Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee » Page 12

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 23

ছোট্ট একটা স্টেশনে ট্রেন থামল। লোকজন নামতেই চলতে শুরু করল ট্রেন। মেশোমশায় গলা তুলে বললেন—–ও কেষ্টা,তোমার ঝাঁপি খোল। আমি বললাম——- বিশাখাপত্তনম থেকে একশো সতেরো কিলো মিটার দূরত্বে এই পূর্ব ঘাট পর্বত মালার উপরে এই পাহাড়ী রেল স্টেশন। নাম আরকু ভ্যালি। সুরসিকা মেয়েটি বলল——- দেখার আর কি কি আছে? বললাম——- আমার মতে প্রকৃতি ছাড়া আর কিছুই নেই।তবে এ.পি.ট্যুরিজম দেখাচ্ছে অনেক কিছুই। মন্দাকিনী বলল—— তোমার মত ছাড়া আর কি কি দেখার আছে? সবই একে একে বললাম। যেমন অনন্ত গিরির জলপ্রপাত,পদ্ম পূরাণ গার্ডেন,ট্রাইব্যাল মিউজিয়াম, ট্রাইব্যাল ডান্স, গোস্তানী নদী, মৎসগুদাম ও বোরাকেভস। তাছাড়া ট্রেন চলাচল কালীন দু’পাশের সৌন্দর্য দেখার মত। আমাদের কথার মাঝেই গুহার মাঝে রেল গাড়ি চলে এসেছে। যতবার গুহার ভেতরে ট্রেন ঢুকছে ততোবার ই উৎসাহের উজান বইছে ট্রেনে মধ্যে। মাসীমা বললেন—- এত চেঁচামেচি কেন? মহিলা বললেন—– বোধ হয় ট্রেন টানেলর ভেতরে ঢুকছে। আমার কর্তাটিকে দেখুন কি নিশ্চিন্ত! আসলে ও জানে লোক জন থাকলে আমার ভয় থাকে না।ঐ দেখুন লাইট অফ করে দিল। আমি বললাম—— ভয় নেই, সবাই আছে।এবার ভাবুন তো যারা টানেল করেছিল।রেল লাইন পেতেছে! মাঝ পথে গাইড এসে বলে গেল,যে সিমলীগুডা রেল স্টেশন আসছে।বাইরের দিকে তাকালাম। পূর্ব ঘাট পর্বত মালার সবুজের ঢল নেমেছে।মাঝে মাঝেই ট্রাইব্যাল দের আঁকা বাঁকা পায়ে চলার পথ। যেন বাঁকা চোরা মাথার সিঁথি। মেশোমশায়কে বললাম——— এই কে কে লাইনের হায়েস্ট পয়েন্ট হল সিমলীগুডা। উচ্চতা তিন হাজার তিন শো ফিট। সত্যিই বাহবা দিতে হয় ভারতীয় টেকনোলজিস্ট দের আর রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারেদের। এমন একটা চমকপ্রদ কাজ শেষ করতে পারার জন্য। মেশোমশায় বললেন——সত্যিই ভাবা যায় না।এমন একটা জায়গাতে যখন প্রথম কাজ শুরু করল। মানুষের পদক্ষেপ পড়েনি সেখানে।কি কষ্ট না করতে হয়েছিল তাদের! মেশোমশায়কে বললাম—- হ্যাঁ। এমনই একটা জায়গায় শিল্পের উন্নয়ন হয়েছিল। সিমলীগুডায় বাঁশ শিল্প বিখ্যাত। চম্পী বলে একটা জায়গা আছে সেখানে পটারী আর টেরাকোটার খেলনা তৈরী হয়। সেই আধুনিকা বলল——ট্রি টপ্ এ থাকার কটেজ আছে? বললাম—–ঠিক শুনেছ। পদ্ম পূরাণ গার্ডেন এ গাছের ওপর কটেজ তৈরি করেছে ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট। মজার ব্যাপার হল এই গার্ডেন উনিশ শো বিয়াল্লিস সালে তৈরি হয়েছিল। দ্বিতীয়বিশ্ব যুদ্ধে সৈনিকদের সব্জি যোগান দিতেই এই বাগান তৈরি হয়েছিল। মেশোমশায় বললেন—-তাই নাকি?এখন ও চাষ হয়? কথা বলতে বলতেই সিমলীগুডা স্টেশন এসে গেল। মনে হল হায়েস্ট ব্রডগেজ স্টেশন এ নেমে দাঁড়াই। আমি আর মেশোমশায় নেমে দাঁড়ালাম। মন্দাও নামতে যাচ্ছিল, কিন্তু মাসীমার বকায় বসে রইল। কিন্তু আমাদের রসিকা সহযাত্রীনি প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁড়াল। ওর মা,মাসীমার উল্টো কথা বললো। ——– দিদি, অত রাশ টানবেন না।তাতে উল্টো ফল হয়। আমি তো ছেড়ে দিয়েছি।তাতে ভাল মন্দ বুঝতে শিখবে। ট্রেন থেকে নামতে নামতে সে কথা আমার কানে এল। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ভাবছি,কতো কষ্ট করে এই লাইন পাতা হয়েছে।দুর্গম গিরি, তায় গভীর অরণ্য। হিংস্র পশুর অভাব নেই। প্রথমেই ডিজেল, তারপর ইলেকট্রিফিকেশন হয়েছে।দিনে একটা মাত্র ট্রেন চলে এই কে কে লাইনে। দাও আর নাও এর ব্যাপারে আমাদের কম লাভ হয়নি। জাপানের দরকার ছিল উঁচুদরের লোহার। বায়লা ডিলার লোহা পেতে হলে রেল লাইন চাই। তাই কে কে লাইনে ব্রডগেজ রেল পাতা হল।তারই জন্য টাকা দিল জাপান। বদলে ভারত দিল চার মিলিয়ন টন আকরিক লোহা প্রতি বছরে। এই চুক্তি হল জাপানের সাথে। চমক ফিরল মেশোমশায়ের কথায়। ——– পাহাড়ে সুরঙ্গ করে রেল পাততে তো বিশাল খরচ। তাই না? বললাম—–হ্যাঁ। সারভে থেকে শুরু করে সমস্ত খরচ তখন কার পঞ্চান্ন কোটি টাকা। ছত্তিশগড়ের বায়লা- ডিলা খনি থেকে আকরিক লোহা নেবার জন্য ই এই রেল লাইন চালু হয়েছিল। মেশোমশায় বললেন ——- যা এলাহী ব্যাপার তাতে আয় ও ভাল ই হচ্ছে। বললাম——— বই য়ে একটা গড় হিসাব দিয়েছে। প্রতিদিন এক কোটি আশি টাকার আয় এই লাইন থেকে হয়।ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এই লাভ জনক ব্যবসা করছে। গার্ড পতাকা নেড়ে দিতে এ পি টুরিজ্ম এর গাইড আমাদের ট্রেনে উঠে যেতে বলল। উঠে পড়লাম ট্রেনে। সেই মেয়েটি কখন যে ট্রেন এ উঠেছে জানিনা। তাকে দেখলাম না। মেশোমশায় এগিয়ে গেলেন। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে অনন্ত গিরির রুপে মজে গেছি।একেই বুঝি বলে বিস্তীর্ণ পর্বত মালা। এই জন্যই বুঝি অনন্ত গিরি এই পাহাড়ের নাম।যে গিরি মালার শেষ নেই। দূর থেকে মেশোমশায়ের গলা শুনে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। আমার অনুপস্থিতি হয়ত ভাল লাগছে না। তাই বুঝি আমাকে ডাকছেন। আমায় দেখে মেশোমশায় বলেন। ———- কি হল একা দেখলে হবে? আমাদের কিছু বল। বললাম——– কিরানডুল লাইন এ তেরোশো একটা ব্রিজ তৈরি হয়েছিল। টানেল তৈরী হয়েছিল ষাট টা। দরজায় দাঁড়িয়ে অনন্ত গিরির সৌন্দর্য দেখছিলাম। এতক্ষণে সুরসিকা কে দেখলাম। কখন উঠেছে দেখিনি। তার মা বললেন। ——– পাহাড়ের সৌন্দর্য!!আমার মনে হচ্ছে কখন শেষ হবে? হাসতে হাসতেই বললাম——ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এর কাছে যাতায়াত করুন দেখবেন পরের বার দেখবেন আমার কথা ঠিক কিনা!! আরকু ভ্যালি ওপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে।ঠান্ডা তুষার গুড়ো মেঘ আমাদের শরীর ছুঁয়ে দিল মনে হল। মাসীমা বললেন—— মে মাসের গরমে এত সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া!ভাবা যায় না।দারুণ! ঠিক ই বলেছেন মাসীমা।ভাষাতে প্রকাশ করা যায় না মনের ভাব। তাই শুধু দারুণ, বলে দেখাই ভাল। বুনো সবুজ আর হলুদের মেলা।সুরঙ্গ ভরপুকোটা পুরো নাম সাদামাটা ভাষায় “এসকোটা “।আসল নাম শৃঙ্ঘভরপুকোটা। সেই এসকোটা থেকে আসার পথে জঙ্গল আর কফি চাষের নমুনা দেখার মতো। পাহাড়ী ঝর্ণার শব্দ যেন সুখ স্বপ্ন। গাইড এর মুখে শুনেছিলাম “বোরা গুহালু” রেল স্টেশন অবধি বাহান্ন টা টানেল। ভাবলে আশ্চর্য লাগে মাউন্টেন রেঞ্জের ওপর তিন হাজার তিন শো ফিট উঁচুতে আমরা। গা ঘেষে চলেছে এই পাহাড়। গাড়ি দাঁড়াল আরকু স্টেশনে। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। আমার কাঁধে ঝোলা ছাড়া আর কিছুই নেই। মেশোমশায়ের হাত থেকে ব্যাগ নিতে গেলাম। মন্দাকিনী ছিনিয়ে নিল ব্যাগ টা। বলল—-এটা আমি নেব। স্টেশনে দাঁড়ালাম সবাই। এ পি টুরিজ্ম এর গাইড আমাদের স্টেশনের বাইরে নিয়ে চলল।দূর থেকেই দেখলাম বাস দাঁড়িয়ে আছে। হাটতে হাটতেই লক্ষ্য করছিলাম,সহযাত্রীনি সেই মেয়েটি আমার পাশে পাশেই হাঁটছে। দশ কদম ও যাইনি মন্দাকিনী এসে আমার হাত ধরল। থমকে গেলাম আমি। লোক সমক্ষে আমার হাত ধরেছে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি!মাসীমার কথা কি ভুলে গেছে? পর মুহূর্তেই মনে হল কথাটা। “আরকু পৌঁছে কৃষ্ণদা আমার “।তাই বুঝি এই প্রচেষ্টা! ওকে আশ্বস্ত করতেই বললাম——-কি গো কেমন দেখছো? মন্দাকিনীর মনে কি চলছে তা আমি জানি।আমার কথাতেও মনের ভাব চাপতে পারল না।বলেই ফেলল।- ———–আমাদের কথা চিন্তা করতে হবে না।ভাল সঙ্গিনী তো তোমার জুটেই গেছে। পাশের মেয়েটি যাতে শুনতে না পায় তেমন করেই বললাম। ———– ভাল? ভাল টি তো তার মায়ের আঁচলের তলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার কথায় সুবদনীর চোখে মুখে আলোর ঝলকানি দেখলাম। ———- ধ্যাত্। এটা ধর। ঐ টুকু বলেই হাতের ব্যাগ খানা আমার হাতে দিয়ে ছুটে পালাল। বুঝলাম, ওটা আনন্দের অভিব্যক্তি। পার্শ্ববর্তিনী আরও কাছে এগিয়ে এল। বলল——– কৃষ্ণ দা, বিয়ে করছো না কেন? বললাম——-এখনও ভাবিনি। সেই মেয়ে বলল—— মন্দাকিনী তোমাকে ভালবাসে। বললাম——- কি করে বুঝলে! ——– ভাব দেখেই বুঝি। মনে ভাবলাম, মেয়েদের তৃতীয় নয়ন আছে।তাই যদি হয় তবে মাসীমা ও তো বুঝতে পেরেছেন। আবার মনে হল। বুঝেই বা কি করবেন?অত্যাচার করবেন মেয়েকে? নাকি আমাকে?হয়ত বা অপেক্ষায় আছেন আমার শুভবুদ্ধি উদয়ের। বিশাল বিশাল দু’খানা দুধ সাদা বাস দাঁড়িয়ে আছে। পেছনের বাসটিতে আমাদের জায়গা।হাত বাড়িয়ে প্রথমেই মাসীমাকে তুলে নিল আমাদের গাইড। দেখলাম মন্দাকিনী তখন ও নিচে দাঁড়িয়ে। বললাম—— দাঁড়িয়ে কেন? মাসীমার পাশে বস। মন্দাকিনী বলল——- না।আমি ঐ মেয়েটির পাশে বসব। বুঝলাম কেন ও ঐ মেয়ের পাশে বসতে চাইছে! তাই ওকে অভয় দিতে বললাম——- তুমি মাসীমার পাশে বস। আমি মেশোমশায়ের পাশে বসব। মন্দাকিনীকে যেমন বলেছি,তেমনই বসলাম। সেই ভদ্রলোক তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে বাসে উঠলেন।

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 24

ভদ্রলোক তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে কে নিয়ে বাসে উঠলেন। উঠেই ছোট মেয়েকে ধমক দিলেন। ——-দেখেছ সবাই বসে গেছে!কেবল আইসক্রিম আর আইসক্রিম। এসব জায়গার বাজে জিনিস খেতে হয় না। এবার তাঁর বড় মেয়ে বলল——-বাপী, তুমি ছোট বেলায় এমন খেতে চাওনি?হয়ত তখন আইসক্রিম ছিল না।কি বলুন কৃষ্ণ দা? কি আর বলব। হাসলাম। এরা সহজ ভাবে মেশে লোকের সাথে। মেয়েটির পরনের জিন্স আর গেঞ্জির সঙ্গে ওর স্বভাব মেলেনা। তার বাপী অর্থাৎ মেয়েটির বাবা হেসেই বলেন। ——— আইসক্রিম!না না ,তখন ছিল হাওয়াই মিঠাই। একটা কাঠিতে গোলাপী রং-এ ফাঁপা মিষ্টি জড়ানো থাকতো।ঠিক বলেছি কিনা দাদা? আমরা সবাই শুনেছিলাম। বাস চলা শুরু হয়নি। তাই একটা ঘরোয়া পরিবেশে আলাপ আলোচনা ভাল ই লাগছিল। মেশোমশায় কে সলিশ মানায়, মেশোমশায় খুশি হয়ে বলেন। ——হ্যাঁ। আর এক একজন এক একটা খাবার ব্যাপার ছিল না।দাদা কিনলে তবে আমরা দু ভাই বোন ভাগ পেতাম। আর একজন বয়স্ক মানুষ বলে উঠলেন। ——— একদম ঠিক বলেছেন। মেশোমশায় আবার বললেন——-দাদা খাবার পর, সেটার ফাঁপা ভাবটা উবে যেত। আমরা দু ভাই বোন কাঠির ওপরে লাগা চিটে গুড়ের মত মিষ্টিটা চেটে চেটে খেতাম। সুরসিকা মেয়েটি বলল——-কতবার খেয়েছেন জেঠু? ———- ও রকম আর খেতে ইচ্ছা করেনি।তবে মা গোটা গোটা কিনে দিলে খেতাম। তখন ই হাওয়াই মিঠাই এর স্বাদ পেতাম। দেখলাম মাসীমা মেশোমশায়ের কথা শুনে বেশ মজা লুটছেন। বাসে সবাই বাঙালি।তাই ভাল ই লাগছে। খোশ মেজাজে সবাই। তার আরো একটা কারণ এতক্ষণ পাহাড়ের অলি গলি,সুরঙ্গে থাকার পর মুক্তির স্বাদ। ড্রাইভার বাসে বসতেই বাস ছেড়ে দিল। আমাদের গাইড দরজায় দাঁড়িয়ে প্রথম ইংরেজী তে ও পরে তেলেগু তে গন্তব্য স্থলের বর্ণনা দিত শুরু করল। এ সব আগেই বলেছিলাম তাই আর শোণার দরকার নেই। বাস এর গদী আরাম দায়ক।তবে ‘নন এসি’।অবশ্য বাইরে এতো হাওয়া যে শীততাপ এর ব্যবস্থা না হলেও চলে।নতুন জায়গাতে ভাল লাগছে। মেশোমশায়ের সাস্থ্য টা ভাল তাই হাতলটা দুজনের মাঝে থাকায় একটু গুতোগুতি হচ্ছিল আমাদের। মেশোমশায়কে বললাম——ঠিক আছে?কষ্ট হচ্ছে না তো? মনে ভাবলাম এই সীটে নারী পুরুষ হলে আরো অসুবিধা হবেই। গাড়ি থামল ট্রাইব্যাল মিউজিয়াম এর সামনেই। একে একে নামলাম আমরা।ড্রাইভার তেলেগু তে বোঝাতে শুরু করেছে কারণ প্রথম বাসে বেশির ভাগই তেলেগু ভাষি রয়েছেন। আমি বললাম——– উনিশ শো ছিয়ানব্বইয়ে এই মিউজিয়াম খোলা হয়। ট্রাইব্যাল দের জীবন যাত্রার রকম সকম দেখানো হয়েছে। মন্দাকিনী বলল—-এরা তো শিল্পী ছিল। বললাম——হ্যাঁ। এদের শিল্প কলা,সংস্কৃতি,কারু শিল্প, অঙ্কন শিল্পের নমূনা ধরে রেখেছে এখানে। এদের গহনা, শিকারের অস্ত্র, তাঁত এইসব মডেলের দ্বারা দেখান হয়েছে।মিউজিয়ামের ঘেরাটোপের মধ্যে ঘুরে দেখলাম সব। যে দিক দিয়ে ঢুকলাম তার উল্টো পথে বের হলাম। গাড়িতে বসে মাসীমা বললেন—— দুর, এসব দেখে কি হবে?সব পয়সা আয়ের ধান্ধা! মেশোমশায় বললেন—— উপজাতি দের তৈরি করা। ওদের সম্বন্ধে জানবে না?কি ভাবে ওরা সমাজের বাইরে থেকেও নিজেদের উন্নত করেছে। গাইড বলল——এবারের গন্তব্য পদ্মপূরাণ গার্ডেন। সার কথা হল, পদ্ম পূরাণ গার্ডেন অধুনা বোটানিক্যাল গার্ডেনস হয়ে তার পর লাঞ্চ হবে পুনমী যাত্রী নিবাসে। লঞ্চের পর ট্রাইব্যাল ডান্স দেখব। এরপর টায়ডা ন্যাচার ক্যাম্প দেখা হবে। বাইরে সূর্যের তাপ হলেও মিষ্টি হাওয়া বইছে। তাই বেড়ানোটা কষ্ট কর লাগছে না।গাড়ি পদ্ম পূরাণের দিকে চলতে লাগল। আমি বললাম——- আসল অ্যাট্রাকশন বোরো কেভ। বাকি গুলো সঙ্গে যোগ করা হয়েছে। মেশোমশায় বললেন——- খাবার কোথায় দেবে? বেলা তো হল ? বললাম—– হিল রিসর্ট করেছে এ পি টুরিজ্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন। ওর উল্টো দিকেই। কথা বলতে বলতেই পদ্মপূরাণ গার্ডেন এ গাড়ি পৌঁছল।মোটা আর্চ করা গেট। বহুদিনের গাছ রয়েছে।গাইড আমাদের তেজ পাতা দেখাল। ব্লাড সুগার রোধক গাছ দেখালো। অনেকেই কিনে নিল। বাগান টা চক্কর দেবার জন্য টয় ট্রেন করেছে।সেই ট্রেন এ চড়ে পুরো বাগান টা দেখলাম। কাছেই খাবার জায়গা।তাই খাবার খাওয়ার তাড়া লেগে গেছে। পেট এমন একটা জিনিস যেটা খালি থাকলে মুশকিল। চার দিকে গাছ লাগিয়ে আর ও শোভা বাড়ান হয়েছে।বাঁয়ে একটা বড় সড় বিল্ডং। ওখানেই আমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাওয়ার পর মেশোমশায় বললেন—–খাওয়াটা কিন্তু খারাপ দেয়নি। বের হয়ে এলাম বাইরে।উল্টোদিকে ট্রাইব্যাল ডান্স শুরু হয়েছে। মন্দাকিনী বলল—— ওদের’ দিমসা ‘ নাচ শুরু হল বলে।তাড়াতাড়ি চলে । সারে সারে মেয়েরা পড়েছে কমলা, আকাশে, গোলাপী,হলুদে ইটে রং এর শাড়ি। সঙ্গে মানানসই ব্লাউজ। মাথার খোঁপায় রকমারি ফুল। কিন্তু তাদের মুখ গুলো সবই যেন এক রকম মনে হল আমার। মেয়েদের সামনে একটি করে পুরুষ। তার পড়নে হলুদ ধুতি আর সাদা ফতুয়া। গলায় সাদা আর হলুদ ফুলের মালার বাহার। মাথায় হলুদ কাপড়ের ফেটি বাঁধা। গলায় একখানা মাফলার। তাও সামনের দিকে দোলানো।কোমড়ে হলুদ কাপড়ের ফেটি।বাজন দার চারজন। আর সেই পুরুষের হাতে ময়ূরের পেখম। নৃত্য শুরু হয়ে গেছে।তালে তালে সেই পুরুষ আগে আগে কোমড়ে হাত দিয়ে নাচতে লাগল। কেউই লাগ ছাড়া হচ্ছে না ।গানের তালে তালে চলছে নাচ। আমার পাশে মন্দাকিনী দাঁড়িয়েছিল। সহযাত্রী সেই মেয়েটিও কাছেই ছিল। ওর মা বললেন——-যা না,নাচ গিয়ে। সেই মেয়ে বলল মন্দাকিনীকে——- চল, নাচি। ঐ মেয়ের কথায় মন্দাকিনীও জুটেছে ঐ দলে। আমি চেয়ে আছি।ভাবছি,এই বুঝি মন্দাকিনী ফিরে আসবে!কিন্তু তা হল না।সেট হয়ে গেছে মন্দাকিনী। ঐ তালে কি কোন যাদু আছে!ওদের মতোই কখনও নুয়ে পড়ছে আবার সোজা হয়ে নাচছে। তবে কি মন্দাকিনী নাচ করত ! আমার ই বুঝি জানা হয়নি ওর ঐ গুনের কথা।ওদের স্রোতের সাথে তাল মেলাতে পারল না ঐ মেয়েটি।বেড়িয়ে এল দল থেকে।বাজন দার দ্রুত থেকে দ্রুত তর হতে লাগল। মন্দাকিনী চলেছে সমান তালে। কখনও এঁকে বেঁকে চলছিল নাচ।বাজনা থামতে মন্দাকিনী চলে এল। ওদের অনেকেই মন্দাকিনীর হাত ধরে প্রশংসা করল। শেষ রোদের আলোয় মন্দাকিনীর গালে লালের আভা।চোখে মুখে লজ্জার হাসি।আমার চোখে চোখ পড়তেই গালের লালের ছোপ। পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করে ওদের দিতে বললাম। মন্দাকিনী এগিয়ে গেল সে দিকে। দলনেতৃ টাকাটা নিয়ে ওপরে তুলে ধরে কি যেন বলল।তারপর সবাই মুখে হাত দিয়ে হু হু করে কি যেন বলল। আবার ওরা নাচতে লাগল। এটা বুঝি টাকা পাবার খুশিতেই করল। মেশোমশায় বললেন——- আমাদের মন্দা তো ভালোই নাচে!কি গো মায়া তুমি শুধুই নাচা বন্ধ করে দিলে! মাসীমা বললেন—— বড় হলে নাচ না করাই ভাল। মাসীমার কথা শুনেই তাকালাম মন্দাকিনীর দিকে। এ রুপ কি আমি দেখেছি?আশ্চর্য হলাম সেই কিশোরী কাল থেকেই যাকে চিনি তার এই খবর টুকু জানিনা! মেশোমশায় বললেন—– নাচ হল শিল্প। যারা এই দিমসা নৃত্য করল তাদের কি ছোট মনে করো? মাসীমা বললেন—ওদের কথা ছাড়।আমাদের মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। আমি শক্ত হয়ে গেলাম। এমন একটা টপিক উঠল যে এর সাথে নিজেকে যুক্ত মনে করছি।আমার চোখ ওর চোখে পড়তেই ফিরিয়ে নিল। মেশোমশায় বললেন——-কিসের থেকে কি! আবার গাড়িতে ওঠা একে একে। এবার ঢালের দিকে বাস চলেছে। চলেছি বোরা কেভ এর দিকে। এক পাশে পাহাড়ী ঢাল। অন্য দিকে পাহাড়ের সবুজ। মেশোমশায় বললেন—— কেষ্টা বোরা কেভ এর গভীরতা সম্বন্ধে কিছু কি জান? বললাম ——– না মেশোমশায়। এ সম্বন্ধে কোন রেকর্ড নেই। বাস দাঁড়াল যাত্রীদের ওয়েটিং হলের কাছে।।বাঁয়ে একটা রেস্টুরেন্ট। মাঝ বরাবর একটা গেট।সেই গেট দিয়ে নেমে গেলাম আমরা।যেতে যেতেই বললাম। ——- আঠেরোশো সাত সালে ব্রিটিশ জিওলজিস্ট, ‘উইলিয়াম কিং’ বোরাকেভস আবিষ্কার করেন। ওড়িশার ভাষাতে বোরা মানে গর্ত। এই কেভ প্রকৃতি গত ভাবেই তৈরি।প্রায় হান্ড্রেড ফিফটি মিলিয়ন বছরের পুরনো মন্দাকিনী বলল——-ট্রাইব্যাল রা নাকি একে বোরা দেবতা ভাবে । ভেতরে নাকি শিব পার্বতী আছে? আমাদের রেলের সহযাত্রীরা যে এতক্ষণ আমাদের সঙ্গেই চলছে তা ওদের কথা শুনেই বুঝলাম। মেয়েটির কথা কানে এল। তবে সে মন্দাকিনীকে বলছে। ——— শুধু তাই নয়,আরো অনেক কিছুই আছে। মাদার এন্ড চাইল্ড, হিউম্যান ব্রেন, ক্রোকোডাইল, টাইগার আর গরু আছে। সত্যি নয় কিন্তু। আমাদের সঙ্গী মহিলা তার স্বামীকে বললেন। ——– শুনছো, গুহার ভেতরে কিন্তু আমি নামবো না।অনেক নিচে সিঁড়ি নেমে গেছে। এবার তাদের মেয়ে বলল——– বাপী,তুমি বোন আর মা কে নিয়ে ওপরে থাকো। আমি এদের সঙ্গে নিচে নামছি।বোনের ও কষ্ট হবে। ‘সো ইউ হ্যাভ টু স্যাক্রিফাইস ফর ইয়র ডটার এন্ড ওয়াইফ’। কি বল? ভদ্রলোক বললেন—— মেয়ের আমার দারুণ বুদ্ধি। মেশোমশায় বললেন——– মায়া তোমার ও তো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করা কষ্ট। তাই ওরা ই যাক। মাসীমার দিল খোলার কারণ আমাদের সঙ্গের মেয়েটি। তা বুঝতে আমার অসুবিধা হল না।আমি কেন মেশোমশায়ের ও বুঝতে বাকি নেই। যে আমি ওদের মেয়েকে খারাপ করতে পারব না।কারণ সঙ্গে ঢাল আছে। মেশোমশায়ের খুশির কারণ সিঁড়ি বেয়ে যদি হাটুর দফার রফা হয়!তখন?ভাবতে ভাবতেই হাঁটছিলাম। কানে এল মেশোমশায়ের উঁচু গলার স্বর। ——— সাবধান কেষ্টা,গাইড কে ছেড়ো না তাহলে গোলক ধাঁধায় পড়ে যাবে। আমার দু’পাশের দুই নারী আমাকে চালনা করছে। ওপরে না ওঠা অবধি মুক্তি নেই।কারণ আমার দু’ তরফে গোপীয়া আর মাঝে আমি।মনে হল আমিকি তবে মাসীমার পথে ই ফিরব!কিন্তু আমার পৌরুষত্বে ,ঘা লাগবে এমন কাজ আমায় সাজে না।কানে আসছে গোপীদের কলগুনঞ্জন। ——-ও কৃষ্ণ দা। গাইড চলে যাচ্ছে তো? চমক ভাঙ্গল আমার। দেখলাম গোপীরা নেই।আছে মন্দাকিনী আর সেই সুরসিকা।মন্দাকিনী আজ কি পোষাক পড়েছে?তা এখনও দেখিনি। ছিঃ ছিঃ এমন একটা মেয়ের বেশ বাস আমার চোখেই পড়েনি?ধিক্ আমাকে। সকাল থেকেই যার সঙ্গে রয়েছ তার অঙ্গাবরন টুকু অবধি তোমার মন হয়নি! সুতরাং দোষ স্খলনে লেগে পড়। আমার চোখ ফিরল মন্দাকিনীর ওপরের আবরণটুকুর আঁকে বাঁকে। আজতো আমার প্রেয়সী চুড়িদার পড়েছে।কবজি অবধি ঢাকা তার হাত। গলার কাছে কিছুটা উন্মুক্ত। চোখ ফেরাতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না,কারণ বুকের প্রথম বোতামের কাছে তিন টে সুদৃশ্য ঝুমকোতে আমার চোখ আটকে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

2 thoughts on “বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee”

  1. চোখের সামনে মনে হচ্ছে দৃশ্য গুলো ফুটে উঠছে, খুবই ভালো লাগলো দিদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *