Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সুবোধবাবু এ বাড়িতে পা দিয়েই

সুবোধবাবু এ বাড়িতে পা দিয়েই খেয়াল করেছেন, এককালে এ বাড়ির সিঁড়ি ও মেঝে ইটালিয়ান মার্বেল দিয়ে মোড়া ছিল। এখনও যে নেই, তা নয়। মেঝের সর্বত্র না হলেও অনেক জায়গাতেই আছে কিন্তু সিঁড়িতে প্রায় নেই বললেই চলে। তাদের শূন্যস্থান পূর্ণ হয়েছে সিমেন্ট-বালি দিয়ে। গরমের দিনে মুখে পাউডার মাখার মত কোন কোন জায়গায় ঐ সিমেন্ট-বালির উপর একটু সাদাঁ সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। গ্রাম্য যাত্রার দলে পুরুষ নর্তকী যেমন বেমানান, তেমনই বীভৎস?

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই সুবোধবাবু প্রশ্ন করেন, আচ্ছা মহেন্দ্রবাবু, এ বাড়ি কতদিনের হল?

তা একশ বছরের উপর হল। মহেন্দ্রবাবু পাশ ফিরে ওঁর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, আঠারোশ উনষাট সালে আমার গ্রেট গ্র্যাণ্ড-ফাদার ইংরেজদের কাছ থেকে প্রথম জমিদারী পান।…

তার মানে সিপাহী মিউটিনির পর পরই?

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন।

সুবোধবাবু আর কোন প্রশ্ন না করলেও রাজাবাবুর বংশধর ওঁদের একদা গৌরবের কাহিনী বলে যান, ঐ জমিদারী পাবার পর আমার গ্র্যাণ্ডফাদার রাজা অবলাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বিহার-উত্তরপ্রদেশের সাতটি বড় বড় শহরে সাতটি প্যালেস তৈরী করেন।…

এত কথা শোনার পর কি চুপ করে থাকা উচিত?

নিতান্ত সৌজন্যের জন্য সুবোধবাবু বলেন, আচ্ছা?

এবার মহেন্দ্রবাবু একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বলে, ঐ সাতটি প্যালেসের মধ্যে এইটি সবচাইতে ছোট!

সুবোধবাবুও একটু হাসেন। বলেন, আপনার গ্রেট গ্র্যাণ্ড ফাদারের রুচি ও মেজাজ দেখছি সত্যি রাজামহারাজের মতই ছিল।

সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উনি একটু থেমে, একটু হেসে বলেন, আপনি খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম করুন। তারপর ওঁর গল্প শোনাব।

দোতলার বিরাট বারান্দায় পা দিয়েই সুবোধবাবু বললেন, এবার আর ওঁর গল্প শোনা হবে না

কেন? আপনি কি ইন্টারেস্টেড না?

না, না, তা না। আমি আজ বিকেলের গাড়িতেই চলে যাব।…

এ কথা শুনেই মহেন্দ্রবাবু যেন চমকে উঠলেন। থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, না, না, তা কখনোই হতে পারে না। আপনাকে অন্তত দুচারদিন থাকতেই হবে।

বারান্দা দিয়ে এগুতে এগুতেই সুবোধবাবু অত্যন্ত ধীর স্থিরভাবে বললেন, না মহেন্দ্রবাবু, এ যাত্রায় দয়া করে আমাকে যেতে দিন। কাল কলকাতায় আমার অনেক কাজ।

কিছু ভিক্টোরিয়ান, কিছু মামুলী ফার্নিচার দিয়ে সাজানো ড্রইংরুমে পা দিয়েই মহেন্দ্রবাবু বললেন, কিন্তু…

এবার দয়া করে আমাকে বাধা দেবেন না। সত্যি আমার অনেক কাজ। উনি পুরনো দিনের একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন, মা আর মেজ মাসীর জন্য এখন এলাম। হয়তো

এবার মহেন্দ্রবাবু ওঁর কথার কোন জবাব না দিয়ে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মত হুঙ্কার দিলেন, বাবুলাল?

বাবুলাল দরজার আড়ালেই দাঁড়িয়েছিল প্রভুর স্নেহের ডাক শুনেই সে আত্মপ্রকাশ করে বলে, জী হুজুর!

চা আন।

বাবুলাল জী হুজুর বলে ভিতরের দিকে পা বাড়াতেই প্রভু আবার হুকুম করলেন, আর শোন, মাকে আসতে বল।

জী হুজুব! ও এবার দৌড়ে ভিতরে গেল।

এই ড্রইংরুম দেখে সুবোধবাবুর মনে হল, এক অতীত ইতিহাসের অন্ধকার ভগ্নস্তূপের মধ্যে বসে আছেন। মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পা বা নালন্দা-বিক্রমশীলাও তো ভগ্নস্তূপ! কিন্তু ঐসব ভগ্নস্তূপের প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে মানবসভ্যতার গৌরবময় কাহিনী, ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। আর এখানে? ভাবতে গিয়েও বোধ হয় ওঁর লজ্জা হয়। তবু উনি বেশ আগ্রহের সঙ্গেই চারপাশ দেখেন।

কী আর দেখবেন সুবোধবাবু? এখন তো আমরা ভিখারী! আক্ষেপ করে মহেন্দ্রবাবু বলেন।

ছি, ছি, ওকথা বলবেন না।

সত্যি কথাই বলছি সুবোধবাবু। যা ছিল তার তুলনায় ভিখারী বৈকি!

গভর্নমেন্ট জমিদারী নিয়ে নিলে…

ওঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই উনি বলেন, গভর্নমেন্ট জমি দারী নেবার আগেই আমাদের বারো আনা টাকাকড়ি-সম্পত্তি বাবা বেচে দেন।

কেন? সুবোধবাবু একটু বিস্ময় প্রকাশ করেই জিজ্ঞেস করেন, উনি বুঝি খুব আমুদে লোক ছিলেন?

মহেন্দ্রবাবু প্রায় চিৎকার করে ওঠেন, না, না, নট অ্যাট অল! নট অ্যাট অল! হি ওয়াজ এ গ্রেট ন্যাশনালিস্ট।

তাই নাকি?

উনি ন্যাশনালিস্ট লীডার ও কর্মীদের দুহাতে টাকা বিলিয়েছেন। পরিচিতদের মধ্যে যারা জেলে যেতেন, তাদের ফ্যামিলীকে ঠিক নিজের ফ্যামিলীর মত প্রতিপালন করতেন।

সুবোধবাবু মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন।

উনি প্রায় এক নিশ্বাসেই বলে যান, টেররিস্ট মুভমেন্টের সময় টেররিস্টদের লুকিয়ে রাখার জন্য উনি কয়েকজন বাঈজীকে বছরের পর বছর রেখে দেন।

বাঈজীদের বাড়িতে টেররিস্টদের লুকিয়ে রাখেন?

সম্মতিতে মাথা নাড়িয়ে একগাল হাসি হেসে মহেন্দ্রবাবু বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেন, পুলিসের গোয়েন্দারা কি জমিদারের বুদ্ধির সঙ্গে

সুবোধবাবু বেশ জোরেই হেসে ওঠেন।

মহেন্দ্রবাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু দেশের জন্য এত ক্ষতি স্বীকার করেও বাবার কত বদনাম হয়েছে জানেন?

আরে ওসব গ্রাহ্য করতে নেই।

এ বিষয়ে আর কোন কথাবার্তা হবার আগেই মহেন্দ্রবাবুর স্ত্রী ড্রইংরুমে ঢুকলেন। চা-জলখাবারের ট্রে নিয়ে ওঁর পিছন পিছন বাবুলাল এল।

আমার স্ত্রী! মহেন্দ্রবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন।

মিসেস ব্যানার্জী ও সুবোধবাবু প্রায় একই সঙ্গে নমস্কার ও প্রতি নমস্কার করলেন।

সেন্টারটেবিলে চা-জলখাবারের পাত্র রাখতে রাখতে মিসেস ব্যানার্জী বললেন, আমার শ্বশুরমশায়ের খুড়তুতো বোনের দূরসম্পর্কের ননদ হলেও যোগমায়া পিসী আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করেন।…

মহেন্দ্রবাবু বললেন, একটু চা খান।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই সুবোধবাবু একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, তা জানি।

ভদ্রমহিলা পাশের একটা সোফায় বসে বললেন, ঈশ্বরের কি ইচ্ছা জানি না তবে আপনাদের মত শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত পরিবারে মেয়েকে দিতে পারলে আমরা ধন্য মনে করব।

না, না, একথা বলবেন না। সুবোধবাবু আবার এক চুমুক চা খেয়ে বললেন, আজকাল তো সবাই শিক্ষিত। তাছাড়া আপনাদেব মত ঐতিহ্য বা আভিজাত্য তো আমাদের নেই।

মিসেস ব্যানার্জী একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, ঐ নামেই তালপুকুর। আসলে ঘটি ডোবে না।

মহেন্দ্রবাবু চুপ করে থাকলেও ওঁর স্ত্রী বলে যান, ঐ ঐতিহ্য আভিজাত্যই এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওঁর কথা শুনে সুবোধবাবু মনে মনে ওঁকে শ্রদ্ধা না করে পারেন না কিন্তু মুখে বলেন, কিন্তু ব্যক্তি বা সমাজজীবনে তো ঐতিহ্য আভিজাত্যের একটা বিরাট ভূমিকা আছে।

ভূমিকা আছে বলবেন না। বলুন, ভূমিকা ছিল। উনি একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, এ যুগে ঐতিহ্য-টৈতিহ্যের দাম ফুটো পয়সাও না।

এতক্ষণ পর মহেন্দ্রবাবু ওঁর স্ত্রীকে বললেন, এদিকে প্রফেসর সাহেব কী বলেছেন জানো?

কী?

উনি আজই বিকেলের ট্রেনে কলকাতা চলে যাবেন।

মিসেস ব্যানাজী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অসম্ভব।

সুবোধবাবু বললেন, কিন্তু কাল কলকাতায় আমার সত্যি অনেক কাজ।

নিশ্চয়ই কাজ আছে, কিন্তু দাদা আপনার মত মানুষকে তো কাছে পাই না! তাই এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে পারব না।

এবার সত্যি সুবোধবাবু হাসতে হাসতে বলেন, শুনেছিলাম, আপনার স্বামী উকিল কিন্তু এখন দেখছি, আপনিই সিনিয়র অ্যাডভোকেট!

ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই হাসেন। ঐ হাসতে হাসতেই মিসেস ব্যানার্জী জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু মামলায় জিতেছি কিনা তা তো বললেন না?

জজ সাহেব বলেছেন, এমন তুচ্ছ ব্যাপারে মামলা করাই অন্যায় হয়েছে। তাই উনি দু-পক্ষকেই মিটমাট করে নিতে বলেছেন, অধ্যাপক মুখার্জী চাপা হাসি হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন।

যাক তাহলে মামলায় হারিনি। অর্থাৎ অজি বিকেলে আপনি যাচ্ছেন না।

ঐ ড্রইংরুমে বসেই আরও এক রাউণ্ড চা খেতে খেতে ঠিক হল, সুবোধবাবু পরের দিন ভোরবেলার ট্রেনে রওনা হবেন।

সুবোধবাবু স্নান করে বেরুতেই ব্রেকফাস্টের ডাক পড়ল। উনি ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতেই মিসেস ব্যানার্জী বললেন, ছোট মেয়ে মামারবাড়ি গেছে। তাই এখন আমরা মাত্র তিনটি প্রাণী এখানে আছি। আমরা দুজনে আপনার সঙ্গে গল্প করছি আর। আমার মেজ মেয়ে একলা একলা ঘরের মধ্যে

সুবোধবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমরা সবাই মিলেই তো গল্প করতে পারি।

ওঁরা স্বামী-স্ত্রী প্রায় একসঙ্গেই ডাক দিলেন, কৃষ্ণা, এদিকে আয়।

দক্ষিণ দিকের কোণার ঘর থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণাকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে দেখেই সুবোধবাবু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *