Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বাংলা অক্ষরের সংস্কার || Rajshekhar Basu

বাংলা অক্ষরের সংস্কার || Rajshekhar Basu

বাংলা অক্ষর সংস্কারের প্রস্তাব অনেক কাল থেকে হয়ে আসছে। এ বিষয়ে সম্ভবত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় অগ্রণী। তার পদ্ধতি মোটামুটি এই।–স্বরান্ত ব্যঞ্জন একই রকমে লেখা হবে, যেমন কু শু পু হু, কূ শূ, কৃ; এবং যুক্তব্যঞ্জনের অঙ্গীভূত অক্ষরগুলি যথাসম্ভব অবিকৃত থাকবে, যেমন ক্ত ক খ। কিন্তু যে যুক্তব্যঞ্জনের বিকৃত উচ্চারণ হয় তার আকৃতি তিনি বদলান নি, যেমন ক্ষ। এছাড়া তিনি অনাবশ্যক বোধে এবং ব্যাকরণের সমর্থনে রেফের পর দ্বিত্ব বর্জন করেছেন। বিদ্যানিধি মহাশয়ের উদ্দেশ্য বর্ণের মূল রূপ যথাসম্ভব বজায় রাখা, ছাপার সুবিধা অসুবিধার উপর তিনি দৃষ্টি দেন নি। বহু বৎসর পূর্বে যে একলিপি বিস্তার-সমিতি স্থাপিত হয় তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা উড়িয়া গুজরাটী প্রভৃতি ভাষায় নাগরী অক্ষর চালানো। নাগরী-প্রচারিণী সভারও উদ্দেশ্য অনুরূপ। এই দুই সমিতি এখন প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। গত দশ বৎসরের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালীর অনেকে অক্ষর-সংস্কারে উৎসাহী হয়েছেন, তার ফলে নানারকম পরিকল্পনা প্রচারিত হয়েছে। প্রস্তাবকগণের লক্ষ্য সমান নয়, কেউ এক বিষয়ে কেউ অন্য বিষয়ে বেশী ঝোঁক দিয়েছেন।

আমাদের আলোচ্য কোন্ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য বাংলা অক্ষরের সংস্কার আবশ্যক এবং কি উপায়ে তা সুসাধ্য হবে। কামাল আতাতুর্ক অল্পায়াসে তার রাষ্ট্রে আরবী লিপির বদলে রোমান লিপি চালাতে পেরেছিলেন তার কারণ শুধু জবরদস্তি নয়। দেশের সুশিক্ষিত জনমতের তিনি সমর্থন পেয়েছিলেন, অশিক্ষিত প্রজাবর্গও তাঁকে শ্রদ্ধা করত। আমির আমানুল্লা নিজের ক্ষমতা আর লোকপ্রিয়তা না বুঝেই হঠাৎ সমাজসংস্কার করতে গিয়ে বিতাড়িত হলেন। আমাদের দেশে এমন কোনও সর্বমান্য শক্তিমান্ নেতা নেই যাঁর হুকুমে অক্ষরের আমূল সংস্কার হতে পারে। সংস্কারের পরিকল্পনা যতই সরল ও যুক্তিসম্মত হক, লোকমত অগ্রাহ্য করে হঠাৎ তা চালানো যাবে না, সুতরাং শুধু কাগজে কলমে একটা সর্বগুণসম্পন্ন আদর্শলিপির খসড়া খাড়া করে লাভ নেই। এ কথাও মানতে হবে যে সকলকে বা অধিকাংশ লোককে খুশী করা অসম্ভব। অতএব ক্রমে ক্রমে সইয়ে সইয়ে পরিবর্তন করা ভিন্ন উপায় নেই। যদি জনকতক প্রতিষ্ঠাবান লেখক একমত হয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে নূতন পদ্ধতি মেনে নেন এবং ছাপাখানার কর্তারা তাদের সাহায্য করেন তবে সংস্কার ক্রমশ অগ্রসর হবে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়, সাহিত্যপরিষৎ এবং বিশ্বভারতীর সমর্থন পাওয়া যায় তবে সংস্কার দ্রুততর হবে।

আদর্শ অক্ষরমালা কিরকম হবে সে সম্বন্ধে বোধ হয় বেশী মতভেদ নেই। এমন অক্ষর চাই যা চেনা পড়া ও লেখা সহজ, যাতে জটিলতা নেই, যার গঠনে রেখার বাহুল্য নেই, যার মোট সংখ্যা অল্প, যার যোজনপদ্ধতি সরল; যাতে শুধু বাংলা ভাষার সাধারণ শব্দাবলী নয়, ইংরেজী প্রভৃতি বিদেশী শব্দও মোটামুটি উচ্চারণ অনুসারে লেখা যায়; যা ছাপবার জন্য বিস্তর টাইপ দরকার হয় না, যার গড়ন এমন যে ছাপবার সময় সহজে টাইপ ভাঙে না; এবং যা টাইপরাইটারের উপযুক্ত।

আমাদের বাংলা লিপি সুশ্রী তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উল্লিখিত গুণাবলীর বড়ই অভাব। অক্ষরের জটিল গঠন ও যোতন পদ্ধতির জন্য শিক্ষার্থীকে বিশেষত শিশুকে অনেক কষ্টভোগ করতে হয়। একখানা বর্ণপরিচয় যথেষ্ট নয়, প্রথমভাগ ও দ্বিতীয়ভাগ চাই। ব্যঞ্জনের সঙ্গে যোগ করতে গেলেই স্বরবর্ণের রূপ বদলে যায়। অ-কার অন্তর্হিত হয়, আ-কার এবং ঈ-কার ব্যঞ্জনের পরে বসে, অথচ ই-কার এ-কার ঐ-কার আগে বসে। ও-কার এবং ঔ-কারের আধখানা আগে আধখানা পরে বসে। উ-কার ঊ-কার ঋ-কার সাধারণত নীচে বসে, কিন্তু স্থলবিশেষে ব্যঞ্জনের ডাইনে জোড়া হয়। কতকগুলি যুক্তব্যঞ্জনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একবারে বদলে গেছে। শিক্ষার্থীকে ৪৮টি মূল বর্ণ, ১৩/১৪ রকম স্বরচিহ্ন, য-ফলা রেফ র-ফলা প্রভৃতি ৭/৮টি ব্যঞ্জনচিহ্ন, এবং প্রায় ১৬০টি যুক্তব্যঞ্জন শিখতে হয়। তা ছাড়া অঙ্ক যতিচিহ্ন প্রভৃতি আছে। ছেলেবেলায় এই সমস্ত আয়ত্ত করতে কিরকম কষ্ট পেতে হয়েছিল তা হয়তো এখন আমাদের মনে নেই।

ছাপাখানার অক্ষরসমষ্টি আরও বেশী। ইংরেজী ছাপতে ক্যাপিটাল, স্মল, অঙ্ক এবং যতিচিহ্নাদি সমেত প্রায় ৭০টি টাইপে কাজ চলে, কিন্তু বাংলায় প্রায় ৫০০ টাইপ চাই। এত টাইপ কেন লাগে তা সংক্ষেপে বোঝানো অসম্ভব, সেজন্য তার আলোচনা করব না। আমাদের দেশে যারা টাইপের ছাঁদ উদ্ভাবন করেছে তারা সূক্ষ্মবুদ্ধি শিল্পী নয়, সাধারণ মিস্ত্রী মাত্র, কোনও দূরদর্শী অভিজ্ঞ লোক তাদের উপদেশ দেয় নি। তারা যথাসম্ভব হাতের লেখার নকল করেছে, নিজের রুচি অনুসারে একটু আধটু পরিবর্তন ও অলংকরণ করেছে, কিসে টাইপ সরল হয় তা মোটেই ভাবে নি, অনর্থক সংখ্যা বাড়িয়েছে। কতকগুলি অক্ষর এত জটিল যে ছাপায় প্রায় জুবড়ে যায়। সীসা-অ্যান্টিমনি-ঘটিত যে ভঙ্গুর ধাতুতে টাইপ গড়া হয় তার শক্তির উপর জুলুম করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একটি টাইপ থেকে শাখা বেরিয়ে পাশের টাইপের মাথায় বা নীচে প্রসারিত হয়। এই শাখাগুলি ছাপাবার সময় প্রায় ভাঙে। ইংরেজীতে এইরকম kern টাইপের প্রয়োগ খুব কম।

বাংলা লিপির বদলে নাগরী লিপি চালালে একলিপিবিস্তারের সাহায্য হবে বটে, কিন্তু অন্য কোনও লাভ হবে না, কারণ নাগরী অক্ষর বাংলার তুল্যই দোষগ্রস্ত। আমরা যদি নিজের প্রয়োজনে নাগরী অক্ষর অল্পাধিক পরিবর্তিত করি তা হলে সে পরিবর্তন হিন্দী প্রভৃতি ভাষীর রুচিসম্মত না হতে পারে। সুতরাং নাগরীর মোহ ত্যাগ করাই কর্তব্য।

পণ্ডিতরা বলেন, প্রাচীন ফিনিশীয় লিপি থেকেই হিব্রু আরবী গ্রীক রোমান এবং ভারতীয় লিপিগুলি উদ্ভূত হয়েছে। ভারতীয় লিপির মূল যাই হক, আমাদের পরম সৌভাগ্য যে পশ্চিম দেশীয় বর্বর বর্ণমালা (alphabet) এদেশে আমল পায় নি। প্রাচীন ভারতের ব্যাকরণকার আলফা বিটা গামা, এ বি সি, আলিফ বে পে প্রভৃতি উদ্ধৃঙ্খল বর্ণক্রম পরিহার করে বিজ্ঞানসম্মত অ আ ক খ প্রভৃতি ক্রমে বর্ণমালা সাজিয়েছেন। আমাদের বর্ণসংখ্যা পশ্চিমদেশের চেয়ে বেশী, সেজন্য আমাদের অক্ষর অর্থাৎ বর্ণের লিখিত রূপও বেশী হয়েছে। পাশ্চাত্ত্য বা ভারতীয় কোনও অক্ষরমালা মুদ্রাযন্ত্র বা টাইপরাইটারের অপেক্ষায় সৃষ্ট হয় নি, লেখার জন্যই হয়েছে। দৈবক্রমে পাশ্চাত্ত্য অক্ষরের অল্পতা মুদ্রণের অনুকূল হয়েছে এবং ভারতীয় অক্ষরের বাহুল্য বাধাস্বরূপ হয়েছে। এতে পাশ্চাত্ত্য দেশের বাহাদুরি নেই, আমাদেরও লজ্জার কারণ নেই। বর্ণমালা এবং তার লিখিত রূপ বা লিপি এক জিনিস নয়, প্রথমটি অবিকৃত রেখেও দ্বিতীয়টি বদলানো যেতে পারে। এদেশে তা ঘটেছে। পাণিনির সময় বা তার পূর্ব থেকেই বর্ণমালা প্রায় অবিকৃত আছে, কিন্তু লিপি বা অক্ষরমালার আকৃতি কালে কালে বদলেছে। প্রাচীন সরল ব্রাহ্মী অক্ষরগুলি ক্রমে ক্রমে জটিল হয়ে বাংলা নাগরী প্রভৃতির বর্তমান রূপ পেয়েছে।

রোমান অক্ষর জটিলতাহীন, বহুপ্রচলিত, তাদের বিন্যাসরীতিও সরল, পর পর সাজালেই শব্দচনা হয়, বাংলা বা নাগরীর মতন একটা অক্ষরের সঙ্গে আর একটা জড়াতে হয় না। রোমান লিপির সুবিধা এবং কি উপায়ে তা বাংলা বর্ণমালার উপযোগী করা যায় তার বিশদ আলোচনা অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একাধিক প্রবন্ধে করেছেন। কিন্তু আমাদের অভ্যাস মজ্জাগত, আত্মাভিমানও প্রবল, সেজন্য অত্যন্ত উপযোগিতা সত্ত্বেও রোমান লিপি এখনই প্রচলিত হবার সম্ভাবনা নেই। এখন আমাদের যা আছে তারই যথাসম্ভব সংস্কারচেষ্টা কর্তব্য। এই সংস্কার ক্রমে ক্রমে করতে হবে যাতে অভ্যাস পীড়িত না হয় এবং বর্তমান রীতির সঙ্গে যোগসূত্র সহসা ছিন্ন না হয়।

অনেকে প্রস্তাব করেছেন যুক্তাক্ষরের পরিবর্তে হাইফেন-যোগে অক্ষর সংযুক্ত করা হক। এই পদ্ধতিতে লিখলে বা ছাপলে যোজিত অক্ষরগুলির মধ্যে যে ফঁক থাকবে তা দৃষ্টিকটু হবে এবং লোকে হাইফেনটিকে সংযোগচিহ্ন না ভেবে বিচ্ছেদচিহ্নই মনে করবে। বরং হচিহ্ন ভাল। অনেক শব্দে যুক্তাক্ষরের বদলে হচিহ্ন চলে, তার প্রয়োগ বাড়ালে অভ্যাসে তত বাধবে না। এই চিহ্ন যদি নীচে না দিয়ে অক্ষরগুলির প্রায় মাঝামাঝি বসানো হয় এবং কম হেলানো হয় তবে ফাঁক বেশী হবে না। কিন্তু সংস্কারের আরম্ভেই সমস্ত যুক্তাক্ষর তুলে দিয়ে হচিহ্ন চালানো কঠিন হবে।

কেউ কেউ বলেন, বাংলায় ঈ ঊ ঋ এবং তিন রকম শ ষ স রাখবার দরকার নেই। এই প্রস্তাব গ্রহণীয় মনে করি না। বাংলায় অসংখ্য সংস্কৃত শব্দ আছে, তাদের উচ্চারণ যতই বিকৃত হক ভারতীয় অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বানানের সাম্য রাখা একান্ত বাঞ্ছনীয়। এদেশে সংস্কৃত ভাষার চর্চা লোপ পাবে না, সে কারণেও পূর্ণ অক্ষরমালা আবশ্যক। বিদেশী শব্দের sh এবং s-এর পৃথক উচ্চারণ বোঝাবার জন্য। শ এবং স-এর প্রয়োজন আছে।

আমার প্রস্তাব সংক্ষেপে নিবেদন করছি। অক্ষরসংস্কারের প্রথম ক্ৰম হিসাবে নিম্নলিখিত পদ্ধতি এখনই নেওয়া যেতে পারে।

(১) অনেক শব্দে যুক্তব্যঞ্জন স্থানে হচিহ্ন সহজেই চালানো যেতে পারে, তাতে চক্ষুপীড়া বা উচ্চারণের বাধা হবে না; যেমন ধিককার, বাগদেবী, খড়গ, তগত, সদ্ভাব, উদ্যোগ, প্রগম্ভ, বগা, সদ্ব্যয়। কিন্তু উদ্যান, বিদ্বান্ প্রভৃতি যথাবৎ লিখতে হবে। খণ্ড ত অনাবশ্যক। রেফের পর দ্বিত্ববর্জন করলে যুক্তব্যঞ্জন কমবে। বহু অসংস্কৃত শব্দে যুক্তব্যঞ্জন বাদ দেওয়া যেতে পারে, অনেক স্থলে হচিহ্নও না দিলে চলে যেমন নকশা, আড্ডা, সরদার, পরদা, উলটা। এর ফলে যুক্তব্যঞ্জন খুব না কমলেও হচিহ্ন প্রয়োগের অভ্যাস বাড়বে এবং ক্রমশ আরও বাড়ানো সম্ভবপর হবে।

(২) যুক্তব্যঞ্জনের অঙ্গীভূত অক্ষরগুলির মূল রূপ যথাসম্ভব অবিকৃত রাখতে হবে। এ বিষয়ে আচার্য যোগেশচন্দ্রের রীতি গ্রহণীয়। লাইনোটাইপে অনেকটা তা করা হয়েছে। জ্ঞ এবং ক্ষ এই দুই অক্ষরের বাংলা উচ্চারণ অত্যন্ত বিকৃত, সেজন্য এখন বর্তমান আকৃতিই রাখা ভাল।

(৩) হিন্দী মারাঠী প্রভৃতি ভাষায় বগীয় বর্ণের পূর্বে সেই বর্গের পঞ্চম বর্ণ যোগ হলে সাধারণত পঞ্চম বর্ণের প্রতীকস্বরূপ অনুস্বার দেওয়া হয়, যেমন রংগমংচ, পংডিত, নংদ, কংপ। অবশ্য উচ্চারণ পঞ্চম বর্ণ অনুসারেই হয়। আজকাল কয়েকজন সাহসী বাঙালী লেখক কবর্গের পূর্বে প্রায় সর্বত্র ঙ স্থানে অনুস্বার দিচ্ছেন, যেমন অংক, সংগে। এই রীতি সকল বর্গেই প্রচলনযোগ্য, কিন্তু উচ্চারণে বাধতে পারে। যদি অনুম্বারের পুচ্ছ বাদ দেওয়া যায় তবে গোল চিহ্নটি সকল পঞ্চম বর্ণের প্রতীকরূপে গণ্য হতে পারে, অনুস্বার বলে ভ্রম হবে না। এর ফলে ২০টি যুক্তব্যঞ্জন কমবে এবং নূতন পদ্ধতি অভ্যাস করতেও অসুবিধা হবে না।

(৪) তুচ্ছ কারণে ছাপাখানায় টাইপের বাহুল্য করা হয়েছে। শব্দের আদিতে মধ্যে ও শেষে দেবার জন্য দুরকম এ-কার আ-কার এবং ণ অনাবশ্যক। লাইনোটাইপে একই রকম অক্ষরে কাজ চলছে, সাধারণ টাইপেও চলবে। অনেক টাইপে ব্যঞ্জনের সঙ্গে ই-কার ঈ-কার উ-কার ঊ-কার ঋ-কার য-ফলা রেফ এবং চন্দ্রবিন্দু জোড়া আছে। এই বাহুল্য অনাবশ্যক। সর্বত্র ই-কার উ-কার য-ফলা প্রভৃতি পাশে বসিয়ে দিলেই কাজ চলে, যেমন লাইনোটাইপে।

(৫) লাইনোটাইপে এক নূতন উপায়ে অনেকগুলি যুক্তব্যঞ্জনের টাইপ কমানো হয়েছে। গ ণ দ ন প ম ল শ ষ স অক্ষরের ডান দিকের রেখাঁটি বাদ দিয়ে কতকগুলি অর্ধ-টাইপ করা হয়েছে। এইগুলির পাশে অন্য ব্যঞ্জনের পূর্ণ-টাইপ বসিয়ে দিলেই যুক্তাক্ষর তৈরি হয়, যেমন গ্ল ন্ট দগ দ ল্ক শ্চ স্ন ষ্ট। এই উপায়ে প্রায় ৭৬ টাইপ কমেছে। সাধারণ টাইপেও এই পদ্ধতি গ্রহণীয়।

অক্ষর সংস্কারের দ্বিতীয় ক্রমে অধিকাংশ যুক্তব্যঞ্জনের জায়গায় হচিহ্ন চালাতে হবে। য-ফলা, র-ফলা, রেফ, এবং যেসব যুক্তব্যঞ্জন শব্দের গোড়ায় বসে, যেমন ক্ল ক্ষ গ্ল জ্ঞ প্ল ব্ল ম্ল প্রভৃতি, তখনও হয়তো ছাড়া চলবে না। প্রায় এগার বৎসর পূর্বে শ্রীযুক্ত অজয়চন্দ্র সরকার এই রকম প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সমস্ত যুক্তব্যঞ্জন বাদ দিয়েও আমরা আদর্শ লিপিতে পৌঁছতে পারব না। যদি মূল বর্ণগুলির আকৃতি সরল করা হয় এবং আ-কার ই-কার প্রভৃতির যোজ্য চিহ্ন তুলে দেওয়া হয়, অর্থাৎ অক্ষরমালার আমূল পরিবর্তন হয় এবং স্বরব্যঞ্জননির্বিশেষে সকল অক্ষর পাশাপাশি বসিয়ে শব্দরচনা হয়, তবেই সকল বাধা দূর হবে।

অক্ষর সংস্কারের শেষ পর্যায় কি? আশা করি তত দিনে আমাদের স্বরাজ্যলাভ এবং আত্মমর্যাদার প্রতিষ্ঠা হবে, উদ্যম বাড়বে, বুদ্ধি মোহমুক্ত হবে। তখন নানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অক্ষরেরও চূড়ান্ত সংস্কার করতে দ্বিধাবোধ করব না। নূতন অক্ষর উদ্ভাবনের প্রয়োজন কি? রোমান লিপি আমাদের সুপরিচিত, বাংলা বর্ণমালার লিখিত রূপ হিসাবে এই রোমান অক্ষর চালানোই সুসাধ্য। বুদ্ধিমানের দৃষ্টিতে ক-অক্ষর বা k-অক্ষর কোনওটি গোমাংস নয়। যদি আমরা ক নাম দিয়েই k অক্ষর চালাই তাতে ক্ষতি কি? ইওরোপ যেমন সুবিধাজ্ঞানে ভারতীয় মঞ্চ এবং দশমিক গণনাপদ্ধতি নিয়েছে আমরাও সেইরকম রোমান লিপি আত্মসাৎ করতে পারি, তার জন্য দীনতার গ্লানি আমাদের স্পর্শ করবে না।

[হাতের লেখা আর ছাপার টাইপ সমান হতে পারে না। লেখার টানে অক্ষর অম্লাধিক জড়িয়ে যায়। কিন্তু ছাপায় অক্ষরের স্বাতন্ত্র্য অত্যাবশ্যক। শতাধিক বৎসর পূর্বে হাতে লেখা পুঁথির গোটা গোটা অক্ষরের নকলে টাইপের যে ছাঁদ হয়েছিল এখনও তাই চলছে। আধুনিক হাতের লেখার সঙ্গে তার অনেক প্রভেদ। যদি টাইপের ছাঁদ কিছু বদলানো হয় তবে এই প্রভেদ বাড়বে না।

এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, আজকাল বইএর মলাটে এবং পণ্য বস্তুর বিজ্ঞাপনে অনেক রকম বিকৃত অক্ষর দেখা যাচ্ছে। অক্ষরকার বোধ হয় মনে করেন যে দুপাঠ্যতাই আধুনিকতার লক্ষণ। কিছুকাল পূর্বে আমার কয়েকজন বন্ধু একটি পত্রিকার মলাটে ছাপা নামটি অনেক চেষ্টা করে পড়েছিলেন–তাড়ী। কিন্তু নামটি প্রাচী। এইরকম বিকৃত অক্ষরে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য পণ্ড হয়। ইংরেজী বিজ্ঞাপনে উৎকট অক্ষর দেখা যায় না।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *