Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বামনের দেশে || Shamsur Rahman

বামনের দেশে || Shamsur Rahman

মেঘম্লান চন্দ্রালোকে ক’জন বামন শুদ্ধাচারী
যাজকের জোব্বা গায়ে মহত্তম যুগের স্মরণে
জুটেছে রাস্তার মোড়ে। “দ্যাখো এই পৃথিবীকে দ্যাখো,
আমাদের কীর্তিমান অগ্রজেরা জোগালেন যাকে
স্মরণীয় দিনের মহিমা, যাকে নাটকের শেষ
দৃশ্যের বিক্ষুব্ধ নায়কের মতো শোকে ত্যাগ করে
কালান্তরে করলেন নিঃশব্দে প্রস্থান, তাকে নোঃরা
করেছে অজস্র জন্তু, পবিত্রতা বিগত সুদূর
শতাব্দীর মতো অনাত্মীয়। মোট কথা, ইতিমধ্যে
সযত্নে লালিত সেই পৃথিবীর কতটুকু আর
অবশিষ্ট ধ্যাননেত্রে? হাসি পায়, যখন সম্প্রতি
দেখি কনিষ্ঠেরা শুধু অবিশ্বাস্য ছলে সরাসরি
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে জীবনকে পরায় মুকুট।
অথচ জানে না তারা তাদেরও নিস্তার নেই সেই
ধ্বংসের প্রহার থেকে, হবে শবাগার জীবনের
সমস্ত বৈভব। সে বিপুল অর্থহীন অপচয়ে
তারাও নিশ্চিত লিপ্ত আজীবন। তারাই ইন্ধন”

বলে সেই বামনেরা বাজালো ভ্রান্তির ডুগডুগি।
দূর হ হতাশা,
যা তুই নচ্ছার! জীবনের ত্রিসীমায়
দেখাবিনে মুখ আর, যা তুই ফিরে যা!
মৃত্যুর গোলামি করগে যা, আমরাতো সর্বক্ষণ
জীবনের স্তবে আন্দোলিত,
মজ্জাগত উৎসবের উজ্জ্বল চিৎকার।
সময়ের স্বগতকথনে বার বার
কান পাতি, প্রাজ্ঞ পদাবলী, প্রতীকের উচ্চারণ, রূপাভাস,
গাঁথি মগজের কতো শাণিত ফলকে!

সাধারণ হলেও অন্তত
অতিশয় লঘুমতি যুবা নই, অলৌকিক মন্ত্রের মায়ায়
কবরের ধুলিকে বানাই
নক্ষত্রের ফেনা, যত পারি দূরে রাখি
অনুশোচনার মলময়
কীটের স্বৈরিতা! অমরত্ব কাকে বলে জানি না তা,
সে-জ্ঞানে উৎসাহ কম, বাছা-বাছা ভাষ্যকার তার
দিয়েছেন যে-ব্যাখ্যা তাতেও
কখনো ওঠেনি মন। পিতৃপুরুষেরা
ধারণার যে ক’বিঘে জমিতে লাঙল চষে কিছু
শাক-সবজি, সাধের আনাজ
তুলেছেন ঘরে, সেগুলো রোচেনি মুখে।

আমরা নতুন শব্দ ছুঁড়ে দিই সময়ের মুখে,
সেই শব্দে মুগ্ধ হয়ে কোনো স্থির সহজ সিদ্ধান্তে
না-এসেই আমরা অনেকবার সাগ্রহে হয়েছি পার কতো
স্বল্পজীবী নালিমার সাঁকো!

বলা যায় না করে অধিক বাক্যব্যয়
বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের সঙ্গে ক্রমাগত
বিখ্যাত বসন্ত শুধু করছে বিশ্বাসঘাতকতা।
ভুলেছে স্বধর্ম তার, আমাদের আকাঙ্ক্ষার ডালে
দেয় না ফুলের গুচ্ছ, পক্ষান্তরে চৈতন্যের আনাচে কানাচে
সর্বদা দিতেছে ছুঁড়ে তিরস্কার। নষ্ট বাগানের
ভ্রষ্ট কিছু পাখি।
কবরখানার গান গেয়ে-গেয়ে নিজেরাই ছায়া হয়ে যায়।
এ শহরে চতুর্দিকে ভিড়, চতুর্দিকে
বামনেরা জটলা পাকায়
এবং চাঁদের নখ উপড়ে আনবে ভেবে তারা
গুটিয়ে জোব্বার হাতা এলাহী রগড় করে শেষে
থুতু ছুঁড়ে দেয়
আকাশের মুখে।

মহামান্য বামনেরা সময়ের বিবাহ-বাসরে
অতিথির ভূমিকায় ক্লান্ত হয়ে কন্যাপক্ষ সাজেঃ
অনেক মোড়লি করে-গাঁয়ে না মানুক
তাতে কী বা এসে যায়
সভায় আনতে গিয়ে কনে
আলমারি থেকে টেনে আনে সম্পন্ন ফরাসে এক
প্রাচীন কংকাল!
তারপর বনেদি কেতায় হেসে ওঠে,
যেন তীব্র ফুর্তির প্রগল্‌ভ পিচকারি
ছুঁড়ে দিলো দুঃস্বপ্নের সংখ্যাহীন বিন্দু,
অন্দরে-বাহিরে
লণ্ডভণ্ড সব,
পণ্ড হলো বিবাহ-বাসর।

বাদ দাও শৃগালের বিখ্যাত ধূর্তামি,
মুখোশের বিচিত্র কল্পনা বাদ দাও।
তুমি কি মিথ্যার জালে পারবে ধরতে
অতর্কিতে উল্লিখিত সত্যের ঈগল
কোনোদিন? পারবে কি সময়ের ত্বক
ছিঁড়ে ফুঁড়ে জন্ম দিতে সোনালি আপেল-
মাংস যার জানবে না অবক্ষয়, শুধু
চৈতন্যের নিঃসংশয় প্রভাবে সে-ফল
চেনা পরিবেশে পাবে শিল্পের মহিমা!

পথে ছুটি দিশাহারা, ফতোবাবুদের
ভিড় দেখি ছত্রভঙ্গ। বিভ্রান্তি চৌদিকে
প্রত্যহ ছড়িয়ে পড়ে প্রবাদের মতো।
পিকাসের গার্নিকা ম্যূরাল মনে পড়ে-
ক্রুদ্ধ সেই ঘোড়াটার আর্তনাদ যেন
আমাদের কাল। আমরা ভয়ার্ত চোখে
ধূর্ত মর্ত্যজীবীদের করুণা কুড়াই
অহর্নিশ। অগোচরে স্বপ্নের ঘোড়াকে
ঝোঁটিয়ে বেড়াই, ভাবি তাকে তাড়ালেই
থাকা যাবে নিশ্চিন্তির সম্পন্ন কোটরে।

অথচ অবাক লাগে যখন স্বপ্নের গলিঘুঁজি
পেরিয়ে ব্রোজ্ঞের তপ্ত চত্বরে দাঁড়াই,
বাঁচবার চেষ্টা করি তীব্র বক্তব্যের
অন্তরঙ্গতায়,
সামনে তাকিয়ে দেখি পরিবর্তনের
টগবগ ঘোড়া
থমকে দাঁড়ায় নৈঃশব্দ্যের ক্ষণস্থায়ী প্রাঙ্গণের
এক কোণে, এবং মাথায় তার স্বপ্নের কিরীট
সম্মোহনে একান্ত নির্ভর।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে মুহূর্তে লাফিয়ে পড়ে সুতীক্ষ্ণ বাতাসে
এবং তখন
ক্ষুধার্ত চোয়ালে তার বাস্তবের খড়কুটো নড়ে!

যেদিকে তাকাই
নিশ্চয়তা কিছু নেই। দুর্যোগের দিনে
মাদুলি তাবিজ তুকতাক নিয়ে মেতে আছে যারা,
সর্বক্ষণ যারা
পশুদের দাসত্বে বিলীন,
যাদের আত্মায় শুধু পশুদের বিষ্ঠা স্তূপীকৃত-
ভদ্রমহোদয়গণ, তাদের নিষ্ঠায়
তিলমাত্র করি না সন্দেহ,
অথচ নিশ্চিত তারা লোকালয় ছেড়ে
কবরখানায় খোঁজে স্বেচ্ছা নির্বাসন
বস্তুত নিজেরই অগোচরে।

চতুর্দিকে যে বিচিত্র চিত্রশালা দেখি রাত্রিদিন
তাতে সবি ব্যঙ্গচিত্র। চোখ জুড়ে আছে কিমাকার
জীবনমথিত দৃশ্যঃ বিশিষ্ট প্রতিভাবানদের
আত্মার সদগতি করে সম্মিলিত শৃগাল ভালুক
ফিরে আসে ময়লা গুহায়। নির্বোধেরা সারাক্ষণ
গড়ছে এমন সিঁড়ি যা-দেখে শিউরে ওঠে দূরে
ভূশণ্ডীর কাক। দুঃস্বপ্নের জোড়াতালি দিয়ে-দিয়ে
লিখেছে প্রাচীরপত্র সর্বনাশ বড় জাঁক করে।
পৃথিবীর সব কিছু ধোপানীর গালগল্প ভেবে
পথে বসে হতবুদ্ধি হয়ে যাই বামনের দেশে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *