৩. মাড়োয়ারি জাতটা
‘মাড়োয়ারি’ জাতটা যে, ব্যবসাবাণিজ্যে এতবড়ো হয়েছে তা শুধু মালিকদের জন্যেই নয়, প্রত্যেক কর্মচারীরও জন্যে। এমন পরিশ্রমী, কাজ-গত প্রাণ, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, নিয়মানুবর্তী কর্মচারী যে, হতে পারে তা এদের কাছ থেকে না জানলে জানতেও পেত না শিরীষ। কাজের কোনো সময় নেই। কোনোরকম অবহেলা নেই মালিকের কোনো কাজেই, তা অফিসিয়াল-ই হোক, কী ব্যক্তিগত; কোনো ‘না’ নেই। কাজ দিলে নিশ্চিন্ত থাকেন মালিক যে, সে-কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবেই।
অন্যমনস্ক ছিল বলে, পথের যে-মোড়ে ডানদিকে গেলে জগাদা-মাধাদাদের বাড়ি যাওয়া যেত সেখানে ঘুরতেই ভুলে গেল।
স্টেশনে পৌঁছোতে পৌঁছোতেই অন্ধকার হয়ে গেল। দু-তিনজন লোককে দেখল, বসে আছে স্টেশন-মাস্টারের ঘরের সিমেন্ট-বাঁধানো বারান্দাতে। কিন্তু ঝাণ্ডুয়াকে দেখতে পেল না। লোকগুলোর মুখ চেনা ওর। কালকে বোধ হয় এরাই এসেছিল ঝাণ্ডুয়ার সঙ্গে। সাইকেলটা রেখে ওদের দিকে এগোতেই ওদের-ই মধ্যে এক একজন এগিয়ে এসে বলল ঝাণ্ডুয়া আসছে এখুনি। তবে মামাবাবু আসতে পারবেন না। তাঁর পা ফুলে গেছে পড়ে গিয়ে। আজ সকাল থেকে ঝিঁঝি দিদিমণি দু-বার এসেছিল আপনার ডেরাতে–আপনি তো ছিলেন না। বাবু।
না। আমার কাজ ছিল। সকালেই বেরিয়ে গেছিলাম।
তারপর বলল, এসেছিলেন কেন? ঝিঁঝি দিদিমিণি?
আপনাকে টিশানে আসতে বলতে। চিঠিও লিখে এসেছেন, মাজি বললেন। আপনি। বাড়িতে যাননি?
নাঃ।
একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলল, শিরীষ।
মনে মনে বলল, স্টেশানে তো এসেইছি রে বাবা। তোমাদের কাছেও কি এক্সপ্ল্যানেশন দিতে হবে।
টিরেন চারঘণ্টা লেট হ্যায় বাবু।
চারঘণ্টা।
হাঁ। আভি তো মাস্টারবাবুকে পুছা।
ঝাণ্ডুয়া কাঁহা হ্যায়?
উত্তভি লওট গ্যয়া। আষায়গা টাইম পর।
তো ম্যায় হিয়া বৈঠকে কোন মচ্ছর মারেগা? হামভি ঘুম-ঘামকে আতা।
আচ্ছা বাবু।
এই মানুষগুলোর ‘আনুগত্য’ও মাড়োয়ারি কর্মচারীদের মতন-ই। এদেরও উন্নতি হবে।
সাইকেলটা টেনে নিয়ে একবার ভাবল, বাড়িতেই যায়। খিদেও পেয়েছে বেশ। কিন্তু বাড়িতে, মাঝে মাঝে, সন্ধের পরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। ‘দাঁড়কাকের বাসা। বড়ো শূন্য লাগে। মন খারাপ। পূর্ণিমা যতই এগোবে বুড়ি-মাই-এর বাতের ব্যথাটা ততই বাড়বে। সর্বক্ষণ একটা গোঙানি থাকে তার মুখে। কালুটা খচরখচর শব্দ করে গা চুলকোবে। শিরীষের সামনে বসে দু-থাবার ওপরে মাথাটা রেখে উজ্জ্বল দু-টি বুদ্ধিদীপ্ত কালো চোখ মেলে নীরবে কত কথাই যে, বলবে সে শিরীষের সঙ্গে। তারপর, হয়তো শিরীষের মনের কথা বুঝতে পেরেই জোর শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। নাকের সামনে থেকে ধুলো উড়ে যাবে কিছুটা। তারপর-ই আবার যেন, ভাগ্যের-ই হাতে নিজেকে সমর্পণ করে, দু-থাবার মধ্যে মাথা রেখে চেয়ে থাকবে তার দিকে। কে জানে! বুড়ি-মাই-এর মতো কালু কুকুরও ভাগ্যবিশ্বাসী কি না!
কালুটা না থাকলে যে কী হত? কেমন করে যে, থাকত, কাটত বর্ষার আর, গ্রীষ্মর আর বসন্তের দীর্ঘ সব একাকী রাত!
বাড়ি গেল না। লেভেল-ক্রসিং-এর মোড়ের চায়ের দোকানে গিয়ে চা আর সামোসা খেল। নস্যি ফুরিয়ে গেছিল, ছোটোকৌটোতে ভরে নিল পঞ্চাশ পয়সার নস্যি। তারপর…
এইসব সময়েই বড়ো পাগল পাগল লাগে। যখন কোথাও গিয়ে হঠাৎ-ই পড়ে-পাওয়া সময়ের একটা সুন্দর ফালি কারো কাছে দিয়ে আসতে ইচ্ছে করে এবং ঠিক তখন-ই যখন মনে পড়ে, যাওয়ার মতো একটা জায়গা নেই তার।
ঝিঁঝিদের বাড়িতে যেতে পারত কিন্তু যাবে না। কারণ, অভিমান।
বানোয়ারির (বানোয়ারিচাচা নয়, ওর খেলার বন্ধু) বাড়িতেও যেতে পারত। কিন্তু যাবে না। সন্ধের পরেই সেখানে মদের ঠেক বসে। মদ খেলে বানোয়ারি সূক্ষ্ম নয়, নানারকম উচ্চস্তরের আলোচনা তখন ওকে পেয়ে বসে–সেটা আনন্দের-ই–কিন্তু ওর কাছে যেসব ছেলেরা আসে তাদের অধিকাংশকেই পছন্দ হয় না শিরীষের। মদের আড্ডাতে গভীরতা প্রায়ই অচিরে আহত হয়। তারপর পালিয়ে যায়।
মগনলালের বাড়িতেও যেতে পারত। ওর বউটিকে বেশ লাগে শিরীষের। খুব সুন্দর কথা বলে। সুন্দর করে সাজে। হায়ার-সেকেণ্ডারি পাশ। লণ্ঠনের আলোতে তার উজ্জ্বল কালো চোখ দু-টি, স্নান-করে-ওঠা, সস্তা পাউডারের গন্ধমাখা শরীরের গন্ধ উলটোদিকের চেয়ারে বসে পেতে ভালো লাগে। মুন্নির সাহিত্যপ্রীতিও আছে। বাংলা গল্প-উপন্যাসও পড়ে। রবিবারে আনন্দবাজার রাখে আর সাপ্তাহিক বর্তমান। প্রায়-ই বিমল কর-এর গল্প করে ও। ওর মামাবাড়ি হাজারিবাগের সারিয়াতে– রোড স্টেশনে। ওখানে আগে আগে পুজোর সময়ে যেত। সাহিত্যিক বিমল করও সেখানে যেতেন পুজোর সময়ে–হয়তো। ওঁর বাড়িও ছিল সেখানে–জানে না শিরীষ। বিমল করের লেখার কথা উঠলেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। মুন্নি। আর ভালো লাগে ওর দিব্যেন্দু পালিতের লেখা। তিনিও নাকি ভাগলপুরের-ই মানুষ।
বিহারে তো পরশুরাম, সতীনাথ ভাদুড়ি, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, বনফুল, বিমল কর এবং দিব্যেন্দু পালিতও ছিলেন জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে। কেউ কেউ আজীবন। শিরীষ ভাবে, আজকের লিটল ম্যাগাজিনের কবি ‘মহুয়া-মিলন’-এর শিরীষ সেনও কি নামজাদা সাহিত্যিক হয়ে উঠবে একদিন? কে বলতে পারে! বুড়ি-মাই-এর কথাতে বলতে গেলে বলতে হয়, সবহি তকদিরহিকা খেল।
ভালো লাগা সত্ত্বেও যায় না, কারণ, মুন্নি তাকে একটু অন্য চোখে দেখে। অথচ মগন তার ছেলেবেলার বন্ধু।
মেয়েদের সম্বন্ধে শিরীষ বিশেষ কিছু জানে না। কাউকেই কাছ থেকে দেখেওনি। ওর তীব্র রোমান্টিসিজম ওকে কোনোরকম শারীরিক ব্যাপার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ভয় করে ওর। তা ছাড়া, মগনলালের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও করা হবে। মগন রোজ-ই ফেরে রাত করে, বাঘড়া মোড় থেকে। প্রতিসন্ধেতেই মুন্নি একাই থাকে। আসতেও বলে শিরীষকে আন্তরিকভাবেই। মুন্নির সঙ্গর জন্যে মাঝে মাঝে এক ধরনের অনাস্বাদিত শারীরিক কাঙালপনাও যে, বোধ করে না এমনও নয়। কিন্তু ওই যে, বিবেক! শেঠ চিরাঞ্জিলাল বলেন, বিবেক শালা, হারামজাদা আছে। সে শালা বেঁচে থাকলে বেওসা-কারবার সবহি চৌপাট। সেই বিবেকের জন্যেই শিরীষের যাওয়া হয় না মুনির কাছে। ও নিজের চারিত্রিক জোরটা কখনো পরীক্ষা করেও দেখেনি। যদি পরীক্ষাতে ফেল করে যায়? সেই ভয়। যদিও অনেক-ই মানুষের অধিকাংশ প্রাপ্তির পেছনেই হয়তো অন্যের প্রতি বঞ্চনা নিহিত থাকেই তবু, শিরীষ ভীতু বলে, ভালোমানুষ বলেই, তেমন করে মুন্নির দিকে হাত বাড়ায়নি। তাই ইচ্ছে করলেও কখনো-সখনো শরীরের অদৃশ্য কাঁকড়াগুলো কামড়ালেও, যাওয়া হয় না। মুন্নিকে শরীর-সর্বস্ব মেয়ে বলেও মনে হয়।
যেহেতু নারী-শরীর সম্বন্ধে ও সম্পূর্ণ অজ্ঞ, ও ভয়ও পায়।
যেতে পারে, জগাদা-মাধাদার কাছেও। কিন্তু গেলেই খাইয়ে দেন ওঁরা। ও গরিব বলেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়। যদি ওঁরা কখনো ভেবে বসেন, খাওয়ার লোভেই যায় শিরীষ?।
মদন, তার আর এক বন্ধু; বলে, যে, সে কয়লার ব্যবসা করে, ঠিক যে, কী করে, তা সে-ই জানে। বড়োকাকানার একটি বিহারি মেয়েকে বিয়ে করেছে। চারবছরের মধ্যে তিনটি ছেলে-মেয়ে। আজকের দিনেও। ভাবা যায় না। কিছুদিন হল, সে সন্ধের পরে সিদ্ধির গুলি খেয়ে পড়ে থাকে। শিরীষ গেলেই টাকা ধার চায়। দিয়েছেও কয়েকবার। বলা বাহুল্য; ফেরত পায়নি। কানাঘুসোতে শোনে, ওর বউটা নাকি রাতে বাজারের বাবু ডাকে। বেচারি! চালাবেই বা কী করে! কিন্তু ভিক্ষা দিয়ে সাহায্য করে তো কাউকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। যদি না সে, নিজে বাঁচতে চায়, বাঁচানো কাউকেই যায় না। মদনকে ঘেন্না করে শিরীষ, আর মদনের বউ মুঙ্গলিকে ভয় পায়।
অথচ মদনের মতো বন্ধু তার ছিল না একজনও। কষ্ট হয় তাই। কিন্তু জীবন এইরকম-ই। যতই সময় যায় ততই ঝড়ের মধ্যে পড়া নৌকার-ই মতো আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিতরা কে যে, কোন দিকে ভেসে যায়! কার জীবন, কার চরিত্র, কার রুচি, কার মানসিকতা, কার সাফল্য বা কার ব্যর্থতা যে, কেমন রূপ ধারণ করে তা আগে থেকে থেকে একটুও বলা যায় না। এবং সেইসব ব্যাপারের ওপরে অন্য কারোর-ই বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণও থাকে না। বন্ধুর কাছে মানুষে যায় আনন্দ করতে, দুটো মজার কথা বলতে, শুনতে, হাসতে, হাসাতে। সবসময়ই যদি দুঃখ, দুর্দশা, অর্থাভাব, হতাশা, অসুবিধের কথা শুনতে হয়, তখন আর সেখানে যেতেই ইচ্ছে করে না।
কার জীবনেই বা সুখ উথলানো-দুধের মতো উপচে পড়ছে?
একটিপ নস্যি নিয়ে সাইকেলে উঠে বসল শিরীষ। বসে, তার ‘দাঁড়কাকের বাসার কিছুটা আগেই যে-পথটা পাহাড়তলির দিকে চলে গেছে, গিয়ে, চাট্টি নদী থেকে বেরিয়ে-আসা বুড়হা-নালাটাকে কেটে চলে গেছে খিলড়ির দিকে, সেখানে নদীর মধ্যের বড়ো বড়ো কালো পাথরে গিয়ে বসে এই বাসন্তী রাতের শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ নেবে ভাবল ও। প্রকৃতির মধ্যে যা আনন্দ আর কোনো কিছু থেকেই পেতে পারে না একজন–বিশেষ করে আজকের দিনে। যতই দিন যাচ্ছে ততই এই সত্যটা ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ও যখন, গদ্য লিখবে তখন ওর এই বিশ্বাস, ওর এইসব বোধের কথা ও লিখবে।
দশ মিনিটেই পৌঁছে গেল। গিয়ে বসল, মধ্যের বড়ো পাথরটাতে। এখানে এমনই এক রাতে গতবছর ঝিঁঝিকে নিয়ে এসে বসেছিল। অনেকক্ষণ ছিল ওরা। চাঁদের মধ্যে এলেই ঝিঁঝি চন্দ্রাহত হয়ে যায়। এক ধরনের পাগলামি জাগে ওর ভেতরে।
‘চিরিপ-চিরিপ-চিরিপ-চিরিপ’ শব্দ করে একটা পাখি ডাকছে। এই পাখিটা ওর চেনা, ডাকও ওর চেনা কিন্তু নাম জানে না পাখির। এখানে এলে, এখানেই বসে শিরীষ। পিউ কাঁহা পাখি ডাকছে ‘পিউ-কাঁহা, পিউ-কাঁহা করে। কাঁহা? কাঁহা? কাঁহা’-রবের আর্তি মাথার মধ্যে হাতুড়ি পিটতে থাকে।
বুকের মধ্যে অভ্রখনি খুঁড়তে শুরু করে অদৃশ্য হাতে। এই স্তব্ধ, সুগন্ধি, দিগন্তব্যাপী প্রকৃতির মধ্যে এলেই শিরীষের কেবল-ই ঝিঁঝির কথা মনে হয়। আর কারো কথাই নয়।
এর মানে কী?
নিজেকে শুধোয় শিরীষ।
তারপর জবাবটার আভাস নিজের বুকের মধ্যে উঁকি মারামাত্রই ভয়ে একেবারে সিটিয়ে যায়। অপমানেও।
‘ডিড-ইউ-ডু-ইট, ডিড-ইউ-ডু-ইট’ করে হট্টিটি পাখি পাহাড়ের কোলে লম্বা লম্বা পা দুলিয়ে দুলিয়ে ভাসতে ভাসতে দূরে চলে যায়। আবারও কাউকে ওই প্রশ্ন করবে বলে। এই পাখিগুলো চিরদিন-ই বোধ হয় শুধু এই প্রশ্নই করে ফেরে। জবাব কি পায় কারো কাছ । থেকে? কে জানে!
কী করার কথা শুধোয় পাখিগুলো? কী করার? কে জানে তা!
পাখির ভাষা পাখিই জানে।
এইরকম বনজ্যোৎস্নাতে একা একা বসে থাকতে থাকতে, এক ধরনের আচ্ছন্নতা আসে। জগৎ-সংসার, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া ছাড়িয়ে মন এক অপার্থিব লোকে ভেসে যায়। ইচ্ছে করে, সারাজীবন এমন করেই বসে থাকে। নদীধারার কুলকুলানি, সুগন্ধি হাওয়ার থমকে থেকে আবার হঠাৎ চলা, রাতপাখির বিষণ্ণ উদাস ডাক মনকে বড়োই সংসারবিমুখ, পার্থিব সব বস্তুর প্রতি উদাসীন করে তোলে। অথচ দুঃখটা এই যে, একসময় ঘরে ফিরতেই হয়, ময়দা কী চিনির খবর করতে হয় বুড়ি-মাই-এর কাছ থেকে। কী খাবে, তার বরাত দিতে হয়। শেঠ চিরাঞ্জিলালের গদিতে যেতে হয়। নরাধমের সঙ্গে কথা বলতে হয়। এসব-ই করতে হয় শুধু পেটের-ই জন্যে। মানুষের পেট-ই মানুষকে তার মূলগন্তব্য থেকে বোধ হয় কেবল-ই সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে, পঙ্কজের সুগন্ধ থেকে পঙ্কের পচা গন্ধর মধ্যে। পেটের ক্ষুধার নিবৃত্তি হলেও পেট সুখী হয় না। তখন আরও চায়। পুঞ্জীভূত অর্থ, মান, প্রতিপত্তি এইসবের জন্যে তীব্র লোভ জাগে মনে। আর যেই জাগে; মন আর মন থাকে না; মানুষ আর মানুষ থাকে না।
এমন সময় শিরীষের খুব-ই ইচ্ছে করে যে, একটি বড়ো উপন্যাসে হাত দেয়। এই বনজ্যোৎস্নায় সিক্ত প্রকৃতির মতো আনন্দময় কোনো লেখাতে। মানুষের সব ক্ষুদ্রতা, ব্যর্থতা, কুটিলতা, আবিলতা ছাপিয়ে যা-শাশ্বত হয়ে থেকে যাবে চিরদিন। যেমন লেখা পড়ে মানুষ আনন্দ পাবে, লক্ষ লক্ষ পাঠক-পাঠিকাকে সেই লেখার মাধ্যমে, সে পরম-আপন করে তুলে নিজেকে তাদের প্রত্যেকের মধ্যে রেণু রেণু করে বিলিয়ে দিতে পারবে। বিলিয়ে দিয়ে, নিজের অন্তরে সে, পরমরিক্ত হয়ে যাবে। এই রিক্ততাও এক ধরনের পূর্ণতা’। সেই পূর্ণতাই শিরীষ সেনের একমাত্র প্রার্থিত ধন।
পারবে কি শিরীষ? গদ্য লিখতে? ও যে, কবি!
কিন্তু উপন্যাস কী করে যে, লিখতে হয় তা তো ও জানে না। কীভাবে শুরু করবে, কীভাবে ভাগ করবে অধ্যায়গুলি, কীভাবে, যা বলতে চায়, তা সঠিকভাবে বলবে? কীভাবে, প্রতিটি নিঃশব্দ শব্দকে বা’য় করে তুলে আলোকবর্তিকা করে, পাঠক-পাঠিকার হৃদয়মূল উদ্ভাসিত করবে তার প্রক্রিয়ার কিছুমাত্রই যে, তার জানা নেই!
এখানে বসেই শিরীষ ঠিক করল, আজ-ই রাত থেকে শুরু করবে সেই লেখাটি। একবার লেখার পর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পাতা বার বার করে পড়বে, বার বার করে কাটবে। আবার নতুন করে লিখবে। যতবার প্রয়োজন, ততবার। তারপর একসময়ে পুরো লেখাটাই, যা ছিল গোড়াতে; তা থেকে আলাদা হয়ে উঠবে। নিজের কাছেই নিজের লেখা যতক্ষণ না পাশ করছে, সেই প্রথম পরীক্ষাতে, তার লেখাকে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে, তার আসল পরীক্ষকদের কাছে পেশ-ই করবে না। গানের যেমন ‘পকড়’, লেখারও তেমন ‘পকড়’ নিশ্চয়ই আছে। লেখকজীবনের প্রথম লেখা ‘বন্দিশ’ই যদি পাঠক-পাঠিকার মনোমতো না হয় তবে সে, কেমন ‘তান-কর্তব’ করল, কেমন বিস্তার, কেমন রাগের বাহার ফুটোল পরে, তা জানার অপেক্ষা না করেই, তাঁরা তাকে বাতিল করে দেবেন।
লেখা বোধ হয় দু-রকমের হয়, শিরীষ ভাবে। একরকমঃ স্বগতোক্তি। আত্মচরিতের মতো। অন্যরকমঃ সংগম, মনের সংগম; পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে। সেই প্রত্যাশিত সংগমেই যেকোনো লেখার সার্থকতা; পরিপ্রুতি।
পারুক আর নাই পারুক, চেষ্টা করতে দোষ কী? তা ছাড়া লেখার মধ্যে শারীরিক কষ্ট যেমন আছে, যেমন আছে, নিজেকে অনেক-ই আনন্দ থেকে নিরন্তর বঞ্চনা করার দুঃখ, রাতের পর রাত জাগার কারণে স্নায়বিক দুর্বলতা, তেমন-ই এক গভীর আনন্দ নিশ্চয়ই আছে; যা, লেখকমাত্রই জানেন।
পাঠক-পাঠিকার শিরোপা বা মুঠো বোধ হয় আসে অনেক-ই পরে, তার অনেক আগেই লিখতে লিখতেই লেখক এক গভীর নিভৃত আনন্দে অবগাহন করেন। গায়ক যেমন করেন, আলাপ শুরু করার পরমুহূর্ত থেকেই। লেখা’ও এক ধরনের পুজো, নামাজ পড়া। ঈশ্বরের সঙ্গে, খোদার সঙ্গে তখন তার আলাপচারী। লেখক বা গায়ক যখন, লেখেন বা গান করেন তখন তাঁর অন্তরে জেগে থাকেন তাঁর নিভৃত প্রাণের দেবতা। যাঁর চরণেই সব সৃষ্টিশীলতার নৈবেদ্য-বর্ষণ।
পাঠক-পাঠিকারা যখন কোনো ঝকঝকে ছাপা, সুন্দর, বহুরঙা প্রচ্ছদের বই হাতে পেয়ে আনন্দে ঝলমল করে ওঠেন, তখন তাঁরা জানতেও পান না কত অশ্রুজল, কত ঘাম, কত বিনিদ্র রজনির তপস্যা সেই বইয়ের পাতায় পাতায় বিমূর্ত হয়ে থাকে। সেই বই পড়ে পাঠক-পাঠিকা যদি, সুখী হন বা দুঃখী হন, হাসেন বা কাঁদেন, শুধু তখন-ই লেখকের সব দুঃখ অমৃত হয়ে ওঠে। পাঠক-পাঠিকারাই লেখকের জীবনকাঠি-মরণকাঠি। তাঁরাই লেখককে রাজা করেন এবং হেঁটো-কাঁটা দিয়ে পুঁতে দেন বিস্মৃতি ও অবহেলার নাবাল জমিতে।
না, সত্যিই শুরু করবে আজ-ই একটা লেখা শিরীষ।
শিরীষের হাতঘড়ি নেই। টাইটান কোম্পানির অ্যাকুরা মডেলের রেডিয়াম দেওয়া একটি ঘড়ি কেনার স্বপ্ন দেখে রোজ-ই কিন্তু যে-মাইনে সে পায়, তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। বই কিনতেই চলে যায়, সামান্য উদবৃত্ত যদি কখনো-বা থাকে। তার উপন্যাস লেখার স্বপ্নের ই মতো, কবে যে, তার হাতঘড়ির স্বপ্ন সত্যি হবে, ঈশ্বর-ই জানেন।
সন্ধ্যাতারার দিকে চেয়ে তার অবস্থান জেনে আন্দাজ করার চেষ্টা করল ও, তখন ক-টা বাজতে পারে। ট্রেনের সময় হতে বেশি বাকি নেই আর। আর এক টিপ নস্যি নিয়ে উঠে পড়ল শিরীষ। তারপর পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলটাকে উঠিয়ে নিয়ে নদীর বালিতে কিছুটা হেঁটে গিয়ে পাকদন্ডী পথটিতে পড়েই উঠে পড়ল সাইকেলে। ও যখন ফাঁকা এবং নির্জন পথে সাইকেল চালিয়ে যায় নিধুবাবুর (রামনিধি গুপ্তের) একটি গান গায় গুনগুন করে। মা গাইতেন এই গানটি। কার কাছ থেকে শিখেছিলেন, তা অবশ্য জানে না ও। গানের কথাগুলি খুবই সুন্দর।
তবে প্রেমে কী সুখ হত
আমি যারে ভালবাসি, সে যদি ভালবাসিত
তবে প্রেমে কী সুখ হত।
কিংশুক শোভিত প্রাণে, কেতকী কণ্টক হীনে
ফুল ফুটিত চন্দনে, ইক্ষুতে ফল ফলিত
তবে প্রেমে কী সুখ হত
প্রেমে, তবে প্রেমে, কী সুখ হত।
প্রেম যমুনার জল, তা হলে হত শীতল
বিচ্ছেদ বাঢ়বানল তাহে যদি না থাকিত
তবে প্রেমে কী সুখ হততবে,
তবে প্রেমে, কী সুখ হত।
গানটা গাইতে গাইতে ওর দু-চোখের কোণ ভিজে ওঠে। যখন-ই গায়। আর কেবল-ই ঝিঁঝির মুখটা মনে পড়ে। বড়ো খারাপ লাগে।
সেদিন ঘণ্টেমামা বলেছিলেন, তুমি কি বাওয়া টিকটিকি? ঝিঁঝি ধরে খাওয়ার শখ হয়েচে বুজি?
ওই কথাটা মনে পড়ে গিয়ে হাসি পেল। এবং পরক্ষণেই কান্না। বাজে, বাজে, বাজে। ও একটা বাজে ছেলে। হতচ্ছাড়া।
স্টেশনের কাছে যখন পৌঁছোল, তখন ডিসট্যান্ট সিগন্যাল পড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি সাইকেল নিয়ে লাইনটা পেরোল। ডিজেল ইঞ্জিনগুলি পাগলা হাতির মতো নিঃশব্দে চলে আসে অতগুলি কামরাকে টেনে নিয়ে। দূরাগত ঝরনার আওয়াজের মতো একটা ঝরঝর শব্দ হয়। কিন্তু সেটাও ট্রেন একেবারে কাছে না এলে বোঝা পর্যন্ত যায় না। গতমাসে হামিদ বাবুর্চি কাটা পড়ে গেল এই কারণেই। এখানে তো প্ল্যাটফর্ম বলেও কিছু নেই। সমতল। ট্রেনে ওঠা বা ট্রেন থেকে নামা এক ঝকমারি।
ঝাণ্ডুরা দাঁড়িয়েছিল অন্যদের সঙ্গে।
শিরীষ বলল, মামাজি কাঁহা? যদিও শুনেছিল, ঝাণ্ডুর সঙ্গীর কাছে।
ঝাণ্ডু বলল, উনকি টেংরিমে চোট লাগা। চুন-হলুদ লাগাকর ঘরমে বইঠা হুয়া হ্যায়।
মনে মনে খুশি হল শিরীষ। বলল, ঠিক হয়েছে। নীলোৎপল দাসের পাবলিসিটি অফিসার।
ঝাণ্ডু বলল, ম্যায় কেইসে পহেচানেগা মেহমানলোগোঁকো?
শিরীষ বলল, এখানে নামবে ক-জন? যারা নামবে তারা সবাই আমাদের চেনা। যে, ক জন অচেনা তারাই আমাদের মেহেমান। তাদের-ই দায়, তারাই খুঁজে নেবে আমাদের। বেশি ভ্যাজর-ভ্যাজর কোরো না তো। আমার মাথা ধরেছে।
ঝাণ্ডু হেসে বলল, হাঁ! ইয়ে বাত তো ঠিকেই বোলা আপনে শিস বাবু।
আমি সবসময় ঠিক-ই বলি।
ঝাণ্ডু বলল, ওহি দেখিয়ে, আভিতক লাল দিখাতা হ্যায়।
কী?
যাঁহা হামিদ মিয়া কাট গ্যায়থে, খুন কা দাগ আভিভি হ্যায়।
আঃ। বাস করো। বাস করো। শিরীষ মুখ ঘোরাল অন্য দিকে।
শিরীষের মাথার মধ্যে পাগলা ঘণ্টি বেজে গেল। মনে হল, মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হতে লাগল মাথার মধ্যে। হামিদ যেদিন ট্রেনে কাটা পড়ে, ও সেদিন স্টেশনেই ছিল। শেঠ চিরাঞ্জিলালের সাডুভাইকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল। পুনমচাঁদজি, লাডসারিয়াজি, নরাধম এবং পুরো অ্যাকউন্টস ডিপার্টমেন্টের সকলেই এসেছিল শেঠ-এর আদেশে। এটাও তাদের সকলের অলিখিত ডিউটির মধ্যে পড়ে। মাড়োয়ারিদের গুণের মধ্যে সামাজিকতাও পড়ে। এমন ঘনসন্নিবিষ্ট, পরিব্যাপ্ত প্রজাতি ভারতে আর বেশি নেই। এমন ‘সংঘবদ্ধ’ও নয়। তাদের জাগতিক ব্যাপারে সাফল্যের সেটাও একটা মস্ত কারণ; যেমন, তার অভাব বাঙালিদের ব্যর্থতার।
কী রক্ত! কী রক্ত! রক্ত দেখতে পারে না শিরীষ। শিরীষকে অনেকেই এই কারণে মেয়েলিও বলেন। হবেও হয়তো। কিন্তু তাতে দোষের কিছু দেখতে পায় না ও। যারাই সংবেদনশীল, যারাই সূক্ষ্মরুচির, যারাই মমত্ববোধসম্পন্ন তাদের-ই স্কুল পুরুষেরা মেয়েলি বদনামে ভূষিত করে। করুক।
ভারি রাগ হল ঝাণ্ডুর ওপরে। দেখবার আর দেখাবার অন্য কোনো জিনিস পেল না। রাগটা বাড়তে-না-বাড়তে ট্রেনটা এসে গেল। ঝাণ্ডু হাত পাতল শিরীষের কাছে। দেখা হলেই এমন করে। নস্যির কৌটোটা থেকে একটু নস্যি দিল ঝাণ্ডুয়াকে। ঝাণ্ডুয়া পরম ভক্তিসহকারে সেই দান গ্রহণ করে, তার পুরো পুরু ঠোঁট দু-খানির নীচেরটা ফাঁক করে মাড়ি আর ঠোঁটের মধ্যে চালান করে দিল।
শিরীষ ভাবছিল, এত লোক এই প্ল্যাটফর্মহীন স্টেশনে কাটা পড়ে মরে, তা নীলোৎপলও কী পড়তে পারে না? রক্তোৎপল হয়ে যায় তাহলে। পরক্ষণেই নিজেকে ধমক দিল মনে মনে, নিজের ক্ষুদ্রতার কারণে। নিজেকে মনে মনে তৈরি করল, রিসেপশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে। ডায়লগ এবং মহড়াও দিল। আসুন আসুন কী সৌভাগ্য আমাদের। আমার নাম…। ঘণ্টেমামা পড়ে গিয়ে…’।
ট্রেনটা দাঁড়াল। ওরা সকলে ফাস্ট-ক্লাস কামরার সামনে দাঁড়িয়েছিল প্রায় পবননন্দনের মতো হাতজোড় করে রামজির রিসেপশনের জন্যে। কিন্তু ফাস্ট-ক্লাস থেকে কেউই নামলেন না। জনা দশেক মানুষ নামল কুল্লে। সেকেণ্ড ক্লাস থেকে। দু-জনের বগলে, সাদা, জবরদস্ত দু-টি মোরগা। একজনের হাতে দড়িবাঁধা কালো কুচকুচে বোঁটকা-গন্ধের পাঁঠা একটা। আর একজনের হাতে দুটো লাউ।
ওদের বিস্ময়ের ঘোর কাটতে-না-কাটতেই ডিজেল ইঞ্জিনটা হেঁপোরোগীর কাশির মতো একবার বমকে কেশেই ছেড়ে দিল।
এখন আর বাঁশি বাজায় না কোনো ট্রেন। স্বপ্নের মধ্যে বাজিয়ে শরতের রোদ আর কাশফুলের মধ্যে, বসন্তের শিমুল, অশোক আর পলাশের মধ্যে, বর্ষার চাপ চাপ স্নিগ্ধ-সবুজ সিক্ত তৃণভূমির মধ্যে ছুটে যায় না। ট্রেনগুলিও এখন নরাধমের মতো হয়ে গেছে। রোমান্টিসিজম বিদায় নিয়েছে এই স্কুল, ধমকে-দেওয়া, থমকে-থাকা পৃথিবী থেকে।
ঝাণ্ডুয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল শিরীষের মুখের দিকে।
বলল, অব ক্যা হোগা’?
ভাবে মনে হচ্ছে, যেন নীলোৎপলের সঙ্গে ঝাণ্ডুয়ার-ই বিয়ে হতে যাচ্ছিল। হাসি পেল শিরীষের। এতক্ষণ যে, তীব্র এক টেনশন জমে উঠেছিল ওর মধ্যে, নীলোৎপল দাস অ্যাণ্ড ‘পেঁপেদু’ কোম্পানির আগমন উপলক্ষে তা মুহূর্তে অন্তর্হিত হল। পূর্ণিমার আগের দুধলি চাঁদের আলোকে হঠাৎ আরও সুন্দর বলে মনে হতে লাগল। স্তবকে স্তবকে ফুটে-থাকা শালফুলের গন্ধ হঠাৎ ছুটে এল চৈতি হাওয়ায়। কাঁঠালের মুচির গন্ধ, আমের বোলের সুবাস, সবাই না-বলে বলল, শিরীষ। খুশি তো? খুশি তো? খুশি তো?
‘নীলোৎপল আসেনি তো কী হয়েছে?’ শিরীষ মনে মনে বলে উঠল।
এমন সময় লাইন্সম্যান ভরত পাঁড়ে এসে বলল, মাস্টারবাবু বোলাইন।
শব্দটা শিরীষের কানে শোনাল ‘বেলাইন।
নীলোৎপল বেলাইন?
কাহে লা?
ম্যায় ক্যা জানে?
চাল, ম্যায় আ রহা হ্যায়।
মাস্টারমশায় বললেন, বড়োকাকানার টিশন-মাস্টার ওয়্যারলেস-এ খবর পাঠিয়েছেন যে, মিস্টার এন দাস অ্যাণ্ড পার্টি আসতে পারেননি। পরের সপ্তাহে আসবেন। এইদিন-ই বিশেষ কাজ পড়ে যাওয়াতে দুঃখিত।
ঝাণ্ডুয়া বলল, ক্যা হুয়া বাবু?
ওরা সব সামনের বৃহস্পতিবারে এই গাড়িতেই আসবেন। বাড়ি গিয়ে বলে দিস। জরুরি কাজে আটকে গেছেন।
হামারা শালাকা শাদি হ্যায়। হাম তো ছুটি লে লুঙ্গা। যো ভি হো।
শিরীষ বলল, সেসব কথা পরে হবে।
ওরা লাইন পেরিয়ে, কিছুটা হেঁটে; পথে গিয়ে উঠল।
শিরীষ বলল, ম্যায় অব চলে।
ইতিনা ফেরাইড-রাইস আউর চিলিয়া-চিকেনওয়া কি ক্যা হোগা? সবহি তো বরবাদ হোগা। জাড়াকি টাইম তো নেহি না!
হলে হবে, তার আমি কী করব! আমার জন্যে যেন, কিছু আবার নিয়ে এসো-না ভালোবেসে। হামারা পেট গড়বড় হুয়া। কালুয়া কুত্তাকেই খিলানা পড়েগা। সমঝা-না। কান খোলকর শুন লো। আউর তুমহারা ঝিঁঝি দিদিকে যাকে কহ দো।
ঝিনঝি বাবাকো?
হাঁ। ঝিনঝি বাবাকো আউর ঝিনঝি বাবাকো মাইজিকো ভি। সমঝা-না?
হাঁ বাবু, সমঝা।
শিরীষ সাইকেলে উঠল। উঠেই মনে মনে বলল, তু কুছ নেহি সমঝা!
তারপর-ই বলল মনে মনেই, সেজে গুঁজে রইল রাই,এই লগনে বিয়া নাই।
তিন সেকেণ্ডের মধ্যেই শিরীষের সব খুশি উড়ে গেল। নিজের মানসিকতার কারণে নিজের কাছেই লজ্জিত হল। ঝিঁঝির জন্যে, এক গভীর দুঃখে ওর মন ভরে গেল। বেচারি ঝিঁঝি! এবং সেই মুহূর্তেই ও জীবনে প্রথমবার বুঝতে পারল যে, যদি কেউ কাউকে সত্যিই ভালোবাসে, তবে তার সব সুখ অথবা দুঃখ-ই নিজের-ই সুখ অথবা দুঃখ হয়ে ওঠে।
শিরীষ ঠিক করল, এই কথাটিই বলবে ওর উপন্যাসে। ও নিজেকে যতখানি ভালো করে চেনে তেমন করে তো আর কাউকেই চেনে না। এমনকী ঝিঁঝিকেও নয়। তাই নিজের সব আবরণ উন্মোচন করবে সেই উপন্যাসে ধীরে ধীরে, পরতের পর পরত, পেঁয়াজের খোসার মতো। নিজেও যা, কোনোদিন দেখেনি, সেই নিজের অভ্যন্তরের মোড়কে কী আছে, তা খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে একেবারে মর্মমূলে পৌঁছে দেখাবে পাঠক-পাঠিকাকে। তাদের সঙ্গে নিজেও দেখবে।
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না, ফুরাবে নাসেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।
সুনীতি বারে বারে বসার ঘরের ঘড়ি দেখছিলেন এবং একবার বসার ঘর এবং আরবার খাওয়ার ঘর করছিলেন। ঝিঁঝি তার নিজের ঘরেই ছিল।
আয়নার সমানে বসে, সন্ধের পরে মুখে একটু হালকা প্রসাধন করেছিল। ভালো করে গা ধুয়েছিল। সুনীতি সকালে স্নান করার আগে নিজের হাতে মেয়ের মুখে সর-ময়দা মাখিয়ে দিয়েছিলেন, ঝিঁঝির তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও। গলাতে একগাছি মটরমালা। দু-কানে দু-টি রুবির দুল। সাচ্ছল্যের দিনের প্রতীক। তার সঙ্গে ম্যাচ করে একটি কুসুম গাছের নতুন পাতার মতো লাল-রঙা তাঁতের শাড়ি পরেছিল। তাঁতির বোনা। কবে ঢাকা, টাঙাইল সব পূর্ব-পাকিস্তানে চলে গেছে, অধুনা বাংলাদেশ; তবু এখনও নামগুলো রয়ে গেছে ঘর ছেড়ে-আসা মানুষের স্মৃতিতে।
শাড়িটি পরতে পরতে, শিরীষের কথা মনে পড়েছিল ঝিঁঝির। কারণ, শিরীষ-ই তাকে কুসুমগাছ চিনিয়েছিল একদিন পাহাড়তলিতে নিয়ে গিয়ে। বলেছিল, চৈত্র-শেষে বৈশাখের প্রথমে যখন, নতুন পাতা আসে কুসুমগাছে, তখন আশ্চর্য এক, লালের ছোপ ধরে পাতাগুলিতে। পরে, ধীরে ধীরে রং সবুজ হয়ে আসে। যখন নতুন পাতা আসবে তখন দেখাবে বলেছিল ওকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে। মনেই পড়েনি ঝিঁঝির যে, চৈত্র শেষ হয়ে যাবে ক-দিন পরেই। তখনও দেখাতে পারেনি শিরীষ ঠিকই। কিন্তু একটা জংলি ফুল ছিঁড়ে দেখিয়েছিল রঙের রকমটা। তাই জানে, ঝিঁঝি।
সুনীতি বললেন, কী হল আপনার অতিথিদের? ঘণ্টেবাবু! নিজে তো পা মচকে পড়ে থাকলেন। এদিকে আজ যদি ওঁরা না আসেন, তবে আপনার ঘাড় মটকাব আমি। না আছে ফ্রিজ, না আছে কিছু; শীতের দিনও নয় যে, খাবার রেখে দিলে থাকবে। এতজনের খাবার। না এলে যে কী হবে! ভাবতেও আতঙ্ক লাগছে। ঘণ্টেবাবু বললেন, আরে, ওঁরা মান্যিগণ্যি মানুষ। ওঁদের কি সেন্স অফ রেসপনসিবিলিটি বলে কোনো ব্যাপার নেই? গতবুধবারে নীলোৎপলের কাকার সঙ্গে আমার নিজের কথা হয়েছে ট্রাঙ্ক-কলে।
কোথা থেকে?
ডালটনগঞ্জ থেকে।
এস. টি. ডি. বুঝি হয়নি এখনও?
না-হলেও আমাদের ম্যানুয়াল-ই ভালো। রাঁচিতে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে লাকরা বাবু আছেন। বললেই লাইন লেগে যায় ফটাফট। তবে এস. টি. ডি হবে শিগগিরি।
জানি না বাবা! আপনি যাই বলুন। আমার মন কিন্তু ভালো বলছে না।
ঘণ্টেবাবু, সুনীতির আপন ভাই তো নন-ই, কোনোরকম আত্মীয়ই নন। ঘণ্টেবাবুর বাবা সুনীতির বাবার কর্মচারী ছিলেন কলকাতায়। সুনীতির বাবার ওষুধের কারখানা ছিল। ছেলেবেলা থেকেই ঘণ্টেবাবুদের পুরো পরিবার-ই ওঁদের পরিবারের বশংবদ। উনি চারবারেও ইন্টারমিডিয়েট পাশ করতে না পেরে, ভাগ্যসন্ধানে বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে ঘুরতে বিহারের পালামৌ জেলার ডালটনগঞ্জে এসে, ওই বিড়ি কোম্পানিতে থিতু হন। ঝিঁঝির বাবা সুমনবাবু, হঠাৎ-ই এনকেফেলাইটিস-এ গত হওয়ার পরে, যখন কলকাতার পাট চুকিয়ে একদিন শখ করে বানানো, এবং ক্কচিৎ-ব্যবহৃত এই মনোয়া-মিলনের ‘শুটিং-লজ’ ‘মহুয়া’তে এসে সুনীতিকে আশ্রয় নিতে হয় তখন-ই ঘণ্টেবাবুর সঙ্গে যোগাযোগটা বাড়ে।
সুমন ব্যানার্জির একটু আধটু শিকারের শখ ছিল। শিকারি ছিলেন না প্রকৃতার্থে। বড়োলোকদের নানা শখ থাকে। সেইরকম-ই এক শখ ছিল তাঁর এই জঙ্গলময় জায়গাতে এসে, শীতে বা বসন্তে ক-দিন কাটিয়ে যাওয়ার। মানুষটি নির্জনতাও ভালোবাসতেন। জগা মুকুজ্যে এবং এই ঘণ্টেবাবুর মাধ্যমেই এখানে নির্জনে জঙ্গলের মধ্যে জমি দেখে অনেকখানি কম্পাউণ্ড নিয়ে একটি ভিলা বানান। আউট-হাউস। কেয়ারটেকারের কোয়ার্টার। সুমনবাবু আসতেন সপারিষদ। ক্রেট-ক্রেট হুইস্কি-জিন-রাম-ভদকা আসত সঙ্গে। বোড়া-ভরতি বিয়ার। বেয়ারা, বাবুর্চি, মোসাহেব।
মানুষের পায়ের তলা থেকে যখন, মাটি সরতে থাকে তখন কম মানুষই তা বোঝেন। বোঝা যায়, যখন পাড় ধসে নদীতে পড়ে। কিন্তু তখন বড়োই দেরি হয়ে যায়। সুমন ব্যানার্জির বেলাতেও তাই-ই ঘটেছিল। কর্মচারীদের মধ্যে আত্মীয় ও মোসাহেব-ই বেশি ছিল। তাঁরাই তাঁর অর্থনৈতিক ভিত-এর ভেতরটা ফোঁপরা করে দেন। মৃত্যুর পরে পথে বসতে হয় সুনীতিকে, ঝিঁঝিকে নিয়ে। অবস্থার সামান্য বৈকল্যও কষ্টে ফেলে সন্দেহ নেই কিন্তু সেই বৈকল্য যদি প্রচন্ড হয় তখন আর্থিক ধাক্কার চেয়েও যা, বেশি বিধ্বস্ত করে মানুষকে তা মানসিক’ ধাক্কা। বাঙালির মতো পরশ্রীকাতর’ জাত আর দু-টি নেই। একদিন যে, আত্মীয় বা বন্ধু অতিসচ্ছল ছিল, তার দৈন্যদশা দেখে বাঙালি যে, অসীম পুলকলাভ করে তা বাঙালিমাত্রই নিজের বুকে হাত ছোঁওয়ালেই অবশ্যই স্বীকার করবেন। যদি অবশ্য তিনি আপাদমস্তক ভন্ড না হন।
সুমন যখন আসতেন তখন, ঘণ্টে মিত্তিরও বিড়ি কোম্পানি থেকে ছুটি করে চলে আসতেন দু-তিনদিন আগেই। সব ঠিকঠাক করতে। এদিকে জঙ্গল ও জংলি জানোয়ার তখন অনেক-ই ছিল।
নির্জনতা যদিও সুনীতিরও প্রিয় কিন্তু হঠাৎ দক্ষিণ-কলকাতার অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পাড়া ছেড়ে এখানে নিতান্ত বাধ্য হয়েই চলে আসার পর কত রাত যে, তাঁর কেঁদে কেটেছে কিশোরী মেয়েকে বুকে জড়িয়ে, তা সুনীতিই জানেন। তবে এখন বোঝেন যে, আচমকা স্বামী-হারা হয়ে প্রচন্ড আর্থিক কষ্টের মধ্যে না পড়লে পৃথিবীও চেনা হত না তাঁর। সংসার ও সমাজ যে, নিছক-ই ‘কনভিনিয়েন্স’-এর তা সেদিন প্রচন্ড আঘাতের সঙ্গে বুঝেছিলেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনের মধ্যে অধিকাংশর-ই স্বরূপ দেখে সেদিন চমকে উঠেছিলেন।
তবে এই সংসারে ভালোমানুষও যে, নেই একথাও ঠিক নয়। কলকাতাতেও কিছু শুভানুধ্যায়ীও ছিলেন।
অনেক পরিচিত ধনবান আবার কাছে আসতে চেয়েছিলেন ‘এ’ হয়ে শুধুমাত্র তাঁর সুন্দর শরীরটার-ই লোভে। সুনীতি কোনো ব্যাপারেই গোঁড়া ছিলেন না কিন্তু দুর্দিনে যেসব পুরুষ অসহায় এক পরিচিত মহিলার শরীরের লোভেই মহত্ত্বর মুখোশ পরে কাছে আসতে চেয়েছিলেন তাঁদের তিনি চিনতে ভুল করেননি।
জীবনযাত্রার মান রাতারাতি নিরুপায়ভাবে নামিয়ে আনাটা কলকাতার চেয়ে এখানে অনেক-ই সহজ হবে বলেই এখানে চলে আসা। সামান্য সঞ্চয়ের সুদের ওপরে ভরসা করেই যখন বাকি জীবন বাঁচতে হবে বলে, স্থিরীকৃত হল তখন তাঁর অন্য কোনো উপায়-ই ছিল না।
রাঁচিতে, হস্টেলে রেখে, ঝিঁঝিকে বি.এ.-টা পাশ করিয়েছিলেন। স্কুল ফাইনাল প্রাইভেট হিসেবে দিয়েছিল। উনিই পড়িয়েছিলেন। চোখ-কান সব বন্ধ করে, অনেক অসুবিধের মধ্যে, ওই দুর্যোগের মধ্যে বন্যার মধ্যে বনহরিণীর মতো একটি বছর সাঁতরে এসেছেন। তবু, আত্মসম্মানবোধ কখনোই খোয়াননি উনি। যাঁরা, তা খুইয়েও বেঁচে থাকেন, তাঁরা তো নিজেদের আর মানুষ বলে দাবি করতে পারেন না। খোওয়াননি বলেই, ঘণ্টেবাবুর কথাতে, এই মেয়ে দেখতে আসার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়ে এই মুহূর্তে সাংঘাতিকরকম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত বোধ করছেন উনি।
এতদিন পরে কি আত্মসম্মানজ্ঞান এমনি করেই খোয়াতে হবে?
যদি তাঁরা না আসেন? যদি ছেলে, ছেলের কাকা, ছেলের পিসেমশাই মেয়েকে দেখে অপছন্দ করে চলে যান? সেও তো একরকমের ধর্ষণ-ই হবে বলতে গেলে। এবং সেই ধর্ষণের ফল শারীরিক ধর্ষণের চেয়েও ব্যাপ্ত, সুদূরপ্রসারী হতে পারে। কেন জানেন না, ওঁর মনটা আদৌ ভালো বলছে না।
সুমনের যেদিন মৃত্যুবাহী জ্বরটা এসেছিল, সেদিনও তাঁর মনটার মধ্যে ঠিক এইরকম-ই হয়েছিল। অথচ জ্বর তো সুমনের কতবারই হয়েছিল বিয়ের পরে!
খাবার ঘরে গিয়ে, কী মনে করে, তাড়াতাড়ি টেবল-ক্লথটা বদলালেন।
ঝিঁঝি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, কী হল মা?
এটা দিনের বেলায় পাতব কাল। রাতে, এই রংটাতে মন খারাপ হয়ে যায়।
ঝিঁঝি একদৃষ্টে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল। কথা বলল না কোনো।
এই দেশে যে, মেয়ে স্বাবলম্বী’ নয়, তার মা-বাবা যতই ভালো এবং বুঝি হন না কেন, তার বিয়ের ব্যাপারে বাবা-মায়ের উদবেগ, অর্থসংস্থানের চিন্তা-ভাবনাতে মেয়ে নিজে যে, কতখানি ক্লিষ্ট হয়, তা শুধু এই দেশের মেয়েরাই জানে! নিজেকে বড়োই অপরাধী বলে মনে হয়। বড়ো বোঝার মতো; অপারগ মা-বাবার অশক্ত কাঁধে।
এমন সময়ে ঘণ্টেমামার উত্তেজিত হুংকার শোনা গেল বসার ঘর থেকে। ই লোগ ক্যা আদমি হ্যায়? না, জানোয়ার?
কী হয়েছে?
বলে, সুনীতি তাড়াতাড়ি বসবার ঘরে এলেন খাওয়ার ঘর ছেড়ে।
ঝিঁঝি গেল না। খাওয়ার ঘরের পর্দার আড়ালেই দাঁড়িয়ে রইল। কে এসেছে, কে জানে।
সিঁড়িতে ঝাণ্ডুর পা-পোঁছার শব্দ পেল ঝিঁঝি। ঝাণ্ডুর পদতল ফুটি-ফাটা; কর্কশ। বাইরে থেকে এলেই সে, প্রথমে সিঁড়ির কোনাতে অমন করেই পা পুঁছে, তারপর-ই ভেতরে ঢোকে। পাপোশ কখনোই ব্যবহার করে না।
সুনীতি বললেন, ক্যা হুয়া! ঝাণ্ড?
নেহি আয়া। আগলা বিফেকো আয়েগা।
ঔর আনা নেহি হোগা।
প্রচন্ড বিরক্তির সঙ্গে বললেন সুনীতি।
বলেই, ঝাণ্ডুর কাছে একথা বলার কারণে লজ্জিত হলেন।
কত কষ্টে দু-দিনের মতো খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন। ঝিঁঝিও জানে না। বাজারের ফকরালাল ‘সোনা চাঁদিওয়ালার’ দোকানে তাঁর বিয়েতে-পাওয়া একগাছি চুড়ি বিক্রি করেছেন উনি পরশু। যা সামান্য গয়নাগাটি আছে তা সব-ই রাখা আছে জগা মুকুজ্যের-ই কাছে। এই জঙ্গলে, এমন জায়গাতে, দুই মহিলা এমনিতেই যথেষ্ট বিপদের মধ্যে বাস করেন।
মেয়েদের শরীররটাই তো নানারকম বিপদকে চুম্বকের-ই মতো আকর্ষণ করে। তার ওপরে আবার সোনাদানা!
ঘণ্টেবাবু প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে আবারও বকলেন, ই লোগ আদমি হ্যায় না জানোয়ার হ্যায়?
বলেই, প্রবল বেগে উঠে দাঁড়াতে গেলেন বেতের চেয়ার ছেড়ে এবং পরক্ষণেই প্রবলতর বেগে পড়ে গেলেন ‘উ উ উ উ উ করতে করতে।
অনেকেই মনে করেন যে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। আসলে দাঁড়াবার যে, এখনও দেরি আছে, তা তাঁরা আদৌ বুঝতে পারেন না। বুঝতে পারলেও, স্বীকার করতে চান না।
‘শিরীষবাবু গ্যয়াথা? স্টেশনমে?’ সুনীতি শুধোলেন।
এই প্রশ্ন, ভেতর থেকে শুনতে পেয়ে ঝিঁঝি বাইরের ঘরে এল।
পাঁচ মিনিট আগেই ও শেষবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। যদিও ওর গায়ের রং কালো, বাবার মতো রং পেয়েছে ও; কিন্তু ফিচার্স’ অসাধারণ সুন্দর। ও সেটা জানে। তা ছাড়া, ওর মুখে ‘বুদ্ধির’ যা প্রসাধন তা প্যারিসের ক্রিশ্চান-ডায়র বা লণ্ডনের ম্যাক্স-ফ্যাক্টর-এর প্রসাধনকেই ম্লান করে দেয়। ও সেটাও জানে।
শিরীষ একদিন বলেছিল, আমার ভীষণ ইচ্ছে করে, তোকে কুন্তী বলে ডাকি।
খুন্তি?
ঝিঁঝি বলেছিল, অবাক হয়ে। এবং রেগে গিয়েও।
কেন, খুন্তি কেন? আর তুই, শিরীষ সেন, তাহলে কি কড়াই?
উঃ কী আটারলি অশিক্ষিত বাঙালি তুই!
হতাশ ভঙ্গিতে হাট থেকে কেনা সস্তা লাল-সাদা ডোরাকাটা শার্ট-পরা দুটি হাত ওপরে তুলে শিরীষ বলেছিল।
কেন? অশিক্ষিত কেন? সত্যিই বলছি জানি না। কুন্তি বা খুন্তি কী ব্যাপার?
তুই ‘আরণ্যক’ পড়িসনি?
না। সেটা কী জিনিস? বৃহদারণ্যক না বৃহদারণ্য উপনিষদ-এর নাম শুনেছি মার কাছে, কিন্তু “আরণ্যক’টা কী জিনিস?
ছিঃ ছিঃ। আমাকে বললি, বললি, অন্য কোনো শিক্ষিত বাঙালিকে আবার এ-কথা বলতে যাস না। যে বাঙালি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ পড়েনি তাকে আর যা ই বলা যাক, শিক্ষিত বলা যায় না। সেই আরণ্যকেরই একটি চরিত্র রাজা দোবরু পান্না। গভীর জঙ্গলের গহনে বসবাসকারী এক আদিবাসী রাজা। আর কুন্তী হচ্ছে তাঁর-ই মেয়ে। রাজকুমারী। বিভূতিবাবু কুন্তীর যে-সৌন্দর্য এঁকেছেন, নিকষ কালো-পাথরে কোঁদা অনির্বচনীয় সুন্দরী অথচ সারল্যের প্রতিমূর্তি–সেই কুন্তী। তোকে আমার কুন্তী বলে মনে হয়। জানি না কেন?
ঝিঁঝি বলেছিল, থ্যাঙ্ক ইউ।
তারপরেই বলেছিল, বাঙালিরা প্রত্যেকেই নিজেকে উচ্চশিক্ষিত বলে মনে করে কিন্তু তুই বোধ হয় ঠিক-ই বলেছিস। যে, বাঙালিরা নিজের মাতৃভাষার সাহিত্য পড়ে না, নিজের সংস্কৃতির খোঁজ রাখে না কোনোই তাদের বোধ হয় শিক্ষিত বলা সত্যিই চলে না। বলা উচিত তো নয়-ই!শুধু বাংলাভাষাকে বুকের কোরকে রেখে, মাথায় স্থান দিয়ে রাখবে। পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা ডায়মণ্ডহারবার বা বহরমপুর বা বাঁকুড়ার উচ্চারণে ইংরিজি বলে মাড়োয়ারি-গুজরাতি-পাঞ্জাবি মালিকের তৈরি তেল-সাবান-গুড়-চা-পাট বিক্রি করবে। সেলসম্যানশিপ-ই হবে শিক্ষার চরম পরাকাষ্ঠা। সাহিত্য, সংগীত, দর্শন, ইতিহাস এসবের চর্চা উঠেই যাবে পুরোপুরি। ভালোই হয়েছে যে, আমরা আর পশ্চিমবঙ্গে থাকি না। তুই এনে দিবি ‘আরণ্যক’ আমাকে?
এনে দেব কী রে? আমার কাছেই আছে। কাল-ই তোকে দেব।
পড়েছিল ঝিঁঝি। পড়ে, অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। শিরীষ যে, তাকে কুন্তীর সঙ্গে তুলনা করে একথা জেনে মনে মনে খুব খুশিও হয়েছিল।
এত কথা ভাবার সময় এ নয়। অথচ আশ্চর্য মানুষের মন। ফিলম-এর ফ্ল্যাশব্যাকের-ই মতো কোনো-না-কোনো অতীতের স্মৃতি মুহূর্তের মধ্যে খুঁড়ে বের করে আনে এই মন যে, ভাবলেও অবাক হয়ে যেতে হয়।
শিসবাবু তো দো দফে, টিশান গ্যয়া থা।
ঝাণ্ডু বলল, সুনীতির প্রশ্নর উত্তরে।
দো দফে? কেন, দো দফে কেন?
পইলে মরতবে গ্যয়া থা টাইম পর। ঔর দুসরা মরতবে গ্যয়া আভি। টিশন মাস্টারকো পাস বাড়কাকানাসে খবর আয়া।
কী খবর?
যো, মেহমানলোগোঁনে আগলা বিফেকোরোজ আওবে করেগা।
সামনের বৃহস্পতিবার।
হতাশ হয়ে সুনীতি বসে পড়লেন একটি চেয়ারে।
পরক্ষণেই ঝিঁঝিকে শুধোলেন। কী করব? মিছিমিছি শিরীষ ছেলেটা দু-দুবার! ঝাণ্ডুকে দিয়ে বেশি করে খাবার পাঠিয়ে দিই ওকে। কী বলিস? যাতে দু-দিন খেতে পারে। আর ঝাণ্ডুর সঙ্গে যে-বেচারারা গেছিল, ওদের গ্রামের লোক, ওদেরও একটু খাইয়ে দিই।
ঝাণ্ড বাংলা বোঝে। কিন্তু বলতে পারে না।
সুনীতির কথা শুনে ও বলল, শিষবাবুকো পেট খারাব।
তোকে কে বলল?
বাবুনেই বোলা।
ঝিঁঝির কথাটা শোনামাত্রই সন্দেহ হল যে, খাবার যে যেতে পারে, তা শিরীষ আগে থাকতেই অনুমান করেই ঝাণ্ডকে বানিয়ে এই কথা বলে দিয়েছে।
সুনীতি যেন, ঝিঁঝির মনের কথা বুঝেই বললেন, খাবার এখন পাঠালে ছেলের অভিমান হতেই পারে। আমরা তো ওকে আজ রাতে খেতেও বলতে পারতাম! আপন বলতে তো জগাবাবু-মাধাবাবু আর ও-ই। আর কে খোঁজ রাখে আমাদের? এখন খাবার ফেলা যাবে বলে, যদি ওর জন্যে পাঠাই ও তো ভাবতে পারে কিছু। ও কি ভিখিরি! তবে এমন ভাবটা উচিত নয় ওর। ওর জানা উচিত…
ঝিঁঝি মায়ের মুখের কথা কেড়ে বলল–
‘আত্মসম্মান’ থাকাটা তো দোষের নয় মা। না-থাকাটাই বরং দোষের।
তুই চুপ কর তো!
হঠাৎ ঝিঁঝির ওপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলেন সুনীতি।
ঝিঁঝির মুখটা বেগুনি হয়ে গেল। ও জানে যে, সুনীতির যত অশান্তি, যত বিড়ম্বনা, যত খরচ তার সবের-ই মূলে ও-ই।
ঝিঁঝি উঠে বাইরে গেল, যেখানে ঝাণ্ডুর গ্রামের তিনজন লোক বাঁক হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর ছমছমে জ্যোৎস্নার মধ্যে দাঁড়িয়ে, মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে, নিজে স্বাবলম্বী নয় বলে; নিজেকে নীরবে অজস্র অভিশাপ দিতে লাগল। গেটের দু-পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছ দুটো, বাউণ্ডারির কাঁটাতারের বেড়া বরাবর বোগোনভিলিয়া লতা। হাতার বাইরের প্রাচীন মহুয়ারা এই চাঁদের রাতে ছোপ ছোপ অন্ধকারের ঝোঁপ গড়েছে, বড়ো ছোটো, তার আলোকিত মনের মধ্যের ছায়ার ঝোঁপের-ই মতো।
সুনীতি এবার ঝাঁঝটা স্থানান্তরিত করলেন ঘণ্টেবাবুর ওপরে। বললেন, চলুন, ঘণ্টেবাবু, আজ সব খাবার আপনাকেই খাওয়াব। যে-মানুষদের দায়িত্বজ্ঞানের বহর এরকম তাঁদের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে আদৌ দেওয়া উচিত হবে কি না তাও ভেবে দেখতে হয়।
সুনীতির ভাব দেখে ঘণ্টেবাবু আর রা’ কাড়লেন না। ‘উঁ উঁ উঁ উঁ’ শব্দটাই নীচুগ্রামে করে যেতে লাগলেন সমানে, সুনীতির মন অন্যত্র স্থানান্তরিত করার চেষ্টায়।
সুনীতি বাইরের দরজাতে দাঁড়িয়ে বললেন, ভেতরে আয় ঝিঁঝি। ঝাণুদের খেতে দিতে হবে। ঝাণ্ডুকে বললেন, তুমলোগ সব্বে আও ঝাণ্ডু। বাওয়ার্চিখানামে আও।
ঝাণ্ড, বাগানের মধ্যে দিয়ে পেছন দিক দিয়ে গিয়ে বাওয়ার্চিখানার দরজাতে দাঁড়িয়ে বলল, উলোগোঁনে জিন্দগিমে কভভি ফেরায়েড-রাইস নেহি না খায়া মাইজি। আপ যযাভি দিজিয়েগা, উলোগোঁনে, কহ রহা হ্যায় কি, ঘর লে কর যায়েগা। বিবি-বাচ্চোকা সাথ থোরা থোরা করকে বাঁটকে খায়েগা।
বাসন কোথায় যে, দেব?
সুনীতি বললেন।
হাঁড়ি-কড়াতে করেই দিয়ে দিন মাইজি। ওরাই কাল মেজে-টেজে দিয়ে যাবে ফেরত।
ওদের জন্যে খাবার বাড়তে বাড়তে সুনীতি বললেন, ঝিঁঝিকে উদ্দেশ করে, কিন্তু স্বগতোক্তির-ইমতো; সব দিয়ে-টিয়ে তো দিলাম। এখন যদি এসে হাজির হন তাঁরা, গাড়ি টাড়িতে করে? ঝাণ্ড, ধান শুনতে কান শুনল না তো রে!
নাঃ। শিরীষ যখন গেছিল এবং ফিরেও এল, ওঁরা যে, আসেননি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আগে জানলে, জগামামা-মামামাকেও আজ খেতে বলে দেওয়া যেত। শিরীষকেও। কতগুলো বাজে লোকের মধ্যে তোমার এত ও এত্তরকম কষ্ট। অর্থব্যয়। সব-ই তো আমার ই জন্যে। নিজের ওপরে ঘেন্নায় মরি!
সুনীতি ঝিঁঝির কাছে এসে, একটু আগেই বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন বলে, সম্ভবত অনুতপ্ত হয়ে মেয়ের গাল টিপে আদর করে দিয়ে বললেন, কেন? তোর এমন মনে হল কেন? তোর ভালো হলে তো আমার-ই ভালো। আমার স্বার্থ তো তোর স্বার্থর-ই সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তুই বড়ো ঘরে পড়বি। ভালো থাকবি, ভালো খাবি, গাড়ি চড়বি, বেড়াতে যাবি নানা জায়গায়, ব্যাপারটা ঘটলে, কত্ত সুখী হবি তুই! ছেলেবেলায় তো শখ-আহ্লাদ কম করিসনি, তোর বাবার কত্ত আদরের মেয়ে ছিলি তুই! সেসব দিনের কথা তো আমি ভুলিনি! তোর হয়তো সব কথা মনে নাও থাকতে পারে।
মায়ের অনাদরে যা ঘটেনি, এবারে তাই ঘটে গেল মায়ের আদরে, মুখের দুটো মিষ্টি কথাতেই।
এমনিতে খুব-ই চাপা-মেয়ে ঝিঁঝির দু-চোখের কোণ জলে ভরে এল।
ঘণ্টেমামা চেঁচিয়ে বললেন, বউদি! কাল যে-করেই হোক লাঠি হাতে করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমি জগাবাবুদের বাড়ি গিয়ে, কলকাতাতে একটা ফোন করব এবং ডালটনগঞ্জেও। ভুল হয়ে গেল বড়ো। কাল রাতে বা আজ সকালেও একটা ফোন করে জেনে নেওয়া উচিত ছিল। সব ই কপাল। ট্রেন থেকে নামতে-না-নামতেই তো পা-টার এমন হাল করলাম। শিরীষ বলেওছিল, একটা টর্চ নিয়ে যেতে। আমিই বাহাদুরি করতে গেলাম।
সুনীতি খাবার ঘর থেকেই গলা তুলে বললে, আসুন এবারে, সাবধানে। আস্তে আস্তে খাবার টেবলে চলে আসুন ঘন্টুবাবু। বড়ো টেনশান গেছে আমার আজ সারাদিন। সব পাট চুকিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ব। কালকে, আপনি যা মনে হয়, তাই করবেনখন। আমরা তো তাঁদেরই চিনিই না। তাই আমার অথবা ঝিঁঝির পক্ষে তো কথা বলা সম্ভব নয়। উচিত তো নয়ই।
তারপর-ই গলা নামিয়ে বললেন, বাহাদুরি তো উনি চিরটাকাল-ই করে এলেন। নেহাত ই অসহায় না হলে কি, আমার এইসব মানুষের শরণাপন্ন হতে হয়। যাইহোক, আজ ওঁকে ফাঁসির খাওয়া খাওয়াব।
ঝিঁঝি বলল, ওরকম করে বোলো না মা। উনি তো ভালো ভেবেই যা করার করতে গেছিলেন। যাঁদের আসার কথা ছিল তাঁরা তো ওঁর মালিকও বটেন। তাঁদের ওপরে যে, হম্বি তম্বি করবেন তারও কোনো উপায় নেই। একথা ঠিক যে, বাবার কাছে উনি অনেক-ই উপকৃত, ওরা পুরো পরিবার-ই উপকৃত, তবু তো মানুষটির মতো কৃতজ্ঞতাবোধ-ই বা ক জন দেখিয়েছেন বলো!”
বলেই, ঘরে গিয়ে ঘণ্টেবাবুর হাত ধরে ওঠাল ঝিঁঝি, চেয়ার থেকে, বলল, চলুন ঘণ্টেমামা। আজকে যাকে বলে ‘ফাঁসির খাওয়া’ তাই খাওয়াবে মা আপনাকে। একটু আগেই বলছিলেন।
আর বোলো না মা। ফাঁসির খাওয়া না খেয়ে নিজে আমগাছ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলে যেতে ইচ্ছে করছে আমার! তোমাদের জন্যে একটু কিছুও যদি করতে পারতাম তাহলে আমার মতো সুখী আর কেউই হত না। অন্য কোনো ভাবে তো কিছুই করতে পারি না। তাই ভেবেছিলাম…। তোমার বাবার কথা তো…।
ঝিঁঝি তাঁকে ধরে ধরে খাবার ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ফাঁসির খাওয়া কাকে বলে ঘণ্টেমামা?
ও, তাও জানো না? যার ওপরে ফাঁসির আদেশ হয়, তাকে ফাঁসির আগের দিন-ই সম্ভবত জেলে কতৃপক্ষ জিজ্ঞেস করেন যে, তার শেষ ইচ্ছে কী? তাকে সম্ভবত গান্ডেপিন্ডে খেতেও দেওয়া হয়। যদি নিজে সে কিছু খেতে চায়, তবে তো কোনো কথাই নেই। অনেক সময়েই ফাঁসির খাওয়াটা ফাঁসি যাওয়ার চেয়েও মারাত্মক হয়ে ওঠে বলে শুনেছি। বউদি, দেখি, সে বন্দোবস্তই করছেন। তবে যার আগামীকাল ফাঁসি হবে, সে মানুষ কি আদৌ কিছু খেতে পারে? জানতে ইচ্ছে করে খুব।
ওরা তিনজন খেতে বসলেন যখন, তখন সুনীতি বললেন, আপনি কাল যে, কোথাও হেঁটে যেতে পারবেন বলে তো আমার মনে হচ্ছে না। তার চেয়ে ঝিঁঝি, তুই একবার শিরীষের কাছে যাস। ওকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলিস কাজে যাওয়ার আগে। আমিই ওকে বুঝিয়ে বলব, যা বলার, তারপরে জগাবাবুর বাড়ি গিয়ে ওঁকে বলে কলকাতায় যদি ওঁকে দিয়েই একটা ফোন করাতে পারে! শিরীষ ছেলেমানুষ। ও বলার চেয়ে, জগাবাবু বললেই ব্যাপারটা ভালো দেখাবে।
ঘণ্টেমামা বললেন, এ যে দেখছি, ইংরিজিতে কী একটা কথা আছে না ‘ফ্রম দ্য ফ্রাইং প্যান টু দি আভেন’ তাই ঘটবে। জগাবাবু বললেনঃ ‘আপনাডা কেমন মানুট মডাই? খপরডা এটু আগে কি ডিটে পাট্টেন না? কোনোই টেনট অপ রেটপনটিবিলিটিই নেই ডেকচি। আপনাডেড টঙ্গে কোন ভটটায় মেয়েড বিয়ে ডেব বলটে পাডেন?’
সুনীতি হেসে উঠলেন ওই বিড়ম্বনার মধ্যেও।
ঝিঁঝিও হাসল।
ঘণ্টেবাবুর এই গুণটি আছে! যে-মানুষকে সাধারণত অন্যেরা নিতান্তই নির্গুণ বলেও জানেন তাঁর মধ্যেও অনেক-ই গুণ থাকে, যা বড়ো বড়ো গুণীর মধ্যেও থাকে না। নির্ভেজাল-গুণী অথবা নির্ভেজাল-নির্গুণ মানুষ সংসারে বড় একটা দেখা যায় না বোধ হয়। তা ছাড়া মোসাহেবি’, দোষ কী গুণ তা তর্কসাপেক্ষ হলেও মোসাহেবি করতেও যে, প্রচুর গুণপনার প্রয়োজন হয় সেটা সহজবোধ্য। ঘণ্টেবাবু সুমন ব্যানার্জির সুদিনে ভালো মোসাহেব ছিলেন বলেই, তাঁর মধ্যেও অনেক গুণ ছিল। মানুষ হিসেবে, যদিও মোসাহেবদের একটি বড়ো অংশের মধ্যেই ভেজাল থাকে কিন্তু উজ্জ্বল ব্যতিক্রমের মধ্যে ঘণ্টেবাবু পড়েন।
মানুষটি তিনি ভালোই।
পরিবেশটা লঘু করে দেওয়ার জন্যে ঝিঁঝি ও সুনীতি দু-জনেই স্বাভাবিক কারণেই খুশি হলেন। মনের মধ্যে জমে-ওঠা গুমোটটা কেটে গেল হঠাৎ-ই। সুনীতি ভাবলেন যা হবার তা হবে। বিয়ে কি এককথায় হয়? লাখ কথায় হয়। তা ছাড়া, তাঁরা এলেই যে, তাঁদের পছন্দ হত, ঝিঁঝিকে বা ঝিঁঝি এবং সুনীতির তাঁদের; তাই বা কে বলতে পারে।
ঈশ্বর যা করেন, মঙ্গলের জন্যেই করেন।
খাওয়া শেষ করে বাসন-পত্ৰ দু-জনে মিলে ধুতে ধুতে সুনীতি বললেন, শিরীষ ক-টার সময় কাজে বেরোয় রে?
শুনেছি সকাল নটায় গদিতে পোঁছোয়। তারপর দুপুরে একবার খেতে আসে বাড়িতে, তারপর ফিরে গিয়ে আবার ছটা অবধি থাকে। কোনো-কোনোদিন অনেক রাত অবধি থাকে। তবে কাল তো শুক্রবার। ওর ছুটি তো। গতকাল হাট ছিল। হাটের পরদিন ছুটি থাকে ওর।
তাহলে তো ভালোই হল। তুই একেবারে সকালেই এক কাপ চা খেয়ে চলে যাস, শিরীষের কাছে। তারপর ওকে ডেকে নিয়ে আসবি।
ডেকে এনে কী লাভ হবে? আমি কি বুঝিয়ে বলতে পারবনা ওকে? বরং জগামামাদের ওখান থেকে ফিরতি পথে আমাদের এখানে হয়ে যেতে বলব।
তাই ভালো। ওর জন্যে চিড়ের পোলাও করব। ছেলেটা খেতে ভালোবাসে।
তুমি কী করে জানলে? তোমাকে বলেছে?
মুখে কি সবাই সব কথা বলে? বুঝে নিতে হয়। একদিন খেয়েছিল, আমার হাতের চিঁড়ের পোলাও। ওর মুখ-চোখ দেখেই বুঝেছিলাম যে, খুব ভালোবেসে খেয়েছিল।
চুপ করে থাকল ঝিঁঝি। কী যেন, ভাবল একটুক্ষণ।
তারপর বলল, বলব ওকে। তবে ও কি আসতে পারবে? মানে, এলেও খাবে কি? সেদিন কী করে পেঁপে আর কাঁচকলা জোগাড় করে আনল! মাসের সব ছুটির দিন-ই ও রাঁচি যায় লাইব্রেরিতে আর বইয়ের দোকানেও। যা মাইনে পায় তার সব-ই তো চলে যায় বই আর ক্যাসেট কিনতে। হরিমটর চিবিয়েই থাকে বলতে গেলে।
ভালোই তো।
বলেই, উদাস হয়ে গেলেন সুনীতি। তারপর বললেন, তোর বাবাও প্রথম জীবনে এইরকম-ইছিলেন। বলতেন, আমার জীবনের লক্ষ্য “লো লিভিং হাই থিঙ্কিং”। প্রাচুর্যময় জীবনযাত্রার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই বরং এক ধরনের স্থূলতা আছে। মানুষের গর্ব হওয়া উচিত চিন্তার-ই সমারোহে, মানসিকতার এমন গভীরতা মানুষের মতো তো বিধাতা আর কোনো প্রাণীকেই দেননি!
অমন-ই ছিলেন প্রথম জীবনে। বিয়ের আগে যখন জানতাম ওঁকে। তারপর কী যে হল! জাগতিক সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষটা ভেসে গেলেন সাচ্ছল্যর বন্যাতে। অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। এমন হবেন জানলে ওঁকে আমি বিয়েই করতাম না। অর্থ, বিষধর সাপের-ই মতো। হয়তো, ক্ষমতা-প্রতিপত্তিও। কোনোদিন সে সাপুড়েকেই ছোবল মারবে, আগে থাকতে বোঝা যায় না।
কেন হলেন বাবা ওরকম?
কী করে বলব। শিকড় বোধ হয় যথেষ্ট শক্ত ছিল না। জীবনে ‘শিকড়’টাই হচ্ছে আসল, বুঝলি। জীবনের সবক্ষেত্রেই। শিকড় যাঁদের গভীরে না পৌঁছেছে তাঁদের পক্ষে মহীরুহ হয়ে ওঠা একেবারেই অসম্ভব। যাই করিস, যতটুকুই করিস; শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবি তোর নিজস্ব জমিতে। শিকড় নামিয়ে দিবি অনেক গভীরে। এই শিকড়ের ব্যাপারটা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের বেলাতেও সমানভাবে খাটে। যেসব সম্পর্কে শিকড় গভীরে গিয়ে পৌঁছোয়, শুধু সেইসব মানুষ-ই কোনো হঠাৎ-বানে কখনোই ভেসে যায় না। পাহাড়ি নদীর ওপরের কজওয়ের’-ই মতো সে স্বস্থানেই থাকে–উপর দিয়ে তখনকার মতো তাকে ডুবিয়ে দিয়ে, তার মাথার উপর দিয়ে আলোড়ন তুলে তোলপাড় করে, যতই বেগে জল বয়ে যাক-না কেন।
ঝিঁঝি, খেতে খেতে, কথা না বলে, সুনীতির মুখের দিকে তাকাল একবার।
সুনীতি বললেন, কথাটা জীবনভর-ই মনে রাখিস।
একটু অবাক হল ঝিঁঝি! ‘জ্ঞান দেওয়া যাকে বলে তা কখনোই দেননি ওর মা ওকে। নিজের জীবন দিয়েই, জীবনযাত্রার আত্মসম্মানের প্রকৃতি দিয়েই যা-শেখাবার তা শিখিয়েছেন, ওকে শিশুকাল থেকেই। শিখিয়েছেন উপদেশ দিয়ে নয়; উদাহরণ দিয়ে।
আজ কেন, হঠাৎ এমনভাবে কথা বলছেন সুনীতি তা ঝিঁঝি ঠিক বুঝল না।