ফেরা (Fera) : 05
ইয়াসির একটি রিক্সা করে কল্যাণী আর দীপনকে নওমহল পৌঁছে দেয়। এই বাড়িতে শরিফা থাকে—সেই শরিফা-লম্বাটে মুখ, চোখদুটো বড় বড়, মাথা ভরা কোঁকড়া চুল। শরিফা তাকে চিঠিতে লিখত—‘আমার কিছু ভাল লাগে না কল্যাণী, এখানে আমার কোনও বন্ধু নেই। তুই চলে আয়। আমি যদি ইন্ডিয়া যাবার রাস্তা চিনতাম, তোর কাছে চলে যেতাম। তোর বোধ হয় নতুন নতুন বন্ধু হয়েছে। তুই ছাড়া আমার কোনও বন্ধু নেই। আমাদের খেলা আর জমে না। তোকে ছাড়া খেলতে যেতে ভাল লাগে না। আম্মা বলে বড় হয়েছিস এখন ঘরে বসে রান্না কর, সেলাই কর, খেলা-টেলা বাদ। তুই না থাকায় আমার সব অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। আমার আর গান গাওয়াও হয় না। তোর বাড়িতে দুজন নেচে নেচে গাইতাম—‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো’—এই গান কোথাও শুনলে আমার বড় কান্না পায়। তোর সঙ্গে কবে দেখা হবে বল তো! তোর মামা যদি না নিয়ে আসেন একাই চলে আয়। তুই না একা একা একবার নদীর ওই পার গিয়েছিলি, তা হলে আর ভয় কিসের! রাতবিরেতে শ্মশানঘাটেও তো গেলি একবার। শান্তি সুনীতির সঙ্গে তোর মেশার দরকার নেই। পরিমলকেও বলিস না মিশতে। অহঙ্কারী মেয়েদের আমার দুই চোখে দেখতে ইচ্ছে করে না।’
কল্যাণীও সব জানিয়ে লিখত। গোবরার ঝিল, ট্রামলাইন, বাসে চড়া, ব্রেবোর্ন কলেজে বন্ধুহীন দিন, কিছুই ভাল না লাগা, বাবার ওপর অভিমান, জ্যোতিদার নিরুদ্দেশ, ব্রহ্মপুত্র, জানলার পাশে কামিনীগাছে ফুল ফুটেছে কি না। —ছ-সাত পাতা ভরে যেত এসবেই।
সেই শরিফাকে এত বছর পর দেখবে সে—বুক কেমন ধুকপুক করে, যেন সে হাতের মুঠোয় এক্ষুনি তার সতেরো বছর বয়সটি পেয়ে যাবে। যেন সে এটি বন্ধক দিয়ে গিয়েছিল কারও হাতে। এখন ফেরত নিতে এসেছে। কল্যাণীর চলে যাবার দিন ধুলোয় গড়িয়ে কেঁদেছিল শরিফা, ফিরে আসবার কথা ছিল তার, ফিরে সে আসলই কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
বসবার ঘরে ভারি কাঠের সোফা পাতা। কাঠের একটি সেলফে কাচের বাসনপত্র সাজানো। দুটো ছ-সাত বছর বয়সের মেয়ে দরজায় উঁকি দিয়ে সরে যায়। দেওয়ালে একটি কাবাশরিফের ছবি, মখমলের, বাঁধানো। ইয়াসির ভেতরে গেছে শরিফাকে ডাকতে। কল্যাণী কেন শরিফার বাড়িতে অতিথির মত বসবার ঘরে বসবে! তার তো ভেতরে ঢুকে ওকে আগে জড়িয়ে ধরা উচিত। দীর্ঘ অদর্শনশোক কী সহজে কাটবে তাদের! এসব ভেবে যখনই সে ভেতরের ঘরে ঢুকতে যাবে তখনই যে স্থূল শরীরের ভদ্রমহিলা কুঞ্চিত দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে কল্যাণী চিনতে চেষ্টা করে সে শরিফা কি না; ফর্সা লম্বাটে মুখ, বড় বড় চোখ কি না তার, কোঁকড়া চুলে ঝুঁটি বেঁধে ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে’ গেয়ে গেয়ে নেচে উঠবার সেই কিশোরী কি না সে। চোখদুটো চেনা যায়—সেই চোখ, সেই বিষন্ন সুন্দর চোখ আর চিবুকের কাছে কালো তিল—এই তো শরিফা, এই তো সেই শরিফা, তাকে ছোঁবার জন্য দু হাত বাড়িয়ে দৌড়ে যায় কল্যাণী, কিন্তু শরিফার কপালের ভাঁজ মেলায় না, সে বলে—আপনারে তো চিনতে পারলাম না।
—আমি কল্যাণী। আমাকে ভুলে গেছিস তুই? আমি কল্যাণী। কল্যাণী।
শরিফার কোলে একটি বাচ্চা। তার গায়ের গৌরবর্ণটি নেই আর, তামাটে হয়ে গেছে। কপালে ভাঁজ বাড়ে শরিফার, জিজ্ঞেস করে—কোন কল্যাণী?
—কালিবাড়ির। হরিনারায়ণ রায় আমার বাবা, তোদের পাশের বাড়ি। আমরা খুব বন্ধু ছিলাম।
শরিফার বিস্ময় কমে। কপালের ভাঁজ কপালে থাকে না। সে হেসে বলে—ও। কেমন আছেন?
—তুই আমাকে আপনি করে বলছিস শরিফা?
শরিফা অপ্রস্তুত হাসি হাসে। কোলের বাচ্চাটা হঠাৎ কেঁদে ওঠে। শরিফা বাচ্চার দিকে মনোযোগ দেয়। ‘না না কান্দে না’ বলে বাচ্চাকে দোলায়। কল্যাণীর চেয়ে এই বাচ্চাটির ক্রন্দন তাকে বেশি আকৃষ্ট করে। সে তার কান্না থামাতে দূরে সরে যায়। দীপন পরম আগ্রহে সব দেখছে, সেও কত শুনেছে শরিফার নাম, খেলায় হেরে গেলে শরিফা কাঁদত শুনে দীপন বলেছে—‘শরিফা আন্টি জানে না ফেইলুর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস?’ কল্যাণী কখনও বিমর্ষ বসে থাকলে দীপন বলেছে—‘কার জন্য মন খারাপ মা, দাদু দিদিমা? শরিফা আন্টি?’
শরিফা বাচ্চাটি কোথাও রেখে আসে। এসে আবার সেই অপ্রস্তুত হাসি। ওর দাঁতের ফাঁকে কালো দাগ, পান-জর্দার দাগ। হেসে বলে—কবে আসা হইল?
—আজই এলাম। সকালে রওনা দিয়েছি।
—এইটা ছেলে বুঝি? বাচ্চার নাম কী?
—দীপন। তোর বাচ্চা ওটি? তোর কটি বাচ্চা রে?
—আল্লার রহমতে আমার পাঁচ মেয়ে দুই ছেলে।
—তোর সাত বাচ্চা?
শরিফা মুখে আঁচল চেপে বলে—দুই মেয়ের বিয়াও হইয়া গেছে।
—তাই নাকি? কবে বিয়ে দিলি? কী আশ্চর্য তাই না। আমারও বোধহয় মেয়ে বিয়ে দেবার সময় হল। কত বড় হয়ে গেছি আমরা, তাই না শরিফা? মনে হয় এই সেদিন, এই সেদিন আমরা এক্কা দোক্কা খেলেছি। এক্কা দোক্কা তেক্কা চৌকা পঞ্চা যমুনা দিল্লি। তুই জানিস, এখনও মাঝে মধ্যে স্বপ্নের মধ্যে কুতকুত খেলি। তোরও কী এরকম হয়?
—ওর আর ভাই বোন নাই? শরিফা দীপনকে দেখিয়ে বলে।
—হ্যাঁ। বড় মেয়ের নাম জয়িষা।
—ও।
কল্যাণী আকুল চোখে তাকায় শরিফার মুখের দিকে, শরিফা মেঝেয় চোখ রেখে চুপচাপ বসে থাকে। শরিফার হাত ধরে বিকেল হলেই কল্যাণী চলে যেত নদীর ধারে। হাতটির দিকে তাকায় সে, দু হাতে মোটা দুটো অনন্তবালা। হঠাৎ, কোনও প্রসঙ্গ নেই, কল্যাণীর মনে পড়ে—বাড়িতে নারকেলগাছ পরিষ্কার করবার লোক আসত, নারকেল পাতা ফেলে ফেলে স্তূপ বানিয়ে রাখত মাঠে, সরলাবালা উঠোনে দু-তিনজন লোক বসিয়ে দিতেন পাতা কেটে কেটে শলা বের করতে, সেই শলা দিয়ে বাড়ির ঝাড়ু বানানো হত, কল্যাণী আর শরিফা ছেটে রাখা নারকেল পাতা দিয়ে হাতের ঘড়ি আর বাঁশি বানাত। ওরা হাতে ঘড়ি পরে প্যাঁ পুঁ প্যাঁ পুঁ শব্দে বাঁশি বাজিয়ে ফিরত সারা বাড়ি। এই হাতই তো সেই হাত। শরিফা কি ভুলে গেছে সবুজ পাতার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘড়ি না-বোঝা বয়সে তারা দশটা বাজলে বলত ছ’টা বাজে, আর দুটো বাজলে ন’টা বাজে? এই নিয়ে জ্যোতিদা আনিস ভাই তুমুল হাসত।
শরিফাকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয় যে সেই যে নারকেল পাতার বাঁশি বানাতাম মনে আছে? জিজ্ঞেস করবার আগেই শরিফা হঠাৎ উঠে ভেতর-ঘরে চলে যায়। যখন আসে, তার পিছন পিছন ট্রে হাতে ঢোকে একটি ছেলে। ট্রেতে চা, টোস্ট বিস্কুট আর চানাচুর। কল্যাণী আর দীপন দুপুরে খায়নি কিছু। শরিফার আর দোষ কী, ও তো আর জানে না যে তারা এখনও না-খাওয়া। দীপন চানাচুরের প্লেটটি কাছে টেনে নেয়। কল্যাণী চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে—‘শরিফা, ঘরে ভাত-টাত নেই? আমরা দুপুরে কিন্তু খাইনি কিছু।’ কল্যাণী বলতে কোনও সঙ্কোচ করে না। তার কেন শরিফার কাছে ভাত চাইতে দ্বিধা হবে! একসময় এ ওর বাড়িতে সে দুপুর হোক রাত হোক খেতে বসে পড়ত। ছোটবেলার বন্ধুর কাছে আবার রাখঢাক কী! শরিফাই বরং লজ্জা পেয়ে ‘দেখি’ বলে উঠে যায়। ও এত কম কথা বলছে কেন? ও কি ভুলে গেছে সেই সব দিন? সেই সব…সেই সব…ভোকাট্টা ঘুড়ির পিছনে সেই সারা দুপুর দৌড়নো দিন একাই কল্যাণী লালন করেছে তবে! আর সবার কাছে তা ধূসর! একদিন ফিরে আসবে বলে সে যে গুছোচ্ছিল জীবন, সে কী এরকম ফিরে আসা—যে, শরিফা তাকে দেখেই আনন্দে উল্লাস করবে না, কলকল করে তিরিশ বছরের গল্প করবে না দুজনের হাতদুটো দুজনে জড়িয়ে, যেন কেউ আর ছুটে যেতে না পারে! এ কেমন ফিরে আসা তবে কল্যাণীর! অনির্বাণ এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে বলেছিল—কী তুমি ফিরবে তো, নাকি থেকে যাবে!
কল্যাণী হেসে বলেছিল—-আমি তো দেশে ফিরছি। আর কলকাতায় তো আসতে হবেই। সংসারে যখন আটকে গেছিই।
—সংসারে না আটকালে মনে হয় আসতে না?
কল্যাণী হেসেছিল। ওই হাসির কী অর্থ অনির্বাণ করেছে তা অনিবার্ণই জানে।
বারবার বাদলের কথা মনে পড়ে তার। বাদল কোথায় থাকে, সেও কী খুব পাল্টে গেছে! সেও কী হঠাৎ দেখলে চিনবে না, ভ্রু কুঁচকে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কল্যাণীর বলতে হবে—সেই যে আমরা কলেজ ফাঁকি দিয়ে নৌকো করে ব্রহ্মপুত্রে ভেসে বেড়াতাম। আর বাবুইপাখির মত ঘর বাঁধতে চাইতাম, ছোট্ট একটি ভালবাসার ঘর। আমি সেই দুর্ভাগা কল্যাণী!
চা দেবার ছেলেটি দুটো প্লেটে ভাত আর ডিমভাজা রেখে যায়। কল্যাণী জিজ্ঞেস করে—শরিফা কোথায়?
ছেলে বলে নামাজ পড়ে।
শরিফা নামাজ পড়ে? কল্যাণীর মনে পড়ে না শরিফাকে সে কখনও নামাজ পড়তে দেখেছে। বরং দুর্গাপুজোয়-কালীপুজোয় সে কল্যাণীর সঙ্গে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াত। জ্যোতিপ্রকাশ, সৌমেন, মাখনদের আরতি দেখে খুশিতে হাততালি দিত। বিসর্জনের দিন কল্যাণীর সঙ্গে সেও মহাদেবের গায়ের ওপর দাঁড়ানো লাল জিভ বের করা কালীমূর্তির পিছন পিছন নদীতে যেত। দীপন ডিম খেতে পছন্দ করে না। কল্যাণী বলে—ডিম খুব ভাল জিনিস বাবা, প্রোটিন, খেয়ে নাও।
দীপন ভাতগুলো নাড়ে-চাড়ে, কল্যাণীও মেখে রেখে দেয়। শরিফা নামাজ শেষে ফিরে এসে বসে, যোজন দূরত্ব নিয়ে বসে। কল্যাণী আকুল স্বরে বলে—কালিবাড়ি যাই চল। আমাদের বাড়িতে।
শরিফা ঠাণ্ডা গলায় বলে—কিছু তো নাই এখন।
—তবু যা আছে। জামগাছটি আছে দেখলাম।
শরিফা অবাক হয়—জামগাছ দেইখা কী হইব?
কল্যাণী নির্বাক তাকিয়ে থাকে, বোঝাতে পারে না, জামগাছ দেখে তার কী হবে। জামগাছে দেখার মত কী-ই বা আছে। দীপন উসখুস করছিল, কল্যাণী বলে—‘যাও বাবা, বারান্দায় ওদের সঙ্গে খেলা কর গিয়ে।’ দীপন বারান্দায় চলে যায়। কল্যাণীর পায়ের কাছে পড়ে আছে কাপড়চোপড়ের ব্যাগটি। তার মুখ হাত ধোয়া দরকার। বাসের জার্নি। ধুলোয় ভরে গেছে গা। শরিফা গলা উঁচু করে বলে—এই রে লতিফা, নিম্মি, নাদিরা অযু কইরা শিগরি নামাজ পড়তে যা।
সালোয়ার কামিজ ওড়না পরা টিন এজ তিনটে মেয়ে মায়ের গলা শুনে ভেতরে আসে। বড় বড় চোখ করে কল্যাণীকে দেখে। কল্যাণী জিজ্ঞেস করে—তোর মেয়ে বুঝি ওরা?
সুড়সুড় করে মেয়েগুলো ভেতর-ঘরে চলে যায়। কল্যাণী ডাকে ওদের—শোন শোন।
কেউ দাঁড়ায় না। ওড়নায় মুখ আড়াল করে চলে যায়।
কল্যাণী বলে–মেয়েগুলো খুব লাজুক নাকি? তোর একেবারে উল্টো, তাই না?
শরিফা সম্ভবত ‘উল্টো’ শব্দটিতে খুশি হয় না। হ্যাঁ না কিছু বলে না।
কল্যাণী জিজ্ঞেস করে—তুই পড়াশুনা কতদর করলি রে শরিফা?
—আই এ পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। বিয়া হইয়া গেল, পরীক্ষা আর দেওয়া হয় নাই।
—কালিবাড়ি যাস না?
—খুব কম।
—আমাদের বাড়িটা কারা নিল রে, কারা থাকে এখন? বাড়িটা ভাঙল কারা? গাছগুলো কাটল কারা শরিফা?
শরিফা ঠোঁট উল্টে বলল—জানি না।
—এই দেখ দেখ মাটি এনেছি। আমাদের বাড়ির মাটি। কল্যাণী ব্যাগ খুলে মাটির ডেলাটি বের করে।
শরিফা ছুঁয়ে দেখে না। বলে—ও। যেন তৈমুম করার মাটি।
—তৈমুম? তৈমুম কি রে?
—শরীল অসুস্থ থাকলে পানি না ছুইয়া তৈমুম করলেও নামাজ হয়। ঘরে আমিও মাটি রাখি।
কল্যাণীর মনে হয় এটিও অনেকটা তৈমুম করবার মাটি। এটি ছুঁলেও গা পবিত্র হয়। এই মাটিতে তাদের গোল্লাছুটের গন্ধ আছে। এই মাটি যদি পবিত্র নয়, পবিত্র তবে কী!
কল্যাণীর বুক ভেঙে যায়। শরিফা মুখ মলিন করে বসে থাকে।
সে আরও কাছে সরে আসে শরিফার। আবারও আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে—রুখসানা কেমন আছে? সেলিম? মাখন? সৌমেন? ওরা কোথায়? অনিলকাকার খবর জানিস?
—সংসার নিয়া এত ঝামেলা। ওই দিকে আর যাইতে পারি কই!
—মুন্নিটা কেমন আছে? শুনলাম ঢাকায় থাকে। অতটুকুন মেয়ে ঘর সংসার করছে? মনে আছে একবার কলতলায় আছাড় খেয়ে পড়েছিল, পরনে হলুদ একটা হাফপ্যান্ট ছিল তার?
শরিফা অবাক চোখে তাকায়। কবে আছাড় খেয়েছিল মুন্নি, কোন ছোটবেলায়, তার পরনে কী রঙের প্যান্ট ছিল না ছিল কে জানে। এত তুচ্ছ ঘটনা কি কেউ মনে রাখে?
—ফুলদানি ছুঁড়েছিল শাহানা। ওর কপাল কেটে গিয়েছিল। দাগ কি শেষ অবধি মিলিয়েছিল?
—কি জানি! তা তো জানি না।
—তোর মনে আছে শরিফা, আমরা একবার তোদের বাড়ির ছাদে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সারারাত আমাদের কেউ খুঁজে পায়নি! বাবা থানায় ডায়রি করে এলেন। সকালে আমরা চোখ ডলতে ডলতে নামলাম।
‘ডলতে ডলতে’ শব্দদুটো ব্যবহার করবার পর কল্যাণীর চেতনা হয়, তার আসলে ময়মনসিংহের ভাষায় কথা বলা উচিত। জয়িষা দীপনের সঙ্গে কল্যাণী মাঝে মধ্যে ‘কিরে তরা খাইবি না?’ ‘ভাল কইরা লেখাপড়া না করলে পরীক্ষায় লাড্ডু পাইবি কইলাম।’ এরকম কথা বলে। শুনে অনির্বাণ বিরক্ত হয়ে বলে—ছেলেমেয়েদের কী শেখাচ্ছ বল তো! তুমি কি এদের মানুষ হতে দেবে না?
কল্যাণী মনে মনে হাসে মানুষ কি আমরা হইনি? অনির্বাণটা বোকাও বটে। ওর বোকামোর কথা ভেবে কল্যাণীর আবার হাসি পায়। হেসেই সে বলে—টয়লেটটা দেখাইয়া দে তো শরিফা, চান কইরা ফালাই।
কল্যাণী কোনও ফাঁক রাখতে চায় না। ভাষার দূরত্বটুকু ঘুচিয়েও সে শরিফার কাছাকাছি আসতে চায়। ব্যাগ থেকে নিজের সাবান তোয়ালে বের করে টয়লেটে যায়। শরিফা পিছন পিছন আসে, কল্যাণী এক চিলতে উঠোনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে—তোদের টিউবওয়েল নেই?
শরিফা দ্রুত মাথা নাড়ে যেন টিউবওয়েল একেবারেই ছোটলোকদের জিনিস, ভদ্রলোকের বাড়িতে এটি থাকে না। কল্যাণী ময়মনসিংহের টিউবওয়েল চেপে জল খাবে বলে কতকাল অপেক্ষা করে ছিল। স্নানঘরে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, শরিফার কী কোনও কারণে মন খারাপ? সে তো এখনও তাদের জন্য কোনও ঘর দেখিয়ে দেয়নি। একবারও বলেনি তার বাড়িতে থাকতে, ভাত খাওয়ার কথা—এমন কি স্নান করবার কথাও যেচে বলল কল্যাণী। এত কেন নিস্পৃহ শরিফা? ওর কি বড় কোনও অসুখ হয়েছিল, স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে? কী তবে হয়েছে শরিফার, শৈশব কৈশোর তো হাজার বছর আগে তারা পেরিয়ে আসেনি যে ভুলে যেতে হবে সব! আর ওসব কি ভুলে যাওয়ার জিনিস? কেউ পারে ভুলে যেতে? পারে কেউ ভুলে যেতে দুজনে বড় বিজ্ঞানী হবে, তারপর পিঠের পিছনে দুটো পাখা লাগাবে, উড়ে বেড়াবে আকাশময়, সেইসব স্বপ্ন? তারা খাবে না পরবে না, জগতের পার্থিব জিনিস নিয়ে তারা ভাববে না, কেবল উড়ে বেড়াবে এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে। চাঁদে যাবে, মঙ্গলগ্রহ, বুধ, বৃহস্পতি, নেপচুন সব দেখবে ঘুরে ঘুরে। সেই চাঁদে তো শেষ অবধি গেলই মানুষ। মানুষ যাবার আগে মনে মনে অনেকবার গিয়েছে ওরা, শরিফা আর কল্যাণী। শরিফা কি ভুলে গেছে সব? যাহ, মানুষ কি ভুলে যেতে পারে এত কিছু? ভুললে এ তার নিজেকেই ভুলে যাওয়া। কল্যাণী মন ভরে স্নান করে। কতদিন দেশের জলে সে স্নান করেনি। না হোক পুকুর বা টিউবওয়েলের জল, তবু তো দেশেরই জল। জলে সে দেশ দেশ গন্ধ পায়। এখনও তার জল খাওয়া হয়নি। বুকের মধ্য থেকে তৃষ্ণাটি কিছুতেই যাচ্ছে না। স্নানের জলকেই সে আঁজলা ভরে নিয়ে দেখে, তার পলক পড়ে না।
স্নান সেরে কল্যাণী বলে—শহরটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করছে। চল ঘুরি।
শরিফা শোবার ঘরের খাটে বসেছিল, নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বলে—আমি তো যাইতে পারব না। বাচ্চার বাপের কাছে না জিগাস কইরা আমার যাওয়া হইব না।
—না জিগাস কইরা গেলে তোরে কী করবে শুনি?
শরিফা ম্লান হাসে। কল্যাণী বুঝে পায় না তার এখন কী করা উচিত। সে কি শরিফার শীতল শরীরটি ঝাঁকুনি দিয়ে একবার বলবে কী তুই মরে গেছিস নাকি?