বাদলের মন খারাপ
টিফিনের ঘন্টা বেজে যাওয়ার পর, বাবলু বলল, স্কুল ছুটির পর বাদল তোকে নিয়ে আমি এক জায়গায় যাব, ছুটির পর মাঠের পাশে ওই বকুল গাছটার নীচে তুই দাঁড়াস আমার জন্য।
বাদল বলল, আচ্ছা।
তারপর যে যার ক্লাসে চলে গেল। বাবলু ক্লাস সেভেনে পড়ে। বাদল পড়ে ক্লাস সিক্সে। দু’জনেরই বাড়ি একই পাড়ায় পাশাপাশি। বাবলুর বাবার একটি মুদি দোকান আছে। বাদলের বাবা কাঠের মিস্ত্রি।
পলাশপুর হাই স্কুল অনেক দিনের পুরনো নয়। নতুন হয়েছে। তাই ছাত্রের সংখ্যা বেশি নয়। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো হয়। এই স্কুলটি মাধ্যমিক করার চেষ্টা চলছে। মাধ্যমিক হলে তখন স্কুলটি পাকা করা হবে। এখন মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা পাঁচটি পাশাপাশি লাগোয়া ঘর। উপরে টালি। একটি ঘর মাষ্টারদের জন্য বরাদ্দ, বাকি চারটে ঘরে চারটি ক্লাসের ছাত্ররা বসে। হেডমাষ্টারকে নিয়ে স্কুলে মোট চারজন শিক্ষক আছেন।
স্কুলের পাশে একটা বড় মাঠ। তারপরেই শুরু হয়েছে গভীর বন। কত রকমের গাছ-পালা যে সেখানে আছে তার কোনও হিসেব নেই। হত্তুকী, কুল, শিমূল, বনপাট, বাবলা, শিরীষ প্রভৃতি। গাছ-পালার ডাল সরিয়ে বনের ভিতর ঢুকতে হয়। বনের ভিতরে নাকি একটি ডাকতে কালী মন্দির আছে। সেখানে গেলে কল্পতরু গাছের চারা পাওয়া যাবে।
- কি হবে কল্পতরু গাছ দিয়ে?
বাবলু তাকে ধমকে উঠল, হাঁদারাম, তাও জানিষ না? - না তো।
- কল্পতরু গাছের কাছে, যা চাইবি, তাই পাবি।
- সত্যি?
- তবে না তো কি?
- হীরা, মুক্তা পাওয়া যাবে?
- যাবে না কেন?
- পরশ পাথর?
- চাইলে, তাও পাওয়া যাবে।
বাদল ভাবে, কি মজা হবে তাহলে। তারা ধনী হয়ে যাবে। বাবাকে আর কাঠ-মিস্ত্রির কাজ করতে হবে না।
বাবলু তাকে এসব কথা বলে, স্কুল ছুটির পর তাকে নিয়ে চলল, বনের ভিতরে। অনেক গাছপালার ডালপালা সরিয়ে বনের ভিতরে তারা অনেকটা ঢুকে গেলে। কিন্তু তারা কোনও কালী মন্দিরের দেখা পেল না। এদিকে বিকেল ফুরিয়ে গিয়ে, দ্রুত সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে। এবার তাদের বাড়ি ফেরা উচিৎ। কিন্তু গভীর বনের ভিতরে তারা, বাড়ি ফেরার পথ হারিয়ে ফেলল। যত হাঁটে, তত বন আরও গভীর হয়। এদিকে সূর্য্য ডুবে বনের ভিতর অন্ধকার হয়ে আসছে। পাখি পাখালিরা যেন গাছের উপরে গানের কনসার্ট বসিয়েছে। এমন সময় পাখিদের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতেই বাদল দেখল, একজন কেউ অনেক দূর থেকে তাদের লক্ষ্য করছে। বেঁটে গোলাকার আকৃতির একটি বিদকুটে প্রাণী। বাবলু সেদিকে না তাকিয়ে বনের ভিতর কল্পতরু বৃক্ষের চারা খুঁজে ফিরছে। তারপর মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে একটা গাছের চারা তুলে নিয়ে বাবলু বলল, বাদল একটা কল্পতরু চারা পাওয়া গেছে। আর একটা পেলেই তোকে দেব।
বাদল তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে সেই অদ্ভূত কিমাকার দেখতে প্রাণীটির দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
বাদল তার কথার কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে, বাদলের দিকে তাকিয়ে, তার দৃষ্টি অনুসরণ করে যা দেখল, তা দেখে বাবলু আতকে উঠে, ভূ – – উ – – উ – – ত – – , ভূ – – উ – – উ – – ত – – বলে চিৎকার করে উঠে, চারা গাছটা মুঠোয় শক্ত করে ধরে গাছ-পালার ডাল সরিয়ে বন-বাদারের ভিতর দিয়ে সে সামনের দিকে ছুটে পালাতে লাগল। বাদলেরও ছুটে পালিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু সে পালাতে পারল না। নড়তে পারল না এক চুলও। পাথরের স্ট্যাচুর মতো সেখানেই সে দাঁড়িয়ে রইল। দেখল, বাবলু পালিয়ে যাবার পর, প্রাণীটি এবার গুটিগুটি পা ফেলে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। বাদল মুহুর্ত-কয়েক ভাবল, এবার কি তার দৌড়ে পালানো উচিৎ নয়? মন বলল, না দেখা যাক শেষপর্যন্ত কি হয়। সে দাঁড়িয়ে রইল। প্রাণীটি কাছে এলে দেখা গেল, একটি রোবট। রোবটটি তার কাছে এসে বলল, কেমন আছেন মিষ্টার বাদল?
প্রাণীটির মুখে তার নাম শুনে, বাদল ঘাবড়ে যায়।
- আপনি কি আমায় চেনেন?
- চিনব না কেন? আপনি কাঠমিস্ত্রি গগনবাবুর ছেলে।
শুনে বাবদ আরও আশ্চর্য হয়ে বলে, আপনি বাবাকেও চেনেন? - হ্যাঁ, চিনি।
বাদল ভাবল, কি করে চেনে?
বাদল এবার তাকে প্রশ্ন করল, আপনি কে? - আমি এলিয়ান।
- থাকেন কোথায়?
- মঙ্গল গ্রহে।
- সেকি? এখানে এসেছেন কেন?
- পলাশপুর ঘুরে দেখতে।
- এলেন কিভাবে?
- স্পেস রকেটে চেপে।
- মঙ্গলের প্রাণীরা কি বাংলায় কথা বলে?
- না।
- আপনি তাহলে বলছেন কি করে?
- রোবটটি এবার তার ঠোঁটের কাছে একটা ছোট বোতাম দেখিয়ে বলল, এটা দিয়ে। এটা অন করলে সব ভাষা শোনা যায়, বোঝা যায়। আর তা শুনে, বুঝে সেই ভাষায় যথাযথ উত্তর দেওয়া যায়।
শুনে বাদলের বিস্ময়ের অন্ত রইল না। - আপনি আমাদের চিনলেন কি করে?
- খুব সহজে। কপালের কাছে কোটের বোতামের মত একটা বড় বোতাম দেখিয়ে বললেন। আমাদের মাথার ভিতর, এই ছোট যন্ত্রটা সবার নাম বলে দেয়। তারা কে কি কাজ কর্ম করে তাও জানিয়ে দেয়।
- আশ্চর্য তো। বাদল ভাবল।
সে রোবটটিকে বলল, মিষ্টার এলিয়ান, আপনি কি অনুগ্রহ করে আমাদের বাড়িতে একবার যাবেন?
- কেন বলুন তো।?
- আমার বাবা মা আপনাকে দেখে খুব খুশি হবে বলে।
- বেশ, চলুন তবে আপনার মা বাবার সঙ্গে দেখা করে আসি।।
বাদল তাকে নিয়ে বনের ভিতর দিয়ে অন্ধকার পোরিয়ে হেঁটে আসতে আসতে অনুভব করল, অন্ধকার আর তেমন চোখে লাগছে না। সবই দেখা যাচ্ছে, তবে কিছুটা অস্পষ্ট। সামনে কেউ দু’হাত তুলে গৌরাঙ্গের মতোন দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, দু’দিকে হাতের মতো ডাল ছড়ানো সেটা একটা বড় শিরীষ গাছ। কখনও মনে হচ্ছে বুঝি গান্ধিজী লাঠি হাতে লবণ আন্দোলনে যাচ্ছেন। কাছে গেলে সেটাও দেখা গেল একটা হত্তুকী গাছ। বুদ্ধদেব যেন ধ্যানমগ্নভাবে বসে আছেন, তাও কাছে গিয়ে দেখা গেলে একটা ঝুপসি কুলগাছ। এইভাবে বনের অনেক গাছ পেরিয়ে এলিয়ানকে নিয়ে বাদল বন থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। শেষে তাকে নিয়ে চলল, তাদের নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মা বাবাকে মঙ্গল গ্রহের প্রাণী এলিয়ানকে দেখাবে বলে।
বন পেরিয়ে বাইরে এসে এলিয়ান বলল, এভাবে আপনার সঙ্গে আমাকে কেউ যেতে দেখলে, তাদের কৌতূহলের সীমা থাকবে না। তাই আমি অদৃশ্য হয়ে আপনার সঙ্গে সঙ্গে যাব। যাতে কেউ আমাকে দেখতে না পায়। তাহলে আর কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।
বাদল বলল, ঠিক আছে, তবে তাই করুন।
মহূর্তের মধ্যেই এলিয়ান অদৃশ্য হয়ে গেল। সেইভাব বাদলের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের বিশাল মাঠ পেরিয়ে এসে, বাদলদের বাড়ির দিকে চলতে লাগল।
বাড়ির সামনে আসতেই বাবা তাকে দেখতে পেয়ে বলল, স্কুল ছুটির পর কোথায় গেছিলি বাপ, এত দেরি করলি কেন বাড়ি ফিরতে?
বাবার কথাবার্তার ধরণই এমন। বাদল বলল, এক বন্ধুকে বাড়িতে নিয়ে আসব বলে, তার সাথে দেখা করতে গেছিলাম।
- সে আসেনি?
- হ্যাঁ এসেছে।
- কোথায়?
- এই তো বলে। এলিয়ান দৃশ্যমান হলেন।
বাবা তাকে দেখে বলল, এ তো দেখতে লাগে একটা যন্ত্র । এ তোর বন্ধু হয়? - হ্যাঁ বাবা, এর নাম এলিয়ান। থাকে মঙ্গল গ্রহে।
- অন্য গ্রহের ছাওয়াল?
- হুম।
- তোর বন্ধু হল কি করে?
- একজনের সঙ্গে যেভাবে আর একজনের বন্ধুত্ব হয়, সেইভাবে।
- ওহ্ আচ্ছা। ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসা। ওকে কিছু খেতে দিতে বল তোর মাকে।
- আমরা কিছু খাই না আঙ্কেল।
- তবে বেঁচে থাক কি করে?
- দিনের বেলা দু’তিন আউন্স সূর্যের রস্মি গিলে নিলেই দিব্যি সারাদিন বেঁচে থাকা যায়।
- তাই নাকি?
-হ্যাঁ। - আমাদের এখানে এ ব্যবস্থা থাকলে তো বেশ ভালই হত। যা খাদ্যের অভাব এখানে।
- আপনারাও চেষ্টা করলে পারবেন, তবে অভ্যাস করতে হবে।
- কিভাবে?
- সে আপনাদের আমি শিখিয়ে দেব কাল সকালে।
- বেশ।
মার ডাকে, সকালবেলা যখন বাদলের ঘুম ভাঙল, তখন সে দেখল কোথায় এলিয়ান? হতাশ হয়ে ভাবল, এতক্ষণ তাহলে সে একটা মিথ্যে স্বপ্ন দেখছিল? বাদলের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।