Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বকধার্মিক || Lila Majumdar » Page 3

বকধার্মিক || Lila Majumdar

১১.

আমরা অসুখ করে যে-যার বিছানায় পড়ে থাকি। নেপু উঠে মাঝে মাঝে ঘুর ঘুর করে বেড়ায়, তবে ঘর ছেড়ে বার হবার হুকুম নেই। খুব জ্বালায় আমাকে। রাতে আমাদের চোখে ঘুম আসে না। মা জেঠিমারা কতরকম গল্প বলেন, ওঁদের ছেলেবেলার গল্প, ভূতের গল্প, জানোয়ারদের গল্প।

কেমন করে জেঠিমার ঠাকুরদাদা নৌকো করে গঙ্গাসাগরে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছোবার ঠিক আগে কুয়াশায় চারদিক ছেয়ে গেল, তারপর জোর জলঝড় উঠল, নৌকো কোথায় ভেসে গেল তার ঠিক নেই। ভোরে দেখেন একেবারে গহিন সাগরে গিয়ে পড়েছেন। জলের মাঝখানে উঁচু উঁচু দুটো কালো পাথর উঠে রয়েছে। সেই পাথরের ওপর থেকে কী সুন্দর। গান আসছে। মনও কেমন করে, আবার ভয়ও করে শুনলে। মাঝিরা ওঁকে নিয়ে কোনোরকমে নৌকো চালিয়ে এল। ফিরে আবার গঙ্গাসাগরে যখন পৌঁছুল, সবাই বললে বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছ। কিন্তু তার পর থেকে ঠাকুরদাদা কেমন যেন হয়ে গেলেন, আর কোনো সুখ ভোগ ভালো লাগত না তার।

কেমন করে এক সন্ন্যাসীঠাকুর আমার মার দাদামশাইয়ের বাবাকে একটা কালো পাথর দিয়েছিল, বলেছিল তাই দিয়ে যা ছোঁয়াবে তাই সোনা হয়ে যাবে যদি মনে পাপ না থাকে। দাদামশায়ের চোখের সামনে একটা বটফলকে সোনা করে দিয়েও ছিল। কিন্তু সে চলে গেলে পর, আর কিছুকে সোনা করা গেল না। পাপ নেই এমন লোক কোথায় আছে?

বড়োবউদিও বললেন, আমাদের একজন পূর্বপুরুষ একবার ঘোর জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে দেখেন, একজন পরমাসুন্দরী মেয়ে গাছতলায় বসে হাউহাউ করে কাঁদছে। তাকে যত্ন করে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে বাড়ি নিয়ে এলেন, কিন্তু বাড়ি পৌঁছেই মেয়েরা তাকে যেই-না চান করাবার জন্যে শ্বেতপাথরের বাঁধানো চৌবাচ্চায় জলের মধ্যে নামিয়েছে, অমনি সে চিনির মতো গলে গেল! জলের নীচে তার দু-হাতের দুখানি মোটা মোটা সোনার বাউটি থাকল। সে বাউটি এখনও আমাদের দেশের বাড়িতে সিন্দুকে বন্ধ আছে।

আমাদের শংকরঠাকুরও কম্বল মুড়ি দিয়ে, মাথায় মঙ্কি-ক্যাপ পরে দোর গোড়ায় বসে গল্প শুনছিল, সে বললে, আমাদের দেশে সন্ধ্যের পর ওনাদের ভয়ে কেউ পথে বেরুতে চায় না। আমাদের পিস-শাশুড়ি কী যেন মাড়িয়ে, সন্ধ্যে বেলায় পুকুরঘাট থেকে ডুব দিয়ে ভিজে কাপড়ে ফিরছেন, এমন সময় দেখেন কাঁদের যেন ছোটো মেয়ে ঘাটের কাদায় আছাড় খেয়ে পড়ে গেছে।

পিসিমাও অমনি আহা, বাছারে, বলে ছুটে গিয়ে তাকে কোলপাজা করে তুলেছেন, আর অমনি ঝোঁপের আড়াল থেকে সাদা কাপড়-পরা তার মা বেরিয়ে এসেছে। পিসিমা তার কোলে মেয়ে দিয়ে, বাড়ি ফিরে পিদ্দিমের আলোতে অবাক হয়ে দেখেন যে, তার হাতের শাঁখাজোড়া আর আঁচলের চাবিগাছি আগাগোড়া সোনার হয়ে গেছে।

গল্প বলার মাঝে মাঝে এক-এক বার সবাই থেমে যাচ্ছে, আর অমনি বাইরের গাছ থেকে পাতা খসার শব্দ, টিনের ছাদের মটমট শব্দ, বাড়ির পেছনে ছোটো নদীর ওপারে সরল গাছের বনে হু-হুঁ করে বাতাস দেওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

অদ্ভুত সব চুরির গল্পও হল। তার কাছে আমাদের এখানকার চুরির কথা কোথায় লাগে!

জেঠিমাদের বংশ-পরিচয়তে লেখা আছে যে বাংলাদেশে এসে বসবার আগে, ওঁদের পূর্বপুরুষরা বেহারে কোথাও থাকতেন। তারা নাকি সেখানকার রাজা ছিলেন! একদিন ছেলেরা সব মৃগয়া করতে গেছেন, আর মেয়েরা সেই সুযোগে, দরজায় বড়ো বড়ো কুলুপ এঁটে, দাস-দাসী, পাহারাওয়ালা, সেপাই-সান্ত্রি সব নিয়ে গ্রামের মাঠে ছট পুজো দেখতে গেছেন। ভোরবেলা বাড়ি ফিরে দেখেন সব ভোঁ ভোঁ, কোথাও কিছু নেই! বাড়িঘর, পুকুর, বাগান, বাঁধানো ঘাট, কোনো কিছুর এতটুকু চিহ্ন নেই। চারদিকে শুধু অসংখ্য হাতির পায়ের ছাপ। এইসব কারণেই বেহার ছেড়ে ওঁরা বাংলাদেশে এসে বসতি করতে লাগলেন।

জগদীশদার পিসিমাও ক-দিন আমাদের এখানে আছেন। একা বাড়িতে ভয় করে। পুবের আধখানাতে ভাড়াটে এলেই আবার নিজের বাড়িতে ফিরে যাবেন।

ওইসব গল্প শুনতে শুনতে পিসিমা একেবারে জেঠিমার গা ঘেঁষে বসে বললেন, বাবা! এসব কথা শুনলেও গায়ে কাঁটা দেয়। তবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। দশ বছর আগেও ও বাবা! ওটা কী?

ঠক করে কী একটা ভারী জিনিস জানলার একটা শার্সি ভেঙে পিসিমার কোলের কাছে পড়ল। পিসিমা প্রায় ভিরমি যান আর কী! আমি সেটাকে তুলে দেখি একটা বেশ বড় নুড়ি পাথরের চারদিকে জড়ানো একটা সাদা কাগজ, তাতে লাল পেনসিল দিয়ে আঁকাবাঁকা হরফে লেখা, প্রজাপতির জন্যে ধন্যবাদ।

চিঠি পড়ে পিসিমার সত্যি সত্যি হাত-পা এলিয়ে গেল। জেঠিমার গায়ে একেবারে ঢলে পড়লেন।

এমনি সময় বাবা আর জ্যাঠামশাই ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে কী সব বলাবলি করতে করতে এসে উপস্থিত হলেন। ডাক্তারবাবু আমাদের পেট-টেট টিপে, ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন, তারপর তোমাদের গোয়েন্দাগিরির তা হলে এখেনেই ইস্তফা, কী বল নেপুবাবু? নেপু বললে, কেন কেন!

ডাক্তারবাবু খুব হাসলেন, ওমা খবর শোননি বুঝি? থানায় যে উড়ো চিঠি এসেছে, জঙ্গলের মধ্যে ভূতের বাড়ির দেয়ালের মধ্যে চোরাকুঠরিতে সব চোরাইমাল গুম করা আছে। আর অর্কিড ফুল কোথায় জান? ম্যাজিস্ট্রেটের সামনের বারান্দা থেকে তুলে নিয়ে, আস্তাবলের পেছনের বারান্দায় ঝোলানো!– আচ্ছা, এবার তাহলে সোনাহানা মুখ করে এই তেঁতো ওষুধগুলো গিলে ফেলো দিকিনি। আঁ, এই ঠিক হয়েছে, এবার বাছাধনরা যে যার শুয়ে পড়ো তো।

ডাক্তারবাবু ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে হাসতে পাশের ঘরে গিয়ে বসলেন, অনেক রাত অবধি গল্পগুজব চলল। মা জেঠিমারাও কেউ আমাদের ঘরে এলেন না। আমরা খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে, যে-যার লেপ গায়ে দিয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম,এ আবার কী কথা! চোর কি তাহলে ধরা পড়বে না? যে জিনিস ফিরিয়ে দেয় সে কি চোর?

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।

১২.

পরদিন শহরে সে কী হইচই! সে সময়কার কথা বললে সহজে কেউ বুঝতে পারবে না। সারা বছর শহরটা যেন ঘুমিয়ে থাকত, একটা কিছু ঘটলে হঠাৎ জেগে উঠে বসত। তাই নিয়ে সে যে কী উত্তেজনা চলত, যারা আজকাল শহরে বাস করে, তারা কোনমতেই বুঝতে পারবে না।

বাজার পর্যন্ত ভালো করে বসল না সেদিন। সকালে দুধওয়ালা, রুটি-মাখনওয়ালা, ডিমওয়ালা কেউ এল না। মাছওয়ালাও অনেক বেলা করে এসেছিল, তাও নেহাত না এলে মাছ পচে যেতে পারে বলে।

দলে দলে সবাই বনের মধ্যে ভূতের বাড়িতে কী পাওয়া গেল দেখতে চলল।

বড়দাও গেছল। এসে বলল, দুটো দেয়ালের মাঝখানে লুকোনো একতি ফালি ঘর। দরজার মাথার ওপর নকশাকরা একটা ফুল, তারি মাঝখানটা টিপলে, পাশের দেয়ালের খানিকটা ফাঁক হয়ে গিয়ে, চোরাকুঠরি বেরিয়ে পড়ে।

মাটি থেকে ছাদ অবধি জিনিসপত্রে ঠাসা। যেখানকার যেমন হারিয়েছিল ঠিক তেমনি অবস্থায় রাখা হয়েছে। অবিশ্যি খাবার জিনিসগুলো নেই। ম্যাজিস্ট্রেটের কুকুরটাও নেই।

সারাটা দিন, তারপর আরও চার-পাঁচ দিন লেগেছিল, নিজেদের জিনিস চিনে নিয়ে, পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে।

জিনিস হারানোর সময় যত-না হুলস্থূল হয়েছিল, এ তার চাইতেও বেশি হল।

আমাদের বাক্সটাও বন্ধ অবস্থাতেই পাওয়া গেল। বাক্সের ওপর একটা পাথরের থালা চাপানো ছিল, সেটাসুদ্ধু তেমনি রয়েছে।

বিকেলে জেঠিমা বললেন, একে আবার চুরি বলে না কি? জিনিস না হারালে আবার চুরি কী?

জগদীশদার পিসিমা বললেন, জিনিস হারায়নি তো আমার সোনার কৌটো কই? হিরের প্রজাপতিটে কই? তোদের এত ফুর্তি কীসের গা? চোর ধরা পড়বে না? তার সাজা হবে না? আমার জিনিস ফিরে পাব না?

নেপু বললে, ইস্কুল খুললে, অপূর্বদা এসে একবারটি দেখলেই সব বুঝে নেবেন। অপূর্বদা বলেছেন বিলেতে কিছু চুরি গেলে, ঘরের জিনিসপত্রের ওপর কী-একটা গুঁড়ো ছড়িয়ে, তার ফোটো তোলা হয়। ব্যস, চোরের আঙুলের ছাপের ছবি পাওয়া যায়। তাপ্পর আর কী, ওই ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দু-দিনেই চোর গ্রেপ্তার হয়। দেখিস এসেই ওইসব করাবেন।

শুনে পিত্তি জ্বলে গেল। বললুম, রেখে দে তোর গুফো মাস্টারের ক্যারানি! ভূতের ভয়ে রাতে জানলা না বন্ধ করলে যার ঘুম হয় না, তার আবার কথা!

নেপুও চটে গেল, মোটেই ভূতের ভয়ে নয়। ওর হাঁপানির রোগ আছে।

বললুম, রেখে দে তোর হেঁপো মাস্টারের কথা!

নেপু রেগে পেয়ালা থেকে অনেকখানি দুধ মাটিতে ঢেলে ফেলে দিয়ে বললে, রেখে দে তোর ললিতা মাস্টারনির কথা।

কীরকম আস্পর্ধা দেখলে তো? কীসের থেকে কী টেনে আনা। ওই বলে আবার দুম দুম করে পা ফেলে খাটে গিয়ে শুল!

সে যাই হোক গে, আস্তে আস্তে সবাই সেরে উঠলুম। মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেলুম, ঘর থেকে ছাড়া পেলুম। মাসের ছুটির সঙ্গে, পুজোর বারো দিন ছুটি জুড়ে, মস্ত লম্বা ছুটির পর শেষটা আবার ইস্কুল খোলবার সময় হয়ে গেল। বোর্ডিঙের মেয়েরা ফিরে এল। শুনলুম ললিতাদি, লাবণ্যদি এসেছেন। নেপুর অপূর্বদাও এলেন।

তখনও ইস্কুল খুলতেদু-দিন বাকি আছে, জগদীশদার পিসিমা দিন চারেক হল বাড়ি গেছেন, ও-দিকটাতে ভাড়াটে এসে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে সন্ধ্যে বেলা আমাদের বাড়িতে ছুটে এলেন। খুশিতে ফেটে পড়েছেন।

ও বউমা, ওরে মিনু, ওরে নেপু, সুখবর শুনেছিস? ডবল বিয়ের নেমন্তন্ন খাবি যে সবাই! অপূর্বর সঙ্গে লাবণ্যর বিয়ে, আর জগদীশের সঙ্গে লাবণ্যর বোন মলিনার বিয়ে। লাবণ্যর মা-টা সবাই আজ এসে পৌঁছোলেন, এখানেই বিয়ে হবে।

বুকটা ধড়াস করে উঠল। লাবণ্যদির সঙ্গে গুঁফো অপূর্বদার বিয়ে তাই কখনো হয় নাকি?

পিসিমা আরও বললেন, নাকি জগদীশদাও আসছে। বিয়ের পর অপূর্বদারাও চলে যাবে। জগদীশদার আপিসেই কাজ করবে। আগেও নাকি তাই করত। জগদীশদার কাজ নাকি ও-ই ঠিক করে দিয়েছিল। কী জানি!

হয়তো সবাই কলকাতায় গিয়ে ট্রামরাস্তার ওপর থাকবেন, ঘড়ঘড় করে সামনে দিয়ে ট্রাম যাবে, মাথার ওপর বিজলি পাখা ঘুরবে, সন্ধ্যে হলে কুলপি বরফওয়ালাকে ডেকে সবাই কুলপি খাবেন।

সেই পাহাড় দেশের প্রচণ্ড শীতে, লেপের ভেতর পা গুটিয়ে শুয়ে, এসব কথা মনে করে দারুণ কান্না পেতে লাগল।

কিন্তু নেপুটার এতটুকু দুঃখ নেই। আবার সে কী তড়পানি! বললে, ভালোই তো, আসছে বছর আমার বারো পুরবে, তারপর তিন বছর বাদে পরীক্ষেটা কোনোমতে পাস করে নিয়েই, কলকাতা চলে যাব! ব্যস্, আর কী? হস্টেলে থাকব, রোজ সন্ধ্যে বেলা অপূর্বর্দার বাড়িতে গিয়ে মালাই বরফ খাব। তোর লাবণ্য মাস্টারনি রাঁধতে পারে তো?

চব্বিশ ঘণ্টা কেবল খাবার তালেই আছে। আমি কিন্তু রোজ রাত্রে বালিশে মুখ গুঁজে খুব কেঁদে নিতুম।

ইস্কুলের মেয়েরা সবাই চাদা তুললুম। লাবণ্যদিকে খুব ভালো করে ফেয়ারওয়েল দিতে হবে। সুখে থাকো লেখা সোনার পিন কেনা হল, সাড়ে তেরো টাকা দিয়ে। তখন সোনা কত সস্তা ছিল; সবাই শাড়ির কাঁধে সোনার পিন লাগাত।

এসব নিয়ে নেপুর সে কী বিশ্রী হাসাহাসি। বলে, কী রে তোদের বালতি-টালতি কেনা হল? নইলে মেয়েরা চাঁদা করে কাঁদাকাটি করবে কী করে?

এই ধরনের ঠাট্টা আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি নে। তবু চুপ করে থাকলুম, নইলে আরও কত কী বলবে, বিশ্বাস কী!

অরুণাবউদি কিন্তু আচ্ছাসে ওর কান পেঁচিয়ে দিয়ে বললেন, মেয়েদের একটু সমীহ করতে শেখ, লক্ষ্মীছাড়া!

তখন একটু না হেসে পারলুম না। লাবণ্যদি নিজে একদিন আমাদের বাড়ি এসে দেখা করে গেলেন। মাখনের মতো রঙের একটি শাড়ি পরে কী যে সুন্দর সে আর কী বলব!

আমার গালে একটা চুমো খেয়ে বললেন, কলকাতায় গেলে, আমাদের বাড়িতে যেয়ো, কেমন?

শুনে খুব আনন্দও লাগল, আবার কান্নাও পাচ্ছিল। তারপর মাকে বললেন, শেষটা ভূতের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র উদ্ধার হল! সেদিন আমরা যখন সেখানে গিয়ে কানের ফুল কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, তখনি আমার সন্দেহ হয়েছিল। তবে বড় অন্ধকার ছিল কি না, ভালো করে খোঁজাই গেল না। নইলে আমরাই হয়তো পেয়ে যেতাম।

সত্যি, কী বুদ্ধি যে লাবণ্যদির। ওঁর বোনকেও সঙ্গে এনেছিলেন, তিনিও ওঁরই মতন সুন্দরী, তবে আমার ওকে ততটা ভালো লাগেনি। কেমন যেন একটু দেমাকি বলে মনে হল। কথাই বললেন না ভালো করে। তবু জগদীশদার সঙ্গে বিয়ে হলে একটুও মানাবে না মনে হল। কী কাঠ-কাঠ হাত-পা জগদীশদার, মাথায় কী কম চুল!

চারিদিকে তখন বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো কথা নেই। লাবণ্যদির মা আমাদের জন্যে পুলিপিঠে করে পাঠিয়ে দিলেন। বাবা জ্যাঠামশাই মহা খুশি।

তবু ওই চুরির কথাটা আমার প্রায়ই মনে হত। আর পিসিমার তো মহা দুঃখ, অ্যাদ্দিন বাদে বউমা আসছে ঘরে, কিন্তু সিঁদুর রাখবার জন্যে হিরের প্রজাপতি-বসানো সোনার কৌটোই নেই!

১৩.

সেকালের ব্যাপার ছিল আলাদা। লোকে থাকত ভারি সাদাসিধেভাবে। বিকেলে কেউ কারো বাড়ি গেলে, গরম লুচি ভেজে, লাল কাশীর চিনি দিয়ে খেতে দিত। বেশি দামের কাপড়চোপড় পরারও রেওয়াজ ছিল না।

তবে বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে কারো বিয়ে থা হলে পাড়াসুদ্ধ এসে জুটে যেত। পরামর্শ দিত দেদার, সাহায্যও কম করত না।

এক মাস আগে থাকতে হইচই লেগে যেত। মফস্বল শহর, সব বন্দোবস্তই আগে থাকতে করতে হত। ব্যাবসাদাররা, কারিগররা বায়না নিয়ে, এক মাস আগে থেকেই কাজে লেগে যেত। আর এবার তো মাস খানেকও নেই, তারপর ডবল বিয়ে! ঝগড়াঝাটি ভুলে, সবাই মিলে আমোদ করতে লেগে গেল।

কোথায় মেরাপ বাঁধা হবে, ক-শো চেয়ার পড়বে, কী খাওয়া হবে, কী দেওয়া হবে, এখন সবার মুখে কেবল ওই এক কথা।

জগদীশদার পিসিমা নতুন মানুষ বনে গেলেন। আনন্দের চোটে মোষের মতো রঙের আলোয়ানটা চাকরটাকে দিয়ে দিলেন। কাঁঠাল কাঠের বাক্স খুলে পুরোনো একখানা হলদে হয়ে-যাওয়া গরদ বের করে পরলেন। বাদামি রঙের একটা কাশ্মীরি শাল গায়ে জড়ালেন। গলায় একটা দশভরি বিছে হার পরলেন।

আর দিনরাত কেবল জগদীশদার প্রশংসা। কেমন সোনাহানা মুখ করে যা দেওয়া যায় তাই খায়। সাত চড়ে রা নেই–এইসব। আমরা তো দেওয়ালে সেই পিন দিয়ে কাগজ আঁটার কথা, শশীদিদির গালে চড়ের দাগের কথা মনে করে, হাঁ হয়ে যেতুম।

তার ওপর বউমাকে আশীর্বাদ করবেন বলে সুন্দর এক পুরোনো গয়নাও বের করলেন। জেঠিমা তো রীতিমতো চটেই গেলেন, কীরকম কঞ্জুস বুড়ি দেখলি? এতকাল এর বাড়ি ওর বাড়ি ফলপাকুড়টা, ক্ষীর সন্দেশটা খেয়েই বেড়িয়েছে। হাত উপুড় করে একটা পয়সা ঢালেনি। অথচ ঘরে তার এত দামের গয়না!

পিসিমা ওদিকে জাঁক করে বলে বেড়াতে লাগলেন, বাবা, আমি কি তেমনি মেয়ে! কৌটো পাবামাত্র পেতলের হাঁড়িতে উটিকে ভরে, রান্নাঘরের মেঝেতে তিন হাত মাটি তুলে, রাতারাতি পুঁতে ফেললাম। তাপ্পর তার ওপর উনুন পেতে দিব্যি রাঁধাবাড়া করতে লেগে গেলাম! আর এও সত্যি বলছি, তারপর থেকে ডাল ঝোলগুলোও খেতে লাগত যেন মদু! উদিকে দেওয়ালের ওধারে ডাকাতের সর্দার গুটে নিশ্চিন্তে রাঁধছে, আর সুবিধে পেলেই এঘর-ওঘর হাতড়ে বেড়াচ্ছে! ওই কানের ফুলটি ছবির পেছনে লুকিয়ে রেখে ভুলেছিলুম, ব্যস্ অমনি সেটি গাপিয়েছে! কিন্তু এটাতে কিছুতে হাত লাগাতে পারেনি!

বলেই পিসিমা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। মা-রা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ও কী ঠাকুরঝি? বুক ধড়ফড় কচ্ছে নাকি? ওরে, হাতপাখাটা নিয়ে আয়!

পিসিমা মাথা নেড়ে বললেন, না, না, শরীর খারাপ হয়নি, হিরের প্রজাপতি কেমন করে নিল তাই ভাবছি! আবার চিঠি লিখে জানাল সেকথা! অথচ একদিনও চোখে দেখলাম না ওদের!

লাবণ্যদিদিদের বাড়িতে লোক ধরে না। ওঁর মা কাশী থেকে বেনারসি শাড়ি আনিয়েছেন, দূর দূর পাড়া থেকে মেয়েরা তাই দেখতে আসে। তখন এসব শৌখিন জিনিস বেশি দেখবার। সুযোগই পেত না কেউ।

কলকাতা থেকে গয়না গড়িয়ে এনেছেন। তবে পিসিমার ওই পুরোনো কানবালা জোড়ার কাছে সেসব দাঁড়াতেই পারে না।

দলবল নিয়ে জগদীশদাও এল বিয়ের দুদিন আগে। অপূর্বদার বাড়িতে উঠল সব। এখন দেখি দু-জনার ভারি ভাব। অথচ দু-মাস আগেও জগদীশদার কাছে অপূর্বার নাম করা যেত না!

জগদীশদাকেও চেনা যায় না। এই অল্প সময়ের মধ্যেই চেহারাটা দিব্যি চেকনাই হয়েছে। সিল্কের পাঞ্জাবি, জংলা শাল, সাদা পাম্পশু পরেছে।

তার পরে চল্লিশ বছরের ওপর কেটে গেছে, কিন্তু সেই ডবল বিয়ের কথা আমার আজও মনে আছে। বিয়ের আগের দিন, পাড়ার ছেলেরা পাড়ার ক্লাবের পক্ষ থেকে কংস-বধ থিয়েটার করল। শহর ভেঙে সব দেখতে এল। সে থিয়েটারের কথাও আমি ভুলিনি। কীসব চেহারা, মঞ্চের ওপর লাফিয়ে চড়ে কংসের সে কী আস্ফালন! এই বড়ো বড়ো লাল চোখ ঘুরিয়ে সে কী তর্জন-গর্জন! ভয়ে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁদিয়ে গেছল! তারপর মল যখন, উঃ, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম!

তখন সবে শীত পড়ে আসছে, হিমেতে আর চাঁদের আলোতে চারদিক ঝিকমিক করছে। অথচ এতটা ঠান্ডা পড়েনি যে বাইরে বেরুতে কষ্ট হয়।

মফস্বল শহরে তখনকার দিনে বিয়ের খাওয়া-দাওয়াও আলাদা রকমের ছিল। এই বড়ো বড়ো লুচি, ছোলার ডাল, কুমড়োর ছোঁকা আর পাঁঠার মাংস। রাঙা আলুর অম্বল, টক দই আর লাল লাল বোঁদে। তার ওপর লাবণ্যদির মা কলকাতার মেয়ে, রাশি রাশি পান্তুয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সবাই তাঁর খুব প্রশংসাও করেছিল।

লাবণ্যদি আর মলিনাদিকে সেজেগুঁজে পাশাপাশি বসে, দেখাচ্ছিল যেন পরিদের দুই রানি!

আমরা সেজেগুজে, ঘুরে ফিরে, খেয়ে-দেয়ে, পান চিবিয়ে গাল পুড়িয়ে, এমন ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম যে শেষপর্যন্ত বাড়ি এসে, কাপড়চোপড় ছেড়ে লেপের মধ্যে ঢুকতে পারলে বাঁচি। নেপু নাকি তেরোটা পান খেয়েছিল। দুটো পান পাঞ্জাবির পকেটে করে বাড়িতেও এনেছিল, এমনি অসভ্য! পকেটে খয়েরের দাগ লাগার জন্যে, তেমনি বকুনিও খেয়েছিল জেঠিমার কাছে।

বড়দা, নেপু, বাবা, জ্যাঠামশাই সব গেছলেন অপূর্বার আর জগদীশদার বরযাত্রী হয়ে। আমরা মেয়েরা হলুম কনে বাড়ির লোক। এমনি করে সেই ডবল বিয়েটা হয়েছিল।

শুনলুম, লাবণ্যদি মলিনাদি নাকি যমজ বোন, ওদের মা দু-জনাকে সব একরকম জিনিস দিয়েছিলেন।

তারপর দিন রাত্রে অপূর্বদা আর জগদীশদা সবাইকে বায়োস্কোপ দেখালেন। সেকালে কেউ সিনেমা বলত না, সবাই বলত বায়োস্কোপ। সে শুধু দেখা যেত, কানে শোনা যেত না, ছবির নীচে নীচে কথাবার্তা লেখা থাকত, আর একদল সায়েব মতন লোক কোট-পেন্টেলুন পরে, থেকে থেকে হারমোনিয়ম, বেহালা, ক্ল্যারিয়োনেট বাজাত।

বায়োস্কোপ দেখানোর পর খুব খাওয়াল অপূর্বদারা, চা শিঙাড়া, খাস্তা কচুরি আর নানারকম মণ্ডামেঠাই।

তার পরদিন সকালের মোটরে অপূর্বদা, জগদীশদা, লাবণ্যদি, মলিনাদি দলবলের কয়েক জনের সঙ্গে চলে গেলেন।

আমরাও ফুলের মালাটালা নিয়ে, মোটর আপিসে গিয়ে খুব কেঁদে-কেঁদে ওঁদের বিদায় দিলুম। লাবণ্যদিদিদের মা বাকি দলবলের সঙ্গে জিনিসপত্র গুছিয়ে তুলবেন বলে আরও এক দিন থেকে গেলেন।

মোটর ছাড়বার ঠিক আগে, সকলের সামনে তিনি হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে, কেঁচড় থেকে দুটো সিঁদুর কৌটো বের করে, মেয়েদের হাতে দিয়ে বললেন, ওরে এগুলো তোদের ঠাকুরদা তোদের জন্যে রেখে গেছিলেন। যত্ন করে রাখিস।

পিসিমা আবার চোখে একটু কম দেখেন, একে ওকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কী দিল বেয়ান তার মেয়েদের?

শেষপর্যন্ত মেয়েরা হাতের মুঠি খুলে কৌটো দু-টি তাঁকে দেখাল। লাবণ্যদিদিরটা আগাগোড়া এই বড়ো বড়ো মুক্তো বসানো। আর মলিনাদিদিরটা সোনার তৈরি, গায়ে লাল-সবুজ পাথর আর ঢাকনির ওপর এই এত বড়ো একটা হিরের প্রজাপতি ঠিক যেন এখুনি ডানা মেলে উড়ে যাবে।

পিসিমা সেদিকে একবারটি তাকিয়ে, আঁক আঁক শব্দ করে, একেবারে মুচ্ছো!

তখন জল কই, হাতপাখা কই, করে চার-পাঁচজন লোক ছুটোছুটি করতে লাগল। তারই মধ্যে মোটর ছাড়বার সময়ও হয়ে গেল। ওঁরাও চলে গেলেন।

বাড়ি ফেরার সময় পিসিমাকে ডাক্তারবাবুর টমটমে তুলে দিয়ে, আর সবাই যেমন সেকালে যেত, হেঁটে চলল।

জেঠিমা তখন লাবণ্যদিদির মাকে বললেন, কিছু মনে করবেন না দিদি, ঠাকুরঝির ফিটের ব্যামো আছে।

বাড়ি এসে মাকে বললেন, ঠাকুরঝিও যেমন! কৌটো যেন ওঁর বাবা ছাড়া আর কারও থাকতে পারে না।

মা আস্তে আস্তে বললেন, যেমন শুনেছিলাম, এটা কিন্তু অবিকল সেই রকম দেখতে।

১৪.

পরদিন লাবণ্যদিদিদের মা-রা রওনা হয়ে গেলে পর, সন্ধ্যে বেলা পিসিমা আমাদের বাড়িতে এসে বললেন, দ্যাখ দিকি কাণ্ড! ও কৌটো যদি আমার সেই হারানো কৌটো না হয় তো কী বলেছি! তা তোরা আমাকে কিছু বলতেই দিলি নে!

জেঠিমা বললেন, বাবা! কী ভয়ে ভয়েই যে কাল দিনটা কাটিয়েছিলাম। খালি ভাবি এই বুঝি তুমি বেয়ানকে বেস কিছু বলে বস! ঘরের কথা বেয়াই বাড়িতে বলতে হয় না, ঠাকুরঝি।

পিসিমা হেসে বললেন, কেন বলব? ওতো আমার জগদীশের বউয়ের জন্যই রেখেছিলাম। তা সেই যখন পেয়ে গেল, আমার আর বলবার কী থাকতে পারে? খালি ভাবি কৌটোটা যেমন করেই পাক প্রজাপতিটে পেল কোত্থেকে?

দরজার কাছ থেকে ফস করে কে বললে, সে আর আশ্চর্য কী? আপনি নিজেই যখন হাতে করে ওনাদের কাছে তুলে দিলেন।

সবাই হাঁ করে দেখি গুটে সেই হাতকাটা গেঞ্জির ওপর আলোয়ান জড়িয়ে এসে কখন দোর গোড়ায় দাঁড়িয়েছে।

মাথা চুলকে বললে, আমার বাক্সটা নিতে এলাম, মা, সার্টিফিকেটটা ওর মধ্যে কি না।–ওকী পিসিমা, দরজায় খিল দিচ্ছেন কেন? আমি যাব যে।

পিসিমা দরজায় খিল এঁটে, তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে, জেঠিমাকে বললেন, বড়োবউ, তুই ছাতাটা নিয়ে এপাশে খাড়া থাক তো দেখি। এই হতভাগা, এবার বল ওরা আমার কৌটো কী করে পেল?

গুটে আমতা আমতা করতে থাকে, আমার ওপর কারো চোখ পড়বার আগেই আমি টুপি করে বাবার বড়ো চেয়ারটার আড়ালে বসে পড়লুম। কী জানি কখন এরা আমাকে কী বলে বসে!

গুটে হঠাৎ মাথা তুলে বললে, বেশ তবে বলেই ফেলি, আমার আর কী? গোড়া থেকেই শুনুন তবে। একটু বসতে পারি?

বলে মাটিতেই আসন পিঁড়ি হয়ে বসে পড়ে বললে, গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে, যদি একটু চা—

জেঠিমা কর্কশ গলায় বললেন, ওই কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খাও, বাছা। সব কথা শোনবার পর চা আর মালপো দেব।

গুটে তো মহা খুশি।

তাহলে সব কথাই শুনুন। অপূর্ববাবুদের অবস্থা এককালে খুব ভালো ছিল, আমার বাবা ওঁদের বাড়ির সরকার ছিলেন। আমি ওখানেই মানুষ হয়েছি। ম্যাট্রিক পাশ করে, গোয়েন্দাগিরি শিখেছি ওনাদের খরচায়। তবে অবস্থা এখন পড়ে গেছে।

গত বছর পুজোর সময় জগদীশবাবু কলকাতা গেছলেন মনে আছে তো? সেইভেনে অপূর্ববাবুদের সঙ্গে আলাপ। লাবণ্যদিদির সঙ্গে অপূর্ববাবুর বিয়ে ঠিক হয়েছে, কিন্তু দিদিমণির মা কিছুতেই বিয়ে দেবে না যদ্দিন না কি এক সোনার কৌটো খুঁজে পাওয়া যায়। ওনার শ্বশুরের জিনিস, কে এক জোচ্চোর বদমাশ চালাকি করে হাতিয়ে নিয়েছে–

এই অবধি বলেই জিভ কেটে, গুটে পিসিমাকে বললে, কিছু মনে করবেন না, পিসিমা, গুটে নস্করের মুখ থেকে সর্বদাই হক কথা বেরিয়ে পড়ে।

পিসিমা বললেন, বাজে কথা রাখো! তারপর কী হল?

তারপর আর কী হবে? লাগাও গুটে গোয়েন্দাকে, সে জোচ্চোর বুড়োকে খুঁজে বের করুক। দেরিও হল না বের করতে, জগদীশবাবুই কথায় কথায় সব ফেঁসে দিলেন। হল কী, লাবণ্যদিদি মলিনাদিদির জন্মদিনে ওনারও নেমন্তন্ন হল। প্রেজেন্ট দিলেন একমুঠো সেকালের টাকা! সে টাকা তো আপনারা পরে বোর্ডিঙের মাসিমার কাছে দেখেওছেন- যাকগে সে কথা। তাপ্পর আর কী, এখেনে ইস্কুলে সব চাকরি খালি আছে, সেও জগদীশবাবুর কাছেই শোনা। অপূর্বাবু আপিস থেকে এক বছরের ছুটি নিয়ে এখানে চলে এলেন। লাবণ্যদিদিও মেয়ে ইস্কুলের বড়োদিদিমিণি হয়ে বসলেন।

আমিও এলাম আমাদের গোয়েন্দা সিন্ডিকেটের যতসব বেকার গোয়েন্দা জুটিয়ে এনে। কৌটো উদ্ধার করতে হবে তো। লোক নইলে চলবে কেন।

নিজে গা ঢাকা থেকে, ঘরে ঘরে দলের লোক চাকর সাজিয়ে ঢোকালাম। বিশ্বাস না হয় খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন এর মধ্যে সবার বাড়ির এক-আধটা ভালো চাকর ভেগেছে কি না। আমাদের সব ট্রেনিং দেওয়া লোক, করুক তো কোনো সত্যি চাকর ওদের মতো কাজ?–একটু চা নইলে সত্যি আর বলতে পারছি নে মা।

জেঠিমা খিল খুলে চা করতে গেলেন, বাকিরা পাহারায় থাকল। কারো মুখে কথা নেই। গুটে বার বার বলতে লাগল, গোয়েন্দাগিরি কি সোজা কথা, পিসিমা? এর জন্যে কী না করতে হয়।

ততক্ষণে চা এসে গেল, চা খেয়ে গুটে বললে, পান। মা পেতলের বাক্স থেকে দুটো পান দিলেন। গুটে বললে, চুন। মা চুন দিলেন। গুটে বললে, হা, তাপ্পর শুনুন। সমিস্যে হল কৌটো জগদীশবাবুদের বাড়িতে থাকলেও, সে-বিষয় জগদীশবাবু যে কিছুই জানে না সেটা ঠিক। কিছু মনে করবেন না, পিসিমা, ওনাকে একটু মাছের মুড়ো খেতে বলবেন, তাতে বুদ্ধি খোলে। অবিশ্যি আমাদের তাতে সুবিধে হল এই যে ওনার কাছ থেকে মেলা খবর বের করে নেওয়া গেল, উনি আমাদের এতটুকুও সন্দেহ করলেন না। একটু জল খাব।

এবার অরুণাবউদি নিজেই কুঁজো থেকে জল ঢেলে দিলে। জল খেয়ে গুটে বললে, এখন কৌটোটাকে বাইরের হাওয়ায় বের করা যায় কী করে? হরিসভার মহিলা সমিতিতে আমাদের চর ছিল, না পিসিমা, তার নাম কিছুতেই বলব না, তা ছাড়া সে এখানে নেইও–সে করলে কি না, পিসিমার প্রাণে চোরের ভয় ঢুকিয়ে দিল। ব্যস্, অমনি কৌটো আলোতে বেরিয়ে এল।

পিসিমা ভাঙা গলায় বললেন, নিলি কী করে?

গুটে তো অবাক! ও আর এমন কি শক্ত? ব্যাঙ্ক তো আমাদের লোকেই ঠাসা ছিল। জগদীশবাবু যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাগজে সই দিচ্ছেন তখন পকেট থেকে কৌটো সরিয়ে, কিমামের শিশিই যদি ভরে দিতে না পারে, তো আবার তারা গোয়েন্দা কীসের? কৌটোর কথা তো ব্যাঙ্কসুষ্ঠু সবাই শুনল, জগদীশবাবু এমনি ফলাও করে বললেন!

কিন্তু ঘরে এনে দেখা গেল কৌটোর মুখের হিরের প্রজাপতিটাই নেই। উঃ! বাপ! সেটি বের করতেই তো প্রাণ যাবার জোগাড় হয়েছিল।

জেঠিমা বিরক্ত হয়ে বললেন, কী বলছ, বাছা, গুছিয়ে বলো।

গুটে বললে, মানে কী বুঝলেন না? দলের লোকরা মনে করেছিল সাত দিনে কাজ হাসিল করে যে যার চলে যাবে। পিসিমা যদি প্রজাপতি না সরাতেন তো হতও তাই। আচ্ছা, ও-রকম কৌটো এক জায়গায়, প্রজাপতি আরেক জায়গায়, অন্য গয়না অন্য জায়গায় ও-রকম থানে থানে জিনিস রাখবার মানে কী?

পিসিমা বললেন, ওমা, কী বলে! এ আবার কীরকম গোয়েন্দা! এক জায়গায় জিনিস রাখি, আর সব একসঙ্গে যাক আর কী! তা ছাড়া প্রজাপতি তো খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। তোমরা কোথায় পেলে?

গুটে বললে, কী যে বলেন পিসিমা, আমরা আর পেলুম কোথায়? এদিকে দলের লোক উশখুশ করছে, তাদের কাজ না দিলে নাকি তারা স্রেফ চাকর বনে যাবে। তাই এটা-ওটা সরাবার বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল, হাতসাফাই বিদ্যেটা অন্তত চালু থাকুক! তবে যার যারটা ফিরে পেয়েছে কি না বলুন?

আমি আর থাকতে না পেরে উঠে বললুম, কোথায় সব ফিরে পেয়েছে? আলুগাছ পায়নি, পাঁঠা পায়নি, ম্যাজিস্ট্রেটের কুকুরটা পায়নি।

গুটে বিরক্ত হয়ে উঠল। কী যে বোকার মতন কথা বল দিদি। ইস্কুলে গিয়ে কী শেখ? খাবার জিনিস খেয়ে ফেললে আবার আসবে কোত্থেকে? আর কুকুরটা তো চার-পাঁচজনকে কামড়ে-টামড়ে পালিয়েই গেল। এতদিনে নাকি ফিরেছে।

হ্যাঁ, কী বলছিলাম যেন?– ও, হা সেই হিরের প্রজাপতিটে কোথাও পাই নে। তার ওপর পিসিমা দিলেন পুলিশ লেলিয়ে, পালিয়ে পথ পাই নে! শেষটা রাতে দলবল নিয়ে ওনাদের বাড়ি সার্চ করা ছাড়া উপায় থাকল না! উঃ! সে কী কাণ্ড! সেইদিন জগদীশবাবু প্রমাণ পেয়ে গেলেন যে অপূর্ববাবুরা কী উদ্দেশ্যে ওনার সঙ্গে ভাব পাকিয়েছেন। অবিশ্যি কিছুদিন থেকেই নানান কারণে ওঁর সন্দেহ হচ্ছিল। বিশেষ করে মাসিমার কাছে টাকাগুলো দেখে অবধি। ওটা একটা ভুল চাল হয়েছিল, আমি তখনি মানা করেছিলুম, তা কে শোনে! আমাকে তো সে রাত্রে বিরাশি সিক্কা ওজনের এক চড়ই কষিয়ে দিলেন– এখনও দাঁত কনকনানি যায়নি– আর অপূর্বদার ওপর মহা চটে গেলেন।

জেঠিমা বললেন, অতই যদি চটল তো পুলিশে দিয়ে দিল না কেন তোমাদের সবাইকে বাছা? অত যত্ন করে আমাদের এখানে লুকিয়ে রাখার মানেটা কী?

গুটে তো হাঁ!

বাঃ, তা রাখবেন না? আমার মতন কে বেঁধে খাওয়াতে পারে সেটা বলুন? জানেন, রাজরাজড়ারা– আর পুলিশে দেবেন কী করে? তা হলে লাবণ্যদিদির মা মলিনাদিদির সঙ্গে ওনার বিয়ে দিলেন আর কী!

ঢোক গিলে, পিসিমা বললেন, কিন্তু হিরের প্রজাপতিটা কোথায় পেলে?

গুটে একটু চুপ করে থেকে বললে, কেন, পেয়ারা-জেলির শিশিতে। সেখানে আপনিই লুকিয়ে রেখে থাকবেন। তাপ্পর শিশিসুদ্ধ দিয়ে দিলেন।

পিসিমা পুরো এক মিনিট হাঁ করে গুটের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর ঝু করে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। দরজাটাকে ঠেস দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিলেন, এবার দরজাটাও অমনি হাট করে খুলে গেল। আর গুটেও এতক্ষণ বাদে দরজা খোলা পেয়ে, নিজের বাক্সটা তুলে নিয়ে, চোঁ চোঁ যে দৌড় দিল, আর তাকে দেখিনি।

১৫.

এ সবের পরে আমাদের সেই পাহাড় দেশের ছোটো শহরটা অমনি আবার ঝিমিয়ে পড়ল। ওই এক বছরের কাহিনি আস্তে আস্তে সবার মন থেকে মুছে গেল। গুটের গল্প সত্যি কি মিথ্যে কিছুই বোঝা যায়নি। পিসিমাও এর পরেই বাড়ি বেচে কাশী চলে গেলেন।

কিন্তু নেপু নাকি কলকাতায় যখন পড়তে গেছিল, অপূর্বদাদের খোলাখুলি জিজ্ঞেস করেছিল।

তাঁরা সব শুনে শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন।

বলিস কী রে! ও সিঁদুরের কৌটো দুটো যে তোর লাবণ্যদিদির ঠাকুরদাদা নাতনিদের বিয়েতে দেওয়া হবে বলে কবে থেকে লোহার সিন্দুকে তুলে রেখেছিলেন! গুটেও পিসিমার ভয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলল, আর তোরাও অমনি বিশ্বাস করলি? দেখলি কাণ্ড, অবিনাশ?

আর অবিনাশ বলে অপূর্বদার একতলার ভাড়াটে, একমুখ দাড়ি-গোঁফসুদ্ধু মাথা নেড়ে বলল, অদ্ভুত! খাসা রাঁধত নাকি ওই অবিনাশ, নেপুকে খাইয়েছিল।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *