Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee » Page 11

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 21

সবই মন্দাকিনীকে মানায়। তবুও এই টিপটা অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। বুঝলাম আমার দৃষ্টিতে আমার’ মন’ ঘায়েল হয়েছে। এটা বাড়তে দেওয়া যাবে না।কারণ সারাটা পথ দু’ জনকে ই ফিরতে হবে। একেবারেই নিরিবিলিতে।সঙ্গে কেউ নেই। একটা কিছু ঘটতে দিলে বিপদ। কারণ মাসীমা বড় জ্যোতিষী। মুখ দেখেই সব বুঝতে পারেন। ওকে সহজ করতেই বললাম। চল, সুখ সাগরে আইসক্রিম খাওয়া যাক। কথাটা শুনে যা ভেবেছিলাম তাই হল।আইসক্রিম খাবার পর ওখানেই আলাপ হল এক বাঙালি নব দম্পতির সাথে। আমাদের ধারে কাছের হোটেলেই ওরা যাবে।তাই ভাবলাম ওদের দুজনকে ও আমাদের সঙ্গে যেতে বলি। কারণ আমাদের পাশাপাশি বসে যাওয়া ঠিক হবে না।কি জানি যদি মন দুর্বল হয়ে যায়! তাই বলি——— একই রাস্তা তো, চলুন না এক সঙ্গেই যাই। সঙ্গে সঙ্গেই মন্দাকিনী বলল——- ওদের কেন ডিসটার্ব করছো? মহিলা বলল—— না না, এক সঙ্গেই যাব।ভালই হল বাঙালি পাওয়া গেল। সামনে অটো এসে দাঁড়াতেই আমি সামনের সীট এ বসে পড়লাম। বললাম——–আপনারা উঠে পড়ুন। মন্দাকিনীর মুখ ভার দেখেই বুঝলাম ও এই ব্যবস্থায় খুশি নয়।মনে মনে বললাম, তোমার প্ল্যান টা বানচাল হয়ে গেল। আমাদের পৌঁছানোর পর মাসীমা বললেন—– তোমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এবার চল, রাতের খাবার দাবার খেতে হবেতো? কালেক্টরেট অফিস এর উল্টো দিকের রেস্তোরায় ঢুকলাম। মাসীমা আর মেশোমশায় মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন। আমি হাত ধুতে উঠে গেলাম। পিছু ফিরতেই দেখলাম, আমার পেছনেই মন্দাকিনী।ওর দৃষ্টিতে ছদ্মকোপ। চোখে চোখ পড়তেই বলল। অটোতে অমন করলে কেন? আমি নিপাট ভাল মানুষের মত সোনা মুখ করে বললাম। কি করলাম? আমার ভাবখানা এমন যেন কিছুই বুঝতে পারিনি। অথচ আমি জানি ওর রাগের কারণ টা।ওর উদ্দেশ্য বুঝেই আমি ঐ সুযোগ টা হাত ছাড়া করিনি।আর তা না করলে কি আমিই নিজেকে সংযমে রাখতে পারতাম ?আমি হলফ করে বলতে পারি তাতে ওর কষ্ট বাড়তো বৈ কমতো না।সে জন্যই সুযোগটা লুফে নিলাম। আমার মুখের ভঙ্গিতে কি বুঝল কি জানি! বেশ ঝাঁঝিয়ে ই আমাকে বলল। তুমি ভাব আমি বুঝি না? এবার ওর মন গলাতে হাসলাম। আরো রেগে গেল মন্দাকিনী। বলল——– তুমি আমাকে ভয় পাও!কাপুরুষ! আমি বললাম——–সে কি একটা মেয়ে কে ভয় পাব?আমি একটা পুরুষ গো মন্দাকিনী। পুরুষ হলে আমার পাশে বসতে ভয় পেতে না। কথাটা বলতে বলতেই বেসিনের দিকে এগোল মন্দাকিনী। অমনি আমি আমার বাঁ হাত দিয়ে ওকে আমার দিকে ফেরালাম। মন্দাকিনীর ছাল ছাড়ানো দৃষ্টি আমার চোখে।কিন্তু আমার দৃষ্টি ওর শাড়ি ভেদ করে তরঙ্গ তুললো ওর সারা শরীরে।