Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বটুকবুড়োর চশমা || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 5

বটুকবুড়োর চশমা || Shirshendu Mukhopadhyay

তা রোজগারপাতি আজও কিছু

তা রোজগারপাতি আজও কিছু কম হল না নবর।

গুনেগেঁথে দেখল, সকাল থেকে মাত্র ঘণ্টা তিনেকের মেহনতে তিনশো বাহান্ন টাকা। এই রেটে চলতে থাকলে বছরটাকের মধ্যে নন্দকিশোরের আট বিঘে ধানিজমি, সতু হাজরার আটা চাক্কি, যদু ঘোষের বসতবাড়ি আর অন্তত একটা দুধেল গাই কিনে ফেলতে পারবে।

নামাবলিখানা ভাঁজ করে, পুঁথিপত্র গুছিয়ে চশমাজোড়া খুলতে যাবে, এমন সময় একজন মোটাসোটা লোক, “বেঁধে ঠাকুরমশাই, বেঁধে! ও কাজ করবেন না, তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! প্রলয় ঘটে যাবে!” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে, হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাজির। নব ঘাবড়ে গিয়ে থপ করে বসে পড়ল।

লোকটা সামনে এসে বসে পড়ে বলল, “করছিলেন কী ঠাকুরমশাই! সেই গেড়েপোতা থেকে আপনার শ্রীচরণ দর্শনে কত কষ্ট করে আসছি, আর আপনি পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলছিলেন?”

নব আমতা আমতা করে বলল, “না, এই বেলা হয়েছে তো! মানুষের স্নানাহার বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!”

পকেট থেকে ফস করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে হাতে গুঁজে দিয়ে হেঁঃ হেঁঃ করে বলল, “আজ্ঞে, গ্রহ-তারকা, রাহু কেতু চিবিয়ে ছাতু করে ফেলছেন, আপনার আবার স্নানাহার! ও হবেখন। তা ঠাকুরমশাই, শরীরগতিক সব ভাল তো?”

“যে আজ্ঞে।”

“আজ্ঞে, সেই যে জষ্টি মাসে বলেছিলেন, সাইকেল থেকেই আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করবে! মনে নেই আপনার?”

নব মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, কতজনাকেই তো রোজ কত কিছু বলতে হয়, সব কি আর স্মরণে থাকে?”

“তা তো বটেই, তা তো বটেই! চুনো-পুঁটিদের মনে রাখাটাও কাজের কথা নয় কিনা। আর আপনারা হলেন গিয়ে বাকসিদ্ধাই, মুখের কথাটি খসল কী সেটাই বোমা হয়ে ফাটল। ওঃ, কী কাণ্ড মশাই!”

নব আঁতকে উঠে বলল, “বোমা ফেটেছে নাকি? ও বাবা!”

“আহা, সেই বোমা নয়! এ হল বাক্যের বোমা, একেবারে অব্যর্থ। তা মশাই, একদিন সত্যিই ওই সাইকেলে চেপেই আমার ভবিতব্য ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে এসে হাজির।”

নব ভারী খুশি হয়ে বলল, “তাই নাকি?”

“তবে আর বলছি কী! দুপুরবেলা সবে খেতে বসেছি, পঞ্চদেবতাকে নিবেদন করে সবে উচ্ছেসেদ্ধ দিয়ে এক গরাস মুখে তুলেছি কি তুলিনি, অমনি বাইরে সাইকেলের পিরিং পিরিং ঘণ্টি। ছোট মেয়ে পটলি ছুটে এসে বলল, ও বাবা, তোমার টেলিগ্রাম এসেছে। কী মুশকিল বলুন, ভাত ছেড়ে উঠলে পাত ত্যাগ হয়ে যাবে। সারা দিনমানে আর অন্নজল মুখে ভোলার উপায় নেই। আর আমার বাড়ির লোকগুলোও সব ক অক্ষর গোমাংস। তখন পিয়ন নীলমণি হাঁক দিয়ে বলল, “ও বিদ্যেধর, আজকের মতো ভাত খাওয়া এমনিতেই ঘুচেছে। টেলিগ্রামে খবর এসেছে যে, তোমার খুড়োমশাই গত হয়েছেন।”

“আহা, কিন্তু এ তো বড় দুঃখের খবর মশাই।”

“কে বলল দুঃখের খবর?”

নব অবাক হয়ে বলল, “নয়? কিন্তু আমি যেন শুনেছিলুম খুড়ো জ্যাঠা গত হওয়া দুঃখেরই ব্যাপার!”

“আহা, তা তো বটেই। তবে কিনা কোনও কোনও খুড়ো গত হলে কারও কারও একটু সুবিধেও হয় আর কী। এই আমার স্বর্গত খুড়োমশাইয়ের কথাই ধরুন। বছরটা আগে বড্ড আতান্তরে পড়ে তিনশোটি টাকা ধার চাইতে গিয়েছিলুম। তা খুড়োমশাই ফস করে একটা হিসেবের খাতা বের করে গড়গড় করে খতিয়ান দিয়ে বললেন, “আমি নাকি গত বাইশ বছরে তাঁর কাছ থেকে মোট এগারো হাজার তিনশো বারো টাকা হাওলাত নিয়ে এক পয়সাও শোধ দিইনি। বুঝুন কাণ্ড! যার অত বড় ফলাও অবস্থা, ত্রিশ বিঘে ধানিজমি, আম-নারকোলের বাগান, মাছের পুকুর আর তেজারতির ব্যাবসা, তার কাছে ওটা একটা টাকা হল? তা বুক ঠুকে সেদিন বলেই ফেললুম, “খুড়ো, আপনি পটল তুললে আপনারটা খাবে কে? এই শৰ্মাই তো আপনার একমাত্র ওয়ারিশান। তারপর মুখাগ্নি, শ্রাদ্ধশান্তি সেসবও আমি ছাড়া করার লোক নেই!’ এ কথায় খাপ্পা হয়ে খুড়ো আমাকে খড়ম-পেটা করে তাড়ালেন। বুড়ো বয়সে কী অপমান বলুন? খুড়িমা বেঁচে থাকতে এত অনাদর ছিল না। বছর দুই আগে তিনি মরে গিয়ে ইস্তক খুড়োমশাই যেন আরও কঞ্জুস, আরও তিরিক্ষি হয়ে উঠেছিলেন। তার ফলটা কী হল দেখুন।”

“কী হল বলুন?”

“অপঘাত মশাই, অপঘাত! একপাল শেয়াল ক’দিন ধরে বাগানের ফলপাকুড় খেয়ে বেজায় ক্ষতি করে যাচ্ছিল। তাই সেদিন সন্ধের মুখে বন্দুক নিয়ে খুড়োমশাই শেয়াল মারতে বেরিয়েছিলেন। তখনই ভূত দেখে হার্টফেল হয়। গত জষ্টি মাসে আপনি চেতাবনি দিয়েছিলেন, সাইকেলে চেপে আমার ভাগ্য আসবে। একেবারে চার মাসের মাথায় কাঁটায় কাঁটায় ফলে গেল। তা সব দখলটখল নিয়ে এখন জেঁকে বসেছি আর কী। তাই ভাবলুম আপনাকে আর একবার হাতটা দেখিয়ে যাই। তা দেখুন তো ঠাকুরমশাই, সামনে আর কী কী ভাল জিনিস আসছে?”

নব একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনার খুডোমশাই ভূত দেখে হার্টফেল হয়েছিলেন বুঝি?”

বিদ্যেধর সতর্ক চোখে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “লোকে নানারকম কথা রটাচ্ছে মশাই! কেউ কেউ বলছে সম্পত্তির লোভে আমিই নাকি খুড়োকে মেরেছি! ও কথায় মোটেই কান দেবেন না মশাই। সন্ধেবেলা শেয়াল মারতে বেরিয়ে খুড়োমশাই যে ভূতটাকে ভুষনোর মাঠে জঙ্গলের ধারে দেখেছিলেন, সেটা তালগাছের মতো লম্বা, আর তার গায়ের রং সবুজ। নির্যস সত্যি কথা। আর আপনার কাছে লুকিয়ে তো লাভ নেই। ত্রিকালদশী মানুষ আপনি, আপনার কাছে মিছে কথা বলে কি পার পাওয়ার জো আছে…? ভুষনোর মাঠের সেই ভূতকে রাতবিরেতে অনেকেই দেখেছে। আমার ছেলে বলাইয়ের বয়স এই সাত বছর, সেও নাকি দেখেছে সবুজ রঙের ঢ্যাঙা ভূতটা সন্ধের পর আনাচে-কানাচে ঘুরে কেঁচো আর গুবরেপোকা তুলে নিয়ে খায়। কী নিঘিন্নে জীব বলুন!”

নব আতশ কাঁচটা বের করে বলল, “শেয়াল মারতে যাওয়াটা আপনার খুড়োর উচিত কাজ হয়নি।”

বিদ্যেধর গলা নামিয়ে বলল, “আমরাও তো তাই বলাবলি করি। তা শেয়ালে দুটো ফলপাকুড় খাচ্ছিল তো খেত। কিন্তু খুড়োমশাইয়ের তো ওইটেই মস্ত দোষ ছিল কিনা। পুরনো জুতোজোড়া অবধি প্রাণে ধরে কাউকে দেননি কখনও। কেউ কুটোগাছটি সরালেও খেপে উঠে লাঠিসোটা নিয়ে তাড়া করতেন। আর তাই তো বেঘোরে প্রাণটা দিতে হল।”

“আপনার খুড়োমশাইয়ের খুব ভূতের ভয় ছিল নাকি?”

“খুব, খুব। দিনমানে পর্যন্ত কাছে লোকজন রাখতেন। সন্ধের পর বড় একটা ঘরের বাইরে বের হতেন না। সেদিন যে কোন নিশির ডাক শুনে হুড়োহুড়ি করে বেরোতে গেলেন কে জানে? আর ভূতেরাও কেন ভুষনোর মাঠে ঘুরঘুর করছে কে জানে!”

“আপনাদের গেজেঁপোতায় কি খুব ভূতের উপদ্রব নাকি?”

“আমি অবিশ্যি দেখিনি, তবে শুনি, ইদানীং তেনাদের আনাগোনা বড্ড বেড়েছে। অনেকেই দেখতে পাচ্ছে তাঁদের। ক’দিন হল দেখছি, দু-তিনজন উটকো লোকও এসে ভুষনোর মাঠের ঝোঁপঝাড়ে ওত পেতে বসে থাকে। তারা ওঝা-বদ্যিই হবে কিংবা ফকির-দরবেশ। আমাদের নিয়ামত ফকিরবাবা তো ভূত ধরে শিশিতে মশলা-তেলে ভিজিয়ে রেখে দিতেন। এদেরও মনে হয় সেই মতলব। তা ভূতের বাজারদর এখন কেমন যাচ্ছে ঠাকুরমশাই?”

নব তার জিনিসপত্র গুটিয়ে উঠে পড়ল। বলল, “আমার স্নান খাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে মশাই। আমি চললুম।”

.

হালদারপুকুর হল ভারী একটেরে নিরিবিলি জায়গা। ওপারে ফলসার ঘন বন, চারদিকে জমাট বাঁধা ঝোঁপঝাড়। এ পাশটায় জনমনিষ্যির বড় একটা যাতায়াত নেই। চারদিকে গাছে মেলা পাখিপক্ষী আছে, জঙ্গলে কাঠবিড়ালি, গিরগিটি, সাপ, বেজি, তক্ষক, বাঁদর আর মেঠোহঁদুরের অভাব নেই। পুরনো ভাঙা ঘাটলায় বসে সকাল থেকে ছিপের ফাতনার দিকে নজর রাখছেন বিরাজমোহন। ওই একটা কাতলা মাছ এক বছর ধরে তাঁকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। সত্যিকারের ধরা পড়েছিল একবারই। গত বছর। কিন্তু ধূর্ত মাছটা বঁড়শি গিলেও এমন চুপ করে রইল, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। বিরাজমোহন সেদিন লুচি আর মোহনভোগের পেল্লায় জলখাবার খেয়ে এসেছিলেন। সকালের মনোরম আবহাওয়ায় বয়সের দোষে একটু ঘুম এসে গিয়ে থাকবে। সেই ফাঁকে শয়তান মাছটা ছিপ টেনে নিয়ে পালাল। সেই ছিপ পরে উদ্ধার হয় বটে, কিন্তু সুতোটা কাটা ছিল। সেই থেকে এই পর্যন্ত মাছটা বিরাজমোহনের আরও তিনটে দামি হুইল বঁড়শি ছিনতাই করেছে। তার মধ্যে দুটি আর পাওয়া যায়নি। বিরাজমোহন আজকাল স্বপ্ন দেখেন, বিরাট কালো মাছটা বিরাজমোহনের আহাম্মকির কথা ভেবে মাঝরাতে জলের মধ্যে অট্টহাস্য করে।

আজও সকাল থেকে বসে গিয়েছেন বিরাজমোহন। কাতলার সঙ্গে তাঁর লড়াই কবে শেষ হবে কে জানে? কিন্তু ধৈর্য হারানোর পাত্র তিনি নন। একটি ইতর প্রাণীর কাছে এরকম লজ্জাজনকভাবে হেরে যাওয়াকে তিনি খুবই অপমানজনক বলেই মনে করেন। নিত্য নতুন চারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আজও একটি আনকোরা নতুন চার লাগিয়েছেন তিনি। অতি মজবুত সুতো এবং খুবই দামি হুইল ছিপ।

ঘণ্টাখানেক কেটে যাওয়ার পর বিরাজমোহন হঠাৎ খুব জোরালো ঝিঝির ডাক শুনতে পেলেন। ঝিঝির শব্দই, তবে একটু যেন অন্যরকম। কেমন যেন তালে-লয়ে ঝিঝি ডাকছে। সেই সঙ্গে দেখতে পেলেন ফাতনা একটু একটু নড়তে লেগেছে। বিরাজমোহন ছিপটা শক্ত করে ধরে রইলেন।

হঠাৎ জলে একটা বিপুল ঘাই মেরে মাছটা একবার ভেসে উঠে বিরাজমোহনকে যেন জিভ ভেঙিয়ে আবার জলে ডুব দিল।

তারপরই ছিপে প্রচণ্ড টান। আচমকা টানে ছিপটা আজও চলে যাচ্ছিল প্রায়। একেবারে শেষ মুহূর্তে সামাল দিয়ে বিরাজমোহন সুতো ছাড়তে লাগলেন। মাছটা অনেক দূর চলে গেল। আবার বিরাজমোহন সুতো গুটিয়ে টেনে আনলেন মাছটাকে। আবার মাছটা সুতো নিয়ে পালাতে লাগল। খেলাটা ভারী জমে উঠতে লাগল। এতদিনে ব্যাটা ঠিকমতো বঁড়শি গিলেছে বলে টের পাচ্ছেন বিরাজমোহন। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি মাছটাকে খেলাতে লাগলেন।

আজ যে তার ভাগ্য সদয় তা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বুঝতে পারলেন বিরাজমোহন। কারণ, মাছটা যে হেদিয়ে পড়ছে তা তিনি সুতোর টান দেখেই অনুমান করতে পারছেন। আর-একটু খেলিয়ে নিয়েই এবারে তুলে ফেলতে পারবেন।

ঠিক এই সময় মাঝপুকুরে ভুস করে একটা মাথা জলের উপর জেগে উঠল। সেই সঙ্গে তীব্র ঝিঝির শব্দ। বিরাজমোহন অবাক হয়ে দেখলেন, মাথাটা একজন মানুষের, তবে আকারে বড় এবং রং গাঢ় সবুজ। লোকটা তার দিকে এমনভাবে চেয়ে রইল যে, বিরাজমোহনের গা দিয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে লোকটা মাঝপুকুরে উঠে দাঁড়াল। বিরাজমোহন দেখলেন, হালদার পুকুরের মতো গভীর জলেও লোকটার মাত্র কোমর অবধি ডুবে আছে। আর তার বাঁ হাতে সাপটে ধরা একটা বিশাল কাতলা মাছ লেজ ঝাঁপটাচ্ছে, মুখে বঁড়শিটা গেঁথে আছে এখনও।

সবুজ লোকটা খুব যত্ন করে মাছের মুখ থেকে বঁড়শিটা খুলে নিয়ে মাছটাকে আবার জলে ছেড়ে দিয়ে বিরাজমোহনের দিকে আঙুল তুলে যেন কিছু বলল। ভাষাটা বুঝতে পারলেন না বিরাজমোহন। শুধু ঝিঝির ডাক তো কোনও ভাষা হতে পারে না। কিন্তু বিরাজমোহন ওই ঝিনঝিন শব্দের মধ্যেই যেন লুকিয়ে থাকা বাক্যটা বুঝতে পারলেন।

লোকটা যেন বলল, “এখান থেকে চলে যাও। আর কখনও এ কাজ কোরো না।”

বিরাজমোহন কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “ভুল হয়ে গিয়েছে বাবা, আর কখনও হবে না।”

ছিপটিপ ফেলে বিরাজমোহন সিঁড়ি বেয়ে উঠে একরকম দৌড়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তারপর বুড়ো বয়সে দৌড়ের ধকলে এমন হাঁফিয়ে পড়লেন যে, কিছুক্ষণ কথাই কইতে পারলেন না।

বীরেনবাবু তাকে দেখে শশব্যস্তে উঠে ধরে এনে বসালেন। “কী হয়েছে বিরাজজ্যাঠা?”

“ভূতে বিশ্বাস করিস?”

“ফুঃ! ভূতটুত কেউ বিশ্বাস করে নাকি? আজগুবি ব্যাপার।”

“আমি এইমাত্র হালদারপুকুরে ভূত দেখে এলাম। শুধু দেখাই নয়, কাতলা মাছটাকে এক বছরের চেষ্টায় আজ বাগে এনে প্রায় তুলেও ফেলেছিলাম। ঠিক সেই সময় জলের ভিতর থেকে একটা সুড়ঙ্গে লম্বা মূর্তি বেরিয়ে এসে মাছটা কেড়ে নিয়ে জলে ছেড়ে দিল। তারপর সে কী তড়পানি! সোজা আঙুল তুলে জানিয়ে দিল, হালদারপুকুরে ফের গেলে দেখে নেবে।”

বীরেনবাবু খুবই চটে গিয়ে বললেন, “হালদারপুকুর তো আমরা বছর চারেক আগেই কিনে নিয়েছি। ও আমাদের খাসপুকুর। কার এত সাহস যে, হালদারপুকুর থেকে আপনাকে তাড়িয়ে দেয়? এক্ষুনি লোজন পাঠাচ্ছি। জবর দখল করা বের করছি আজই। দরকার হলে রক্তারক্তি করে ছাড়ব।”

“মাথা গরম করিসনি। সে মনিষ্যি হলেও না হয় কথা ছিল।”

“মানুষ না তো কী?”

বিরাজমোহন মাথা নেড়ে বললেন, “মানুষ কি আট-দশ হাত লম্বা হয় নাকি তার গায়ের রং সবুজ হয়?”

বীরেনবাবু হা হয়ে গেলেন, তারপর বললেন, “সবুজ মানুষ! মানুষের ন্যাবাট্যাবা হলে রং হলদেটে মেরে যায়। জানি, রোদে পুড়লে কালচেও মেরে যায়। কিন্তু সবুজ হচ্ছে কোন সুবাদে? এই তো সেদিনও ভেচকুড়ি-কাটা লোকটা সবুজ মানুষের কথা বলছিল। এ তো বড় সমস্যা হল দেখছি! পুলিশে একটা খবর দেওয়া দরকার।”

বিজয়বাবু সব শুনে বললেন, “এটা নিয়ে বেশি হইচই করার দরকার নেই। আপাতত বিরাজদাও আর হালদারপুকুরে না গেলেই ভাল। কারণ, সবুজ মানুষেরা মাছটাছ ধরা পছন্দ করে না।”

বীরেনবাবু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “কিন্তু এটা তো আমাদের পক্ষে অপমান! আমাদের পুকুরে আমরা মাছ ধরব তাতে অন্যে বাগড়া দিতে আসবে কেন? এত আস্পদ্ধা কার?”

বিজয়বাবু মৃদু স্বরে বললেন, “আস্পদ্ধা কাঁদের হয় জানিস? যারা শক্তিমান। আমার ধারণা তুই লোকজন, লেঠেল পাঠিয়েও তাদের কিছুই করতে পারবি না।”

“ওরা কারা বিজয়জ্যাঠা?”

“সেটা আমিও ভাল জানি না, তবে জানবার চেষ্টা করছি। সবুজ মানুষরা আমাদের কিছু বলতে চাইছে। সেটা হয়তো খুব খারাপ কথাও নয়।”

বীরেনবাবু বললেন, “কথা কইতে চায় তো ভাল কথা, বাড়িতে এসে চা খেতে খেতে বলুক না। অসুবিধে কোথায়?”

বিজয়বাবু বললেন, “অসুবিধে আছে। তুই বুঝবি না।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress