Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বনভোজনের ব্যাপার || Narayan Gangopadhyay

বনভোজনের ব্যাপার || Narayan Gangopadhyay

হাবুল সেন বলে যাচ্ছিল–পোলাও, ডিমের ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, মাংসের কোর্মা

উস-উস শব্দে নোলার জল টানল টেনিদা : বলে যা–থামলি কেন? মুর্গ মুসল্লম, বিরিয়ানি পোলাও, মশলদা দোসে, চাউ-চাউ, সামি কাবাব–

এবার আমাকে কিছু বলতে হয়। আমি জুড়ে দিলাম : আলু ভাজা, শুক্তো, বাটিচচ্চড়ি, কুমড়োর ছোকা–

টেনিদা আর বলতে দিলে না! গাঁক-গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল : থাম প্যালা, থাম বলছি। শুক্তো বাটি–চচ্চড়ি।–দাঁত খিঁচিয়ে বললে, তার চেয়ে বল না হিঞ্চে সেদ্ধ, গাঁদাল আর শিঙিমাছের ঝোল! পালা-জ্বরে ভুগিস আর বাসক-পাতার রস খাস, এর চাইতে বেশি বুদ্ধি আর কী হবে তোর! দিব্যি অ্যায়সা অ্যায়সা মোগলাই খানার কথা হচ্ছিল, তার মধ্যে ধাঁ করে নিয়ে এল বাটি-চচ্চড়ি আর বিউলির ডাল! ধ্যাত্তোর।

ক্যাবলা বললে, পশ্চিমে কুঁদরুর তরকারি দিয়ে ঠেকুয়া খায়। বেশ লাগে।

–বেশ লাগে?–টেনিদা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল : কাঁচা লঙ্কা আর ছোলার ছাতু আরও ভালো লাগে না? তবে তাই খা-গে যা। তোদের মতো উল্লুকের সঙ্গে পিকনিকের আলোচনাও ঝকমারি।

হাবুল সেন বললে, আহা-হা চৈইত্যা যাইত্যাছ কেন? পোলাপানে কয়–

–পোলাপান! এই গাড়লগুলোকে জলপান করলে তবে রাগ যায়। তাও কি খাওয়া যাবে এগুলোকে? নিম-নিসিলের চেয়েও অখাদ্য। এই রইল তোদের পিকনিক–আমি চললাম! তোরা ছোলার ছাতু আর কাঁচা লঙ্কার পিণ্ডি গেল গে–আমি ওসবের মধ্যে নেই!

সত্যিই চলে যায় দেখছি। আর দলপতি চলে যাওয়া মানেই আমরা একেবারে অনাথ। আমি টেনিদার হাত চেপে ধরলাম : আহ, বোসো না। একটা প্ল্যান-ট্যান হোক। ঠাট্টাও বোঝ না।

টেনিদা গজগজ করতে লাগল : ঠাট্টা। কুমডোর ছোকা আর কুঁদরুর তরকারি নিয়ে ওসব বিচ্ছিরি ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না।

-না-না, ওসব কথার কথা।হাবুল সেন ঢাকাই ভাষায় বোঝাতে লাগল : মোগলাই খানা না হইলে আর পিকনিক হইল কী?

–তবে লিস্টি কর–টেনিদা নড়ে-চড়ে বসল।

প্রথমে যে লিস্টটা হল তা এইরকম :

বিরিয়ানি পোলাও

কোর্মা।

কোপ্তা কাবার দুরকম।

মাছের চপ–

মাঝখানে রেসিকের মতো বাধা দিলে ক্যাবলা : তা হলে বাবুর্চি চাই, একটা চাকর, একটা মোটর লরি, দুশো টাকা–

–দ্যাখ ক্যাবলা–টেনিদা ঘুষি বাগাতে চাইল।

আমি বললাম, চটলে কী হবে? চারজনে মিলে চাঁদা উঠেছে দশ টাকা ছ-আনা।

টেনিদা নাক চুলকে বললে, তাহলে একটু কম-সম করেই করা যাক। ট্যাক-খালির জমিদার সব-তোদের নিয়ে ভদ্দরলোকে পিকনিক করে!

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, তুমি দিয়েছ ছ-আনা, বাকি দশ টাকা গেছে আমাদের তিনজনের পকেট থেকে। কিন্তু বললেই গাঁট্টা। আর সে গাঁট্টা ঠাট্টার জিনিস নয়-জুতসই লাগলে স্রেফ গালপাট্টা উড়ে যাবে।

রফা করতে করতে শেষ পর্যন্ত লিস্টটা যা দাঁড়াল তা এই :

খিচুড়ি (প্যালা রাজহাঁসের ডিম আনিবে বলিয়াছে)

আলু ভাজা (ক্যাবলা ভাজিবে)

পোনা মাছের কালিয়া (প্যালা রাঁধিবে)

আমের আচার (হাবুল দিদিমার ঘর হইতে হাত-সাফাই করিবে)

রসগোল্লা, লেডিকেনি (ধারে ম্যানেজ করিতে হইবে)

লিস্টি শুনে আমি হাঁড়িমুখ করে বললাম, ওর সঙ্গে আর-একটা আইটেম জুড়ে দে হাবুল। টেনিদা খাবে।

–হেঁ–হেঁ–প্যালার মগজে শুধু গোবর নেই, ছটাকখানেক ঘিলুও আছে দেখছি। বলেই টেনিদা আদর করে আমার পিঠ চাপড়ে দিলে। গেছি গেছি বলে লাফিয়ে উঠলাম আমি।

আমরা পটলডাঙার ছেলে কিছুতেই ঘাবড়াই না। চাটুজ্জেদের রোয়াকে বসে রোজ দু-বেলা আমরা গণ্ডায় গণ্ডায় হাতি-গণ্ডার সাবাড় করে থাকি। তাই বেশ ডাঁটের মাথায় বলেছিলাম, দূর-দূর। হাঁসের ডিম খায় ভদ্দরলোক। খেতে হলে রাজহাঁসের ডিম। রীতিমতো রাজকীয় খাওয়া!

–কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে শুনি? খুব যে চালিয়াতি করছিস, তুই ডিম পাড়বি নাকি?–টেনিদা জানতে চেয়েছিল।

–আমি পাড়তে যাব কোন দুঃখে? কী দায় আমার?–আমি মুখ ব্যাজার করে বলেছিলাম : হাঁসে পাড়বে।

–তা হলে সেই হাঁসের কাছ থেকে ডিম তোকেই আনতে হবে। যদি না আনিস, তা হলে–

তা হলে কী হবে বলবার দরকার ছিল না। কিন্তু কী গেরো বলল দেখি। কাল রবিবার–ভোরের গাড়িতেই আমরা বেরুব পিকনিকে। আজকের মধ্যেই রাজহাঁসের ডিম যোগাড় করতে না পারলে তো গেছি। পাড়ায় ভন্টাদের বাড়ি রাজহাঁস আছে গোটাকয়েক। ডিম-টিমও তারা নিশ্চয় পাড়ে। আমি ভন্টাকেই পাকড়ালাম। কিন্তু কী খলিফা ছেলে ভন্টা! দু-আনার পাঁঠার ঘুগনি আর ডজনখানেক ফুলুরি সাবড়ে তবে মুখ খুলল।

–ডিম দিতে পারি, তবে, নিজের হাতে বার করে নিতে হবে বাক্স থেকে।

–তুই দে না ভাই এনে। একটা আইসক্রিম খাওয়াব। ভন্টা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললে, নিজেরা পোলাও-মাংস সাঁটবেন আর আমার বেলায় আইসক্রিম। ওতে চলবে না। ইচ্ছে হয় নিজে বের করে নাও–আমি বাবা ময়লা ঘাঁটতে পারব না। কী করি, রাজি হতে হল।

ভন্টা বললে, দুপুরবেলা আসিস। বাবা মেজদা অফিসে যাওয়ার পরে। মা তখন ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোয়। সেই সময় ডিম বের করে দেব।

গেলাম দুপুরে। উঠোনের একপাশে কাঠের বাক্স–তার ভেতরে সার সার খুপরি। গোটা-দুই হাঁস ভেতরে বসে ডিমে তা দিচ্ছে। ভন্টা বললে, যা–নিয়ে আয়।

কিন্তু কাছে যেতেই বিতিকিচ্ছিরিভাবে ফাঁস-ফাস করে উঠল হাঁস দুটো।

ফোঁসফোঁস করছে যে!

ভন্টা উৎসাহ দিলে : ডিম নিতে এসেছিস–একটু আপত্তি করবে না? তোর কোন ভয় নেই প্যালাদে হাত ঢুকিয়ে।

হাত ঢুকিয়ে দেব? কিন্তু কী বিচ্ছিরি ময়লা!–ময়লা আর কী বদখত গন্ধ! একেবারে নাড়ি উলটে আসে। তার ওপরে যেরকম ঠোঁট ফাঁক করে ভয় দেখাচ্ছে–

ভন্টা বললে, চিয়ার আপ প্যালা। লেগে যা!

যা থাকে কপালে বলে যেই হাত ঢুকিয়েছি–সঙ্গে সঙ্গে–ওরে বাপরে! খটাং করে হাঁসটা হাত কামড়ে ধরল। সে কী কামড়! হাঁই-মাই করে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।

–কী হয়েছে রে ভন্টা, নীচে এত গোলমাল কিসের?-ভস্টার মার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।

আমি আর নেই। তাঁচকা টানে হাঁসের ঠোঁট থেকে হাত ছাড়িয়ে চোঁচা দৌড় লাগালাম। দরদর করে রক্ত পড়ছে তখন।

রাজহাঁস এমন রাজকীয় কামড় বসাতে পারে কে জানত। কিন্তু কী ফেরোজ ভস্টাটা। জেনে-শুনে ব্রাহ্মণের রক্তপাত ঘটাল। আচ্ছা পিকনিকটা চুকে যাক–দেখে নেব তারপর। ওই পাঁঠার ঘুগনি আর ফুলুরির শোধ তুলে ছাড়ব।

কী করা যায়–গাঁটের পয়সা দিয়ে মাদ্রাজী ডিমই কিনতে হল গোটাকয়েক।

পরদিন সকালে শ্যামবাজার ইস্টিশানে পৌঁছে দেখি, টেনিদা, ক্যাবলা আর হাবুল এর মধ্যেই মার্টিনের রেলগাড়িতে চেপে বসে আছে। সঙ্গে একরাশ হঁড়ি কলসি, চালের পুঁটলি, তেলের ভাঁড়। গাড়িতে গিয়ে উঠতে টেনিদা হাঁক ছাড়ল : এনেছিস রাজহাঁসের ডিম?

দুর্গা নাম করতে করতে পুঁটলি খুলে দেখালাম।

–এর নাম রাজহাঁসের ডিম। ইয়ার্কি পেয়েছিস?–টেনিদা গাঁট্টা বাগাল।

আমি গাড়ির খোলা দরজার দিকে সরে গেলাম : মানে–ইয়ে, ছোট রাজহাঁস কিনা–

-ঘোট রাজহাঁস! কী পেয়েছিস আমাকে শুনি? পাগল না পেটখারাপ?

হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও–ছাড়ান দাও। ডিম তো আনছে!

টেনিদা গর্জন করে বললে, ডিম এনেছে না কচু। এই তোকে বলে রাখছি প্যালাডিমের ডালনা থেকে তোর নাম কেটে দিলাম। এক টুকরো আলু পর্যন্ত নয়, একটু ঝোলও নয়! ..

মন খারাপ করে আমি বসে রইলাম। ডিমের ডালনা আমি ভীষণ ভালোবাসি, তাই থেকেই আমাকে বাদ দেওয়া! আচ্ছা বেশ, খেয়ো তোমমরা। এমন নজর দেব পেট ফুলে ঢোল হয়ে যাবে তোমাদের।

পিঁ করে বাঁশি বাজল–নড়ে উঠল মার্টিনের রেল। তারপর ধ্বস-ধ্বস ভোঁস ভোঁস করে এর রান্নাঘর, ওর ভাঁড়ার-ঘরের পাশ দিয়ে গাড়ি চলল।

টেনিদা বললে, বাগুইআটি ছাড়িয়ে আরও চারটে ইস্টিশান। তার মানে প্রায় এক ঘন্টার মামলা। লেডিকেনির হাঁড়িটা বের কর, ক্যাবলা।

ক্যাবলা বললে, এখুনি। তাহলে পৌঁছবার আগেই সে সাফ হয়ে যাবে?

টেনিদা বললে, সাফ হবে কেন, দুটো-একটা চেখে দেখব শুধু। আমার বাবা ট্রেনে চাপলেই খিদে পায়। এই একঘন্টা ধরে শুধু-শুধু বসে থাকতে পারব না। বের কর হাঁড়ি–চটপট–

হাঁড়ি চটপটই বেরুল–মানে, বেরুতেই হল তাকে। তারপর মার্টিনের রেলের চলার তালে তালে ঝটপট করে সাবাড় হয়ে চলল। আমি ক্যাবলা আর হাবুল সেন জুল-জুল করে শুধু তাকিয়েই রইলাম। একটা লেডিকেনি চেখে দেখতে আমরাও যে ভালোবাসি, সেকথা আর মুখ ফুটে বলাই গেল না।

ইস্টিশান থেকে নেমে প্রায় মাইলখানেক হাঁটবার পরে ক্যাবলার মামার বাড়ি। কাঁচা রাস্তা, এঁটেল মাটি, তার ওপর কাল রাতে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে আবার। আগে থেকেই রসগোল্লার হাঁড়িটা বাগিয়ে নিলে টেনিদা।

–এটা আমি নিচ্ছি। বাকি মোটঘাটগুলো তোরা নে।

–রসগোল্লা বরং আমি নিচ্ছি, তুমি চালের পোঁটলাটা নাও টেনিদা।–লেডিকেনির পরিণামটা ভেবে আমি বলতে চেষ্টা করলাম।

টেনিদা চোখ পাকাল : খবরদার প্যালা, ওসব মতলব ছেড়ে দে। টুপটাপ করে দু-চারটে গালে ফেলবার বুদ্ধি, তাই নয়?– বাবা–চালাকি ন চলিষ্যতি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাঁটরি বোঁচকা কাঁধে ফেলে আমরা তিনজনেই এগোলাম।

কিন্তু তিন পাও যেতে হল না। তার আগেই ধাঁইধপাস্! টেনে একখানা রাম-আছাড় খেল হাবুল।

–এই খেয়েছে কচুপোড়া!–টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল।

সারা গায়ে কাদা মেখে হাবুল উঠে দাঁড়াল। হাতের ডিমের পুঁটলিটা তখন কুঁকড়ে এতটুকু–হলদে রস গড়াচ্ছে তা থেকে।

ক্যাবলা বললে, ডিমের ডালনার বারোটা বেজে গেল।

তা গেল। করুণ চোখে আমরা তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে। ইস–এত কষ্টের ডিম। ওরই জন্যে রাজহাঁসের কামড় পর্যন্ত খেতে হয়েছে।

টেনিদা হুঙ্কার দিয়ে উঠল : দিলে সব পণ্ড করে। এই ঢাকাই বাঙালটাকে সঙ্গে এনেই ভুল হয়েছে। পিটিয়ে ঢাকাই পরোটা করলে তবে রাগ যায়।

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, হাবুল চার টাকা চাঁদা দিয়েছে–তার আগেই কী যেন একটা হয়ে গেল! হঠাৎ মনে হল আমার পা দুটো মাটি ছেড়ে শোঁ করে শূন্যে উড়ে গেল, আর তারপরেই–

কাদা থেকে যখন উঠে দাঁড়ালাম, তখন আমার মাথা-মুখ বেয়ে আচারের তেল গড়াচ্ছে। ওই অবস্থাতেই চেটে দেখলাম একটুখানি। বেশ ঝাল ঝাল টক-টক–বেড়ে আচারটা করেছিল হাবুলের দিদিমা!

ক্যাবলা আবার ঘোষণা করলে, আমের আচারের একটা বেজে গেল!

টেনিদা খেপে বললে, চুপ কর বলছি ক্যাবলা–এক চড়ে গালের বোম্বা উড়িয়ে দেব।

কিন্তু তার আগেই টেনিদার বোম্বা উড়ল–মানে স্রেফ লম্বা হল কাদায়। সাত হাত দূরে ছিটকে গেল রসগোল্লার হাঁড়ি–ধবধবে শাদা রসগোল্লাগুলো পাশের কাদাভরা খানায় গিয়ে পড়ে একেবারে নেবুর আচার।

ক্যাবলা বললে, রসগোল্লার দুটো বেজে গেল!

এবার আর টেনিদা একটা কথাও বললে না। বলবার ছিলই বা কী! রসগোল্লার শোকে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে চারজনে পথ চলতে লাগলাম আমরা। টেনিদা তবু লেডিকেনিগুলো সাবাড় করেছে, কিন্তু আমাদের সান্ত্বনা কোথায়! অমন স্পঞ্জ রসগোল্লাগুলো।

পাঁচ মিনিট পরে টেনিদাই কথা কইল।

–তবু পোনা মাছগুলো আছে–কী বলিস! খিচুড়ির সঙ্গে মাছের কালিয়া আর আলুভাজা-নেহাত মন্দ হবে না–অ্যাঁ?

হাবুল বললে, হ-হ, সেই ভালো। বেশি খাইলে প্যাট গরম হইব। গুরুপাক না খাওয়াই ভালো।

ক্যাবলা মিটমিট করে হাসল : শেয়াল বলছিল, দ্রাক্ষাফল অতিশয় খাট্টা!ক্যাবলা ছেলেবেলায় পশ্চিমে ছিল, তাই দুই-একটা হিন্দী শব্দ বেরিয়ে পড়ে মুখ দিয়ে।

টেনিদা বললে, খাট্টা! বেশি পাঁঠঠামি করবি তো চাঁট্টা বসিয়ে দেব।

ক্যাবলা ভয়ে স্পিকটি নট! আমি তখনও নাকের পাশ দিয়ে ঝাল ঝাল টক-টক তেল চাটছি। হঠাৎ বুক-পকেটটা কেমন ভিজে ভিজে মনে হল। হাত দিয়ে দেখি, বেশ বড়োসড়ো এক-টুকরো আমের আচার তার ভেতরে কায়েমি হয়ে আছে।

–জয়গুরু! এদিক-ওদিক তাকিয়ে টপ করে সেটা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। সত্যিহাবুলের দিদিমা বেড়ে আচার করেছিল। আরও গোটাকয়েক যদি ঢুকত।

বাগানবাড়িতে পৌঁছুলাম আরও পনেরো মিনিট পরে।

চারিদিকে সুপুরি আর নারকেলের বাগান–একটা পানা-ভর্তি পুকুর, মাঝখানে, একতলা বাড়িটা। কিন্তু ঘরে চাবিবন্ধ। মালীটা কোথায় কেটে পড়েছে, কে জানে!

টেনিদা বললে, কুছ পরোয়া নেই। চুলোয় যাক মালী। বলং বলং বাহ্বলং নিজেরা উনুন খুঁড়বখড়ি কুড়ব, রান্না করব–মালী ব্যাটা থাকলেই তো ভাগ দিতে হত। যা হাবুল ইট কুড়িয়ে আনউনুন করতে হবে। প্যালা, কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে আয়,ক্যাবলাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যা।

–আর তুমি?–আমি ফস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।

–আমি?–একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে টেনিদা হাই তুলল : আমি এগুলো সব পাহারা দিচ্ছি। সবচাইতে কঠিন কাজটাই নিলাম আমি। শেয়াল কুকুর এলে তাড়াতে হবে তো।–যা তোরাহাতে-হাতে বাকি কাজগুলো চটপট সেরে আয়।

কঠিন কাজই বটে! ইস্কুলের পরীক্ষার গার্ডদেরও অমনি কঠিন কাজ করতে হয়। ত্রৈরাশিকের অঙ্ক কষতে গিয়ে যখন ‘ঘোড়া-ঘোড়া ঘাস-ঘাস’ নিয়ে আমাদের দম আটকাবার জো, তখন গার্ড মোহিনীবাবুকে টেবিলে পা তুলে দিয়ে ফোঁরর্‌-ফৌ শব্দে নাক ডাকাতে দেখেছি।

টেনিদা বললে, যা–যা সব-দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঝাঁ করে রান্নাটা করে ফ্যাল বড় খিদে পেয়েছে।

তা পেয়েছে বইকি। পুরো এক হাঁড়ি লেডিকেনি এখনও গজগজ করছে পেটের ভেতর। আমাদের বরাতেই শুধু অষ্টরম্ভা। প্যাচার মতো মুখ করে আমরা কাঠখড়ি সব কুড়িয়ে আনলাম।

টেনিদা লিস্টি বার করে বললে, মাছের কালিয়া–প্যালা রাঁধিবে।

আমাকে দিয়েই শুরু। আমি মাথা চুলকে বললাম, খিচুড়ি-টিচুড়ি আগে হয়ে যাক–তবে তো?

–খিচুড়ি লাস্ট আইটেম–গরম গরম খেতে হবে। কালিয়া সকলের আগে। নে প্যালা-লেগে যা–

ক্যাবলার মা মাছ কেটে নুন-টুন মাখিয়ে দিয়েছিলেন, তাই রক্ষা। কড়াইতে তেল চাপিয়ে আমি মাছ ঢেলে দিলাম তাতে।

আরে–এ কী কাণ্ড! মাছ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই কড়াই-ভর্তি ফেনা। তারপরেই আর কথা নেই–অতগুলো মাছ তালগোল পাকিয়ে গেল একসঙ্গে। মাছের কালিয়া নয়–মাছের হালুয়া।

ক্যাবলা আদালতের পেয়াদার মতো ঘোষণা করল : মাছের কালিয়ার তিনটে বেজে গেল।

–তবে রে ইস্টুপিড–। টেনিদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল : কাঁচা তেলে মাছ দিয়ে। তুই কালিয়া রাঁধছিস? এবার তোর পালাজ্বরের পিলেরই একদিন কি আমারই একদিন।

এ তো মার্টিনের রেল নয়–সোজা মাঠের রাস্তা। আমার কান পাকড়াবার জন্যে টেনিদার হাতটা এগিয়ে আসার আগেই আমি হাওয়া। একেবারে পঞ্জাব মেলের স্পিডে।

টেনিদা চেঁচিয়ে বললে, খিচুড়ির লিস্ট থেকে প্যালার নাম কাটা গেল।

তা যাক। কপালে আজ হরি-মটর আছে সে তো গোড়াতেই বুঝতে পেরেছি। গোমড়া মুখে একটা আমড়া-গাছতলায় এসে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।

বসে বসে কাঠ-পিঁপড়ে দেখছি, হঠাৎ গুটি গুটি হাবুল আর ক্যাবলা এসে হাজির।

–কী রে, তোরাও?

ক্যাবলা ব্যাজার মুখে বললে, খিচুড়ি টেনিদা নিজেই রাঁধবে। আমাদের আরও খড়ি আনতে পাঠাল।

সেই মুহূর্তেই হাবুল সেনের আবিষ্কার! একেবারে কলম্বাসের আবিষ্কার যাকে বলে?

–এই প্যালা–দ্যাখছস? ওই গাছটায় কীরকম জলপাই পাকছে!

আর বলতে হল না। আমাদের তিনজনের পেটেই তখন খিদেয় ইঁদুর লাফাচ্ছে। জলপাই-জলপাই-ই সই! সঙ্গে সঙ্গে আমরা গাছে উঠে পড়লাম–আহাটক-টক-মিঠে-মিঠে জলপাই–যেন অমৃত।

হাবুলের খেয়াল হল প্রায় ঘন্টাখানেক পরে।

–এই, টেনিদার খিচুড়ি কী হইল?

ঠিক কথা খিচুড়ি তো এতক্ষণে হয়ে যাওয়া উচিত। তড়াক করে গাছ থেকে নেমে পড়ল ওরা। হাতের কাছে পাতা-টাতা যা পেলে, তাই নিয়ে ছুটল উধ্বশ্বাসে। আমিও গেলাম পেছনে পেছনে, আশায় আশায়। মুখে যাই বলুক–এক হাতা খিচুড়িও কি আমায় দেবে না? প্রাণ কি এত পাষাণ হবে টেনিদার?

কিন্তু খানিক দূর এগিয়ে আমরা তিনজনেই থমকে দাঁড়ালাম। একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ!

টেনিদা সেই নারকেল গাছটায় হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে। আর মাঝে মাঝে বলছে, দেদে ক্যাবলা, পিঠটা আর একটু ভাল করে চুলকে দে।

পিঠ চুলকে দিচ্ছে সন্দেহ কী। কিন্তু সে ক্যাবলা নয়-একটা গোদা বানর। আর চার-পাঁচটা গোল হয়ে বসেছে টেনিদার চারিদিকে। কয়েকটা তো মুঠো মুঠো চাল-ডাল মুখে পুরছে, একটা আলুগুলো সাবাড় করছে আর আস্তে আস্তে টেনিদার পিঠ চুলকে দিচ্ছে। আরামে হাঁ করে ঘুমুচ্ছে টেনিদা, থেকে থেকে বলছে, দে ক্যাবলা, আর একটু ভালো করে চুলকে দে!

এবার আমরা তিনজনে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম : টেনিদা বাঁদর বাঁদর।

–কী! আমি বাঁদর!বলেই টেনিদা হাঁ করে সোজা হয়ে বসলসঙ্গে সঙ্গেই বাপ বাপ বলে চিৎকার!

–ইঁ-ইঁ-ক্লিচ-ক্লি্চ! কিচ-কিচ!

চোখের পলকে বানরগুলো কাঁঠাল গাছের মাথায়। চাল-ডাল আলুর পুটলিও সেই সঙ্গে। আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তরিবত করে খেতে লাগল–সেই সঙ্গে কী বিচ্ছিরি ভেংচি! ওই ভেংচি দেখেই না লঙ্কার রাক্ষসগুলো ভয় পেয়ে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল!

পুকুরের ঘাটলায় চারজনে আমরা পাশাপাশি চুপ করে বসে রইলাম। যেন শোকসভা! খানিক পরে ক্যাবলাই স্তব্ধতা ভাঙল।

–বন-ভোজনের চারটে বাজল।

–তা বাজল।–টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : কিন্তু কী করা যায় বল তো প্যালা? সেই লেডিকেনিগুলো কখন হজম হয়ে গেছে–পেট চুঁই-চুঁই করছে খিদেয়!

অগত্যা আমি বললাম, বাগানে একটা গাছে জলপাই পেকেছে, টেনিদা

জলপাই! ইউরেকা! বনে ফল-ভোজন–সেইটেই তো আসল বন-ভোজন! চল চল, শিগগির চল!

লাফিয়ে উঠে টেনিদা বাগানের দিকে ছুটল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress