বর্ণপরিচয়
তারাপদ বিশ্বাস, হৃদয়পুরের তারাপদ বিশ্বাসের মাথায় ব্যাপারটা কিছুতেই ঢোকে না যে, এইসব মিছিল-টিছিল করে কার কী লাভ! সেরেফ চেল্লানি, রাস্তা জুড়ে শাহেনশা ঠাটে পা ফেলা, ট্রাম বাস জ্যাম করে একটা মাতব্বরি দেখানো, তারাপদ বিশ্বাস মনে-মনে এই কথাই বলে। বেশ কিছুকাল থেকেই ওর একটা ধারণা ছিল, যতসব মায়ে-তাড়ানো বাপে-খেদানো ছেলেদের নিয়ে কিছু উঠতি নেতা-গোছের লোক শ্যালদা থেকে রিফুজি জুটিয়ে এইসব মিছিল-টিছিল করে। অবশ্য অফিসে এসে তারাপদর ধারণাটা একটু মোড় নিয়েছিল, ব্যাপারটা ও সাজিয়েছিল এই রকম, এরা যখন কথায়-কথায় মিছিল, টিফিনে গরম বক্তৃতা হেই করেঙ্গা সেই করেঙ্গা করছে তখন এটা এদের কাছে নেশার মতো হয়ে গেছে। মদ খাওয়ার মতো মিছিলে শ্লোগান দেওয়া একটা জব্বর রবরবা নেশা। লোকগুলো খোলা মাঠে যাত্রা করতে পারে। কোথায় ভিয়েতনামে কী হচ্ছে, কোথায় মালয়েশিয়ায় কারা মরল, চলো ময়দান। তারাপদ নিশ্চিত, মনুমেন্টটা একদিন পুরো নীল হয়ে যাবে বিষে। আর হ্যাঁ, রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে শ্লোগানে গলা মেলানো ফুটপাত ভরতি লোকের সামনে, আর লোকগুলো যেমন ড্যাবডেবে চোখে গেলে, কেমন লাগে তারাপদর। ফুটপাতের লোকগুলো যেন সার্কাস দেখে। প্রতিক্ষণেই মনে হয় এই কেউ দেখে ফেলল। বলবে, কেরানি তারাপদটা মিছিল করছিল। মরে গেলেও লাশ পাঠাব না মিছিলে। এই তো সেদিন একটা বড়বাজারি লোককে সে বলতে শুনেছিল, নোকরলোক যাতা হ্যায়। এসব কথা যে কারও সঙ্গে ক্লিয়ার করে বলবে তার উপায় নেই। কানে কানে খানখান হবে যে তারাপদ বিশ্বেসটা দালাল। অথচ কালই তারাপদর সঙ্গে ঘাটে পা রাখা বুড়োটার দেখা হয়েছিল। পুব বাংলার ঘি-হাতের গন্ধ বয়ে বেড়ানো একটি নিঃস্ব, রুগ্ন না খেতে পাওয়া বৃদ্ধ ট্যাঁক থেকে একটা টাকা বের করে দাঁতহীন মাড়িতে হেসেছিল। প্রত্যেক মিছিলে ওর আয় একটা টাকা। গ্রাম থেকে ময়দান। এক-একদিন দুটো কি তিনটে মিছিলেও গেছে লোকটা।
অথচ অফিসে কারওর সঙ্গে খোলামনে কথা বলা যাবে না। খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। দিনগুলো। এর চেয়ে ইংরেজ আমল ভালো ছিল। ভাবতে চেষ্টা করল তারাপদ। ম্যাট্রিক পাশ করে অফিসে ঢুকেছিল সে। এখন সরকার তাকে যা দেয়, কোন ম্যাট্রিক পাশ তা পায়! বাড়িতে তিনটে গাই আছে, ভালো দুধ দেয়। শাকসবজির বাগান আছে, ধানভূমি আছে হৃদয়বিলের গা ঘেঁষে। বাজারে যেতে হয় কদাচিৎ। আর বাবুরা এদিকে গণ্ডাগণ্ডা বায়োস্কোপ দেখবেন, টাকাটা খসিয়ে টিফিন হয় না, টেরিলিনের চেকনাই আছে ষোলো আনা। আবার এদিকে মাগগি ভাতা বাড়াও বলে চেল্লানি!