আর সেই তরঙ্গের অনুভব করলাম আমি ওর ঠোঁটের আর আঁখি পল্লবের কম্পন দেখে। আমার চোখে কি ছিল জানিনা। চোখ নামিয়ে নিল মন্দাকিনী।কাঁপা কাঁপা গলায় বলল—— ছাড়। আমি আরও শক্ত হাতে ওকে ধরে বললাম। কি মনে হচ্ছে?আমি পুরুষ?নাকি আরও প্রমাণ দিতে আর একটু এগোতে হবে?এবার বুঝলে কেন তোমার পাশে বসিনি? শেষের কথাগুলো শুধু নিরস ছিল তা নয়।বেশ কঠোর ভাবেই বলেছি।তা বুঝলাম মন্দাকিনীর চোখে জলের আভাস দেখে। ছাড়, লাগছে। কথাটা কানে যেতেই হাত ঢিলে হয়ে গেল। খারাপ লাগল এই ভেবেই, যে নিজের অক্ষমতার বোঝা ওর ওপরে চাপাচ্ছি। উঁচুদরের পাত্র হলে কি ওর উথলে পড়া প্রেমে সারা দিতাম না?কারণ সে প্রেম অসফল হতো না। হঠাৎই নজরে পড়ল মন্দাকিনীর হাতের বাজুতে বারবার জল দিয়ে আমার হাতের ছাপ মুছতে ব্যস্ত। বললাম——-ইস, লাল হয়ে গেছে!দাও একটু ঘষে দেই। ম্যাসেজ করতে করতে কি যেন বলল।শুনতে পেলাম না।কেন যে অমন করে চেপে ধরেছিলাম জানিনা।মনে হল এও আমার অক্ষমতার নজির। তবে জ্যোতিষ ঠাকরণ যে ধরে ফেলবেন?কারণ মন্দাকিনীর মুখে সব রক্ত জমা হয়েছে। কথা অন্য দিকে যাওয়ায় খুশি হলাম। খাওয়া হতে আমি কাউন্টারে এগুলাম। বিচ রোড এ পড়তেই ঠান্ডা হাওয়া।শহরের তাপমাত্রা থেকে এখানের তাপমাত্রা অনেক কম।অটো ধরে গেস্ট হাউজ পৌঁছলাম। বিছানায় শুয়েও বার বার মন্দাকিনীর হাতের লাল ছাপ মনে পড়ছে। এত নৃশংস আমি কি করে হলাম! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কখন যে সকাল হল বুঝতেই পারতাম না।অ্যালার্ম এর শব্দে জেগে গেলাম। কিরানডুল প্যাসেঞ্জার ছাড়বে সাতটা পয়তাল্লিশ এ। তৈরি হয়ে ভাবলাম একটা চক্কর দিয়ে আসি সী বিচ এ।দোতলা থেকে নামলাম নিচে।ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা সারা শরীরে আরাম বুলিয়ে দিল। এক পা এক পা করে এগুলাম সমুদ্র মুখী। রাস্তার ধারেই দাঁড়ালাম। ডানে একটু এগলেই সেই ঐতিহাসিক জায়গা দেখা যাচ্ছে এখান থেকেই। সমুদ্রের ভাঙ্গন থেকে তট ভূমিকে রক্ষা করা হয়েছিল সেই কালেই।সমুদ্র গর্ভে দেবী বিশাখার মন্দির বিলীন হয়ে গেল যখন তখন ই বড় বড় পাথর ফেলে বাধ দেওয়া হয়েছিল। আজও ডাচ ব্যাটারীর সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে কোস্টাল ব্যাটারী।এই সেই জায়গা,যেখানে সতেরো শো আশি সালে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল। সেই সিপাহী রা গ্রেনেড চালিয়ে ‘স্পট ‘ এ সমস্ত অফিসার –দের মেরে ফেলেছিল। ভাবতে ভাবতেই মনে হল সেই যুগে পৌঁছে গেছি। কিন্তু বেশিক্ষণ চিন্তায় ডুবে থাকা গেল না।কারণ পথচারীদের রাস্তা ছেড়ে দিতে হচ্ছিল। সার ফিরল আমার। ঘড়ি দেখলাম, না এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ও বেশী সময় পার হয় নি!কিরানডুল প্যাসেঞ্জার এখন ও অনেক দেরি।তবুও আমাদের সাতটার মধ্যে স্টেশন পৌঁছতে হবে।কারণ সকাল সাতটায় এ পি টুরিজ্ম এর রিপোর্টিং করতে হবে। এদের ব্যবস্থা শুনেছি ভালই। একদিনের “কন্ডাক্টেড ট্যুর “।সকাল সাতটা থেকে রাত নয়টা অবধি ।আরকু ভ্যালি দেখাবে। পথে দেখাবে পদ্মা পুরাণ গার্ডেণ,, ট্রাইব্যাল মিউজিয়াম, জাঙ্গল বেল,টাইডা, অনন্ত গিরি ,কফি প্ল্যন্টেশন, গালি কোন্ডা ভিউ পয়েন্ট, বোরা কেভস। এছাড়াও ট্রাইব্যাল ডান্স মানে দিমসা নাচ ও দেখাবে । মেশোমশায়ের ইচ্ছা ছিল এক রাত আরকু তে থাকার।সে ব্যবস্থাও রেখেছে এরা।আবার হাই টেক ভিডিও কোচ এ আরকু ঘুড়িয়ে দেখাবার ব্যবস্থা ও রেখেছে আরকু। পিঠে হাত পড়তেই চিন্তা ছুটে গেল। দেখলাম আমার পেছনেই মেশোমশায়। বললেন, কি এতো ভাবছো? বললাম——আপনারা তৈরি? হ্যাঁ। তুমি ? আমি তৈরি বলেই ঘরের দিকে এগুলাম। সঙ্গে সঙ্গেই এলেন মেশোমশায়।ভেতরে দেখলাম মাসীমা চেয়ারে বসে আছেন। মন্দাকিনী ভেতর ঘরে। বেশ রুক্ষ স্বরে ই মাসীমা বললেন আমাকে। কি ব্যাপার?কোথায় ছিলে?মন্দাকিনীর গলার হার টা খুঁজে পাচ্ছেনা। কোথায় গেল বলতো? সকাল বেলা এমন একখানা কথায় আমি স্তম্ভিত। একটা হার পাওয়া যাচ্ছে না।তাও আবার যার তার নয়। মন্দাকিনীর, যাকে আমি ভালবাসি।তার ই হার খোয়া গেছে। হঠাৎই মাথায় বিদ্যুতের ঝিলিক। মাসীমা আমাকে চোর দায়ে ধরেননি তো? মনটা মন্দাকিনীর চুরি করলেও হার খানা নেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তাই মনমরা হয়ে বললাম। ভালো করে খুঁজলেই পাবে।যাবে কোথায়। মেশোমশায়ের গলা শুনলাম। আচ্ছা মুশকিল হল দেখি!মন্দার হারের খবর কি আমাকে আর কেষ্টাকে রাখতে হবে?তাহলে তো তোমাকে ও জিজ্ঞেস করি,মন্দার হার খানা কোথায়?পারবে উত্তর দিতে? মেশোমশায় কে মাসীমার কথার প্রতিবাদ করতে দেখে মনে একটু জোর পেলাম। যে ঘরে ঐ মেয়ে রয়েছে সেখানে ঢুকলাম। তবে আওয়াজ দিয়েই। আঁতি পাতি করে খুঁজে চলেছে হার খানা।ওঘর থেকে মেশোমশায়ের গলা কানে এল। আর খুঁজতে হবে না ।দেরি হয়ে যাবে। মন্দাকিনী বেড়িয়ে গেলেও আমি বার হলাম না।শেষ চেষ্টা করি মাসীমার মুখের হাসি ফেরাতে। বেডসীট ঝাড়লাম।না কিছুই নেই। এবার বালিশের ওয়ারে হাত ঢোকালাম। তখুনি হাতে কিছু ঠেকল। একটা কিছু,আরে এ তো সেই ঝুঠো পাথরের গলার হারটা। এ তো সোনার নয়!আমার কেনা সিমহাচলম এর সেই ঝুঠো পাথরের হার!এটা তো আমার পকেটে রেখে ছিলাম। সেই বালিশের ওয়ারের ভেতরেই রেখে দিলাম আবার। হারখানা রেখে দিলেও এ হারের চিন্তা আমার মগজ কে নাড়া দিল বেশি।কারণ ঐ হার কিনলেও আমি এখন ও মন্দাকিনীকে দিতে পারিনি!মানে চেষ্টা করিনি এখন ও।ভেবেছিলাম কলকাতা পৌছেই ওর হাতে দেবো।সেটা ওর কাছে গেল কি করে? ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখলাম সবাই গাড়ির ভেতর বসে আছে।মাসীমা বললেন——- কেষ্টা, পেলে? বললাম, না,মাসীমা। মনে ভাবলাম এমন মিথ্যাচারে দোষ নেই। মাসীমা বললেন——-একবার গেলে আর পাওয়া যায়?যে নিয়েছে, সে বার না করলে কার সাধ্য তা বার করে? মেশোমশায় বললেন——- তখন থেকেই হার হার করছ। যে হারিয়েছে তার চিন্তা নেই তোমার চিন্তা! মাসীমা বললেন, তা হবে কেন?টাকাটা তো বাবার গেছে।ওর আর কি? মা,হারটা হারানোয় তোমার থেকেও আমার বেশি কষ্ট। আর আমার কষ্ট সেটার কতো দাম তা নিয়ে নয়।ওটা দুঃস্প্রাপ্য বলেই।তুমি ভরি নিয়ে ওজন করছো। মাসীমা বলেন——-শোন মেয়ের কথা। দামী!তা টাকাটা কিছুই নয়? মেশোমশায় বললেন ——–তোকে ঠিক অমন টা গড়িয়ে দেবো। মাসীমা বললেন—–কোন হার টারে মন্দা?সেবার জন্ম দিনে যেটা দিয়েছিলাম?ইস্। সেটা গেল? মন্দাকিনী বলল—– তুমি দাওনি। মাসীমা বললেন——তবে কে দিয়েছিল? মন্দাকিনী একটু চুপ করে বলল। আমার এক বন্ধু দিয়েছে। মাসীমা আবার বললেন——– কে সে?তায় আবার সোনার হার দিয়েছিল? আমার বুক টা ধক্ করে উঠল। আমি ছাড়া ও আর একজন আছে যে মন্দাকিনীকে সোনার গহনা দিতে পারে। মনে ভাবলাম, কেষ্টাচরণ তুমি যতোই আকাশে ভেলা ভাসিয়ে স্বপ্ন দেখ না কেন। তুমি স্বর্গের দেবী মন্দাকিনীর কাছে পৌঁছতে পারবে না।কারণ সেই লাইনে আরও একজন আছে।যার পাল্লাটা তোমার থেকেও ভারী।নইলে মন্দাকিনীর গলার স্বর অমন হয়? এবার মেশোমশায়ের গলার স্বর চড়ল। ——মায়া, থামতো। তখন থেকেই হার হার করছ। বন্ধু দিয়েছে। তাই না মা?সোনার হতে পারে না? এবার মন্দাকিনীর গলায় অন্য সুর। ——দিতেই পারে। তবে ওটা সোনার না,।ঝুঠো পাথরের সেটিং হার। দারুণ দেখতে ছিল!ইস্ এখন ও চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। আমায় যেন এক ধাক্কায় কেউ পিছনে ফিরিয়ে দিল। তাই, সে ভাবেই দেখলাম মন্দাকিনীকে। সেই চোখে চোখ পড়তেই ওর চোখ আপনা হতেই নেমে গেল। আমার মন তিড়িং বিড়ং করে লাফ দিয়ে একেবারেই উঠে গেল সেই স্বর্গের সোপানে। যেখানে মন্দাকিনীর সুবর্ণ সিংহাসনে আমার ও বসার জায়গা আছে।সেই দেবী মন্দাকিনীর পাশের জায়গা টুকু শুধুই আমার ই তা ওর চোখের নজর ই বলে দিল। মেশোমশায়ের দম ফাটা হাসিতে আমার চমক ফিরল। মাসীমা বললেন—— হাসছো কেন? মেশোমশায় বললেন——হাসবো না?সকাল থেকেই হেনস্থা করে চলেছ হার নিয়ে। সেটা তো সোনার ভেবেই করেছিলে?শেখো মেয়ের থেকে।সোনার থেকে ও দামী কিছু আছে। তা হল ভালবাসার। স্টেশন এসে যেতে কথা থেমে গেল। এগিয়ে গেলাম ট্রেনের দিকে। মেইন গেট এর সামনেই এ পি টুরিজ্ম এর কোচ্। তাই খুঁজতেই হল না সামনেই উর্দি পরা টুরিজ্ম এর গাইড দাঁড়াল।

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 22

ভাল জায়গাতেই বসলাম। তাও আমাদের পছন্দের জায়গাতেই বসতে দিল। বসার সাথে সাথেই আমাদের ব্রেক ফাস্ট এর প্যাকেট ও মিনারেল ওয়াটার এর চারটে বোতল এসে গেল। একটু পরেই চা এসে গেল। তারপর একখানা সংবাদ পত্র। এটা অবশ্যই চেয়ে নিলাম। প্রাতরাশের পরেই সেই হার খানার কথা মনে এল। চোখাচখির ব্যাপার নেই। কারণ জানালার ধারে সেই মেয়ে বসেছে। তার মা তাকে আড়াল করে বসেছে। পাছে সেই মেয়ের পাশে কেউ বসে যায়! মেশোমশায় মন্দাকিনীর মুখোমুখি বসেছেন। আমার চোখাচখি হলে,হবে মাসীমার সাথেই। আর সেটা যতটা না হয় মঙ্গল।কারণ আমার আঁখির ভাষা এখন সহজ পাঠ্য। তাই একটু ধার ঘেষেই বসলাম। যাতে মাসীমার চোখে আমার চোখ না পড়ে। করুণাময় বোধ হয় আমার কষ্ট কর অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। তাই মনে হল, যখন দেখলাম স্বামী-স্ত্রী তাদের দুই মেয়ে নিয়ে আমাদের কাছে বসল। আমার পাশে বসল বছর কুড়ির মেয়েটি।তার পোষাক দেখে যে কেউ বলে দেবে, যে তাদের ঠাট বাট উচ্চ মহল ঘেষা। যত উচ্চ মহল ঘেষা হোক না কেন, আমাদের পাশে পেয়ে মহিলা যেন ধন্য।চোখাচোখি হতে এক গাল হাসলেন। বললেন—- ভাগ্যিস বাঙালি পেলাম। এ রাস্তায় এতো টানেল যে একটুও ভাল লাগে না। আমি বললাম——– কেন?সবাই তো শুনেছিলাম উপভোগ করে। আমার পাশের মেয়েটি বলল। টানেল এ মা ভয় পায়।বদ্ধ জায়গাতেই এটা হয়।অনেক দিন ধরেই আছে। বললাম—–সাইকোলজিস্ট কে দেখিয়েছেন? মহিলা বললেন—-না না ।দলবল থাকলে ভয় পাই না।লিফ্টে উঠতেও ভয় পাই। যে নিজেকে সারাতে চায় না ,তাকে আর কি বলব? আমাদের ধারণা মনোবিদের কাছে যাওয়া মানে ই পাগলের পর্যায় যাওয়া।এটা ভাবি না শিক্ষাবিদের কাছে যেমন শিক্ষনীয় বিষয় জানতে পারি।তেমন মনোবিদের কাছে গেলেই জানতে পারবো মনের কোন কোন অবস্থা রোগের কোন পর্যায়ে চলে গেছে। তাঁর নির্দেশেই আবার সুস্থ জীবন ফিরে পেতে পারি। কথায় আছে “হ্যাবিট পারফেক্টস এ ম্যান “। আমার হাতে হাত পড়তেই চাইলাম সে দিকে। দেখলাম মেশোমশায় কি যেন বললেন। একটু এগোতেই মেশোমশায় বললেন। গাইড কে বলে দাও ভদ্রমহিলার অজ্ঞান হবার টেন্ডেন্সী আছে। ভয় পেলেই অজ্ঞান হয়ে যায়। বললাম——- তাই নাকি? ——–তোমার মাসীমাকে বললেন মহিলা। বললাম, আমি?ওর স্বামী আছেন। যদি কিছু মনে করে? মেশোমশায় বললেন——- আরে ঝামেলা হলে তো আমাদের ও খারাপ লাগবে।তাই কি না? বললাম——- ঠিক ই বলেছেন। দেখি ওর মেয়ের সাথে কথা বলে। মেয়েটি আমার দিকেই চেয়ে আছে। আমি তাকাতেই হেসে ফেলল মেয়েটি।প্রত্যুত্তরে আমিও হাসলাম। আপনা হতেই আমার দৃষ্টি ছুটল সেই মেয়ের অর্থাৎ আমার মনোহারিনীর দিকে। সন্দিহান বাণ সে চোখে। আমি হলপ করে বলতে পারি ,আমাদের দু’জনের চোখের চালাচালির কিছু না কিছু বুঝেছে আমার পাশে বসা মেয়েটি।তাই ওর হাসিটা এবার একটু পাল্টে গেল। খুব ই নিচু স্বরে বলল। আপনার নাম কি কেষ্টা? না,মানে উনি বললেন তো- – তাই না? বললাম——হ্যাঁ। আবার বলল সে——– ইস, আপনার নাম উত্তম কুমার হলে ভাল মানাতো। বললাম, খুব সিনেমা দেখ বুঝি? বলল——- হ্যাঁ। তাপস, গোবিন্দা, প্রসেনজিৎ হলে তো যাবোই।যতো ঝড় জল হোক না কেন। আপনি যান না ঐ ওকে নিয়ে? চমকে উঠলাম ওর ঈষারায় ।বলে কি এই মেয়ে? মন্দাকিনীকে নিয়ে সিনেমায় যাব?ভাবতেই পারিনা। তাই বললাম। ও আমার ছাত্রী।ওকে পড়াতাম আমি। আবার বলল, কিন্তু ওর সঙ্গে তো আপনার গেম চলছে।এটা কতো নম্বর হল আপনার? মেয়েটির কথা শুনে আমি যার পর নেই আশ্চর্যান্বিত হলাম। কতদূর চৌকশ হলে এমন প্রশ্ন করতে পারে একটা মেয়ে!তাও একজন সম্পূর্ণ অজানা পুরুষকে।তবে ওর মধ্যে কোন অশালীনতা নেই।যেন কোন ঝকঝকে সত্য কে আমার সামনে তুলে ধরছে। দেখলাম মেয়েটি আমার উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। তাই বললাম ——— ভালবাসা কি খেলা? একে তুমি গেম বলো? মেয়েটির মুখ এবার ধারালো হল।সেই ঢং এই বলল। আই আন্ডারস্ট্যান্ড। দ্যাট ইউ আর নট্ ইন দ্যাট টাইপ। অনেকেই এটাকে গেম হিসাবে নেয়। প্রথমেই প্রেমে পড়ি আমার টিউটরের। সে আমার প্রেম কে গেম হিসাবেই নিয়েছিল। পরে বুঝলাম আঘাত পেয়ে লাভ নেই। তাকে বলেছিলে? হ্যাঁ ।সে আমার প্রেমকে সিরিয়াস লি নেয় নি।শিক্ষা হয়েছিল আমার। অ্যাকচুয়ালি ইট ওয়াজ আ গেম। নাউ আই অ্যাম নট টেকিং ইট সিরিয়াসলি। তোমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় না? ইয়েস। বাট থ্যাঙ্ক গড। ভাগ্য সে সিরিয়াস লি নেয়নি।নইলে আমার যে কি অবস্থা হত?অমন লোককে কি করে ভাল বেসেছিলাম? বললাম—– কেন?কি হল তার? ক্যান ইউ ইমাজিন, আমি একটা পেট মোটা, টাক পড়া লোকের বৌ? ওর কথা বলার ধরনে হেসে উঠলাম। আর তখনই নজরে পড়ল, মন্দাকিনী আমায় ডাকছে। ওর জ্বালা টা বুঝে ও না বোঝার ভান করলাম। ইচ্ছা করেই পাশের মেয়েটির দিকে ফিরলাম। বললাম———তা,তোমার তাপস, জিতেন্দর ওদের ও তো টাক পড়েছে। পড়েনি? বলল——-হ্যাঁ। তাপস, ঠিক আছে। আর ওদের সঙ্গে কি সংসার করব?আমার মনে হচ্ছে, আপনার সাথে কথা বলাটা ওর ভাল লাগছে না। ঈশারা টা মন্দাকিনীর দিকে। তবুও আমি বললাম। এখন ও গেম চলছে নাকি? চলছে। বললে ঐ দিদিকে হটিয়ে বসে যেতে পারি বিয়ের পিঁড়ি তে।বলুন রাজী? সুরসিকা বটে মেয়েটি।ওর কথায় হাসি চাপতে পারলাম না।আমার হাসির শব্দেই বুঝি মন্দাকিনী আর বসে থাকতে পারল না।আমার দিকে তাকে উঠে আসতে দেখে আমার পাশের মেয়েটি বলল। কি দেব নাকি হটিয়ে?পিঁড়িতে বসতে রাজি? আমি বললাম চেষ্টার তো কম করো নি। পারলে কি? এবার মন্দাকিনীর দিকে চেয়ে বললাম। ——— তুমি এখানে বসবে? মন্দাকিনী বলল—–কৃষ্ণ দা, তুমি আমার জায়গাতে বস। মেয়ে টি আবার বলল——-বাহ্। আপনার নাম টা তো সুন্দর। এটা কি সবার জন্য?নাকি স্পেশাল কারো জন্য? ওর কথায় আমি মন্দাকিনীর দিকে চেয়ে হাসলাম। আমার হাসিতে হয়তো উত্তর টা লেখা ছিল। তাই সে উঠে মাসীমার কাছে গেল। বলল——–মাসীমা, আপনার পাশে বসি? মাসীমার চুপ করে থাকা দেখে মেশোমশায় বলেন। ——– হ্যাঁ। বস। একসঙ্গে যাচ্ছি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বসলে ভাল ই লাগবে। মাসীমার পাশের জায়গাতে বসে আবার উঠে এল আমার দিকে। বলল——আপনার এখানে ম্যাগাজিন টা ফেলে গেছি। মাথা নিচু করে তুলে নিল ম্যাগাজিনটা। তখন ই মন্দাকিনীর কানের কাছে মুখ নিয়ে কি যেন বলল। কি বলল ঐ আধুনিকা! তা জানার আগ্রহ থেকেই গেল। জিজ্ঞেস করলাম না মন্দাকিনীর মুখের ভার ভাব দেখে। একটু পরেই মন্দাকিনী বলল— কি গল্প করছিল তোমার সাথে? বললাম——- কি আবার?সিনেমা দেখি কিনা? তাতে ওর কি?এতক্ষণ যে হাসছিলে? বাহ্। হাসির কথা বললে হাসব না?ওর সাথে কথা বলায় তুমি খারাপ মনে করোনি তো? ফাঁদে পড়ে গেল মন্দাকিনী। আমতা আমতা করে বলল। খারাপ?না।তবে একটা যুবতী মেয়ের বেশি হাসাহাসি করলে ভাল দেখায় না। ওর মা ও কেমন, মেয়েকে শাসন করে না। বললাম——-তুমি কি ওকে ঈর্ষা করছো? ——- কেন?মেয়েটা সুন্দর বলে? ——-ওর থেকেও তুমি অনেক বেশি সুন্দর মন্দাকিনী। একভাবেই চেয়েছিলাম মন্দাকিনীর দিকে। বুঝি স্থান কাল ভুলে গিয়েছিলাম। যদি না ঐ মেয়েটির ডাক শুনতাম। বলল সেই মেয়েটি—–কৃষ্ণ দা,জায়গা বদলাবেন কি? চমকে তাকালাম ওর দিকে। মুখে ওর বজ্জাতির হাসি।উঠতে যাচ্ছিলাম আমি। মন্দাকিনী চিমটি কেটে বসিয়ে দিল আমায়। আমার হয়ে ঐ মেয়েটিকে বলল মন্দাকিনী । তুমি এখন বস, দরকার হলে বলব। মন্দাকিনী আমার দিকে ফিরে বলল। ——– খুব বাজে মেয়ে! তাই না গো ?ছ্যাব্ লা। চুপ করে রইলাম আমি। কি বললে মন্দাকিনী কি ভাবে!তা ভেবেই চুপ করে থাকা।আমার চুপ করাটা মন্দাকিনীর পছন্দ হবে না তা জানি।কারণ ঐ মেয়েটির সাথে মন্দাকিনীর শিক্ষা সহবৎ এর কোন মিল নেই। ঐ মেয়ে বাইরের জগতের উপযোগী। মন্দাকিনী সংসারের শ্রীময়ী নারী। চমক ফিরল আমার, মন্দাকিনীর কথায়। ——– কি গো ওর সঙ্গে আমাকে নিয়ে কোন কথা হচ্ছিল? বললাম——কেন? না।আমার কানে কানে কি বলল জান? —— কি বলল? বলল, “কিছুক্ষণের জন্য তোমাকে দিলাম”। আরকু পৌঁছে আর পাবে না।তখন কৃষ্ণ দা পুরোপুরি আমার। হাঃ হাঃ করে হাসলাম। বললাম। তোমাকে রাগাতেই বলেছে।আমায় বলেছে, আমি রাজী থাকলে তোমাকে হটিয়ে বিয়ের পিঁড়ি তে বসে যাবে। তারমানে, তুমি কিছু বলেছ?নইলে কেন বলবে?কি বাজে মেয়ে। ——— আমায় কিছুই বলতে হয়নি।তোমার নজর বলে দিয়েছে সব।আরে ওরা প্রেম করে না।ভালবাসে না।আবার ছলনা ও করেনা।মেয়েটা দিল খোলা,দেখলে না কেমন কায়দা করে তোমাকে আমার পাশে বসিয়ে দিল? দেখলাম মাসীমা অবধি আমাদের দিকে দৃষ্টি দিতে পারছেন না ঐ মেয়ের খপ্পরে পড়ে। মন্দাকিনী বলল —— বাব্বা,তুমি দেখি ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমিও উত্তরে বললাম—— কি আর করব বলো? পথে ঘাটে বন্ধু পেলে লাভ বৈ লোকসান নেই। যদি যদি দু একটা ঝুঠো গয়না দক্ষিণায় পাই।যেমন টা তোমার এক বন্ধু তোমায় দিয়েছে।বলো নি তো, তোমার এক বন্ধু আছে? ধারাল উত্তর মন্দাকিনীর ——ও তোমাকে দেবে? না তুমি আগ বাড়িয়ে আছো দেবার জন্য?আর শোন, তোমার মত আমি বন্ধু খুঁজি না। ——-দেবো, তা কি করে ভাবলে?তোমায় তো কিছুই দেই নি আমি।কি গো, দিয়েছি তোমাকে? আমার ঐ কথায় মন্দাকিনীর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আবার নিভে গেল সে হাসি। মন্দাকিনী বলল——-দাও নি,কিন্তু কিনেছিলে তো? না বোঝার ভান করে বললাম—— কি কিনেছিলাম? আবার ও বলল, —- ন্যাকামো করো না তো।।দাওনি, তবে কিনেছিলে তো আমার জন্য ঐ ঝুঠো পাথরের নেকলেস টা! বজ্জাতি করেই বললাম——তাই বল। আমি তো ভুলে গিয়েছিলাম। পকেটে ও দেখলাম নেকলেস টা নেই। আবার মন্দাকিনী বলল থাকবে কি করে? আমি তো নিয়ে নিয়েছিলাম পরের দিন সকালে। যা বেখেয়াল তুমি!কোথাও ফেলবে,আর পাবো না। ইচ্ছাকরেই বললাম—– তা,সেটা তো পড়লেই পারতে? মন্দাকিনী বলল—–আরে, সেটাই তো হারিয়ে ফেলেছি!মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই প্রথম একটা জিনিস তুমি দিলে, তাও হারিয়ে ফেললাম। আশা ছিল হারিয়ে যাওয়া হার আমার ই কেনা।তবুও ওর মুখে ঐ কথা শুনে অপার আনন্দে আত্মহারা হলাম। গাড়ির বলা মন্দাকিনীর বলা কথাগুলো মনে হল।”দুঃস্প্রাপ্য হার”,”বন্ধু” দিয়েছে। আত্মহারা হয়েই বললাম —-তোমাকে আবার ঐ রকমের হার আমি কিনে দেব। লজ্জা পেয়ে মন্দাকিনী বলল—–না না আর কিনতে হবে না। মনে মনে বললাম, তোমাকে তো আমি উজার করে দিতে চাই। মুখে বললাম——–, সেই হার টাই যদি তোমাকে দেই? মন্দাকিনীর চোখের হাজার বাতি জ্বেলে উঠল। সেই আলোয় মুগ্ধ আমি। মন্দাকিনী বলল——-তার মানে তুমি হারটা পেয়েছ? মন্দাকিনীর গলার স্বরের উচ্ছাস ছড়িয়ে পড়ল গুহার ভেতরে।ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনি আছড়ে পড়তে লাগল গুহার পাথরে। রেল গাড়ির শব্দে কেউ কিছুই শুনল কিনা জানি না।আমার মনে হল, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে মন্দাকিনীর আনন্দের ভাষা। শুধু কি আনন্দের ভাষা?সেই সঙ্গে সেই মেয়ের মুখের রং রুপ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার মতো হল। পলকহীন নজর আমার হোঁচট খেল গাড়ির এক ঝাঁকিতে। ছোট একটা স্টেশন এ ট্রেন থামল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

2 thoughts on “বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee”

  1. চোখের সামনে মনে হচ্ছে দৃশ্য গুলো ফুটে উঠছে, খুবই ভালো লাগলো দিদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *