Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

কলিকাতার বাটীতে ব্রজবাবুর স্থানে শিবচন্দ্র এখন কর্তা। মাধবীর পরিবর্তে নূতন বধূ এখন গৃহিণী। মাধবী এখনও এখানে আছে। তাই শিবচন্দ্র স্নেহ-যত্ন করে, কিন্তু মাধবীর এখানে থাকিতে মন নাই। বাড়ির দাস-দাসী, সরকার-গোমস্তা এখনো ‘বড়দিদি’ বলে, কিন্তু সবাই বুঝে যে, আর একজনের হাতে এখন সিন্দুকের চাবি পড়িয়াছে। তাই বলিয়া শিবচন্দ্রের স্ত্রী যে মাধবীকে অবজ্ঞা বা অমর্যাদা করে তাহা নহে, কিন্তু সে এমন ভাবটি দেখাইয়া যায়, যাহাতে মাধবী বেশ বুঝিতে পারে যে, এই নূতন স্ত্রীলোকটির অনুমতি পরামর্শ ব্যতীত সব কাজ করা এখন আর তাহার মানায় না।

তখন বাপের আমল ছিল, এখন ভাইয়ের আমল হইয়াছে। কাজেই একটু প্রভেদ ঘটিয়াছে। আগে আদর ছিল, আবদার ছিল–এখন আদর আছে, কিন্তু আবদার নাই। বাপের আদরে সে সর্বময়ী ছিল, এখন ‘আত্মীয়-কুটুম্বের’ দলে পড়িয়াছে।

এখন যদি কেহ বলেন যে, আমি শিবচন্দ্র কিংবা তাহার স্ত্রীর দোষ দিতেছি, সোজা করিয়া না বলিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া নিন্দা করিতেছি, তাহা হইলে তাঁহারা আমাকে ভুল বুঝিয়াছেন। সংসারে যাহা নিয়ম, যে রীতি-নীতি আজ পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে, আমি তাহারি উল্লেখ করিয়াছি মাত্র। মাধবীর যেন কপাল পুড়িয়াছে, তাহার আপনার বলিবার স্থান নাই, তাই বলিয়া অপরে নিজের দখল ছাড়িবে কেন? স্বামীর দ্রব্যে স্ত্রীর অধিকার, একথা কে না জানে? শিবচন্দ্রের স্ত্রী কি শুধু এ কথা বুঝে না? শিবচন্দ্র নাহয় মাধবীর ভ্রাতা, কিন্তু সে মাধবীর কে? পরের জন্য সে নিজের অধিকার ছাড়িয়া দিবে কেন? মাধবী সব বুঝিতে পারে। বৌ যখন ছোট ছিল, তখন ব্রজবাবু বাঁচিয়া ছিলেন, তখন মাধবীর নিকট প্রমীলাতে ও তাহাতে প্রভেদ ছিল না। এখন কথার অনৈক্য হয়। সে চিরদিন অভিমানিনী, তাই সে
সকলের নীচে। কথা সহিবার ক্ষমতা নাই, তাই সে কথা সহে না। যেখানে তার জোর নাই সেখানে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে তাহার মাথা কাটা যায়। মনে দুঃখ পাইলে নীরবে সহিয়া যায়, –শিবচন্দ্রকে কিছুই বলে না। স্নেহের দোহাই দেওয়া তাহার অভ্যাসের বাহিরে, তাই আত্মীয়তার ধুয়া ধরিয়া অধিকার কায়েম করিতে, তাহার সমস্ত শরীরে মনে ধিক্কার উঠে। সামান্য স্ত্রীলোকের মত ঝগড়া-কলহে তাহার যে কত ঘৃণা তাহা শুধু সে-ই জানে।

একদিন শিবচন্দ্রকে ডাকিয়া বলিল, দাদা, আমি শ্বশুরবাড়ি যাব। শিবচন্দ্র বিস্মিত হইল।—সে কি মাধবী, সেখানে ত কেউ নেই!

মাধবী মৃত স্বামীকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, ছোট ভাগ্নে কাশীতে ঠাকুরঝির কাছে আছে, তাকে’নিয়ে আমি গোলাগাঁয়ে বেশ থাকব।

পাবনা জেলার গোলাগাঁয়ে মাধবীর শ্বশুরবাড়ি। শিবচন্দ্র অল্প হাসিয়া বলিল, তা কি হয়, সেখানে যে তোর বড় কষ্ট হবে।

কেন কষ্ট হবে দাদা? বাড়িটা এখনো পড়ে যায়নি। দু’বিঘা দশ বিঘা জমি-জিরাতও আছে, একটি বিধবার কি তাতে চলে না?

চলার কথা নয়। টাকার ভাবনা নেই, কিন্তু তোর যে বড় কষ্ট হবে মাধবী!

কষ্ট কিছুই নয়।

শিবচন্দ্র কিছু ভাবিয়া বলিল, কেন যাবি বোন? আমাকে সব খুলে বল দেখি, আমি সব মিটিয়ে দিচ্ছি।–ইতিপূর্বে শিবচন্দ্র বোধ হয় স্ত্রীর নিকট ভগিনীর বিরুদ্ধে কিছু শুনিয়া থাকিবে। সম্ভবতঃ তাহাই মনে হইয়াছিল। লজ্জায় মাধবীর সমস্ত মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। সে বলিল, দাদা, তুমি কি মনে কর, আমি ঝগড়া করে তোমার বাড়ি থেকে যাব?

শিবচন্দ্র বড় লজ্জিত হইল। তাড়াতাড়ি কহিল, না না, তা নয়। আমি ও-কথা বলিনে, কিন্তু এ বাড়ি চিরদিনই তোমার, আজ কেন তবে চলে যেতে চাও?

যুগপৎ দুই জনেরই সেই স্নেহময় পিতার কথা মনে পড়িল। দুই জনের চক্ষেই জল দেখা দিল। চোখ মুছিয়া মাধবী বলিল,
আবার আসব। তোমার ছেলের যখন পৈতা হবে, তখন নিয়ে এস। এখন যাই!

সে ত আট-দশ বছরের কথা।

যদি বেঁচে থাকি, তা হলে আসব।

কোনরূপেই মাধবী এখানে থাকিতে সম্মত হইল না, যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিল। নূতনবৌকে সংসার বুঝাইয়া দিল, দাস-দাসীকে ডাকিয়া আশীর্বাদ করিল। শেষ দিনটিতে শিবচন্দ্র অশ্রুপূর্ণ-চক্ষে ভগিনীর কাছে আসিয়া বলিল, মাধবী, তোর দাদা কখনো ত তোকে কিছু বলেনি?

মাধবী হাসিল, বলিল–সে কি কথা দাদা?

তা নয়; যদি কোন অশুভক্ষণে, যদি কোনদিন মুখ থেকে অসাবধানে কিছু–

না দাদা, সে সব কিছু নয়।

সত্যি কথা?

সত্যি!

তবে যা। তোর নিজের বাড়ি যেতে আর মানা করব না। যেখানে ভাল লাগে–। তবে সর্বদা সংবাদ দিতে ভুলিস নি।

প্রথমে মাধবী কাশী গিয়া ভাগিনেয়কে সঙ্গে লইল, তাহার পর তাহার হাত ধরিয়া গোলাগাঁয়ে আসিয়া এই দীর্ঘ সাত বৎসর পরে স্বামী-ভবনে প্রবেশ করিল।

তখন গোলাগাঁয়ে চাটুয্যে মহাশয়ের বড় বিপদ ঘটিল। তিনি এবং যোগেন্দ্রের পিতা উভয়ে বড় বন্ধু ছিলেন। তাই মৃত্যুকালে যোগেন্দ্র যে কয় বিঘা জমি-জায়দাদ ছিল, তাঁহারই হাতে দিয়া গিয়াছিলেন। যোগেন্দ্রনাথের জীবিতকালে, তিনি যে সকলের তত্ত্বাবধান করিতেন, যোগেন্দ্র সে সকলের বিশেষ কোন সংবাদও লইত না। শ্বশুরমহাশয়ের অনেক টাকা, তাই এই ক্ষুদ্র পিতৃ-দত্ত বিষয়টুকু তাহার যত্নের বাহিরে ছিল। তাহার পর সে মরিবার পর চাটুয্যে মহাশয় ন্যায্য অধিকারে বিনা বাধায় সে-সকল ভোগদখল করিতেছিলেন। এখন বিধবা মাধবী এতদিন পরে ফিরিয়া আসিয়া তাহার সুশৃঙ্খল নিয়মবদ্ধ পাতা সংসারে গোলমাল বাধাইয়া দিল। সুতরাং, চাটুয্যে মহাশয়ের ইহা অত্যন্ত অবিচার বলিয়া মনে হইল, এবং মাধবী যে হিংসা করিয়াই
এমনটি করিয়াছে, তাহাও তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন। নিতান্ত বিরক্ত হইয়া আসিয়া বলিলেন, তাইত বৌমা, তোমার দু’ বিঘা যে জমি আছে, তার দশ বৎসরের খাজনা মায় সুদসুদ্ধ একশত টাকা বাকি আছে, সেটা না দিলে জমি নিলাম হবার মত হয়েচে। মাধবী ভাগিনেয় সন্তোষকুমারকে দিয়া বলাইল যে, টাকার জন্য চিন্তা নাই এবং অবিলম্বে একশত টাকা বাহিরে পাঠাইয়া দিল। অবশ্য এ টাকা চাটুয্যে মহাশয়ের অন্য কাজে লাগিল।

মাধবী কিন্তু অত সহজে ছাড়িবার লোক নহে, সে সন্তোষকে পাঠাইয়া জিজ্ঞাসা করিল যে, শুধু দুই বিঘা জমির উপর নির্ভর করিয়া তাহার স্বর্গীয় শ্বশুরমহাশয়ের গ্রাসাচ্ছাদন চলিত না, সুতরাং বাকি যেসব জমি-জায়গা আছে, তাহা কোথায় এবং কাহার নিকট আছে?

চাটুয্যে মহাশয় নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া স্বয়ং আসিয়া বলিলেন যে, তাহা সমস্তই বিক্রয় হইয়া গিয়াছে, কিছু বা বন্দোবস্তে আছে। এই আট-দশ বছর ধরিয়া জমিদারের খাজনা না দিলে জমি-জায়গা কিরূপে থাকা সম্ভব?

মাধবী কহিল, জমির কিছু কি উপস্বত্ব হইত না যে, এই কয়টা টাকা খাজনা দেওয়া হয় নাই? আর যদি যথার্থই বিক্রয় করা হইয়া থাকে, তাহা হইলে সে কে বিক্রয় করিয়াছে, এবং এখন কাহার নিকট আছে, সংবাদ পাইলে উদ্ধার করিবার চেষ্টা করা যায়। কাগজপত্রই বা কোথায়? চাটুয্যে মহাশয় অবশ্য কিছু জবাব দিয়াছিলেন কিন্তু মাধবী তাহা বুঝিতে পারিল না। ব্রাহ্মণ বিড়বিড় করিয়া কত কি বকিলেন, তাহার পর ছাতা মাথায় দিয়া, নামাবলি কোমরে জড়াইয়া একখানা থান কাপড় গামছায় বাঁধিয়া লইয়া জমিদারবাবুর কাছারি লাল্‌তা-গাঁ অভিমুখে রওনা হইলেন। এই লালতা-গ্রামে সুরেন্দ্রনাথের বাটী, এবং ম্যানেজার

মথুরবাবুর কাছারি। ব্রাহ্মণ আট-দশ ক্রোশ বরাবর হাঁটিয়া একেবারে মথুরবাবুর নিকট উপস্থিত হইয়া কাঁদিয়া পড়িলেন–দোহাই বাবা, গরীব ব্রাহ্মণকে বুঝি পথে
পথে ভিক্ষে করে খেতে হয়।

এমন ত অনেকে আসে! মথুরবাবু মুখ ফিরাইয়া বলিলেন, হয়েছে কি?

বাবা, রক্ষে কর।

কি হয়েছে তোমার?

বিধু চাটুয্যে তখন মাধবী-দত্ত একশত টাকা দক্ষিণা হাতে গুঁজিয়া দিয়া বলিলেন, আপনি ধর্মাবতার, আপনি না রক্ষা করলে আমার সর্বস্ব যায়!

আচ্ছা, খুলে বল।

গোলাগাঁয়ের রামতনু সান্যালের বিধবা পুত্রবধূ কোথা থেকে এতদিন পরে ফিরে এসে, আমার সমস্ত দখল করতে চায়।

মথুরবাবু হাসিলেন–সে তোমার সমস্ত দখল করতে চায়, না, তুমি তার সর্বস্ব দখল করতে চাও–কোন্‌টা?

ব্রাহ্মন তখন হাতে পৈতা জড়াইয়া ম্যানেজারের হাত চাপিয়া ধরিলেন–আমি যে এই দশ বছর থেকে সরকারের খাজনা যুগিয়ে আসচি?

জমি ভোগ করচ, খাজনা দেবে না?

দোহাই আপনার–

ভাবটা মথুরবাবু বেশ বুঝিলেন–বিধবাকে ফাঁকি দিতে চাও ত? ব্রাহ্মণ নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

কয় বিঘা জমি?

পঁচিশ বিঘা।

মথুরবাবু হিসাব করিয়া বলিলেন, অন্ততঃ তিন হাজার টাকা। জমিদার কাছারিতে কি সেলামি দেবে?

যা হুকুম হবে তাই,–তিন শ’ টাকা।

তিন শ’ টাকা দিয়ে তিন হাজার টাকা নেবে? আমার দ্বারা কিছু হবে না।

ব্রাহ্মণ শুষ্কচক্ষে জল বাহির করিয়া বলিল, কত টাকা হুকুম হয়?

এক হাজার দিতে পারবে?

তাহার পর গোপনে বহুক্ষণ ধরিয়া দু’জনে পরামর্শ হইল, ফল এই দাঁড়াইল যে, যোগেন্দ্রনাথের বিধবার প্রতি বাকি খাজনা বাবদ দশ বৎসরের সুদে-আসলে দেড়সহস্র টাকার নালিশ হইল। শমন বাহির হইল। কিন্তু মাধবীর নিকটে তাহা পৌঁছিল না। তাহার পর এক তরফা ডিক্রি হইয়া গেল, এবং দেড়-মাস পরে মাধবী সংবাদ পাইল যে
বাকি খাজনার দায়ে জমিদার সরকার হইতে তাহার মায় বাটীসুদ্ধ নিলামের ইস্তাহার জারি হইয়াছে, তাহার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি ক্রোক হইয়াছে।

মাধবী একজন প্রতিবেশিনীকে ডাকিয়া কহিল, তোমাদের দেশ কি মগের মুল্লুক?

কেন বল দেখি?

তা নয় ত কি? একজন ঠকিয়ে আমার সর্বস্ব নিতে চায়, তোমরা দেখচ না?

সে বলিল, আমরা আর কি করব? জমিদার যদি নিলাম করে, আমরা দুঃখী লোক তাতে কি করতে পারি?

তা যেন হল, কিন্তু আমার বাড়ি নিলাম হবে, আর আমাকে সংবাদ নেই? কেমন তোমাদের জমিদার?

সে তখন সমস্ত কাহিনী বিবৃত করিয়া কহিল, এমন উৎপীড়ক জমিদার, এমন অত্যাচার, এ দেশে কেহ কখনও পূর্বে দেখে নাই। সে আরও কত কি কহিল। এ যাবৎ যাহা কিছু লোকপরম্পরায় অবগত ছিল, সমস্ত একে একে খুলিয়া বলিলে, মাধবী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, জমিদারবাবুর সঙ্গে নিজে দেখা করলে হয় না? ভাগিনেয় সন্তোষকুমারের জন্য মাধবী তাহাও করিতে স্বীকৃত ছিল।

সে তখন কিছু বলিতে পারিল না, কিন্তু কথা দিয়া গেল যে, কাল তাহার বোনপোর নিকট সব কথা ভাল করিয়া জানিয়া আসিয়া বলিবে। তাহার বোনপো দুই-তিনবার লাল্‌তা-গ্রামে গিয়াছিল, জমিদার সরকারের অনেক কথা সে জানিত। এমন কি, সেদিন সে বাগানবাড়িতে এলোকেশীর সংবাদ পর্যন্ত শুনিয়া আসিয়াছিল। তাহার পর মাসিমাতা যখন জমিদারবাবুর সহিত রামতনুবাবুর বিধবা পুত্রবধূর দেখা করা সম্বন্ধে প্রশ্ন করিল, তখন সে মুখখানা যথাসম্ভব গম্ভীর করিয়া বলিল, এই বিধবা পুত্রবধূটির বয়স কত?

মাসিমাতা বলিল, কুড়ি-একুশ হবে।

সে মাথা নাড়িয়া বলিল, দেখতে কেমন?

মাসিমাতা কহিল, পরীর মত।

তখন সে মুখভঙ্গী-সহকারে কহিল, দেখা করলে কাজ হতে পারে; কিন্তু আমি বলি, তিনি আজ রাত্রেই নৌকা
ভাড়া করে বাপের বাড়ি প্রস্থান করুন।

কেন রে ?

এই যে বলচ– সে দেখতে পরীর মত।

কেন, তাতে কি?

তাতেই সব। দেখতে পরীর মত হলে জমিদার সুরেন রায়ের কাছে রক্ষে নেই।

মাসিমাতা গালে হাত দিলেন,–বলিস কি, এমন!

বোনপো মৃদু হাসিয়া কহিল, হাঁ, এমন। দেশসুদ্ধ লোক এ কথা জানে।

তবে ত দেখা করা উচিত নয়?

কিছুতেই নয়।

কিন্তু বিষয়-আশয় যে সব যাবে!

চাটুয্যে মহাশয় যখন এর ভিতর আছেন, তখন বিষয়ের আশা নেই। তার উপর গৃহস্থঘরের মেয়ে–ধর্মটাও কি যাবে?

পরদিন তিনি মাধবীকে সমস্ত কথা বলিলেন। শুনিয়া সে স্তম্ভিত হইয়া গেল। জমিদার সুরেন রায়ের কথা সে সমস্ত দিন চিন্তা করিল। মাধবী ভাবিল, সুরেন রায়! নামটি বড় পরিচিত, কিন্তু লোকটির সহিত ত মিলিতেছে না। এ নাম সে কত দিন মনে মনে ভাবিয়াছে। সে আজ পাঁচ বৎসর হইল। ভুলিয়া ছিল–আবার বহুদিন পরে মনে পড়িল।

স্বপ্নে ও নিদ্রায় মাধবীর সে রাত্রি বড় দুঃখে কাটিল। অনেকবার পুরানো কথাগুলো মনে পড়িতেছিল, অনেকবার চোখে জল আসিয়া পড়িতেছিল । সন্তোষকুমার তাহার মুখপানে চাহিয়া ভয়ে ভয়ে কহিল, মামীমা, আমি মা’র কাছে যাব।

মাধবী নিজেও কয়েকবার এ কথা ভাবিতেছিল, কেননা, এখানকার বাস যখন উঠিয়াছে, তখন কাশীবাস ভিন্ন অন্য কোন উপায় নেই। সন্তোষের জন্য সে জমিদারের সহিত দেখা করিবে মনে করিয়াছিল কিন্তু তাহা হয় নাই। পাড়া-প্রতিবাসীরা নিষেধ করিতেছে। তা ছাড়া এখন যেখানেই সে যাক, একটা নূতন ভাবনা, একটা নূতন উপসর্গ হইয়াছে। সেটা এই রূপ-যৌবনের কথা! মাধবী মনে করিল, পোড়াকপাল! এ উৎপাতগুলা কি এখনও দেহটায় লাগিয়া আছে! আজ সাত বৎসর হইল, এগুলা তাহার মনে পড়ে নাই, মনে করাইয়া দিতে
কেহ ছিল না। স্বামী মরিবার পর যখন বাপের বাড়ি ফিরিয়া গেল, তখন সকলে ডাকিল,’বড়দিদি’, সবাই ডাকিল ‘মা’! এই সম্মানের ডাকগুলি তাহার মনকে আরও বৃদ্ধ করিয়া দিয়াছিল। ছাই রূপ-যৌবন! যেখানে তাহাকে বড়দিদির কাজ করিতে হইত, জননীর স্নেহ-যত্ন বিলাইতে হইত, সেখানে কি এসব কথা মনে থাকে! মনে ছিল না, মনে পড়িয়াছে তাই ভাবনাও হইয়াছে। বিশেষ করিয়া এই ‘যৌবনে’র উল্লেখটা! লজ্জায় মলিন হাসি হাসিয়া কহিল, এখানকার লোকগুলা কি অন্ধ, না পশু! কিন্তু মাধবী ভুল করিয়াছিল–সকলেরই মন তাহার মত একুশ-বাইশ বছরে বৃদ্ধ হইয়া যায় না।

ইহার তিনদিন বাদে যখন জমিদারের পিয়াদা তাহার দ্বারপথে আসন করিয়া বসিল এবং হাঁক-ডাক করিয়া গ্রামবাসীকে জানাইতে লাগিল যে, সুরেন রায় আর একটা নূতন কীর্তি করিয়াছে, তখন মাধবী সন্তোষের হাত ধরিয়া দাসীকে অগ্রবর্তিনী করিয়া নৌকায় উঠিয়া বসিল।

বাটীর অদূরেই নদী; মাঝিকে কহিয়া দিল, সোমরাপুরে যাইতে হইবে। একবার প্রমীলাকে দেখিয়া যাইতে হইবে।

গোলাগাঁ হইতে পনর ক্রোশ দূরে সোমরাপুরে প্রমীলার বিবাহ হইয়াছিল। আজি এক বৎসর হইতে সে শ্বশুরঘর করিতেছে। সে হয়ত আবার কলিকাতায় যাইবে, কিন্তু মাধবী তখন কোথায় থাকিবে? তাই একবার দেখা করা।

সকালবেলা সূর্যোদয়ের সঙ্গে মাঝিরা নৌকা খুলিয়া দিল। স্রোতের মুখে নৌকা ভাসিয়া চলিল; বাতাস অনুকূল ছিল না, তাই ধীরমন্থর গমনে ক্ষুদ্র নৌকা বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়া,শিয়াকুল ও বেতঝোপের কাঁটা বাঁচাইয়া,শরঝাড় ঠেলিয়া ধীরে ধীরে চলিল। সন্তোষকুমারের আনন্দ ধরে না! সে ছইয়ের ভিতর হইতে হাত বাড়াইয়া গাছের পাতা ও ডগা ছিঁড়িবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল। মাঝিরা কহিল, বাতাস না থামিলে, কাল দুপুর পর্যন্ত নৌকা সোমরাপুরে লাগিবে না।

আজ মাধবীর একাদশী, কিন্তু সন্তোষকুমারের জন্য কোথাও পানসি বাঁধিয়া,
পাক করিয়া তাহাকে খাওয়াইতে হইবে। মাঝি কহিল, দিস্তেপাড়ার গঞ্জে নৌকা বাঁধিলে বেশ সুবিধা হইবে, সেখানে সব জিনিস পাওয়া যায়।

দাসী কহিল, তাই কর বাপু, যেন দশটা-এগারটার মধ্যে ছেলেটা খেতে পায়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress