বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী -3
সিমহাচলমের পথে———
মসৃণ রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি চলছে।একেবারেই সাঁ সাঁ করে,ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক। তাই থামার কোন বালাই নেই। ডান দিকের পাহাড়ের স্তর দেখতে দেখতে চলেছি।সবুজের ঢেউ দেখে চোখের আরাম হচ্ছে। এই পাহাড়ের ঢেউ একেবারে সিমহাচলম অবধি গেছে। আগে খেয়াল করলে ঐ পাহাড়ের ওপার দিয়েও গাড়ি নিয়ে যেতে পারতাম। ইস্ থুটা কোটার কাছে হনুমান থকা থেকে সোজা সিমহাচলম অবধি রাস্তা তৈরি করেছে বিশাখা আরবান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি। গাড়ি ব্রেক কষতেই সামনে তাকালাম। ট্র্যাফিক সিগন্যাল লাল বাতি জালিয়ে দিয়েছে।জংশন এটা। নাম লেখা রয়েছে ক্রত্তা রোড জংশন। মন্দাকিনীর মগজকে নাড়া দিতেই জিজ্ঞাসা করলাম। ——-এ জায়গার নাম কি বলতে পার? আমার কথার উত্তর ড্রাইভার দিয়ে দিল। —–ইদি ক্রত্তা রোডু জংশন স্যার। আবার মন্দাকিনীকে জিজ্ঞাসা করলাম—-ক্রত্তা কথার মানে বলতে পার? অর্থ টা আমার জানা নেই বলেই ধরে নিয়েছিলাম মন্দাকিনীও বলতে পারবে না।কিন্ত মন্দাকিনীর মগজ কে নাড়া দিতে গিয়ে ওর উত্তরে আমার মগজ ই বিষম নাড়া খেল। সেই মেয়ে বলল——কি আবার!ক্রত্তা মানে নতুন । তখন এটাই বোধ হয় নতুন হয়েছিল। সবুজ বাতি জ্বলে উঠতে গাড়ি ডানে বাঁক নিল। মেশোমশায়কে বললাম—সোজা গেলে আমরা এয়ারপোর্ট আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া পৌঁছে যেতাম।
হাইওয়ে ছেড়ে আমরা শহরের মেন রোড এ ঢুকে পড়েছি তাতে কোন ভুল নেই। কারণ আমাদের কার ছুটছে না।হর্ন বাজতে হচ্ছে। দেখতে দেখতে রাস্তা ফাঁকা হয়ে এল।বুঝলাম আমরা ব্যস্ত জায়গা পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তা মানে সিমহাচলম এর কাছে এসে গেছি।রাস্তাও অপেক্ষাকৃত ছোট হয়ে গেছে। কিছুটা গিয়েই কারুকাজ করা বিশাল গেট পড়ল তাতে বড় বড় করে লেখা “ওয়েল কাম টু সিমহাচলম “। আর্চ করা গেট এর ভেতর দিয়ে আমাদের গাড়ি ঢুকে গেল। সমতল থেকে গাড়ি সিমহাচলম পাহাড়ে উঠতে লাগল। মেশোমশায়কে বললাম—–পাহাড়ের ওপর অবধি বাস যায়।তবে সব বাস ওপরে ওঠে না।নিচে বাস ঘুমটি থেকে অন্য বাসে দেব স্থানম্।ভাড়া আট টাকা জন প্রতি।হিল টপ এ উঠতে মিনিট দশেক। শুনেছি আঠাশ নং( জেড)বাস টা ওপরে ওঠে গাড়ি উঠতে লাগল ওপরের দিকে। কিছুটা যাবার পর চেকপোষ্ট পড়ল। আমাদের গাড়ি দাঁড়াল।দু’জন লোক রিসিপ্ট বুক নিয়ে এল।বুঝলাম, ওপরে ওঠার মাশুল এখানে গুনতে হবে। মাসীমা বললেন—বাবা ,এখানেও চাঁদার উৎপাত!!!
ড্রাইভার মাশুল গুনে দিতে রাস্তার বাধা সরে গেল। আমি বললাম—-ওপরে ওঠার টাকা দেবস্থানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খরচ হয়। পাহাড়কে বেস্টন করে গাড়ি চলেছে সিমহাচলম এর উদ্দেশ্যে।ডানে দূরে ছোট ছোট বাড়ি দেখা যাচ্ছে।গাছপালায় ঘেরা পত্তন গুলো মনে হল শান্তির আলয়।বাঁয়ে পাহাড়ের প্রাচীর । একটু এগোতেই ডানে, চোখে পড়ল সমুদ্র। এ ছবি পোর্ট এরিয়ার। বাঁক নিল সিড়ির ধার দিয়ে।ঘাস আর দুর্বায় ভরা।ভাবলাম বইয়ে পড়েছিলাম এখানে গোলাপ বাগ ছিল। তার তো কোন চিন্হ দেখছি না। তখন ই মনে হল আমরা যে পথে চলেছি সে পথ তখন ও তৈরি হয়নিআগের দিনে হেঁটেই সবাই দেবস্থানে আসতেন। এইটুকু হাঁটা তখন কষ্ট কর ছিল না।সেই পথেই গোলাপ বাগ ছিল। বইএ পড়েছি হাজার সিঁড়ির পথ। মেশোমশায় বললেন—- ঐ তো চূড়ো দেখা যাচ্ছে!!
হলুদ ঘেষা ক্রীম কালার এর মন্দির।গাড়ি দাঁড়াতে আমরা নেমে দাঁড়ালাম। সমতল রাস্তা ওপরের দিকে এগুলাম। এরপর ই পাথরের ভিজে সিঁড়ি।দু পাশে বসে আছে কুষ্ঠ রোগী। তাই এক সাথে হাঁটা যাচ্ছে না।শ্বেত পাথরের সিঁড়িতে মন্দাকিনীর আলতা পড়া পায়ের ছাপ। দেখে উথাল পাথাল আমার মন।” যদি রাঙা চরণ পাই”। কখনও মাসীমা কখনও মেশোমশায় পিছিয়ে পড়ছেন।মন্দাকিনী এগিয়ে গেছে। প্রায় দশটা সিঁড়ি। লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছে মন্দাকিনী।কেন সে ছুটছে?তা জানতে আমার বাকি নেই। আমার মন চায় ওর সঙ্গে চলতে কিন্তু রাশ টানতে হয় মাসীমা আর মেশোমশায়ের জন্য। মাসীমা গলা তুলে বললেন—–কেষ্টা,মন্দাকে দেখ। এগিয়ে যাও। ছাড় পত্র পেয়ে আমি স্বর্গের দেবী মন্দাকিনীর উদ্দেশ্যেই ছুটলাম। সেই চতুরাণি যে কেন আগে চলেছে তা আমার জানতে বাকি নেই।মাসীমা আমাকে পাঠাবে আর আমরা দুজনে এক হব।মাসীমা না বুঝলেও মেশোমশায় যে মেয়ের মনের কথা জানেন তা আমি হলপ করে বলতে পারি।নইলে কেষ্টা চরণ কে কেন ডাকা!!কেষ্টার থেকে উঁচুদরের পালোয়ান এই ভূ-ভারতে অনেক আছে। কারণ কেষ্টা চরণের যা গুন তা অন্য পালোয়ানের নেই।মেয়েকে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দেয়া যায় কেষ্টার কাছে।ধিক্ তোমাকে কেষ্টা একটা যুবতী মেয়েকে তাঁর বাবা মা ছেঁড়ে দিচ্ছেন তা নিয়ে গর্ব করছ? ভাবতে ভাবতেই দাঁড়ালাম। পেছন ফিরতে দেখলাম মেশোমশায়ের ইশারা, আমাকে এগিয়ে যেতে বলছেন। তা দেখা মাত্রই আমি পঙ্খীরাজ ঘোড়ার মত পাখা মেলে উড়ে চললাম ।একেবারেই খপ্ করে মন্দাকিনীর উড়ন্ত আঁচল খানা ধরে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গেই মন্দাকিনীর রূপের বাহার আর রসের বাহারে আমার হৃদয় টইটম্বুর হয়ে উঠল। চল্কে পড়ার ভয়। পাছে আমার অশালীনতায় এই মেয়েকে হারাতে হয়।তাই একটু ফারাকে হাটঁছি। মরাল গ্রীবা বাঁকিয়ে তরল হাসিতে সে বলল—- এসে গেছ? ঐ সামান্য কথায় আমার হৃদয়ে বান ডেকে উঠল। কি করে সামাল দি প্রেমের উথাল পাথাল!!!! শুধুই চেয়ে রইলাম তার দিকে।সূর্যের কুসুম কোমল আলো মন্দাকিনীর কপোল চুম্বন করেছে।মন বলছে তোমার নাম সার্থক। তুমি সত্যি ই স্বর্গের দেবী।তুমি আমার মন। আমিতো তোমায় মন বলেই ডাকি। চমক ফিরল মন্দার ডাকে।আমি ওকে মন্দা বলেই ডাকি। মন্দা বলল–চুপচাপ কেন?অনেক দিন পর দেখা তাই না?ববললাম——তুমি পাল্টে গেছ।কচি খুঁকিটি নেই।সুন্দর হয়েছ। আমার কথায় হেসে উঠল সেই মেয়ে। বলল—– তুমি যেন তেমনি হাবাগোবা আছ-?একেবারেই রাজপুত্তুর। বুঝলে কিছু? বলেই হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল। হাবাগোবা শুনে কষ্ট পেলেও রাজপুত্তুর শুনে সেই ঘা এ মলম পড়ল। তবুও ওর মতো হাসতে পারলাম না।আমি রাজপুত্তুর কি কোটাল পুত্র তা জানিনা তবে মন্দাকিনীর যে আমাকে রাজপুত্তুর মনে হয়েছে তাতে খুশি হওয়া উচিত।
যখন পুরীতে গিয়েছিলাম তখন কি আমি দেখতে খারাপ ছিলাম?হয়ত বা একটা ছিপছিপে ঢ্যাঙা ছেলে।সে।সময় আমি যেমন ই থাকিনা কেন মন্দা তখন ই ইচড়ে পাকা মেয়ে।নইলে আমায় টিউশন ছেড়ে পালাতে হয়! মন্দাকিনীর ডাকে চমক ফিরল—কৃষ্ণদা ,জায়গাটা দারুণ তাইনা? -দারুন।তবে যে কাজের জন্য আমাকে এখানে আনা হয়েছে তাতে গাফিলতি না হয় তাই অন্য দিকে নজর দিতে পারছি না। আমার কথায় মজা লোটার ভঙ্গি করে বলল- -কৃষ্ণদা পুরী থেকে ফেরার পর থেকেই তুমি আমাকে মন্দাকিনী কেন বল? সে কথা বলতে ওর সেই একই ভঙ্গি। বললাম—-মন্দা বললে মনে হয় বাজার মন্দা যাচ্ছে। তুমিও তো আমায় কৃষ্ণ দা বল ,কেন? অসাধারণ মুখভঙ্গী করে বলল। কেষ্টা শুনলে তেষ্টা, চেষ্টা এই সব মনে হয় ,তাই কৃষ্ণ দা বলি। দমফাটা হাসি হাসলাম ওর রস জ্ঞানে।তবে আমরা কেউ সত্যি কথাটা বললাম না তা দুজনেই বুঝলাম।
——বাবা মা কোথায়? বললাম—–বসে আছেন। আমাকে তোমার কাছে পাঠালেন। মন্দা বলল—-বসে আছে?ঐ দ্যাখ কৃষ্ণ দা কারা? তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পিছু ফিরে দেখলাম মেশোমশায় ও মাসীমা আসছেন। বললাম—আমাকে না,তোমাকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। মন্দা আবার বলল—–তূমি বুঝতে পারছ না।
ভাবলাম না বুঝে পারি!অমন ডগমগে মেয়ে যাদের। তারপর যেমন তেমন ছেলে নি আমি।কবিত্ব করেই মেয়ের মন ভুলিয়ে দিতে পারি।ঐ খাসা মেয়েকে কে না চাইবে। বললাম—–তুমি এগোও। বেশিদূর যেয়োনা।আমি ওদের দেখছি।কথা শেষ হবার আগেই মন্দা এক লাফে দুটো সিঁড়ি টপকে গেল।আমার হৃদয়ে একটা ছোট্ট ঢেউ তুলে। গর্বিত আমি চেয়ে রইলাম সেই দিকে।,,ও কেষ্টা,বাবা এগিয়ে যাও,ওকে একা ছেড় না।-,মেশোমশায় দূর থেকেই বললেন।
একটুও দেরি না করে ছুটলাম জোর কদমে।কানে এল মাসীমার গলা——-কি পোড়া দেশ রে বাবা খালি সিঁড়ি আর সিঁড়ি। টগবগিয়ে চলেছি আমি চানা খাওয়া ঘোড়ার মত। চার,ছয়,দশটা সিঁড়ি টপাৎ টপাৎ টপকালাম। কিন্তু কোথায় গেল সেই মেয়ে?অমন নজর কাড়া মেয়ে চোখে না পড়ার কথা নয়।ভয়ে বুক শুকালো।ভয়টা মন্দাকে হারানোর। আর মাসীমাকে। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করি? ভাবতে ভাবতেই একজন নরসুন্দর কে পেয়ে গেলাম। মুন্ডন করাচ্ছেন। বয়সের হেরফের হলেও মুখের ছিরিছাদ একই মনে হচ্ছে।তাদের একজন কেই জিজ্ঞেস করলাম।
—–ভাই সাব, ইধরসে কই লড়কি কো যাতে হুয়ে আপ লোগোনে দেখা কেয়া? ওর মধ্যেই গুঞ্জন উঠল। বুঝলাম আলোচনা হচ্ছে। সারমর্ম বোঝা গেল না।সবাই তেলেগু ভাষাতেই কথা বলছে। একজন বলল——নি ভাষা রাদু বাবু।অর্থাৎ তোমার ভাষা জানিনা। মহা গোল এ পড়লাম। শলা পরামর্শ চলছে ওদের। একজন দয়া পরবশ হয়ে বলল——- এমি বাবু,চেপ্পেন্ডি। হিন্দি অর্থম হাই লেদু ।অর্থাৎ বলুন, তোমার ভাষা জানিনা। যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম। ভাবলাম হে ভগবান নিজেকে শিক্ষিত মনে করি।ছিঃ ছিঃ, মাতৃভাষা শিখে গর্ব বোধ করি।অথচ বলি ভারত মাতা।অন্য ভাষা শেখার আগ্রহ নেই!!ধিক্ আমাকে। এখানে আমিতো একেবারেই নিরক্ষর। আমার তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার কোন দাম নেই এখানে। তখন ই একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল। নরসুন্দর যে কনিষ্ঠ বালকের চুল কাটছিল, সে নরসুন্দরের হাতটা থামিয়ে বলল——– —-আগু,। আমি চমকে উঠলাম ।তাকালাম তার দিকে, বড় জোর বছর দশেক হবে। পরিস্কার হিন্দিতে বলল। ———- আঙ্কেল জী,ম্যায় নে দেখা আপকো বিবিকো।উস তরফ গয়ি। বিবি কথাটা রোমন্থন করার মত। কিন্তু এখন নজর সেই দিকে,যেই দিক ছেলেটি দেখালো।যে দিকে টিকিটের বিশাল লাইন। কোন লাইন তিরিশ টাকার, কোনটা পঞ্চাশ টাকার আবার একশ টাকার ও রয়েছে।কি ভেবে ছেলেটি আমায় বলল———-ডরনা মৎ স্যার। আপকো বিবি জরুর মিলেগা। বিবি কথাটা ভালো লাগলেও মনের অবস্থা তেমন নয়।মাসীমা আর মেশোমশায়ের কথা ভেবেই শরীরের লোম খাড়া হচ্ছে।মনে মনে পরমারাধ্যা মা কালি কে।স্মরণ করলাম। ছুটলাম লাইনের দিকে।
ঘেরাটোপের মধ্যেই লাইন ।হুটোপুটি নেই তাই এদিক থেকে ওদিকে চোখ চালালাম। বারবার মনে হচ্ছে এত বড় দায় টা পালন করতে পারবো তো? “হে দয়াময় মন্দাকিনীকে আমার চোখের সামনে এনে দাও”। আমার চোখ খুঁজে চলেছে সেই মেয়েকে। দশ টাকার থেকে একশ টাকার লাইন অবধি।আমার মস্তিষ্ককে অবশ করে দিচ্ছে এত রঙ আর তার উজ্জ্বল্যতা। এত গাঢ় রঙ কলকাতায় দেখিনি।চোখ ঝলসে যায় এখানের রঙে।সেই মেয়েকে খুঁজতেই এই রঙে চোখ চালানো।এখানে শুধু নারীর বসন নয় পুরুষের বসন ও রঙীন। বুকে দামামা বাজছে। তাকে খুঁজে আমার নয়ন ক্লান্ত। মন বলছে——–“কোথায় পাব তারে”?
বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী -4
আবার শুরু করলাম লাইনের প্রথম থেকে দেখা। আরে!ঐ তো মন্দা!!একেবারে লাইনের প্রথম জনের পাশে দাঁড়ানো।কিন্ত এতক্ষণ দেখিনি কেন?চোখে চোখ পড়তেই হাত নাড়ল সেই মেয়ে।বিশাল লাইনের অত আগে পৌঁছানোর কথা না।তা বুঝেই নজর চালিয়ে ছিলাম। এতক্ষণে মগজে ঢুকল আমার। অমন নজর কাড়া মেয়ে কি চোখে না পড়ার কথা? তা নয়।আসলে মন্দার লম্বা বিনুনী টা গায়েব হয়ে গেছে। মাথায় একখানা গোরের মালা জড়ানো। হয়তো বিনুনী দিয়েই খোঁপা গড়ে নিয়েছে। বুকের কাছে কিছু মালা দুলছে। কেন দেখিনি এতক্ষণ তা জলের মত পরিস্কার হয়ে গেল। মাথায় মালা দেখে দক্ষিণী বলেই ভুল করেছিলাম। চোখ ফিরিয়ে নিলাম সেদিক থেকে। এমন চতুরাণীকে অজ্ঞ ভেবেছিলাম বলে লজ্জা পেলাম। আবার চোখ গেল দিকে। হাসতে হাসতেই কথা বলছে পাশের মেয়েটির সাথে। কি ভাষাতে কথা বলছে !!কি জানি!সব পারে এই মেয়ে। এগিয়ে এলো আমার দিকে। হাতে চার খানা টিকিট। এসে ই অন্য কথা বলল।
কি গো আজ তো অনেক কবিতা লিখবে, তাই না? ওর কথায় থৈ পাই না আমি।তাই বললাম- -হঠাৎ কবিতার কথা? -জীবনে প্রথম এত নারী দেখলে আজ। কবিত্ব করবে না আজ? বললাম-নারী দেখলাম?মানে?কোথায়? মন্দা বলল-দেখলে মানে দেখলে। একেবারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে। কালো হলে কি হবে মুখের ছিরিছাদ কিন্ত তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখার মত।আমার তৃতীয় নয়ন আছে বুঝলে মশায় !!
ওর কথায় রাগ হয়ে গেল আমায় নাকাল করে আবার হুল ফুটাচ্ছে। কিন্ত ওর কি হিংসা হচ্ছে? আমি তো প্রতিটি মেয়ের মুখে এই মেয়ের মুখের আদল খুঁজছিলাম। তখন আমার মনে একটা নাম ই আঁকা ছিল।সেই মেয়ে কালো লাবণ্যবতী দক্ষিণী নয়।সেই মেয়ের পায়ে আলতা, চোখে বিদ্যুতের ঝলক। স্বর্গের দেবী মন্দাকিনী সে।দেবী তো বটেই কোন গুণে লাইনের প্রথমেই যেতে পারে?নাড়া খেল আমারমন । তবে কি- – – ?
হওড়া স্টেশন এ ট্রেন এ ওঠার পর মেশোমশায় বেড়ানোর পুরো তফিলের দায় তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে।বলেছিলেন——– –আর লাগলে বলবে। আমি পয়সা দিয়েই খালাস। এবার সব দায় তোমার। কিন্ত তা হলো না।যাকে কেষ্টা অনভিজ্ঞা ভেবেছিল সেই মেয়ে কেমন বুদ্ধি খরচ করে ভেতরে ঢোকার চারটে টিকিট হস্তগত করল।আমাকে বিশাল লাইন এ দাঁড়াতে হল না।কোন সাহসে এই মেয়েকে অনভিজ্ঞা বলি।তবুও খেরোর খাতায় আমি হিসাব রক্ষক। একটু এদিক ওদিক হলেই লজ্জার সীমা থাকবে না মেশোমশায়ের কাছে। তাই বললাম——কতো টাকার টিকিট? ——— তিরিশ টাকা করে একশ কুড়ি টিকিট। আর পুজোর ডালি শুধু মায়ের আর আমার। পকেট থেকে টাকা বার করে দিলাম। হাসতে হাসতেই সেই মেয়ে বলল—-আরও আছে ঐ মেয়েটাকে মালা কিনে দিলাম। তাই তো আগেই হয়ে গেল। আমি বললাম—-তা হবে না,ঘুষের টাকা আমি দেব না। ঐ জন্য ই বাবা তোমাকে চায়। বললাম–তুমি চাও না? মন্দার আনত দৃষ্টি দেখে কথা ঘুড়িয়ে নিলাম। বললাম—-লাইনের অত আগে পৌঁছলে কি করে? নিজের আন্দাজ টা পরখ করতেই জিজ্ঞাসা করলাম।
চোখ নাচিয়ে বলল——-মেয়েটা দশ বার জন পরে ছিল। ওর পাশে দাঁডিয়ে গল্প জুড়ে দিলাম ওর সাথে। যেন ওরই কেউ আমি।তখন ই মালা কিনে দিলাম ওকে। আমিও পড়েছি।ওই পড়িয়ে দিয়েছে।
আমার চোখ গোল গোল হয়ে গেল। মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেড়িয়ে গেল। আচ্ছা ধড়িবাজ তো তুমি?কি ভাষায় কথা বললে? কেন তেলেগু। আসার আগেই বই কিনে শিখেছি। ওর কথায় আমার টাক খাওয়া হাঁ হল।লজ্জা হল। এ ধ্বনী যে চতুরের চূড়ামনি!! একে অবলা ভেবেছিলাম। ধিক্ আমাকে। –কি ভাবছ মশায়? –ভাবছি এমন গুনী কার ঘর আলো করবে?
চোখের হাসি চমক ফেলল সেই মেয়ের। কেষ্টা চরণ, ঐ হাসি কি বলতে চায়!আমার তো ঘর ই নেই।তাই আলো করার কথাই হয় না।কথা না বলে চোখ সার্থক করছি ঐ মেয়ের রঙ ঢং দেখে। এবার সে বলল——–তাতে তোমার কি ?যে ঘর আলো হবার হবে। ওর মুখের কথায় আমার বুকটা ধক্ করে উঠল। আবার সেই দুষ্টুমি করে বলে ওঠে———– —-কি গো কবি মশায় দেব নাকি একজন কৃষ্ণ কুমারী কে জোগাড় করে?সে তোমার ঘর আলো করবে।
আপনার থেকেই গলাটা কর্কশ হয়ে গেল। বললাম——- ঢের হয়েছে। আর না।এবার চল মাসীমা চিন্তা করছেন। মন্দিরে আজ দর্শনার্থীদের ভিড় বেশি।আরও লোক বাড়বে। তাহলে চন্দন যাত্রার দিন কি অবস্থা হবে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে। দুর থেকেই মেশোমশায় হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। পা চালালাম সে দিকে। মন্দা বলল———কৃষ্ণ দা,এই চন্দন যাত্রা কি প্রতি বছরই হয়? বললাম———-চন্দ্র বংশের রাজা পূরুরবা যখন মাটি খুঁড়ে নরসিংহ-এর বিগ্রহ বার করছিলেন তখন আকাশ বাণীতে তিনি শুনলেন যে যতটা মাটি খুঁড়ে বিগ্রহ বার করেছেন ততোটাই চন্দন প্রলেপ বিগ্রহে লাগাতে হবে। এ ভাবেই বছর ভরে পুজো করতে হবে। ————-তাই কি চন্দন যাত্রা বলে? বললাম——-ঠিক তাই। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন নরসিংহ স্বামীর আগের বছরের চন্দন ধুয়ে স্নান করান হয়। আবার নতুন করে চন্দন পড়ানো হয়। সিল্ক শাড়ির পরতে পরতে চন্দন প্রলেপে একটু একটু করে ঢাকা পড়ে যান নরসিংহ দেব। নিত্য রুপ থেকে নিজ রুপে ফিরে আসেন তিনি। চোখ পড়ল পাহাড়ের নিচের লোকালয়ে। এখনও কুয়াশার চাদরে মোড়া। কুয়াশা না ধোঁয়া বলা শক্ত। তবে সিমহাগিরির মন্দিরের চূড়োয় আলোর ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। কি সাংঘাতিক!কোথাও যেন পড়েছিলাম এই ভাবেই এই কলাকারদের কলার পরিসমাপ্তি ঘটানো হত।আমার নজর সেই চার চৌকো চূড়োয়।নাট্য মণ্ডপের দর্শনার্থীদের লাইনে দাঁড়ালাম আমরা। মন্দিরের কারুকাজ দেখতে দেখতেই লাইনে এগুচ্ছি। চার চৌকো চূড়ো তাক্ লেগে যাবার মত।সেই সব শিল্পীরা আজ কোথায়!!তারা না পেয়েছে কোন সম্মান না পেয়েছে কোন ও দরপত্র। রাজাদের আমলে স্থপতি আর ভাস্কর দের প্রতিভার কোন সমাদর হতো না। উচিত মূল্য একটাই, শিল্পী যাতে দ্বিতীয়বার তার কলা প্রদর্শন না করতে পারে তাই।তার আঙুল কেটে ফেলা হত।
ভাবলাম কোথায় এইসব কলাকারের নাম স্বর্ণাক্ষরে জ্বল জ্বল করবে, তা না করে তাদের প্রতিভার সমাপ্তি ঘটানো হয়েছে। আমার নজর সেই চার চৌকো চূড়োর দিকে। নাট্য মন্ডপের সামনে পাথরের চার চাকা ওলা ঘোড়ার গাড়ি।সেই ঘোড়ার গাড়ি মিশ কালো গ্র্যানাইট তৈরি,অলঙ্করণ হয়েছে ফুল লতা পাতায়। একেবারেই বিষ্ণু পুরাণের ঢংএ অলঙ্করণ।
ভাবলাম, কোথায় গেল সেই সব চিন্হ!যে গুলো মুসলিমরা করেছিল!হিন্দু মন্দির ধংস করার সময় কিছু মূর্তির অঙ্গ হানি করেছিল। বই এ পড়েছিলাম, স্বয়ং বিষ্ণু নাকি এক দল মৌমাছির রুপ ধরে ঐ মুসলিম আক্রমণ কারীদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় শহরের বাইরে অনেক দূর। আমার হাসি দেখে মেশোমশায় বললেন—-একা একা হাসছো কেন ? হাসির কারণ শুনে মেশোমশায় বেশ জোরেই হেসে উঠলেন। তার পর বললেন——একথা তোমার মাসীমা শুনলে সিমহাচলম ছেড়ে যাবেন না।এমনই তিনি ভক্তিতে গদ গদ তায় আবার স্বয়ং বিষ্ণু এসেছিলেন মৌমাছির রূপ ধরে। অন্য কথা বললাম———মেশোমশায় এখানে কাপ্পা স্তম্ভম এর ভেতর থেকে শ্রী নরসিংহ বেড়িয়ে এসেছিলেন। একেবারে জনসমক্ষে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন। সেই থেকেই সিমহাচলম্ পুণ্য ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।এ সবই বই এ পড়েছি। হঠাৎই মাসীমার গলা শুনে বুঝলাম মাসীমাও আমাদের শেষের কথা শুনতে পেয়েছেন। ———— হ্যাঁ।স্থল পুরাণে আছে এসব। হিরণ্য কশিপু প্রহ্লাদের হরি ভক্তিতে রেগে গিয়ে ছেলেকে মারার নানান ব্যবস্থা করেও হেরে গেছেন। কী ভাবে প্রহ্লাদকে তিনি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলেন। তার ওপরে সিমহাচলম পাহাড় চাপিয়ে মারতে চান ঐ শিশু প্রহ্লাদকে। আমি কিছু বলার আগেই মেশোমশায় বললেন—– বাবাজী দেখছি দারুণ শক্তিমান!! মাসীমা বললেন——‘কার কথা বলছো?হিরণ্য কশিপু?তিনি ব্রহ্মার বরে অমর হয়েছিলেন। মহা শক্তিধর হয়েছিলেন। ব্রহ্মা এ কথাও বলেন যে,হিরণ্য কশিপু যদি কোন ধার্মিক মানুষ ও নারীকে নির্যাতন করেন তবে তাঁর বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। মেশোমশায় একটু রসে বশে বলেন —–তাই নাকি? মাসীমা আবার বললেন ত্রেতা যুগের কথা। আমরা শুনছি আর একটু একটু করে লাইনে এগুচ্ছি। মাসীমা আবার শুরু করেন——‘বুঝলে কেষ্টা, হিরণ্য কশিপু শক্তিধর হয়ে সমস্ত দেবতাদের আক্রমণ করেন। দেবরাজ ইন্দ্র কে ও পরাজিত করলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তখন দেবতাদের নিয়ে দেবলোক ত্যাগ করেন। ত্রিলোকে তখন হিরণ্য কোশীপুর আধিপত্য। মেশোমশায় বললেন———–ছিঃছিঃছিঃ।দেবতারা তাদের স্ট্যাটাস হারিয়ে পালিয়ে গেলেন?
মাসীমা মেশোমশায়ের কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে বলতে লাগলেন———শোন,জয় আর বিজয় নামে দু’জন দ্বার রক্ষি ছিল ভগবান বিষ্ণুর বৈকুন্ঠ ধামে। যার সার কথাহলো এঁরা ভগবান বিষ্ণুর কয়েকজন ভক্তে কে অপমান করেছিল। তারই ফলে এরা রাক্ষস কুলে জন্ম নেয়। এরাই হিরণ্যক্ষ্য আর হিরণ্যকশিপু। বেশ শক্তিধর এরা।ছোট ভাই পৃথিবীকে দু হাতে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল।তখন ভগবান বিষ্ণু বরাহ অবতারের রুপ ধরে বিনাশ করেন হিরণ্যক্ষ্যকে। ভাইয়ের শোক সহ্য করতে না পেরে হিরন্যকশিপু স্নানহার ত্যাগ করে ব্রহ্মার ধ্যান করতে লাগল। শেষে” মৃত্যুঞ্জয় হও “বর পেল।
মাসীমার দৃষ্টি আমার দিকে কারণ মন দিয়েই শুনছিলাম, আগে এটা জানা ছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম——-তারপর?দেবতারা বিষ্ণুর কাছে ছুটলেন। কারণ ব্রহ্মার বর ফেরানোর পথ নেই।
চোখের সামনে মনে হচ্ছে দৃশ্য গুলো ফুটে উঠছে, খুবই ভালো লাগলো দিদি।
Excellent!