বাইয়ানী
একটা তিনছক আছে।
বালিয়াড়ি আর ঝাউবনের ভিতর দিয়ে দীর্ঘ কালোকালনাগের মতো একটা পিচ-বাঁধা পথ এসেছে ইন্সপেকশান বাংলোর কাছে। অন্য পথটা চলে গেছে ওড়িশা ট্যুরিজিম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশানের পান্থনিবাস, আর আই-টি-ডি-সির অশোক ট্রাভেলার্স লজ হয়ে পিপিলির দিকে।
মোড় থেকে আরও একটা রাস্তা চলে গেছে ব্ল্যাক পাগোডার পদপ্রান্তে।
রোদ পড়লে, হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। পথটা খুবই নির্জন। মাঝে মাঝে ঝাউ-এর কাটা ডাল ভরতি করে দু-একটি মন্থর গোরুর গাড়ি নয়তো কৃচিৎ ক্যাঁচোর-কোঁচর শব্দতোলা সাইকেল ঝাউবনের মর্মরধবনির শব্দকে ডুবিয়ে দিয়ে নির্জন নিটোল শান্তিকে ছিদ্রিত করে চলে যায়। ঝাউ-এর বনে বনে ফল এসেছে এখন। ক্ষুদে ক্ষুদে কাঁঠালের মতো দেখতে ফলগুলো। গাছে ঝুলে আছে। মাটিতে পড়ে আছে।
ঝাউ-এর ফল থেকে গাছ হয় না। এই ফল শুকিয়ে ফাটিয়ে এ থেকে বীজ বের করে তারপর দু তিন গ্রীষ্মের খরা সেই বীজকে খাইয়ে তবেই ঝাউ-এর চারা করা সম্ভব।
ট্রাভেলার্স লজ-এর বেয়ারাটি বলছিল।
আমার মুখ যেদিকে, সেদিকে সমুদ্র। সমুদ্রর বাঁ-দিকে চন্দ্রভাগার নীল দহ। যে নদীতে বহু বহু বছর আগে কৃষ্ণপুত্র শাম্ব চান করে কুষ্ঠরোগমুক্ত হয়েছিলেন। সমুদ্রতীরে এসে পিচ রাস্তাটা। একটি আশী ডিগ্রি বাঁক নিয়ে ডানদিকে চলে গেছে। চওড়া, উড়াল পিচ রাস্তা। বাঁ-দিকে সমুদ্র, ঝাউবন। ডানদিকেও বালিয়াড়ি আর ঝাউবন। এই-ই নতুন মেরিন-ড্রাইভ। পথে একটি ব্রিজ হতে বাকি আছে। যখন ব্রিজটি হয়ে যাবে, তখন পুরী আর কোনার্কের দূরত্ব একেবারেই কমে যাবে।
সমুদ্রতীরে এসে দাঁড়ালাম। আজ প্রকৃতি উদ্দাম। সাইক্লোনিক আবহাওয়ার সংকেত থাকাতে কোনো জেলে-নৌকাই জলে নামেনি সকাল থেকে। দূরের জেলেবস্তিতে জেলেরা তাদের মসৃণ উজ্জ্বল কালো উরুতে ঘষে ঘষে, পাক দিয়ে দিয়ে জাল বুনছে। মেয়েরা নানারকম কাজ করছে।
ওরা নিজেরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে অনুচ্চস্বরে, তখন গরমের দুপুর বেলার তৃষিত মোরগ-মুরগির কথোপকথনের কথা মনে পড়ে যায় আমার। জনশূন্য দীর্ঘ সমুদ্রতীরে শুধু একজোড়া সমুন্দর-চড়াই কোমর দুলিয়ে, লেজ নাচিয়ে ঝাঁকি মেরে মেরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এই
ভরা বর্ষায় নোনা জলের গন্ধে, বালিয়াড়ি আর ঝাউবনের শী-শী হাওয়ার শব্দের পটভূমিতে ওদের এই আশ্চর্য চমকে চমকে হাঁটাতে এক যাযাবর যৌনতা উড়ছে অনুক্ষণ সামুদ্রিক হাওয়ায়।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফেরার পথ ধরলাম। আজ সূর্যমন্দিরে শেষ সূর্যের সূর্যপ্রণাম দেখব। সূর্যদেবতার পায়ে মাথা ছুঁইয়ে দিনের প্রথম রোদ যেমন করে পৃথিবীতে দিন আনে, তেমনি করেই শেষ রোদ রাত নামায়।
সে নাকি এক দারুণ দৃশ্য।
কিছুদূর হাঁটার পরই দেখি দুটি হিপিনি হেঁটে আসছে এদিকে। সঙ্গে কোলবালিশের মতো
অদ্ভুতাকৃতি দু-টি ব্যাগ নিয়ে। কাঁধেও ব্যাগ ঝুলছে দু-জনের। একজনের পরনে শতছিন্ন জিনস। উপরে গুরু পাঞ্জাবি। অন্য জনের নিম্নাঙ্গে একটি লাল ঘাঘরা। উর্ধ্বাঙ্গে গুরু পাঞ্জাবিই।
আমাকে দেখে মেয়ে দুটি বলল, এদিকে কোনো ফ্যামিলি হাউস আছে?
আমি এখানে মাত্র কালই এসেছি। বলতে পারব না ঠিক। তবে, ফ্যামিলি হাউস কেন, কোনোরকম বাড়িই তো চোখে পড়ল না পথে, একটু এগিয়েই একটা ছোটো ঝুপড়ি মতো ছাড়া, যার বাইরের দেওয়ালে দুর্গাবাড়ি না কী যেন লেখা আছে। তবে, লোকজন থাকে কি? জানি না।
একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল উলটোদিক থেকে। মেয়ে দুটির মধ্যে একজন বলল দোজ বাস্টার্ডস।
কিন্তু আমার কাছে কোনো সাহায্য বা উপকার চাইল না ওরা। পশ্চিমের মানুষদের চরিত্রে সাহায্য প্রার্থনা বা করুণা প্রার্থনা অত্যন্ত বেমানান।
গাড়িটা স্পিড কমাল। কিন্তু আমাকে দেখেই বোধহয় দাঁড়াল না আর।
দেখলাম, ভিতরে চার-পাঁচটি অল্পবয়সি ছেলে। কামার্ত হায়নার মতো কর্কশদলবদ্ধ চিৎকার ছুঁড়ে দিয়ে প্রমত্ত অবস্থায় তারা চলে গেল। মেয়ে-দুটি সম্বন্ধে ওড়িয়াতে অশ্রাব্য কিছু কথা বলে।
বোধহয় কাছাকাছি বড়ো শহর থেকে এসেছে। আজ শনিবার।
দেশবাসীর ব্যবহারে লজ্জিত হয়ে আমি ওদের উপকার করার জন্যে বললাম, মে আই হেলপ উ্য?
প্রথম মেয়েটি নৈর্ব্যক্তিক গলায় বলল, ফ্যামিলি-হোম।
ফ্যামিলি-হোম কোথায় তা জানি না। রাত হয়ে আসছে। যদি জায়গা না পাও, তাহলে ট্রাভেলার্স লজ-এ এসো। থাকতে পার। টাকা না থাকে, তো একরাত আমার অতিথি হয়েই থেক। ভারতবর্ষের লোক খুব অতিথিপরায়ণ।
প্রথম মেয়েটি বলল, হাতজোড় করে, নমস্কারম। ওনলি ফ্যামিলি-হোম, উই ওয়ান্ট।
আমার ওখানেই থাক না কেন?
আমি ঔদার্য দেখিয়ে বললাম। ওরা বলল, উই আর নট বেগারস।
হোয়ার ইউ ফ্রম?
আমি জিগ্যেস করলাম।
আমি যে অনেক দেশ এবং খুব সম্ভব ওদের দেশও দেখেছি একথাটি প্রচার করার ইচ্ছাটা সামলাতে পারলাম না।
ডাজ নট রিয়্যালি ম্যাটার! উই ওয়ান্ট আ ফ্যামিলি-হোম। টু স্পেন্ড দানাইট।
বলেই, হাতনেড়ে আমাকে সামারিলি ডিজপোজ-অফ করে দিল।
এর পরেও তাদের সাহায্য করতে যাওয়াটা অসম্মানের কারণ হতে পারে ভেবে আমি হন হন। করে পা চালিয়ে এগিয়ে এলাম কোনার্কের সূর্যমন্দিরের দিকে। সূর্য কখন ঝুপ করে ডুব মারবে। সূর্যরশ্মির সূর্যমন্দিরের সূর্যদেবতাকে প্রণাম করাটা না দেখলেই নয়। মন্দিরের চত্বরে যখন এসে পৌঁছোলাম তখন আমি ছাড়া আর কেউই নেই সেখানে। কোনার্কে এখন অফ-সিজন। তার উপর সাইক্লোনিক ওয়েদার। দিশি ট্যুরিস্টরা সব ফসলি-বটের। শীতকালে যখন কোনোরকম অসুবিধা থাকে না, তখনই আসেন বেশি। তবে, বিদেশিরা আসেন সবসময়ই।
সূর্যরশ্মি সূর্যদেবের পায়ে মাথা রাখল কিছুক্ষণ। তারপরই সরে এল। চারপাশের ঝাউবন, বালিয়াড়ি, কাজুবাদামের ঝাড় সব কিছুর ছায়া ঘনতর হয়ে কালো প্যাগোডার গম্ভীর। মৌনব্যক্তিত্বকে আরও গাম্ভীর্য দিল।
জগমোহনের দিক থেকে নাটমন্দিরের দিকে হেঁটে আসছি, হঠাৎ এক ভৌতিক উচ্চহাসিতে চমকে উঠলাম। রীতিমতো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। পিছন ফিরে দেখি, একটি বছর উনিশ-কুড়ির মেয়ে হিহি করে হাসছে।
আমি তার দিকে তাকাতেই সে একটি মিথুন মূর্তির দিকে আঙুল তুলে দেখাল। মূর্তিটি দেখলে সঙ্গমরতা বলে মনে হয় না নারী ও পুরুষকে। মনে হয় উনিশশো বিরাশির অলিম্পিয়াডের জন্যে অ্যাক্রোবেটিকস-এর অনুশীলন করছে।
মেয়েটি কেঁপে কেঁপে হাসতে লাগল। তার পরনে একটি নোংরা নীল শাড়ি কোমরে জড়ানো। আর আঁচলটা বুকের কাছে ফেলা। তার পিঠ উন্মুক্ত, দুটি দারুণ সুন্দর বুকের দু-পাশ উন্মুক্ত তার বুকের সৌন্দর্যের কাছে কোনার্ক-এর মৈথুনরত নারীদের বক্ষ সৌন্দর্যও ম্লান। এমন সুন্দর শরীরের এবং মিষ্টিমুখের নারী খুবই কম দেখেছি আমি। আশ্চর্য! তার মাথার চুল বব করে কাটা। যেমন করে ইংরিজি-শিক্ষিতা আধুনিকারা কাটেন।
আবারও মেয়েটি ফুলে ফুলে হাসতে লাগল। শাড়ি দুলে দুলে উঠতে লাগল। তাকে দেখে আমার হঠাৎই মনে হল, মন্দিরগাত্র থেকে কোনো কোবাল্ট পাথরের মূর্তি জীবন্ত হয়ে নেমে এসেছে নীচে।
এমন সময় একজন গাইড কোথা থেকে এসে হাজির হল। মেয়েটিকে ধমকে বলল, এই যে বাইয়ানী। চাল, চাল, তু কঁড় করুচি ইয়াড়ে?
জীবিব, জীবি! মু এটি রহিকি কঁড় করিবি? নিশ্চয় জীবি। তাংকু সঙ্গেরে জীবি। বড্ড ক্ষুদা লাগিলানি।
রক্ত হিম করা হাসি হাসতে হাসতে মেয়েটি বলল, আমারই দিকে আঙুল দেখিয়ে।
পরক্ষণেই, মিথুন মূর্তির গায়ে এক গাদা থুতু ছিটিয়ে বলল, ছিঃ! ছিঃ!
আমার গা ছমছম করছিল। ভাবছিলাম, মানুষের মেয়ে তো?
চত্বরের বাইরে এসে দেখি একটি পান-সিগারেটের দোকান তখনও খোলা। সে দোকানও
দোকানি বন্ধ করার বন্দোবস্ত করছে।
পান আর সিগারেট কিনতে কিনতে দোকানিকে শুধোলাম, ওই মেয়েটি কে?
দোকানি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল, একটুক্ষণ আমার মুখের দিকে। তারপর বুঝতে পেরে বলল, ওঃ। ও বাইয়ানী। ও কে তো এখনও আমরাই তেমন ভালো করে জানি না। শুনেছি, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সামনে যে মস্ত চক–যেখানে মন্দিরের চারদিকের রাস্তা ঘুরে ঘুরে এসে পড়েছে, ও সেইখানেই ঘুরে বেড়াত। কোথা থেকে এল, কার মেয়ে, পাগলই-বা হল কীভাবে, তা কেউই জানে না। তবে, কাল থেকেই দেখছি ওকে।
পুলিশে দিলে না কেন?
দোকানি বলল, পুলিশের এমনিতেই কত দায়িত্বপূর্ণ কাজ, তাদের সময় নষ্ট করার সময় কোথায়?
কালকে এখানে এল কীসে করে মেয়েটি? কার সঙ্গে এল? কেন এল? আমি জানি না।
দোকানি দরজার পাল্লা বন্ধ করতে করতে বলল। তবে, একজন গাইড বলছিল, এক বাসের কন্ডাকটর ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছানা-পোড়া খাইয়ে, নিয়ে এসেছিল। রাতেও তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যা করবার করে, বাস নিয়ে যাবার সময় ফেলে রেখে চলে গেছে। আর কী? মাথা-খারাপ জোয়ান, সুন্দরী মেয়ে। যে তাল পাবে, সেই একবার সুখ করে নেবে।
বাংলোতে ফিরে আসতে আসতে আমার জ্বর-জ্বর লাগতে লাগল। কখনো এমন হয়নি আমার এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে। তিনু আর গুরচির কথা মনে হল আমার। আমার স্ত্রী ও ছেলে। কিন্তু সেই বাইয়ানী মেয়েটির কাছে আমার সমস্ত অতীত, আমার বংশপরিচয়, আমার সুনাম এবং আমার ভবিষ্যতের সমস্ত সম্মানের শান্তির সাধ ধূলিসাৎ হয়ে গেল এক নিমেষেই। শেষ। বিকেলের কোনার্কের কালো প্যাগোডার কালো কালো অসংখ্য মিথুন-মূর্তি আর কামকেলির মধ্যে ওই কালো জীবন্ত মেয়েটিকে আরও অনৈসর্গিক বলে মনে হয়েছিল।
অপ্রাকৃতিক!
সে কি ওই মন্দিরের দেওয়াল বেয়েই নেমে এল? ক্ষণিকের জন্যে? হাজার হাজার বছর আগে কখনো কি সে আমার প্রেমিকা ছিল? যুগে যুগে সে কি আমাকেই চেয়েছিল? নইলে সে অমন করে হাসল কেন? দেওয়ালের মিথুন-মূর্তি দেখিয়ে? সেকথা না বলেও চোখে মুখে আমাকে অমন করে বুকের মধ্যে শিহরণ তুলে ডাকল কেন?
একথাও সত্যি যে, জীবনে আমি কোনোদিনও অমন তীব্র তীক্ষ্ণ কামভাব বোধ করিনি। এত জ্বালা। কেউ আমার বোধের কেন্দ্রমূলে যেন একটি উত্তপ্ত ছুরি আমূল বিদ্ধ করে দিয়েছিল। কী অস্বস্তি! কী অবিশ্বাস্য জ্বালা, সারা শরীরে! বুঝলাম, জ্বরটাও এই জ্বালারই জন্যে। এ অন্য জ্বর নয়, কাম-জ্বর।
লজে ফিরেই, শাওয়ার খুলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম শাওয়ারের নীচে। শাওয়ারের
জলের ফিনকি শরীরের ঘাম ধুতে পারে, সুগন্ধি সাবানের ফেনা ধুতে পারে, কিন্তু কাম ধুতে পারে না। কাম কেবল নিবৃত্তিতেই তৃপ্ত হয়, অন্য কিছুতেই নয়।
চান সেরে বারান্দায় এসে বসলাম। আজ দ্বাদশী বা ত্রয়োদশী হবে। চাঁদ উঠেছে সামুদ্রিক ঝোড়ো হাওয়ায় চুল উড়িয়ে। চাঁদের আলোয় ঝাউবন যেন দোলনা দুলছে।
আমার ঘরটা খুবই নিরিবিলি। এক নম্বর ঘর। ম্যানেজার মিস্টার রায় দেখে শুনেই দিয়েছেন, যাতে লেখা-পড়ার অসুবিধে না হয়! পুবে আর দক্ষিণে জানালা। বাইরে চওড়া বারান্দা। বারান্দার পর অনেকখানি কম্পাউন্ড। নীচে দেওয়াল তোলা। ইউক্যালিপ্টাস, ঝাউ, ঝোপ-ঝাড়। ওই বালি আর জমির মধ্যে বোগেনভিলিয়া ছিল। পাতাই হয়েছে একগাদা। ফুল নেই। মালিটা বোধ হয় খুব জল ঢালে। কোনো ফুল আদরের জলদানে ফোটে, কোনো ফুল রুক্ষতায়, পাথরে, অনাদরে। এই তথ্যটিই যার জানা নেই, সে মালি হবে কী করে? ফুল ফোঁটানো কি সকলেরই আসে? এতই সোজা?
বারান্দার চেয়ারে বসে অনেক কথা ভাবছিলাম। মনটাকে, শরীরটাকে শান্ত করতে চাইছিলাম। কিন্তু পাগলি মেয়েটা আমাকে পাগল করে দিয়ে গেছে।
কী করি, কেমন করে তাকে কাছে পেতে পারি, তাকে যত্ন করতে পারি, এই বাংলোতে এনে সুখে রাখতে পারি পাশের ঘরে? আহা। ভালো খেত, ভালো ঘুমোত। শাড়ি জামা কিনে দিতে পারতাম। তার মা-বাবার খোঁজ করার চেষ্টাও করতাম। তাকে শারীরিকভাবে পাওয়াটা হয়তো এখন আর সম্ভব নয়। আমি সম্রান্ত, শিক্ষিত, ঠিকানাসর্বস্ব নামি এক ভদ্রলোক। আর ও পরিচয়হীন, ধূলিমলিন, উকুনচুলের একজন পথের পাগলি?
সম্ভব নয়, এখানে এখন নয়। কখনোই নয়।
হয়তো সম্ভব। তবে লোকচক্ষুর অন্তরালে। মুখোশটা খুলে রেখে। বিবেক ব্যাটাকে ভাঙ-এর গুলি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে। যা কিছু সম্মানের সঙ্গে, মাথা উঁচু করে নিজের ঠিক-ঠিকানা জাহির করে পাওয়া যায় না অথচ পেতে বড়োই ইচ্ছা করে, তাকে পেতে হয় ভণ্ডামির মধ্যে দিয়েই, ভান করে, নামগোত্র পরিচয় ভাঁড়িয়ে নির্জনে। ভণ্ডামি আর ভাঁড়ামির আরেক নামই তো সভ্যতা।
বেল দিয়ে বেয়ারাকে ডাকলাম। বেয়ারা এসেই বারান্দার সুইচ টিপে আলো জ্বালাল। আমি নিভোতে বলে দিলাম। এমন সুন্দর চাঁদ-ওড়া পাখি-ভাসা রাত। এমন রাতে কেউ বিজলী বাতি জ্বালে? ওকে জিজ্ঞেস করলাম ওই বাইয়ানীটি সম্বন্ধে ও কিছু জানে কি না?
ওর নাম প্রফুল্ল। ও বলল, জানে না।
উলটে ও জিজ্ঞেস করল, কেন হঠাৎ ওকথা জিজ্ঞেস করছি আমি।
বললাম ওকে। যতটুকু বলা যায়। যাকে বলে, শাকে মাছ ঢেকে।
আমাদের সারাদিন তো এখানেই কেটে যায়। বেরুতে পারি কই? বাইরের খবর আর রাখি কোথায়?
আজ কি খুব গরম?
আমি শুধোলাম প্রফুল্লকে।
তো! আজ তো রীতিমতো ঠান্ডা। কালকে সাইক্লোন আসতে পারে। সারাদিন তো মেঘই ছিল, ঝোড়ো হাওয়া, মেঘলা। বিকেলের দিকেই শুধু একটি উজলা হল।
আমি বললাম, একটা বিয়ার পাঠিয়ে দিতে বলো তো বারম্যানকে। বড়ো গরম লাগছে আমার।
বারম্যান নেত্রানন্দ নিজে এল বিয়ার এবং বরফ নিয়ে বারান্দাতে চাঁদের আলোয় সব ঠিকঠাক করে দিয়ে সেলাম করে চলে গেল।
বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে আমি সামনের সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ঝাউবন আর কাজুবাদামের বন আর বালিয়াড়ির দিকে চেয়ে রইলাম। লাল নরসিমাদেব, পূর্ব গঙ্গা ডাইনাস্টির রাজা এই সূর্যমন্দির বানিয়েছিলেন বারো-শো খ্রিস্টাব্দে। তার মন্ত্রী শিবসামন্ত রায় বারো-শে ভাস্কর এবং খোদাইকারকে দিয়ে ঠিক কতদিন ধরে এই সূর্যমন্দির বানিয়ে ছিলেন তা কেউ সঠিক জানেন না। বিদেশি নাবিকরা সমুদ্র বেয়ে তাদের জাহাজে করে ভাসতে ভাসতে চলে যাবার সময়ে এই ব্ল্যাক প্যাগোডার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে যেত! বাৎসায়নের কামসূত্র, কোক্কোকার রতিশাস্ত্র, কল্যাণমল্লর অনঙ্গ-রঙ্গ এবং শেখ নেকজ্যউইর পারফিউমড গার্ডেন যেন মূর্ত হয়ে রয়েছে এই আশ্চর্য মন্দির গাত্রের পাথরে পাথরে।
লোকে বলেন যে, ব্রিটিশরা যদি আগে তাজমহলকে না দেখতেন তাহলে কোনার্ক-এর মন্দিরকে তাজমহলের চেয়েও উঁচুতে স্থান দিতেন। মানে। তবে, কোনার্ক-এর মান ও সম্মান এখনও। তাজমহলের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। সকলেই এই মন্দিরের সম্বন্ধে একটি কথা ভেবে অবাক হয়ে যান যে, তখনকার দিনে যখন যাতায়াত ব্যবস্থা ও যন্ত্রযান বলে কিছুই ছিল না, তখন অত বড়ো বড়ো পাথরের চাঁইগুলোকে অবিকৃত ও অক্ষতভাবে বয়ে আনা হল কীভাবে?
বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার মনোমোহন গাঙ্গুলি তাঁর ওড়িষ্যা অ্যান্ড হার রিমেইনস বইতে লিখেছেন ইট ইজ এ ম্যাটার অফ গ্রেট ওয়ানডার এ্যাজ টু হাউ সাচ হেভি স্টোনস এ্যান্ড আইরন বিম কুড বি রেইজড টু গ্রেট হাইটস বিফোর দ্যা ইনভেনশন অফ স্টিম ইঞ্জিন, ওয়্যার-রোপ, ডেরিক এ্যান্ড পুলি ব্লকস।
কোনার্কের পুব দিকের প্রবেশদ্বারের কাছে একটি কারুকার্য করা পাথর ছিল তাতে সপ্তাহের সাতটি দিন সম্বন্ধে নানা কারুকার্য করা ছিল। শুধু সেই জায়গার পাথরটিকে (বড়ো বড়ো পাথরের কথা বাদই দেওয়া যাক) ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মিউজিয়ামে স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করেন তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের তাবৎ শক্তি প্রয়োগ করেও এই বালিময় জায়গাতে সে পাথরটিকে মাত্র দু-শো গজ মতো নিয়ে যেতে পারা যায়। অতএব স্থানান্তরণের চেষ্টা পরিত্যক্ত হয়।
অনুমান করতে কষ্ট হয় না, কীভাবে এই মহান শিল্পসৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। হাজার হাজার, হয়তো লক্ষ লক্ষ সাধারণ প্রজা এবং হাতি ঘোড়া মিলেই নিশ্চয়ই এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিল। তাদের মধ্যে কত হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছিল অনাহারে অসুখে এবং সামন্ততন্ত্রের অত্যাচারে তার হিসাব ইতিহাস রাখেনি। এমনকী ওই ইতিহাস, এই ব্ল্যাক প্যাগোডার যিনি প্রধান ভাস্কর, তাঁর নামও লিখে রাখা প্রয়োজন বোধ করেনি। আজকের ইতিহাসেও যেমন
আঠারো-শো বছর আগের ইতিহাসেও তাই, শুধু রাজা লাঙুল নরসিমাদেব এবং তার মন্ত্রী শিবসামন্ত রায়ের কথাই স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
রাজা এবং রাজনীতির কারবারিরাই ইতিহাসের পাতা চিরদিন জবরদখল করে রেখেছেন এবং করছেন। এটাই এদেশীয় নিয়ম। কোনার্ক-এর সূর্যমন্দির আনন্দিত চিত্তে এবং আনন্দ বিকিরণের জন্যে দেখা দরকার কিন্তু এখানে এসে প্রথমেই আমার মনে হয়েছে অসংখ্য মানুষের চোখের জল এই মিথুন মূর্তিগুলির মুখের স্মিতহাসির আড়ালে স্থবির প্রস্তরীভূত হয়ে রয়েছে। পিংক স্যান্ড স্টোন আর সফট ডার্ক-গ্রিন ক্লোরাইট শিস্ট পাথরে তৈরি এই প্যাগোডার মিথুনমূর্তিগুলি একদিন রোদে জলে ঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, কিন্তু ব্ল্যাক-গ্রানাইটের কালো। অন্ধকারের মধ্যে যতদিন কোনার্কই বেঁচে থাকবে, ততদিন সেই অনামা অপ্রশংসিত লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখের জলে লিপ্ত থাকবে এই সূর্যমন্দির। ঝাউবনের কান্নায় এবং বালিয়াড়ির দীর্ঘশ্বাসে সেই সব মানুষের আত্মারা চিরদিন ঘুরে বেড়াবে এই মন্দিরের আশেপাশে।
বাইয়ানী! বাইয়ানী! বাইয়ানী রে!
রাতে আমার ঘুম আসছিল না। কেবলই এপাশ-ওপাশ করছিলাম খাটে! কী আশ্চর্য উজ্জ্বল চোখ মেয়েটির। কী সুঠাম বুক, কোমর। পিঠের শিরদাঁড়ার সমান্তরাল নদীখাতটি কী সাবলীলতায় এসে হারিয়ে গেছে সুন্দর নিতম্বের দুটি টিলাতে। বাইয়ানী! তুমি মানুষ নও। আমি জানি তুমি দেওয়াল থেকেই নেমে এসেছিলে আমাকে ভুলিয়ে মারতে। নিয়ে যেতে, কামজ্বরে ক্লিষ্ট করে চাঁদনি রাতের দুধলি বালিয়াড়িতে। তারপর আঁচল খসাতে খসাতে নাচতে নাচতে দৌড়োতে দৌড়োতে নরম বালির মধ্যে নিঃশব্দ পায়ে, আর আমাকে ছোটাতে তোমার পেছনে পেছনে। তারপর একসময় সমুদ্রের পারে নিয়ে গিয়ে ঢেউ-এর দোলায় নরম এবং না-ছোড় হাতে ধরে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে আমায়। কী করতে তা তুমিই জানই।
বাইয়ানী, তুমি আমার জীবনের দ্যুতি। মৃত্যুর দূতী।
হঠাই এক আর্ত চীকারে আমার ঘুম ভেঙে গেল। একটি তীক্ষ্ণ, তীব্র নারীকণ্ঠের চীৎকার। তারপরই একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। দু-জন পুরুষের উত্তেজিত সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা। তারপরই গাড়ির ইঞ্জিন রিভার্স করার কর্কশ শব্দ।
আমি মশারি তুলে একলাফে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বাইরে চাঁদ ছেড়া উথাল পাতাল ফিসফিস হিসহিস হাওয়ার চাঁদোয়ার নীচে উদলা রাত।
গাড়িটাকে পান্থনিবাসের বাংলোর হাতার কিছুদূরেই ঝাউবনের মধ্যে পিচ রাস্তায় রিভার্স করছিল ওরা। গাড়ির টেইল-লাইটের লাল জোড়া চোখ দুটি, অস্পষ্ট মেঘলা জ্যোৎস্নায় ঝাউ-এর দোলা লাগা ছায়ায় আমার সদ্য ঘুমভাঙা চোখে কোনো প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর চোখের মতো মনে হচ্ছিল।
আমি চিৎকার করে উঠলাম. বাইয়ানী বাইয়ানী।
বলেই হাতার মধ্যে দিয়ে দেওয়ালের দিকে দৌড়ে গেলাম।
প্রফুল্ল এবংনাইট গার্ডও দৌড়ে এল আমার পেছন পেছন স্যর স্যর করতে করতে।
পাশের ঘর থেকে ইয়ান গ্রসভেনর আর জ্যাকি ম্যাকআইভর স্লিপিং স্যুট পরেই দৌড়ে এসে আমাকে ধরল।
আমি শুনলাম, জ্যাকি বলল, ইজ হি আউট অফ হিজ মাইন্ড?
আমি প্রফুল্লকে বললাম, গাড়িটা পালিয়ে যাচ্ছে। চলো চলো, ধরি ওদের।
কিন্তু কেউই আমার সঙ্গে গেল না। কেউই না। ওরা সকলে মিলে জোর করেই আমাকেও যেতে দিল না।
প্রফুল্ল বলল এখানে রাতে এমন করে কেউ বেরোয় না। ভয় আছে। সাপ আছে। মন্দিরে এই সময় দেব-দেবীরা নাচ গান করেন।
শেষ রাতে ঘুমোলাম, ঘুম আসছিল না।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। যখন ঘুম ভাঙল তখন অনেক বেলা। ঝকঝকে রোদ-ওঠা শ্রাবণের সকাল। যথারীতি মুখ ধুয়ে এসে বারান্দার চেয়ারে বসে চা আনবার জন্যে বললাম। চা না-আনা অবধি গত রাতে কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে জানতেও পারিনি। কিন্তু লক্ষ করলাম, সমস্ত বাংলোতে একটা থমথমে ভাব।
চা খেতে-খেতেই আমার চোখ গেল দূরে। ঝাউবনের মাঝের পিচের পথে। সেখানে বেশ বড়ো একটা ভিড় জমেছে। আর পথের দু-পাশের ঝাউবনে শকুনের সারি। গলা বাড়িয়ে নীচের পিচের পথে তারা কী যেন দেখছে। উকট ঔৎসুক্যর প্রতীক এ পাখিগুলো।
বেল বাজালাম।
প্রফুল্ল এল।
ওখানে কী? প্রফুল্ল?
প্রফুল্ল জবাব দেবার আগেই ম্যানেজার এলেন। ভদ্রলোক খুব ভদ্র ও পরিশ্রমী। সমস্ত লজটি যথাসাধ্য সুন্দর করে চালাবার চেষ্টা করেন সবসময়ই। সচরাচর সরকারি ট্যুরিস্ট লজে এমন বিবেকসম্পন্ন লোক বেশি দেখিনি। পশ্চিমবঙ্গে তো নয়ই।
আপনার শরীর কেমন আছে?
ওঁর প্রশ্নের জবাব না দিয়েই আমি উঠে দাঁড়ালাম। ওই দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্বগতোক্তির মতো বললাম, ওখানে কী? কীসের ভিড়?
ম্যানেজার ক্ষমা-চাওয়া মুখে বললেন, একটা পাগলি এসেছিল কোথা থেকে। অ্যাম্বাসাড়ার গাড়ি করে আসা একদল ছেলে তাকে গ্যাঙ-রেপ করার পর ছুরি মেরে শেষ করে এখানেই ফেলে গেছে পথের উপরে। পুলিশ এসেছে। ডেডবডি মর্গে নিয়ে যাবে একটু পরেই।
আমি একটু যাব।
আমি স্বগতোক্তির মতো বললাম।
ভাবছিলাম, কাল রাতে যে-সময়ে চিৎকারটা শুনেছিলাম ঠিক সেই সময়েই নিশ্চয়ই ঘটনাটা ঘটেছিল। পান্থনিবাসে এত লোক থাকতে আমাদের মধ্যে একজনও রাতে তাকে বাঁচাতে যাইনি।
আপনার যাওয়া ঠিক হবে না স্যার। আপনি কি ওই বাইয়ানীকে চিনতেন?
ম্যানেজার আবার বললেন।
চিনতাম।
আমি বললাম।
বলেই, চা-এর কাপ নামিয়ে রেখেই পা বাড়ালাম। আমার মন বলছিল, জন্ম-জন্মান্তর থেকেই যেন চিনতাম ওকে। যার সঙ্গে প্রেম ছিল আমার। ছিল মৈথুন।
ম্যানেজার ও প্রফুল্লও চললেন সঙ্গে সঙ্গে। ওঁরা বোধহয় আমাকে ছাড়তে চান না একা।
প্রফুল্লর মুখ দেখে মনে হল ও যেন ভূতগ্রস্ত হয়েছে। আসলে ও আমাকেই ভূতগ্রস্ত ভাবছিল। ও বোধহয় ভেবেছিল, কাল রাতে আমায় নিশিতে ডেকেছিল।
না গেলেই ভালো ছিল। অবশ্য না গেলে প্রায়শ্চিত্ত করা হত না। দেখলাম, বাইয়ানীর পরনের নীলরঙা রক্তমাখা শাড়িটিকেই খুলে, তার শরীর ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
মুখটা একটু দেখব আমি। এক সেকেন্ডের জন্যে।
আমি বললাম। পুলিশটি ম্যানেজারের মুখের দিকে চাইলেন।
একজন পুলিশ এদিকে দৌড়ে আসতে আসতে বলল, ছেলেগুলো ধরা পড়েছে। এইমাত্র খবর এল। ভুবনেশ্বরের কাছে। গাড়িটাও ধরা পড়েছে হাইওয়েতে।
ভিড়ের মধ্যে থেকে খালি গায়ের হাড় জিরজিরে একজন লোক বলল, ধরিলেভি কঁড় হব? পচারিকি দেখব, দেখিবে সেমানে মিনিস্টাররংকু, কী এম এল এ মানংকু পুত্তমান সবেব। ধরিকি কঁড় হবব? গুট্টে টেলিফোন আসিবে। মানংকু পুলিশ ছাড়ি দেবি।
আমি ভাবছিলাম, হিপিনি মেয়ে দু-টি যদিও বাইয়ানীর চেয়ে অনেক বেশি নোংরা, নেশাগ্রস্তা, পাপবিদ্ধাঞ্জ, তবুও, চামড়া সাদা বলেই তারা অক্ষত রইল। যেহেতু বাইয়ানী গরিব ভিখিরি, সহায় সম্বলহীনা, তাই নেকড়েগুলোর দলবদ্ধ কামের শিকার হল বেচারি।
পুলিশটি বাইয়ানীর মুখের কাপড়টা সরালো একটু। মুখে কামড়া-কামড়ির কালসিটের দাগ। কিন্তু আশ্চর্য! চোখে কোনোই আতঙ্ক নেই বরং এক আশ্চর্য ক্ষমাময় হাসি লেগে আছে। বাইয়ানীর মুখ পশ্চিম দিকে, যেদিকে সূর্যমন্দির। যে দেবতার পায়ে প্রণাম করে সূর্য এখন তার সাতরঙা সাতটি ঘোড়ার রথে চড়ে অনেক পথ চলে গেছেন অয়নপথে।
কোনার্ক-এর মন্দিরের দিকে তাকালাম। চোখ জ্বলছিল আমার। মূর্তিপুজোয় বিশ্বাস করি না আমি কিন্তু ঈশ্বরে করি। সেই ঈশ্বরে, যে ঈশ্বর, এই মন্দির বানাবার সময় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুকে উপেক্ষা করেননি, যাঁর কাছে লাঙুল নরসিমাদেব তাঁর মন্ত্রী শিব সামন্ত রায় আর সেই নামহীন গোত্রহীন ইতিহাসে অনুল্লেখিত লক্ষ লক্ষ মানুষগুলি সবাই-ই সমান। কাল রাতের দ্বিতীয় যামে যমরূপী ছেলেগুলো, যারা এ যুগের সামন্ততন্ত্রের প্রতিভু, তারাও তাদের কামের কামিন। নখরাঘাতে এই দুখিনী বাইয়ানীকেও হাজার হাজার অনামা অনুল্লেখিত মানুষের ভিড়ে মিশিয়ে দিয়ে গেল। মিষ্টি মুড়কিকে, নোন্তা মুড়ির সঙ্গে। মন্দিরের সৌন্দর্য বাড়ল। বাইয়ানীও সেই কালো কালো সাধারণ উদোম গায়ের মানুষগুলোর অদৃশ্য ভিড়ের মধ্যে কেমন মিশে গেল। একটি আর্ত চিৎকার রাতের ঝোড়ো হাওয়ায় ঝাউবনে উড়িয়ে দিয়ে।
প্রণাম করলাম আমি। মন্দিরকে নয়! বাইয়ানীকে।
ছেলেগুলো জানে না, ওদের বদলে আমিই কাল এই ঘৃণীত দুষ্কর্মকরতাম হয়তো।
কারণ আম তো ওদেরই সমাজের একজন। আমরা তো এই-ই করে এসেছি চিরদিন। অন্তত করতে চেয়েছিলাম। এবং করলে, যেহেতু আমি ভদ্রলোক, মানী লোক, সেই হেতু পাছে বাইয়ানী কাউকে এ কথা বলে দেয় এই ভয়ে তাকে যে করেই হোক খুনও হয়তো করে ফেলতাম। বালিয়াড়িতে। ঝাউবনে। তারপর পুঁতে দিতাম ওর লাশ পাছে আমার মান সম্মান না প্রোথিত হয়।
আমি বেঁচে গেলাম। মরল বাইয়ানী। এবং ছেলেগুলোও।
ছেলেগুলো এখনও দাগি হয়নি। আমার মতো ধাউর হয়নি। তাই-ই ধরা পড়ল। চিরদিন বোকারাই তো ধরা পড়ে।
সবাই ভুলে যাবে ধূর্ত-ধাউরদের ইতিহাস। যারা মন্দির বানিয়েছিল এবং পাথর বয়ে এনেছিল সেইসব অনভিজাত মানুষদের যেমন করে ভুলে গেছে সকলেই, বাইয়ানীকেও সকলে ভুলে যাবে। কোনার্ক-এর মিথুন মূর্তিদের কাছাকাছি না থাকলে পাথরে-গড়া মূর্তির মতো মেয়েটি হয়তো এমনি করে মরত না। মরত ঠিকই, আস্তে আস্তে ঘা-হওয়া পথের কুকুরির মতোঞ্জ, কারণ যারা বাঁচতে এসেছে আমার মতো, ও তাদের দলের নয়। মরত ও পুরীর জগন্নাথের মন্দিরের সামনে, যেখানে রোজ হাজার হাজার পুণ্যার্থী আর মহৎ প্রাণের গর্বিত মানুষদের যাওয়া-আসা।
বাইয়ানীর শক্ত হয়ে-যাওয়া জোড়া জোড়া কামার্ত দাঁতের দাগ-ভরা স্তনযুগলের আভাস ও ক্ষরিত-রক্ত ভুলুণ্ঠিতা নিঃসাড় শরীরের দিকে চেয়ে আমার মনে পড়ে গেল যে, বাইয়ানী–