Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

কাটুসোনা

কাল রাতে আমাদের বাড়িতে চোর এসেছিল। মাগো! ভাবতেই ভয় করে। গায়ে কাঁটা দেয়। সবচেয়ে বেশি ভয় ভূতকে আর চোরকে।

আমাদের একটা লোমওয়ালা সুন্দর ভুটিয়া কুকুর ছিল। তার নাম পপি। ছোটখাটো, ভুসকো রঙের, ভারী মিষ্টি দেখতে। ভুক ভুক করে যখন ডাকত তখন ডাকটাও মিষ্টি শোনাত। সেই ছোট্ট একটু কুকুরছানা অবস্থায় আমাদের বাড়িতে আনা হয়েছিল তাকে। আমিও তখন ছোট্ট একটুখানি। টানা বারো বছর আমাদের সঙ্গেই সে বড় হল, বুড়ো হল। তারপর এই তো গেলবার শীতের শেষ টানে মরে গেল একদিন। পপির জন্য আজও বুকের কান্না সব শেষ হয়নি। ভাবলেই কান্না পায়। কেন যে কুকুরের পরমায়ু এত কম! আমি তো এখনও ভাল করে যুবতীও হয়ে উঠিনি, এর মধ্যেই পপি বুড়ো হয়ে মরে গেল!

তা যাই হোক, পপির মতো এত নিরীহ কুকুর হয় না। কোনও দিন কাউকে কামড়ায়নি, রাস্তার কুকুরদের সঙ্গে মারপিট করেনি। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই থাকতে ভালবাসত। তবে ভুক ভুক করে ডাক ছাড়ত ঠিকই। আর তার ভয়েই গত বারো বছরে কোনও দিন আমাদের বাড়িতে চোর আসেনি। পপি মরবার পর এ পর্যন্ত কম করেও দশ-বারো বার চোর হানা দিয়েছে।

কাল রাতের চোরটাকে বাঁটুল দেখেছে। ঠাকুমার কাছে বাঁটুল আর চিনি শোয়। বাঁটুলের ভয়ংকর কৃমির উৎপাত। সারা রাত দাঁত কড়মড় করে। গতবারেও তার গলা দিয়ে এত বড় কেঁচো বেরিয়েছিল। মাঝে-মাঝে সে বিছানায় ছোট-বাইরে করে ফেলে। সেও নাকি কৃমির জন্যই। কাল মাঝরাতে ছোট-বাইরে পাওয়ায় কোন ভাগ্যিতে তার ঘুম ভেঙেছিল। সলতে কমানো হ্যারিকেনের অল্প আলোয় সে দেখতে পায় একটা লম্বা বাঁখারি জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে আলনা থেকে ঠাকুমার থানধুতিটা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাঁটুল ভয়ে আধমরা অবস্থায় চোখ মিটমিটিয়ে জানালার দিকে চেয়ে দ্যাখে, একটা লোক। কেমন লোক, রোগা না মোটা, কালো না ফরসা, লম্বা না বেঁটে তার কিছুই বলতে পারেনি। শুধু একটা লোককে সে দেখেছে। ওই অবস্থায় আমি হলে ভয়ে জানালার দিকে চাইতামই না। কড়াক্কর করে চোখ বন্ধ করে রাখতাম। বাঁটুল লোকটাকে দেখে ঠাকুমাকে চিমটি দিয়ে জাগিয়ে দেয়।

ঠাকুমা তো বুঝতে পারেনি কেন বাঁটুল চিমটি কেটেছে। ফলে ঠাকুমা উঃ বলে জেগে উঠে বাটুলকে বকে উঠেছে, এ ছেলেটার সঙ্গে শোওয়াই যায় না। এই হাঁটু দিয়ে গুতোচ্ছে, এই গায়ে পা তুলে দিচ্ছে, এই দাঁত কড়মড় করছে, এখন আবার চিমটিও দিতে শুরু করেছে।

সাড়াশব্দে বাইরের ঘরে ভৈরবকাকা জেগে উঠে গম্ভীর গলায় বলল, কে রে?

চোর কি আর তখন ত্রিসীমানায় থাকে? চোর ধরতে হলে কখনও আওয়াজ দিতে নেই। নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নাকি হঠাৎ সাপটে ধরতে হয়। কিন্তু সে সাহস এ বাড়ির কারও আছে বলে মনে হয় না। তবে মাঝরাতে বেশ একটা হই-হই হল আমাদের বাড়িতে। বাঁটুল চোর কথাটা উচ্চারণের সঙ্গে-সঙ্গে প্রথমে ঠাকুমা, তারপর ভৈরবকাকা এবং তারপর ঘুম ভেঙে বাড়ির প্রায় সবাই আতঙ্কে বিকট গলায় চোর! চোর! চোর! চোর! করে চেঁচাতে লাগল। কিন্তু কেউ দরজা খুলে বেরোয় না। পাড়ার লোক যখন জড়ো হল তখন চোর তার বাড়িতে গিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুম দিচ্ছে।

কিন্তু আমরা বাড়িসুদ্ধ লোক সেই যে জেগে গেলাম তারপর আর সহজে কেউ ঘুমাতে গেল না। আলনা থেকে ঠাকুমার থানধুতি ছাড়া চিনির একটা সোয়েটার আর ভৈরবকাকার একটা পুরনো পাজামা চুরি গেছে। পুরনো পাজামাটার জন্য দুঃখের কিছু নেই, ওটা ঠাকুমা ন্যাতা করবে বলে এনে রেখেছিল। কিন্তু তবু এই চুরি উপলক্ষ করেই বাড়িতে মাঝরাতে সিরিয়াস আলোচনাসভা বসে গেল। এমনকী এক রাউন্ড চা পর্যন্ত হয়ে গেল। সেই চা করতে রান্নাঘরে যেতে হল আমাকেই, সঙ্গে অবশ্য পিসি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ভৈরবকা বললেন, চোরেদের নিয়ম হল, চুরি করে গেরস্তবাড়িতে পায়খানা করে যায়।

বাবা বললেন, দূর! ও সব সেকেলে চোরদের নিয়ম।

তবু দেখা যাক।

বলে ভৈরবকাকা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ আর বিরাট লাঠি হাতে বেরোলেন। সঙ্গে আমাকে আর বাঁটুলকে নিলেন। বললেন, আমার চোখ তো আর অত বেশি তেজি নয়। তোরা একটু নজর করতে পারবি।

ভয়ে আমার হাত পা হিম হয়ে আসছিল। বাটুল তার এয়ারগান বগলদাবা করে আমাকে ভরসা দিয়ে বলল, কোনও ভয় নেই রে মেজদি, এয়ারগানের সামনে পড়লে চোরকে উড়িয়ে দেব।

আমি বললাম, হু! খুব বীর।

টর্চ জ্বেলে ভিতরের মস্ত উঠোন আর বাইরের বাগান খুঁজে দেখা হল। কোথাও সে রকম কিছু পাওয়া গেল না।

তখন ভোর হয়ে আসছে। ভৈরবকাকা বললেন, আর শুয়ে কাজ নেই। চল, মর্নিং ওয়াকটা সেরে আসি।

বেড়িয়ে ফেরার পথে মল্লিকদের বাড়ির বাগানে অনেক বেলফুল দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। ওদের বাড়িতে কুকুর নেই। তাই নিশ্চিন্তে ফটক খুলে ঢুকে এক কোঁচড় বেলকুঁড়ি তুলে ফেললাম। ভিজে ন্যাকড়ায় ঢাকা দিয়ে রাখলে বিকেলে ফুটে মউ মউ করবে গন্ধে। ফুল তুলছি আপনমনে, এমন সময় হঠাৎ বাড়ির ভিতর থেকে একটা বিদঘুঁটে হারমোনিয়ামের শব্দ উঠল। খুব অবাক হয়েছি। এ বাড়িতে গানাদার কেউ নেই হারমোনিয়ামও নেই জানি। তবে?

সারেগামার কোনও রিডেই সুর লাগছে না। সেই সঙ্গে আচমকা একজন পুরুষের গলা বেসুরে মা ধরল। এমন হাসি পেয়েছিল, কী বলব!

ভৈরবকাকা কাকভোরে জাম্বুবানের মতো ফটকের বাইরে লাঠি আর টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে। হারমোনিয়াম শুনে তিনি বললেন, কাটুসোনা, চলে আয়। বাঁটুল ফুল চুরিতে আগ্রহী নয় বলে একটু এগিয়ে গেছে।

এ বাড়িতে ফুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লেও আমার ভয় নেই। বলতে কী এ বাড়িতে আমার কিছু অধিকারও আছে। এ বাড়ির ছোট ছেলে অমিতের সঙ্গে বহুকাল হল আমার বিয়ের কথা ঠিকঠাক। সে আমেরিকা থেকে এক ফাঁকে এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। আমিও তৈরি।

ভৈরবকাকা অবশ্য ফুল চুরির ব্যাপারটা পছন্দ করছেন না। কারণ হবু বউ ভাবী শ্বশুরবাড়িতে ফুল চুরি করতে এসে ধরা পড়লে ব্যাপারটা যদি কেঁচে যায়। তাই উনি তাড়া দিয়ে বললেন, সব জেগে পড়েছে। পালিয়ে আয়। অত ফুল তোর কোন কাজে লাগবে শুনি?

মনে মনে বললাম, মালা গাঁথব।

মুখে বললাম, একটু দাঁড়াও না। এ বাড়িতে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে কে?

কে জানে! তবে ওদের একটা মাথা-পাগলা গোছের ভাই এসেছে কলকাতা থেকে শুনেছি। সে-ই বোধ হয়।

কী রকম ভাই?

সে কত রকম হতে পারে। পিসতুতো, মাসতুতো, খুড়তুতো, জ্ঞাতির কি শেষ আছে! কে জানে?

আমি খুশি হতে পারি না।

হারমোনিয়ামটা তারস্বরে বিকট আওয়াজ ছাড়ছে। সঙ্গে গলাটা যাচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য সুরে। যাকে বলে বেসুরের সঙ্গে বেসুরের লড়াই।

আমি কোঁচড় ভরতি ফুল নিয়ে চলে আসি। ভৈরবকাকাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি দেখেছ লোকটাকে?

লোকটা নয়, ছেলেটা। একেবারে পুঁচকে ছোকরা। টাউন ডেভেলপমেন্টের চাকরি নিয়ে এসেছে। কিছু দিন হল। সে দিন দেখি প্রকাণ্ড একটা পাকা কাঁঠাল নিয়ে বাজার থেকে ফিরছে। পিছনে-পিছনে দুটো গোরু তাড়া করাতে মালগুদামের রাস্তা দিয়ে দৌড় দিচ্ছিল। তাই দেখে সকলে কী হাসাহাসি।

মল্লিকবাড়ি এখন অবশ্য ফাঁকাই থাকে। ছেলেরা সবাই বিদেশ-বিভুয়ে চাকরি করে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। থাকার মধ্যে বুড়ো আর বুড়ি। অবশ্য বুড়োবুড়ি বলতে সাঙ্ঘাতিক বুড়োবুড়ি তারা নন। আমার হবু শাশুড়ির চেহারায় এখনও যৌবনের ঢল আছে। হবু শ্বশুরমশাই এখনও বাহান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে দিনে চার মাইল করে হেঁটে আসেন। দরকার হলে সাইকেলও চালান।

হারমোনিয়ামের শব্দটা বহু দূর পর্যন্ত আমাদের তাড়া করল।

রাস্তার মোড়েই দাঁড়িয়েছিল বাঁটুল। ভৈরবকাকাকে এগিয়ে যেতে দিয়ে আমি আর বাঁটুল পাশাপাশি হাঁটছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁ রে বাঁটুল, মল্লিকবাড়িতে কে নাকি এসেছে?

হ্যাঁ। পাগলা দাশু।

তার মানে?

অমিতদার ভাই। সবাই তাকে পাগলা দাশু বলে ডাকে।

কেন?

কী জানি? লোকটার একটু ট্যানজিস্টার শর্ট আছে।

বাঁটুলের সব কথাই অমনি। ভাল বোঝা যায় না। তবে একটা আন্দাজ পাওয়া যায় ঠিকই। বললাম, সত্যিকারের পাগল নাকি?

না, না। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে রোজ বাঘাযতীন পার্কে ফুটবল খেলতে যায় সে। গোলকিপিং করে। কিন্তু একদম পারে না। বল হয়তো ডান দিক দিয়ে গোলে ঢুকছে, সে বাঁ দিকে ডাইভ দেয়। আমরা হেসে বাঁচি না।

তবে খেলায় নিস কেন?

বাঁটুল গম্ভীর হয়ে বলে, না নিয়ে উপায় আছে? এ পর্যন্ত তিনটে রাশিয়ান টাইপের ফুটবল কিনে দিয়েছে তা জানিস? এক-একটার দাম ষাট-সত্তর টাকা।

ভূত বা চোরের মতো পাগল আর মাতালদেরও আমার ভীষণ ভয়। কিন্তু যারা পুরো পাগল নয়, যারা আধপাগলা খ্যাপাটে ধরনের তাদের আমার কিন্তু মন্দ লাগে না। এই যেমন ভৈরবকাকা। খুঁজে দেখতে গেলে ভৈরবকাকা আমাদের রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়। জ্ঞাতি মাত্র। বিয়ে শাদি করেনি, একা-একা একটা জীবন দিব্যি কাটিয়ে দিল। সাত ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে গত পনেরো-ষোলো বছর আমাদের পরিবারে ঠাই নিয়েছে। বিয়ে না করলে একটা বাই বাতিক হয় মানুষের। সব সময়েই উদ্ভট সব চিন্তা আসে মাথায়। ভৈরবকাকাও তাই। খামখেয়ালি, রাগী, অভিমানী আবার জলের মতো মানুষ। এমন লোককে কার না ভাল লাগে? আমার তো বেশ লাগে। খ্যাপামি না থাকলে মানুষের মধ্যে মজা কই? আমার বাপু বেশি ভাবগম্ভীর হিসেবি লোক তেমন ভাল লাগে না। রবি ঠাকুরের বিশু পাগলা বা ঠাকুরদার মতো চরিত্র আমার বেশি পছন্দ।

আমি বাঁটুলকে জিজ্ঞেস করি, পাগলা দাশু আর কী কী করে?

বাটুল বলে, সে অনেক কাণ্ড। ছুটির দিনে নতুন পাহাড় আবিষ্কার করতে একা-একা চলে যায়। নতুননতুন গাছ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। তা ছাড়া সাইকেলে চড়া শিখতে গিয়ে রোজ দড়াম-দড়াম করে আছাড় খায়। গান শিখবে বলে লিচুদিদের পুরনো হারমোনিয়ামটা দুশো টাকায় কিনে এনেছে।

দুশো টাকা?– বলে আমি চোখ কপালে তুলি।

লোকটা বোকা আছে মাইরি রে।

ফের মাইরি বলছিস?

বাঁটুল জিব কাটল।

আমি ভাবছি একটা লোক আমার ভাবী শ্বশুরবাড়িতে এসে খানা গেড়েছে, বাঁটুলদের সঙ্গে ভাব জমিয়েছে, লিচুদের হারমোনিয়াম কিনেছে, আর আমি লোকটার কোনও খবরই রাখতুম না!

সকালে আজ অনেক বেশি কাপ চা আঁকতে হল। চোরের খবর নিতে পাড়ার লোকজন এল। দারোগা কাকা নিজে তদন্তে এলেন। ভারী হাসিখুশি ভুড়িওলা প্রকাণ্ড মানুষ। চুরির বিবরণ শুনে বাঙাল টানে বললেন, চোরের ইজ্জত নাই, নিতে নিল ভৈরবদার পাজামাখান? ইস্। কপাল ভাল যে ভৈরবদারে দিগম্বর কইরা পরনের লুঙ্গিখানা লইয়া যায় নাই।

বলতে বলতে নিজেই হেসে অস্থির। চোখে জল পর্যন্ত চলে এল হাসতে হাসতে।

ভৈরবকা রেগে গিয়ে বলেন, তোমাদের অ্যাডমিনস্ট্রেশন দিনে দিনে যা হচ্ছে তাতে পরনের লুঙ্গিও টেনে নেবে একদিন ঠিকই। তার আর বেশি দেরিও নেই। ঘরের বউ, বেটাবেটিকেও টেনে নিয়ে যাবে।

দারোগাকাকা রাগবার মানুষ নন। তার দুই প্রিয় জিনিস হল শ্যামাসংগীত আর জাপান। একটা শুনলে আর অন্যটা খেলে তার দুই চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসে। চায়ের পর জাপান খেয়ে এখনও তাঁর চোখ ঢুলুঢুলু করছিল। বলেন, অ্যাডমিনস্ট্রেশন তো আমরা চালাই না, চালায় গবর্নমেন্ট। যদি গবর্নমেন্টটাকে চালায় তয় কইতে হয় ভূতে।

ভৈরবকাকা চেঁচিয়ে বলেন, আলবত ভূতে। তোমাদের গোটা অ্যাডমিনস্ট্রেশনটাই আগাগোড়া ভূতের নৃত্য। চুরি বাটপারি, রেপ রাহাজানি এভরিথিং তোমাদের নলেজে হচ্ছে। প্রত্যেকটা সমাজবিরোধীর কাছ থেকে তোমরা রেগুলার ঘুষ খাও।

দারোগাকাকা অবাক হওয়ার ভান করে বলেন, ঘুষ খামু না ক্যান? ঘুষের মধ্যে কোন পোক পড়ছে?

ভৈরবকাকা উত্তেজিতভাবে বলেন, না ঘুষে পোকা পড়বে কেন? পোকা পড়েছে আমাদের কপালে।

দারোগাকাকা আবার ভুড়ি দুলিয়ে হেসে বলেন, আপনের গেছে তো একখান ছিড়া পায়জামা, হেইটার লিগ্যাই এই চিল্লা-চিল্লি? তা হইলে সোনাদানা গেলে কী করতেন?

ছেঁড়া পায়জামাই বা যাবে কেন? ইফ দি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইজ গুড দেন হোয়াই ছেঁড়া পায়জামা

ভৈরবকাকা ইংরিজিতে আর থই না পেয়ে থেমে যান। আমরা হাসতে হাসতে বেদম হয়ে পড়ি।

ভৈরবকাকা উত্তেজনা সামলে নিয়ে আবার বলেন, ছেঁড়া পায়জামাটা কোনও ফ্যাকটর নয়, ফ্যাকটর হল চুরিটা। আমার প্রশ্ন, চুরি হবে কেন?

দারোগাকাকা বলেন, কুত্তা পোষেন।

কুকুরই বা পুষতে হবে কেন?

তা হইলে চুরিও হইব।

আর তোমাদের যে পুষেছি। এত দারোগা পুলিশ যে সরকার রেখেছে আমাদের ট্র্যাক থেকে নিয়ে?

কই আর পুষলেন। ভাবছিলাম চাকরি ছাইড়া দিয়া আপনের পুষ্যিপুত্তুর হমু। কিন্তু আপনে তো কথাটা কানেই লন না।

কথায় কথায় পলিটিকস এসে গেল এবং তুমুল উত্তেজনা দেখা দিল। আরও দু’ রাউন্ড চা করতে হল। পরে দারোগাকাকা উঠতে উঠতে বললেন, চোরটারে ধরতে পারলে এমন শিক্ষা দিমু যে আর কওনের না। হারামজাদায় জানে না, ভৈরবদার ছিড়া পাজামা আমাগো ন্যাশনাল প্রপার্টি।

এ সব গোলমাল মিটলে বাড়িটা একটু ঠান্ডা হল। ভৈরবকাকার বদলে আজ দাদা বাজার করে এনেছে। ফলে রান্নাঘরে আমরা সবাই ব্যস্ত। এক প্রস্থ জলখাবার হবে, সেই সঙ্গে বাবার আর দাদার অফিসের ভাতও।

জলখাবারের চচ্চড়ির আলু ধুতে গিয়ে কুয়োর পাড়ে দেখি, চিনি বাড়ির মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে পড়তে উঠে এসে পুতুল স্নান করাচ্ছে।

বললাম, অ্যাই, মাস্টারমশাই বসে আছেন না?

ছোড়দার অঙ্ক দেখছেন তো!

তা বলে তুই এই সাতসকালে পুতুল খেলবি? যা।

সে গুটি-গুটি চলে যায়। ওর সোয়েটারটা গেছে আমার দোষেই। সামনের শীতের জন্য প্যাটার্ন তুলতে ওটা নিয়েছিল লিচু। কালই ফেরত দিয়ে গেছে। আলিস্যির জন্য আমি ওটা তুলে না রেখে ঠাকুমার ঘরে আলনায় ঝুলিয়ে রেখেছিলাম।

কালও কই হারমোনিয়ামটা নিয়ে একটা কথাও তো বলেনি লিচু। আচ্ছা সেয়ানা মেয়ে যা হোক। ওদের বাড়িতে কখনও গান তুলতে গেলে ওই হারমোনিয়াম দেখলেই আমার হাসি পায়। মাগনা দিলেও নেওয়ার নয়। পাগলা দাশুকে খুব জক দিয়েছে ওরা।

গোমড়ামুখো দাদা কুয়োর পাড়ে এসে সিগারেট ধরাচ্ছে। বাথরুমে যাবে। দেশলাইটা কুয়োর কার্নিশে রেখে বলল, ঘরে নিয়ে যাস তো। নইলে কাক ঠোঁটে করে তুলে পালায়।

পাগলা দাশুকে চিনিস দাদা?

কোন পাগলা দাশু?

মল্লিকদের বাড়িতে যে এসেছে।

ও, অসিতের ভাই। পাগলা নয় তো। পাগলা হতে যাবে কেন?

কথাটা তুলেই আমার লজ্জা করছিল। ব্যাপারটা এত অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু ওই হারমোনিয়াম কেনার কথাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না যে! লিচুরা আচ্ছা ছোটলোক তো! কী বলতে ওই অখাদ্য হারমোনিয়ামটার জন্য দুশো টাকা নিল?

বাইরের ঘরে একটা বাজখাই গলা শুনে কুয়োতলা থেকেও বুঝতে পারলাম, মল্লিকবুড়ো অর্থাৎ আমার হবু শ্বশুর এসেছেন। চোর আসার খবর পেয়েই আসছে সবাই।

চচ্চড়ির আলু ধুয়ে রান্নাঘরে যেতেই মা বলল, বীরেনবাবুর চা-টা তুই-ই কর।

বীরেনবাবু অর্থাৎ মল্লিকবুড়োর চায়ে বায়নাক্কা আছে। দুধ বা চিনি চলবে না, লিকারে শুধু পাতিনেবুর রস মেশাতে হবে তাও টক চা হলে চলবে না। লিকারে শুধু একটু গন্ধ হবে।

আমি বাগানে পাতিলেবু আনতে যাওয়ার সময় বৈঠকখানার দরজায় পরদার আড়ালে পঁড়িয়ে শুনতে পেলাম মল্লিকবুড়ো বলছেন, শেষ রাতে তো শুনলাম আমার বাগানেও চোর ঢুকেছিল। আমার ভাইপো কানু দেখেছে, ছুকরি একটা চোর বেলফুল তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সাড়াশব্দ পেয়ে পালিয়ে যায়।

বাবা বললেন, ও। সে তো ফুলচোর!

আমি রাঙা হয়ে উঠলাম লজ্জায়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress