৭. মনোয়া-মিলনে
মনোয়া-মিলনে, আজ শেষ-বিকেলের প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে ঝড়-বৃষ্টির তান্ডব চলল। তাপাঙ্ক একলাফেই অনেক নীচে নেমে গেল।
পূর্ণিমা প্রায় এসে গেছে। কিন্তু আকাশে চাঁদের হদিশ নেই কোনো। মাঝে মাঝে অবশ্য ছেঁড়া-খোঁড়া আছে, কালো মেঘের আস্তরণ; সেখানে উজলা-আকাশের উদ্ৰান্ত উদ্ভাস। নইলে, ঘন-কালো, ফিকে-কালো, ছাই-রঙা মেঘ আর সেই মেঘের আড়াল থেকে কোনো অদৃশ্য, মনমৌজি মাদল-বাদক ক্রমান্বয়ে ‘দ্রিমি-দ্রিমি-দ্রিমি’ করে মাদল বাজিয়ে চলেছে। বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে কখনোও মুহূর্তে বিশ্ব-চরাচরকে উন্মোচিত করে, তীব্র, সাদা আলোর প্যানোরোমিক ফোকাস-এর মাধ্যমে সবকিছুকে দৃশ্যমান করে, আবার কখনো-বা শুধু প্রকৃতির কোনো বিশেষ অংশ বা ফালিকেই। একসারি ঊর্ধ্ববাহু পত্রহীন গাছ, নদীর একটি অংশ, পাহাড়তলি অথবা কাছিমপেঠা পাহাড়ের একটি ঢালকে হঠাৎ বোম-টেপা প্রচন্ড শক্তিশালী ঐশ্বরিক টর্চের মুহূর্তবাহী চকিত আলোয় আলোকিত করেই পরক্ষণেই নিকষ-কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দিচ্ছে।
নীলপাখি দু-টি এবারেও এল না। ভাবছিল, শিরীষ অথচ অনেক অনেক মানুষের-ই টুকরো-টাকরা মঙ্গলের জন্যে তাদের এবারে আসাটা বড়োই প্রয়োজন ছিল। মানুষের দরকারের কথাই যদি তারা না বুঝল, তবে তারা কীসের মঙ্গলদাতা বা দাত্রী?
ট্রেনটা এসে চলে গেছে অনেকক্ষণ-ই। ঘণ্টেমামা, শিরীষ, ঝাণ্ড, ঝাণ্ডুর দু-জন দোসর এবং অটো-রিকশাওয়ালা, ওরা সবাই ফিরে এসেছে ঘণ্টা দুই আগে। শিরীষ ফিরেছে তার সাইকেলেই। অন্যরা সকলে অটো-রিকশাতে। আগামী কাল সকালের ট্রেনেই ফিরে যাবেন ঘণ্টেমামা ডালটনগঞ্জে। শিরীষের মন-ই যখন এতটা খারাপ হয়ে গেছে নীলোৎপলরা না আসাতে; তখন কাকিমা, ঝিঁঝি এবং ঘণ্টেমামারও মনের মধ্যে কী যে, হচ্ছে কে জানে!
বুড়ি-মাই আজ সুজির খিচুড়ি বেঁধেছিল। মধ্যে আলু ও পটল ও কাঁচালঙ্কা ফেলে। তা গরম করে নিয়ে তাতে যখন একটু ঘি ঢেলে নিয়ে খেতে বসেছিল, শিরীষ তখন বুড়ি-মাই তার আলো-ছায়া কম্পমান ঘরের মধ্যের চৌপাই-এর ওপরে বসেই বলল, গলা তুলে; ঝিঁঝির বর কি এল?
বর কোথায়? বিয়ের কথাই তো হচ্ছিল শুধু।
বহত-ই আচ্ছি লেড়কি হ্যায়, ঝিঁঝি।
খেতে খেতে শিরীষ নীচুস্বরে বলল, হু’।
কালু তার দুধ-রুটি খাচ্ছিল। সেও যেন, জিভের চকাঁচক আওয়াজ থামিয়ে বলল, হুঁ।
তুঝে বহত-ই পেয়ার করতি হ্যায় উও লেড়কি।
ক্যা? হামে?
খাওয়া থামিয়ে, মুখ তুলে অবাক গলায় শুধোল শিরীষ।
একটা লঙ্কায় হঠাৎ কামড় দেওয়াতে কান ঝাঁঝাঁ করছিল।
হাঁ। উসমে কোই শক নেহি।
তুমে ক্যায়সি মালুম বুড়ি-মাই?
বুড়ি-মাই হাসল, ফোকলা মাড়িতে।
বড়ো সুন্দর দেখে শিরীষ, তার চলে-যাওয়া সম্ভ্রান্ত মায়ের এই সম্ভ্রান্ত সুন্দরী পরিচারিকাকে, কুচকুচে কালো ত্বকের, ধবধবে সাদা চুলের, শান্ত, কোনোরকম জাগতিক চাহিদাহীন, ক্ষোভহীন, অনুযোগহীন এই মমতাময়ী বৃদ্ধাকে।
বুড়ি-মাই বলল, আমিও তো মেয়েই! না-হয় এখন লোল-চর্ম বৃদ্ধাই। যৌবন তো একদিন আমারও ছিল! যুবতী নারীর মন বোঝা তো আমার পক্ষে কষ্টের নয়। তোর মাও খুব পছন্দ করত ঝিঁঝিকে। যদিও ঝিঁঝির মা-বাবাকে তেমন করত না!
শিরীষ বলল, থাক-না এসব কথা বুড়ি-মাই। পরের বাড়ির মেয়েকে নিয়ে এত আলোচনার কী আছে? আমাকে স্টেশনে যেতে বলেছিল, তা দু-দিন-ই গেছিলাম। পাত্রই এল, তার কী করতে পারি আমি? এর আগেরবার তো ঝুড়ি ঝুড়ি পাকা-পেঁপে আর কাঁচকলাও লাতেহার থেকে জোগাড় করে এনেছিলাম। এবারে অবশ্য তেমন কিছু করতে হয়নি।
পেঁপে আর কাঁচকলা! কেন?
আছে। সে অনেক কথা! পরে কখনো বলবখন।
খেয়ে উঠেই আজ শুয়ে পড়ল শিরীষ। কিন্তু ঘুম এল না। মাথার মধ্যে নানারকমের চিন্তা। আজ বৃহস্পতিবার। গুঞ্জনের কাছে যাওয়া হল না এবং খবরও দেওয়া হল না।
আজ ছুটি বলে সে গদিতেও যায়নি। গত পরশু পুনমচাঁদজি বিশ্রামপুরে গিয়েছেন লাইম স্টোনের কাজে। সে অনেক দূরের পথ। ডালটনগঞ্জ থেকে মধ্যপ্রদেশের দিকে, যে-পথ চলে গেছে তার-ই ওপরের বর্ডারের প্রায় কাছাকাছি। খুব-ই জঙ্গুলে জায়গা। বিশ্রামপুর থেকে গাড়োয়া আর রাংকা হয়ে ফিরতে ফিরতে রবিবার হয়ে যাবে। এদিকে শেঠ চিরাঞ্জিলাল এবং লাডসারিয়াজিও মনোয়া-মিলনে নেই। ওঁরা থাকলে, গুঞ্জনদের দেখাশোনা ওঁরাই করেন পুনমচাঁদজির অনুপস্থিতিতে। গতকাল দেখেছে, ওঁদের নিজেদের মানুষ বলতে আছে শুধু ‘পুরুষোত্তম’ নামক নরাধম। মুন্নি-তিন্নি ওদের পাশের বাড়ির সিংসাহেবের সঙ্গে দু-দিনের জন্যে গেছে খিলাড়ি। সম্ভবত ওই ছেলেগুলোও সঙ্গে গেছে। পুনমচাঁদজি সব জেনেশুনেও কী করে যে, দিনের পর দিন সদ্য-যুবতী মেয়ে দুটোকে অমন ছাড়া-গোরুর মতো ছেড়ে রাখেন, ভেবে পায় না শিরীষ। শিরীষ, মুন্নি-তিন্নির গার্জেন নয়। পুনমচাঁদজি যা মনে করবেন, করবেন।
গতকাল কাজ সেরে বেরোবার সময়ে নরাধম জিজ্ঞেস করেছিল, ওর সরু গলাতে; কাল আইয়েগা ক্যা আপ?
কাল তো ছুটি হ্যায়।
শিরীষ বলেছিল।
সব কাম অর বে-কামসে ছুটি নেহি না হ্যায়!
মতলব?
নেহি, কাল পুনমচাঁদজিকা ঘর নেহি আইয়েগা আপ? কাল-তো বিফে হ্যায় না?
কথাটা শিরীষের খুব ভালোই মনে ছিল। আজ উঠোনে ঘোরা-ফেরা করা গুঞ্জনের সঙ্গে তিন-তিনবার চোখাচোখিও হয়েছে। প্রথমবার ওর চোখে লজ্জা ছিল। ভালো করে চোখ খুলে তাকায়নি গুঞ্জন। দ্বিতীয়বারে, দুপুর নাগাদ যখন চোখাচোখি হয়েছিল, তখন মনে হয়েছিল অনুরাগ ছিল তার চোখে। তৃতীয়বার যখন চোখ পড়েছিল চোখে, তখন আবার মনে হয়েছিল যে, অভিমান ছিল। সেবারেও ভালো করে তাকায়নি গুঞ্জন।
না-তাকাবার কারণও তো আছে! গতবৃহস্পতিবারের পর শিরীষ তো কোনো যোগাযোগ ই করেনি ওঁর সঙ্গে। দু-জনেরই যা বলা-কওয়ার তা আজকে ওদের বাড়ি গেলেই হয়তো হত।
শিরীষের মনে হয়েছে যে, বিয়ের ব্যাপারে খুব ভালো করে ভাবা-ভাবি না করে এরকম ইমোশনাল মেয়ের প্রেমকে গ্রহণ করেছে বলে স্বীকার করা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। একবার এগিয়ে গেলে পিছিয়ে আসা আর সম্ভব নয়। তা ছাড়া ঝিঁঝির সম্বন্ধেও ওর ভাবনা এখনও শেষ হয়নি নানা কারণে। তারমধ্যে নিজের আর্থিক দৈন্যও অছে। নীলোৎপলরা আজ না আসাতে পুরো ব্যাপারটাই আরও কমপ্লিকেটেডও হয়ে গেল। এসব বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসার-ই সময় হয়নি এখনও। নিজের জীবনকে ও ঢেলে সাজাতে চায়। এই গদিঘরের চাকরির সামান্যতা–সব সামান্যতাই; এই সংস্থার ক্রিয়াকর্মের সার্বিক সামান্যতা এবং সামান্য জীবিকা থেকে ওর যা-আয় তার সামান্যতা থেকেও ও নিজেকে মুক্ত এবং বিযুক্ত করতে চায়। সেই সিদ্ধান্ত এবং সেই সিদ্ধান্ত উদ্ভূত ভবিষ্যতের ওপরেই তার ব্যক্তিগত জীবনের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নির্ভর করছে। তাই এই Juncture-এ তাঁর পক্ষে হিন্দি সিনেমার হিরোর মতো এ-গাছ থেকে সে-গাছ জড়িয়ে গান গেয়ে গেয়ে প্রেম করার কোনো অবকাশ ই নেই। গুঞ্জন মুখে যাই বলুক, ওর সঙ্গে মুন্নি-তিন্নির মানসিকতাতে বিশেষ কোনো তফাত নেই। ওকে আর একদিনও পড়াতে গেলেই আগুনে ঘৃতাহুতি পড়বে।
প্রেম অনেক-ই গভীর ব্যাপার, যা পুনমচাঁদজির ভালো কন্যার সৎ ও নরম অনুভূতি অথবা অভিঘাতের গন্ডির বাইরের জগৎ। শিরীষ যেমন ওকে ঠকাতে চায় না, নিজেও জেনেশুনে ঝামেলাতে জড়াতে চায় না। তা ছাড়া আত্মহত্যা করাও অতসহজ নয়! সকলেই বলে, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে যাব’ কথায় কথায়। সেদিন ঝিঁঝি যেমন বলল, দাঁড়কাকের বাসা’র পেছনের শিরীষ গাছ থেকে ঝুলবে বলে। নিজেকে এই রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শর পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতো সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো মূর্খামি গুঞ্জনের কখনোই হবে না। প্রত্যেক মানুষ-ই জীবনকে বড়ো ভালোবাসে। মৃত্যু আর নরাধমের মধ্যে যদি প্রতিযোগিতা হয় তবে গুঞ্জনও অতিসহজে নরাধমকে বরণ করে নেবে যে, সে-বিষয়ে শিরীষের কোনোই সন্দেহ নেই।
সব-ই বুঝছে, জানছে কিন্তু তবু বুকের মধ্যে কোথায় যেন, একটা অপরাধবোধ কাঁটার মতো খচখচ করছে। গুঞ্জনের সঙ্গে একবার দেখা করা অবশ্যই উচিত ছিল। হুলো বেড়ালটাকেও একবার ইনডাইরেক্টলি সাবধান করে দেওয়া উচিত ছিল যে, কবুতরের দিকে ও যেন, হাত না বাড়ায় ভুলেও। বাড়ালে, ফল খুবই খারাপ হয়ে যাবে।
আবারও এই অঞ্চলে নকশালদের ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়েছে। শিরীষ মনে মনে অবশ্য তাদের সমর্থন করে। ঝাড়খন্ডিদের বক্তব্যকেও করে। যদিও তাদের বক্তব্য প্রকাশের পথকে সবসময়ে সমর্থন করে না। কিন্তু এই পোড়া দেশে যে, প্রার্থনা, যুক্তি, অনুনয়-বিনয়, বহুবছরের প্রতীক্ষাতেও কোনো ফল ফলে না। সকলেই চোখের সামনে দেখছে যে, এই মূক-বধির স্বার্থপরায়ণ, অন্ধ প্রশাসন কথা শোনে শুধু তখন-ই; যখন হাতে কেউ অস্ত্র তুলে নেয়। সশব্দে, সবেগে, আগ্নেয়াস্ত্রর গুলির সঙ্গে বিদ্ধ করে সেই বক্তব্যকে পেশ না করতে পারলে কোনো বক্তব্যই যাঁদের তা শোনার, তাঁদের কানে পৌঁছোয় না! এই সত্য। এবং অত্যন্ত দুঃখবহ হলেও শতভাগ সত্য। নকশাল ছেলেগুলোর কাউকে কাউকে চেনে শিরীষ। ঝাড়খন্ডিদেরও কারোকে কারোকে চেনে। ওরা ওকে মানেও। ওর সহমর্মিতার কথা জানে। ওদের লুকিয়ে থাকার জায়গাও চেনে জঙ্গলের গভীরে। নরাধম যদি ‘বাড়াবাড়ি করে তবে তাকে লুকুমখার বা চাহাল-চুঙরুর জঙ্গলের কোনো শিমুলগাছ থেকে ন্যাংটো করে ঝুলিয়ে তার মাংস খুবলে নিতে বলবে ওদের।
ঝিঁঝি কী মনে করল, কে জানে! কাকিমারও ওটা ভীষণ-ই বাড়াবাড়ি। ঘণ্টাখানেক আগেই নিজের সাইকেল চালিয়ে এসেছিল ঝিঁঝি ‘দাঁড়কাকের বাসা’-তে। ঝাণ্ডুর হাতে, তার আগে আগে টিফিন-ক্যারিয়ারে পোলাও-মাংস পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কাকিমা এবং সম্ভবত কাকিমার নির্দেশেই এসেছিল ঝিঁঝিও।
শিরীষ রেগে গিয়ে যখন ঝাণ্ডুকে বলেছিল, নিয়ে যাও এসব। তোমার দিদিমণিকে তো বলেইছি যে, ঘি-এর খাবার সহ্য হয় না গরিবের পেটে। ঠিক তখন-ই ঝিঁঝি এসে পৌঁছেছিল।
ঝাণ্ড তাকে নালিশ করেছিল, দেখিয়ে ঝিনঝিদিদি। মাইজি ইতনা পেয়ারসে আপনা হাতসে সব দে কর ভেজিনথি, ঔর শিসবাবুনে ইনকার কর দিই।
ঝিঁঝি বলল, বসতে তো বলবি! এই রাতে তোর বাড়িতে একা-একা এলাম সাইকেল চালিয়ে। এটুকু ভদ্রতাও তো দেখাতে পারিস।
কথা না বলে, হাত দিয়ে ঝিঁঝিকে ভেতরে আসতে বলল শিরীষ।
ঝিঁঝি মুখ নামিয়ে বলল, আজ কেন খাবি না? আজ তো তোকে মা আমাদের বাড়িতে খেতে বলেছিলেন-ই। জগামামা-মামারাও এসেছিলেন। খাওয়া-দাওয়া করছেন ওঁরা এখন।
শিরীষ মুখ নীচু করে ঘাড় গোঁজ করে বলল, আমি তো বলেইছি যে, কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না!
তুই যে, পোলাও-মাংস খাস না এমন তো নয়! মায়ের হাতের মিষ্টি পোলাও তো তুই খুব ভালোবেসেই খেতিস। সঙ্গে কচি পাঠার কালিয়া। ঘণ্টেমামা এবং মা বসে থাকবেন তোর জন্যে। চল। খাবার ঝাণ্ডুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। চল শিরীষ। আমরা আজ একসঙ্গে খাব।
না। বলেইছি তো যে, আমি যাব না। এত উৎসব করার কী আছে? বিশেষ কিছু কি ঘটেছে ‘তেওহার মানানোর মতো? সে তো এল না।
অপমানে ঝিঁঝির মুখ বেগুনি হয়ে গেল।
তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বলল, সে যে এল না, এইটাই হয়তো উৎসব পালনের একটা মস্ত কারণ। আমাদের বাড়ির কোনো উৎসব-ই কি, তুই ছাড়া সম্পূর্ণ হয়? বল?
তাই কি? আমি যে, মহুয়াতে এতবড়ো একজন ইম্পর্ট্যান্ট লোক হয়েছি তা তো জানতাম না আগে।
যদি আজও না-জেনে থাকিস, তাহলে বলব, যে, তুই পরমবোকা!
হাঃ।
হাসল শিরীষ।
তারপর বলল, তা আর বলতে! আমার মতো গাধা তো আর দু-টি নেই! তবে রাত বাড়ছে। একা যাস না। ঝাণ্ডুর সঙ্গেই যা, আস্তে আস্তে সাইকেল চালিয়ে। দিনকাল খারাপ। আগের ‘মানোয়া-মিলন’ আর নেই।
সত্যিই যাবি-না? খাবিও না এখানে বসেও?
বললাম-ই তো, না।
বুড়ি-মাই বলেছিল, লম্ফ-জ্বালা ঘরের আধো-অন্ধকার গভীর থেকে, কওন আয়া রে শিস?
ম্যায় হুঁ বুড়ি-মাই। ঝিঁঝি।
ঝিঁঝি বলল।
তারপরেই বলল, যাবিও না এবং খাবিও না যখন, তাহলে আর কী। যাই!
যা।
এটুকু জানিস না যে, যা’ বলতে নেই, বলতে হয় ‘আয়’।
না। জানি না।
আর কোনো কথা না বলে ঝিঁঝি চলে গিয়েছিল।
বলল, যা রহি হ্যায় বুড়ি-মাই।
ফির আনা বেটিয়া। রোজহি আনা।
ঝিঁঝি খুব অপমানিত হয়েছিল। হওয়ারই কথা! অপমান করার জন্যেই তো এমন ব্যবহার করা! সত্যিই যদি নাই খেত তবে ও রেখে দিতে পারত বয়ে আনা খাবারটা। কালুকে দিতে পারত। পোলাটা বুড়ি-মাইও খুব ভালোবেসেই খেত যদিও, দাঁত না থাকায় মাংস খেতে পারত না। আসলে এই খাবার শিরীষেরও ভীষণ-ই প্রিয়। কিন্তু কেন যে, এরকম করল! নীলোৎপল না-আসাতে ঝিঁঝির কী এবং কতটুকু অপরাধ? শিরীষের এই ব্যবহারের হেতু কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। শিরীষের নিজের পক্ষেও নয়। আসলে, ঝিঁঝির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, ওকে দুঃখ দিয়ে, ওকে কাঁদিয়ে শিরীষ খুব-ই সুখী হয়। ছেলেবেলাতেও, যখন ঝিঁঝিরা মনোয়া-মিলনে আসত এমন-ই করত ও। কেউকেটা বড়োলোকের মেয়ে বলে কোনো রেয়াত করত না। কিন্তু শিরীষকে এমনিতে প্রত্যেকেই অত্যন্ত ভদ্র-সভ্য ছেলে বলে জানে। ঝিঁঝিকে কষ্ট দিয়ে যে, কী সুখ পেয়ে এসেছে চিরদিন তার ব্যাখ্যা ও খোঁজেনি কোনোদিনও। খোঁজার চেষ্টাও করেনি।
কিছুতেই ঘুম আসছে না। আসলে নীলোৎপলদের না আসাতে ঝিঁঝির যে, অপমান তার কারণে ও নিজেও যে, এতখানি অপমানিত উত্তেজিত হবে তা বুঝতে পারেনি। নিজেকে বোঝে না শিরীষ। বুঝতে পারলে সুখী হত।
সেই বাদামি-কালো বড়ো ল্যাজঅলা লাফিয়ে-লাফিয়ে-চলা পাখিটা, যার স্থানীয় নাম ‘কাউকল’, অনেকে বলে, মহুকল’; যার ইংরিজি নাম ক্রো-ফেজেন্ট, ডাকছে পাহাড়তলি থেকে। সারারাত ধরেই ডাকব। তার গম্ভীর ‘ঢাব-ঢাব-ঢাব-ঢাব’ দূরাগত ডাক ভেসে আসছে। বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির গভীর থেকে। বৃষ্টির পরে প্রকৃতির শব্দপ্রেরণের ক্ষমতা যেন, বহুগুণ বেড়ে গেছে। সমস্ত বনে-পাহাড়ে অনুরণন উঠছে সেই ডাকের।
সেই অদেখা পাখিটাও ডাকছে, খুব কাছ থেকে। নিয়মিত এবং সমান সময়ের ব্যবধানে, ওঁক-ওঁক-ওঁক-ওঁক’ করে। বহুদূরে কপার স্মিথ ডাকছে ‘টাকু-টাকু। তার দোসর সাড়া দিচ্ছে আরও দূর থেকে, টাকু-টাকু-টাকু। ইয়েলো-ওয়াট্রেলড ল্যাপউইঙ্গ ডাকছে–”টি– টি-রটি–টি-টি-টি-টি’ করে, রাতের মোহময়তাকে বাড়িয়ে দিয়ে। ঝড়-বৃষ্টির পরে চাঁদ ওঠাতে চারদিক চকচক করছে চাঁদের আলোয়। রুপোঝুরি হয়ে উঠছে রাত।
.
জিতেন বলল, সব অন্ধকার আজ। সব মহল্লা ডালটনগঞ্জের।
তাছাড়া এমনিতেই আজকাল ডালটনগঞ্জে ভীষণ লোডশেডিং। সব কারেন্ট চলে যাচ্ছে কুটকু, হামিগঞ্জ, আবাদগঞ্জ, কাঁচাইরির দিক, নয়াটুলি, নইমহল্লা, বেলুয়াডিকার এমনকী রেড়মা পর্যন্ত। ড্যামে। ড্যাম বানানো হচ্ছে সেখানে। এমার্জেন্সি-ফুটিং-এ কাজ হচ্ছে। সব সরকারি কাজ-ই প্রথমে শুয়ে-বসে, চূড়ান্ত ঢিলেমি করে এবং অবস্থা যখন বেগতিক তখনই ‘এমার্জেন্সি-ফুটিং’, ওয়ার-ফুটিং’-এ। তদুপরি আছে তার চুরির অন্ধকার। তার চুরি যায় প্রতিসপ্তাহেই একবার করে, গড়ে।
চোর-জোচ্চোর-ছ্যাঁচড়ে দেশটা একেবারেই ভরে গেছে। গরমে ঘেমে-নেয়ে উঠতে উঠতে শেফালি বললেন, নিজের মনে, চারদিকে একেবারে ‘লুট-মার’-এর রাজত্ব চলছে।
যেন, ওঁর মনের কথাই বুঝতে পেরে জিতেন বলল, জানো বউদি। একটা দেশ গড়ে মানুষেই! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল; ফ্রান্স, জার্মানিও। আর আজ দ্যাখো, তারা পৃথিবীকে কত ব্যাপারেই-না নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর সেই যুদ্ধশেষের পরে পরেই আমরাও স্বাধীন হয়েছিলাম। কী করলাম বলো, আমরা সেই স্বাধীনতা নিয়ে? শুয়োর আর গিনিপিগদেরও লজ্জা দিয়ে বংশবৃদ্ধি করা ছাড়া, আর কী করলাম? জনসংখ্যাই এই দেশের সর্বনাশের মূলকারণ হল। অথচ ভোটে হাত পড়ার ভয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দল-ই এই প্রধানতম সমস্যাটি এড়িয়ে গেল। এই গণতন্ত্র নিয়ে কী করার আছে আর আমাদের? মনুষ্যত্ব, সারল্য, সততা, নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রমমুখীনতাই আজ হয়েছে সবচেয়ে বড়োবলি, স্বাধীনতার পরে। মানুষের মনুষ্যত্বে যত ভেজাল হয়েছে, তত ভেজাল ডালডা বা সিমেন্টেও হয়নি। এই ভেজাল, প্রজন্মর পর প্রজন্মকে কুরে-কুরে খেয়ে যাবে। আমরা আবারও পরাধীন হব শিগগিরি। আমরা তো আর বড়োজোর তিরিশ-চল্লিশ বছর বাঁচব। কিন্তু এই পাগলা আর ছুটকিদের জন্যে কোন ভবিষ্যৎ রেখে যাচ্ছি আমরা? বলো?
জিতেন বলল।
সত্যি! ঠিক-ই বলেছ তুমি। ভাবলেও আতঙ্কিত হই। ওদের ভবিষ্যৎ সত্যিই বড়ড়াই অন্ধকার। এখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চোর-জোচ্চোর-অসৎ কতগুলো জানোয়ার, মানুষের চেহারার; কিন্তু মানুষ সেগুলো আদৌ নয়।
শেফালি বললেন, উম্মার সঙ্গে।
পাগলা আর ছুটকির খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ওরা আবার গিয়ে পড়তে বসেছে। এগারোটা অবধি পড়বে। কারেন্ট থাকলে, চোখগুলো বাঁচত।
আর একটু খিচুড়ি দেব? তোমায়?
না, না। তুমি খাবে কী? তা ছাড়া আমাকে তো বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গে একটু খেতে হবেই। মা বসে থাকবেন আমার জন্যে। তুমি খাও।
আর দেরি কোরো না, মাসিমা বসে থাকবেন। তোমার তো পেটও ভরল না।
যাব এবারে। খিচুড়ির স্বল্পতার দোষ কী? আমি যে, আসব তা তো জানতে না তুমি।
জানতাম।
শেফালি বললেন।
জানতে?
জিতেন অবাক গলায় বলল।
জিতেনের চোখে চোখ রেখে শেফালি মাথা নাড়িয়ে জানালেন, হ্যাঁ।
জিতেন চুপ করে শেফালির মুখে চেয়ে রইল। কথা বলল না কোনো।
অড়হর ডালের খিচুড়ি কি কোনো ভদ্রলোকে খায়? কিন্তু কী করব। ওই ছুটকিটা! ভীষণ ই খিচুড়ি ভক্ত। মুগ-মুসুর ছিল না, তা কী করব বলো?
আমি কাল-ই নিয়ে আসব।
না, না। সেজন্যে বলিনি। লজ্জিত হয়ে বললেন শেফালি।
তা জানি।
না, না, ওসব আনতে হবে না। ‘কষ্ট’র মধ্যে ছেলেবেলাটা তো কাটা ভালো। এটা শিক্ষার একটা অঙ্গ। যাঁরা জীবনে বড়ো হন, তাঁদের মধ্যে, লক্ষ্য করলে দেখবে; অধিকাংশই আসেন গরিবঘর থেকেই। আমার তো পড়াশোনা হল না। আমি চাই, আমার ছেলে-মেয়েরা অনেক পড়াশোনা করুক, জীবনে মস্তবড়ো কেউকেটা হোক তারা। পয়সার মাপে বড়ো নয়, মিডিয়া-বাহিত ফালতু উদ্দেশ্যপ্রসূত যশের মাপেও বড়ো নয়; মনুষ্যত্বের মাপে বড়ো।
হবে হবে। ওরা খুব-ই ভালো হবে। চমৎকার ছেলে-মেয়ে ওরা তোমার বউদি।
স্বগতোক্তি করল জিতেন।
শোনো, তোমার কিন্তু চাল-ডাল কিছুই আনতে হবে না। যা নিয়ে আসো, শুধু সেটুকু নিয়েই এসো।
কী তা?
তুমি তা জান না?
স্বল্পক্ষণ শেফালির মুখে চেয়ে থেকে, হঠাৎ-ই লজ্জা ও আনন্দে জিতেনের ফর্সা মুখটি রেঙে উঠল।
লক্ষ করলেন শেফালি, লণ্ঠনের আলোতেও।
.
আজ ভারি সুন্দর করে সেজে এসেছিল ঝিঁঝি। হালকা বেগুনি-রঙা জমির সিল্কের শাড়ি পরেছিল একটা। হয়তো কাকিমার-ই শাড়ি। শাড়িটি পুরোনো। এবং পুরোনো বলেই, নরম। ঔজ্জ্বল্যও কম। তাতে শ্রী আরও খুলেছিল ঝিঁঝির। ম্যাজেন্টা-রঙা পাড় শাড়িটির। সঙ্গে, সাদা ব্লাউজ। গলার কাছে লেসের ফ্রিল দেওয়া। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা রবিঠাকুরের আমলে যেমন পরতেন। গলাতে প্লাস্টিকের ছোটো ছোটো বেগুনি-রঙা সস্তা হার। তাই ঝিঁঝির মরালী গ্রীবাকে মহামূল্য বলে মনে হচ্ছিল। খোঁপা করেছিল। তাতে বেগুনি ফুল গাঁথা ছিল; জ্যাকারাণ্ডা। হাতে ম্যাজেন্টা-রঙা প্লাস্টিকের বালা। কোনো সুগন্ধি মেখেছিল আজ ঝিঁঝি। এমনিতেই ঝিঁঝির গায়ে সুগন্ধ। ওর গায়ে কোনো কটু গন্ধ নেই। পদ্মিনী-নারী ঝিঁঝি। এই সুগন্ধি, নিশ্চয়ই কাকিমার। এবং বহুবছর আগেকার। সযত্নে আলমারিতে তুলে রাখা ছিল এমন-ই কোনো দিনে বের-করার জন্যে।
বেচারি ঝিঁঝি!
এখনও ‘দাঁড়কাকের বাসা’-র বারান্দাটা সুগন্ধে ভরে আছে। সে-গন্ধ বৃষ্টিভেজা বন গন্ধের সঙ্গে ভাসছে মনোয়া-মিলনের আকাশের স্তরে স্তরে।
শিরীষ ভাবছিল, এখন ঝিঁঝি কী করছে, কে জানে? কী ভাবছে? কার কথা? না-আসা নীলোৎপলের কথা কি? না, অন্য কারো কথা?
ঘণ্টেমামার সঙ্গে সিরিয়াসলি কথা বলবে কালকেই শিরীষ। স্টেশনেই কথা হচ্ছিল, কেন্দুপাতার ব্যবসা নিয়ে। এক্সটেনশন না-পেলে তাঁকে কিছু একটা করতেই হবে। যা জানেন, যা-নিয়ে জীবন কাটালেন; তাই করবেন। বলেছিলেন ছোট্ট করে কেন্দুপাতার কাজ আরম্ভ করতেও লাখখানেক টাকা লাগবে। তবে তাঁকে ওই-লাইনে সকলেই চেনে। ওঁর পক্ষে অনেক কমেও হয়তো করা সম্ভব হবে। কিন্তু সেই কমটাই বা জোগাড় হবে কোত্থেকে? তা ছাড়া, জনবলেরও দরকার। সব স্টেজে খবরদারি করলে, অন্তত জনাদুই বিশ্বাসী লোক না থাকলে টাকা সব মার যাবে। কাঁচা-টাকার ব্যাপার। জঙ্গল থেকে কেন্দুপাতাই বেরুবে না।
শিরীষ বলছিল, ওরও আর এই চাকরি ভালো লাগে না। কিছু একটা করতে হবে।
ভাবছিল, ঝিঁঝির কাছে ঝিঁঝির গয়না ধার চাইবে। ওসব গয়না দিয়ে কী হবে? নীলোৎপলের মতো, কোনো কথা-দিয়ে, কথা-না রাখা তথাকথিত “শিক্ষিত’ অভদ্র বাঁদরকে বিয়ে করে, বিয়ের দিনে সেইসব গয়না পরার জন্যে? শিরীষের মায়ের গয়নাও তো সব রাখা আছে জগামামাদের কাছেই। মস্ত লোহার সিন্দুকে রাখা আছে তা। বাড়িতে বন্দুক আছে। তা ছাড়া জগামামা মান্যগণ্য মানুষ তাই সেখানে তা নিরাপদে আছে। ঝিঁঝির জন্যে, যে-গয়না তাও কাকিমা ওখানেই রেখেছেন। কী গয়না, তার দাম কত; সেসব যাচাই করতে হবে এবারে পুঁটলিটা ফেরত চেয়ে নিয়ে। মা নিজেই জগামামাকে ডেকে গচ্ছিত রেখেছিলেন।
শিরীষ মায়ের একমাত্র সন্তান। না-খেতে পেলেও গয়না বিক্রি করব না’–এই বোকা বোকা বাঙালি সেন্টিমেন্ট মায়েরও ছিল। যে-মেয়ের কাছে ‘গয়না’র দাম ভালোবাসা বা স্বামীর সম্মানের দামের চেয়েও বেশি, তেমন মেয়েকে শিরীষ বিয়ে করবে না কখনোই। তাই তার স্ত্রীর জন্যে মায়ের গয়না যখের ধনের মতো আগলে রাখার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই তার। জগামামাদের বাড়ি গিয়ে কোনো সোনা-চাঁদিওয়ালাকে তাঁদের বাড়িতেই ডাকিয়ে এনে মূল্যায়ন করতে হবে সেগুলোর। পঁচিশ-তিরিশ ভরিও যদি হয়, তো তারও দাম তো আজকে অনেকেই। তার ব্যবসার ক্যাপিটাল তা থেকেই পেয়ে যাবে। কত টাকার জোগাড় হতে পারে জেনে নিয়ে তারপর ঘণ্টেমামার সঙ্গে ডালটনগঞ্জে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে আসবে। তাদের ব্যবসার সম্ভবনার শিকড় নিয়ে।
ঝিঁঝি কি পার্টনার হতে রাজি হবে? ঘণ্টেবাবুর কাছে গল্পশোনা সেই বিত্তবান কিন্তু মেহনত করে খাওয়া সংস্কৃতিসম্পন্ন ডালটনগঞ্জের সেই জিতেনবাবুর, ঠিকাদার? তিনিও যদি সঙ্গে থাকেন তো বেশ হয়। তবে বাঙালির পার্টনারশিপ! এতজনে কি টিকবে বেশিদিন? জগাদা গভীর ঘুমে ছিলেন। আজকে একটা খুনের মামলার আসামিকে বেকুসর খালাস করিয়েছেন তাঁর জোরালো সওয়ালে।
যে-মানুষটাকে খুন করার অপরাধে তাঁর মক্কেল অভিযুক্ত হয়েছিল তার বউ ছিল আদালতে। সাক্ষীও দিয়েছিল সে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এর আগের দিন, একথা জানিয়ে যে, সে নিজের চোখে দেখেছে তাঁর স্বামীকে খুন করতে জগাদার মক্কেলকে। জগাদার তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার জেরার মুখে, অবলা, দেহাতি গাওয়ার সাক্ষ্য টেকেনি।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সত্যদ্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র বলে গিয়েছিলেন কবেই যে, আইন! সে তো তামাশামাত্র! বড়োেলোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে-তামাশা দেখিতে পারে।
আজও আইন তামাশাই আছে। ফাঁক-ফোঁকর, বেনিফিট-অফ ডাউটের লঙ্কাগুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে মক্কেলকে বের করে এনেছেন ফাঁসির মঞ্চ থেকে জগাদা। কিন্তু জজসাহেব রায় দেওয়ার পরেই সে, বউটির মুখে যে-ভাব দেখেছিলেন, উনি তাতে বুঝেছেন যে, তাঁর মক্কেল-ই খুন করেছিল মেয়েটির স্বামীকে। কোনো মামলার রায়-ই অবলম্বহীন, অসহায় বিধবার মুখের অভিব্যক্তির চেয়ে বেশি মান্য নয়! অন্তত মানুষের বিবেকের কাছে। জগাদারও বিবেক আছে। এবং আছে বলেই তাঁর মামলা জিতেও এতকষ্ট!
মক্কেল অবতার সিং, ধষর্ণকারী, গুণ্ডা, পাজি, মাফিয়া, জঙ্গলের কাঠচোর, তাঁর দু-পায়ে পড়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। আর একটি বাণ্ডিল দিয়েছিল দশ হাজার টাকার। এক-শো টাকার নোটের।
বলেছিল, সরকার হাইকোর্টমে আপিল করনেসে আপহিকা পাস আয়েগা হজৌর। সিনিয়র-উনিয়র যো লাগানেকি হ্যায় আপহিকা জিম্মেদারি হ্যায়। সমঝে না হজৌর! রুপিয়া যিতনা চাহিয়ে ম্যায় লায়েগা। বে-ফিকুর রহিয়ে।
মাঝরাতে মৃত মানুষটির স্ত্রীর চোখ দুখানি যেন, স্থিরনেত্রে জগাদার চোখে চেয়ে রয়েছে। দেখলেন। অমন সুন্দর ঠাণ্ডা রাতেও ঘুম-ভেঙে, ঘেমে-নেয়ে জেগে উঠলেন তিনি।
নিজেকে বললেন, আমি কী করব! খুনি বেঁচে গেল আইন ব্যবস্থার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে। আমার যে এই কাজ! ফৌজদারি উকিল আমি। বিবেক, আমার বাড়িতে সুগন্ধি রুমাল জড়িয়ে রেখে দিয়ে আসি, কোর্টে আসার আগে। বিবেকের সঙ্গে পেশাদারি কর্তব্যর কোনো সম্পর্ক নেই। বিপক্ষের সরকারি উকিল যদি খেটে না আসে, ভালো সওয়াল না করে, যদি তাঁর মাফিয়া মক্কেলের কাছে ঘুস খেয়ে বিধবাকে ডুবিয়ে দেন, তবে তিনি কীই-বা করতে পারেন? দেশ এখন, এই করেই চলছে। এইভাবেই। তাঁর বিবেকটা তবু এখনও বেঁচে আছে ধুকপুক করে হলেও। কিন্তু সরকারি উকিলের বিবেক? যিনি সরকার থেকে ফিসও পান এবং বিপক্ষের মক্কেলের কাছে ঘুসও খান তাঁর বিবেক? খুনিকে বাঁচিয়ে দিয়ে, অসহায়, সুন্দরী বিধবাকে চিরজীবনের মতো ওই মাফিয়াদের ভোগ্য করে তুলে যে-টাকা, সেই উকিল উপার্জন করলেন সেই টাকার রোটি-ডাল পোলাও-মাংস কি তাঁর মুখে রুচবে? তাঁর কি ঘুম হয় রাতে? তাঁর নিষ্পাপ নাতি-নাতনিদের যখন কোলে নিয়ে বসিয়ে আদর করবেন সেই সরকারি উকিল তখন কী ভয়ে তাঁর বুক কাঁপবে না যে, তাঁর পাপের দায় এই শিশুদের-ই হয়তো বইতে হবে?
কে জানে! হয়তো কাঁপবে না। কারণ শুভ-অশুভ, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-খারাপ এইসব বোধ-ই উবে গেছে এখন দেশ থেকেই। ধর্মের বাঁধনও পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে গেছে। ধর্ম, সাধারণের-ই জন্যে। অসাধারণ মানুষদের জন্যে নয়, তাঁরা নিজস্ব ধর্ম, মানবধর্মকে অবলম্বন করে বাঁচতে পারেন। কিন্তু ধর্মভয়’ চলে যাওয়াতে হিন্দুরা ভ্ৰষ্ট-নষ্ট হয়ে গেছে পুরোপুরিই। মুসলমানেরা ধার্মিক। সে-ধর্ম অন্যের কাছে মান্য কী নয়, উৎকৃষ্ট বলে গণ্য কী নয়; সেকথা অবান্তর। কিন্তু ধর্ম যে, তাদের বেঁধে রেখেছে, সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিরাদরি, ন্যায় অন্যায়–বোধ, শুভাশুভ বোধ জাগিয়ে রেখেছে এরজন্যে, সেই ধর্মের বাঁধনের-ই সবটুকু কৃতিত্ব। আজকে ধর্ম হয়ে গেছে লুটমারের ধর্ম। যেন-তেন-প্রকারণে টাকা চাই। টাকাই ঈশ্বর যেন! তা ছাড়া, হিন্দুধর্মের জাতপাত, মানুষকে মানুষ জ্ঞান না করার চরম অশিক্ষা কত নিরুপায় নিম্নবর্ণের হিন্দুদের নেহাতই নিরুপায় করে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে অন্য ধর্মের ছত্রছায়াতে। ইসলামের বিরাদরি’র গুণটি সবচেয়ে বড়োগুণ। সর্বার্থেই ওই ধর্ম পরমসোশ্যালিস্ট। সেইখানেই সেই ধর্মের সবচেয়ে বড়োজোর। হিন্দুধর্মের যা-কিছুই ভালো তা নষ্ট হয়ে গেছে বা নষ্ট হতে বসেছে। এরজন্যে দায়ী কারা সে-সম্বন্ধে একটু অস্পষ্ট ধারণা যে, নেই জগাদার তা নয় কিন্তু সেইসব প্রসঙ্গ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে কেউ নাড়ে-চাড়ে না। বড়োই অস্বস্তি হয় জগাবাবুর। কিন্তু উনি একা হাতে কী করতে পারেন? তবে যেটুকু পারেন, সেটুকু করবেন। যে-মামলাতে মিথ্যে কথাকে সত্যি বলে চালাতে হবে তেমন মামলা তিনি আর নেবেন না।
কিন্তু তাঁর জুনিয়র পান্ডে বলেন, স্যার, ওকিলকি কম্মি থোরি হ্যায় লাতেহার কোর্টমে? আপ কনসান্স কি চক্করমে ফাঁসনেসে আপকি পরফেশান বিলকুল চৌপট হো যায়েগা।
ই ভি সাহি বাত। মগর করু ক্যা?
জগাবাবু বলেছিলেন।
জগাবাবু ঠিক করেছেন এই মক্কেলকে ফি-এর টাকাটা উনি মৃতর স্ত্রীকে পৌঁছে দেবেন এবং জানাবেন যে, তিনি সত্যিই দুঃখিত।
নিজের বাড়িটাও একটা মেস-বাড়ি হয়ে রইল। মুখে-আগুন দেওয়ার জন্যেও কেউই রইল না। তা ছাড়া একজন মেয়ে না থাকলে কি বাড়িকে বাড়ি বলে মনে হয়? কত করে বললেন মাধাটাকে একটা বিয়ে করতে, তা সে শুনল কই?
এইসব ভাবতে ভাবতেই আবারও ঘুমিয়ে পড়লেন জগাবাবু।
ঘুমের মধ্যেই মাধবাবুর সঙ্গে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত কথোপকথন হল এইরকমঃ
কীরে মাডা! ডামডা হয়ে আড কটোডিন রইবি? একটা বে কড এবাডে।
মাধবাবু বললেন, সবসময় ‘দামড়া-দামড়া’ কোরো না তো দাদা। সেদিন পান্ডে সাহেবের সামনেও বলেছিলে! আমার কি কোনো প্রেস্টিজ নেই?
পেস্টিড? ডাডার কাটে আবার পেস্টিড কী রে? টোর রাগ কি একনও পড়েনি আমাড় উপডে?
কীসের রাগ?
ঠেই ডে,ডকন পটলার মাকে বিয়ে কডটে টেয়েটিলিটকন আমি ‘না’ কড়েটিলাম বলে? ড্যাক, হুডকোহাটের মুকুজ্জেবাডিড টেলে হয়ে টুই ঠেঠে একটা ঝিকে…ঠেই জন্যেই মানটে পাডিনি, ঠেডিন।
তাহলে আবার পুরোনো কতা নিয়ে পড়লে কেন? ঝি বলে কী সে মানুষ ছেলেনি? ভদ্রলোকের মেয়ের যা থাকে, ঝি-এরও তাই থাকে।
আঃ। মাডা। ডোট কটাবাটটা বড়ো ক্রুড হয়ে ডাট্টে আডকাল। ঠরীরটাই কী ঠব? মেন্টাল কম্প্যানিয়নটিপ কি পেটে পারটিট পটলার মায়ের কাঠ ঠেকে?
তা কেন পারতাম না? সোশ্যাল ইনজাস্কিদের জন্যে সে পড়াশুনোর সুযোগ পায়নি, ইংরিজি শেখেনি; তা বলে কি সে মুকু ছেল। দ্যাখো দাদা, প্রত্যেক মানুষ কিছু সহজাত বিদ্যা-বুদ্ধি নিয়ে আসে। দু-পাতা ইংরিজি ফরফরালেই আর বড়োলোকের বাড়ি জন্মালেই কিন্তু ল্যাজ গজিয়ে যায় না মেয়েছেলের। তার বুদ্ধিই যদি না-থাকত তবে তাকে আমার, ভালো কি লাগত? তা ছাড়া, স্বামীহারা মহিলা। ছেলেটাকে মানুষ করতে কী না কী করছে। কে জানে!
আমার আপটিটা টো সেইকানেই ঠিল! বিয়েই ডডি কডবি, টো, ঠবৎসা গাবীকে কেন? মেয়ের কি অবাব পড়েটেল ডেঠে?
কী বললে? সবৎসা গাভী! মাইণ্ড ইয়োর ল্যাঙ্গোয়েজ।
ল্যাঙ্গোয়েজ আবাড কী? ঠব ঠিক-ই আটে। কী করে পটলার মা, টার পটলাকে মানুঠ করঠে ভেবে তোর কেঁড়ে লাব কী? টোর ঠঙ্গে ডা করটো টাই ঠে অন্যর ঠঙ্গে কট্টো। ঠে কি আড তোড ডন্যি কেঁড়ে ভাটাট্টে? “বাবনা কী টোর হাবি, পেটের টলায় ডে ঢন আঠে, টাই ভাঙিয়ে কাবি।
তুমি বড্ড অশ্লীল দাদা। তোমার রুচি বড়ো খারাপ। যে-মেয়ে তোমার ভ্রাতৃবধূ হতে পারত তার সম্বন্ধেই তুমি এমন কতা বলতে পারলে?
কী বলেটি? খাড়াপটা কী বলেডি?
‘ভাবনা কি তোর হাবি, পেটের তলায় যে-ধন আছে তাই ভাঙিয়ে খাবি’ –এটা খারাপ কথা নয়?
টাটে কী? বিয়েটা আর হয়নি টোর ঠঙ্গে পটলার মায়ের। আর হবেও না। টার ঠম্বন্ধে কী বললাম না ঢলোম টাটে কী হডো? কট্টো বালো বালো মেয়ে আটে। রাঁটিতে পালটি-ঘরের বাঁড়জ্যে আটে, রাঢ়ি ওরিডিনাল বাড়ি টেলো বড্ডমানে। টাডের বাডির এট্টি মেয়েকে ডেকেটিডাম…বড্ড পটও হয়েঠিল।
ওসব কথা থাক দাদা। তোমার পছন্দ হয়ে থাকে তো তুমি বে করোগে। আমি দাঁড়িয়ে থেকে তোমার বে দেব। এই বুড়োবয়সে বিয়ে আমি করব না আর। বেশ আছি। শিকার শিকার খেলা করি, তোমার ঘাড়ে খাই-দাই, বানোয়ারিলালের সঙ্গে আড্ডা মারি, তোমার সঙ্গে তাস পিটি, শিরীষের সঙ্গে দাবা; বেশ তো কেটে যাচ্ছে জীবন। তারমধ্যে এই শেষবেলাতে একগাছা মেয়েচেলে এনে ফেলে জীবনটা মাটি করার দরকারটাই বা কী? আমার কী? তুমিই পড়বে সবচেয়ে বিপদে। কত প্যাডিতে কত রাইস’ জানবে তকন হাড়ে হাড়ে। মেয়েচেলের মতো অমন বজ্জাত জাত ভগমান এ-পিথিবীতে দু-টি পয়দা করেননি। এমন সুকে আচো, তোমাকে হঠাৎ ভূতে কিলোতে শুরু করল কেন?
জগাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ডা বালো মনে করিট। ইয়োর লাইফ ইজ ইয়োর লাইফ। আমি টো টিরডিন বাঁডব না! তুইও বুড়ো হবি। টকন টোকে ডেকবেটা কে?
বুড়ো হলে বউ দেখবে? তাই ভাবচ তুমি! সেসব সুখের দিন চলে গেছে কবে। সে ‘রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। বুজে দাদা!
আবার অডোড্যার কটা টোলা কেন? পট্টিমবঙ্গের ড্যোটি বটু বা বুড্ডডেব ভটাটাচ্চিরা একবার ঠুনঠে পেলেই টোড ওপরেও কুব রেগে ডাবে। বলবে, ঢম্মো-নিরপেক্কতা বিগ্নিটো হডো।”
.
জিতেন বলল, চলি বউদি।
আবার এসো। কবে আসবে?
ইচ্ছে তো করে রোজ-ই আসি।
ওইসব দুষ্টু ইচ্ছে মন থেকে ঝেড়ে ফ্যালো। ‘ইচ্ছে’ হচ্ছে বাস্তুসাপের-ই মতো। তাকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেললে পরে, তাকে আর কখনোই মারা যায় না। বুঝেছ!
তারপর বললেন, তুমি ছেলেমানুষ হতে পারো। তা বলে, আমি তো নই।
তা তো বটেই। তুমি তো বুড়িই!
তারপর গলা চড়িয়ে জিতেন বলল, পাগলা, ছুটকি, চললাম রে। আসতে হবে না। পড়া করো।
কিন্তু দু-জনেই হুড়মুড়িয়ে চেয়ার ঠেলে দৌড়ে এল জিতেনকে দরজা অবধি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। ওরা খুব-ই ভালোবাসে জিতেনকে।
শেফালি ভাবছিলেন, জিতেন যখন সংসারী হবে, ওর সংসার সুখের প্রতিমূর্তি হবে। ওর ছেলে-মেয়েরা খুব ভাগ্যবান-ভাগ্যবতী হবে। স্নেহ ব্যাপারটা, আজকাল খুব কম ছেলে মেয়েই তাদের মা-বাবার কাছ থেকে পায়। বাবা-মায়েদের সব অজুহাত-ই হয়তো সত্যিও, তাঁরা অনেকেই নিরুপায় যে, একথাও ঠিকই কিন্তু শৈশবে বা কৈশোরে যে, শিশু মা-বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হল তার বা তাদের মতো হতভাগ্য বড়োবেশি হয় না।
.
ঝিঁঝি শাড়ি-জামা সব ছেড়ে, নাইটি পরে শুয়েছিল। ঘণ্টেমামা কাল সকালেই চলে যাবেন। প্রচন্ড অপমানিত ও লজ্জিতও হয়েছেন উনি। বারে বারেই মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
জগামামারাও চলে গেছেন অনেকক্ষণ-ই খেয়ে-দেয়ে।
সুনীতির মুখের দিকে সন্ধে থেকেই চাইতে পারছে না ঝিঁঝি। দাঁতে-দাঁত কামড়ে ও প্রতিজ্ঞা করেছে, এ-বিষয়ে আর কোনো দেখতে-আসা-টাসার কথা নয়। এ-জীবনে আর এমন করে অপমানিত করবে না নিজেকে। সুনীতিকেও। ও নিজেই কিছু একটা শুরু করবে। ব্যবসা; বাণিজ্য। জগামামাদের সঙ্গে কথা বলবে ভাবছে কালকেই। যাবে সেখানে।
ঝিঁঝির কানদুটো তখনও ঝাঁ ঝাঁ করছিল। ও ঠোঁট কামড়ে স্থির করল যে, আসুক শিরীষ এরপরে তাদের বাড়িতে একবার। অপমান কাকে যে, বলে তা ঝিঁঝি বোঝাবে তাকে! কী মনে করেছে ও? কী মনে করে নিজেকে?
.
শিরীষ ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে শুল। ঘুমন্ত শিরীষের স্বপ্নমাখা চোখ দুটি জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সুগন্ধি ঝিঁঝি। বেগুনি ঝিঁঝি, বেগুনি শাড়ি, খোঁপায় বেগুনি-ফুল।
শিরীষ দেয়ালা করে বলল, ঝিঁঝি, তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি রে! তাই তো এত দুঃখ দিই। তুই দুঃখী হলে আমি সুখী হই। আমাকে সকলেই ভুল বোঝে। তুইও যদি ভুল বুঝিস তো…। তুই আমার-ই ছিলি,আমার-ই আছিস; আমার-ই থাকবি চিরদিন। কোনো মিস্টার ‘পল’-ই তোকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। আমি ব্যবসা আরম্ভ করছি শিগগিরি। দেখিস। তোকে রাজরানি করে রাখব। তোকে কি অনাদরে রাখতে পারি? কত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যর মধ্যে মানুষ হয়েছিস তুই?
পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল গুঞ্জনের কথা। গুঞ্জনটা যা পাগলি মেয়ে! সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা-ফত্যা করে বসবে না তো। ও উৎসাহ না দেখালেই হয়তো গুঞ্জন ভুলে যাবে ওকে। এমন ভালোবাসা এই বয়সি মেয়েদের মনে কত জন্মায় আবার আপনা থেকেই মরে যায়।
পরে ওকে একদিন বুঝিয়ে বলবে শিরীষ যে, সে গুঞ্জনের হাসনুহানা-ভালোবাসা অবশ্যই গ্রহণ করেছে। ভালোবাসার ফুল রাখার জন্যে ফুলদানি তো চাই! একজনের ভালোবাসা নির্ভেজাল, খাঁটি এবং পুষ্পিত হলেও অনেকসময়ে অন্যজনের তা গ্রহণ করার মতো, ফুলদানি থাকে না। এবং থাকে না বলেই সেই মহার্ঘ্য দান গ্রহণ করতে পারে না অন্যজনে। তাতে দাতার অসম্মান হয় না কোনোই। লজ্জা বা দুঃখ যা, তা গ্রহীতার-ই। অপমানটা তার ই। ভালোবাসা, কারো ভালোবাসাই অনাদরে, অমর্যাদায় শুকিয়ে মলিন করার অধিকার অন্যের একেবারেই নেই।
শিরীষ জানে যে, বোঝালে, গুঞ্জন বুঝবে। ইন্টেলিজেন্ট আছে মেয়েটি। সুইটি-পাই। আহা। সুখী হোক বেচারি, সুখী হোক। কে বলতে পারে? হয়তো নরাধমও গুঞ্জনকে সত্যিই ভালোবাসে।
ওদের নিজেদের প্রজাতির ছেলে। কাজে-কর্মে ভালো। তা ছাড়া নরাধমের মোটা চেহারার ও আপাত কামুক দৃষ্টির আড়ালে কোন সূক্ষ্ম মানুষ বাস করে, কোন দুর্মর প্রেমিক তা কি, অত সহজে বলা যায়? ঘণ্টেমামার মধ্যে যে, এমন একজন সংবেদনশীল অভিমানী মানুষ বাস করেন তাও কী আগে জানত?
.
ঘণ্টেবাবু পাশ ফিরে শুয়েছিলেন। পাশেই টেবলের ওপর রাখা ওঁর চশমাটি। চশমা-ছাড়া চোখদুটিকে গহ্বরের মতো মনে হয়। বড়ো করুণ, দুর্বল সেই খালিচোখের দৃষ্টি। হতাশার প্রতিমূর্তি যেন, সেই চোখ দু-খানি।
দাঁতের ফাঁকফোকর দিয়ে নাল গড়িয়ে পড়ে আজকাল। বালিশ ভিজে যায়। বুঝতে পারেন, বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, হেরে যাচ্ছেন জীবনের হাতে মার খেয়ে খেয়ে ক্রমাগত। জীবনটা অন্যরকম হলে যৌবনও থাকত আরও অনেকদিন। ব্লাড-সুগারটা চেক করাতে হবে একবার। ভারি পিপাসা পায়, ক্লান্ত বোধ করেন; খিটখিটে হয়ে গেছেন।
ঘণ্টেবাবু বিড়বিড় করে ঘুমের মধ্যে বললেনঃ “আমাকে বিয়ে করে তুমি জীবনে অনেক এবং অনেকরকম কষ্টই পেয়েছ! কালকে ডালটনগঞ্জে পৌঁছেই আমি রেজিগনেশন দেব এই চাকরি থেকে। যতটুকু আছে, সব ভেঙে নিজেই নতুন করে আরম্ভ করব। এতগুলো বছর ধরে শালাদের কোটি টাকা কামিয়ে দিয়েছি। এখন আমি নিজেও যে, পারি কিছু কামাতে তা ওই শালা অকৃতজ্ঞদের দেখাব। ছোটোলোকের কাছে চাকরি আর করব না। হাতজোড় করে ‘বাবু’ ‘বাবু’ করব না আর একদিনও। শেষজীবনে তোমাকে সোনায়-দানায় মুড়ে দেব। বদলে তোমার কাছে আমি কিছুই চাই না। আমি জানি যে, তুমি এবং তোমার ছেলে-মেয়েরাও সকলেই জিতেনকেই ভালোবাসো। আমাকে তোমরা একদিনের জন্যেও কেউই চাওনি। জানি তা আমি। লুঙ্গি-পরা, বিড়ি-ফোঁকা, টেকো-বুড়ো আমি। আর্ট-কালচার হীন। অপদার্থ। আমার দিন গেছে। বাকিজীবন আমি হান্টারগঞ্জ, জৌরী, চাতরা কি সীমারিয়ার জঙ্গলের ডেরাতেই থেকে যাব? তোমাদের জন্যে টাকা পাঠাব থোকা-থোকা। আমাকে তো তোমরা কেউ-ই চাওনি একদিনের জন্যেও। আমার জন্যে আমাকে চাওনি। কেউই। টাকা চেয়েছ, টাকাই দেব। নিভে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো জ্বলে উঠে প্রমাণ করে যাব যে, যতখানি অপদার্থ তোমরা আমাকে ভাব; আমি তা নই। সংসারে নিতান্ত নির্গুনের ও কিছু গুণ থাকে।
শেফালি আমাকে মুক্ত করে দাও এই জীবনের মতো। আর যে কটা দিন বাঁচি, এই গ্লানি থেকে, অপমান থেকে, এই সবরকম অপারগতার গভীর লজ্জা থেকে আমাকে ছুটি দাও। ছুটি চাই। আর কিছুই চাই না।’
.
ছেলে-মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন রাত বারোটা বাজে। সারাশহর আজ আরামে ঘুমোবে। বৃষ্টির পরে।
শুতে যাওয়ার আগে শেফালি জিতেনের দেওয়া ক্যাসেট-প্লেয়ারে একটি রবীন্দ্রসংগীত শুনছিলেন। বৃষ্টি হয়ে ঠাণ্ডা হওয়াতে আজ গাঢ় ঘুম এসেছে বহুদিন পরে।
গানটি বাজছিল কানে, ঘুমঘোরে; ঘুরে ঘুরে—
আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি।তুমি অবসরমতো বাসিও।আমি নিশিদিন হেথায় বসে আছিতোমার যখন মনে পড়ে আসিও।
বুড়ি মাই-এর কোমরের ব্যথাটা বড়োই বেড়েছে।
পূর্ণিমা, যুবক-যুবতীদের-ই জন্যে।
বয়েস হয়ে গেলে, বাত-ব্যধিতে ধরলে, পূর্ণিমা এবং অমাবস্যাও বড়ো কষ্টের। পূর্ণিমা এল কি না তা দেখতে, চাঁদের দিকে তাকাতে হয় না, ব্যথা বাড়তে থাকলেই বুঝতে পারেন।
আজ আঁধি ও বৃষ্টি হওয়াতে মনোয়া-মিলনের ঘরে ঘরে সব মানুষ-ই স্বস্তিতে শুয়েছে। এই স্নিগ্ধ পরিবেশে স্বামী ও স্ত্রী দুজনে দুজনকে আদর করার পর স্ত্রীর কোমরে বা বুকে হাত রেখে আশ্লেষে ঘুমিয়ে পড়েছে স্বামী। প্রেমিক ঘুমের মধ্যে, প্রেমিকার কথা ভাবছে; প্রেমিকা, প্রেমিকের। কত জ্বালা, যন্ত্রণা কত খিদে, কত কাম, কত প্রেম, কত বিরহ বুকে নিয়ে এই পৃথিবী হেঁটে চলেছে কত হাজার শতাব্দী ধরে।
এই সবকিছুই জড়িয়ে আছে পৃথিবীকে কিন্তু এসব কিছুই নয় আসলে।
বুড়ি-মাই-এর মতো, পথের শেষে পৌঁছে মানুষের বুদ্ধি ও জ্ঞান’ যখন পরিণত হয়, তখন এই পৃথিবীকে মানুষ সম্পূর্ণ অন্য এক চোখে দেখতে শেখে। এর নিত্যরূপকে দেখতে শেখে, অনিত্যরূপের মোড়ক খুলে।
যখন পরপারে যাওয়ার সময় আসে, যেমন, বুড়ি-মাই-এর এসেছে; তখন এইসব কুয়াশার মধ্যে দিয়ে স্বচ্ছদৃষ্টি মেলে এইসব কিছুর-ই অসারতার স্বরূপ বোঝা যায়। উলঙ্গ হয়ে একদিন এসেছিলেন শিশুর রূপে আবার উলঙ্গ হয়েই যা-কিছু জীবনভর দু-হাতে জড়ো করেছিলেন, যা-কিছুকেই মানসিক প্রাপ্তি বলেও জেনেছিলেন, তার সব কিছুকেই ফেলে রেখে শুধু একটি নতুন চাঁদরে শরীর ঢেকে নিয়ে চলে যেতে হবে, তা জানেন। ‘রাম নাম সত হ্যায়’, রাম নাম সত হ্যায়’ বলতে বলতে শিষ আর তার বন্ধুরা মিলে তাকে চাট্টি নদীর শ্মশানে নিয়ে যাবে। তাঁর ছেলে হয়তো আসবে। হয়তো আসবে না। তাতে যাবে-আসবে না কিছুমাত্রই। সব দাবি ও বন্ধনের-ই পরপারে তিনি তখন। তখন-ই হবে আসল মিলন, তাঁর এবং সব মানুষের-ই প্রিয়তম প্রিয়র সঙ্গে। সম্পূর্ণর সঙ্গে ‘অংশ’ সেদিন একাত্ম হবে; পূর্ণর মধ্যে লীন হবে ‘খন্ড।
এই শিষ, ঝিঁঝি এবং আরও অগণ্য যুবক-যুবতী, প্রেমিকা-প্রেমিকারা এখনও জানে না আসলে ‘প্রেম’ কাকে বলে? ওরা নকলকেই ‘আসল’ বলে জানে। জীবিকা এবং জাগতিক নানা ক্রিয়াকলাপকেই, দৈনন্দিন মানবিক মানসিকতাকেই ‘জীবন’ বলে জানে। আসলকে চেনে না বলেই নকলকে আসল ভাবে!
তবু, এইসব জীবনেরই অঙ্গ। নিয়ম এমন-ই। সবকিছুরই নিজস্ব সময় আছে। তার আগে কোনো ঘটনা, কোনো জ্ঞান, কোনো জানাকেই ত্বরান্বিত করা যায় না। এইসব মধুর বিধুর খেলা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, যুগের পরে হঠাৎ নীল-ডোংরির নীলপাখিদের আসা এবং চলে-যাওয়াও, এই সমস্তই একটি বৃত্তকে সম্পূর্ণ করে। সেই বৃত্ত পরিক্রমা না করে বৃত্তান্তে পৌঁছোবার উপায় নেই কোনোই, কোনো মানুষের-ই। এই, মানুষের ভাগ্যলিপি।
ভারি মজা পান বুড়ি-মাই যুবক-যুবতীদের এই প্রেম-প্রেম খেলা দেখে। ওরা এখন ওসব কিছুই জানবে না। জানার কথাও নয়। কারণ, এই জীবনের বৃত্ত পরিক্রমার প্রক্রিয়াটাই এমন। যেটুকু জানার, তা নিজের নিজের জীবনের সুখ-দুঃখর ভেতর দিয়ে, প্রেম ও ঘৃণার মধ্যে দিয়ে; নিজের নিজের তীব্র অনুভূতির নানা অভিঘাতের জারক রসে জারিত করে নিয়ে তবেই কোনো স্থির এবং স্থায়ী জানাতে তাদের প্রত্যেককেই পৌঁছোতে হবে। যতক্ষণ-না সেইসময় আসে ততক্ষণ পরিক্রমা চলবে নিজের-ই নিয়মে। এই গন্তব্যের কোনো পাকদন্ডী পথ নেই যে, অন্যদের চেয়ে স্বল্পসময়ে কেউ কেউ গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছোবে, অন্যের আগে ‘বুড়ি ছোঁবে।
চৌশিঙা হরিণ-হরিণীর-ই মতো খেলছে তার পেয়ারের শিরীষ আর পেয়ারি ঝিঁঝি। অনেক ধূলো ওড়াবে ওদের খুরে খুরে, ঘুরে ঘুরে ওরা। অনেকবার অনেক লড়াই হবে, ভালোবাসার লড়াই, শিঙের সঙ্গে শিং ঠেকিয়ে। তারপর একসময়ে এক শুভক্ষণে সযত্নে চান করে, অতিসুন্দর করে সেজে, সুগন্ধি হয়ে, ঝিঁঝি, শিরীষের ঘরে, শিরীষের শোয়ার খাটের দিকে লঘুপায়ে, মৃদু আলো, আগরবাতির ও ফুলের গন্ধের মধ্যে এগিয়ে যাবে। যে-সাজ, বহুতনে করেছিল, বেশ-ভূষা, কাঁচুলি, বংশ-পরম্পরার অলংকার সব-ই একে একে খুলে ফেলে নিরাবরণ, নিরাভরণ হয়ে শিরীষের অঙ্কশায়িনী হবে।
নারীর সব সাজের-ই পরমগন্তব্য বোধ হয় নগ্নতা। মানুষের জীবনের সব কোলাহল, সব সুখ-দুঃখ, প্রেম-ঘৃণাও তেমন-ই প্রকৃত এবং পরমপ্রেমাস্পদের সঙ্গে একদিন, বিনিসুতোয় মিলিত হওয়ার-ই জন্যে। বুড়ি-মাই শেষমিলনের দিনের খুব-ই কাছাকাছি চলে এসেছেন বলেই এদের এই মিথ্যের মান-অভিমান খুনশুটি, ঝগড়া দেখে খুব-ই মজা পান উনি।
মনে মনে বলেন, বুড়ি-মাই; মঙ্গল হোক শিরীষের, মঙ্গল হোক ঝিঁঝির, ঝিঁঝির মায়ের, মঙ্গল হোক এই পৃথিবীর সকলের-ই। সুখী হোক প্রত্যেক মানুষ-মানুষী। নীলডোংরির নীলটোংড়ির নীল পাখিরা আবারও আসুক। আসুক, বারে বারে।
কালু হঠাৎ-ই চাপাস্বরে ‘ভুউক-ভুরু’ করেই ডেকে উঠল।
ডেকে উঠেই, দৌড়ে গেল।
এমন উজলা, দুধলি চাঁদের রাতে হাওয়া দিলে যখন গাছগাছালির ছায়াগুলো কাঁপতে থাকে এলোমেলো, তখন কালু বড়োই উদ্ৰান্ত, ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছায়াগুলো নিঃশব্দে ঝাঁপ-ঝাঁপ করে লাফিয়ে নামে উঠোনে আর কালু মনে করে, তার বুঝি বেড়াল বা ইঁদুর। দৌড়ে বেড়ায় এদিক থেকে ওদিকে। তার থাবা দু-টি দিয়ে ছায়াগুলি চেপে চেপে ধরার চেষ্টা করে। থাবা, কোনো কিছুকেই পায় না নাগালে। কোনো কিছুকেই ছিঁড়তে পারে না, কামড়াতে পারে না, গরিবের নিষ্ফল আক্রোশের-ই মতো। অথবা, অপরাগের, অক্ষমের ঈর্ষার-ই মতো। তাই আরও বেশি হতাশায় আর আক্রোশে কালু দাপিয়ে-বেড়ায় ঘর বারান্দা-উঠোন এমন রাতে।
চাঁদের রাত তাই ভারি অপছন্দ কালুর।
কালুর খুব ইচ্ছে করে যে, এমন-ই এক রাতে এই ছায়াগুলো সব ভরাট হয়ে উঠবে, সতত-আন্দোলিত হবে না, হবে না ফাঁকি; এবং সেদিন…
বুড়ি-মাই-এর ফোকলা-দাঁতে হাসি ফোটে নিঃশব্দে। সারারাত জেগেই থাকবেন উনি। কারণ, সারাদিন-ই পড়ে পড়ে ঘুমোন।
বুড়ি-মাই অস্ফুটে ডাকেন, কালুয়া। আঃ বেটা, আঃ। শো যা’!
কালুর ভাষা জানলে, বুড়ি-মাই কালুকে বোঝাতেন যে; মানুষের জীবনও ঠিক এমন-ই। চাঁদের রাতে নড়াচড়া-করা ছায়াদের থাবার নীচে চেপে ধরার জন্যে, তোর যে-আকুতি, প্রত্যেক মানুষেরও তাই; সে নারীর-ই হোক, কী পুরুষ! যেদিন তারা জানতে পারে যে, ওগুলো ছায়াই, অবয়বহীন, অলীক সেদিন ছায়ারা যদি প্রাণও পেত তবুও তাদের ধরার ইচ্ছে আর মানুষদের মতোই ও নিজেও করত না।
মানুষেরাও এমন-ই! কালুর-ই মতো। তারা জানে না, এই যা। জীবনের শেষে এসেই যা বোঝার, তা তারা বোঝে। বৃত্ত-পরিক্রমা শেষ করেই বৃত্তান্তে পৌঁছোয়। সেই পরিক্রমা শেষ হওয়ার আগে যা-কিছুই তারা পায়, তার কিছুই তারা চায় না। আর যা চায়; তা তো পায়-ই না।
জীবন এমন-ই! বাসনা, কামনা, স্বপ্ন এইসব-ই জীবনের সব। এইরকম করেই চাইতে চাইতে, দিতে দিতে, পেতে পেতে, হারাতে হারাতে, ছড়াতে ছড়াতে জীবনের পথে চলতে হয় সব মানুষকেই! এই পরিক্রমার নাম-ই ‘জীবন’। বৃত্ত-পরিক্রমা করে সে, যেদিন বৃত্তান্তে পৌঁছোয় সেদিন তার জানা সম্পূর্ণ হয়ে বটে কিন্তু যে-জীবনের জন্যে এত পিপাসা, সেই জীবনের প্রতি, তার কণামাত্রই দুর্বলতা থাকে না।
বুড়ি-মাই-এর এখন যেমন হয়েছে।
বড়ো আশ্চর্য হন এসব কথা ভাবলে। হাসেন বুড়ি-মাই। প্রেমময়, ক্ষমাময়, কিছুমাত্র চাওয়া-পাওয়ার, কোনোরকম সুখ-দুঃখের গর্ব এবং গ্লানিহীন এক পবিত্র-হাসি।
সেই বাদামি-কালো ল্যাজ-ঝোলানো রাত-পাখিটা ডেকে চলে পাহাড়তলির ফুটফুটে চাঁদের আলোর মধ্যের কালো কালো ছায়ার গাছগাছালি, ঝোঁপ-ঝাড়ের গভীর থেকে গম্ভীর স্বরে; ‘ঢাব-ঢাব-ঢাব-ঢাব-ঢাব-ঢাব’…
আর সেই অদ্ভুত পাখিটাও ডাকে, ওঁক-ওঁক-ওঁক-ওঁক-ওঁক করে সময়কে নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে ছিদ্রিত করে। রাত-পাখি।
ইয়ালো-ওয়াট্রেলড ল্যাপউইঙ্গ ডাকে, ডিড ঊ্য ডু ইট? ডিড ভ্য? ডিড-ঊ্য ডু ইট’?
এরা সব কালের প্রহরী। জীবন-মৃত্যু যেন, এদের ছোঁয় না। এরা সব সর্বজ্ঞ পাখি।
বিধাতার আশ্চর্য খেয়ালে, এরা সম্ভবত বৃত্ত-পরিক্রমা সম্পূর্ণ না করেই বৃত্তান্তে না পৌঁছেই; ‘বোধিলাভ’ করে বুদ্ধ হয়ে গেছে।
বুড়িমা ডাকেন নীচুস্বরে, আ বেটা, কালু, আ, শো যা।‘
কিন্তু কালু কথা না শুনে, অগণ্য মানুষের-ই মতো, ছায়া-ধরার খেলায় মেতে দাপিয়ে বেড়ায়, দাঁড়কাক’-এর বাসার আলো-ছায়ার রহস্যভরা, দুধলি, উজলা-রাতের বারান্দায়।
আমাদের এই আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবীর, এধার থেকে ওধারে।