আদালতে দায়রা মামলা চলছিল
ক.
আদালতে দায়রা মামলা চলছিল। মামলার সবে প্রারম্ভ।
মফস্বলের দায়রা আদালত। পশ্চিম বাঙলার পশ্চিমদিকের ছোট একটি জেলা। জেলাটি সাধারণত শান্ত! খুনখারাবি দাঙ্গা-হাঙ্গামা সচরাচর বড় একটা হয় না। মধ্যে মধ্যে যে দু-চারটে। দাঙ্গা বা মাথা-ফাটাফাটি হয় সে এই কৃষিপ্রধান অঞ্চলটিতে চাষবাস নিয়ে গণ্ডগোল থেকে পাকিয়ে ওঠে। কখনও কখনও দু-একটি দাঙ্গা বা মারামারি নারীঘটিত আইনের ব্যাপার নিয়েও ঘটে থাকে। অধিকাংশই নিম্ন আদালতের এলাকাতেই শেষ হয়ে যায়, কৃচিৎ দুটি-চারটি আইনের জটিলতার টানে নিম্ন আদালতের বেড়া ডিঙিয়ে দায়রা আদালতের এলাকায় এসে। পড়ে। যেমন সাধারণ চুরি কিন্তু চোর পাঁচ জন—সুতরাং ডাকাতির পর্যায়ে পড়ে জজআদালতের পরিবেশটিকে ঘোরালো করে তোলে। চাষের ব্যাপার সেচের জল নিয়ে মারামারি, আঘাত বড়জোর মাথা-ফাটাফাটি, কিন্তু দু পক্ষের লোকের সংখ্যাধিক্যের জন্য রায়টিং-এর চার্জে দায়রা আদালতে এসে পৌঁছয়। এই কারণে জেলাটি সরকারি দপ্তরে বিশ্রামের জেলা বলে গণ্য করা হয় এবং কর্মভারপীড়িত কর্মচারীদের অনেক সময় বিশ্রামের সুযোগ দেওয়ার জন্য এই জেলাতে পাঠানো হয়। কিন্তু বর্তমান মামলাটি একটি জটিল দায়রা মামলা।
খুনের মকদ্দমা। আদালতে লোকের ভিড় জমেছে। মামলাটি শুধু খুনের নয়, বিচিত্র খুনের মামলা।
অশোক-স্তম্ভখচিত প্রতীকের নিচেই বিচারকের আসনে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। অচঞ্চল, স্থির, নিরাসক্ত মুখ, অপলক চোখের দৃষ্টি। সে-দৃষ্টি সম্মুখের দিকে প্রসারিত কিন্তু কোনো কিছুর উপর নিবন্ধ নয়। সামনেই কোর্টরুমের ডান দিকের প্রশস্ত দরজাটির ওপাশে বারান্দায় মানুষের আনাগোনা। বারান্দার নিচে কোৰ্টকম্পাউন্ডের মধ্যে শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের রিমিঝিমি বর্ষণ বা দেবদারু গাছটির পত্রপল্লবে বর্ষণসিক্ত বাতাসের আলোড়ন, সবকিছু ঘষা কাচের ওপারের ছবির মত অস্পষ্ট হয়ে গেছে। একটা আকার আছে, জীবন স্পন্দনের ইঙ্গিত আছে, কিন্তু তার আবেদন নেই; বন্ধ জানালার ঘষা কাচের ঠেকায় ওপারেই হারিয়ে গেছে। সরকারি উকিল প্রারম্ভিক বক্তৃতায় ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে মামলাটির আনুপূর্বিক বিবরণ বর্ণনা করে যাচ্ছিলেন। জ্ঞানেন্দ্রবাবুর দৃষ্টি মনের পটভূমিতে সেই ঘটনাগুলিকে পরের পর তুলি দিয়ে এঁকে এঁকে চলেছিল। কৃচিৎ কখনও সামনের টেবিলের উপর প্রসারিত তার ডান হাতখানিতে ধরা পেন্সিলটি ঘুরে ঘুরে উঠছিল অথবা অত্যন্ত মৃদু আঘাতে আঘাত করছিল। তাও খুব জোর মিনিটখানেকের জন্য।
প্রবীণ গম্ভীর মানুষ। বয়স ষাটের নিচেই। গৌরবর্ণ সুপুরুষ, সরল কর্মঠ দেহ, কিন্তু মাথার চুলগুলি সব সাদা হয়ে গেছে। পরিচ্ছন্নভাবে কামানো গৌরবর্ণ মুখে নাকের দু-পাশে দুটি এবং চওড়া কপালে সারি সারি কয়েকটি রেখা তাঁর সারা অবয়বে যেন একটি ক্লান্ত বিষণ্ণতার ছায়া। ফেলেছে। লোক, বিশেষ করে উকিলেরা_যাঁরা তাঁর চাকরি জীবনের ইতিহাসের কথা জানেন বলেন, অতিমাত্রায় চিন্তার ফল এ-দুটি। মুনসেফ থেকে জ্ঞানেন্দ্রবাবু আজ জজ হয়েছেন, সে অনেকেই হয়, কিন্তু তাঁর জীবনে লেখা যত রায় আপিলের অগ্নি-পরীক্ষা উত্তীৰ্ণ হয়েছে এত আর কারুর হয়েছে বলে তারা জানেন না। রায় লিখতে এত চিন্তা করার কথা তারা। একালে বিশেষ শোনেন নি। শুধু তাই নয়, তার চিন্তাশক্তির গভীরতা নাকি বিস্ময়কর। প্রমাণ প্রয়োগ সাক্ষ্যসাবুদের গভীরে ড়ুব দিয়ে তার এমন তত্ত্বকে আবিষ্কার করেন যে, সমস্ত কিছুর সাধারণ অর্থ ও তথ্যের সত্য আমূল পরিবর্তিত হয়ে গিয়ে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়-অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারে তিনি ক্ষমাহীন। একটি নিজস্ব তুলাদণ্ড হাতে নিয়ে তিনি ক্ষুরের ধারের উপর পদক্ষেপ করে শেষ প্রান্তে এসে তুলদণ্ডের আধারে যে আধেয়টি জমে ওঠে তাই অকম্পিত হাতে তুলে দেন, সে বিষই হোক আর অমৃতই হোক।
খ.
কর্মক্লান্ত জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্রাম নেবার জন্যই এই ছোট এবং শান্ত জেলাটিতে মাসকয়েক আগে এসেছেন। ইতিমধ্যেই উকিল এবং আমলা মহলে নানা গুজবের রটনা হয়েছে। জ্ঞানেন্দ্রনাথের আরদালিটি হাল-আমলের বাঙালির ছেলে। এদিকে ম্যাট্রিক ফেল। কৌতুহলী উকিল এবং আমলারা তাকে নানান প্রশ্ন করে। জ্ঞানেন্দ্রনাথ সাধারণত আদালত এবং নিজের কুঠির মধ্যেই আবদ্ধ থাকেন। ক্লাবের সভ্য পর্যন্ত হন নি। এ নিয়ে উচ্চপদস্থ কর্মচারীমহলেও গবেষণার অন্ত নেই।
এ প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন–জ্ঞানেন্দ্রনাথ নাকি বলেন যে, তাঁর স্ত্রী আর বই এই দুটিই হল তার সর্বোত্তম বন্ধু। আর বন্ধু তিনি কামনা করেন না।
প্রবাদ অনেক রকম তার সম্বন্ধে। কেউ বলে তিনি শুচিবায়ুগ্রস্ত ব্রাহ্ম। কেউ বলে তিনি পুরো নাস্তিক। কেউ বলে লোকটি জীবনে বোঝে শুধু চাকরি। কেউ বলে ঠিক চাকরি নয়, বোঝে শুধু আইন। পাপ-পুণ্য, সৎ-অসৎ ধৰ্ম-অধৰ্ম, এসব তার কাছে কিছু নেই, আছে শুধু আইনানুমোদিত আর বেআইনি। ইংরেজিতে যাকে বলে—লিগাল আর ইলিগাল।
তাঁর স্ত্রী সুরমা দেবীও জজের মেয়ে। জাস্টিস চ্যাটার্জি নামকরা বিচারক। এখনও লোকে তার নাম করে। ব্যারিস্টার থেকে জজ হয়েছিলেন। সুরমা দেবী শিক্ষিতা মহিলা। অপরূপ সুন্দরী ছিলেন সুরমা দেবী এক সময়। আজও সে-সৌন্দর্য ম্লান হয় নি। নিঃসন্তান সুরমা দেবীকে এখনও পরিণত বয়সের যুবতী বলে ভ্ৰম হয়। এই সুরমা দেবীও যেন তাঁর স্বামীর ঠিক নাগাল পান না।
জজসাহেবের আরদালিটি সাহেবের গল্পে পঞ্চমুখ। সেসব গল্পের অধিকাংশই তার শুনে সংগ্রহ করা। কিছু কিছু নিজের দেখা। সে বলে—মেমসাহেবও হাঁপিয়ে ওঠেন এক এক
সময়।
ঘাড় নেড়ে সে হেসে বলে রাত্রি বারটা তো সাহেবের রাত নটা। বারটা পর্যন্ত রোজ কাজ করেন। নটায় আরদালির ছুটি হয়। মেমসাহেব টেবিলের সামনে বসে থাকেন; সাহেব। নথি ওলটান, ভবেন, আর লেখেন। আশ্চর্য মানুষ, সিগারেট না, মদ না, কফি না; চা দু কাপ দু বেলা—বড়জোর আর এক-আধ বার। চুপচাপ লিখে যান। মধ্যে মধ্যে কাগজ ওলটানোর খসখস শব্দ ওঠে। কখনও হঠাৎ কথা—একটা কি দুটো কথা, বইখানা দাও তো! বলেন। মেমসাহেবকে। আউট হাউস থেকে আরদালি বয়েরা দেখতে পায় শুনতে পায়।
এখানকার দু-চার জন উকিল, উকিলবাবুদের মুহুরি এবং জজ-আদালতের আমলারা এসব। গল্প সংগ্রহ করে আরদালিটির কাছে।
আরদালি বলে–তবে মাসে পাঁচ-সাত দিন আবার রাত দুটো পর্যন্ত। ঘরে ঘুমিয়ে পড়ি। দেড়টা-দুটোর সময় আমার রোজই একবার ঘুম ভাঙে। তেষ্টা পায় আমার। ছেলেবেলা থেকে। ওটা আমার অভ্যেস। উঠে দেখতে পাই সাহেব তখনও জেগে। ঘরে আলো জ্বলছে। প্রথম প্রথম আশ্চর্য হতাম, এখন আর হই না। প্রথম প্রথম সাহেবের ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়েও থমকে দাঁড়াতাম, সাহেব না ডাকলে যাই কী করে? দুই-এক দিন চুপিচুপি ঘরের পিছনে জানালার পাশে দাঁড়াতাম। দেখতাম টেবিলের উপর ঝুঁকে সাহেব তখনও লিখছেন। এক-একদিন শুনতাম শুধু চটির সাড়া উঠছে। বুঝতে পারতাম সাহেব ঘরময় পায়চারি করছেন। এখনও শুনতে পাই। কোনো কোনো দিন বাথরুমের ভেতর আলো জ্বলে, জল পড়ার শব্দ ওঠে, বুঝতে পারি মাথা ধুচ্ছেন সাহেব। ওদিকে সোফার উপর মেমসাহেব ঘুমিয়ে থাকেন। খুটখাট শব্দ উঠলেই জেগে ওঠেন।
বলেন-হল? এক-একদিন মেমসাহেব ঝগড়া করেন। এই তো আমার চাকরির প্রথম বছরেই; বুঝেছেন, আমি ওই উঠে সবে বাইরে এসেছি; দেখি মেমসাহেব দরজা খুলে বাইরে এলেন। খানসামাকে ডাকলেন–শিউনন্দন! ওরে!
ভিতর থেকে সাহেব বললে-না না। ও কি করছ? ডাকছ কেন ওদের?
মেমসাহেব বললেন– ইজিচেয়ারখানা বের করে দিক।
আমি নিজেই নিচ্ছি—ওরা সারাদিন খেটে ঘুমাচ্ছে। ডেকো না। সারাদিন খেটে রাত্রে না-ঘুমালে ওরা পারবে কেন। মানুষ তো!
আরদালি বিস্ময় প্রকাশের অভিনয় করে বলে—দেখি সাহেব নিজেই ইজিচেয়ারখানা টেনে বাইরে নিয়ে আসছেন। আমি যাচ্ছিলাম ছুটে। কিন্তু মেমসাহেব ঝগড়া শুরু করে দিলেন। আর কী করে যাই? চুপ করে দাঁড়িয়ে শুধু শুনলাম। মেমসাহেব নাকি বলেন-আরদালি এবার বলে যায় তার শোনা গল্প, পুরনো আরদালির কাছে শুনেছে সে, সুরমা নাকি আগে প্রায়ই ক্ষুব্ধভাবে বলতেন—দুনিয়ার সবাই মানুষ। রাত্রে ঘুম না-হলে কারুরই চলে না। ফলে শুনেছি এক ভগবানের। তা জানতাম না যে, জজিয়তি আর ভগবানগিরিতে তফাত নেই। তারপর বলেন, তাই-বা কেন? আমার বাবাও জজ ছিলেন।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ হাসতেন। হেসে আর-একখানা চেয়ার এনে পেতে দিয়ে বলতেন–বোসো
রায় লেখা তখন শেষ হয়ে যেত। সুরমাও বুঝতে পারতেন। স্বামীর মুখ দেখলেই তিনি তা বুঝতে পারেন। রায় লেখা শেষ না-হলে সুরমা কোনো কথা বলেন না। ওই দুটো-চারটে কথা-চা খাবে? টেবিলফ্যানটা আনতে বলব? এই। বেশি কথা বলবার তখন উপায় থাকে না। বললে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বলেন, প্লিজ, এখন না, পরে বোলো যা বলবে।
রায় লেখা হয়ে গেলে তখন তিনি কিন্তু আরেক মানুষ। সুরমা বলতেন—মুনসেফ থেকে তো জজ হয়েছ। ছেলে নেই, পুলে নেই। আর কেন? আর কী হবে? হাইকোর্টের জজ, না সুপ্রিমকোর্টের জজ? ওঃ! এখনও আকাঙা গেল না?
জ্ঞানেন্দ্রনাথের একটি অভ্যেস-করা হাসি আছে। সেই হাসি হেসে বলতেন বা বলেন না। আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। ঠিক সময়ে রিটায়ার করব এবং তারপর সেই ফাষ্ট্র বুকের নির্দেশ মেনে চলব। গেট আপ অ্যাট ফাইভ, গো টু বেড অ্যাট নাইন। তা-ই বা কেন—এইট। সকালে উঠে মর্নিং-ওয়াক করব; তারপর থলে নিয়ে বাজার যাব। বিকেলে মার্কেটে গিয়ে তোমার বরাতমত উলসুতো কিনে আনব। এবং বাড়িতে তুমি ক্রমাগত বকবে, আমি শুনব। কিন্তু যতদিন চাকরিতে আছি, ততদিন এ থেকে পরিত্রাণ আমার নেই।
আর একদিন, বুঝেছেন;–আরদালি বলে আর একদিনের গল্প।
সুরমা বলেছিলেন-আচ্ছা বলতে পার, সংসারে এমন মানুষ কেউ আছে যার ভুল হয় না?
জ্ঞানেন্দ্রনাথ বলেছিলেন–না নেই।
সুরমা বলেছিলেন—তবে?
–কী হবে?
–এই যে তুমি ভাব তোমার রায় এমন হবে যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেউ পালটাতে পারবে না। হাইকোর্ট না, সুপ্রিমকোর্ট না—এ দম্ভ তোমার কেন?
দম্ভ? জ্ঞানেন্দ্রনাথ হা-হা করে হেসে উঠেছিলেন। আরদালি বলে—সে কী হাসি! বুঝেছেন না। যেন মেমসাহেব নেহাত ছেলেমানুষের মত কথা বলেছেন। মেমসাহেব রেগে গেলেন, বললেন– হাসছ কেন? এত হাসির কী আছে?
সাহেব বললেন–তুমি দম্ভ, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, কথাগুলো বললে না, তাই।
মেমসাহেব বললেন–ভুল হয়েছে। ভগবানও পালটাতে পারবেন না বলা উচিত ছিল। আমার।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন—উঁহুঁ, ওসব কিছুর জন্যেই নয় সুরমা। হাসলাম মেয়েরা চিরকালই মেয়ে থেকে যায় এই ভেবে।
–তার মানে?
—মানে? তুমি তো সে ভাল করে জান সুরমা। এবং সে কথাটা তো আমার নয়, আমার গুরুর, তোমার বাবার। দম্ভ নয়, হাইকোর্টে রায় টিকবে কি না-টিকবে সেও নয়, সে কখনও ভাবি নে। ভাবি আজ নিজে যে রায় দিলাম, সে রায় দু মাস কি ছ মাস কি ছবছর পরে ভুল হয়েছে বলে নিজেই নিজের উপর যেন না স্ট্রিচার দিই। শেষটায় খুব রাগ করে তুমি ভগবানের কথা তুললে–। মধ্যে মধ্যে জজগিরি আর ভগবানগিরির সঙ্গে তুলনাও কর—
সুরমা সেদিন স্বামীর কথার ওপরেই কথা কয়ে উঠেছিলেন, বেশ খোঁচা দিয়ে বলেছিলেন না, তা বলি না কখনও। বলি, আমার বাবাও জজ ছিলেন; তার তো এমন দেখি নি। আরও অনেক জজ আছেন, তাদেরও তো এমন শুনি নে। বলি, তোমার জজিয়তি আর ভগবানগিরিতে তফাত নেই। হ্যাঁ, তা বলিই তো। তোমাকে দেখে অন্তত আমার তাই মনে হয়।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ চোখ দুটি বন্ধ করে প্রশান্তভাবে মিষ্টি হেসে বলেছিলেন—তাই। আমার জজিয়তি আর ভগবানগিরির কথাই হল। আমি অবিশ্যি ভগবানে বিশ্বাস ঠিক করিনে, সে তুমি জান, তবু তুলনা যখন করলে তখন ভগবানগিরির যেসব বর্ণনা তোমরা কর—ভাল ভাল কেতবে আছে—সেইটেকেই সত্য বলে মেনে নিয়ে বলি, আমার জজিয়তি ভগবানগিরির চেয়েও কঠিন। কারণ ভগবান সর্বশক্তিমান, তার উপরে মালিক কেউ নেই, সূক্ষ্ম বিচারক নিশ্চয়ই, কিন্তু তবুও অটোক্র্যাট। অন্তত করুণা করতে তার বাধা নেই। ইচ্ছে করলেই আসামিকে দোষী জেনেও বেকসুর মাফ করে খালাস দিতে পারেন। পাপপুণ্যের ব্যালান্সশিট তৈরি করে পুণ্য বেশি হলে পাপগুলোর চার্জশিট ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে নিক্ষেপ করতে পারেন। মানুষ জজ তা পারে না। আমি তো পারিই না।
বার লাইব্রেরি থেকে আদালতের সামনের বটতলা পর্যন্ত এমনি ধরনের আলাপ-আলোচনার মধ্যে এই মানুষটির সমালোচনা দিনে এক-আধ বার না-হয়ে যায় না। এসব কথা অবশ্য পুরনো কথা। জেলা থেকে জেলায় তাঁর বদলির সঙ্গে সঙ্গে কথাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এখন জানেন্দ্রনাথ আরও স্বতন্ত্র এবং বিচিত্র। অহরহ চিন্তাশীল প্রায় এক মৌনী মানুষ। মেমসাহেবও তাই। দুজনেই যেন পরস্পরের কাছে ক্ৰমে মৌন মূক হয়ে যাচ্ছেন। এই দুকূল পাথার নদীর বুকে দুখানি নৌকা দুদিকে ভেসে চলেছে।
গ.
সরকারি উকিল অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মামলার ঘটনাগুলির বর্ণনা করে চলেছিলেন। অবিনাশবাবু প্রবীণ এবং বিচক্ষণ উকিল। বক্তা হিসাবে সুনিপুণ এবং আইনজ্ঞ হিসাবে অত্যন্ত তীক্ষ্ণধী। এই বিচারকটিকে তিনি খুব ভাল করে চেনেন। আরদালির কথা থেকে নয়, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। এবং এই জেলায় আসার পর থেকে নয়, তার অনেক দিন আগে থেকে। এ। জেলায় তখন সরকারি উকিল হন নি তিনি; তার পরের তখন প্রথম আমল। আশপাশের জেলা থেকে তাঁর তখন ডাক পড়তে শুরু হয়েছে। জীবনে প্রতিষ্ঠা যখন প্রথম আসে তখন সে একা আসে না, জলস্রোতের বেগের সঙ্গে কল্লোল-ধ্বনির মত অহঙ্কারও নিয়ে আসে। তখন সেঅহঙ্কারও তার ছিল। একটি দায়রা মামলার আসামির পক্ষ সমর্থন করতে গিয়েছিলেন। সে মামলায় উনি তাকে যে তিরস্কার করেছিলেন তা তিনি আজও ভুলতে পারেন নি। আজও মধ্যে মধ্যে হঠাৎ মনে পড়ে যায়।
সেও বিচিত্ৰ ঘটনা। বাপকে খুন করার অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিল ছেলে। ষাট বছর। বয়সের বৃদ্ধ বাপ, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের জোয়ান ছেলে, সেও দুই ছেলের বাপ। মামলায় প্রধান সাক্ষী ছিল মা। ছেলেটি কৃতকর্মা পুরুষ। যেমন বলশালী দেহ তেমনি অদম্য সাহস, তেমনি। নিপুণ বিষয়বুদ্ধি। প্রথম যৌবন থেকেই বাপের সঙ্গে পৃথক।
বাপ ছিল বৈষ্ণব, ধর্মভীরু মানুষ। বিঘা সাতেক জমি, ছোট একটি আখড়া ছিল সম্পত্তি। তার সঙ্গে ছিল গ্রামের কয়েকটি বৃত্তি। কার্তিক মাসে টহল, বারমাসে পার্বণে—ঝুলন, রাস, দোল, জন্মাষ্টমী, নন্দোৎসবে নাম-কীর্তন এবং শবযাত্রায় সংকীর্তন গাইত, তার জন্য গ্রাম্য বৃত্তি ছিল। এতেই তার চলে যেত। ছেলে অন্য প্রকৃতির, গোড়া থেকেই সে এ-পথ ছেড়ে বিষয়ের পথ ধরেছিল। চাষের মজুর খাটা থেকে শুরু, ক্ৰমে কৃষণি, তারপর গরু কিনে ভাগচাষ, তারপর জমি কিনে চাষী গৃহস্থ হয়েছিল। তাতে বাপ আপত্তি করে নি; প্রশংসাই করত। কিন্তু তারপর ছেলের বুদ্ধি যেন অসাধারণ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। নিজের জমির পাশের জমির সীমানা কেটে নিতে শুরু করল এবং এমন চাতুর্যের সঙ্গে কেটে নিতে লাগল যে অঙ্গচ্ছেদের বেদনা যখন অনুভূত হল তখন দেখা গেল যে, কখন কতদিন আগে যে অঙ্গটি ছিন্ন হয়ে গেছে, তা যার জমির অঙ্গ ছিন্ন হয়েছে, সেও বলতে পারে না। হঠাৎ প্রয়োজনের সময় অর্থাৎ চাষের সময় দেখা যেত বলাই দাসের ছোট জমি বেড়ে গেছে এবং অন্যের বড় জমি ছোট হয়ে গেছে। এবং তখন ছিন্নাঙ্গ জমির মালিক সীমানা মাপতে এলে বলাই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিত, জোর করলে লাঠি ধরত; সালিসি মান্য করলে আদালতের ভোলা দরজার দিকে পথ-নির্দেশ করে সালিসি অমান্য করে আসত। বাপ অনেক হিতোপদেশ দিলে, কিন্তু ছেলে শুনলে না; ধর্মের ভয় দেখালে, ছেলে নিৰ্ভয়ে উচ্চ-হেসে উঠে গেল। ওদিকে বাড়ির ভিতরেও তখন শাশুড়ি-পুত্রবধূতে বিরোধ বেধেছে। বৈষ্ণবের সংসারে বধূটি পেঁয়াজ ঢুকিয়েই ক্ষান্ত হয় নি, মাছ ঢুকিয়েছে এবং ছেলে তাকে সমর্থন করেছে। একদিন মা এবং বউয়ের ঝগড়ার মধ্যে বলাই দাস মাকে গালাগাল দিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, এক অন্নে এক ঘরে সে আর থাকবে না, পোষাবে না। বাড়ির পাশেই সে তখন নূতন ঘর তৈরি করেছে। বাপ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেছিল-জয় মহাপ্রভু, তুমি আমাকে বাঁচালে!
আর বলাই দাসের অবাধ কর্মোদ্যম। তাতে বাপ মাথা হেঁট করে নিজের মৃত্যু কামনা করেছিল। হঠাৎ পুত্রবধূ দুটি ছেলে রেখে মারা গেল। বলাই দাস স্ত্রীর শ্রাদ্ধে বৈষ্ণব ভোজন অন্তে বন্ধুবান্ধব ভোজন করালে মদ-মাংস-সহযোগে এবং গোপন করার চেষ্টা করলে না, নিজেই মত্ত অবস্থায় পথে পথে স্ত্রীর জন্য কেঁদে বলে বেড়ালে—তার জীবনে কাজ নেই, কোনো কিছুতে সুখ নেই, সংসার ত্যাগ করে সে চলে যাবে। সন্ন্যাসী হবে।
বাপ মহাপ্রভুর দরজায় মাথা কুটলে। এবং ছেলের বাড়িতে গিয়ে তাকে তিরস্কার করে এল। বলাই দাস কোনো উত্তর-প্রত্যুত্তর করলে না, কিন্তু গ্রাহ্য করলে হলেও মনে হল না, উঠে চলে গেল।
দিন তিনেক পর ভোরবেলা উঠে বাপ পথে বেরিয়েই দেখলে বলাই দাসের বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে আতর বলে একটি স্বৈরিণী, গ্রামেরই অবনত সম্প্রদায়ের মেয়ে। বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে চলে গিয়েছে; ঝুমুর দলে নেচে গেয়ে এবং তার সঙ্গে দেহ ব্যবসায় করে বেড়ায়; মধ্যে মাঝে দু-দশ দিনের জন্য গ্রামে আসে। আতর কয়েকদিন তখন গ্রামেই ছিল।
বাপ ছেলেকে ডেকে তুলে তার পায়ে মাথা কুটেছিল। এ অধৰ্ম করিস নে। সইবে না। ব্যভিচার সবচেয়ে বড় পাপ।
হাত ধরে বলেছিল—তুই আবার বিয়ে কর।
বলাই দাস তখন অন্ধ। হয়ত-বা উন্মত্ত। শুধু আতরই নয়, গ্রামের আরও যে-কটি স্বৈরিণী ছিল তাদের সকলকে নিয়ে সে জীবনে সমারোহ জুড়ে দিলে। অনুরোধ ব্যর্থ হল, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে হল বিরোধ। বিরোধ শেষে চিরদিনের মত বিচ্ছেদের পরিণতির মুখে এসে দাঁড়াল।
বাপ সংকল্প করলে ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করবে। করলেও। নিজের সামান্য সাত বিঘা জমি দেবতার নামে অর্পণ করে ভবিষ্যৎ সেবাইত মহান্ত নিযুক্ত করলে নাতিদের। শর্ত করল যে, মতিভ্ৰষ্ট ব্যভিচারী বলাই দাস তাদের অভিভাবক হতে পারে না। তার অন্তে সেবাইত এবং নাতিদের অভিভাবক হবে তার স্ত্রী। তার স্ত্রীর মৃত্যুকালে যদি নাতিরা নাবালক থাকে, তো, কোনো বৈষ্ণবকে অভিভাবক নিযুক্ত করে দেবেন গ্রামের পঞ্চজন। ছেলে খবর শুনে এসে দাঁড়াল। বাপ পিছন ফিরে বসে বললে—এ-বাড়ি থেকে তুই বেরিয়ে যা। বেরিয়ে যায় বেরিয়ে যা! এ-বাড়ি আমার, কখনও যেন ঢুকিস নি, আমার ধৰ্ম চঞ্চল হবেন। মৃত্যুর সময়েও আমার মুখে জল তুই দিনে, মুখাগ্নিও করতে পাবিনে, শ্ৰাদ্ধও না। ভগবান যদি আজ আমার চোখ দুটি নেন, তবে আমি বাঁচি। তোর মুখ আমাকে আর দেখতে হয় না।
পরের দিন রাত্রে বাপ খুন হল। গরমের সময়, দাওয়ার উপর একদিকে শুয়ে ছিল বৃদ্ধ, অন্যদিকে নাতি দুটিকে নিয়ে শুয়ে ছিল বৃদ্ধা। গভীর রাত্রে কুড়ুল দিয়ে কেউ বৃদ্ধের মাথাটা দু ফাঁক করে দিয়ে গেল। একটা চিৎকার শুনে ধড়মড় করে বৃদ্ধা উঠে বসে হত্যাকারীকে ছুটে উঠোন পার হয়ে যেতে দেখে চিনেছিল যে সে তার ছেলে। মাথায় কোপ একটা নয়, দুটো। একটা কোপ বোধ করি প্রথমটা, পড়েছিল এক পাশে; দ্বিতীয়টা ঠিক মাঝখানে। মা সাক্ষী দিলে, আবছা অন্ধকার তখন, চাঁদ সদ্য ড়ুবেছে, তার মধ্যে পালিয়ে গেল লোকটি, তাকে সে স্পষ্ট দেখেছে। সে তার ছেলে বলাই। বলাই দাস অবিনাশবাবুকে উকিল দিয়েছিল। কতকটা জমি হাজার টাকায় বিক্রির ব্যবস্থা করে, ফৌজদারি মামলায় তার নামডাক শুনে, লোক পাঠিয়ে তাঁকে নিযুক্ত করেছিল। অবিনাশবাবু জেরা করতে বাকি রাখেন নি। মায়ের শুধু এক কথা।–বাবা
সুযোগ পেয়ে অবিনাশবাবু ধমক দিয়ে উঠেছিলেন। বাবা নয়! বাবা-টাবা নয়। বল, হুজুর।
মা বলেছিল–হুজুর, মায়ের কি ছেলে চিনতে ভুল হয়? আমি যে চল্লিশ বছর ওর মা। দুপুরবেলা মাঠ থেকে ফিরে এলে ওর পিঠে আমি রোজ তেল মাখিয়ে দিয়েছি।
অবিনাশবাবু বলেছিলেন—ছেলের সঙ্গে তোমার অনেক দিনের ঝগড়া। আজ বিশ বছর ঝগড়া। ছেলের বিয়ে হওয়া থেকেই ছেলের সঙ্গে তোমার মনোমালিন্য। তোমাদের ঝগড়া হত। বল সত্যি কি না?
মা বলেছিল তা খানিক সত্যি বটে। কিন্তু সে মনোমালিন্য নয় হুজুর। বড় পরিবারপরিবার বাই ছিল,-পরিবারের জন্যেই ও পেঁয়াজ-মাছ খেতে ধরেছিল, তার জন্যেই পেথকান্ন। হয়েছিল, তাই নিয়ে বকাকি হত। সে বকাকিই, আর কিছু নয়।
অবিনাশবাবু বলেছিলেন না। আমি বলছি সেই আক্ৰোশে তুমি বলছ তুমি চিনতে পেরেছ। নইলে আসলে তুমি চিনতে পার নি।
মা বলেছিল—চিনতে আমি পেরেছি হুজুর। আক্রোশও আমার নাই। ও আমার নিজের ছেলে। ধর্মের মুখ তাকিয়ে-মা থেমেছিল এইখানে, কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছিল তার। অবিনাশবাবু তাকে কাঁদতে সুযোগ দেন নি, সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন ধর্মের মুখ তাকিয়ে? আবোল-তাবোল বোকো না। জোর করে কাঁদতে চেষ্টা কোরো না। বল কী বলছ?
মা-মেয়েটি কঠিন মেয়ে, সে আত্মসংবরণ করে নিয়ে বলেছিলনাঃ, কাদব না হুজুর। ধর্মের মুখ তাকিয়ে সত্যি কথাই আমাকে বলতে হবে হুজুর। আমি মিছে কথা বললে ও হয়ত এখানে খালাস পাবে। কিন্তু পরকালে কী হবে ওর? মরতে একদিন হবেই। আমিই-বা কী বলব ওর বাপের কাছে? আমি সত্যিই বলছি। হুজুর বিচার করে খালাস দিলে ভগবান ওকে খালাস দেবেন, সাজা দিলে সেই সাজাতেই ওর পাপের দণ্ড হয়ে যাবে; নরকে ওকে যেতে হবে না।
অবিনাশবাবু এইবার মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন, জেরা করেছিলেন পাপ-পুণ্য তুমি মান?
মা বলেছিল মানি বৈকি হুজুর। কে না মানে বলুন? নইলে দিনরাত হয় কী করে?
ধমক দিয়েছিলেন অবিনাশবাবু থাম, বাজে বোকো না। সঁইত্রিশ বছর আগে, বর্ধমান জেলায়, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তুমি একবার এজাহার করেছিলে?
বৃদ্ধা ঈষৎ চকিত হয়ে মুখ তুলে স্থির দৃষ্টিতে অবিনাশবাবুর মুখের দিকে তাকিয়েছিল।
কঠোর স্বরে অবিনাশবাবু বলেছিলেন–বল? উত্তর দাও।
বৃদ্ধা বলেছিল—দিয়েছিলাম।
–কিসের মামলা সেটা?
–আমি বাপের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম আমার এই স্বামীর সঙ্গে। আমার বাবা তাই মামলা করেছিল আমার স্বামীর নামে। সেই মামলায় আমি সাক্ষি দিয়েছিলাম।
—তোমার বাবার নাম ছিল রাখহরি ভটচাজ? তুমি বামুনের মেয়ে ছিলে?
–হ্যাঁ।
–যার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিলে সে কোন্ জাত ছিল?
—সদ্গোপ। আমাদের বাড়ির পাশেই ওদের বাড়ি ছিল। ছেলেবেলা থেকে ওর বোনের সঙ্গে খেলা করতাম, ওদের বাড়ি যেতাম। তারপর ভালবাসা হয়। আমি যখন বুঝলাম, ওকে নইলে আমি বাঁচব না, তখন আমি ওর সঙ্গে বেরিয়ে আসি। দুজনে বোষ্ট্রম হয়ে বিয়ে করি। মামলা তখনই হয়েছিল।
–কী বলেছিলে তখন এজাহারে?
–বলেছিলাম-আমি বাপ চাই না, মা চাই না, ধৰ্ম্ম চাই না, আমি ওকে নইলে বাঁচব না, ওই আমার সব–পাপ-পুণ্য সব। এর সঙ্গে যাওয়ার জন্যে যদি আমাকে নরকে যেতে হয় তো যাব।
মামলার সওয়াল-জবাবের সময় অবিনাশবাবু মায়ের চরিত্রের এই দিকটির ওপরেই বেশি জোর দিয়েছিলেন, নারীচরিত্রের বিচিত্র এক বৈশিষ্ট্যের কথা বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন–এ মেয়েটির অতীত ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এ সেই বিচিত্র নারী-প্রকৃতি, যে নারী জীবনের সনাতন পুরুষের জন্য বাপ, মা, জাতি, কুল, ধর্ম অধৰ্ম সবকিছুকে অনায়াসে অবলীলাক্রমে ত্যাগ করতে পারে। এরা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বোধ করি এই লজ্জাকর মোহে মগ্ন এবং অন্ধ হয়ে থাকে। এরা অনায়াসে সন্তান ত্যাগ করে চলে যায় অবৈধ প্ৰণয়ের প্রচণ্ড আকর্ষণে, দেহবাদের। এক রাক্ষসী ক্ষুধার তাড়নায়। এই মেয়েটি যখন আজ ধর্মের কথা বলে তখন বিশ্বসংসার হাসে কিন্তু সে তা বুঝতে পারে না। প্রতিহিংসার তাড়নায় যে ধর্মকে সে মানে না আজ সেই ধর্মের দোহাই দিচ্ছে। আসলে সে হত্যাকারী কে তা চিনতে পারে নি। সেই অতি অল্পক্ষণ সময়, যে সময়ে সে স্বামীর চিৎকারে ঘুম ভেঙে উঠে মশারি ঠেলে বাইরে এসেছিল, যখন হত্যাকারী ঘরের দরজা পার হয়ে পালাচ্ছিল, তার মধ্যে রাত্রির অন্ধকারে কারুর কাউকে চিনতে পারা অসম্ভব। চিনতে সে পারে নি। হয়ত-বা কাউকে দেখেই নি, সে জেগে উঠতে উঠতে হত্যাকারী পালিয়ে গিয়েছিল। সেই উত্তেজিত অবস্থায় সে যা দেখেছিল তা তার চিত্তের কল্পনার অলীক প্রতিফলন। ছেলেকে সে গোড়া থেকেই দেখতে পারত না। তার ওপর ছেলের সঙ্গে স্বামীর বিরোধ হয়েছিল, সুতরাং তার মনে হয়েছিল পুত্রই হত্যাকারী এবং তাকেই সে কল্পনা-নেতে দেখেছিল। এ নারী মা নয়, মাতৃত্বহীনা, বিচিত্রা, পাপিষ্ঠা। আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, মা হয়ে পুত্রকে হত্যাকারী বলে ঘোষণা করবার সময় একটি ফোঁটা চোখের জল পর্যন্ত তার চোখ থেকে নির্গত হয় নি।
জোরালো বক্তৃতা অবিনাশবাবু চিরকালই করেন। ওই কেসে তিনি এই তথ্যটির ওপর ভিত্তি করে প্রাণ ঢেলে বক্তৃতা করেছিলেন। এ ছাড়া আর অন্য কোনো পথই ছিল না। এবং জুরীদের অভিভূত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তারা ওই কথাই বিশ্বাস করেছিলেন স্বামীর প্রতি অত্যধিক আসক্তির বশে এবং পুত্রের বিবাহের পর থেকে পুত্রবধূর প্রতি পুত্রের আকর্ষণের জন্য পুত্রের সঙ্গে তার সনাতন বিদ্বেষের প্রেরণাতেই আপন অজ্ঞাতসারে সে পুত্ৰকেই হত্যাকারী কল্পনা করেছে; এমন ক্ষেত্রে সদ্য ঘুমভাঙার মুহূর্তে অজ্ঞাত হত্যাকারীকে পুত্র বলে ধারণা করাই। সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক। সুতরাং তারা সন্দেহের সুযোগে অর্থাৎ বেনিফিট অফ ডাউটের অধিকারে আসামিকে নির্দোষ বলেছিলেন। কিন্তু এই কঠিন ব্যক্তিটি জুরীদের সঙ্গে ভিন্নমত হয়ে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। এবং তার রায়ে অবিনাশবাবুর মন্তব্যগুলির তীব্র সমালোচনা করে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন।
রায়ে তিনি লিখেছিলেন—এই মায়ের সাক্ষ্য আমি অকৃত্রিম সত্য বলে বিশ্বাস করি। আসামিপক্ষের লার্নেড অ্যাডভোকেট তার চরিত্র যেভাবে মসীময় করে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন তা শুধু বিচার-ভ্রান্তিই নয়—অভিপ্ৰায়মূলক বলে আমার মনে হয়েছে। সাক্ষী এই মাটি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক চরিত্রের নারী। প্রবল দৈহিক আসক্তি, যা ব্যাধির শামিল, তার কোনো অভিব্যক্তিই নাই তার জীবনে। বরং একটি সূক্ষ্ম সুস্থ বিচারবোধ তার জীবনে আমি লক্ষ্য করেছি। সে প্রথম যৌবনে কুমারী জীবনে একজন অসবর্ণের যুবককে ভালবেসেছিল। সে ভালবাসার ভিত্তিতে দেহলালসাকে কোনো দিনই প্রধান বলে স্বীকার করে নি। প্রতিবেশীর পুত্ৰ, বাল্যসখীর ভাই, সুদীর্ঘ পরিচয় এ ভালবাসাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল; মনের সঙ্গে মনের অন্তরঙ্গতা ঘটেছিল। আকস্মিকভাবে কোনো সুস্থ সবল ও রূপবান যুবককে দেখে যুবতী মনে যে বিকার জন্মায়, তাকে উন্মত্ত করে তোলে—তা এ নয়। এ উপলব্ধি সম্পূর্ণরূপে মনের উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিবশে যে হৃদয়াবেগের নির্দেশে সে গৃহ কুল জাতি ত্যাগ করেছিল তা সমাজববাঁধের বিচারে পাপ হতে পারে কিন্তু মানবিক বিচারে অন্যায় নয়, অধর্ম নয়, অস্বাস্থ্যকর নয়। সামাজিক ও মানবিক বিচার সর্বত্র একমত হতে পারে না বলেই আইন মানবিক বিচারের ভিত্তিতে গঠিত। হয়েছে একালে। যা সমাজের বিচারে পাপ সেই সূত্র অনুযায়ীই তা সর্বক্ষেত্রে আইনের বিচারে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে স্বীকৃত নয়। যাকে তিনি বলেছেন দেহলালসা—আইনের বিচারে আমার। দৃষ্টিতে তা সর্বজয়ী ভালবাসা-প্যাশন অব লাইফ; তার জন্য মর্মান্তিক মূল্য দিয়েও সে অনুতপ্ত নয়, লজ্জিত নয়। এবং পরবর্তী জীবনের আচরণে সে একটি বিবাহিতা সাধ্বী স্ত্রীর সকল কর্তব্য অসীম নিষ্ঠার সঙ্গে করে এসেছে। এই মা যে বেদনার সঙ্গে ধর্মের মুখ তাকিয়ে পুত্রের বিরুদ্ধে সাক্ষি দিয়েছে তাকে আমি বলি ডিভাইন; স্বর্গীয় রূপে পবিত্র। আশ্চর্যের কথা, সুবিজ্ঞ অ্যাডভোকেট মহাশয় এই হতভাগিনী মায়ের সাক্ষ্য দেওয়ার সময়ের বেদনার্ততা ও ধর্মজ্ঞানের বা সনাতন নীতিজ্ঞানের মর্মান্তিক দ্বন্দ্ব যেন ইচ্ছাপূর্বকই লক্ষ্য করেন নি। বলেছেন—সাক্ষ্য দেওয়ার সময় পুত্রের ফাঁসি হতে পারে জেনেও তার চোখে জল পড়ল না।
হাইকোর্ট জ্ঞানেন্দ্রনাথের বিচারকেই মেনে নিয়েছিলেন।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ আসামি অর্থাৎ ওই ছেলেকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন। এই দণ্ডাদেশ ঘোষণার ইতিহাসও ঠিক সাধারণ পর্যায়ে পড়ে না। অসাধারণই বলতে হবে। অবিনাশবাবু আর একটা কেসে ওখানে গিয়ে সে ইতিহাস শুনেছিলেন। তিন দিন নাকি সে তার অদ্ভুত স্তব্ধ অবস্থা; তিনটি রাত্রি তিনি ঘুমোন নি, সবটাই প্রায় লিখে ফেলে ওই দণ্ডাদেশের কয়েক লাইন অসমাপ্ত রেখে অবিশ্ৰান্ত পদচারণা করেছিলেন। এদিকে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীমহলে একটা উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছিল। জ্ঞানবাবুর এই বিনিদ্র রাত্রিযাপনের কথা তাদের কানে পৌঁছুতে বাকি থাকে নি। সিভিল সার্জেন এসেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে, সঙ্গে সঙ্গে এসেছিলেন এসপি। এসডি-ও যিনি, তিনিও এসেছিলেন। নতুন জজসাহেব শেষে কি ফাঁসির হুকুম দেবেন? এঁদের যে উপস্থিত থেকে দণ্ডাদেশকে কাজে পরিণত করতে হবে।
ভোরবেলা, আবছা অন্ধকারের মধ্যে ফাঁসির মঞ্চটাকে দেখে অদ্ভুত মনে হবে। মৃত্যুপুরীর হঠাৎ-খুলে-যাওয়া দরজার মত মনে হবে। মনে হবে, দরজাটার চারপাশের কাঠগুলো থেকে। কপাট-জোড়াটা অদৃশ্য হয়ে গেছে, খোলা দরজাটা হাঁ-হাঁ করছে মৃত্যুর গ্রাসের মত। তারপর দূর থেকে হয়ত হতভাগ্যের কাতর আর্তনাদ উঠবে। হয়ত ঝুলিয়ে তুলে নিয়ে আসবে একটা হাড় আর মাংসের বিহ্বল বোঝাকে। ওঃ! তারপর দণ্ডাদেশ পড়তে হবে। দণ্ডিত হতভাগ্যের মাথায় কালো টুপি পরিয়ে দেবে। ওঃ।
সিভিল সার্জেন বলেছিলেন—এ জেলে আজ তিরিশ বছর ফাঁসি হয় নি। গ্যালোজ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু আছে একটা টিবি। সব নতুন করে তৈরি করতে হবে।
ম্যাজিস্ট্রেটসাহেবও বিচলিত হয়েছিলেন।
পরামর্শ করে ওঁরা এসেছিলেন জ্ঞানেন্দ্রবাবুর কুঠিতে। ইঙ্গিতে অনুরোধও জানিয়েছিলেন। জ্ঞানবাবু বলেছিলেন–তিন দিন আমি ঘুমুই নি। শুধু ভেবেছি।
ম্যাজিস্ট্রেট বলেছিলেন-আমি শুনেছি। মানুষকে ডেথ সেন্টেন্স দেওয়ার চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক কর্তব্য কিছু হয় না।
জ্ঞানেন্দ্রবাবু বলেছিলেন, আমার স্ত্রীও খুব বিচলিত হয়েছেন। তিনি যেন আমার মুখের দিকে চাইতে পারছেন না। কিন্তু কী করব আমি।
সত্যই সুরমা দেবী অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলেন, সভয়ে বলেছিলেন—তুমি কি ফাঁসির হুকুম দেবে?
প্রথমটা উত্তর দিতে পারেন নি জ্ঞানেন্দ্রবাবু। অনেকক্ষণ পর বলেছিলেন ওর মা তার সাক্ষ্যে যে কথা বলে গেছে তারপর ওই দণ্ড দেওয়া ছাড়া আমি কী করতে পারি বল?
সুরমা দেবী এরপর আর কোন কথা বলবেন? তবু বলেছি। লনওই মায়ের কথাই ভেবে। দেখ। সে হতভাগিনীর আর কী থাকবে বল?
—ধৰ্ম! জ্ঞানেন্দ্রবাবু বলেছিলেন হিন্দু ধৰ্ম, মুসলমান ধৰ্ম কি ক্রিস্টান ধর্ম নয় সুরমাসত্যধর্ম।
কয়েক মুহূর্ত পরে মুখ তুলে এক বিচিত্ৰ হাসি হেসে বলেছিলেন ওই মেয়েটি আমাকে শিক্ষা দিয়ে গেল। ইতিহাসের বড় মানুষ মহৎ ব্যক্তি এই সত্যকে পালন করে আসেন পড়েছি; একালে মহাত্মা গান্ধীকে দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু ভেবেছি—ও পারেন শুধু মহৎ যারা তারাই। কিন্তু ওই মেয়েটি বুঝিয়ে দিলেনা, পারে, তার মত মানুষেও পারে। মস্ত বড় আশ্বাস পেলাম। আজ।
বলেই সঙ্গে সঙ্গে বসে গিয়েছিলেন লিখতে। এক নিশ্বাসেই প্রায় লাইন কটি লিখে শেষ করে দিয়েছিলেন। বিচার নিষ্ঠুর নয়, সে সাংসারিক সুখদুঃখের গণ্ডির উর্ধ্বে। জাস্টিস ইজ ডিভাইন।
সেদিন ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, সিভিল সার্জেন এঁদেরও সেই কথাই তিনি বলেছিলেন। আর কোনো দণ্ড এক্ষেত্রে নাই। আমি পারি না! আই কান্ট।
ঘ.
অবিনাশবাবু মামলাটি সযত্নে সাজিয়ে নিয়েছিলেন। সাজাবার অবশ্য বিশেষ কিছু ছিল না, তবু একটি স্থান ছিল যেটির জন্য গোটা মামলাটি সম্পর্কে প্রথমেই বিরূপ ধারণা হয়ে যেতে পারে। তার জন্য তিনি প্রস্তুত হয়েই রয়েছেন। তিনি স্থির জানেন যে, বিচারকের আসনে উপবিষ্ট ওই যে লোকটির স্থির দৃষ্টি সামনের খোলা দরজার পথে বাইরের উন্মুক্ত প্রসারিত প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে লক্ষ্যহীনের মত, যা দেখে মনে হচ্ছে এই আদালত-কক্ষের কোনো কিছুর সঙ্গেই তার ক্ষীণতম যোগসূত্রও নেই, দৃষ্টির সঙ্গে কোন দূরে চলে গিয়েছে তার মন উদাসী বৈরাগীর মত, ঘটনার বর্ণনায় কোনো অসঙ্গতি ঘটলে অথবা ঘটনার ঠিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানটিতে মানুষটি সজাগ হয়ে উঠে বলবেন ইয়েস। অথবা চকিত হয়ে ঘুরে তাকাবেন, ভুরুদুটি প্রশ্নের ব্যঞ্জনায় কুঞ্চিত হয়ে উঠবে, এবং জিজ্ঞাসা করবেন—হোয়াট? কী বললেন– মিস্টার মিট্রা? ডিড ইউ সে?
অবিনাশবাবুর অনুমান মিথ্যা হল না; আজও জজসাহেব চকিতভাবে ঘুরে অবিনাশবাবুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, হোয়াট? কী বলছেন মিঃ মিট্রা? আপনি বলছেন ছোটভাই খগেন্দ্র ঘোষ, যে খুন হয়েছে, সে-ই আসামি বড়ভাই নগেনকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? নগেন, এই আসামি, ডেকে নিয়ে যায় নি?
অবিনাশবাবু খুশি হলেন মনে-মনে, এই প্রশ্নই তিনি চেয়েছিলেন; তিনি সম্মতি জানিয়ে ঘাড় নেড়ে বললেন– ইয়েস, ইয়োর অনার। তাই প্রকৃত ঘটনা। তাই বলেছি আমি।
জ্ঞানেন্দ্রবাবু বললেন—দ্যাট্স্ অলরাইট। গো-অন প্লিজ।
অবিনাশবাবু বলে গেলেন ইয়েস, ইয়োর অনার, ঘটনার যা পরিণতি তাতে সাধারণ নিয়মে আসামি নগেন এসে তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল এই হলেই ঘটনাটি সোজা হত। এবং পূর্বের কথা অনুযায়ী নগেনেরই ডাকতে আসবার কথাও ছিল। কিন্তু সে আসে নি।
অবিনাশবাবু ধীরকণ্ঠে একটি একটি করে তাঁর বক্তব্যগুলি বলতে শুরু করলেন। কোনো আবেগ নাই, কোনো উত্তাপ নাই, শুধু যুক্তিসম্মত বিশ্লেষণ।-নগেন আসে নি। তারই ডাকবার কথা ছিল, কিন্তু সে এল না, ডাকলে না। ইয়োর অনার, এইটিই হল আসামির সুচিন্তিত পরিকল্পনার অতি সূক্ষ্ম চাতুর্যময় অংশ। অন্যদিকে এই অতিচতুরতাই তার উদ্দেশ্যকে ধরিয়ে দিচ্ছে, অত্যন্ত সহজে ধরিয়ে দিচ্ছে। সাক্ষ্য-প্রমাণের দ্বারা অত্যন্ত সহজেই এ তথ্য উঘাটিত হবে। অবশ্য আর একটি ব্যাখ্যাও হতে পারে, কিন্তু তাতেও এই একই সত্যে উপনীত হই আমরা। ইয়োর অনার, সমস্ত বিষয়টি যথার্থ পটভূমির উপর উপস্থাপিত করে চিন্তা করে দেখতে হবে। পটভূমিকা কী? পটভূমি হল-বাঙলাদেশের পল্লীগ্রামের একটি স্বল্পবিত্ত চাষীর সংসার। সুবল ঘোষ একজন চাষী। আমাদের দেশের পঞ্চাশ বছর আগের চাষীদের একজন। তখনকার দিনের ধর্মবিশ্বাসে সামাজিক বিশ্বাসে দৃঢ় বিশ্বাসী। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। ছেলেটি বাল্যকাল থেকেই বিচিত্র প্রকৃতির। সাক্ষ্য-প্রমাণের দ্বারা প্রমাণিত হবে যে, প্রথমটায় এই বালক ছিল অত্যন্ত দুর্দান্ত। বাপ একমাত্র ছেলেকে অনেক আশা পোষণ করে স্কুলে পড়তে দিয়েছিল। সাধ্যের অতিরিক্ত হলেও ছেলেকে মানুষের মত মানুষ, ভদ্র শিক্ষিত মানুষ তৈরি করবার সাধকে। সে খর্ব করে নি। কয়েক মাইল দূরে বর্ধিষ্ণু গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে বোর্ডিঙে রেখেছিল। স্কুলের রেকর্ডে আমরা পাই, ছেলেটি আরও কতকগুলি দুর্দান্ত প্রকৃতির ছেলের সঙ্গে মিশে স্কুলে প্রায় নিত্যশাসনের পাত্র হয়ে ওঠে এবং দু বছর পরেই স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়। তার কারণ কী জানেন? তার কারণ চৌর্যাপরাধ এবং হত্যা; মানুষ নয়—জন্তু। বোর্ডিঙের কাছেই ছিল একজন ছাগল-ভেড়া ব্যবসায়ীর খামার এবং গোয়াল। এই গোয়াল থেকে নিয়মিতভাবে দুচার দিন পর পর ছাগল-ভেড়া অদৃশ্য হত। কোনো চিহ্ন পাওয়া যেত না। রক্তের দাগ না, কোনো রকমের চিৎকার শোনা যেত না, কেনো হিংস্ৰ জানোয়ারেরও কোনো প্রমাণ পাওয়া যেত না। শেষ পর্যন্ত অনেক সতর্ক চেষ্টার পর ধরা পড়ল এই দলের একটি ছোট ছেলে। সে স্বীকার করলে, এ কাজ তাদের। তারা এই ছাগল-ভেড়া চুরি করে গভীর রাত্রে রান্না করে ফিস্ট করত। বিচিত্রভাবে অপহরণ করতে পটু এবং সক্ষম ছিল একটি বালক! এই আসামি নগেন ঘোষ। কয়েকটি গোপন প্রবেশপথ তারা করে রেখেছিল। একটি জানালাকে এমনভাবে খুলে রেখেছিল। যে, কেউ দেখে ধরতে পারত না যে, জানালাটি টানলেই খুলে আসে। সেই পথে রাত্রে প্রবেশ করত এই নগেন এবং ঘরের মধ্যে ঢুকেই যেটিকে সে সামনে পেত, সেইটিকেই মুহূর্তে গলা টিপে ধরত, এবং সঙ্গে সঙ্গে মুচড়ে ঘুরিয়ে দিত। এতে সে প্রায় সিদ্ধহস্ত হয়েছিল। এমনটি আর অন্য কেউই পারত না। এই কারণের জন্যই হেডমাস্টার তাকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করেন। বাপ এর জন্য অত্যন্ত মর্মাহত। এবং ছেলেকে কঠিন তিরস্কার করে। তারা বৈষ্ণব, এই অপরাধ তাদের পক্ষে মহাপাপ। এই অপরাধ বাপকে এমনই পীড়া দিয়েছিল যে সে এই পাপের জন্য ছেলেকে প্ৰায়শ্চিত্ত না করিয়ে পারে নি; মাথা কামিয়ে শাস্ত্ৰবিধিমত প্ৰায়শ্চিত্ত! ছেলে সেই রাত্রেই গৃহত্যাগ করে। এবং বার বৎসর নিরুদ্দেশ থাকার পর ফিরে আসে। তখন তার বয়স প্রায় আটাশ-ঊনত্রিশ। ইয়োর অনার, সন্ন্যাসীর বেশে ফিরে আসে। তখন এই যে ক্ষুদ্র শান্ত চাষীর সংসারটি, সে-সংসারে পরিবর্তনশীল কালের স্রোতে অনেক ভাঙন ভেঙেছে এবং অনেক নূতন গঠনও গড়ে উঠেছে। নগেনের মায়ের মৃত্যু হয়েছে, তার ভগ্নী বিধবা হয়েছে, বাপ সুবল ঘোষ বংশলোপের ভয়ে আবার বিবাহ করেছে, এবং একটি শিশুপুত্র রেখে সে-পত্নীটিও পরলোকগমন করেছে। সুবল ঘোষ তখন কঠিন রোগে শয্যাশায়ী। শিশুপুত্রটিকে মানুষ করছে। সুবলের বিধবা কন্যা, আসামি নগেনের সহোদরা।
সুবল হারানো ছেলেকে পেয়ে আনন্দে অধীর হল এবং তার অঙ্গে সন্ন্যাসীর বেশ দেখে। কেঁদে আকুল হয়ে উঠল। বললে—তুই এবেশ ছাড়।
নগেন বললে–না।
বাপ বললে–ওরে তুই হবি সন্ন্যাসী, হয়ত নিজে পাবি পরমার্থ, মোক্ষ। কিন্তু এই আমাদের পিতৃপুরুষের ভিটে, এই ঘোষ বংশ? ভেসে যাবে?
নগেন বললে–ওই তো খগেন রয়েছে।
সুবল বললেছ বছরের ছেলে, ও বড় হবে, মানুষ হবে, ততদিনে মানুষ-অভাবে ঘর পড়বে, দোর ছাড়বে; জমিজেরাত খুদকুঁড়ো দশজনে আত্মসাৎ করে পথের ভিখারি করে দেবে। ওই বিধবা ঘোষ বংশের যুবতী মেয়ে, তোর মায়ের পেটের বোন, ওর অবস্থা কী হবে ভাব? মন্দটাই ভাব!
নগেন বললে, বেশ, খগেনকে বড় করে ওর বিয়ে দিয়ে ঘরসংসার পাতিয়ে দেওয়া পর্যন্ত আমি রইলাম। কিন্তু আর কিছু আমাকে বোলো না।
পাবলিক প্রসিকিউটার অবিনাশবাবু তাঁর হাতের কাগজগুলি টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে কোর্টের দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকালেন। পাঁচটার দিকে চলেছে ঘড়ির কাটা। টেবিলের উপর কাগজ-ঢাকা কাচের গ্লাসটি তুলে খানিকটা জল খেয়ে আবার আরম্ভ করলেন, ইয়োর অনার, মানুষের মধ্যেই জীবনশক্তির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। জড়ের মধ্যে যে-শক্তি অন্ধ দুর্বার, জন্তুর মধ্যে যে-শক্তি প্রবৃত্তির আবেগেই পরিচালিত, মানুষের মধ্যে সেই শক্তি মন বুদ্ধি ও হৃদয়ের অধিকারী হয়েছে। জন্তুর প্রকৃতির পরিবর্তন হয় না; সার্কাসের জানোয়ারকে অনেক শাসন করে অনেক মাদক খাইয়েও তার সামনে চাবুক এবং বন্দুক উদ্যত রাখতে হয়। একমাত্র মানুষেরই পরিবর্তন আছে, তার প্রকৃতি পালটায়। ঘাত-প্রতিঘাতে, শিক্ষা-দীক্ষায়, নানা কার্যকারণে তার প্রকৃতির শুধু পরিবর্তনই হয় না, সেই পরিবর্তনের মধ্যে সে মহত্তর প্রকাশে প্রকাশিত করতে চায় নিজেকে, এইটেই অধিকাংশ ক্ষেত্রের নিয়ম। অবশ্য বিপরীত দিকের গতিও দেখা যায়, কিন্তু সে দেখা যায় স্বল্পক্ষেত্রে।
জ্ঞানবাবুর গম্ভীর মুখে একটি হাসির রেখা ফুটে উঠল। অবিনাশবাবু চতুর ব্যক্তি। অসাধারণ কৌশলী। এইমাত্ৰ যে-কথাগুলি তিনি বললেন, সেগুলি তার অর্থাৎ জ্ঞানবাবুর কথা। কিছুদিন আগে এখানকার লাইব্রেরিতে বক্তৃতাপ্রসঙ্গে এই কথাগুলিই বলেছিলেন।
অবিনাশবাবু বললেন– তৎকালীন আচার-আচরণ কাজকর্ম সম্পর্কে যে প্রমাণ আমরা পাই, তাতে আমি স্বীকার করি যে, আসামি নগেনের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটেছিল এবং সে-পরিবর্তন সৎ ও শুদ্ধ পরিবর্তন। তার বার বৎসরকাল অজ্ঞাতবাসের ইতিবৃত্ত আমরা জানি না কিন্তু পরবর্তীকালের নগেনকে দেখে বলতে হবে, এই অজ্ঞাতকালের সাধু-সন্ন্যাসীর সংস্পর্শ এবং তীর্থ ইত্যাদি ভ্রমণের ফল নিঃসন্দেহে একটি পবিত্র প্রভাব বিস্তার করেছিল তার উপর। না-হলে, অর্থাৎ সেই বর্বর পাষণ্ডতা তার মধ্যে সক্রিয় থাকলে, সে অনায়াসেই তার বাপের মৃত্যুর পর দু-বছরের বালক খগেনকে সরিয়ে দিয়ে নিষ্কণ্টক হতে পারত। তার পরিবর্তে সে এই সভাইকে ভালবেসে বুকে তুলে নিলে। শুধু তাই নয়, বাপের মৃত্যুর কিছুদিন পর বিধবা বোন মারা যায়। তারপর এই নগেনই একাধারে মা এবং বাপ দুইয়ের স্নেহ দিয়ে তাকে মানুষ করে। ছেলেটি দেখতে ছিল অত্যন্ত সুন্দর। নগেন খগেনকে খগেন বলে ডাকত না, ডাকত গোপাল বলে। টোপরের মত কোকড়া একমাথা চুল, কাঁচা রঙ, বড় বড় চোখ। ছেলেটি সত্যিই দেখতে গোপালের মত ছিল।.
একটু থেমে হেসে অবিনাশবাবু বললেন–এক্সকিউজ মি ইয়োর অনার, আমি এক্ষেত্রে একটু কাব্য করে ফেলেছি। বাট আই অ্যাম নট আউট অব মাই বাউন্ডস, ইয়োর অনার। কারণ–
জ্ঞানবাবু বললেন–একটু সংক্ষেপ করুন।
অবিনাশবাবু বললেন–এই মামলাটি অতি বিচিত্র ধরনের, ইয়োর অনার, আমার মনে হয়, বর্তমান ক্ষেত্রে এমনি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এবং তার বিশ্লেষণ ভিন্ন আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হতে পারব না। আমি নিজে স্বীকার করেছে যে, নৌকো উটে নদীর মধ্যে দুজনে জলে ড়ুবে গিয়েছিল। ছোট ভাই সাঁতার ভাল জানত না, সে বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে, বড় ভাই আসামি নগেন সেই অবস্থায় নিজেকে তার কবল থেকে মুক্ত করার জন্য আত্মরক্ষার জান্তব প্রবৃত্তির তাড়নায় তার গলার নলি টিপে ধরে। এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ছোট ভাইয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভেসে উঠে কোনো রকমে এসে নদীর বাঁকের মুখে চড়ায় ওঠে। পরদিন সকালে ছোট ভাইয়ের দেহ পাওয়া যায় ওই চড়ায় আরও খানিকটা নিচে। মৃত খগেনের শবব্যবচ্ছেদের যে রিপোর্ট আমরা পেয়েছি, তাতেও দেখেছি খগেনের গলায় কণ্ঠনালীর দুইপাশে কয়েকটি ক্ষতচিহ্ন ছিল। ডাক্তার বলেন, নখের দ্বারাই এ ক্ষতচিহ্ন হয়েছে। এবং শবের পাকস্থলীতে জল পাওয়া গেছে অতি অল্প; জলে ড়ুবে মৃত্যু হলে আরও অনেক বেশি পরিমাণে জল পাওয়া যেত। ডাক্তার সিদ্ধান্ত করেছেন যে, এ মৃত্যু ঘটেছে শ্বাসরোধের ফলে এবং কণ্ঠনালী প্রচণ্ড শক্তিতে টিপে ধরার জন্য, মৃতের শ্বাস রুদ্ধ হয়েছিল। এখন এক্ষেত্রে আমাদের বিচার্য, আসামি নগেন মানসিক কোন অবস্থায় খগেনের গলা টিপে ধরেছিল। সেই মানসিক অবস্থার অভ্রান্ত স্বরূপ নির্ণয়ের উপরই অভ্রান্ত বিচার নির্ভর করছে। সামান্যমাত্র ভ্রান্তিতে বিচারের পবিত্রতা, মহিমা কলঙ্কিত হতে পারে, নষ্ট হতে পারে। আমরা নির্দোষ একটি অতি সাধারণ মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণায় অধীর হয়ে মানবিক জ্ঞান হারিয়ে আত্মরক্ষার জান্তব প্রবৃত্তির অধীন হওয়ার জন্য তাকে ভুল করে চরম দণ্ডে দণ্ডিত করার ভ্রম করতে পারি। আবার বিপরীত ভুলের বশে অতি-সুচতুর অতিকুটিল ষড়যন্ত্র ভেদ করতে না-পেরে নিষ্ঠুরতম পাপের পাপীকে মুক্তি দিয়ে মানবসমাজের চরমতম অকল্যাণ করতে পারি। ইয়োর অনার, সিংহচর্মাবৃত গর্দভ সংসারে অনেক আছে, কিন্তু মনুষ্যচর্মাবৃত নরঘাতী পশু বা বিষধরের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সিংহচর্মাবৃত গর্দভের সিংহচর্মের আবরণ টেনে খুলে দিলেই সমাজ নিরাপদ হয়, সমাজে কৌতুকের সৃষ্টি হয়; মনুষ্যচর্মাবৃত পশু বা সরীসৃপের মনুষ্যকর্মের আবরণ মুক্ত করলে মানুষের সমাজ আতঙ্কিত হয়; তখন সমাজকে তার হাত থেকে নিষ্কৃতি দেবার গুরুদায়িত্ব এসে পড়ে সমাজেরই উপরে। এই কারণেই আমাকে অতীতকাল থেকে এ-পর্যন্ত এই আসামির জীবন ও কৃতকর্মগুলি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে। ধৰ্মাধিকরণে বিচারক মানুষ হয়েও মানুষের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন, স্থূল প্রমাণ-প্রয়োগসম্মত বিচার করার চেয়েও তার বড় দায়িত্ব আছে; স্কুল প্রমাণ-প্রয়োগের আবরণ ছিঁড়ে মর্ম-সত্যকে আবিষ্কার করে তেমনি বিচার করতে হবে, যাকে বলতে পারি ডিভাইন জাস্টিস।
কোর্টের বাইরে কম্পাউন্ডের ওদিক থেকে পেটা ঘড়িতে ঘণ্টা বাজতে লাগল ঢং ঢং। কোর্টরুমের ঘড়িতে তখনও পাঁচটা বাজতে দু মিনিট বাকি।
নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জ্ঞানবাবু বললেন–কাল পর্যন্ত মামলা মুলতুবি রইল।
একবার তাকিয়ে দেখলেন আসামির দিকে। সরল সুস্থদেহ নগেন ঘোষ, স্থির নিম্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আশ্চর্য স্থির দৃষ্টি, লোকটার মুখ যেন পাথরে গড়া। কোনো অভিব্যক্তি নাই।
লোকটি থানা থেকে এসডিও কোর্ট এবং এখান পর্যন্ত স্বীকার করে একই কথা বলে আসছে। নৌকাতে নদী পার হবার সময় বাতাস একটু জোর ছিল; মাঝনদী পার হয়েই বাতাস আরও জোর হয়ে উঠেছিল, খগেন সাঁতার প্রায় জানত না, সে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে, নগেন হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরে তাকে বলে, ভয় কী? খগেন মুহূর্তে নৌকার ওপাশ থেকে এপাশে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ছোট নৌকাখানা যায় উল্টে। জলের মধ্যে খগেন তাকে সজোরে আঁকড়ে ধরে। দুজনে ড়ুবতে থাকে। প্রথমটা নগেন তার হাত ছাড়াতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু যত চেষ্টা করেছে, ততই সে নগেনকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরেছে। নগেনের বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, জল খাচ্ছিল সে, হঠাৎ খগেনের গলায় তার হাত পড়ে। সে ওর গলাটা টিপে ধরে। খগেন তাকে ছেড়ে দেয়। সে জানে না, খগেন তাতেই মরেছে কি না। কিনারায় এসে উঠে কিছুক্ষণ সে শুয়ে ছিল সেখানে। তারপর কোনো রকমে উঠে বাড়ি আসে। মাঝরাত্রে তার শরীর সুস্থ হলে মনে হয়, খগেন হয়ত মরে গিয়েছে। হয়ত গলা টিপে ধরাতেই সে মরে গিয়েছে। সকালে উঠে সে থানায় যায়। এজাহার করে। এর সাজা কী সে তা জানে না। ভগবান।
জানেন। যা সাজা হয় জজসাহেব দিন, সে তাই নেবে।
ভগবান জানেন। হায় হতভাগা! নিজে কী করেছে তা নিজে জানে না। ভগবানকে সাক্ষী মানে। কিন্তু ভগবান তো সাক্ষি দেন না। অথচ ডিভাইন জাস্টিস করতে হবে বিচারককে।