Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রাস্তাটা নির্জন

রাস্তাটা নির্জন। হঠাৎ স্বপ্নেন্দুর বুকের ভেতরটায় থম ধরল। তার হৃৎপিণ্ড কাঁপতে শুরু করল। খুব নার্ভাস লাগছে এখন। এইভাবে চট করে চলে না এলেই ভালো ছিল। তারপর মরিয়া হলো সে। লাল ব্লাউজ লাল শাড়ির আগুন তাকে চুম্বকের মতো টানছিল।

কলিংবেলের বোতামে আঙুল রাখতেই ভেতরে যেন ঝড় বয়ে গেল। নির্জন দুপুরে বোধহয় আওয়াজ বেশি হয়। কেউ দরজা খুলছে না। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করার পর স্বপ্নেন্দু আবার বেল টিপল। এরপর ধীরে ধীরে দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক মহিলা। মহিলা কারণ তার পরনে সাদা শাড়ি, মাথাটা বিরাট ঘোমটার আড়াল ঢাকা। সেই পরশুরামের গল্পের চরিত্র যেন।

কী চাই?

হেনা সেন আছেন? স্বপ্নেন্দুর স্বর কাঁপছিল।

আপনি কে?

আমি ওঁর অফিসে কাজ করি। আমার নাম স্বপ্নেন্দু।

ও তুমি। এসো ভেতরে এসো। মহিলা দরজা ফাঁক করতে স্বপ্নেন্দু ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করে মহিলা কাতর গলায় বললেন, একি হল বাবা, আমরা কি এমন পাপ করেছি যে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে।

স্বপ্নেন্দু বুঝল ইনি হেনার মা। মনে পড়লো না সেদিন ইনি তাকে তুমি বলেছিলেন কিনা। সে বললো, কী আর করা যাবে বলুন। মহিলা বললেন, এইভাবে বাঁচতে চাই না বাবা। তিনি স্বর্গে বসে রইলেন আর আমি চিরকাল এই নরকে পড়ে থাকব। আমার তো বাঁচবার কোনো আকাঙ্ক্ষাই ছিলো না। শুধু ওই মেয়েটার একটা হিল্লে করতে পারলে! কলকাতার সব মানুষের কি এই দশা?

হ্যাঁ মাসীমা।

কলকাতার বাইরের?

তাদের কথা জানি না।

পরশু থেকে মেয়ে আমার বিছানা ছাড়েনি। শুধু পড়ে পড়ে কেঁদে যাচ্ছে। তুমিই প্রথম আমাদের বাড়িতে এলে।

ওর সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে? স্বপ্নেন্দু যেন অনুনয় করল।

কথা? ও তো কথাই বলতে চাইছে না। কতবার ওকে বললাম সহজ হতে তা মেয়ে আমাকে খেঁকিয়ে উঠছে। সরে যাও সরে যাও আমি কাউকে সহ্য করতে পারছি না। ওকি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে?

মহিলা মাথার পড়ে যাওয়া ঘোমটা চট করে টেনে নিলেন। স্বপ্নেন্দু লক্ষ্য করল এঁর করোটির গায়ে সামান্য হলদে দাগ রয়েছে।

তাহলে থাক। ওকে বলবেন আমি এসেছিলাম। নিশ্বাস ফেললো স্বপ্নেন্দু। মহিলা বললেন, দাঁড়াও। তুমি বড়ো ভালো ছেলে বাবা।

অবাক হয়ে স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলো, একথা বলছেন কেন?

নিশ্চয়ই কারণ আছে। আমি ভাবছি তুমি যদি নিজে গিয়ে ওকে সহজ হতে বল তাহলে যদি কাজ হয়। আগে থেকে বললেও আপনি করবে।

আপনি যদি বলেন। স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড কাঁপতে লাগল।

আগে হলে হয়তো বলতাম না। কিন্তু এখন আমার মাথা ঠিক নেই। দ্যাখো, যদি পারো ওকে সহজ করতে। ওই দরজা দিয়ে যাও।

স্বপ্নেন্দুর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তারপর ধীরে ধীরে সে বাঁ দিকের ছোট্ট প্যাসেজটা ধরে হেঁটে একটা ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়াল। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল মহিলা নেই। নিজের জামা ঠিক করে নিলো স্বপ্নেন্দু, ভেতরে ঢুকতেই খাটটাকে দেখতে পেল। খাটের ওপর হেনা সেন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। হলদে ফুল তোলা ম্যাক্সি ওর গায়ে। বড়ো হাতায় কবজি পর্যন্ত ঢাকা। পায়ের হাড় এবং সাদা করোটি এবার দেখতে পেলো স্বপ্নেন্দু। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকায় হেনা সেন তার উপস্থিতি টের পায় নি। স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড স্থির হয়ে গেল। হেনা সেন ছাড়া নিশ্চয়ই এই ঘরে অন্য কেউ থাকবে না। সে চোখ বন্ধ করতে গিয়েও পারল না। কারণ তার চোখের পাতাই নেই। হৃৎপিণ্ড অনুভবে দৃষ্টিশক্তি যোগাচ্ছে।

সেই হেনা সেন? স্বপ্নেন্দুর মনে হচ্ছিল এখানে না এলেই ভালো হতো। যে মাখনের মতো নরম শরীর তাকে চুম্বকের মতো টেনেছিল সেটাকে স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখাই ছিল। এখন তো হেনা সেন তারই মতো বীভৎস। অথচ এই ঘরে ঢোকবার আগে বুকের ভেতর ভূমিকম্প হচ্ছিল তার। তার অনুরণন তো এখনও মেলায় নি। স্বপ্নেন্দু নিচু স্বরে ডাকলো, শুনুন।

হেনা সেনের কোনো প্রতিক্রিয়া হলো কিনা বুঝতে পারলো না সে। এক পা এগিয়ে সে আবার ডাকলো, মিস সেন!..

এবার চকিতে করোটি ঘুরে গেল। আর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসে হেনা সেন চিৎকার করে উঠলেন, কে? কে? ও মাগো! তার একটা হাত মুখে চাপা দিল।

সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ধিক্কার দিলো স্বপ্নেন্দু। একি দেখছে সে। কিন্তু ততক্ষণে সেই চামড়া মাংস-রক্তহীন কঙ্কালের মুখটা চাদরে ঢেকে ফেলেছে হেনা সেন। এখনও যেন ঘরের মধ্যে আর্তনাদটা পাক খাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু ঘোর কাটিয়ে বলে উঠলো, নার্ভাস হবেন না মিস সেন। আমি স্বপ্নেন্দু।

স্বপ্ন? সঙ্গে সঙ্গে হেনা সেনের মাথাটা আলোড়িত হলো, আমি চিনি না আপনাকে। কেন এলেন এখানে? বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান বলছি। ওমা, মাগো।

আর্তনাদ শুনে স্বপ্নেন্দু এতটা অবাক হয়ে গিয়েছিলো যে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারে নি প্রথমটায়। যেন সত্যি কোনো মহিলার ঘরে সে আচম্বিত ঢুকেছে এবং তিনি চিৎকার করছেন আত্মরক্ষার জন্যে। স্বপ্নেন্দু নামটা শুনেও ওর কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি দেখে সে আরও তাজ্জব হলো। এখনই সেই মহিলা ছুটে আসবেন এবং তাকে বেরিয়ে যেতে হবে এই আশংকায় স্বপ্নেন্দু দরজার দিকে তাকাল। কিন্তু মহিলার আসার কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় সাহস বাড়ল তার। হেনা সেন এখন দুহাতে চাদরটাকে আঁকড়ে ধরে কাঁপছেন।

স্বপ্নেন্দু আর এক পা এগোল, মিস সেন। আমি আপনার অফিসে কাজ করি। এই দুদিন আমি আসতে পারিনি। আজ না এসে পারলাম না। আপনি সত্যি আমাকে চিনতে পারছেন না?

না, আমি কাউকে চিনি না। উত্তেজনা আছে কিন্তু এবার তার ঝাঁঝ কম।

তা কি হতে পারে? আমি শুক্রবারে এখানে এসেছিলাম।

আজ কেন এসেছেন? মজা দেখতে?

মোটেই নয়। স্বপ্নেন্দু আবার দরজাটার দিকে তাকাল। মহিলা ওর ওপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছেন কিনা কে জানে! তবু সে মরিয়া হয়ে বলল, এই কদিন আমি আপনার কথা ভেবেছি।

কি মিথ্যে বলতে এসেছেন!

মিথ্যে নয়। আমার বলা শোভন নয়। স্বপ্নেন্দুকে থামিয়ে দিয়ে হেনা সেন বললো, কী জন্যে এসেছিলেন আমি জানি। এখন তো আর সেসব নেই। আমার শরীর, আমার শরীরটার দিকে তাকালে পুরুষজাতটার চোখ লোভে চকচক করে উঠত। ওই ঘেন্নায় আমি! তা আর এখন কেন? এখন তো আমি একটা কঙ্কাল। এখন আমাকে একটু নিশ্চিন্তে থাকতে দিন।

আপনি ভুল বলছেন।

একটুও না। সেদিন যখন আপনি আমাকে ঘরে ডেকেছিলেন তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেই চোখ। লালসা থিক থিক করছে। আজ আমার কিছু নেই। আপনাদের কাছে আমার কোনো মূল্য নেই। উঃ।

আমি আবার বলছি আপনি ভুল বলছেন।

নাঃ। চিৎকারটা বাড়ল। তারপর এক টানে চাদর খুলে হিসহিসে গলায় হেনা সেন বলল, দেখুন চেয়ে দেখুন। এই হলাম আমি।

স্বপ্নেন্দু একবার ভালো করে দেখল, তার বুক মুচড়ে যাচ্ছিল। সেই ঠোঁটের জাদুকরী হাসি, চোখের কাজ গালের টোল আর মুখের মায়া কোথায় মিলিয়ে গেল। একটা ছোট্ট কঙ্কালের জেদী মুখ তার দিকে ফেরানো। কিন্তু সেই সঙ্গে তার মনে হলো রাস্তাঘাটে এই কদিনে সে অনেক কঙ্কালের মুখ দেখেছে। তাদের চোয়াল, কপাল, নাকের তুলনায় হেনা সেনের মুখ অনেক সুন্দর। অন্তত ওর চিবুকে একটা আলতো আদুরে ভাব মাখানো আছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুগ্ধ হলো স্বপ্নেন্দু। তারপর বললো, আমার মুখের দিকে দেখুন। আমিও আপনার মতো। তবে একটা কথা বলি, সব হারিয়েও আপনি অনেকের চেয়ে সুন্দর, বেশি সুন্দর।

আবার সেই মিথ্যে কথা! সারাজীবন ধরে স্তুতি শুনেছি। আর না। কি আশায় আপনি এসেছেন আমার কাছে? আমার শরীর? তবে দেখুন। নিজের চোখে দেখুন। হঠাৎ দুহাতে পাগলের মতো ম্যাক্সিটা খুলে ফেললো হেনা সেন, দেখুন, ভালো করে দেখুন। আমার শরীরে এখন কটা হাড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আপনারা, পুরুষজাত চিবিয়ে সব নরম সুন্দর গিলেছেন। বাট নাউ আই অ্যাম ফিনিশড। গেট আউট প্লিজ। হেনা সেন থরথর করে কাঁপছিল। স্বপ্নেন্দুর মনে হলো অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখেছ। হেনা সেনের দুটো পা ঈষৎ ভাঁজ করা, কোমর বাঁকানো, বুকের খাঁচার ভেতরে তার হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করছে। যেন কুমোরটুলিতে মূর্তি গড়ার প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে, এবার মাটির প্রলেপ লাগিয়ে দিলেই হলো। সে একটু ঝুঁকে বিছানা থেকে চাদর তুলে নিয়ে হেনা সেনের শরীরে ছড়িয়ে দিল, তারপর বলল, উত্তেজিত হবেন না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে।

কে বলেছেন? হেনা সেনের স্বরে বিস্ময়।

মুখ্যমন্ত্রী।

আঃ আপনি অদ্ভুত লোক তো।

উনি তো অন্যায় কিছু বলেননি। আমাদের যা গিয়েছে তা নিয়ে চিন্তা করে কী লাভ! আমরা তো অমরত্ব পেলাম, তাই না?

কীসের বিনিময়ে অমরত্ব পেলাম? কে চায় এমন অমরত্ব? অন্তত আমি চাই না। আমার ওই শরীরটাকে কৃপণের মতো লোভী হাতগুলোর আওতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। কেন, কীসের জন্যে? আমি তো তার ব্যবহারই জানলাম না, তার স্বাদ আমার অচেনা রয়ে গেল চিরজীবনের জন্যে। কে চায় এই অমরত্ব?

উত্তেজিত হবেন না। আপনি বিশ্বাস করুন আমি কোনো অভিসন্ধি নিয়ে আসিনি।

তাহলে কেন এসেছেন?

বলব। আগে জামাটা পরে নিন।

আমি আর শাড়ি পরতে পারব না। আঃ।

কেন পারবেন না? অফিসে আজ তিনজন মহিলাকে শাড়ি পরে যেতে দেখেছি।

অফিসে? অফিসে লোক গিয়েছিল? মেয়েরা গিয়েছিল?

হ্যাঁ। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন সবাইকে স্বাভাবিকভাবেই চলতে। যাঁরা অফিসে যাবেন না তাদের পাতাল-নরকে ঠেলে দেওয়া হবে।

পাতাল-নরকে? হেনা সেনের স্বরে আবার বিস্ময়।

হ্যাঁ। ওই যে টিউব রেল হচ্ছিল। ওটা কমপ্লিট হতে সময় লাগবে। কিন্তু এখন আর তেমন ট্রান্সপোর্ট প্রব্লেম নেই তাই টিউবের মুখ বন্ধ করে পুলিশ অপরাধীদের ওখানে ফেলে দেবে।

আমি অফিসে যাব না। এই মুখ, শরীর নিয়ে যেতে পারব না।

তাহলে পাতাল-নরকে যেতে হবে। ঠিক আছে, ব্যাপারটা আমি দেখব। আপনার জামা পরুন আগে। আমি কি ঘর থেকে বেরিয়ে যাব?

হেনা সেনের মুখ নিচু হলো। স্বপ্নেন্দু মনে হলো হেনা লজ্জা পেয়েছে। সে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হেনা সেনকে দেখতে পেল। ছবির বাঁধানো ফ্রেমে হেনা সুন্দর হাসছে। সেই মোহিন শরীর আর মুখের হাসিতে ঘর যেন আলো হয়ে গেছে। এই ছবিটাকে খুলে ফেলা উচিত। স্বপ্নেন্দু মনে মনে বলল।

ঠিক তখন হেনা সেন বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে, বসুন।

স্বপ্নেন্দু ফিরে তাকাল! হাতওয়ালা ম্যাক্সি পায়ের গোড়ালি ছুঁয়েছে।

মাথায় একটা কালো রুমাল বাঁধা। স্বপ্নেন্দু বলল, সুন্দর।

হেনার মাথা সামান্য নড়ল, আবার বানানো কথা!

বিশ্বাস করুন। স্বপ্নেন্দুর স্বর ভারী হলো।

আপনি কি পাগল?

তাই মনে হচ্ছে? জানলাগুলো খুলে দিই?

আলো আসবে যে।

আসুক। এখন থেকে খোলা হাওয়ায় বের হবেন।

আমি পারব না, লজ্জা লাগছে, কেমন-ভাবতে পারছি না।

উঁহু। বরং দেখবেন পাঁচজনে আপনার দিকে তাকাবে।

আবার? হেনা একটা চেয়ারে বসল। পাশে স্বপ্নেন্দু।

আপনি আমার কাছে কী চান বলুন তো?

আপনার কী মনে হয়?

আমি বুঝতে পারছি না। আমার তো দেওয়ার মতো কিছুই নেই। সত্যি বলতে কি এই কণ্ঠস্বর ছাড়া আমি আর মেয়েও নই।

ভুল হল। কণ্ঠে আমাদের স্বর নেই। ওট বক্ষস্বর হবে। আর তাই যদি বলেন তাহলে আমিও তো পুরুষ নেই। একমাত্র স্বর সেটা বোঝা যায় আর হয়তো হাড়ের গঠনে। তাই না?

তাহলে? কী চান আপনি?

আপনাকে।

ওঃ, আমি এই কথাটাই তো বুঝতে পারছি না।

বুঝতে হবে না। কাল থেকে অফিসে যাচ্ছেন?

কাল থেকে? না না।

বেশ যেদিন যাবেন বলবেন। আমি একটা ছুটির দরখাস্তে আপনার সই করিয়ে নিয়ে যাব। বাড়িতে বইপত্র আছে?

আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন কিছুই হয়নি।

মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে এসব নিয়ে একদম মাথা ঘামাবেন না।

কি নিয়ে মাথা ঘামাব?

বলব?

বলুন।

আপনার মায়ের সঙ্গে আলোচনা করুন একটা সমস্যা নিয়ে।

কী সমস্যা?

আপনার বিয়ে হয়ে গেলে উনি কোথায় থাকবেন? আপনার সঙ্গে থাকতে ওঁর আপত্তি আছে কিনা? নাকি এখানেই থাকতে চান!

বিয়ে? আপনি কি সুস্থ?

অবশ্যই।

আমাকে কে বিয়ে করবে? আমি তো আর মেয়েই নই।

এইসময় দরজায় হেনার মা এসে দাঁড়ালেন। স্বপ্নেন্দু তাকে আগে লক্ষ্য করেছিল। সে উঠে দাঁড়ালো, আসুন। আপনার মেয়ে সমানে ঝগড়া করে যাচ্ছে।

মোটেই না। হেনা মৃদু আপত্তি করল।

সে কি? একটু আগে আপনি চেঁচাচ্ছিলেন না! আমাকে চিনতে পর্যন্ত চাইছিলেন না। বসুন মাসীমা।

না বসব না। তুই ভালো আছিস?

জবাব দিল না হেনা। একটু চুপ করে বলল, তুমি একটা কাপড় বাঁধো তো মাথায়, বিশ্রী দেখাচ্ছে।

মহিলা ক্লান্ত গলায় বললেন, আমাকে আর কী দেখাবে! ভাগ্যিস তুমি এলে বাবা। নইলে ওকে নিয়ে যে কি করতাম আমি! কোনো কথা শুনতে চাইছিল না। শরীর নিয়ে ওর চিরকালই–।

আঃ চুপ করো তো। মাকে থামিয়ে দিল হেনা সেন।

স্বপ্নেন্দু বললো, আপনারা এক কাজ করুন। বাইরের পৃথিবীতে কি হচ্ছে তা জানতেই পারছেন না। চলুন আপনারা আমার সঙ্গে। বাইরে হেঁটে আসি। নইলে একা একা ঘরে বসে থাকলে আরও মন খারাপ হবে।

হেনার মা বললেন, না বাবা। আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তোর ইচ্ছে হলে ঘুরে আয়। স্বপ্নেন্দু যখন বলছে। হেনার মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

হেনা কোনো জবাব দিল না। স্বপ্নেন্দু কিছুক্ষণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলো, কি হলো?

আজকে একদম ইচ্ছে করছে না।

ঠিক আছে। কাল তৈরি থাকবেন। এলেই বেরিয়ে পড়তে হবে।

কাল আপনি আসবেন?

হ্যাঁ। বললাম তো লোকলজ্জার কোনো কারণ নেই।

আপনি আমাকে ঠকাচ্ছেন না তো?

ঠকিয়ে আমার কী লাভ?

আমার খুব ভয় করে।

কীসের ভয়।

পুরুষজাতটাকে। ওরা মেয়েদের শুধু শরীরের জন্যেই চায় সেটা মিটে গেলে আর তাকিয়েও দ্যাখে না। তাই–

এখন তো আর সেসব প্রশ্ন ওঠে না।

হেনা সেন যেন চেতনায় ফিরল, তা বটে। সেজন্যে আরও গোলমাল লাগছে। আপনি যা বলছেন সব কি সত্যি?

সব। আর এইসব পুরোনো ভাবনাগুলোকে এখন বাতিল করুন। মনটাকে পরিষ্কার করুন দেখবেন সব কিছু হালকা লাগবে। কলকাতা শহরটার চেহারা একদম পাল্টে গেছে। আপনি কেন স্মৃতি আঁকড়ে থাকবেন?

পাল্টে গেছে মানে?

নদীতে জল নেই, পুকুরগুলো খাঁ-খাঁ করছে। একটাও গাছ নেই, ঘাস বাগান ফুল সব ছাই হয়ে গেছে। বলতে বলতে থমকে দাঁড়ালো স্বপ্নেন্দু, না সব নয়। একটা ফুল আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে আছে, এখনও।

একটা ফুল? কোন ফুল, কোথায়?

স্বপ্নেন্দু হাসল, শব্দ হল, সেটা বলা যাবে না। একমাত্র আমিই তার হদিশ জানি।

আঃ আবার সাজানো কথা!

স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারল। হেনা মনে করেছে স্বপ্নেন্দু তার কথা বলছে। যেন হেনাকে একটা ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছে স্বপ্নেন্দু। সে আর ভুল ভাঙল না। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি সাজানো কথা বলি না।

হেনা সেন উঠল, আজ যে আমার কী হলো!

কী হল?

আপনি আসার আগে মনে হচ্ছিল, থাক, বাদ দিন।

দরজা বন্ধ করার আগে হেনা জিজ্ঞাসা করল, সত্যি কথা বলুন তো, আমি কি খুব কুৎসিত হয়ে যাইনি?

স্বপ্নেন্দু বলল, পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী মোটেই না।

হেনার মাথাটা নিচু হল, আপনি আমার মনটাকে পাল্টে দিয়ে গেলেন। আবার কবে আসবেন?

কাল।

সত্যি?

হ্যাঁ। স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। বাইরে বেরিয়ে স্বপ্নেন্দুর হাঁটার গতি বেড়ে গেল। জয় করায়ত্ত। এত সহজে যে সে হেনা সেনকে পেয়ে যাবে তা কল্পনায় ছিল না। একথা ঠিক যদি এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটত তাহলে ব্যাপারটা এত সহজ হত না। হেনা সেন তাকে নানাভাবে যাচাই করত এবং হয়ত শেষ পর্যন্ত ছুঁড়ে ফেলত।

স্বপ্নেন্দু ভাবল, এবার একটা দিন ঠিক করে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে ওরা যাবে। হ্যাঁ, তার শরীর নেই। পুরুষ মানুষের কোনো চিহ্ন তার নেই। হেনার মধ্যে মহিলাত্ব পাওয়া যাবে না। কিন্তু ওগুলোই কি সব? পুরুষ এবং মহিলা কি দুজনের শরীরের মধ্যেই তৃপ্তি খুঁজবে শুধু? তাদের মনের আনন্দ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। হেনা সঙ্গে থাকলে সে ওই আনন্দ পাবেই। দুজনে মিলে গল্প করবে, ভালবাসবে, বেড়াতে যাবে। আসন্ন ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্বপ্নেন্দু শিহরন বোধ করছিল।

বাস থেকে নেমে চোখের ওপর একটা ঘটনা ঘটতে দেখল সে। একজন মহিলা অলসভাবে হাঁটছিলেন। তাঁর হাতে একটা রেডিও সেট। বোধহয় সারাতে দিয়েছিলেন। বা ওইরকম কিছু। হঠাৎ একটা লোক তাঁর হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে দৌড়তে শুরু করল। মহিলা চিৎকার করে পিছু ধাওয়া করতে কোত্থেকে আর একটা লোক উদয় হয়ে তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। পত পত করে শাড়িটা খুলে গেল। মহিলা চেষ্টা করলেও সেটাকে আটকাতে পারলেন না। দ্বিতীয় লোকটা শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টোদিকে দৌড়ল। স্বপ্নেন্দু এতটা উত্তেজিত হয়েছিলো যে পিছু ধাওয়া করলো দ্বিতীয় লোকটার। কিন্তু দূরত্ব এত বেশি যে তার পক্ষে ধরা সম্ভব নয় বুঝে চিৎকার করতে লাগল যাতে অন্য লোক লোকটাকে ধরে। কিন্তু সে দেখল চারপাশের মানুষজন সে-চেষ্টাই করছে না। বরং হাসাহাসি শুরু হয়েছে। স্বপ্নেন্দু রাগত গলায় বললো, আপনারা হাসছেন? লজ্জা করছে না? একজন মহিলাকে বেইজ্জত করছে সবার সামনে। ছি ছি!

জনতার একজন বললো, কে মহিলা? উনি মহিলা তার প্রমাণ আছে?

থমকে গেলো স্বপ্নেন্দু, শাড়ি ব্লাউজ পরেছেন দেখছেন না?

আপনি শাড়ি ব্লাউজ পরলে মশাই একই রকম দেখাবে। শোনেননি কাল থেকে ইম-বাসে লেডিজ সিট উঠে যাচ্ছে।

লেডিস সিট উঠে যাচ্ছে? ততক্ষণে ছিনতাইকারী হাওয়া হয়ে গিয়েছে। স্বপ্নেন্দু মহিলার দিকে তাকাল। দুহাতে জামা ঢাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। স্বপ্নেন্দু বুঝল পুরনো সংস্কার এবং অভ্যেস ত্যাগ করতে পারেননি মহিলা।

সকালে শহরটা বেশ ছিমছাম ছিল। দুপুরে কী হয়েছিল স্বপ্নেন্দু জানে না। হেনা সেনের বাড়িতে যতক্ষণ ছিল বাইরের পৃথিবীর কথা খেয়াল ছিল না। কিন্তু বিকেলে মনে হলো কলকাতা যেন স্বচ্ছন্দ নয়। মানুষগুলোর ব্যবহার পাল্টে গিয়েছে।

অবনীদা বসেছিল দোকানে। স্বপ্নে দেখল দোকানটা ন্যাড়া। জিনিসপত্র কিছুই নেই। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন অবনীদা? আমি স্বপ্নেন্দু।

দেখছ তো ভাই। এগুলো নিয়ে ওরা কী করবে জানি না তবু নিয়ে গেল।

কি নিয়ে গেল?

চায়ের কাপ-ডিশ-কেটলি জলের ড্রাম!

কারা নিল।

এখন তো চেনা মুশকিল। দল বেঁধে সাত আটজন এসেছিল। লুট করে নিয়ে চলে গেল। বললাম কোনো কাজে লাগবে না ভাই কিন্তু শুনল না। তুমি কিছু দ্যাখোনি?

মনে হলো কিছু একটা হয়েছে।

দোকানপাট লুট হচ্ছে, বড়ো রাস্তার কাপড়ের দোকানগুলো ভেঙে সবাই যে যার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। এমন কি মিষ্টির দোকান লুঠ করে সেগুলো চটকাচ্ছে মানুষগুলো। এসব কেন হচ্ছে জানো?

কেনো?

সবাই বুঝে গেছে তাদের আর পাওয়ার কিছু নেই। পুলিশ এসেছিল লরিতে চেপে। ধাওয়া করতে সবাই পালাল। কিন্তু এর মধ্যেই মানুষ জেনে গেছে পুলিশের পুরনো বন্দুকগুলো অকেজো হয়ে গিয়েছে। নতুন যে অস্ত্রের কথা শোনা যাচ্ছে তা কেউ চাক্ষুস করে নি। এখন তাই পুলিশ দেখলে কেউ ভয় পায় না।

অকেজো হয়ে গিয়েছে মানে?

ট্রিগার টিপলেও গুলি বের হচ্ছে না। বোধহয় গুলিগুলোর বারোটা বেজে গেছে। কি ভয়ঙ্কর কথা! চারিদিকে এখন অরাজকতা শুরু হয়ে যাবে। তুমি জানো আমার ছেলেটা আমাকে কী বলেছে?

কী?

বললো, একদম চোখ রাঙাবে না। তোমার খাই না পরি? আমি আমার মতো থাকব তুমি নাক গলাবে না। জীবনে যা কিছু সবই তো ভোগ করেছ। আমি কী পেলাম? বোঝো! আমার ভয় হচ্ছে আমাদের সংসারগুলো পর্যন্ত ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। নরক, নরক এসে গেল। এইসময় আর একটা কঙ্কাল এসে হাজির হল। তার দিকে তাকিয়ে চিনতে পারল না স্বপ্নেন্দু। লোকটা বললো, টিভি চালু হয়েছে? অবনীদা মাথা নাড়লো, জানি না। ওটা ছেলে বগলদাবা করে সরে পড়েছে। বাড়ির সব জিনিস সে হাওয়া করে দিচ্ছে।

কেন?

এখন পড়ে থাকা নাকি মূর্খামি। এমন কি সে তার মাকে বলছে, তুমি আর মা কোথায়, মা হতে হলে তো মেয়েমানুষ হতে হয়।

স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির জানলায় একটি মুখ চিৎকার করে উঠল, কে কে?

আমি স্বপ্নেন্দু।

ও তুমি। আমি তোমার হরিজ্যাঠা। কিন্তু তুমি স্বপ্নেন্দু তার প্রমাণ কী? আজকাল তো কাউকে বোঝা যায় না। বাপের নাম বল?

আমার বাবা আপনার বন্ধু ছিলেন। ঈশ্বর তারকনাথ।

ও বুঝেছি। উই হ্যাভ লস্ট আওয়ার আইডেন্টিফিকেশন। সাম্যবাদ। সাম্যবাদ। ক্যুনিজম। তোমার মুখ্যমন্ত্রী যা বোঝাবেন তাই বুঝতে হবে? বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে চিনতে পারে না। মেয়েকে আর মেয়ে বলে মনে হয় না। হ্যাঁ, শোনো। সবসময় দরজা বন্ধ রাখবে বাবা। কোনো সিকিউরিটি নেই। যে কোনো মুহূর্তেই বাড়ি লুঠ হতে পারে। বড়ো রাস্তায় কী হয়েছে শুনেছ?

শুনেছি।

দাঙ্গার সময় এরকম হতো। তখন কারণটা বোঝা যেত। আমি তো দরজা খুলছি না। যা কথা বলার জানলা দিয়ে বলো।

স্বপ্নেন্দু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল। এই সিঁড়ির মুখে কোনো দরজা নেই। ওপরে উঠে পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট। নিচে দরজা থাকলে কে বন্ধ করবে সেই ঝামেলায় ওটা খোলা রাখা রয়েছে।

ঘরের দরজা বন্ধ করে স্বপ্নেন্দু টেবিলের কাছে চলে এল। চাদর সরাতে ঝাপসা লাল রঙ চোখে পড়ল। সন্তর্পণে বড়ো জারটা খুলতেই ছোটো কাচের বাটির মধ্যে রক্তগোলাপটাকে স্পষ্ট দেখা গেলো। সেই একেই রকম সতেজ, ডাঁটো পাপড়ি। আর কি আশ্চর্য, সেই জলের ফোঁটাটাও অবিকল রয়ে গেছে। স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারছিল একটু হাওয়ার স্পর্শ পেলে ফুলটা হয়তো ছাই হয়ে যাবে। সে কৃপণের মতো ফুলটার দিকে তাকাল। আঃ, হৃৎপিণ্ড ক্রমশ শান্তিতে ভরে যাচ্ছে। কি আরাম।

একটা তোয়ালে নিয়ে মুখ পরিষ্কার করল সে। ধুলো লেগেছিল করোটিতে। তোয়ালেতে বেশ ময়লা। নিজের জামাকাপড় খুলে সে খাটের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে ঘরে। ঝিরঝিরে হাওয়া তার হাড়ের মধ্যে দিয়ে স্বচ্ছন্দে এপাশ ওপাশ করছে। শীতকালে কী হবে? তখন কি হাড় কনকন করবে?

স্বপ্নেন্দুর মনে হেনা সেনের মুখ ভেসে উঠল। নরম চিবুক, গলার স্বরে এখনও আগের মমতা। হেনা কি তাকে ভালোবেসেছে? স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল। আর কিছু চায় না সে। শুধু হেনা ভালোবেসে তার পাশে থাক। ওর সেই মায়া-চোখ, আদুরে গাল, মোহিনী হাসি, দম-বন্ধ করা বুক নাই থাকল কিন্তু হেনা তো আছে। আজ বিকেলে যা দেখল এবং শুনল তাতে কলকাতার পরিবেশটা কাল কি হবে অনুমান করা যাচ্ছে না। মানুষের চরিত্র খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। যত তাড়াতড়ি সম্ভব হেনাকে বিয়ে করা দরকার। স্বপ্নেন্দু বিছানা ছেড়ে উঠল। তারপর টেলিফোন ডাইরেক্টরি দেখে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে ফোন করল।

হ্যালো। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার অফিস?

হ্যাঁ। কী চাই?

এখন বিয়ে করতে গেলে নোটিস দিতে হয়?

বিয়ে? কে বিয়ে করবে?

আমি। কথাটা বলতে একটু লজ্জা বোধ করলো স্বপ্নেন্দু।

আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন?

মানে? এটা কি ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস নয়? এস কে রায়।

হ্যাঁ ঠিকই।

আপনার ওখান থেকে আমার এক বন্ধু মাস তিনেক আগে রেজিস্ট্রি করেছে। পাগল বলছেন কেন?

আপনি কাকে বিয়ে করবেন? তিনি ছেলে না মেয়ে?

কী আজেবাজে কথা বলছেন?

মাপ করবেন। এখন তো কেউ আর ছেলে কিংবা মেয়ে প্রমাণ করতে পারছেন না। ফলে বিয়ে হবে কী করে? পুরোন আইনে আছে পুরুষ এবং মহিলার মধ্যে বিয়ে হতে পারে। পুরুষে পুরুষে কিংবা মহিলায় মহিলায় অথবা নপুংসকদের মধ্যে বর্তমানে বিবাহের কোনো আইন নেই। বুঝলেন মশাই? হাসলেন রেজিস্ট্রার। শব্দ হলো।

সেকি? এখন তাহলে বিয়ে হবে না?

না। তাছাড়া আপনি তো তাজ্জব মানুষ। যেখানে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষ উন্মাদ হয়ে উঠেছে, সম্পর্ক ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে সেখানে আপনি বিয়ের কথা ভাবছেন? ইটস এ নিউজ। খবরের কাগজে ছাপা হওয়া উচিত। হে হে করে হেসে উঠলেন রেজিস্ট্রার।

বিরক্ত এবং হতাশ স্বপ্নেন্দু বলল, জ্ঞান দেবেন না। তাহলে আপনি আছেন কী করতে? আপনার চাকরি তো গেল!

গেলো। দুহাতে এতকাল কামিয়েছি ভাই। সব গেল। তবে একটা সুখবর আছে। আপনি সরকারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে পারেন।

সাটিফিকেট?

হ্যাঁ। আপনি অমুক চন্দ্র অমুক, এক্স শ্রীমতী অমুকের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকতে চান। এ বিষয়ে এক্স শ্রীমতীর কোনো আপত্তি নেই। তাকেও সই করতে হবে। সরকার আপনাদের পাঁচ বছর একত্রে থাকার অনুমতি দেবেন।

পাঁচ বছর?

স্টেয়িং টুগেদার। তারপর ইচ্ছে করলে ছাড়াও যেতে পারে, আবার ওটা রিনিউ করাতেও পারে। আগে বিবাহিত জীবন কতদিন টিকত? পঞ্চাশ-ষাট বড়জোর সত্তর। তার বেশি নয় কিন্তু এখন অনন্ত জীবন। তাই এই ব্যবস্থা। আগে হলে এতো কথার জন্যে দক্ষিণা চাইতাম, এখন কী ঠিক করবেন জানাবেন। আমিই না হয় সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে দেব।

সার্টিফিকেট যদি না চাই?

মিটে গেল গোল। ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দেওয়ার শব্দ হলো রিসিভার নামিয়ে রেখে স্বপ্নেন্দু কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যাঃ শালা, এই কঙ্কালশরীরে বিয়েরও ব্যবস্থা নেই। ওর মনে হল মুখ্যমন্ত্রী এই পরিবর্তিত অবস্থার কথা এতটা না ভাবলেও পারতেন। হেনা সেনের মনে পুরনো সংস্কার জড়িয়ে আছে। বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকতে চাইলে হয়! যতই সুন্দরী হও, আধুনিকা হও, বিয়েটি চাই।

এই সময় বাইরে খুব হইচই শোনা গেল। স্বপ্নেন্দু জানলায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল তিন-চারজন তোক একটা লোককে ঘিরে ধরেছে। লোকটা মোটরবাইকে বসে। লোকগুলো ওকে টানাটানি করছে। লোকটার কঙ্কাল বেশ রোগাপটকা। হঠাৎ মুখ তুলে সে স্বপ্নেন্দুকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠলো, দেখুন, এরা আমার বাইক কেড়ে নিতে চাইছে। দিনদুপুরে ছিনতাই করছে! লোকগুলো হাসল। একজন বললো, এ বাইক তোর প্রমাণ কী?

আমার লাইসেন্স আছে। এই দেখুন!

হে হে হে। এ তো রক্তমাংসের মানুষের ছবি। তোর ছবি তার কী প্রমাণ?

লোকটা প্রতিবাদ করছিল কিন্তু ওরা ওকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে বাইকটাকে নিয়ে চলে গেল।

স্বপ্নেন্দু সরে এল জানলা থেকে। হঠাৎ সমস্ত শহরের পাগল হয়ে গেল নাকি! সে রেডিও খুলতেই মুখ্যমন্ত্রীর গলা ভেসে এল, বন্ধুগণ। আমরা যে পরিবর্তিত অবস্থায় পৌঁছেছি তাকে কাজে লাগানোর জন্যে আমি কলকাতাবাসীর কাছে আবেদন রাখছি। আপনারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিন। এখন অবস্থা অনেক উন্নত। দলে দলে মানুষ অফিস কাছারিতে যাচ্ছেন। ট্রাম-বাসে সহজে চলাফেরা করছেন। কলকাতায় আর কখনও খাদ্যাভাব জলাভাব অনুভূত হবে না। কিন্তু কোনো কোনো কু লোক এত সুন্দর ব্যবস্থাকে বানচাল করে দিতে চাইছেন। তারা সমস্ত কলকাতায় অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছেন। আমি এই বলে তাদের সতর্ক করে দিতে চাই কোনোরকম অশান্তি সরকার সহ্য করবে না। জনসাধারণকে অনুরোধ করছি এর প্রতিবাদ করতে। আপনারা সবাইকে বন্ধুর মতো গ্রহণ করুন।

এইসময় দরজার শব্দ হলো। রেডিওটাকে বন্ধ করে স্বপ্নেন্দু মুখ ফেরাল। দ্বিতীয়বার শব্দটা হলো। কে এলো এই সময়ে? সন্ধে হয়ে আসছে। সতর্কবাণী মনে পড়ল। পরিচিত ব্যক্তি ছাড়া চট করে দরজা খোলা উচিত হবে না। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করল, কে ওখানে?

আমি। স্বরটি মহিলার।

আমি কে?

আহা, খোলোই না!

স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। হেনা না? ওর মতো স্বর। হেনা এসেছে ভাবাই যায় না। সে দ্রুত দরজার পাল্লা খুলতেই দেখল মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে মহিলা ঘরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু এ হেনা নয়, নিশ্চয়ই নয়।

কী ব্যাপার? মহিলা মুখ তুলতেই হোঁচট খেল। না, এ হেনা নয়। হেনার চিবুক বড় আদুরে, মসৃণ এবং গোলাকার।

আমাকে চিনতে পারছ না? হায় ভগবান। আমি আত্রেয়ী।

আত্রেয়ী?

আমি ভেবেছিলাম গলার স্বরে তুমি চিনবে। তোমাকে তো খুব সেনসিটিভ বলে আমি জানতাম। কি অন্য কোনো মেয়ের কথা ভেবেছিলে?

না না। স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারছিল না আত্রেয়ী কেন এল, আসলে ব্যাপারটা এত চমকপ্রদ, বলো কি খবর। বোসো!

আমাকে কেমন দেখাচ্ছে স্বপ্নেন্দু–

মাথায় ঘোমটাটা সরিয়ে ফেললো আত্রেয়ী। সাদা করোটিটা ক্যাটক্যাট করছে। সেটার আকৃতি গোল। কপালটা উঁচু। চোখের ফুটো দুটো বেশ বড়ো, নাকের ডগা বসা, চিবুক চৌকো। হেনা সেনকে দেখে মনের যে আরাম হয়েছিল তার বিন্দুমাত্র হলো না আত্রেয়ীকে দেখে। কিন্তু কেমন। খসখসে শিরশিরানি বোধ করল হৃৎপিণ্ডে। স্বপ্নেন্দু জবাব দিলো,

ভালো।

কিন্তু ও নাকি সহ্য করতে পারছে না। আমিও না।

এটা তো মেনে নিতেই হবে।

সে কথা কে বোঝায় বল। দরজাটা বন্ধ করে দাও। বাইরে খুব গোলমাল।

এই অবস্থায় এলে কেন? স্বপ্নেন্দু দরজাটা বন্ধ করে দিল।

না এসে উপায় ছিল না। আমি একটা পাগলের সঙ্গে থাকতে পারি না।

পাগল?

হ্যাঁ।

সে কি? কেন?

কী বলব তোমাকে! ও পুরুষত্বহীন হয়ে পড়েছিল। অনেক চিকিৎসার পর ও বোধহয় সেরে আসছিল। এইসময় ঘটনাটা ঘটতে ও পাগল হয়ে গেল। এই হারানোটা ও স্ট্যান্ড করতে পারছে না। কাল আমাকে মেরেছে। এরপর আমি থাকি কী করে? না, আর একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ঈষৎ হাঁপাতে লাগল সে।

স্বপ্নেন্দু বলল, বোস।

চেয়ারে বসে আত্রেয়ী জিজ্ঞাসা করল, তুমি অপছন্দ করছ?

না তো। আমি তোমাকে বসতে বললাম কেন?

কিন্তু আমি আর ফিরব না। আমি তোমার সঙ্গে থাকব।

আমার সঙ্গে থাকবে?এবার চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু।

হ্যাঁ। আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। আমি জানি তুমিও আমাকে চেয়েছিলে।

সে তো ছাত্রাবস্থায়!

হ্যাঁ। তখন আমি ভুল করেছিলাম। গ্রেট মিসটেক। এখন সেটা সংশোধন করে নিতে চাই। আমরা তো অমর হয়ে গেছি, কোনো মৃত্যু ভয় নেই। আমরা চিরজীবন পরস্পরকে ভালবাসব। আত্রেয়ী এগিয়ে এল কয়েক পা, আমি প্রমাণ করে দেব ভালবাসা কাকে বলে!

স্বপ্নেন্দু চমকে উঠলো, কি আজেবাজে কথা বলছ? তোমার স্বামী জানতে পারলে কী হবে ভেবেছ? তাছাড়া

কিছুই হবে না। কারণ আমি তার স্ত্রী নই।

স্ত্রী নও মানে? তোমরা বিবাহিত।

ছিলাম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমি আর মহিলা নই। মানে যেহেতু আমার ফিমেল অর্গানগুলো নেই তাই ও আমাকে স্ত্রী হিসেবে ক্লেইম করতে পারে না। তাছাড়া ও নিজেও তো পুরুষ নেই। শব্দ করে হাসল আত্রেয়ী, এখন পৃথিবীতে স্ত্রী পুরুষ আলাদা করে নেই। কোনোরকম পার্থক্য থাকছে না। এখন একটাই পরিচয় আমাদের আমরা মানুষ। ফঁপরে পড়ল স্বপ্নেন্দু। সে বলল, কিন্তু তুমি তোমার মা-বাবার কাছে চলে যেতে পারতে। যদি প্রয়োজন হয় আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

তারা তো সব পাটনায়। শোনোনি, কলকাতার সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোনো যোগাযোগ নেই। তাছাড়া তুমি কি আমাকে পছন্দ করছ না? তেজি ভঙ্গিতে কথা বললো আত্রেয়ী।

না না, সেকথা হচ্ছে না। তুমি হঠাৎ এখানে উঠলে লোকে বলবে কী?

লোকের আর কাজ নেই যে এ ব্যাপারে মাথা ঘামবে। তাছাড়া আমি যে মেয়ে তাই প্রমাণ করবে কে? স্বপ্নেন্দু!

বলো?

আত্রেয়ী এগিয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর কাছে, আমি ভুল করেছিলাম। এতকাল একটুও শান্তি পাইনি। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না।

কিন্তু তুমি বুঝতে পারছ না, এ হয় না।

কেন হয় না। পৃথিবীর যে কোনো মেয়ের তুলনায় আমি তোমাকে বেশি ভালবাসব। তুমি আমার সঙ্গে সাতদিন থাকো। তারপর যদি তোমার আমাকে খারাপ লাগে তাহলে আমি কথা দিচ্ছি আর বিরক্ত করব না। কান্নার শব্দ উঠলো এই ঘরে। জল নেই, শুধু শব্দে বোঝা যাচ্ছে আত্রেয়ী কাঁদছে।

স্বপ্নেন্দু খুব নার্ভাস বোধ করছিল। আত্রেয়ীকে ছাত্রাবস্থায় তার ভালো লাগতো ঠিকই কিন্তু কখনও প্রেম বলে যে ব্যাপার তা মনে আসেনি। অথচ এখন অত্রেয়ী সেইরকম চাপাতে চাইছে। বাইরে এখন বেশ অন্ধকার। তাছাড়া রাস্তার অবস্থা যা তাকে এই রাতটা কোথাও যেতে বলা উচিত হবে না। আজকের রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে দিয়ে কাল সকালে এর বিহিত করতে হবে।

স্বপ্নেন্দু একদম প্রস্তুত ছিল না। তার কথাটা শেষ হওয়া মাত্র আত্রেয়ী ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। অদ্ভুত অনুভূতি হলো স্বপ্নেন্দুর। তার বুকের হৃৎপিণ্ডে মুখ রেখে আত্রেয়ী বলছে, তোমাকে ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। আর তার হৃৎপিণ্ড কাঁপছে। হাড়ে হাড়ে ঘষা লাগায় শব্দ হচ্ছে। কোনো শারীরিক অনুভূতি নেই। কোনো চাঞ্চল্য নেই। বরং হাড়ের সঙ্গে হাড়ের স্পর্শে একটা অস্বস্তিকর শব্দ কানে আসছে। অনেক কষ্টে স্বপ্নেন্দু আত্রেয়ীকে ছাড়াতে পারল। স্বপ্নেন্দু ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে! আত্রেয়ী তার বুকে মুখ রাখার সময় তার খারাপ লেগেছিল কি? একমাত্র ওই শব্দটি তাকে সচেতন করেছিল। এছাড়া সে যে নরম হয়ে পড়েছিল, বেশ আরাম হচ্ছিল তা কি মিথ্যে? যে কোনো মেয়ে বুকে মাথা রাখলেই কি এমন হয়? হেনা সেন যদি জানতে পারে। ছিঃ। হেনার কথা ভাবতেই দৃশ্যটা তেতো হয়ে গেল। সে আত্রেয়ীকে কথা ঘোরবার জন্যে জিজ্ঞাসা করলো, এলে কী করে? রাস্তায় তো গোলমাল হচ্ছে।

অনেক কষ্টে এসেছি! একটা বাসে উঠেছিলাম। ওরা লেডিজ সিটে বসতেই দিল না। বলল, এখন কেউ লেডিজ নয়। নেমেই দেখি একটা কাপড়ের দোকান লুট হচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি পা চালাতে তিনটে তোক আমার পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। আত্রেয়ী দম নিল।

তোমার পেছন পেছন? আগে হলেও কথা ছিল।

না, শরীরের জন্যে নয়। এই শাড়ির জন্যে। ততক্ষণে আমি এই গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। ওই চায়ের দোকানের লোকটা তখন না থাকলে।

চায়ের দোকান। অবনীদা! অবনীদা তোমায় দেখেছে?

ওর নাম বুঝি অবনীদা? উনি তেড়ে উঠতে লোকগুলো চলে গেল।

আমার কাছে আসছ সেটা ওকে বলেছ?

হ্যাঁ। আমি যে বাড়িটা গুলিয়ে ফেলেছিলাম।

কিছু বলেনি? হতাশ গলায় জিজ্ঞাসা করল স্বপ্নেন্দু।

কেন? অবনীদা কি তোমার গার্জেন?

তা কেন হবে?

উঃ স্বপ্ন, তুমি এখনও লোকনিন্দের ভয়ে মরছ! চলো, তোমার সংসার দেখি।

সংসার? আমার আবার সংসার কী। চাকরটা বোধহয় দেশে গিয়ে বেঁচে গেল। আর কখনও আসবে বলে মনে হয় না। এই তো দুটো ঘর। তুমি ওই ঘরটা ব্যবহার করতে পারো। পরিষ্কার আছে কিনা জানি না। কদিন তো ঝাঁট পড়েনি।

ওই ঘর ব্যবহার করবো মানে?

তুমি তো আজ রাত্রে এখানে থাকচ্ছ!

নিশ্চয়ই। কিন্তু তার জন্যে আলাদা ঘর ব্যবহার করতে হবে কেন? তুমি কি আমার সঙ্গে শোবে না? আত্রেয়ীর স্বরে বিস্ময়।

শোনো, আফটার অল তুমি মেয়ে, পরস্ত্রী।

চমৎকার। একটু আগে তোমাকে বললাম আমি আর কারো স্ত্রী নই। তোমাকে ভালবাসি বলে ছুটে এসেছি। তবু তোমার হুঁশ হল না। স্বপ্নেন্দু ভয় পেয়ো না, তোমার পাশে শুলে আমার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কোনো চান্স নেই।

আত্রেয়ী?

হি হি করে হেসে উঠলো আত্রেয়ী, রাগ করো না। এসব কথা আগে উচ্চারণ করতে লজ্জা করত। এখন একটু আধটু না হয় করি। পাগলামি ছাড়ো, এখন আমরা একসঙ্গে থাকব। জানো স্বপ্ন, আমি চিরকাল ভাবতাম মানুষ কেন মানুষকে আত্মিক ভালাবাসবে না? কেন শরীর তার অবলম্বন হবে? একটা মেয়ের ঠোঁট, বুক, পাছা, যোনির আকর্ষণে আর একটা ছেলে কুকুরের মতো পেছনে ঘুরবে কেন? ওটাকে ভালবাসা বলে? ছি! শরীরের ওইসব ক্ষণিক জাদু শেষ হয়ে যাবে, মেয়েটা ছিবড়ে হয়ে যাবে তখন ছেলেটা সেই কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে আর একটা কুকুরীর সন্ধানে ফিরবে! ভাবতেই ঘেন্নায় শরীর গুলিয়ে উঠত। যাকে বিয়ে করেছিলাম সে তো নর্দমা ঘাঁটার মতো শরীরটা খুঁড়ত। কত মাথা ঠুকেছি কিছুতেই শোনেনি। কিন্তু ঈশ্বর শুনেছিলেন। নইলে হঠাৎ সে নপুংসক হয়ে যাবে কেন? অথচ আবার সেটা ফিরে পাওয়ার জন্যে কি চেষ্টা! না পেয়ে পাগল হয়ে গেল। কার্স, কার্স! পুরুষদের ওই পাশবিক অহঙ্কার আমি সহ্য করতে পারি না। ঈশ্বর আমার মনের কথা বুঝেছেন।

স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে শুনেছিল, তুমি পুরুষদের ভালবাসতে চাওনি?

হ্যাঁ চেয়েছি। কিন্তু তাতে শরীর থাকবে না। প্লেটোনিক লাভ হলো অমর। তাতে দেহের কদর্য-ভঙ্গি থাকে না। স্বর্গীয়। এসো স্বপ্ন, আমরা সেই স্বর্গীয় প্রেমে অনন্তকাল ডুবে থাকি। তুমি আর আমি। হাত বাড়াল আত্রেয়ী।

না, তুমি যে এই হাত বাড়াচ্ছ, সেটাতেও তো দেহের প্রয়োজন হচ্ছে!

না, এই কঙ্কালের হাড়ে রক্তমাংস নেই অতএব দেহ কেন হতে যাবে?

আত্রেয়ীর দিকে তাকাল স্বপ্নেন্দু। এই মেয়েটাও কি ওর স্বামীর মতো পাগল হয়ে গেল! হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু আমি যদি অন্য কোনো মেয়েকে ভালবাসি? যদি সে আমাকে সমানভাবে চায়? হাসল আত্রেয়ী, এখন তো কেউ মেয়ে নয়। সত্যি কি কাউকে ভালবাস?

হ্যাঁ।

আমি বিশ্বাস করি না। আমি তাকে দেখতে চাই।

বেশ, দেখাব।

আত্রেয়ীর বসবার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল সে হতভম্ব হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত সে মুখ তুললো, তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ স্বপ্ন?

মোটেই না। আমি তোমাকে বন্ধু মনে করি।

আমিও তাই চাই। এখন দুজন মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের বেশি কিছু হতে পারে না। তাহলে এমন করে বলছ কেন?

এইসময় বাইরে খুব হইচই শোনা গেলো। স্বপ্নেন্দু দ্রুত জানলায় এসে দেখলো নিচের রাস্তায় উন্মত্ত কয়েকটা কঙ্কাল একটি কঙ্কালকে ধরেছে। তারপর তার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিল লোকগুলো। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারছে ওরা। স্বপ্নেন্দুর মাথা খারাপ হয়ে গেল। পাগলের মতো ছোটাছুটি করলো লোকটা। একটু আগুনের গোলা রাস্তাময় ছোটাছুটি করছে। তারপর আগুন আপনা আপনি নিভে গেলে লোকটা হো হো করে হাসল। তার হাড়ে শুধু সামান্য পোড়া দাগ ছাড়া একটুও ক্ষতি হয়নি। আক্রমণকারীরা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। এবার তারা পালিয়ে গেল যে যার মতো। আক্রান্ত লোকটি চেঁচিয়ে বলে উঠল, আমি অমর। হা হা হা মার তোরা, কত মারবি আমায় মার।

যেন কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য চোখের সামনে দেখানো হলো। স্বপ্নেন্দুর মনে হলো একবার রাস্তায় গিয়ে দেখা দরকার। দূরে চেঁচামেচি চলছে এখন। সে রেডিও খুলতেই কোনো শব্দ পেল না। আকাশ বাণী কি মৃত? স্বপ্নেন্দু আত্রেয়ীকে বললো, তুমি বসো আমি একটু দেখে আসছি কি হচ্ছে বাইরে।

আমিও যাব।

না বলতে গিয়ে থমকে গেলো স্বপ্নেন্দু। এই ঘরে আত্রেয়ীকে একা রেখে যাওয়া উচিত হবে না। টেবিলে জারের তলায় ফুলটাকে দেখতে পাবে। সে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইল না।

আত্রেয়ীকে নিয়ে বাইরে আসতেই দেখল লাঠি নিয়ে কিছু কঙ্কাল ছোটাছুটি করছে। মোড়ের কাছে আসতে সে অবাক হলো। অবনীদার দোকানে একটা কঙ্কাল বসে আছে মূর্তির মতো। তার অঙ্গে এক ফোঁটা সুতো নেই। স্বপ্নেন্দু বললো, আচ্ছা অবনীদা কোথায়?

আমিই অবনী। স্বপ্নেন্দু?

হ্যাঁ।

বাড়ি ফিরে যাও স্বপ্নেন্দু। দেখছ না মানুষ কেমন পাগল হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি চলে যাও। অবনী বললো।

কী ব্যাপার?

মানুষ জেনে গেছে এই পৃথিবী থেকে তাদের পাওয়ার কিছু নেই। অথচ তাদের অনন্তকাল অমর হয়ে থাকতে হবে। এমন কি আগুনও তাদের দগ্ধ করছে না। সবাই এই দশা থেকে মুক্তি চায় সবাই চিতায় শুতে চায় স্বপ্নেন্দু।

সবাই?

হ্যাঁ। আমি তো চাই। তুমি জানো না আমার স্ত্রী আজ বেরিয়ে গেছে। সে নাকি যে কোনো উপায়ে আত্মহত্যা করবেই। কত বললাম তবু গেল।

আপনি বাধা দিলেন না?

কী হবে দিয়ে! ওরা আমার লুঙ্গিটাকে খুলে নিয়ে গেল। এই যে উদোম হয়ে বসে আছি খারাপ লাগছে না কিন্তু। বেশ হাওয়া চলছে শরীরে। যাওয়ার সময় আমার ছোটো ছেলেটা বলল মায়ের সঙ্গে থাকবে। জানো, সে বলল মায়ের সঙ্গে? সব নষ্ট হয়ে গেছে, সব সম্পর্ক, কিন্তু স্বপ্নেন্দু শিশুরা এখন মাকে মা বলে জানে।

অবনীদা বললেন, আর দাঁড়িয়ে থেকো না। তোমার সঙ্গে মহিলা আছেন। ওঁর শাড়ি খুলে নেবে ওরা।

কিন্তু পুলিশ নেই?

না। এখন কিছুই নেই। সবাই লুঠ করতে নেমেছে। কারণ লুঠ করলে যদি খুন হয়ে যায় তাহলে বেঁচে যাবে। এই মৃত্যুর নাম জীবন।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress