Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বর্ণপ্রথা আর সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় || Purabi Dutta

বর্ণপ্রথা আর সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় || Purabi Dutta

বর্ণপ্রথা আর সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বর্ণপ্রথার প্রভাব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পক্ষে এক অভিশাপ, এ এক কুৎসিত ব্যাধির নামান্তর । এ প্রথা আর কোন ধর্মে এমন বলবৎ নেই। কয়েক দশক আগে রবীন্দ্রনাথের শিশুপাঠ্য “সহজপাঠ” এর বিকল্প পুস্তক প্রচলন হয়েছিল। কারণ , রবীন্দ্রনাথের লেখায় নাকি শিশুদের মনে বর্ণ বৈষম্যের প্রভাব পড়বে, যেমন তিনি লিখেছেন “মালি ফুল পাড়ে…..”

যিনি বাগান পরিচর্যা করেন, তিনি মালি,যিনি সোনার গহনা গড়েন তিনি স্বর্ণকার, যিনি রান্না করেন তিনি রাধুনি,যিনি শিক্ষা দান করেন তিনি শিক্ষক, যিনি পূজো করেন তিনি পুরোহিত, যিনি গাড়ি চালান তিনি গারোয়ান বা চালক, যিনি দোকানের সওদা বিক্রী করেন তিনি দোকানদার ইত্যাদি…… এটা তাদের বর্ণ বা রঙ,যে রঙে তাদের চেনা যায়, অসুবিধে কোথায়? ঠিক বর্ণপ্রথা বলতে যা বোঝায় তা কিন্ত নয়। তাহলে প্রচলিত বর্ণপ্রথা কথাটির তাৎপর্য কি?

আসুন দেখা যাক ,ঋগ্বেদে কি বলেছে আর পুরাণ কি বলেছে আর বর্তমান যুগে হিন্দুদের এই বর্ণপ্রথার বিভেদের প্রভাব কেমন? কথায় বলে “জাত পাত বর্ণ”— ঋগ্বেদ অনুসারে, বৈদিক যুগে জাতি বলতে ছিল , দুরকম— আর্য ও অনার্য। তফাৎ ছিল চেহারায়, দেহাকৃতিতে, শক্তিতে , ধর্মাচরনে, বেশভুষায় ও খাদ্যাভাসে। আর্যরা অনার্যদের ধনরত্ন কামনা করতেন, এবং অনার্যদের সমীহও করতেন। কিন্ত কোন ছুৎমার্গ ছিল না। উল্লেখ্য, আর্যরা ইন্দ্রর কাছে কাতর কামনা করতেন— ঋগ্বেদ– ৩৷৫৩৷১৪ লিখেছেন ঋষি– বিশ্বামিত্র, ইন্দ্র ও পর্বত দেবতা “হে মঘবন, নীচ বংশীয়দের ধন আমাদের প্রদান করো।”

ঘৃণ্য জাতিভেদপ্রথা বলে কিছু ছিল না। সকলের জন্যই ঋষিরা ইন্দ্রর কাছে প্রার্থনা করতেন, ঋক্– ১৷৮১৷৬ লিখেছেন গৌতম ঋষি, পংক্তি ছন্দে। “ইন্দ্র যজমানকে মানুষের অন্ন প্রদান করেন, তিনি আমাদের সেইরূপ অন্ন প্রদান করুন। ইন্দ্র, আমাদের ধন বিভাগ করে দাও, কারণ তোমার অসংখ্য ধন,আমি তার একাংশ প্রাপ্ত হতে পারি।” সাম্য সমাজবাদ চিন্তাধারা। হিন্দুধর্মের বর্ণ বা আশ্রম ঋগ্বেদের যুগেই উৎপত্তি হয়েছিল। চতুর্বর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,বৈশ্য, শুদ্র ঋগ্বেদ–১০৷৯০৷১২ “ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্বাহু রাজন্যঃ কৃতঃ। ঊরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভাং শূদ্রো অজায়ত।।” লিখেছেন — ঋষি নারায়ণ, ছন্দ –অনুষ্টুপ, ত্রিষ্টুপ। দেবতা– পুরুষপ্রকৃতি পুরুষের মুখ হলো ব্রাহ্মণ, বাহু হলো রাজ্ন্য অর্থাত ক্ষত্রিয়, উরু ছিল বৈশ্য,দুচরণ শুদ্র। ছিল কর্ম অনুসারে বর্ণ , পুরুষানুক্রমে নয়। ঋগ্বেদ ৯৷১১২৷১,২,৩,৪ ঋষি–শিশু, ছন্দ– পংক্তি, দেবতা সোমদেব। সারকথা হলো, “হে সোমদেব, সকল ব্যক্তির কার্য এক নয়, ভিন্ন ভিন্ন প্রকার…” বৈদিকযুগে, সমাজে ছিল নানা বৃত্তি বা পেশা। পুরুষদের মুখনিঃসৃত ছিলেন ঋষিরা,তারা বিদ্যার প্রতিভু, শিক্ষা দান করতেন। বাহু উদ্ভূত ক্ষত্রিয়রা বাহুবলে বা শক্তিপ্রদানে সংসারের সকলকে রক্ষা করতেন। উরু থেকে বৈশ্য, যারা গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য নানা পেশায় নিযুক্ত থেকে সংসার প্রতিপালন করতেন। আর দু-চরণ থেকে উদ্ভূত শুদ্র শ্রেণীরা সকলপ্রকার কর্ম ( পরিচ্ছন্নতা বজায় , রন্ধন, যাবতীয় গৃহস্থালী কর্ম ইত্যাদি) করে সংসার যাত্রা চালিত করতেন। কিন্ত কোন ক্ষেত্রেই জন্মগতভাবে বর্ণ পরিচিতি পেতেন না, কেউ। জাতিবিধি ছিল না। ঋগ্বেদ– ৯৷১১২৷১,২,৩,৪ একই সংসারে, বাড়ির কর্তা ব্রাহ্মণ, এক ছেলে ক্ষত্রিয়, এক ছেলে বৈশ্য, কন্যা ও বঁধুরা শুদ্র শুধুমাত্র কর্ম অনুসারে। অসবর্ণ বিবাহও নির্বাহ হতো।

তারপর পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মে এলো স্মৃতিশাস্ত্র “পুরাণ ” (জাতি বর্ণ জন্ম কথা, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ) ৩৪ জন দেবদেবীর পুতুলপূজা। পণ্ডিত পুরাণ শাস্ত্রকরদের নানাবিধ সমাজ নিয়ন্ত্রণ বিধির ব্যবস্থা। শুরু হয় জন্মগতভাবে বর্ণ প্রথা। ব্রাহ্মণ ঋষির বংশধর আকাট মূর্খ হলেও স্থান সবার উপরে। হাড়ি মুচি ডোমের ছেলে বিজ্ঞ হলেও সে শুদ্র । নানাভাগ উচ্চ নীচ তা ব্রাহ্মণ শ্রেণীতেও কম নয়, সবার উপরে আবার কুলীন। কায়েতের মধ্যেও নানা উচ্চ নীচ বর্ণ— বনিক বা বৈশ্যরা আবার পেশাগতভাবে বিভিন্ন শ্রেণীর। এলো নানাভাবে কৈবর্ত , ময়রা,ধোপা, নাপিত,কামার, কুমার , মুচি, চণ্ডাল, ডোম মেথর !!!! বাপরে—–

আমার মলমূত্র কোন এক মেথর নাম্নী মানুষ পরিষ্কার করছেন, লজ্জার চূড়ান্ত মাত্রার কি কোন প্রতিশব্দ আছে?

আর এলো উচ্চ বর্ণের লোকদের নিম্ন বর্ণের প্রতি ভয়াবহ ছুৎমার্গ প্রথা পালন, যেখানে ছায়া মাড়ালেও রাত বিরাতেও স্নান করতে হতো( এখনও আছে কিন্ত কোথাও কোথাও বহাল তবিয়তে এ নিয়ম)। বর্ণ বৈষম্যের এই অভ্যাস নারী পুরুষ সবাই কিন্ত বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতেন। মুখ বুজে, ” আরাম সে” । শিশুরা বড়দের দেখে শেখে, নিজেও সে আবর্তে ঘুরতে থাকে নিরন্তর, পরবর্তী কালে।

একান্ত ভাবে জন্মগত এ বর্ণ মেনে নিতেন নিম্ন বর্গের লোকেরাও, যেন জন্ম যখন হয়েছে, আর কি করা !!! প্রতিবাদ এলো অতি ধীরে, মেনে নিতে হচ্ছে অতি ধীর শম্বুক গতিতে। একেশ্বরবাদের প্রভাবে ধর্মান্তরিত হবার জন্য হিন্দু সংখ্যা হ্রাস। ঝড় উঠল সাহিত্যেও । শরৎচন্দ্রের ” বামুনের মেয়ে” বা রবীন্দ্রনাথের “গোরা” শিক্ষিতকুলের চোখ খুলে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। তবুও কি হলো, হায়, পুরষ সমাজ এগিয়ে এলেও নারী বা মহিলা কুলই প্রবল আপত্তির বিপাকে। ছুৎমার্গ ব্যাধি শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মজ্জায় মজ্জায় বহমান কুঞ্চিত শোণিত প্রবাহ বহু জনম ধরে বিদ্যমান।

কয়েকদিন আগে , বাংলাদেশের এক বাচিক শিল্পী, “রেজাউল হোসেন টিটো ” , “ছায়ানট ” সংস্থার আহ্বানে, কলকাতা এসে, নানা অনুষ্ঠানের অবকাশে ২২শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শরৎ সমিতির (শরৎচন্দ্রের বাসভবন)সভাগৃহে, কিছু বক্তব্য রাখেন ও কবিতায় ঝড় তুলেছিলেন। না, এটা ” ধান ভাঙতে শিবের গীত নয়”। তিনি তার কথায় একটু ছুয়েছিলেন, হিন্দুদের ছুৎমার্গ অভ্যাসের প্রসঙ্গ। বলেছিলেন, ” দুর্গোৎসবের বিজয়া মহা উৎসবে ছোটবেলায় আমরা মুসলিম ছেলেরাও হিন্দুদের বাড়ির উঠোনে জমায়েত হতাম,খুব ভালো লাগত –ঐ নাড়ু, তক্তির লোভে আর কি, বাড়ির মা-বোনেরা আমাদের দু-হাত ভরে দিতেন আলতো করে, ছোওয়া বাঁচিয়ে। আর এও জানতাম , আমরা চলে গেলে, তারা উঠোন, গোবর জল বা গঙ্গা পানি দিয়ে পবিত্র করবেন।” আমাদের সকলের মুখে হালকা নীরব দুষ্ট মিষ্টি হাসি, কবির মুখেও হাসি।

এটা ঠিক, জাতবর্ণের ব্যাপারটিতে অন্দর মহলের নারীরাই কট্টর ছিলেন বেশি। এখন অনেক অনেক শিথিল, সন্দেহ নেই, তবে পূর্ণ সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠতে সময় লাগবে। কারণ, বংশ পরম্পরায় এ ব্যাধি আমাদের শরীরের স্মৃতিতে। ধরুন, আপনার শরীর মন খুব খুব তৃষ্ণার্ত — এক গ্লাস জল চাইলেন, পরিচ্ছন্ন পোষাকে, পরিষ্কার গ্লাসে জল এনে দিলেন এক মহিলা, তৃপ্তি করে খাবার পর প্রথম জানলেন, ঐ মহিলা একজন মেথরানি ! কি হবে !!! বিদ্যুতের মতো এক শীতল শিহরণ আপনার হাড় মাস মজ্জা দিয়ে বয়ে যাবে এক ঝলক। অস্বীকার করতে পারবেন কি?

ঠিক যেমন কোন রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের কোন এক যুবক প্রথম যখন গোমাংস মুখে তোলেন, অনুভূতি তথৈবচ। এ হলো সংস্কার—- মন থেকে তাড়িয়ে দিলেও, বাসা বেঁধে আছে দেহে, বংশানুক্রমিক, বলা যায় জিন এ। তবে আশা— এও একদিন চলে যাবে যেদিন, সেদিন হিন্দুধর্মে মানুষের পরিচয় শুধু “মানুষ” হয়ে উঠবে। কথেশিল্পী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কোন জাত পাত বিচার ছিল না। ব্রাহ্মণ হয়েও তিনি হিন্দু বর্ণবৈষম্য ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে ছিলেন। উপন্যাস “বামুনের মেয়ে” তে সবার কাছে এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন তুলে ধরেছেন “মানুষ” নামক এক জীব-জন্মের। কবে হবে মানুষ শুধুই মানুষ!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress