিনী বলল——–তখন ওদের খুব কষ্ট ছিল। অত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হত। বললাম——-ঠিক বলেছ। হাজার সিঁড়ি বেয়ে ওদের ওপরে উঠতে হত।পথে জলাধার ও ছিল। সেখানেই যাত্রীরা হাতমুখ ধুয়ে, পরিচ্ছন্ন হত। মন্দা বলল—–কি দারুণ। ইস্ আমার ও ইচ্ছা করছে সেই জলাধার দেখতে। বললাম—–‘চন্দন যাত্রার সময় আলোর মালায় সাজান হত সিঁড়ির দুপাশ। মন্দির থেকে বেড়িয়ে একটা চত্বরে পড়লাম আমরা। মোজেক করা বারান্দায় অনেকে বসে আছেন। দেখে মাসীমা ও বসলেন। জাঁক করে একটা সিগারেট ধরালেন মেশোমশায়।আমায় বললেন——- যাও না মন্দা কে নিয়ে একটু এদিক ওদিক ঘুরে এস। আমাকে উশখুশ করতে দেখেই হয়তো বললেন। কিন্তু মাসীমা বাধ সাধলেন। বললেন——-মন্দা কোথায় যাবে? বেগতিক দেখে মন্দা বলল—–বাবা টাকা দাও,কিছু কিনবো না? মেশোমশায় হাজার টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন——-যা চায় কিনে দিও। মনে মনে হাসলাম আমি।মেয়ের বুদ্ধির কাছে মাসীমার রোক টোক আর কাজে লাগল না।বাধ্য হয়েই মেনে নিলেন তিনি। এত সকালে পসরা সাজিয়ে বসেছে সিঁড়ির দুপাশে । কি না সাজিয়ে বসেছে!পুঁতীর মালা,ঝুটো পাথরের হার, কাসা পিতলের রকমারি পসরা। সবই নেড়ে চেড়ে ঘেটে দেখছে সেই মেয়ে।রাজ্যের বিস্ময় ওর চোখে। এই মেয়ের চোখের চাহনি দেখে আর একজনের কথা মনে পড়ে গেল। বাড়িতে ফেরিওয়ালা আসত। তার পসরা সাজান থাকত একটা কাঠের বোর্ড-এ। সেটা বুকে ঝুলিয়ে ফেরি করত। অনু পরম বিস্ময়ে চেয়ে থাকত সেই বাক্সের ভেতরের কানের দুল,মাথার ফিতের দিকে। দরে না পোষালে ফেরী ওয়ালা ফিরে গেলে অনু থুতু ফেলে লাফ দিয়ে ডিঙ্গতো।বলতো——এমন করলে ফেরি ওয়ালা ওগুলো আমাদের দিয়ে যাবে। মনটা ভার হয়ে গেল অনুর কথা ভেবে।ওদের পয়সার অভাব ছিল। কিন্তু একটা শিশু মনের চাহিদা গুলো পূরণ করার সময় পয়সার কথা মনে থাকে না।অনু আজ নেই।ছোট্ট বোনের চাহিদা মেটাতে না পারার কষ্ট কুড়ে খাচ্ছে মনটাকে। চমক ভাঙলো দোকানির চিৎকারে। মন্দা এখন ও পরম আদরের সঙ্গে একটা ঝুঠো পাথরের নেকলেস দেখছে। একবার রাখছে আবার সেটা হাতে নিয়ে পরখ করছে।এ ক্ষেত্রে অনুর সঙ্গে মন্দার কোন পার্থক্য নেই। মনে ধরেছে তা বুঝলাম। আবার রেখে দিল কিন্তু মন যে সেই নেকলেস এ পড়ে আছে তা বুঝলাম ওর নজর ঘুরে ফিরে সেই নেকলেস এ যাচ্ছে দেখে। এ ব্যাপারে বড়লোক আর গরীব লোকে কোন পার্থক্য নেই। সব মেয়েই এক। এই দোকানে ভীড় একটু বেশি।কেনার থেকে দেখার আগ্রহ টা ওদের বেশি।একেবার দেখে নেওয়া,যদি কোন অমূল্য রতন চোখে পড়ে!সাগর সেচে মুক্ত নেবার মত চোখ খুঁজে ফেরে সেই বস্তুটিকে।যেটা কেউ ব্যবহার করেনি।একেবারেই নতুন ঢং এর।দামে কম কিন্তু তাক লেগে যাবার মতো নজর। সামনে বাঙ্লা ভাষা শুনে সে দিকে ফিরলাম। স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে তাদের ছেলে। কানে এলো মহিলার স্বর——–না,তুমি হাজি বাজি জিনিস নিবা না। ছেলের মা,ছেলের বাবার গরবে গরিয়সী।যাকে নিয়ে গরব তিনি কিন্তু খাঁটি বাঙালি।একরত্তি বিদেশীয়ানা নেই তাঁর পোষাকে আশাকে।অথচ সেই মহিলার দেশীয়ানা নৈব নৈব চ।তবুও বলতেই হয় স্বদেশ কে তিনি ছাড়েন নি।ছাড়তে পারেননি এখনও। নইলে কি অমন ভাষা শুনতাম!——–“না।তুমি হাজি বাজি গাড়ি নিবা না।” তবে ঐ শ্রীময়ীর পেন্সিল পয়েন্টেড হিল জুতোর সঙ্গে জিনস, হোয়াইট টপ যেমন মানান সই।তেমন ওর ঐ বরিশালের ভাষা,বেমানান হলেও আমার দারুণ লাগছে শুনতে। কারণ আমার বাবা একেবারেই ক্যালকেশিয়ান হলেও মায়ের দেশ বড়িশাল।বাবা পছন্দ করতেন না বলেই মা দেশের ভাষা বলতেন না।তবে মনে আছে শিশুকালে আমায় আদর করার মায়ের বুলিটা বরিশালের ই ছিল। আমার ভেতরে যখন তির তির করে ভক্তিরস উছলে পড়ছিল। ঠিক তখনই টের পেলাম। আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে। ———– কৃষ্ণ দা।ও কৃষ্ণ দা।কোথায় যাচ্ছ? পিছু ফিরতেই বুঝলাম কে ডাকছে। চারদিক চেয়ে দেখলাম। অনেক টা চলে এসেছি।সেই স্বামী-স্ত্রী তাদের ছেলে নিয়ে অনেক টা এগিয়ে গেছে।ওদের সঙ্গেই এগিয়ে এসেছি।আমার মন!তার কথা কি করে ভুলে গেলাম। এমনটা তো হবার কথা না!!! হয়তো মায়ের কথা মনে পড়তেই মন্দাকিনী আমার মন কে স্পর্শ করতে পারেনি।মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা বাড়ি থাকতেন না যে সময়টা,সে সময়টা আমার টুষ্টুমী করার সময়।তাতে আমার মায়ের রাগ হতো না।সেটা আমি বুঝতাম। তাই দুষ্টমীর রকমারী নমূনাগুলো মাকে দেখাতাম। মা আমায় আদর করে বলতেন——– আমার ডাকা বুকা পোলাটা। ভাবলে আশ্চর্য হই যে ঐ “ডাকা বুকা ” কথাটা মা কখনও বাবার সামনে বলতেন না।তখন মাকে দেখে মনে হতো মা জোর করে কিছু করছে। ঐ কচি বয়সেই আমার মায়ের জন্য কষ্ট হত। আবার চোখ পড়ল মন্দাকিনীর দিকে। হাত নাড়ল পা চালালাম ওর দিকে। মনে মনে আমার মাকে সযত্নে তুলে রাখলাম মায়ের সেকালের কাশ্মীর সিল্ক শাড়ির সঙ্গে।সেই পুরনো তোরঙ্গে। যেটায় মায়ের দু’খানা শাড়ি এখনও রয়েছে।একখানার রঙ নীল, তাতে সাদা হংসরাজ। অন্য খানা কচি সবজে রঙ এর নানা রঙ এর জলছাপের কারুকাজ। সেই দু’খানা শাড়িই রয়েছে মায়ের তোরঙ্গে। মাঝে মাঝেই সেই তোরঙ্গ খুলি আর মায়ের আদরে মাখামাখি হয়ে যাই। মন্দাকিনী ভ্রু-ভঙ্গী করে বলল———- এই যে কবি মশায়, ভাবের ঘোরে কার সঙ্গে চলছিলে?দেখো, আমায় যেন হারিয়ে ফেল না। মনে ভাবি, তোমায় হারাবার!সে সাধ্য আমার কি আছে! বললাম অন্য কথা। —– পছন্দ হল কিছু? সেই মেয়ে বলল——— দেখার আর সময় পেলাম কই?আমি তো শুধু তোমাকেই দেখে চলেছি তখন থেকে। লজ্জা পেলাম , ভাবলাম তাই যেন হয়। সারাজীবন তুমি শুধু আমাকেই দেখ। মুখে অন্য কথা বললাম—–হঠাৎ এমন সৌভাগ্যের কারণটা কি জানতে পারি? ————- অবশ্যই পারো। সকালে অত মেয়ে দেখে যে তোমার অভ্যাস টা খারাপ হয় যাবে তা ভাবতেই পারিনি! ঐ মেয়ের চোখ বলছে যে আমার ঘাটতিটা মাফ হয়ে গেছে। কি বলছে তা বুঝেই বললাম—– —কি নেবে নাও।সেই মালা টা নিলে না? কোন উত্তর দিল না মন্দাকিনী।তাই আবার বললাম——নিয়ে নাও ওটা। ————–না গো কৃষ্ণ দা ।দারুণ দেখতে ওটা। বললাম———- তা নেবে না কেন? মন্দাকিনী বলল———- ভাল জিনিস দেখে চোখের আরাম করি।ভাল জিনিসের কি অভাব আছে। যদি সব কিনতে থাকি তবে তো বাবা ফতুর হয়ে যাবে! মন্দাকিনীর মনের থৈ পাই না আমি!রকমারি দ্রব্য দেখার বহর দেখে ভয় পেয়েছিলাম ,তা কাটলো। ভয় তো পাবার ই কথা। যাকে ভালোবাসি তার চাওয়া পাওয়ার হিসাবের গড়মিল হলে মনটাই বা পাব কি করে?কিন্তু আনচান করে ওঠে সেই ঝুঠো পাথরের মালার জন্য। যেটা মনে ধরেছিল এই মেয়ের। মন্দাকিনীর বাবার যা এলেম, তাতে অমন কেন?তার থেকে হাজার মানের উঁচুদরের গলার হার কিনে ঘর ভরে ফেলতে পারে। কেন ভাল লাগা সত্বেও কিনলো না ঐ হার?তবে কি- – – ? লজ্জা হল নিজের ক্ষুদ্রতার কথা ভেবে।হে কেষ্টাচরণ,কবি হবার স্বপ্ন ছাড়ো।তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা টা কাজে লাগা। আগে চাঁদের কাছাকাছি যাও। তারপর চাঁদে হাত দিও।
চোখের সামনে মনে হচ্ছে দৃশ্য গুলো ফুটে উঠছে, খুবই ভালো লাগলো দিদি।
Excellent!