আজ অফিসে ঢোকার সময় তারাপদ দেখেছে দেওয়ালে-দেওয়ালে পোস্টার পড়েছে, নূন্যতম মাগগি ভাতার দাবীতে আগামী দশই ধর্মঘট। তারাপদ দেওয়ালঘড়ি দেখল, তিনটে বেজে কুড়ি। বিয়েতে পাওয়া ঘড়িটা বউয়ের সুটকেসে রেখে দিয়েছে সে। শালা যা শহর, ছিনতাই তো। জলভাত। তারাপদ সিট ছেড়ে উঠল। একটু বাদেই গেটে লোক দাঁড়িয়ে যাবে। তখন আর একটি মাছিকেও গলতে হচ্ছে না। যেন গরু তাড়িয়ে নিয়ে যায় মনুমেন্টে বাঁধতে। বিকেল চারটে দুই এর ট্রেনটা ধরতে পা চালাল তারাপদ। ডালহৌসি থেকে পায়ে হেঁটে শ্যালদা।
বড়বাবুটা বেলুনের জাত, নইলে তারাপদকে আজ দশ বছর রিসিভিং সেকশনে ফেলে রাখবে। কেন? সেই চিঠি রিসিভ করে খাতায় এন্ট্রি করা–অবশ্য তারাপদর এটা খারাপ লাগে না। মাথা ঘামানোর তো দরকার নেই এতে। অবশ্য ওর জুনিয়রগুলো রিসিভিং থেকে সেকশনে, সেখান থেকে ইন্সপেক্টর হয়ে যাচ্ছে দুমদাম করে। এইখানটায় ওর একটু খারাপ লাগে। সার্ভিস বুক। দ্যাখো, তারাপদ বিশ্বাস লেট হয়নি একদিনও, কাজুয়েল লিভ পচেছে তবু কামাই কড়ে আঙুলে গোনা যায়। অফিসে একটু কমই কথাবার্তা বলে সে। নতুন ছোঁড়াগুলো সিনেমা আর পলিটিক্স নিয়ে যে রকম মস্তানি করে তারাপদর প্রবৃত্তি হয় না কথা বলতে। অফিস কাঁপিয়ে ট্রানজিস্টার বাজিয়ে ক্রিকেট-রিলে শুনছে কেউ কিছু বলার নেই। অথচ ওরা যখন ঢুকেছিল? তারাপদ এখনও সিট ছেড়ে ওঠে না পারতপক্ষে। বাড়ির চিড়েভেজানো নলেনগুড়ের টিফিনেই শেষ দশটা বছর কাটিয়ে দিল। আজ অবধি প্যান্টের চোঙায় পা গলায়নি সে। শার্ট ধুতিতেই সে অভ্যস্ত। শ্যালদা থেকে ডালহৌসি আসে হেঁটে। ট্রামের খরচা বাঁচে। আর যা ভিড়। তারাপদর বায়ু কুপিত হয় ট্রামে উঠলে। একেই বেশি বয়সে বিয়েটা করল সে। মা নেহাত পায়ের হাজার কষ্ট পাচ্ছে। ইদানীং, তাই। তেলেনিপাড়ার মেয়ে। বয়স তারাপদর অর্ধেক, সতেরো হবে, কথা বলে চটপটির মতো। স্বাস্থ্য জব্বর। বিয়ের সময় তারাপদ শুনেছিল, কনের বন্ধুরা বলছে, ওমা, এ যে কাঠ। কয়লা-গো–শুটকি মাছ! তা বলুক! তারাপদর দিদিমা বলতেন, হীরের আংটি বাঁকা, শোনো কথা!
কলকাতা থেকে মিনিট পঁয়তাল্লিশের রাস্তা হৃদয়পুর। স্টেশন থেকেই তারাপদর বাড়ির লম্বা সুপরিগাছের মাথাটা দেখা যায়। খুব অস্বস্তি নিয়েই ফিরল তারাপদ। ধর্মঘট যত এগিয়ে আসছে অস্বস্তিটা তত বাড়ছে। আজ কর্তৃপক্ষ সার্কুলার দিয়েছে, ধর্মঘটে যে যোগ দেবে, সরকার তার চাকরির নিশ্চয়তা দেবে না। আবার এদিকে ইউনিয়ন থেকে ইস্তাহার এসেছে, কমরেড, আমরা প্রাণ থাকতে কোনও দালালকে অফিসে ঢুকতে দেব না। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ–তারাপদ থুথু ফেলল।
ঘরে ঢুকতেই নতুন বউ একগাল হাসল–এত তাড়াতাড়ি এলে যে।
এলাম। তারাপদ বলল।
বাব্বা, কি সৌভাগ্য!নতুন বউ হাত ঘুরিয়ে খোঁপা বাঁধতে-বাঁধতে বলল, জানো, আজ বাবার চিঠি এসেছে।
কী লিখেছেন? তারাপদ শার্ট খুলছিল।
এইসব বাড়ির কথা আর কী। আর হ্যাঁ, সতু ছাড়া পেয়েছে।
সতু কে? তারাপদ অবাক হল।
সতু গো। আমাদের পাশের বাড়ির ব্রজ মাস্টারের ছেলে। বিয়ের সময় আমার পিঁড়ি ধরেছিল, দ্যাখোনি!
তারাপদ মনে করতে পারল না সঠিক। কী হয়েছিল তার?
বাঃ তোমাকে বললাম না সেদিন। ধর্মঘটের দিন পুলিশ যখন গুলি করছিল, সতুরা সব ওদের। কারখানার সামনে ইনকিলাব জিন্দাবাদ করছিল। সে কি মারামারি! সতুর মাথা ফেটে গেল। কী রক্ত! বাবা দেখেছে। তা পুলিশ ওদের সবাইকে ধরে চালান দিয়েছিল।
তারাপদ গম্ভীর হল শুনে। তারপর নিজের মনেই যেন বলল, তা ওরা ওসব মাতব্বরি করতে গিয়েছিলই বা কেন?
নতুন বউ যেন অবাক হল, ইস, কেন করবে না! ওদের বেশি খাঁটিয়ে কারখানায় কম মাইনে দিত যে!
তারাপদ বেরিয়ে এল। খুব বিরক্তি লাগছিল তার। বাড়িতেও যদি এসব কথাবার্তা শুনতে হয়, তাহলে—। তারাপদ মনে-মনে ঠিক করে নিল, বউকে পারতপক্ষে তেলেনিপাড়ায় পাঠাবে না।
ধর্মঘটের জোর প্রস্তুতি চলছে। তারাপদ অফিসে কদিন গুম হয়ে রইল। বাড়িতে অর্ধসাপ্তাহিক একটা খবরের কাগজ আসে ওদের অনেকদিন থেকে। তাতে ফলাও করে ধর্মঘটের কথা লিখেছে। পড়ে বউ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তারাপদ এড়িয়ে গেছে।
ধর্মঘটের আগের দিন সকালে তারাপদ অনেকক্ষণ ঘুমোল। বউ অনেকবার ডেকে ফিরে গেল। বেলায় তারাপদ ছুটি-ছুটি মুখ করে উঠল। উঠে কোনওদিন তারাপদকে কামাই করতে দ্যাখেনি। কেন?
বাঃ, কাল ধমর্ঘটনা? বলল, আজ অফিসে যাচ্ছি না।
নতুন বউ অবাক হল। তার বিয়ের পর সে—
তাতে কী হয়েছে?
আশ্চর্য! তারাপদ হাসল, তুমি তেলেনিপাড়ার মেয়ে হয়ে জানো না?
তারপর খুব গাঢ় স্বরে বলল, কাউকে বলো না যেন, আমরা আজ রাত জাগব। অফিসে একটা ভলান্টিয়ার পার্টি হয়েছে। আজ রাত থেকে কাল বিকেল অবধি আমরা অফিসে পাহারা দেব। যাতে কেউ অফিসে না ঢুকতে পারে।
নতুন বউ ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল প্রথমটায়, তারপর সারা মুখে ঝরনা ঝরাল, ওমা তুমি ভলান্টিয়ার হবে নাকি, কি মজা! তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, হ্যাঁগো, গোলমাল হবে না তো?
ঠোঁট ওলটালো তারাপদ, কী জানি!
পুলিশ-টুলিশ দেখলে সামনে যেও না, লক্ষ্মীটি!
তারাপদ ভারিক্কী গলায় হাসল, ক্ষেপেছ! তবে বুঝলে কিনা, নেতা হয়ে আর পিছিয়ে থাকি কী করে! অবিচার দেখলে আমি আবার কেমন হয়ে যাই।
সন্ধের কিছু পরে তারাপদ ট্রেন থেকে নামল। শীতের রাত। সন্ধেতেই রাতটা যেন অনেক দূর গড়িয়ে এসেছে মনে হয়। আর শীতটাও যেন কলকাতায় জম্পেশ করে নেমেছে। তারাপদ ওর লাল আলোয়ানটা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে বাঁ-হাতে টিফিন কেরিয়ার ভরতি লুচি তরকারি নিয়ে ট্রামে উঠল। তারাপদের হাতটা বড় ঘামছিল। এবং এই প্রথম সে ট্রামে উঠল অফিসের পথে।
অফিসের আগের স্টপেজে তারাপদ নেমে পড়ল। দোকানগুলো বন্ধ হচ্ছে সে দেখতে পেল। হ্যারিসন রোড ধরে এগিয়ে এসে স্ট্র্যান্ড রোডের মুখে একটা বিড়ির দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল সে। রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। ফুটপাথের এককোণে আগুন জ্বেলে গোল হয়ে কতগুলো দিনম জ্বর হাত-পা সেঁকছে। তারাপদ একটু এগিয়ে তাদের অফিস দেখতে পেল। অফিসে সামনেটা ফাঁকা। একটা ভাঁড়ের চায়ের দোকান ছিল অফিসের গায়ে–সেটাও বন্ধ। ব্রেবোর্ন রোডের মুখে একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখল সে। কোনও পরিচিত বা সন্দেহজনক মুখ তার চোখে পড়ল না। একটু বাদেই পাশের পুলিশ আউটপোস্টে নটা বাজার ঘণ্টা শুনতে পেল। তারাপদর এই ঠান্ডাতেও কপালে ঘাম হচ্ছিল। তারাপদর একবার মনে হল ফিরে যায়। এখনও হৃদয়পুরে যাওয়ার ট্রেন আছে কয়েকখানা। পরমুহূর্তেই পা ভারী হল তার।
ফুটপাথের ধার ঘেঁষে তারাপদ অফিসের পেছনের দরজায় এল। তারপর চট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ওদের অফিস ছ-তলায়। লিফটে যাওয়া-আসা অভ্যেস, এখন সিঁড়ি ভাঙতে হবে। অন্ধকার বাড়িটায় কোনও শব্দ নেই। তারাপদ খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে পা টিপেটিপে ওপরে উঠতে লাগল। এই অন্ধকারে তারাপদ যেন তার বুকের ড্রামে কে যেন দ্রুত ঘা মেরে চলেছে টের পেল। অন্ধকারে হোঁচট খেতে-খেতে চলল এগিয়ে। তার নিজের পায়ের শব্দ যেন দেওয়ালে দেওয়ালে মারামারি করে চতুর্গুণ হয়ে তার কানে ফিরে এসে তাকে চমকে দিচ্ছিল। ছ-তলায় উঠে সিঁড়ির বাঁকে দাঁড়াল তারাপদ। সে ভীষণ হাঁপিয়ে পড়েছিল এবং শীতেও তার বেশ গরম হচ্ছিল। অফিসের লম্বা করিডোর অন্ধকার। কেউ নেই কোথাও। তারাপদ ধীরে-ধীরে এগোল। ওদের অফিসঘরটার কোলাপসিবল গেটে তালা মারা। করিডোরটার এক প্রান্তে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সে। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না এখন। এত কালো অন্ধকারে তারাপদ। কখনও দাঁড়ায়নি। ওর হঠাৎ ভয়-ভয় করছিল। সামনেই গঙ্গা, ওপারে হাওড়া স্টেশন। দারুণ। হাওয়া আসছে। করিডোরের অপর প্রান্তের গঙ্গার দিকের জানলাটাদারোয়ানটা হয়তো ভুল করে বন্ধ করেনি। হাওয়ার ঝাঁপটায় জানলার পাল্লাটা দড়াম-দড়াম করে শব্দ করছে। তারাপদ প্রথমটায় চমকে উঠেছিল। এখন তার শীত করতে লাগল। তারাপদ একটু-একটু করে এগোল। অন্ধকারটা ক্রমে-ক্রমে চোখ সওয়া হয়ে আসছিল ওর। করিডোরের অন্য প্রান্তে এসে তারাপদ চমকে উঠল। একটা হিমহিম স্পর্শ যেন তার রক্তে ছুঁয়ে যেতে লাগল। তারাপদর হাঁটু দুটো ঠকঠক করে কাঁপছিল। সে মুখ ফেরাল কোনও মতে। করিডোরের কোণায় একটা ঘুপচি মতন জায়গায় যেখানে এতদিন পুরোনো ফর্ম এবং বাজে কাগজের তাড়া জমা থাকত, তারাপদ দেখেছে সেখানে একটা আগুনের ফুলকিকে সে জোনাকির মতো দেখতে পেয়ে কিছু চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। এই সময় তারাপদ খকখক শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা সামান্য বিরতি। দিয়ে হতে লাগল। তারাপদ সমস্ত লোমকূপগুলো পদ্মকাঁটার চেহারা নিল। সে কিছুতেই কোনও ঠাকুর দেবতার নাম স্মরণ করতে পারল না। আবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই আগুনের ফুলকিটা। ঝলকে উঠেই ছোট হয়ে গেল। এবং হঠাৎ তারাপদ সেই ফুলকির আলোয় একটি নাক মুখ চোখ দেখতে পেয়ে পাথর হল। সয়ে যাওয়া অন্ধকারে তারাপদ ক্রমশ একটা মানুষের আদল দেখতে পেল। কাশিটা যে ওখান থেকেই আসছে তারাপদ বুঝতে পারল। তারাপদ দৃষ্টি ফেরাচ্ছিল না।
হঠাৎ আলোর ফুলকিটা মাটিতে মিলিয়ে গেল। এবং তার কয়েক মুহূর্ত বাদে পায়ের ওপর কে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তেই তারাপদ আর্তনাদ করে লাফিয়ে উঠল।
বাবু, আমি বাবু! একটা মিনমিনে গলার স্বরে কাকুতি ফুটল।
তারাপদ স্থির হল। গলার স্বরটা যেন চেনাচেনা, কে?
আমি বংশী!
বংশী!
হ্যাঁ, বাবু। দয়া করে ধরিয়ে দেবেন না বাবু। আপনার পায়ে পড়ছি। কাল অফিসে না এলে একদম না খেতে পেয়ে মারা যাব বাবু। বংশীর গলার স্বর ডুকরে উঠল।
তারাপদ এক পা এগিয়ে নিচু হয়ে দেখল বংশী হাতজোড় করে বসে আছে। বংশীর সঙ্গে কেউ সচরাচর কথাবার্তা বলে না। রোগগ্রস্ত লোক। সর্বক্ষণ মুখ দিয়ে লালা গড়ায়। আজীবন তৈলহীন চুলে উকুনের বাসা আছে। এক পা খুঁড়িয়ে হাঁটে। জেনারেল সেকশনের বেয়ারা বংশীচরণ। সামনের বছর রিটায়ার করবে। এক্সটেনশনের কোনও আশা নেই। অফিসে আছে এই পর্যন্ত। তারাপদ বুঝল বংশীচরণ তার মতোই রাত থেকেই অফিসে চলে এসেছে। কালকে ধর্মঘট। ভয়ংকর।
তারাপদ বসল বংশীচরণের পাশে। বংশী অবাক হল। এভাবে অনেক দিন অফিসের কেউ তার কাছাকাছি আসেনি। তারাপদকে চিনতে পারল সে, পেয়ে হাসল।
তারাপদ ফিসফিসিয়ে বলল, আর কেউ, ইউনিয়নের কেউ আসেনি তো? বংশী ঘাড় নাড়ল। না। পোড়া বিড়িটা কানে জল সে।
দারুণ হাওয়া দিচ্ছিল। এতক্ষণের পরিশ্রমের পর শীত লাগছিল জোর। গঙ্গার বাতাসের দাপট বেশ। তারাপদ এবং বংশীচরণ বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল।
তোমার কয় ছেলে-মেয়ে বংশীচরণ? তারাপদ আস্তে-আস্তে শুধাল।
দশটাই মেয়ে। মাগী আবার বিয়োবে। ভগবানের হাত, আমি কী করব বলুন! তা এদের। খাওয়াতে হবে তো। ধর্মঘটে চাকরি গেলে পেনসনটাও যে পাব না এটা কাকে বোঝাই বাবু!
তারাপদ ঘাড় নাড়ল, এর চেয়ে ইংরেজ আমল ভালো ছিল।
ছিলই তো। বংশীচরণ নড়েচড়ে বসল, পাকিস্তান হওয়ার আগে আমাদের কোন অভাবটা ছিল বলুন। আমরা তেরো ভাই। দুবেলা পাতে দুধ পড়ত। তা বাবুরা তো এসব কথা কিছু বোঝেন না। ধর্মঘটের ডাক দিয়েই খালাস।
বংশীচরণ খুব দ্রুত অথচ ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়ির দেওয়ালগুলো কথাগুলোকে সজোরে ফিরিয়ে দিচ্ছিল যেন। ওরা ক্রমশ জোরে কথা। বলতে ভয় পেল। তারাপদ দেখল হাওয়ার দাপটে শীত করছে বংশীর। হঠাৎ চাদরের এক প্রান্ত খুলে সে বলল, নাও, একটু জড়িয়ে নাও হে, ঠান্ডাটা কমবে।
বিব্রত হাতে বংশী জড়িয়ে নিল চাদরের কোণটা, শালা হাওয়া না তো, নতুন বিয়ানো গাই চাট মারছে–হি-হি-বাবা।
ওরা দুজনে গায়ে গা দিয়ে এক চাদরের তলায় কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারাপদর এই মুহূর্তে বংশীচরণকে খুব নিজের লোক বলে মনে হচ্ছিল। তারাপদ বলল, কাল সকালে কোনও গোলমাল হবে না তো!
কী আর হবে। লোকে দুটো কুকথা বলবে, ছি-ছি করবে এই তো! তা চাকরি গেলে তো আর কেউ মাগ-বাচ্চার মুখে গ্রাস তুলতে আসবে না! অবশ্য, আমাদের দেখতে পেলে তো। বংশী নির্বিকার।
তারাপদ গাঢ় গলায় বলল, তাহলে কাল রাতেই বেরুব, বুঝেছ। আমার সঙ্গে তিরিশটা লুচি আছে। খাবার কোনও ভয় নেই।
বংশীচরণ যেন আমোদেই এবার খকখক করে কাশল। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে দিল, নিন ধরান। এক টানেই শীতকে মায়ের পেটে লুকোতে হবে।
তারাপদ বিড়িটা ধরাল। আজন্ম সে কোনও নেশা করেনি কখনও। কিন্তু এই মুহূর্তে সে বিড়িটা ধরাল। প্রবল কাশিতে বুক ফেটে গেলেও শব্দের ভয়ে তার মুখ থেকে একটা খকখক শব্দ বেরুল। অন্ধকারে দুটো আগুনের ফুলকি পরম আত্মীয়ের মতো জ্বলছিল আর নিবছিল।
কখন পুবের আকাশ ঘোর লেগেছে, হাওড়া স্টেশনের মাথায় মণির মতো জ্বলা নিওন আলোগুলো ফ্যাকাশে হয়েছে আর একটু-একটু করে অফিসবাড়িটার ছ-তলার অন্ধকার চোরের মতো পালিয়েছে তারাপদরা টের পায়নি। ছতলার নিচে ট্রাম লাইনের শব্দ হচ্ছে। মানুষজনের কথাবার্তা, গঙ্গায় স্টিমারের ভোঁ, ঘুমভাঙা মহানগরীর আড়মোড়া ভাঙা এই সময়টায় ওরা আচ্ছন্নের মতো বসে রইল খানিক। তারপর যত বেলা বাড়তে লাগল তারাপদর বুকের ভেতর ছটফটানিটা তত বেড়ে যেতে লাগল। কাল সারারাত সে ঘুমোয়নি। বংশীচরণ হাঁটুতে মুখ গুঁজে রাত কাবার করলেও তারাপদ বড়বাজার পুলিশ আউটপোস্টের ঘণ্টা শুনে রাত কাটিয়েছে। এখন সে উঠল। চোরের মতো ইতিউতি দেখতে-দেখতে বাথরুমের কালো জলে মুখ ধুলো। না, এখন কেউ আসবে না। নিদেনপক্ষে দারোয়ানরাও নয়। অফিসাররা যে-ার ঘরের চাবি নিয়ে গেছে।
সময়ের হিসেব নেই। তবু রোদের রং দেখে বুঝল অফিস বসার সময় হয়েছে। অথচ কেউ নেই–কোথাও নেই। এর মধ্যে বংশীচরণ দুবার বলেছে, এবার বাবু বাক্সটা খোলেন, দুটো চড়িয়ে দিই। খিদে তারাপদরও পেয়েছিল। এখন একটা টেবিলে টিফিন কেরিয়ারটা খুলে সমান লুচি ভাগ করে নিল সে। বেশ মিষ্টি গন্ধ। তরকারিটায় একটু টক গন্ধ ধরেছে। তারাপদ দেখল বংশীর বাটি শেষ। পনেরোটা লুচি যেন নস্যি। তারাপদর নিজের খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও গোটাচারেক মুখে তোলার পর শরীর গোলাতে লাগল।
দশটা বাজার খানিক পরেই অফিসাররা এল। তারাপদ সেই ঘুপচিতেই বংশীকে নিয়ে লুকিয়ে থাকল। মিত্তিরসাহেব সব ঘরগুলো খুললেন। অন্য অফিসাররাও সঙ্গে আছেন। বংশী বলল, শুনছেন।
অবাক হয়ে তারাপদ শুনল, মিত্তিরসাহেব গলা খুলে হিন্দি গান গাইতে গাইতে দরজা খুললেন। যে মিত্তিরসাহেব দু-দিন আগে অর্ডিন্যান্স দেখিয়ে বলেছিলেন, দিস স্ট্রাইক ইজ ইললিগাল। যাঁরা আসবেন না, তাঁদের দায়িত্ব তারা নিজেরা নেবেন আর যাঁরা আসবেন, তাঁদের দায়িত্ব আমরা নেব।
অফিসঘর খুলে দিয়ে অফিসাররা মিত্তিরসাহেবের ঘরে জমায়েত হলেন। স্পষ্ট বোঝা গেল আজ আর কাজকর্ম কিছু হবে না। তারাপদ বংশীচরণের পিছুপিছু অফিসঘরে ঢুকল। সামনে বড়বাবুর টেবিল। টেবিলের ওপর ফোন, অ্যাটেন্ডেন্স খাতা সাজানো। অতবড় হলঘরটার সবকটি টেবিল খাঁ-খাঁ করছে। বংশী অ্যাটেন্ডেন্স খাতাটা খুলতেই তারাপদর গা ছমছম করে উঠল। তারাপদ নামটা দেখলে পেল। জ্বলজ্বল করছে। বংশী বলল, সই করে দেন বাবু।
তারাপদর কেমন যেন সাহস হচ্ছিল না। সই করলে কাল যদি ওরা দেখে ফেলে। তারাপদ দেখল, পিওনদের পাতাটা বের করে বংশী সই করল কায়দায়। করে খাতাটা তারাপদর দিকে এগিয়ে দিল। ঠিক এই সময় ফোনটা বেজে উঠল ফাঁকা ঘরে ঝনঝনিয়ে। ডাইরেক্ট লাইন। রিসিভার ধরতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল সে। কার ফোন কে জানে! আজ অবধি তারাপদর কোনও ফোন আসেনি কখনও। যদি ওরা করে! যাচাই করতে চায় উড়ো ফোন করে কে-কে অফিসে এসেছে জানতে। ফোন বেজে চলেছে। তিনবার চারবারবারবার। বংশী ভূতের মতো দাঁড়িয়ে ফোনটার দিকে চেয়ে আছে। পায়ের শব্দ পেল তারাপদ। তারপর দেখল দরজায় মিত্তিরসাহেব। রিং হচ্ছে দেখে ছুটে এসেছেন। এদের দেখেই থমকে দাঁড়ালেন যেন। তারপর গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে রিসিভার তুললেন, হ্যালো, স্পিকিং। তারাপদ নিশ্বাস চেপে শুনলেন, আই অ্যাম মি:মিত্র, হুম ডুয়ু ওয়ান্ট?
কে এসেছেনা এসেছে দ্যাটস নট ইওর বিজনেস! বলে ঘটাং করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন মিত্তির সাহেব।
আপনারা!
আজ্ঞে। তারাপদ হাত কচলাল।
হঠাৎ বংশীচরণ ঝপাং করে মিত্তিরসাহেবের পায়ের ওপর পড়ল, আমাকে বাঁচান স্যার। চাকরি গেলে একদম সপরিবারে… একটি গোঙানি দিয়ে কথাটা শেষ হল।
কখন এলেন? মিত্তিরসাহেব তারাপদকে জিজ্ঞাস করলেন।
আমরা স্যার লয়াল সারভেন্ট। কাল রাত থেকেই আছি। আপনি আসতে বলেছিলেন…। তারাপদ হাতজোড় করল।
সই করেছেন?
না স্যার। ওরা যদি দেখে ফেলে–পরে করলে হয় না স্যার? মানে গোলমাল মিটে গেলে…। সঙ্কুচিত তারাপদ।
যা ভালো মনে করেন করুন, আমার কী বলার আছে! বলে মেজাজি চালে বেরিয়ে গেলেন, তিনি।
কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল তারাপদ। এই যে মিত্তিরসাহেব সেদিন ঘরে ডেকে বললে ধর্মঘট না করলে সবরকম প্রোটেকশন দেওয়া হবে তার কী হল! তারাপদ স্থির করল, কদিন যাক, সাহেব তো দেখে গেলেন, তারপর একদিন সইটা করে দিলেই হবে।
এই সময় নিচে কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে বুঝতে পারল ওরা। স্লোগান চলছে সমানে। তারাপদরও ইচ্ছে হল একবার দ্যাখে ব্যাপারটা কী হচ্ছে। কিন্তু যদি ওরা দেখে ফেলে। ভাবতেই হাত পা যেন শরীরের মধ্যে গুটিয়ে যায়। শ্লোগান আরও জোর হল। কৌতূহল চেপে রাখতে পারছিল না সে। পায়ে-পায়ে জানলায় এসে দাঁড়াল। খড়খড়িটা সামান্য ফাঁক করে উঁকি মারল। ট্রামের তার ছাড়া ছ-তলার ওপর থেকে প্রথমে কিছু চোখে পড়ল না। বংশীর কৌতূহল যেন মাত্রা ছাড়িয়েছিল। এস্তে ওর হাতটা সরিয়ে নিল তারাপদ, অ্যাই খবরদার, দেখে ফেলবে যে!
কিছু বাদে তারাপদ আবার মুখ বাড়াল কিছুটা। হ্যাঁ এবার খুব দ্রুত তারাপদ দেখে নিল। অফিসের সামনে প্রচুর পুলিশ, পুলিশ ভ্যান, আর ওপাশের ফুটপাথে জনাদশেক ইউনিয়নের ভলান্টিয়ার। তাদের অফিসের কয়েকজনকে দেখতে পেল সে। হাত নেড়ে স্লোগান দিচ্ছে, এ লড়াই বাঁচার লড়াই। কে যেন মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকাতেই চকিতে মুখটা সরিয়ে নিল তারাপদ।
একটু বাদে খুব জোরে শব্দ হচ্ছে বুঝতে পারল ওরা। সম্ভবত টিয়ারগ্যাসের শেল ফাটছে। হইচই চিৎকার স্লোগান ইত্যাদি শুনতে-শুনতে ওরা সমস্ত দুপুরটা কাটালো চোরের মতো সেই ঘুপচিতে। যেখানে কাল সারারাত কেটেছে। বিকেলে অফিসাররা আবার তালা লাগিয়ে নিচে নেমে যেতেই বংশী বলল, চলেন।
খপ করে হাত ধরল তারাপদ, দাঁড়াও রাত হোক আগে, সবাই চলে যাক।
রাত গড়াল, আবার হু-হুঁ হাওয়া আসছে গঙ্গা থেকে উঠে। ওরা নামল পায়ে-পায়ে। এখনও বাতাসে চোখ জ্বালা করা ভাব আছে, সমস্ত তল্লাট ফাঁকা।
লাস্ট ট্রেন ধরে হৃদয়পুরে নামল তারাপদ। প্রচণ্ড জ্যোৎস্না উঠেছে। বাঁশবন আর আশশ্যাওড়ার ঝোঁপের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে তারাপদ ক্লান্তি বোধ করল এই প্রথম। আকাশটায় রূপোর ঝাঁপি কে উপুড় করে দিয়েছে যেন। দূর থেকে দেখল সে, বাড়ির ছাদের আলসেতে নতুন বউয়ের চুল জ্যোৎস্নায় চকচক করছে। নতুন বউও তাকে দেখতে পেয়েছিল, ছুটে এল নিচে, এত দেরি হল কেন গো, কিছু হয়নি তো, আমি যে চিন্তায় মরে যাই।
তারাপদ হাসল, তা গোলমাল একটু হয়েছিল বইকি। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছেড়েছিল।
সেকি! কে যেন বলল রেডিওতে বলেছে কলকাতায় খুব গোলমাল হচ্ছে। আর আমি এদিকে ঠায় দাঁড়িয়ে, মানুষটা সেই গতরাতে যে গেল এখনও এল না কেন? মা তো ঘরবার করছে। নতুন বউ পরম তৃপ্তির সঙ্গে কথাগুলো বলছিল, তারপর কী হল?
দাওয়ায় বসল তারাপদ, তা কাল রাত থেকে তো আমরা ঠায় জেগে। কাউকে ঢুকতে দেব না। পারেনি কেউ। তা সকালবেলায় দেখি দু-একজন আসছে ইতি উতি তাকাতে-তাকাতে। তা আমাদের দেখেই যেন তুলসিপাতা। বলে ধর্মঘট দেখতে বেরিয়েছি। হুজ্জতটা বাধল দুপুরে। একজন বলল যাবেই, আমরা বললাম, কখনও না। ব্যস পুলিশ চালাল কাঁদানে গ্যাস।
নতুন বউ বড়-বড় চোখ করে শুনছিল। তারপর স্বামীর বুকের কাছে লেপটে বলল, কিছু মনে করো না গো, আমি ভাবতুম তুমি লোকটা কীরকম। সতু কেমন ভালো-ভালো কথা বলে, সবার হয়ে কথা বলে আর তুমি শুধু অন্য কথা বলো। আজ আমার খুব লজ্জা হচ্ছে গো। চলো ভেতরে চললো। মা বসে আছে।
তারাপদ উঠল। তারপর আলেকজান্ডারের মতো ঘরে ঢুকল।
পরদিন খুব ভয়ে-ভয়ে অফিসে ঢুকল সে। কিন্তু একটু বাদেই বুঝতে পারল ভয়ের কিছু নেই। অফিসের সবাই ধর্মঘট নিয়েই ব্যস্ত। কোথায় সফল হয়েছে কোথায় হয়নি। পুলিশ কালকে ধর্মঘট ভাঙতে চেয়েছিল, পারেনি ইত্যাদি। টিফিনের সময় ইউনিয়নের নেতারা এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেল, বলল, প্রস্তুত থাকতে যে-কোনও দুর্যোগের মুখোমুখি হওয়ার জন্যে। নূ্যনতম ভাতা দিতেই হবে। তারাপদকে একজন নেতা সামনাসামনি দেখে কাঁধে হাত রেখে বলে গেল, অভিনন্দন কমরেড। এবং তারপরই আজ সবার সঙ্গে সে আলোচনা করতে লাগল যেচে-যেচে। কোন কাগজ কী লিখেছে। কথা উঠল, কেউ অফিসে এসেছে কিনা। কাল নাকি একজন ঢুকতে। চেয়েছিল, তাকে নিয়ে গোলমাল, পুলিশ টিয়ার গ্যাস চার্জ করেছিল। দালালটা আজ আসেনি। যা হোক, সরকারের মতিগতি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। প্রত্যেকে যতই চেঁচাক, বুকের ভিতর একটা ভয় ওৎ পেতে বসে আছে যেন সবার।
সেদিন একটু বেশি কাজ করল তারাপদ। পাঁচটার অনেক পরে বেরুল সে। তখন অফিস ফাঁকা। করিডোরে আসতেই একটু থমকে গেল, মিস্টার মিত্তিরের ঘরের সামনে উবু হয়ে বসে আছে। বংশীচরণ। ফুলে-ফুলে কাঁদছে। চোরের মতো সরে এল সে। আজ সারাদিন সে বংশীচরণের সঙ্গে কথা বলেনি। চেনেই না সে। এখন তার নিজেরই অবাক লাগছিল, কীভাবে একটা রাত একটা দিন ওই ঘেয়ো রোগগ্রস্ত লোকটার সঙ্গে কাটিয়েছে। কিন্তু শালা বুড়োটা কাঁদছে কেন? একটা কাঁটা খচখচ করতে লাগল তারাপদর মনে। কেউ কিছু শোনেনি তো আজ দিনভোর। শালা বেইমানি করবে না তো!
অত বড় লিফটে ও একাই নিচে নামল। বিকেল গড়িয়ে না যেতেই সন্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কলকাতার রাস্তায়। শীতের বেলা যৌবনের চাইতেও দ্রুত চলে যায়। এখন হেঁটে শ্যালদা। ওঃ অনেকদিন বাদে একটু ভালো করে ঘুম হবে আজ, তারাপদ ভাবল, কাল রোববার।
ব্রেবোর্ন রোডের মুখে দাঁড়াতেই তারাপদ দেখতে পেল। ইউনিয়নের কয়েকজন নিচের দিকের কর্মী পানের দোকানটার পাশে জটলা করছে। তারাপদ লক্ষ করল, ওকে দেখেই সব চুপ মেরে গেল। কেন? তারাপদর পায়ের তলা ঘামছিল, তবু হাসল সে, সব ভালো তো?
এই আর কি! তারপর খবর কী? নতুন ঢোকা একটা ছেলে বলল।
চলে যাচ্ছে। আমার আবার খবর! ধর্মঘট মিটল! তারাপদ সহজ হওয়ার চেষ্টা করছিল।
না, একটু বাকি আছে। বলে লোকটি এগিয়ে এসে তারাপদের সাদা শার্টের কলার চেপে দাঁতে দাঁত ঘষল, শালা দালাল! সন্ধের আকাশটা যেন ঝুপ করে তারাপদকে ঘিরে ফেলল, আর সে। অনুভব করছিল যেন কয়েক লক্ষ রয়েল বেঙ্গল টাইগার তার মাংস খুবলে-খুবলে খাচ্ছে। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
অনেক রাত্রে, গতকালের মতো শেষ ট্রেন ধরে তারাপদ হৃদয়পুরে নামল। কালকের চেয়ে আজ যেন জ্যোৎস্নার রং পাকা হয়েছে। স্টেশনের পাশে কাঁঠলিচাঁপা গাছটা বড় সুবাস ছড়াচ্ছিল বাতাসে। নির্জন স্টেশনে কেউ নেই। তারাপদ অনেক কষ্টে পা টেনে-টেনে হাঁটছিল। শার্ট, ধুতি ছেঁড়া, মুখ ক্ষত-বিক্ষত, সর্বাঙ্গে রক্তের ছাপ ছড়ানো। সেই বাঁশঝাড় আর আশশ্যাওড়া ঝোঁপের মধ্যেকার পথ দিয়ে হাঁটতে তার বড় কষ্ট হচ্ছিল। তার মাথার চুলে রক্তে আঠার মতো চটচট করছে, একটা রাতের পোকা ওপর থেকে মাথায় পড়ে বুঝি আটকে গেল সেখানে। ওরাই ওকে শিয়ালদায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। শীতের শেষ ট্রেনে লোক ছিল না বিশেষ। যারা ছিল তাদের ওরা বলে গিয়েছিল, দালালটাকে হৃদয়পুরে নামিয়ে দেবেন। কামরার লোকগুলো কিছু জানতে চায়নি, কথাও বলেনি।
এই দারুন জ্যোৎস্নায় তারাপদর সর্বাঙ্গের লাল ছোপগুলো যেন জ্বলছিলই। আরও কয়েক পা। যেতে তারাপদ ছাদের কার্নিশে ঝুঁকে পড়া একটা আবছা মূর্তি পেল। নতুন বউ দূর থেকেই তারাপদকে দেখতে পেয়ে থ হয়ে গিয়েছিল। তারপর প্রচণ্ড চিৎকার করে নিচে নেমে দৌড়ে তারাপদকে ধরল। সেই নির্জন রাত্রে গ্রামের সমস্ত স্তব্ধতা চৌচির হল নতুন বউয়ের চিৎকারে–ও মাগো, তোমার এ কি হল গো, পুলিশগুলোর কি একটু দয়ামায়া নেই গো, তুমি কেন গেলে পুলিশের সামনে? আশেপাশের সবাই এই মাঝরাত্তিরে ঘুম ছেড়ে ছুটে এল। নতুন বউ মাটিতে বসে তারাপদকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরেছিল আর ডুকরে-ডুকরে কাঁদছিল। তারাপদদের ঘিরে একটা জটলা পুলিশের অত্যাচারের গল্প করছিল নিজেদের মধ্যে। পাড়ার যুবকরা জমায়েত হচ্ছিল। তারাপদ কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল। নতুন বউ-এর কান্নাভেজা গলায় যেন একটা। গর্বের সুর। কারণ তাদের ঘিরে জনতা বেশ বেড়ে গেছে।
আর তারাপদ, হৃদয়পুরের তারাপদ বিশ্বাস ক্রমশ চেতনা হারাতে-হারাতে একটা ঘোরের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, ব্যাঙাচির মতো টুক করে লেজটা খসিয়ে ফেলল।