রেকাবে পোড়া পাউরুটি
না, ডোবাবে না।
অনুপম টেবিলে রাখা রেকাবে পোড়া পাউরুটি আর পেঁয়াজ-লঙ্কা-ডিমের একটা ঘন্টর দিকে তাকিয়ে আপন মনে মাথা নাড়ল। বারো হাজার টাকা এবার সে যথার্থ একটা ভাল কাজে লাগাবে। একটা প্রাণ…একটা পরিবার যদি তাতে রক্ষা পায়।
আপনি খাচ্ছেন না যে? পঞ্চি ভয়ে ভয়ে রেকাবের দিকে তাকিয়ে কুণ্ঠিত স্বরে বলল।
হ্যাঁ, খাচ্ছি। একটা টোস্ট তুলে অনুপম কামড় দিল। খুব ভাল হয়েছে।
উজ্জ্বল হয়ে উঠল পঞ্চির মুখ। মেসোমশাই বলে, শক্ত ঝামার মতো টোসের সঙ্গে মামলেট খেতে খুব ভাল লাগে।
অনুপম সায় দিয়ে কী একটা বলতে যাচ্ছিল তখন নীচের থেকে কেউ পঞ্চির নাম ধরে ডাকল। চেয়ার থেকে স্প্রিংয়ের মতো উঠে দাঁড়িয়েই অনুপম টলে পড়ে যাচ্ছিল। বাঁ পা তার ভার নিতে পারছে না।
কে? পঞ্চি ছুটে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে নীচে তাকাল। কাকে যেন অপেক্ষা করতে বলেই ফিরে এসে সিঁড়ির দিকে এগোল।
শোনো। অনুপমের ভীত তীক্ষ্ণ স্বরে পঞ্চি থমকে অবাক হয়ে তাকাল। কে এসেছে?
পাশের বাড়ির ছেলে তিলু। বাচ্চুর গরম জামা, দুধের কৌটো, খাওয়ার ওষুধ নিতে এসেছে।
ও কি ওপরে আসবে?।
না। সব তো নীচের ঘরে রয়েছে।
তিলুকে দিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে দেবে।
পঞ্চি নেমে যাওয়ার পর অনুপমের খাওয়ার ইচ্ছাটা মরে গেল। রাতের ভয়। দিনের আলোয় যেন আরও বেশি করে তাকে পেয়ে বসছে। খবরের কাগজটা একই ভাবে পড়ে আছে। হাত বাড়িয়েও সে টেনে নিল।
ভাঁজ করা প্রথম পাতায় একটা চার কলাম ছবির খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। পাঁজাকোলা করে একটা লোককে একজন নিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা আর বাঁ হাতটা ঝুলছে। চোখ বন্ধ। পেছনে আবছা ভিড়। তবু বোেঝা যাচ্ছে একটা ছেলে ইট ছুড়ছে। হেলমেট পরা পুলিশ একটা লাঠি উঁচিয়ে ছুটে যাচ্ছে। আকাশের দিকে পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া।
ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অনুপম। এসব তারই সৃষ্টি। যে লোকটাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে কি মৃত? ইট, লাঠি, আগুন বের করে আনল একটা খেলা! দোষটা কি খেলারই, না কি যারা খেলে আর খেলায়, তারাই আসল অপরাধী?
আপনি খাবেন না? পঞ্চি উঠে এসেছে।
না। জ্বর জ্বর লাগছে। পায়ের ব্যথাটা যেন আরও বেড়েছে। তুমি আমাকে এক ডেকচি জল গরম করে দাও আর ফ্রিজ থেকে বরফ দাও।…আর শোনো। অনুপম ইতস্তত করে বলল, কেউ এলে যেন বোলো না আমি এখানে আছি। সদর গেট সব সময় বন্ধ করে রাখবে।
মাসিমাও তাই বলে গেছে। জানেন আমাদের এখানে ছেলেধরা বেরিয়েছে! হ্যাঁ সত্যি! আমাদের গাঁদালপাড়ায়, যেখানে আমাদের বাড়ি, পরশু সেখানে অবনীকাকার ছেলে পল্টুকে, ছ বছর বয়স, একটা লোক ডেকে, ফুল নেবে ফুল বলে একটা লাল ফুল দিল। পল্টু ফুলটা শুকেই অজ্ঞান হয়ে যায়, তখন ওখান দিয়ে পল্টুর জেঠি যাচ্ছিলেন, তিনি ওকে শুয়ে থাকতে দেখে চেঁচিয়ে ওঠেন। তখন লোকটা একটা সাইকেলে চড়ে পোঁ পোঁ করে আমাদের এইদিক দিয়ে পালায়। আচ্ছা, ওরা নাকি বাচ্চাদের ধরে নিয়ে গিয়ে রক্ত চুষে খায়, সত্যি?
সত্যি।
তা হলে তো বাচ্চুকে সাবধানে চোখে চোখে রাখতে হবে! পঞ্চি দায়িত্বের ভারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
সেই জন্যই তো বলছি সদর মোটেই খোলা রাখবে না। নীচে কেউ নেই, চোর টোর ঢুকেও চুরি করতে পারে। তা ছাড়া আমি এখন তো খোঁড়া, ছেলেধরা এলে কিছুই করতে পারব না।
এত কথা বলার পর অনুপমের মনে হল পঞ্চির মনে কৌতূহল জাগাবার মতো কোনও কথা কি সে বলে ফেলেছে? বোলো না আমি এখানে আছিটা একটা সন্দেহ জাগাবার মতোই কথা। এর অর্থ, লুকিয়ে রয়েছি। তবে রক্ষে, মেয়েটা মোটেই চালাক-চতুর নয়। ওকে একটু খুশি রাখা দরকার।
অনুপম পোড়া টোস্টের ওপর চামচ দিয়ে ডিম তুলতে তুলতে বলল, খেয়েই ফেলি, এত সুন্দর লাগল না। তুমি গরম জল আর বরফ এনে দাও।
নীচে থেকে আবার তিলুর গলা পাওয়া গেল। পঞ্চি নেমে গেল। অনুপম চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। সার দিয়ে মুখগুলো ভেসে আসছে রবিদা, বউদি-মণি, বাচ্চু—সেই ছেলেটা, চার বছর আগে অটোগ্রাফ নিতে আসা ছেলেটা, রোগাটে লম্বা মুখ, পাতাকাটা চুল কপালে ঝুলে, ঘন চোখের মণি দুটো বড় বড় চোখ জুড়ে অবাক, সরল আর আহত চাউনি। দলাপাকানো হ্যান্ডবিলটা ঠিক কপালে—অনুপম সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বজ্রাহত হল। তারপর চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে দু হাত ঠকঠকিয়ে কেঁপে উঠল।
দেখুন না, এই লোকটা আমার কথা শুনল না, ওপরে উঠে এল। আমি পইপই বললুম বাড়িতে এখন কেউ নেই।
পঞ্চির অনুযোগ, কৈফিয়ত কিছুই ঢুকল না অনুপমের কানে। সে তার সামনে সাক্ষাৎ নিয়তিকে যেন দেখতে পাচ্ছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু গলা দিয়ে স্পষ্ট কোনও কথা বেরোল না।
খুব অবাক হয়ে গেছিস তাই না? পানের ছোপধরা দাঁতগুলো বেরিয়ে এল। সুপ্রিয় গুপ্ত হাসছে।
তুমি এখানে! জানলে কী করে?
রেকাবির দিকে তাকিয়ে সুপ্রিয় প্রশ্নটা অগ্রাহ্য করে বলল, খাচ্ছিলি
? না, খিদে নেই। জ্বর জ্বর লাগছে।
তা হলে আমি খেয়ে নিচ্ছি। খুকি এক গ্লাস জল দাও তো।
সুপ্রিয় চেয়ারে বসে ঠাণ্ডা টোস্ট আর ওমলেট মুখের মধ্যে গুঁজে চিবোতে চিবোতে আবার চোখ বুঝল।
খুব ভোরে বেরিয়েছি, কিছু খাওয়া হয়নি, দাঁত পর্যন্ত মাজা হয়নি।
স্বয়ং শিব এসে তার সামনে দাঁড়ালে অনুপম এত অবাক হত না। কী ভাবে জানল সুপ্রিয়! একমাত্র দুলোদা ছাড়া আর কেউ জানে না সে কোথায় এসে উঠেছে। তেঁতুলতলার একটা রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গেছে, রবিদার বাড়িটাও দুলোদা জানে না। তা হলে আর কার কাছ থেকে জানল? কখনও কারও কাছে সে তো রবিদা বা তেঁতুলতলার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি।
কী ভাবছিস। কেমন করে খোঁজটা পেলুম? সুপ্রিয় খালি জলের গ্লাস পঞ্চির হাতে দিয়ে বলল, আর এক গ্লাস।
অনুপম মাথাটা নাড়ল।
ওসব জেনে তোর আর এখন কী লাভ হবে। এখানে পালিয়ে এসে ভালই করেছিস, কাল তোর ফ্ল্যাটে বিরাট ভাঙচুর হয়েছে। জিনিসপত্তর ভেঙে ছড়িয়ে লণ্ডভণ্ড করে, তোর চাকরটাকে পিটিয়ে আধমরা করে দিয়েছে। এখন সে হাসপাতালে। তোকে যদি পেত ওরা—
ওরা কে?
এবার সুপ্রিয়র অবাক হওয়ার পালা। সে পিটপিট করে অনুপমকে কয়েক সেকেন্ড নিরীক্ষণ করে বলল, সেই তারাই, যাদের সম্পর্কে বলেছিলাম—গোল দিয়ে ট্রফি নিতে না পারলে তোকে ছিঁড়ে খাবে।
তুমি এখানে কী করতে এসেছ? কথাটা সুপ্রিয়কে বলে অনুপম কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চির দিকে তাকাল।
আপনার গরম জল আর বরফ—
থাক, লাগবে না এখন, তুমি যাও।
সুপ্রিয় গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর হয়ে উঠল। অনুপম তার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি কাটাতে চুলের মধ্যে আঙুল ঢোকাল।
তোর আজকের এই অবস্থায় পৌঁছোনোটা একদিনে হয়নি। ধাপেধাপে হয়েছে। তুই ভাল খেলে নাম করেছিস, তোকে নিয়ে এ-ক্লাব ও-ক্লাব টানাটানি করেছে, তোর দরও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, চল্লিশ হাজার থেকে আজ দু লাখে…কিন্তু তুই দারুণ ভাবে বদলে গেলি।
তোমরাই আমাকে বদলে দিয়েছ।
কী ভাবে?
আমার সম্পর্কে এমন ভাবে লিখতে শুরু করলে যেন ভারতে আমার মতো ফুটবলার আগে কখনও জন্মায়নি। ভারতের জিকো কলকাতার প্লাতিনি এসব তোমাদেরই দেওয়া টাইটেল। আমি স্বীকার করছি— অনুপম থেমে গেল সুপ্রিয়কে পকেট থেকে নোটবই বের করতে দেখে।
বলে যা।
স্বীকার করছি এসব বিশেষণ আমার ভাল লেগেছিল। চারদিকে তখন ভক্ত, যেখানে যাই সবাই আমার দিকে তাকায়, কথা বলতে চায়, বিশেষ ভাবে খাতির দেখায়। এসব আমার ভাল লাগত। সুপ্রিয়দা, এইসঙ্গে আমার বয়সটার কথাও মনে রাখবেন, তা ছাড়া লেখাপড়াও তো বিশেষ করিনি, স্কুল ফাইনালটা কলকাতায় এসে পাশ করেছি, কিন্তু কী ভাবে করেছি সেটা না বলাই ভাল। পড়তে আমার একদমই ভাল লাগে না, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিনের হেডিং আর ছবি দেখে রেখে দিই..হ্যাঁ, সিনেমার খবর পড়ি।
অনুপম কথাগুলো টানা বলে গেল যেন মহলা দেওয়াই ছিল। বলতে তার ভাল লাগল। সুপ্রিয়র ডটপেন নোটবইয়ে দ্রুত সরছে। মুখ ঘুরিয়ে অনুপম বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকাল। অটো রিকশা চলে যাওয়ার আর দূর থেকে বাসের হর্নের শব্দ ছাড়া শ্রবণকে আঘাত করার মতো আর কিছু এখানে নেই।
আমাকে প্রভাবিত করেছিল আপনাদের স্তাবকতা। আপনারা প্রভাবিত করেছিলেন ফুটবলপাগল মানুষদের। তাদের কাছে আমাকে রাজপুত্র বানিয়ে ঠেলে দিয়েছিলেন, রূপকথার রাজপুত্র। মানুষ তো রূপকথা ভালবাসে, তাই তারা আমাকে লুফে নিয়েছিল। তারা আপনাদের কাগজ কেনে আমার সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানতে, আমার কথা শুনতে, আমাকে তারা বীর হিসেবে দেখতে চায় আর আপনারা তাই দেখাবার জন্য লিখতেন।….
কেন? আপনাদের কাগজের বিক্রি বাড়াবার জন্য। আমি নিজের ফাঁদে নিজেই পড়ে গেলাম,…নিজেকে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখার ফাঁদ। আমার সম্পর্কে প্রশংসা করে, গুণ গেয়ে যা নই তার থেকেও বড় করে দেখিয়ে প্রচুর মিথ্যে কথা যখন লিখেছেন তখন আমি তার প্রতিবাদ করিনি, চুপচাপ সেসব মেনে নিয়েছি কেননা মিথ্যে কথাগুলো, ভানগুলো আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে।
কিন্তু অনেকে তোর বিরুদ্ধে লিখেছে, কড়া কথা বলেছে।
হ্যাঁ। লিখেছে, বলেছে আর তাতে আমি বিরক্ত হয়েছি, রেগেও গেছি। আমার মেজাজ, ব্যবহার সব সময় স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে না, অনুপমের চোখে ভেসে উঠল, অবাক দুটি সরল চোখের ওপরে লেগে একটা পাকানো হ্যান্ডবিলের ছিটকে যাওয়ার ছবিটা।
কেন থাকে না তা আমি জানি না, সত্যি বলছি সুপ্রিয়দা, তা আমি জানি না। সতেরো বছর বয়সে গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছিলাম খেলতে। অমানুষিক পরিশ্রম করে, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, অপমান ঠেলে ওপরে উঠেছি।
তখন অনেকেই তোকে সাহায্য করেছিল কিন্তু পরে তুই তাদের ভুলে গেছিস।
অনুপম চুপ করে রইল।
তোর দেশের বাড়িতে একবার গেছলাম। দেখেছি তোরা কত গরিব ছিলিস, তোর বাবা-মা কত কষ্ট করতেন, আজও করেন। তুই ওঁদের নিয়ে এসে কলকাতায় নিজের কাছে রাখতে পারতিস, কিন্তু তা করিসনি। শেষ বয়সে তা হলে ওঁরা একটু সুখের মুখ দেখতেন।
আমি আনতে চেয়েছিলাম সুপ্রিয়দা, কিন্তু বাড়ি ছেড়ে ওঁরা আসতে রাজি হননি।
মিথ্যে কথা বলিসনি, অনুপম, তুই আনতে চাসনি। মাসে মাসে টাকা পাঠিয়েছিস ঠিকই, কিন্তু নিজের অতীতকে তুই এড়িয়ে যেতে চেয়েছিস। আধুনিক, দ্রুতগতির জীবন তোর ভাল লেগে গেছল। সেখানে গ্রামের মানুষরা মিসফিট, বেমানান। তাদের মানসিক ধারা থেকে তুই নিজেকে ছিঁড়ে বের করে নিয়ে যেতে গিয়েই তুই, আমার মনে হয়, বিপত্তি ঘটিয়েছিস। তোর কী মনে হয়?
তুমি কী উদ্দেশ্যে এমন সময়ে এখানে এসেছ? এই সব কথা বলার জন্য?
মনে পড়ে, কাল কী বলেছি তোকে? তোর উত্থান দেখেছি, পতনটাও খুব কাছ থেকে দেখতে চাই। বড় তাড়াতাড়ি তুই পড়ে গেলি। হাবিবকে দেখেছিস? হায়দরাবাদ থেকে তোর মতো বয়সেই কলকাতায় এসে কত বছর ধরে খেলে কত নাম কত টাকা করে গেল। বাঙালি ছেলেরা কোথায় দুর্বল, কোথায় পিছলে যায়, আমি সেটাই জানতে চাই বলে সাবজেক্ট হিসেবে তোকে বেছে নিয়েছি। তোকে নিয়ে লিখব।
অনুপম পাংশু মুখে উঠে দাঁড়াল। সুপ্রিয় জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে হাত নেড়ে বসতে ইঙ্গিত করল।
যাচ্ছিস কোথায়? বারান্দায় কি জানলায় এখন যাসনি। এই বাড়ি খুঁজে বের করতে বাস থেকে নেমে অনেক লোককে জিজ্ঞেস করেছি। রবিদা নামটা আর চার বছর আগে তার বাড়িতে এসেছিলি, এইটুকু ইনফরমেশন শুধু সম্বল। তোর নাম করে আমি যা গালাগাল শুনলাম সেটা কাল সারথির টেন্টের সামনেও শুনেছি। এখানকার লোক যদি একবার জানতে পারে—।
অনুপম চেয়ারে বসে পড়ল। নীচের দরজাটা পঞ্চি বন্ধ করেছে কি না, সুপ্রিয়র সামনে তা জিজ্ঞেস করলে ভয় পেয়ে গেছে ভাবতে পারে। সে তাচ্ছিল্যভরে বলল, জানলে কী আর হবে, দল বেঁধে এসে মারবে?..পিটিয়ে মেরে ফেলবে?
এখন তো দল বেঁধে পিটিয়ে মারাই হয়। এ-রাজ্যে এটাই তো এখন টপমোস্ট
ফেবারিট গেম। কাগজে দেখিস না, ডাকাত সন্দেহে, ছেলেধরা সন্দেহে গেরস্থ ভালমানুষরাও পাঁচজনে মিলে খুন করছে প্রকাশ্যে আর গণপ্রহার বলে খুন করার দায় থেকে হাত ঝেড়ে ফেলছে। দশ-বারোটা লোক যে-কোনও ছুতোয় তোকে দিনদুপুরে বড় রাস্তায় হাজার লোকের সামনে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে, একজনও বাধা দেবে না। আজকের কাগজগুলো পড়েছিস?
টেবিলে পড়ে থাকা প্রভাতী সংবাদটার দিকে সুপ্রিয় তাকাল। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে ভাঁজ খুলে প্রথম পাতায় চোখ রেখে বলল, প্রত্যেকটা কাগজে লিখেছে তুই আজ এত বাজে না খেললে, টাই ব্রেকারের পেনাল্টিটা মিস না করলে এত কিছু ঘটত না। এগারোটা লোক মারা গেছে
এগারো! আটটা নয়?
মাঠেই আট, হাসপাতালে আরও তিন। মরার মতো অবস্থায় চারজন, সিরিয়াস আহত, মানে হাসপাতালে অ্যাডমিটেড সাতাশজন, তার মধ্যে তোর চাকরটাও রয়েছে। লুটপাট, আগুন, রেড রোড আর ধর্মতলায় মোটর গাড়ির কাচভাঙা, এসব তো আছেই। এসব ঘটনায় তোর রিঅ্যাকশান জানতে কাল তোকে গোরু-খোঁজা খুঁজেছি। সহদেব মালি বলল, তোকে গাড়িতে করে নিয়ে গেছে দুলাল শীল।
তা হলে দুলোদা তোমায় বলল আমি এখানে!
সুপ্রিয়র মুখে কুটিল একটা ফিকে হাসি খেলে গেল। সে হ্যাঁ বা না, কিছুই বলল না।
দুলোদা বলে দিল? অনুপম নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। ক্লাবে তার সবচেয়ে বড় হিতৈষী বলে যাকে সে জানে, অভিভাবকের মতো যার কথা শুনে চলে, যাকে কমিটিতে আনার জন্য সে ক্লাব পলিটিক্সে মাথা গলিয়ে শত্রু বাড়িয়েছে, শেষকালে সেই লোকই কিনা তাকে বিপদে ঠেলে দিল তার হদিস বলে দিয়ে!
সে কি চিৎকার করে উঠবে? সে কি চোখের জল মুক্ত করে দেবে? সে কি কলকাতায় ছুটে গিয়ে দুলালচাঁদের গলা টিপে ধরবে? অনুপম ডান হাতের তালুতে চোখ ঢাকল।
ওর গাড়িতে তোর পকেট থেকে ঘড়িটা পড়ে গেছল, পাঠিয়ে দিয়েছে। নে ধর।
অনুপম হাত বাড়াল। সুপ্রিয় ঘড়িটা টেবিলে রাখল।
জীবনে অনেক কিছু তোর শেখার বাকি।
কিন্তু কেন?
আমার যতদূর মনে হয়, যা ঘটে গেল এর পর সারথি তোকে আর রাখবে না। এখন ছেড়া ন্যাকড়ার মতো তোকে ফেলে দেবে। কাল তোকে নামিয়ে দিয়ে দুলাল শীল সোজা গেছল বারিন দত্তর বাড়ি। দুজনে হাতে হাত মিলিয়েছে। ওদেরও তো বাঁচতে হবে। শুধু তোকে আগলে, বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে তো দুলাল নিজের আখের খোয়াতে পারে না। তোকে দিয়ে যতটা পাওয়ার তা পাওয়া হয়ে গেছে, এখন তুই একটা বোঝা।
এসব কি তুমি লিখবে?
না। এরা হচ্ছে আমার খবর পাওয়ার সূত্র, আমার ওপর এদের আস্থাটা নষ্ট করব কেন? আমাকে বিশ্বাস করে বারিন দত্ত গত বছরই বলেছিল লিগে কটা ম্যাচ সারথি কিনেছে, কিন্তু আমি লিখিনি। তুই কি জানিস, কে. এস. টি-র সঙ্গে সেমিফাইনাল ম্যাচটাও কেনা ছিল?
অনুপম চুপ করে তাকিয়ে রইল। সে জানে। দুলোদা আগের দিনই তাকে জানিয়ে দিয়েছিল। শোনা মাত্র বুকের মধ্যে একটা বরফের চাঁই নেমে এসেছিল। সোজাসুজি খেলে ম্যাচ জেতবার ক্ষমতা আর তার নেই। অথচ সবার চোখে সে বড় ফুটবলার হয়ে রয়েছে। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠেছিল। অপমানে, না হীনতাবোধে, সে ঠিক বুঝতে পারেনি।
অনুপম, সারথি তোকে ছেড়ে দিলে যাবি কোথায়?
সুপ্রিয়র ডটপেন অপেক্ষা করছে উত্তরের জন্য। অনুপম এমন একটা প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না। আরও দুটো সিজন পরে সে এটা নিয়ে হয়তো ভাবত। এখনও তার যা খেলা রয়েছে তাতে কলকাতার মাঠে তার দাম পড়বে না।
অন্য ক্লাব তোকে নেবে কি না জানি না, নিলেও পঞ্চাশ-ষাট হাজারের বেশি দেবে না।
এসব নিয়ে আমি এখন কিছু ভাবতে রাজি নই।
হ্যাঁ, এখন তো প্রাণ বাঁচানোটাই সবার আগে। এখানে কত দিন লুকিয়ে থাকবি?
জানি না। রবিদা আসুক.নীচের এক ভদ্রলোক কাল রাতে ফেরেননি
জানি, এখানকার একজনের মুখেই শুনলাম। কাল খেলা দেখতে গিয়ে আর ফেরেনি। এখানে ধারণা, গোলমালের মধ্যে পড়ে লোকটা হয় মারা গেছে নয়তো গেছে হাসপাতালে। তোকেই এজন্য দায়ী করছে। আর কী আশ্চর্য, শেষকালে তুইই কিনা এই বাড়িতে!
সুপ্রিয়া প্লিজ, এখন এই আলোচনা বন্ধ করুন। আমার পায়ে এখন সেঁক দিতে হবে, বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।
কী ভাবে লাগল! কোথায়, দেখি? সুপ্রিয় ঝুঁকে হাত বাড়াল অনুপমের পায়ের দিকে।
থাক, থাক, তোমাকে আর পরীক্ষা করতে হবে না, এটা ফল্স নয়। সত্যি ইনজুরি।
নীচে কোলাপসিবল গেটের চাকা সরার শব্দ হল। রবিদা বলে হাঁক দিয়ে কেউ উপরে উঠে আসছে। অনুপম ছিলে-ছেড়া ধনুকের মতো উঠে দাঁড়িয়েই পাশের ঘরের পরদা সরিয়ে ঢুকে গেল। আর তখনই দুটো লোক দোতলায় উঠে এল।
রবিদা ফিরেছে নাকি রে?
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসা পঞ্চিকে লক্ষ্য করে একজন বলল।
মেসোমশাই, মাসিমা কেউ ফেরেনি, বউদিও না।
তুই একা বাড়িতে। বলেই লোকটি সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি?
আমার নাম সুপ্রিয় গুপ্ত, প্রভাতী সংবাদ থেকে আসছি। রবিবাবুর কাছে দু-একটা খবর নেব।
লোক দুটির ভ্রূ কুঁচকে মুখ থমথমে হয়ে গেল। ওদের একজন, বেঁটে, গাঁট্টাগোট্টা, বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, পরনে লুঙ্গি ও খদ্দরের পাঞ্জাবি, গম্ভীর স্বরে বলল, আপনিই সেই সুপ্রিয় গুপ্ত, যিনি সারথির মন্দ ছাড়া ভাল দিকটা দেখতেই পান না, সারথির গায়ে কাদা না মাখালে যার ভাত হজম হয় না, সারথির ভেতরের কেচ্ছা তারিয়ে তারিয়ে লেখেন।
সুপ্রিয় সরল হাসিতে মুখ ভরিয়ে শুধু তাকিয়ে রইল। এই রকম লোকের সম্মুখীন জীবনে সে বহুবার হয়েছে। সে জানে তর্ক করা বৃথা, চুপ করে মেনে নেওয়াই এখন বুদ্ধিমানের কাজ।
রবিদাকে জিজ্ঞেস করে আবার কী খবর নেবেন? উনি তো খেলেন না, খেলে ওঁর ভাই অনুপম। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।
অন্যজন, আরও কমবয়সি, কর্কশ স্বরে প্রায় ধমক দিয়ে তার মেজাজের অবস্থাটা জানিয়ে রাখল।
তাকে তো পাচ্ছি না বলেই রবিবাবুর কাছে এলাম। শুনেছি এককালে উনি অনুপমদের গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন, ওকে বাল্যকাল থেকে দেখেছেন, ওর সম্পর্কে জানেনও অনেক কিছু।সুপ্রিয়র কোমল বিনীত কণ্ঠ আবহাওয়াকে আর তপ্ত হতে দিল না।
এখন অনুপমকে নিয়ে লেখার এটাই কি সময়? আপনার আক্কেলকে বলিহারি? ক্লাবটাকে ডুবিয়ে আজ পথে বসাল যে–
অনুপমের প্রশংসা করব বলে তো এখানে আসিনি। সারথি সত্যিই ডুবেছে। এবার তাকে টেনে তুলতে হলে বোঝা কমাতে হবে। সবচেয়ে বড় বোঝা এখন অনুপম আর তার মতো প্লেয়াররা, ঠিক কি না?
আলবাত। আগে ওটাকে তাড়ানো দরকার।
আপনারাই তো লিখে লিখে একটা পাঁঠাকে সিংহ বানিয়েছেন। মশাই এখন পেলে ওকে বলি দিয়ে কোর্মা বানিয়ে খেতুম।
সুপ্রিয় মুখে স্মিত হাসি লাগিয়েই রেখেছিল, শুধু ওদের কথা শুনতে শুনতে সেটাকে ছোট বড় করে নিচ্ছিল। নিজের দিক থেকে আক্রোশটা অনুপমের দিকে ঘুরে গেছে বুঝে সে মাতব্বরি ঢঙে বলল, ক্লাবটা তো এক দিনে ডোবেনি, তেমনই তুলে ভাসানোটাও একদিনে সম্ভব নয়। লিগে যতটা করা যায় তা আমি করব কিন্তু মেম্বাররা, হিতৈষীরা যদি এগিয়ে না আসেন তা হলে হাজার লিখেও কিসসু করা যাবে না। আপনারাই পারেন সারথিকে বাঁচাতে। এগিয়ে আসুন, প্রেসার দিন কমিটি মেম্বারদের, নানান জায়গায় মিটিং করুন।
তাই করতে হবে এবার। বেঁটে লোকটা ঘড়ি দেখল। রবিদারা এখনও যখন আসেনি, তার মানে সিরিয়াস কিছু হয়েছে। আপনি আর কতক্ষণ বসে থাকবেন?
দূর থেকে আসছি, দেখি আরও কিছুক্ষণ।
লোক দুটি নীচে নামার পর গেট বন্ধ করার শব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করে সুপ্রিয় ডাকল, বেরিয়ে আয়।
অনুপমের মুখ এই কয়েক মিনিটেই বসে গিয়ে চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। প্রবল তৃষ্ণার্তের মতো চাহনি। দরজার পরদা ধরে সে নিজেকে খাড়া রেখেছে।
এখানে আর তোর থাকা উচিত নয়। নীচের লোকটার যদি খারাপ কিছু হয় তা হলে তুই খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ে যাবি।
কিন্তু এখন আমি যাব কোথায়? কীভাবেই বা এখান থেকে বেরোব?
সুপ্রিয় মাথা নামিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল, দুটো থেকে আড়াইটের, না সাড়ে তিনটের সময় আমি গাড়ি নিয়ে আসব। আসা মাত্র উঠে পড়বি।
কোথায় যাব?
তুই বল কোথায় যাবি, পৌঁছে দেব।
কলকাতায় যাব না…দেশের বাড়িতে যাব।
সেই ভাল।
সুপ্রিয় গুপ্ত কোনও বিদায় না জানিয়ে দ্রুত নেমে গেল। অনুপম সিড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল, ওর সঙ্গে যাওয়াটা কি উচিত হবে? লোকটা কোনও বজ্জাতি করবে না তো! নানান ধরনের বিপদের কথা তার মনে আনাগোনা করতে লাগল। তারপর ভাবল, যা থাকে কপালে! দেখাই যাক না কী হয়! এইভাবে নিজেকে নিজে কয়েদ করে কত দিন চলা যায়!
পঞ্চি এসে দাঁড়াল। গরম জল আর বরফ দোব?
সারা বাড়ির কর্তী হওয়ার সুযোগ পেয়ে ওর কর্মতৎপরতা বেড়ে গেছে।
না থাক। আমার জ্বরটা কম লাগছে, খিদেও পাচ্ছে। ভাত খাব। কাল বউদি বলল, তোমার হাতের রান্না নাকি খুব ভাল।
খুশিতে আনন্দে পঞ্চির মুখ থেকে কথা সরল না। অনুপম গত চব্বিশ ঘণ্টায় এই প্রথম হৃদয়ের গভীরে একটা শান্ত সুখ অনুভব করল মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে।
আড়াইটে থেকেই অনুপম উৎকর্ণ হয়ে দালানে বসে অপেক্ষা করছে। পঞ্চি ঘরের মধ্যে মেঝেয় ঘুমোচ্ছে। ঘড়িতে দেখল তিনটে বেজে পাঁচ। উঠে গিয়ে সন্তর্পণে মুখটা জানলার কাছে নিয়ে তাকাল। একটা কাঁঠাল গাছ দৃষ্টির অনেকটা আড়াল করে থাকলেও রাস্তার কিছু অংশ দেখতে পেল। জনপ্রাণী নেই।
সে আবার এসে চেয়ারে বসল। কলকাতায় গিয়ে গাড়ি জোগাড় করে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসা কি সম্ভব? গাড়িই বা পাবে কোত্থেকে, সুপ্রিয়র নিজের তো গাড়ি নেই!
তা হলে কি দুলোদার কাছ থেকে চেয়ে আনবে! অসম্ভব, ওই লোকটার কোনও দয়া সে নেবে না। যদি দুলোদার গাড়ি নিয়ে আসে তা হলে সে যেতে অস্বীকার করবে। গত বছর সে একদিন তাই করেছিল, তবে প্রবল ঘৃণায় নয়, প্রচণ্ড রাগে।
.
সারথি কোচ বদল করে নতুন কাউকে আনবে এটা গত বছর সিজনের আগেই কমিটি ঠিক করে। একটার পর একটা টুর্নামেন্ট হেরে, লিগ চ্যাম্পিয়নশিপে চতুর্থ হওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত অবধারিতই ছিল। টিম নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য বাড়তি বাজেটও বরাদ্দ হয়।
তা ছাড়া রোভার্স কাপের সেমি ফাইনালে লিডার্স ক্লাবের কাছে ৩-০ হারের পর অনুপমের যে ইন্টারভিউটা প্রভাতী সংবাদে বেরোয়, সেটা নিয়েও কমিটিতে কথা হয়। তাতে অনুপম বলেছিল, সারথি এখন ভরে গেছে অযোগ্যদের ভিড়ে। কেউই কন্ডিশনে ছিল না, দুজন ভাইটাল প্লেয়ার ইনজুরির কথা চেপে গিয়ে খেলতে গিয়েছিল। টিমকে তারাই ডুবিয়েছে, আর আমার বিরুদ্ধে এখন তারাই বলে বেড়াচ্ছে। সিনসিয়ার ছিলাম না।
ক্লাবে তো বটেই, বাইরেও সমর্থকদের মধ্যে এই ইন্টারভিউটা নিয়ে তোলপাড় হয়। টিমের মধ্যেও প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয়। অনুপম কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। দুলোদার গাড়িতে সেদিন একটা বউভাতের নিমন্ত্রণে যাচ্ছিল। দুলোদা তখনই তাকে বলেছিল, তোর জন্য টিম স্পিরিট সাফার করছে। কেন তুই সুপ্রিয়কে ইন্টারভিউ দিতে গেলি। মুখ বন্ধ করে থাকতে পারিস না? ক্লাব সম্পর্কে তুই সিনসিয়ার ঠিকই, কিন্তু নিজের প্রতি তুই ইনসিনসিয়ার। তোর খেলা দেখে বোঝা যায় এখন আর তুই খাটিস না, প্র্যাকটিসে মন নেই।
অনুপম প্রতিবাদ করে বলেছিল, এইসব রদ্দি লোকের সঙ্গে খেলে খেলে আমি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছি।
আগে তুই একাই খেলা দিয়ে এদের ঘাটতি পুষিয়ে দিতিস, টিমকে টেনে নিয়ে যেতিস। কিন্তু এখন আর তা পারছিস না। ভাল প্লেয়ার কলকাতায় আর কোথায়, উঠে আসছে কই? এইসব রদ্দি লোক দিয়েই কাজ চালাতে হবে। তুই এদের মধ্যে মিসফিট, এখন তোকেই মাঠে ফালতু বলে মনে হয়। তোর খেলা এরা বোঝে না, তোকে একটা বল দিতে পারে না, তোর কাছ থেকে নিতেও পারে না।
অল্পবয়সি কিছু ভাল ছেলেকে এবার আনুন, আমি তৈরি করে নেব। আমি কোচ করব। এই হেমন্ত সেনকে দিয়ে আর চলে না।
অ্যাাঁ, তুই কোচ করবি! দুলোদা এমন মুখভাব করল যেন সারথির জার্সি পরে রোসি বা জিকোকে মাঠে নামতে দেখছে। হ্যাঁ, কোচ এবার বদলাবার কথা উঠেছে। যে টিমে ট্যালেন্ট নেই সেই টিমকে অন্যভাবে কোচ করে খেলাতে হয়। ছেষট্টির ইংল্যান্ডের ববি মুর, ববি চার্লটন আর ব্যাঙ্কস ছাড়া ছিলটা কী, অথচ ওয়ার্লড চ্যাম্পিয়ান হল! স্কিল, ইমাজিনেশন, ফ্লেয়ার এ সবের ঘাটতি এনডিওরেন্স আর স্ট্যামিনা দিয়ে পোষাতে হয়। অবিরাম বলের পেছনে তাড়া করে গেলেও সেটা ফল দেয়।
তাকে কি তুমি ফুটবল খেলা বলবে?
আমার দরকার ম্যাচ জেতা, ট্রফি আনা। যদি হামা দিয়ে খেলে ম্যাচ জেতা যায়, তা হলে আমি হামাই দেব। আর্টিস্টিক, অ্যাটাকিং ফুটবল খেলব, যখন অমন করে খেলার মতো ট্যালেন্ট পাব। ছক কেটে অঙ্কের মতো করে এবার সারথি খেলবে। নতুন কোচ ভাবা হচ্ছে সুজিত ঘোষকে। প্রস্তাবটা আমারই।
অনুপম চিৎকার করে বলে উঠেছিল, সুজিত ঘোষকে তুমি আনছ…তুমি? গাড়ি থামাও।
অবাক হয়ে দুলালচাঁদ ব্রেক কষে। গাড়ি থেকে নেমে অনুপম বলেছিল, সুজিত ঘোষকে যে লোক সারথিতে আনতে চায় তার গাড়িতে আমি চড়ব না।
আগের বছর কলম্বােয় এশিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপের জোনাল প্রতিযোগিতায় ভারতের কোচ সুজিত ঘোষ দুটো খেলায় থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনুপমকে নামায়নি।
দুলালচাঁদের গাড়িতে তাকে প্রাণ বাঁচাতে তেঁতুলতলায় আসতে হল। কিন্তু এখান থেকে যেতেও হবে কি ওর গাড়িতে?
.
মোটরের ইঞ্জিনের আওয়াজ যেন শুনতে পাচ্ছে। অনুপম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।
হ্যাঁ, গাড়িরই। সে বারান্দায় গিয়ে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করল। একটা কালো পুরনো অ্যাম্বাসাডারের বনেটের একধার, হেডলাইট আর সামনের দরজাটা দেখেই সে পিছিয়ে এল। দুলোদার গাড়ি এটা নয়। সুপ্রিয় তা হলে অন্য কারও গাড়ি এনেছে।
পঞ্চিকে ঘুম থেকে তুলে বলে যাবে কি না, অনুপম ভাবল। দরকার নেই। যেমন আচমকা এসেছি তেমনভাবেই চলে যাচ্ছি। কেউ কিছু মনে করবে না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে প্রদীপ হালদারের বন্ধ দরজাটার সামনে থমকাল। তালা ঝুলছে। ঘুরে সদরের দিকে এগোতে গিয়ে সে আর পা বাড়াতে পারল না।
গাড়ি থেকে নেমে রবিদা আর বউদি এগিয়ে আসছে। যুবক আর একজন, এই বোধ হয় সন্তু, পাশের বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। কোলাপসিবল লোহার ফাঁক দিয়ে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে শুভ না অশুভ, সেই খবরটা জানার চেষ্টা করল। ঝুঁকে পড়া, বিধ্বস্ত, ক্লান্ত শরীর, উদ্বেগে ঝলসানো রাতজাগা চোখ, রুক্ষ চুল, পায়ে যেন লোহার জুতো পরা।
ধীর পায়ে এগিয়ে অনুপমই গেট খুলে দিল। ওরা দুজন স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে। রবিদা নিশ্চয়ই শুনেছে সে কাল রাতে এখানে এসেছে—তাই কোনও বিস্ময় ফুটল না। অনুপমের চোখে বিহ্বলতা দেখে রবিদা শান্ত স্বরে বলল, শ্মশান থেকে আসছি, ওপরে আয়।
দোতলায় উঠে এসে চেয়ারে বসে শরীর এলিয়ে দিয়ে রবিদা অস্ফুটে আহহ বলে চোখ বন্ধ করল। অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে অনুপমকে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, বোস। রাতেই এসেছিস। কাল রাত থেকে ছোটাছুটি চলছে। বউমার বাপের বাড়ি বেহালায় গেলাম। অত রাতে বাড়ি খোঁজাও এক দুর্ভোগ, তারপর আবার এলাম এখানে, তোর বউদি আর বউমাকে নিয়ে যেতে। হাসপাতাল, ডাক্তাররা অবশ্য খুব হেল করেছেনইলে এত তাড়াতাড়ি বডি বের করতে পারতাম না। বউমার ভাইয়ের, কাকা, পাড়ার ছেলেরা রয়েছে, তারাই যা কিছু করার করছে। প্রদীপ হাসপাতালে যখন পৌঁছয় তখনও প্রাণ ছিল, ঘণ্টা দুই বেঁচে ছিল। আমাদের আর কিছু করার ছিল না তাই চলে এলাম।…তোর পায়ে নাকি বড় চোট পেয়েছিস?
নীচের উনি ফিরলেন না? ওঁর ছেলেটি তো এখানেই রয়েছে। মাথা নিচু রেখেই অনুপম বলল।
না, বউমাকে আর আসতে বললাম না। কী হবে এসে? বাপের বাড়িতেই নিয়ে গেল। বাচ্চুকে কাল আমি পৌঁছিয়ে দিয়ে আসব।
বউদি ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। পঞ্চি ঘুমভাঙা চোখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
একটু চা খাওয়াবি রে। রবিদার শ্রান্ত গলা থেকে সজল করুণ একটা সুর যেন বেরিয়ে এল।
পঞ্চির ঘুমের ঘোর কাটেনি। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেলল, নীচের দাদা এসেছে?
রবিদাই শুধু নয়, অনুপমও প্রশ্নের আকস্মিকতায় অপ্রতিভ হয়ে গেল। সেটা কাটিয়ে উঠে রবিদা নরম স্বরে বলল, আনতে পারলাম না রে।
উত্তরটা বোধগম্য না হওয়ায় পঞ্চি তাকাল অনুপমের দিকে। একটা ঝাঁঝালো রাগ তখন অনুপমের দু চোখ দিয়ে মাথার মধ্যে ঢুকে গেল।
মারা গেছে। সে ঝলসানো শব্দ দুটো মুখ থেকে বের করে আনল কঠিন গলায়।
অ্যাঁ, দাদা মরে গেছে!…দাদা মরে গেছে!…তা হলে বাচ্চুর কী হবে, ও মেসোমশাই কার কাছে বাচ্চু থাকবে… বলতে বলতে পঞ্চি সারা বাড়ির অব্যক্ত শোককে মুখর করে ফুপিয়ে উঠল। কেউ তাকে কাঁদতে বারণ করল না।
রবিদার চোখের পাতা ধীরে ধীরে নেমে এল। অন্ধ দৃষ্টি আকাশের দিকে তুলে। ফিসফিস করে শুধু বলল, টিকিটটা আমিই দিয়েছিলাম।
অনুপম তখন দালানে আবদ্ধ ফোঁপানো বাতাসের উদ্দেশে মনে মনে বলল, পেনাল্টিটা আমিই মিস করেছি।
কারও মুখ থেকে পঞ্চির জন্য একটিও সান্ত্বনা-বাক্য বেরোল না। কাঁদতে কাঁদতে সে ঘরে গিয়ে তার মাসিমার কাছে মনের কষ্ট, বেদনা জানাতে লাগল। কিন্তু সেখানেও কোনও জবাব না পেয়ে সে চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে চলে। গেল।
সন্তুকে বলেছি বাচ্চুটাকে আজ তোদের কাছেই রাখ। ওরও একটা দুবছরের বাচ্চা আছে, ভালই থাকবে। রবিদা মন্থর স্নান গলায় বলল।
কাল ওকে কখন দিতে যাবে? অনুপম চেয়ারে বসে, কিছু একটা বলে সজীবতা তৈরি করার জন্য কথা বলল। কালকের ঘটনা এবং তার জন্য কে বা কারা দায়ী, এই ধরনের কথাবার্তা থেকে দূরে থাকতে চায় সে।
সকালেই যাব। ছটার সময় গাড়িটাকে আসতে বলেছি। আমাদের নিয়ে কাল রাত থেকে গাড়িটা খাটছে। সফিকুলের আজ সকালে কাকদ্বীপে যাওয়ার বুকিং ছিল, সেটা ক্যানসেল করে অ্যাডভান্স ফিরিয়ে দিয়েছে। একবার পেট্রল নিল দশ লিটার, দাম দিতে গেলাম, নিল না।…সফিকুলের বাড়ির অবস্থা কিন্তু মোটেই ভাল নয়, ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে পুরনো গাড়িটা কিনেছে। রবিদা মুখ ফিরিয়ে অনুপমের মুখের দিকে তাকিয়ে অবশেষে বলল, ছেলেটা তোদেরই বয়সি।
চোখ নামিয়ে নিল অনুপম। রবিদার এই শেষ কথাটা বলার উদ্দেশ্য কী। সফিকুল আমারই বয়সি তো কী হয়েছে? ও ভাল কাজ করে আর আমি খারাপ কাজ করি?
তোর পায়ের অবস্থা এখন কেমন?
ভাল।
সেই সময় পঞ্চি দুজনের জন্য চা এনে ওদের হাতে দিল।
ইতিমধ্যে কোনও অসুবিধে হয়েছি কি তোর? ডাক্তার দেখাবার মতো সিরিয়াস কিছু হয়ে থাকে…।
বাইরে থেকে মোটরের হর্নের শব্দ ভেসে এল। কাউকে ডাকার মতো ছোট ছোট করে দুবার বাজল। অনুপমের হাতের কাপটা একবার নড়ে উঠেই স্থির হয়ে গেল। সুপ্রিয় গুপ্ত গাড়ি নিয়ে এসেছে।
রবিদা, কাল সকালে বাচ্চুকে নিয়ে তোমার আর যাওয়ার দরকার নেই। আমি ওকে নিয়ে গিয়ে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দেব। ধীর এবং দৃঢ় গলায় অনুপম কথাটা বলে পঞ্চির দিকে তাকাল। দ্যাখ তো, মোটর গাড়িটা এই বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কি না।
তুই ওকে নিয়ে যাবি! বিশ্বাস করা রবিদার সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। তোর নিজের কথা তুই ভাব, এসব নিয়ে চিন্তা আমি করব।
আমি ভেবেচিন্তেই বলেছি।
পঞ্চি ছুটে ফিরে এল। হ্যাঁ গো, দুপুরে যে লোকটা এসেছিল, সে আর ব্যাগ কাঁধে একটা লোক গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে।
দুপুরে কে এসেছিল? রবিদার বিস্মিত প্রশ্ন।
প্রভাতী সংবাদের রিপোর্টার সুপ্রিয় গুপ্ত।
জানল কী করে তুই এখানে…উদ্দেশ্যটা কী?
উদ্দেশ্য নিজের স্বার্থ, নিউজের সন্ধানে আসা, আমি তো এখন বড় নিউজ। এত বড় ঘটনার পর উধাও…সেই পলাতক ভিলেনকে তার গোপন ডেরায় খুঁজে বের করে তার ইন্টারভিউ নেওয়া…ডিটেকটিভ গল্পের মতো গা-ছমছম করা একটা লেখার সুযোগ পেলে সুপ্রিয় গুপ্ত ছাড়বে কেন?
আবার হর্নের শব্দ। এবার একটু বড় করে। পঞ্চি আবার ছুটে গেল বারান্দায়।
যে আমাকে কাল এখানে পৌঁছে দিয়েছে সে-ই ওকে জানিয়েছে। সুপ্রিয় গুপ্ত আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবে বলে গাড়ি এনেছে। অনুপম চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে বলল, কিন্তু আমি যাব না। আমি যাব কাল,বাচ্চুকে নিয়ে।
লোকটা হাত নেড়ে আমাকে নীচে ডাকল, যাব? উত্তেজিত পঞ্চি তাকাল। রবিদার দিকে।
দরজা খুলে ওপরে নিয়ে এসো। অনুপম শান্ত স্বরে নির্দেশ দিল।
নিয়ে আয়। রবিদা অনুমোদন করতেই মেয়েটি নীচে নেমে গেল।
রবিদা, গত চব্বিশ ঘণ্টা আমাকে চব্বিশ হাজার বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে গেছে, জানি না আরও কত আমাকে দেবে।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। ওরা তাকিয়ে রইল। প্রথমে সুপ্রিয়, তার পেছনে পঞ্চি, তারপর ব্যাগ কাঁধে বেঁটে, টাকমাথা, স্থূলকায় অরবিন্দ পাইন, হাতে ফ্লাশ লাগানো ক্যামেরা।
কী রে, তুই রেডি হসনি? ঈষৎ বিরক্ত ও ব্যস্ত স্বরে সুপ্রিয় সিড়ি থেকেই বলল।
হেসে অনুপম বলল, বসুন। সুপ্রিয়দা।
আলোর ঝলসানিটা চোখকে সইয়ে সে অরবিন্দর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে একটু বড় করে হেসে বলল, ভাল করে অনেকগুলো নিন অরবিন্দদা আর আমাকে কিন্তু গোটা দুই কপি দেবেন।
অরবিন্দ কম কথা বলে। মাথা নেড়ে সে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে রবিদা ও পঞ্চিসমেত অনুপমের ছবি নেবে সেটাই ঠিক করায় মনোযোগী হয়ে পড়ল।
সুপ্রিয় চেয়ার টেনে বসে বলল, আপনিই রবিদা, নমস্কার, কী ঝামেলায় যে একটু আগে পড়ে গেছলাম।…অনু। তোকে ক ঘণ্টা আগেই বলে গেলাম না, আমাদের ফেভারিট গেম এখন ডাকাত কি ছেলেধরা বলে লোককে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা, সেটাই ঘটতে যাচ্ছিল আমাদের প্রায় চোখের সামনে, এই এখানকার বাজারের কাছে। অশথ গাছটার নীচে একটা পাথর বসিয়ে যেখানে পুজোটুজো হয়, তার থেকে দু-তিনশো হাত আগে, বাস-রাস্তাতেই!..আমাদের উলটো দিক দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সাইকেল চালিয়ে একটা ছোকরা মোটরের গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল আর তার ষাট-সত্তর গজ পেছনে তাড়া করে আসছিল তিরিশ-চল্লিশটা লোক। সাইকেলটাকে ধরতে পারেনি, বাঁ দিকে একটা রাস্তায় নেমে গেল। শুনলাম আর একজনকে ধরে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেছে। হয়তো এতক্ষণে লাশ ফেলে দিয়েছে।…নে, তাড়াতাড়ি চল, কিছু নেওয়ার তো নেই?
সুপ্রিয় উঠে দাঁড়াল। অনুপম স্থির হয়ে বসে রইল। রবিদার জ্ব কুঁচকে উঠেছে। পঞ্চি ছেলেধরার গল্প শুনে রোমাঞ্চিত।
আমি যাচ্ছি না সুপ্রিয়দা।
সে কী! অফিস থেকে ব্যবস্থা করে গাড়ি আনলাম, তোর থাকারও ব্যবস্থা করেছি, দেশে আর তোকে যেতে হবে না। আমাদের চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্টের দাদার খালি বাড়ি রয়েছে উলুবেড়েয়, গঙ্গার ওপর। চল, এখন না বেরোলে সন্ধে হয়ে যাবে পৌঁছতে।
যা বলার বলে দিয়েছি, যাচ্ছি না। নীচের ভদ্রলোক গতকাল হাসপাতালে মারা গেছেন। আমি তাঁর বাচ্চা ছেলেটাকে কাল সকালে বেহালায় পৌঁছে দিয়ে আসব মায়ের কাছে। সেখানে ফোটোগ্রাফার নিয়ে আসুন, আমাদের ফেভারিট গেমের রিপোর্ট করার, ছবি তোলার প্রচুর সুযোগ তখন পাবেন।
অনুপমের মুখভাব এবং কণ্ঠস্বর থেকে সুপ্রিয় জেনে গেল, সিদ্ধান্তটার নড়চড় হবে না। থমথমে হয়ে উঠল তার মুখ। একটা দুর্দান্ত স্টোরির টোপ ফেলে, সম্পাদককে রাজি করিয়ে সে গাড়িটা এনেছে। এখন সে খালি হাতে ফিরে গিয়ে বলবে কী?
তা হলে তুই এটা আগে বললি না কেন? এত তেল পুড়িয়ে, সময় নষ্ট করে এভাবে হ্যারাল্ড হওয়ার কোনও দরকার ছিল না।
কে বলল দরকার ছিল না। এটাই তো তোমার স্টোরি। অনুপম বিশ্বাসটা যে কত পাজি, শুধু সারথি থেকে কেন, ভদ্রসমাজ থেকেই তাকে তাড়ানো যে কত মঙ্গলজনক কাজ হবে সেটা এবার তুমি কলম খুলে লিখতে পারবে। সুপ্রিয়দা, এতগুলো লোকের মৃত্যু, জখম, কেউ কেউ পঙ্গুও হতে পারে, এ সবের জন্য আমি একা দায়ী নই। যে সিস্টেমে, যে কাঠামোয়, যে পদ্ধতিতে আমাদের ফুটবল চলছে তাই থেকেই বেরিয়ে আসছে এই বিষ। অপরাধের বোঝা আমি একা কেন বইব, অনুশোচনা, অনুতাপ একা আমি কেন করব? সবাইকে বইতে হবে, করতে হবে, আপনাকেও এর ভাগ নিতে হবে। চারদিকে শুধু তো শুয়োপোকার ভিড়। মানুষ…বুদ্ধিমান, হৃদয়বান মানুষ কোথায়? কলকাতার ফুটবল চালাচ্ছে যারা, ক্লাব চালাচ্ছে যারা, সেখানে কাদের দাপট, কাদের প্রতিপত্তি? ধান্দাবাজ, আত্মমর্যাদাবোধহীন, পা-চাটা, চোর-জোচ্চোর ক্লাসের বারিন দত্ত, দুলাল শীল, সুবোধ বোসদের হাতে ফুটবল গেলে এই অবস্থাই হয়; আগুন জ্বলে, টেন্ট ভাঙে, মানুষ মরে। আর বলির পাঁঠা করার জন্য প্লেয়াররা তো আছেই। আর আছেন আপনারা।
সুপ্রিয় উঠে সিঁড়ির দিকে এগোতেই অনুপম ঝটিতি হাত বাড়িয়ে ওর বাহু ধরে টান দিল। সুপ্রিয় টানের চোটে পিছিয়ে টেবিলে ধাক্কা খেল। অনুপমের দু চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে, রগ দুটো দপদপাচ্ছে, ফুলে উঠেছে গলার দুধারের শিরা। মুঠো করা পুরো বাহুর পেশি স্ফীত।
সুপ্রিয় এবং অরবিন্দ কিছুটা ভয় পেয়ে রবিদার দিকে তাকাল। অনুপম কিছু যদি ঘটিয়ে ফেলে তা হলে এই লোকটি তাদের রক্ষাকর্তার ভূমিকায় যেন অবতীর্ণ হয়, এমন একটা প্রত্যাশা তাদের দৃষ্টিতে। কিন্তু রবিদার হাবভাবে এই ভূমিকা পালনের কোনও ইচ্ছা ফুটে উঠেছে বলে তাদের মনে হল না। বরং মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকাটাই তাদের চোখে পড়ল।
অনুপম গলাবাজি তো এখন খুব করছিস। কিন্তু গড়াপেটা ম্যাচে গোল দিয়ে ছোট ছোট টিমগুলোকে হারিয়ে বীরদর্পে যখন মাঠ থেকে বেরোস, ভক্তদের সাষ্টাঙ্গ প্রণামগুলো অবলীলায় যখন গ্রহণ করিস, তখন তোদের এই ন্যায়নীতি বোধগুলো থাকে কোথায়? তোরা যদি ফুটবলটা খেলতে জানতিস, পরিশ্রম করে খেলাটা। শিখতিস, তা হলে কি ম্যাচ গড়াপেটা করার দরকার হত? সুপ্রিয় এবার কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মরিয়া হয়ে গলা চড়াল।
কেউ খেয়াল করেনি ঘরের পরদা সরিয়ে বিষাদে আচ্ছন্ন, ফোলা ফোলা দুটি অশ্রুসজল চোখ নিয়ে বউদি দরজায় দাঁড়িয়ে। রবিদার দৃষ্টি হঠাৎ সেই দিকে পড়তেই সচেতন হয়ে নম্র স্বরে বলে উঠল, এই নিয়ে এখন তর্কাতর্কি এখানে না করলেই ভাল হয়। বাড়ির কারও এখন মন ভাল নেই।
রবিদার কথা গ্রাহ্যে না এনে সুপ্রিয় সমানে গলা চড়িয়ে বলে চলল, আমরা লিখে-লিখে তোর পপুলারিটি, তোর ইমেজ ধরে রেখেছি অনুপম, তা যদি না করতাম তা হলে আজ তুই দেড় লাখ-দু লাখ এইরকম খেলে কামাতে পারতিস না। তুই একটা বেইমান, তাই কাগজকে দোষী করছিস। তোকে যে কোনও সময় ময়দান থেকে বিদেয় করে দিতে পারি, সেটা যেন মনে রাখিস।
তার আগে আমিই তোমায় এখান থেকে বিদেয় হতে অনুরোধ জানাচ্ছি, নইলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে— অনুপম দুপা এগোল সুপ্রিয়র দিকে।
অনু। ধমক দিয়ে রবিদা দাঁড়িয়ে উঠল। অরবিন্দ ততক্ষণে সিড়ির মাঝামাঝি নেমে গেছে। সুপ্রিয় নামতে নামতে মুখ ঘুরিয়ে বিষাক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, একটা ক্রিমিনালের মতো ফেরার থেকে ভেবেছিস বেঁচে যাবি। দেখি কেমন করে তুই বাঁচিস।
সুপ্রিয় গুপ্ত নেমে গেল। একটু পরেই গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার শব্দ শোনা গেল। অনুপম তখন স্বগতোক্তি করল, আপদ বিদায় হল।
এর পর বউদি আর পঞ্চি পাশের বাড়ি গেল বাচ্চুকে দেখার জন্য। রবিদা নীচে নেমে এসে সদর দরজার বাইরের রকটায় বসল। কলকাতা থেকে সে ফিরেছে জানলে প্রদীপ হালদার সম্পর্কে খবর নিতে কেউ কেউ নিশ্চয় আসবে। বাড়ি। বাইরেই তাদের সঙ্গে কথা বলা ভাল, তা হলে দোতলায় অনুপম নির্বিঘ্ন হতে পারবে।
.
বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যার এগিয়ে আসাটা অনুপম ঘরের পেছনের জানলা দিয়ে দেখছিল। কালকের থেকে ঠাণ্ডাটা কম, গরম জামা পরার মতো নয়। বাড়ির খিড়কি দরজা খুললেই ডোবার মতো একটা পুকুর। তাকে ঘিরে নারকেল গাছ। আরও কিছু গাছ রয়েছে যার মধ্যে পেয়ারা, আম আর বাতাবিলেবু গাছগুলোকে সে চিনল।
এই সবের পেছনে পুরননা, ভেঙেপড়া ইটের পাঁচিল-ঘেরা দোতলা বাড়ি, যেটা সে কাল দেখেছিল। ইটগুলো ক্ষয়ে যাওয়া, শ্যাওলায় কালো। জানলায় রং নেই, শিকও সবগুলোতে নেই। এইরকম এক সময়ের অবস্থাপন্ন কিন্তু এখন কোনওক্রমে দিন গুজরান করা পরিবার সে মফস্বলের গ্রামের যেখানেই গেছে, দেখেছে। বাড়িটার পেছনে ও পাশে বড় বড় গাছ আর আগাছার জঙ্গল।
ম্লান হয়ে আসা আলোয় ক্রমশ আবছা হয়ে আসছে পুকুরে ছায়া ফেলা গাছেরা। অনুপমেরা বুকের মধ্যে দম বন্ধ করা স্মৃতিগুলো জানলা দিয়ে খোলা প্রকৃতির মধ্যে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। এই বাড়িতে আর কিছুক্ষণ থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে কি না, এমন চিন্তাও তার মধ্যে এল।
সিড়িতে দ্রুত উঠে আসা পায়ের শব্দ আর উত্তেজিত চাপা গলায় রবিদার, অনু, অনু…কোথায় তুই শুনে অনুপম বলল, এই যে, ঘরে।
সব্বোনাশ হয়েছে। এ বাড়িতে নাকি ছেলেধরা তাড়া খেয়ে ঢুকেছে। আর তাকে নাকি আমি লুকিয়ে রেখেছি ভাই পরিচয় দিয়ে!
ঘরের দরজায় রবিদা ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। এখন তাকে দেখেই অনুপমের গা শিরশির করল।
সে কী, কে বলল?
ছুটতে ছুটতে এসে পাড়ার ছেলে দেবাশিস খবর দিল, গ্যাঁদালপাড়া বাঁশতলার লোকে খেপে উঠেছে। তারা দলবেঁধে আসতে পারে।
এসব রটাল কারা?
দেবাশিসকে একজন বলেছে, মোটরে করে যাচ্ছিল দুটো লোক, গাড়ি থামিয়ে তারা বলল, যে ছেলেধরাটাকে সবাই তাড়া করেও ধরতে পারেনি, সেই লোকটাকে চুপিচুপি রবি সরকারের বাড়িতে ওরা ঢুকতে দেখেছে।…তোর সেই রিপোর্টারের কাজ। কী শয়তান লোক! অনু কোনও রিসক নেওয়া নয়। তোকে খিড়কির দরজা দিয়ে
রবিদার কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার করতে করতে একটি ছেলে ওপরে উঠে এল, রবিকাকা, রবিকাকা ওরা এসে পড়ছে, অনেক লোক…আপনি শিগগির নীচে গিয়ে কথা বলে আটকান, নয়তো…
ছেলেটি আসার মতোই বেগে নেমে গেল। রবিদা উদভ্রান্তের মতো এধার-ওধার তাকাচ্ছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। অনুপমের সিক্সথ সেন্স বলল, এ বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকা নয়। জনতা মানেই বোধবুদ্ধিহীন, অন্ধ এক দানব। ঘটনা ঘটিয়ে তারপর ভাবতে বসে।
কোলাহলের মতো শব্দ ভেসে এল। অনুপম ধাক্কা দিয়ে রবিদাকে সিঁড়ির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বলল, খিড়কির দরজাটা কোথায় দ্যাখাও।
একতলায় সিঁড়ির পাশে বাড়ির পেছনে যাওয়ার দরজা। সেখানে সিমেন্টের উঠোন, টিউবওয়েল, পাম্প, কলঘর ইত্যাদি এবং বাইরের পুকুরে যাওয়ার ছোট দরজা। অনুপম দরজা দিয়ে বেরিয়ে নিজেই টেনে বন্ধ করার আগে রবিদাকে বলল, বলবে, কেউ আসেনি…খিলটা দিয়ে দাও।
কোলাহলটা এখন চিৎকার আর তর্জনগর্জন। কিছু কিছু কথা স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে।
রবিদা বলছে, আস্তে আস্তে, কালকেই এই বাড়ির একজন মারা গেছে, বাড়ির মানুষ এখন শোকে দুঃখে…।
রাখুন রাখুন, ওসব অনেক শোনা আছে।
বের করুন, নয়তো বাড়ি জ্বালিয়ে দেব।
রবিদা বলছে, আমি এখানে এতদিনকার বাসিন্দা, আমি কেন এখানকার ছেলে চুরি করব! এখানে আমার ব্যবসা, দোকান…বাড়িতে এখন একটা লোকও নেই।
আরে মশাই পুরনো বাসিন্দে ফাসিন্দে বুঝি না। ব্যবসা-দোকান আছে বলে পয়সার গরম দেখাচ্ছেন? ছেলে ধরে বিদেশে পাচার করার, সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করে নেওয়ার কারবারেও অনেক পয়সা। বড়লোকেরাই এসব করে।
ভেতরে ঢোক, ব্যাটাকে টেনে বের করি।
অনুপম পুকুরধার দিয়ে, নারকেল গাছগুলো ঘেঁষে পায়ে-চলা সরু জমি ধরে এগোল। তার লক্ষ্য, যত তাড়াতাড়ি দূরে সরে যাওয়া। ওরা শুধু তো বাড়ির মধ্যেই খুঁজবে না, পুকুরের দিকেও আসবে। শুধু একটাই আশা, অন্ধকার হয়ে এসেছে। কিন্তু ওদের কারও সঙ্গে যদি টর্চ থাকে! এখানে ঘন ঝোপজঙ্গল নেই যে, সে আড়াল নেবে। তা ছাড়া দলবেঁধে ওরা খুঁজবে, লুকোনো কাউকে পেলে এক সেকেন্ডও খরচ করবে না পিটিয়ে মারতে।…রডটা চালিয়েছিল এক সেকেন্ডেই মনঃস্থির করে। কিংবা তখন মন বলে কিছু ছিলই না।
পাঁচিলের ধারে এসে অনুপম উচ্চতা অনুমান করে দু হাত তুলে লাফাল। পাঁচিলের মাথা দু হাতের আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরতেই ঝুরঝুর করে গুঁড়ো চুন-সুরকি এবং তারপর দুটো ইট নিয়ে সে জমিতে পড়েই হাঁটুর যন্ত্রণায় কাতরে উঠল।
রবিদার বাড়ির দোতলা থেকে অনেক লোকের গলা আসছে। ওরা ঘরে ঘরে খোঁজ চালাচ্ছে। ছাদেও নিশ্চয় যাবে। সেখান থেকে পুকুরের দিকে চোখ পড়বেই, আর কিছু লোক খুঁজতে আসবেই।
অনুপম আর একটু সরে গিয়ে পাঁচিলে কয়েকটা কিল মেরে বুঝতে চেষ্টা করল, কতটা মজবুত। তারপর আবার দু হাত বাড়িয়ে লাফাল।
শক্তই। মনে হয় ইট খসে আসবে না। দুহাতে চাড় দিয়ে বুক পর্যন্ত উঠে একটা পা পাঁচিলের ওপর রেখে বাকি শরীরটা তুলে নিয়ে পাঁচিলে রাখা। অনুপম চাড় দিয়ে উঠল।
খিড়কির দরজা খোলার শব্দ হল। সে ডান পা তুলল। পাঁচিলের ওপর রেখে বাকি শরীর তোলার জন্য পায়ের ওপর ভর দিতেই ইটটা খসে পড়ল আর সেই সঙ্গে ডান পা ঝুলে নেমে এল।
ইট পড়ার শব্দটা সন্ত্রস্ত করে দিল অনুপমকে। কিছু লোক বেরিয়ে পুকুরের ঘাটলার সিঁড়িতে। মুখ ফিরিয়ে সে কয়েকটা সাদা ধুতির নড়াচড়া দেখতে পেল।
খিড়কিতে আলো নেই? বললেই হল! জ্বেলে দিতে বল।
শিগগির একটা টর্চ নিয়ে আয়। খোঁজ ব্যাটাকে।
অনুপমের কনুই দুটো জ্বালা করছে। কিন্তু তাই নিয়ে উহু-হু করার সময় এটা নয়। এখন বাঁচা আর মরার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এই পাঁচিল। প্রতিটি সেকেন্ড এখন…। সে আবার লাফিয়ে পাঁচিল ধরল। ডান পা সবেগে পাঁচিলের মাথায় পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একই ঝোঁকে গোটা শরীরটাকে পাঁচিলের ওপর তুলে দিয়ে নিজেকে সে আধপাক গড়িয়ে দিল। আন্দাজ করে নিয়েছিল এদিকের মতো ওদিকেও জমি আটন ফুট নীচেই হবে।
শরীরে একটা পাক দিয়ে নীচে পড়ার সময় তার মনে একটা ভয়ই তখন ঝলসে গেল—ইট পাথর বা লোহার কোনও খোঁচা জমিতে পড়ে নেই তো! কিন্তু ভয়টা অমূলকই। আঘাত পাওয়ার মতো কিছু ওধারে ছিল না।
পাঁচিল ঘেঁষে দুই তালু আর হাঁটুর ওপর ভর রেখে অনুপম শক্ত জমিতে পড়ল এবং মুখ দিয়ে তার প্রথম কথাই বেরোল, হাঁটুটা গেল।
যন্ত্রণায় সে ধীরে ধীরে কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ল। বাঁ হাতের আঙুলগুলো হাঁটুর ওপর নিজের থেকেই এগিয়ে গেল সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে। দেড় বছর আগে ডা. চ্যাটার্জি বলেছিলেন, বাঁ পায়ের কার্টিলেজ অপারেশন করিয়ে নিতে, আবার যদি চোট পাও, তা হলে কিন্তু খেলা ছাড়তে হবে। অপারেশনে তার ভীষণ ভয়। তখন সে রাজি হয়নি। এখন তার মনে হল, বোধ হয় এবার খেলা ছাড়তেই হবে।
চিত হয়ে সে শুয়ে রইল। পরিষ্কার আকাশ, কয়েকটা তারা দেখা যাচ্ছে। মাটির আর গাছপালার নিজস্ব মিষ্টি গন্ধ আছে। গাছে পাখির ডানা ঝাড়ার শব্দ। অনুপম উৎকর্ণ হল পাঁচিলের ওধারে গলার আওয়াজে। দূর থেকে ফেলা টর্চের রশ্মিটা পাঁচিলের ওপর দিয়ে একটা সাদা লাঠির মতো ঘোরাফেরা করল।
আরে, সে কি আর এতক্ষণ বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে আছে, দ্যাখগে ভালমাষির মতো মুখ করে সন্তোষের দোকানে বসে এখন চা খাচ্ছে।
দেখলে তুই চিনতে পারবি?
খুব পারব।
কথাগুলো ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে এল। উঠে বসল অনুপম। কাদের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে এসে পড়লাম? এরা কেমন লোক? সারথির সাপোর্টার কি? তাকে চিনতে পারলে কি রড দিয়ে পিটিয়ে মারবে? ছেলেধরা ধরার লোকগুলো এখন কত দূরে? এখানে কতক্ষণ বসে থাকা যায়? ঝোপজঙ্গলে, বিশেষ করে পাঁচিলের ধারে গর্তে সাপ থাকতে পারে। শীতের ঘুমে যতই আচ্ছন্ন হয়ে থাকুক, ওদের বিশ্বাস নেই।
সুপ্রিয় গুপ্তকেও সে বিশ্বাস করে না। খবর খুঁজে বের করতে না পারলে, বানিয়ে লেখায় সিদ্ধহস্ত। মান-অপমান বোধটাও কম, চক্ষুলজ্জারও বালাই নেই। লোকটা যে কী ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসাপরায়ণ, এখন সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
কাছেই একটা কুকুর ডেকে উঠল আর অনুপম ব্যস্ত হয়ে কোনওক্রমে উঠে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। তার আর একটি ভয় এখন কাছাকাছিই চার পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলে নিরাপদ হওয়া যাবে কি না, এই নিয়ে যখন সে দ্বিধার মধ্যে, তখন আরও কাছে কুকুরটার ডাক সে শুনতে পেল। আর ডাকের ভঙ্গিটা মোটেই বন্ধুজনোচিত নয়।
অন্ধকারে অপরিচিত লোক দেখলে তেড়ে এসে কামড়াতে পারে। ছুটে পালানোর ক্ষমতা এখন তার নেই। তা ছাড়া পালিয়ে সে যাবে কোথায়! ইট ছুড়ে মারলে বরং আরও চেঁচাবে, আরও তেড়ে আসবে। তা ছাড়া অন্ধকারে এখন কোথায় সে ইটকাঠ খুঁজবে! অন্ধকার থেকে বেরোনোটাই এখন দরকার। চেহারা দেখলে কুকুরটা। কামড়াবার আগে একটু ভেবে দেখবে, ও তো গণপ্রহারের কাজে নামেনি।
অনুপম বাঁ পা ফেলেই কাতরে উঠল। সে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল, অসম্ভব, অসম্ভব। তারপরই দেখল হাতকুড়ি দূরে কুকুর। মাঝারি আকৃতির, গায়ের রং নিশ্চয় সাদা নয়, তা হলে ঘোলাটে দেখাত। ভয় পেয়েই অনুপম, হ্যাট, হুশশ, হুশশ শব্দ করল মুখ দিয়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে জেনে গেল ভীষণ বোকামি করে ফেলেছে।
কুকুরটা মুখ নিচু করে, হিংস্র ডাক ছেড়ে তেড়ে এল তার দিকে। পায়ের ব্যথা ভুলে অনুপম খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়িটার দিকে এগোল। কুকুরটা পেছন থেকে এসে ডান গোড়ালির কাছে তার প্যান্ট কামড়ে টান দিল।
অ্যাই, অ্যাই। অনুপম পা ছুড়ল। নিচু হয়ে হাতড়ে হাতড়ে একটা মাটির ঢেলা পেয়ে কুড়িয়ে নিল। কুকুরটা চার-পাঁচ হাত দূর থেকে গজরাচ্ছে।
ঢেলাটা ভেঙে একটা টুকরো ছুড়েই সে বাড়িটার দিকে মরিয়া হয়ে এগোল। প্রায় ছুটেই। পেছনে আবার গজরানি এবং বাঁ পায়ের ডিমের কাছে প্যান্ট ভেদ করে দাঁত বসানোটা টের পেয়েই সে ঘুরে নিচু হয়ে ঘুসি চালাল। কুকুরটার মাথায় লেগেছে। একটু পিছিয়ে গিয়ে তারস্বরে জানোয়ারটা চিৎকার করতে লাগল।
পল্টন, আয় আয়, পল্টন। বাড়ির ভেতর থেকে পুরুষকণ্ঠের ডাক শোনা গেল। পল্টন নিশ্চয় এই কুকুরটাই, কেননা ওর ঘেউ ঘেউ আরও বেড়ে গেল ডাকটা শুনে কিন্তু আর কামড়াতে এগোল না।
বাড়ির সামনের দিকে যাওয়ার পথটা যে কোনদিকে অনুপম তা ঠাওর করতে পারছে না। সেই সময় দোতলার জানলা থেকে বয়স্ক পুরুষ গলায় কে বলল, দ্যাখ তো, পল্টনটা চেঁচাচ্ছে কেন। শুনছি ছেলেধরা নাকি তাড়া খেয়ে এদিকে এসেছে।
দয়া করে একটু কুকুরটাকে ডেকে নেবেন? ডুবন্ত মানুষ সামনে দিয়ে ভেসে যাওয়া কাঠের টুকরো দেখলে যেমন মরিয়া হয়, অনুপম সেইভাবেই বলল, আমি আপনাদের পাশের রবি সরকারের বাড়ির লোক।
দোতলায় বিস্ময়জনিত একটা শব্দ হল। আপনি এখানে কী করছেন…পল্টন, এই পল্টন। ধমকে উঠল লোকটি। আয়, ভেতরে আয়।
অনুপমকে এড়িয়ে ঝোপের পাশ দিয়ে কুকুরটা ছুটে চলে গেল। দোতলা থেকে নির্দেশ এল, ডানদিক দিয়ে ঘুরে আসুন।
অনুপমের আর হাঁটার ক্ষমতা নেই। বাঁ পা ফেললেই হাঁটু থেকে একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা মাথার তালু পর্যন্ত পেশি, শিরা, অস্থি চিরে চিরে উঠে আসছে। জ্বালা করছে পায়ের ডিমের কাছটা। দাঁত বসিয়েছে তো বটেই, মাংসও তুলে নিয়েছে কি না সে বুঝতে পারছে না।
সে জমিতে দুই তালু রেখে হামা দিতে গেল। পারল না। ব্যথাটা আরও অসহ্য হয়ে তাকে উপুড় করে প্রায় শুইয়ে দিল। কুকুরটা যদি ফিরে আসে তা হলে কিছুই তার করার থাকবে না। তবে ওটা কুকুরই, প্রভুর আদেশ মেনে চলে।
বাড়ির কোনও লোক যদি এখন এসে পড়ে তা হলে সে এই অসহায়তা থেকে রেহাই পেতে পারে। অনুপম করুণ চোখে জানলাটার দিকে তাকাল। অন্ধকার। কুকুরটা বাড়ির মধ্যে একবার ডেকে উঠল।
আজ এই অবস্থা আমার হল কেন? মাটিতে মুখ ঠেকিয়ে অনুপম চোখের জল আটকে রাখার কোনও চেষ্টা করল না। এত অপমান, এত হীনতা স্বীকার, এত ভয় পাওয়া, এত হেনস্থা আর লাঞ্ছনা! কী পাপ আমি করেছি? মাটিতে গড়াগড়ি খেতে হবে কেন? কী আমার দোষ? ভারতের এত বড় ফুটবলার এমন শাস্তি পাবে কোন রুলস বইয়ের নিয়মে?
টর্চের আলো তার দেহের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওমা! বলে একটা ভয়-পাওয়া কণ্ঠস্বর অনুপমের মাথার কাছে থমকে পড়ল।
মুখ তুলে তীক্ষ্ণ রশ্মির আঘাতে সে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
কে আপনি? এখানে কেন? একটি ছেলের গলা। অনুপম ওঠার জন্য দু হাতে ভর দিয়ে দেহটা তুলতে গিয়ে পারল না।
আমাকে একটু ধরে তুলে দেবে ভাই। আমার বাঁ পা-টা জখম হয়েছে, চলার ক্ষমতা নেই।
নিশ্চয়, নিশ্চয়।
হাতের লাঠিটা আর টর্চ মাটিতে রেখে অনুপমকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল ছেলেটি। আমি বাড়ি থেকে বরং কাউকে ডেকে আনি। দুজনের কাঁধে ভর না রাখলে আপনি চলতে পারবেন না। ততক্ষণ লাঠিটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন।
ছেলেটি দ্রুত ডেকে আনল একজনকে। দুজনের কাঁধ ও গলা জড়িয়ে ধরে অনুপম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এল নিচু তক্তপোশ পাতা একটা ঘরে, যার বিবর্ণ দেয়ালে তেলরঙে আঁকা ধূলিমলিন অস্পষ্ট দুটি ছবি। ভারী কাঠের একটা টেবলে পড়ার বই ছড়ানো। ঘরের একমাত্র বালবটা কম পাওয়ারের।
অনুপমকে ওরা চেয়ারে বসাল। এতক্ষণে সে ভাল করে লক্ষ করল তার উদ্ধারকারীদের। মুখের মিল থেকে অনুমান করল বাবা ও ছেলে। কিন্তু ছেলেটির মুখ যেন তার চেনা চেনা মনে হল। কবে, কোথায় যেন সে দেখেছে! চোখ বুজে মাথাটা পেছনে হেলিয়ে সে মনে করার চেষ্টা করল।
ওরা অবাক হয়ে দেখছিল অনুপমকে। সারা মুখ মাটি আর ময়লা মাখা। জামা আর প্যান্টের সামনের দিকও তাই। প্যান্টের তলা ঘেঁড়া। পায়ে রক্ত লেগে।
পল্টন বোধহয় কামড়েছে। চন্দন তাড়াতাড়ি গরম জল করতে বল, তুলো আর ডেটল আন। মারকিউরোক্রোম দিলেই হবে। আর ওনার মুখ হাত ধোয়ার জন্য এক বালতি জলও আনিস।
বয়স্ক লোকটি উবু হয়ে অনুপমের প্যান্টটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে তুলে পরীক্ষা করে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, বাড়ির পোষা কুকুর, কামড়ালেও ইঞ্জেকশন নেওয়ার দরকার হবে না। কিন্তু আপনি কে? বাগানে এখন এলেনই বা কীভাবে?
বাবা, ইনি বিখ্যাত ফুটবল প্লেয়ার অনুপম বিশ্বাস। রবি জ্যাঠামশায়ের ভাই, এখানে একবার এসেছিলেন।
কথাটা শুনেই অনুপম চোখ খুলল। চন্দনের সঙ্গে চোখাচোখি হল। মুখে হাসি ছড়িয়ে চন্দন ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
এইবার মনে পড়েছে। সেই ফরসা, রুগণ, লম্বাটে মুখ। সেইভাবেই পাতাকাটা চুল কপালে ঝুলে রয়েছে। চারটে বছর ওকে আর একটু বড় করে দিয়েছে আকারে। চোখ দুটিকেও। গলার স্বর অতটা মিষ্টি আর নেই। গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া সবই তো আগের মতো।
তাই কি? সেই চাহনি, সেই দৃষ্টি! সরল, গভীর আয়ত চোখে ফুটে ওঠা অপমানের ব্যথাটা তো অনুপম দেখতে পাচ্ছে না! অত লোকের সামনে অপ্রতিভ হওয়ার লজ্জা কাটাতে হাসির জন্য মর্মান্তিক চেষ্টাটা এখন আর ওর ঠোঁটে নেই। কাগজটা পাকিয়ে ছুড়েছিল ওর কপালে। বাইরে কোনও ইনজুরি হয়নি, কোনও আঁচড় স্মৃতিতে পড়েছিল কি? ওর কি কিছুই মনে নেই! তাই কি হয়!
আমি কে সেটা আগে জেনে এসে…, হায় রে, কে এখন অনুপম বিশ্বাস? তাকে এবার নিজের মুখে নিজের পরিচয় দিয়ে ভিখিরির মতো বলতে হবে, আমাকে বাঁচাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও।
আমাকে যদি রবিদার বাড়ি পৌঁছতে একটু সাহায্য করেন— অনুপম ওঠার চেষ্টা করতে করতে আবার বসে পড়ল চেয়ারে।
নিশ্চয়। গরম জলে আগে জায়গাটা ধুয়ে ওষুধ লাগিয়ে নিন। রবিদার আর আমাদের বাড়ির পেছন যদিও পিঠোপিঠি, তবে দুটো বাড়ির সদর দুই রাস্তায়। আপনাকে ঘুরে অনেকটা হেঁটে যেতে হবে। আমি বরং রবিদাকে খবর দিয়ে আনাচ্ছি।…খুব কি যন্ত্রণা হচ্ছে? আসলে জানেন, কুকুরটাকে আমরা সন্ধের সময়….
বিব্রত ও উদ্বিগ্ন ভদ্রলোককে থামিয়ে অনুপম বলল, যন্ত্রণা হচ্ছে, কিন্তু কুকুর কামড়ানোর জন্য নয়। দাঁতটা সামান্যই বসেছে। আমি রবিদার কথা ভাবছি। একদল লোক ওর বাড়িতে হামলা করতে ঢুকেছিল ছেলেধরা খোঁজার নাম করে। তাদে: হাত এড়াতে আমি পাঁচিল টপকে আপনাদের বাগানে নেমেছি। অনুপম কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরব থেকে, মাথা নামিয়ে মৃদুস্বরে আবার বলল, আমার জন্য, এ সবই আমার জন্য। মানুষের ক্ষতিই শুধু করে গেলাম।…কী যে খেললাম এতদিন ধরে! কারও কোনও উপকারে এলাম।
হতভম্ব ভদ্রলোক ওর ব্যথিত বিষগ্ন কথা শুনে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বললেন, আমি অবশ্য খেলাটেলা বুঝি না, খোঁজখবরও রাখি না, তবে আপনার নাম আমি শুনেছি। বিরাট প্লেয়ার আপনি
বাজে কথা। সব বানানো, সব তৈরি করা। অবিরত লিখে লিখে বিশ্বাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে। হতে পারতাম…বড় প্লেয়ার হতে পারতাম। সেই স্বপ্ন নিয়ে বারো বছর আগে ঘর ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলাম। প্রচণ্ড খাটতাম, খেলাই ছিল আমার সব কিছু, আমার ধ্যানজ্ঞান, আমার জীবন।
অনুপম ম্লান চোখ দেয়ালে টাঙানো ম্লান ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। অন্যমনস্কের মতো কিছু যেন ভাবছে। ভদ্রলোক ওর ভাবনায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে চুপ করে রইলেন।
স্বীকারোক্তি করার মতো নিচু গলায় অনুপম কথা বলছে। এই সময় এই সব কথা বলার কী দরকার, তা সে বুঝতে পারছে না। কথাগুলো নিজের থেকে বেরিয়ে এল অন্তর ভেদ করে।
নিজেকে নিজেই তৈরি করে নিয়েছি, সেজন্য অনেক ব্যাপারে স্বার্থপর হয়েছি। সবাই বলবে অন্যায় করেছি, বলুক তারা। মানুষকে আনন্দ দেওয়া আমার কাজ, এর একটা গুরুত্ব সমাজে আছে। সারথির হাজার হাজার সাপোর্টারকে আনন্দ দিয়েছি, এর কি কোনও দাম নেই?
অনুপম ছবি থেকে চোখ সরিয়ে রাখল ভদ্রলোকের মুখে। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে নড়ে বসে বললেন, আজকের কাগজে দেখলাম।
জানি, কী দেখেছেন। আমিই সেই লোক যার জন্য মাঠে এত হিংসা, রক্ত, মৃত্যু। ঘটে গেল। ভালবাসার কথা, ভাল কাজ করার প্রেরণা, মঙ্গলের পথ দেখানো আমার খেলা দিয়ে জানাতে পারিনি, দেখাতে পারিনি। অনুপমের কণ্ঠস্বর প্রান্তরে হা হা রবে বয়ে-যাওয়া বাতাসের মতো শোনাল।
জল নিয়ে চন্দন ঘরে ঢুকল। শুষার দায়িত্ব তাকে দিয়ে তার বাবা রবিদাকে খবর দিতে চলে গেলেন। বালতির জলে মুখ ও হাত থেকে ধুলো-মাটি ধুয়ে ফেলল। অনুপম। গরম জলে ক্ষত পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছিল চন্দন। অনুপম ওর শান্ত, অচঞ্চল মুখের দিকে তাকিয়ে আলাপ শুরু করল, স্কুলে পড়ো।
হ্যাঁ, ক্লাস টুয়েম্ভ হবে।
খেলা দ্যাখো…ফুটবল?
আমাদের টিভি নেই। তবে এখানকার খেলা দেখি।
কালকের খেলায় যা ঘটেছে তা শুনেছ, পড়েছ?
আমাদের পাড়ার একটা ছেলে খেলা দেখতে গেছল, তার কাছে শুনলাম খুব হাঙ্গামা হয়েছে। কাগজেও পড়লাম, লোক মরেছে…আপনার জন্যই সব ঘটেছে।
কী করে জানলে আমার জন্যই ঘটেছে?
কাগজে লিখেছে।
তা হলে সুপ্রিয় গুপ্ত সফল। খেলা দেখে না যে ছেলে, তাকেও বুঝিয়ে দিতে পেরেছে অনুপমই সব কিছুর মূলে।
ট্রাইবেকারে শেষ কিকটা ছিল আমার। যদি গোল দিতাম তা হলে ম্যাচটা ড্র হত, আমরা যুগ্ম বিজয়ী হতাম। আমার কিকটা বারের ওপর দিয়ে চলে গেল। না গেলে আমাকে কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত, এত সব কিছুই হত না। অনুপম হাসার চেষ্টা করল।
গোল একটা অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?
প্রশ্নটা এড়িয়ে চন্দন বলল, পল্টন খুব বেশি কিছু করেনি, দু দিনেই শুকিয়ে যাবে। ভয়টয় দেখায়, তাড়া করে, তবে ফেরোসাস নয়। আপনার প্যান্টটা গোটানোই থাক, নইলে ওষুধ লেগে যাবে।
ফুটবল নিয়ে কথা বলায় ছেলেটির কোনও আগ্রহই নেই। অথচ চার বছর আগে আমার অটোগ্রাফ চেয়েছিল! অনুপম এই প্রথম দেখছে, তার উপস্থিতি একদমই উত্তেজিত করল না একটি কিশোরকে।
তোমার মনে আছে কি, একটা হ্যান্ডবিল নিয়ে তুমি তাতে আমার অটোগ্রাফ। চেয়েছিলে?
হ্যাঁ। চন্দনের মুখে লাজুক হাসি ফুটল। আপনি দেননি।
সেটা ছুড়ে তোমার কপালে মেরেছিলাম।
হ্যাঁ, কিন্তু আমার লাগেনি।
তাতে তুমি দুঃখ পাওনি।
একটু, তারপর ভুলে গেছলাম। চন্দনের বড় বড় চোখ দুটিতে অনুপমকে গ্রাহ্যে না এনে তাচ্ছিল্য দেখানোর কোনও চেষ্টা নেই। সরল, অকপট, আন্তরিক চাহনি। অনুপমের ভেতরটা কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল।
বাবা বলেছিলেন, খুব অন্যায় করেছিস। অতবড় প্লেয়ারকে ওইরকম একটা বাজে কাগজে সই চেয়ে তাকে অসম্মান করেছিস। তারপর আমি ভেবেছিলাম আপনাকে চিঠি লিখে ক্ষমা চাইব। কিন্তু কেমন লজ্জা করল, তাই লেখা হয়নি।…আচ্ছা এখন যদি আপনার কাছে মাফ চাই?
অনুপম অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে চন্দনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বলছে কী! ওকে তো আমিই অপমান করেছি, ওরই তো রেগে থাকার কথা। তার বদলে ও আমায় শ্রদ্ধা দিল। একটা আবেগ অনুপমের বুক থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে লাগল আর সে আবিষ্কার করল তার শরীর থেকে বাথা-যন্ত্রণা ক্রমশ যেন মিলিয়ে যাচ্ছে।
এখন কার কাছে তুমি মাফ চাইবে, আমি তো সেদিনের মতো অত বড় প্লেয়ার আর নই। আজ আমি মার খাওয়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার জন্য, কাগজে পড়েছ তো, কত কিছু ঘটে গেল।
আপনি নিশ্চয় আবার পরিশ্রম করে বড় হয়ে উঠবেন।চন্দন খুব সাধারণ গলায় বলল। আমি ক্লাস নাইনে ইতিহাসে খুব কম নম্বর পেয়েছিলাম, মাত্র পঞ্চান্ন। বাবা বললেন, একটু জোর দাও, আলাদা যত্ন নাও। প্রতিদিন পনেরো মিনিট সময় দিয়েছি। ইতিহাসকে। একদিনও বাদ যায়নি। মাধ্যমিকে লেটার পেলাম। আপনিও যদি…না না, পনেরো মিনিটে হবে না জানি। যতটা দরকার, যদি ততটা সময়–
চন্দনের পক্ষে বলা সম্ভব নয় একজন ফুটবলারের কী কী করা দরকার। তাই সে কথা থামিয়ে ফেলল। কিন্তু অনুপমের মনের মধ্যে অজস্র কথা ঘুরপাক খেয়ে উঠল।
চন্দন, তুমি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে চাও কেন?
মুশকিলে পড়ে গেল চন্দন। এভাবে কেউ এই প্রশ্ন তাকে এখনও করেনি। সে বিব্রত হয়ে বলল, ভাল রেজাল্ট তো সবাই করতে চায়, আমিও চাই। ওপরের দিকে থাকলে খুব ভাল লাগবে, সবাই প্রশংসা করবে।
আমিও তাই চেয়ে খুব পরিশ্রম করেছিলাম। কিন্তু কিছুটা উঠেই আর করিনি। আমার কাজটা হয় বডি দিয়ে, তোমারটা ব্রেইন দিয়ে, এইখানেই আমাদের বড় পার্থক্য। শরীরের ক্ষমতা এক সময় তো কমতে শুরু করবেই কিন্তু তোমার ক্ষমতাটা যত চর্চা করবে, তত বাড়তেই থাকবে।
কথা বলতে বলতে অনুপমের নিজেকে হালকা মনে হতে লাগল। যে গ্লানিটাকে চার বছর ধরে বয়ে চলেছিল, সেটা যেন চন্দনের সঙ্গে কথা বলে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
আপনার শরীরের ক্ষমতা কি কমে গেছে? বাবা বলেন, কখনও নেগেটিভ চিন্তা কোরো না, তা হলে তুমি ব্যর্থ হবেই। আর শুধুই চিন্তা করে সফল হওয়া যায় না, কাজও করতে হয়। কাজে কখনও ঢিলে দিয়ো না।
অনুপম চুপ করে রইল। শরীরের ক্ষমতা এই ঊনত্রিশ বছর বয়সে কমবে কেন, তা হলে তার মধ্যে কী ঘটল? নেগেটিভ চিন্তা? কাজে ঢিলেমি?
তোমার বাবা কী করেন?
ক্লার্ক। ইস্টার্ন রেলে, হাওড়া অফিসে।
তোমাদের বাড়িটা খুব বড়, আর পুরনো।
একশো কুড়ি বছর আগের তৈরি। এখানে আমাদের অনেক জমিজমা ছিল।
এখন নেই?
চন্দন হেসে, জবাব না দিয়ে দরজার দিকে তাকাল। পল্টন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। মাঝারি গড়নের, কালো আর বাদামি রঙের দো-আঁশলা কুকুর। চন্দন হাত নেড়ে ওকে চলে যেতে নির্দেশ দিল। পল্টন দু পা পিছিয়ে বসে পড়ল।
এখন আমাদের কিছুই নেই বাড়ি আর বাগানটা ছাড়া। বাবা বলেন, ধনসম্পত্তি আর ফিরিয়ে আনা যাবে না, কিন্তু মানমর্যাদা তো চেষ্টা করলে ফিরে পাওয়া যেতে পারে।
কীভাবে? অনুপম টানটান হয়ে বসল। চন্দনের উত্তর তার কাজে লাগতে পারে।
আমি যদি বড় হতে পারি। বড় মানে ধরুন..খুব বড় বিজ্ঞানী, বড় ডাক্তার, সুপ্রিম কোর্টের জজ, ব্যারিস্টার কি ভাইস চ্যান্সেলার, ইকনমিস্ট। তা হলে আবার আমাদের বাড়ির কথা এই অঞ্চলের লোকেরা বলবে, তাতে আমারও গর্ব হবে।
গর্ব তুমি চাও?
নিশ্চয়। চন্দন এমনভাবে তাকাল যেন অঙ্কের সার বোর্ডে দুই আর দুইয়ে পাঁচ লিখে ফেলেছেন। অনুপমের মনে হল, চন্দন যাকে আমাদের বাড়ি বলল, সেটাই তার কাছে সারথি সঙ্ঘ। সারথির মান-মর্যাদা তিন বছর ধরে ধুলোয় লুটোচ্ছে, তাই তারও আজ কোনও সম্মান নেই। এই ছেলেটি আবার তার বংশের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। আর সে?
অনুপমের সারা শরীর মুহূর্তের জন্য শক্ত হয়েই পেশিগুলো ধকধক করে উঠল। এখনই যেন ভেতরে কোনও বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে উঠছে। তার ইচ্ছে করছে এখনই বল নিয়ে মাঠে ট্রেনিংয়ে নেমে পড়তে। এক মিনিটও আর সে অপেক্ষা করতে পারবে না…চন্দনের বয়সে তার এমনই হত!
আর সেই সময়েই চন্দনের বাবা ফিরে এলেন, সঙ্গে রবিদা। আর তাদের পেছনে। অনুপম যাকে দেখল, তাতে তাজ্জব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
ডা. চ্যাটার্জি, তাঁর পেছনে বারিন দত্ত আর দুলাল শীল!
এখানে শুয়ে পড়ো, পা-টা দেখি। ডা. চ্যাটার্জি ব্যস্ত এবং কড়া গলায় প্রথম কথাটি বললেন।
আপনারা?
ওসব পরে শুন। আগে শোও।
অনুপমকে দু পাশ থেকে ধরে তুলল বারিন দত্ত ও দুলাল শীল। তাদের কাঁধে ভর দিয়ে সে তক্তপোশের ওপর বসল। পা তুলে ছড়িয়ে দেওয়ার সময় যন্ত্রণায় আবার সে কাতরে উঠল।
এটা কী?
কুকুরে কামড়াতে গেছল, পারেনি। চন্দন সবার আগে উত্তরটা দিল। বাড়ির পোষা কুকুর।
ডা. চ্যাটার্জি হাঁটুর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়লেন। তারপর আলতো করে আঙুল রেখে সামান্য চাপ দিতেই অনুপম উহহ লাগছে বলে উঠল। হাঁটুটা মুড়ে ওপরে তুলতে গেলেন। অনুপম, না, না, পারব না। বলে পিঠ বাঁকিয়ে তুলল।
আর দেখার কিছু নেই। এখনই কলকাতায় নিয়ে চলুন। এক্স-রেটা আজই করাতে হবে। কালই অপারেশন করব। ডা. চ্যাটার্জি সাদামাঠা শান্ত পেশাদারি গলায় বললেন।
সারা ঘর চুপ। প্রথম কথা বলল দুলাল শীল। ফেডারেশন কাপে খেলতে পারবে তো? আর দেড় মাস পরেই—
থাম দুলো, বারিন দত্ত হাত তুলে বিরক্ত দৃষ্টিতে দুলালকে মৃদু ধমকাল। ডাক্তার চ্যাটার্জি যা বলছেন…গাড়িটা ভেতরে আনতে বল। আমার অ্যাম্বাসাডারেই যাবে।…দেড়মাসে কি কখনও হাঁটু ঠিক হয়? তিরিশ বছর ধরে হাঁটুর চোট কম তো দেখিনি। তাড়াহুড়ো করে মাঠে নামিয়ে দিয়ে কত ছেলের কেরিয়ারও শেষ হতে দেখেছি। ফেডারেশন আমার দরকার নেই, সামনের লিগটা নিয়েই আমি ভাবছি।
এই পা নিয়ে হাঁটাচলা করলে কী করে? ডা. চ্যাটার্জির বিস্ময় দেখে অনুপম ফিকে হাসল। শুধু হাঁটাচলাই নয়, আট-দশ ফুট ওপর থেকে একটা লাফও সে দিয়েছে।
ফুটবলারের পা। এতক্ষণে রবিদা একটা কথা বলার সুযোগ পেয়ে বলল।
বাইরে মোটর এঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। অনুপম রবিদাকে জিজ্ঞেস করল, ওরা কোনও ঝামেলা করেনি তো?
না, না। সারা বাড়ি ঘুরে, পেছনে পুকুর টুকুর দেখে বেড়াচ্ছে, তখন পঞ্চি পাশের বাড়ি থেকে এসে হাজির। লোকগুলো তো সব ওর পাড়ারই—গাঁদালপাড়া, বাঁশতলার। মেয়েটা চেঁচিয়ে মেচিয়ে বলল, এ বাড়িতে কোনও বাইরের লোক ঢোকেনি, কোনও লোক দুদিন ধরে আসেওনি। তাই শুনেই ওরা সরে পড়ল।
রবিদা, আমি বলেছিলাম কাল সকালে বাচ্চুকে নিয়ে আমি— অনুপম উৎকণ্ঠায় উঠে বসল।
থাক এখন ওসব। তোর নিজের অবস্থার কথা আগে ভাব। দেরি করলে তোর ক্ষতি হতে পারে, ফুটবল-জীবনটাই শেষ হতে পারে, কিন্তু বাচ্চুরা তো রইলই। কোন কাজটা তা হলে আগে করা উচিত? রবিদা শান্ত গলায় কথাগুলো বলে ওর মাথায় হাত রাখল। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন যে ক্ষতি হতে পারে সেটা বন্ধ হোক।
অনুপম অসহায় বেদনার্ত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে অবশেষে চন্দনের মুখের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল, যেন তার কী করা উচিত সেটাই বলে দিক চন্দন।
কিন্তু চন্দন চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে চলে গেল।
আর দেরি নয়, রাত হয়ে যাবে পৌঁছতে। দুলাল শীল তাড়া দিল।
না।
ঘরের সবাই সচকিতে অনুপমের দিকে তাকাল। ওর গলার স্বরের সঙ্গে একটা অটল ইচ্ছা বেরিয়ে এসেছে যেটা সবারই কানে ধরা পড়েছে।
আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আমাকে কথা রাখতে হবে। অনুপম দাঁড়িয়ে উঠে বলল। এক পায়ে জোর না থাকায় সে টলছে।
কীসের প্রায়শ্চিত্ত? বারিন দত্ত অবাক এবং বিব্রত হয়ে অনুপমকে ধরার জন্য হাত বাড়াল।
আমার ভাড়াটে ভদ্রলোেক কাল খেলা দেখতে গিয়ে মারা গেছে। তারই চার বছরের একমাত্র ছেলে বাচ্চু। অনু বলেছিল ওকে বেহালায় কাল সকালে মামার বাড়িতে নিজে গিয়ে দিয়ে আসবে। রবিদা মৃদুকণ্ঠে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল।
একটা বাচ্চা পিতৃহারা হল কেন, কী জন্য, কার জন্য? অনুপম সবার মুখের দিকে এক এক করে তাকাল। কোনও মুখ থেকেই সে উত্তর খুঁজে পেল না।
আমি, এই আমি। অনুপম নিজের বুকে আঙুল ঠেকাল। তারপর ফিসফিস করে বলল, আমার জন্য, আমার জন্য।
শুধু তোর জন্য কেন, ফুটবল কি আর একজনের খেলা? গোটা টিমটাই…।
না না দুলোদা, আমি শুধু আমিই দায়ী। অনুপম উত্তেজিত হয়ে এগোতে গিয়ে টলে উঠল। বারিন দত্ত তাকে জড়িয়ে ধরে না নিলে পড়েই যেত।
ছ-সাত বছর আগেও আমি একাই টেনে নিয়ে যেতে পারতাম সারথিকে, আজ আর পারি না।…কেন, কেন এমন হল? আমার নিজের কাছে আমার কোনও মর্যাদা নেই, এর থেকে যন্ত্রণাকর আর কিছু কি হতে পারে?…আমাকে খুঁজে দেখতে হবে। কেন এমন হল। আমাকে আবার গোড়ায় যেতে হবে যখন আমি ছিলাম অনামা অখ্যাত এক উঠতি প্লেয়ার, সেই সময়ে যেতে হবে যখন আমি খাটতুম বড় হবার স্বপ্ন। নিয়ে, যখন আমার মোটিভেশন ছিল। অনুপমের উত্তেজনা, আবেগ তার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে দেহকেও থরথর কাঁপাচ্ছে। কথাগুলো যে তার অন্তরের গভীর থেকে উঠে আসছে সেটা বুঝতে পারছে সবাই।
দুলাদা, বারিনদা, মানমর্যাদা চেষ্টা করলে ফিরে পাওয়া যেতে পারে, আমি আবার চেষ্টা করব।
তা হলে তাড়াতাড়ি চল। দুলোদা ঘড়ি দেখল, এক্স-রে আজ আর বোধহয় করা যাবে না, কসবায় আমাদের এক মেম্বারের এক্স-রে প্লান্ট আছে, ব্যবসা করে। তাকে গিয়েই ধরব যদি আজই করে দেয়।
অনুপম মাথা নাড়ল। বারিন দত্ত জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
বাচ্চুকে নিয়ে ওর মার কাছে যাব বলেছি—এইখান থেকেই শুরু হবে আমায় গোড়ায় ফিরে যাওয়া। বারিনা, আগে এক্স-রে নয়, আগে বাচ্ছ—আমার মোটিভেশন।
অনু ওকে নিয়ে বেহালায় যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। রবিদা বোঝাবার চেষ্টা করল। আগে বরং এক্স-রেটা করিয়ে নে। কাল তো আমি দিয়ে আসবই। তুই পরে নয় বেহালায় একদিন গিয়ে—। তার কথায় কান না দিয়ে, মাথা নাড়তে নাড়তে অনুপমকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে রবিদা কথা থামিয়ে ফেলল।
ঘরের বাইরে দালানে চন্দন উবু হয়ে বসে পল্টনের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল আর পল্টন চোখ বুজিয়ে তার লেজ মৃদু মৃদু নাড়ছিল। অনুপমকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে চন্দন উঠে দাঁড়াল।
রবি জ্যাঠামশাই যে কথাটা বললেন সেটাই কিন্তু করা উচিত–আগের কাজ আগে। চন্দন মৃদু শান্ত স্বরে অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল।
কোন কাজটা আগে করার কথা বলছ? অনুপম থতমত হল আচমকা এমন একটা কথা শুনে।
একটু আগে যে বললেন আপনার কাজটা করতে হয় বডি দিয়ে! তা হলে এখন আগের কাজ হল, বডিটাকে হান্ড্রেড পারসেন্ট ফিট রাখা, তৈরি রাখা। তা না রাখলে আপনার মধ্যে নেগেটিভ চিন্তা আসবেই। হাঁটুতে জখম থাকলে আপনি কি পুরো ক্ষমতা নিয়ে খেলতে পারবেন?…মোটিভেশন যতই থাকুক না।
তা হলে? অনুপমকে বাচ্চাছেলের মতো অসহায় দেখাচ্ছে।
ডা. চ্যাটার্জি অনুপমের পিছনে দাঁড়িয়ে চন্দনের কথাগুলো শুনেছেন। তিনি এবার বললেন, তা হলে উচিত এখনি এক্স-রে করা। আর আমার যা মনে হচ্ছে, অপারেশন করতেই হবে, কালকেই। প্রচণ্ড ক্ষতি, তা না হলে কিন্তু হয়ে যাবে।
অনুপম মুখ নামাল ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। পায়ের কাছে মুখ তুলে পল্টন বসে। দুজনে চোখাচোখি হতেই পল্টন কানদুটো ঘাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে লেজ নেড়ে ছোট করে একটা ভ্যাক করল। অনুপম ঝুঁকে দুহাত বাড়াতেই পল্টন সামনের দুপা তুলে দাঁড়িয়ে উঠল। ওর মাথাটা ধরে পেটের কাছে টেনে এনে হাত বোলাতে বোলাতে অনুপম বলল, বাছুর সঙ্গে দেখা করতে বেহালায় আমি যাব, রবিদা তুমি আমায় নিয়ে যেয়ো। বারিনদা, দুলোদা, সামনের বছরের জন্য যে টাকাটা আমাকে দেবেন সেটা বাচ্চুর মায়ের হাতে…আচ্ছা পরে এ নিয়ে কথা বলব। চলুন তা হলে। অনুপম হাত বাড়িয়ে চন্দনের কাঁধ ধরে গাড়ির দিকে এগোল।
সামনের আসনে বারিন দত্ত, পেছনে দুলাল শীলের কোলে পা ছড়িয়ে আধশোয়া অনুপম। অন্য গাড়িতে ডা. চ্যাটার্জি। গাড়ি ছাড়ার সময় দুলাল স্বগতোক্তি করল, কী ভয়ঙ্কর যে চব্বিশটা ঘণ্টা কেটে গেল!
অনুপম চোখ বন্ধ করল। জানলা থেকে রবিদার গলা শোনা গেল, তোকে নিয়ে একদিন বেহালায় আমি যাব।
গাড়ি তেঁতুলতলা থেকে পাকা বাস রাস্তায় পড়তেই অনুপম দুহাতে চোখ চেপে ধরল।