প্রেম ট্রেম
বিনা দোষে বিবাহ ভঙ্গের সেই ঘটনা থেকে জমশের আলীর মনে অনেক কষ্ট জমে আছে। এমনটি হয়েছিল জীবনে সেই প্রথমবার বিবাহ করতে যেয়ে। বড় সখ করে মাথায় পাগড়ি পরে বর সেজে সলজ্জ মুখে রুমাল চাপিয়ে বিবাহের আসরে বসেছিল বাঞ্ছারামপুরের গনি মিঞার বাংলায়। মৌলভী সাহেব তখন সবেমাত্র সুরেলা নাকি সুরে তার বিয়ে পড়ানোর পোষা গৎখানি আওড়াতে শুরু করেছেন, বাড়ৈখালী গ্রামের বাবর আলী হাওলাদারের জ্যেষ্ঠ পুত্র জমশের আলী হাওলাদারের সহিত বাঞ্ছারামপুরের গনি মিঞার কনিষ্ঠা কন্যা মোসাম্মৎ শরিফা আক্তারের এক হাজার এক টাকা দেন মোহরানায় ইসলামী শরিয়ত বিধি মোতাবেক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইতে… রাজি আছি হুজুর, আমি রাজী আছি। আলহামদু… জমশের আলীর আর তর সইছিল না। মৌলভী সাহেবের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আলহামদুল্লিাহ্ বলতে না বলতেই বিবাহের আসরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছিল শরিফা আক্তারের মারমুখো প্রেমিক আর তার জঙ্গী সাকরেদের দলবল। তাদের বেধড়ক ঠ্যাঙ্গানীর চোটে ত্রাহি ডাক ছেড়ে লেজে গোবরে হয়ে জমশের আলীকে নদী সাঁতরে পালাতে হয়েছিল বিবাহের আসর ছেড়ে। সেই থেকেই
মুরব্বীদের পাতানো বিয়ে শাদিতে জমশের আলীর আর ভক্তি নেই। মুরব্বীদের দিয়ে কোনও কাজ হয় না। শাকিল মিয়া বাইয়ের রায়ই ঠিক। আসল বিবাহ হলো প্রেমের বিবাহ। তাতে ঝুট ঝামেলা কম। মিয়া বিবিতে ডাইরেক্ট কায়-কারবার। সেই থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ জমশের আলী। বিবাহ হলে প্রেম করেই হবে। নইলে নয়। এই তার সাফ কথা।
জমশের আলী কিন্তু বসে নেই। চাচাত ভাই শাকিল বদরুদ্দিনের এক্সপার্ট সহায়তায় একটি লাগসই প্রেমিকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে এখনও উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি। মহল্লার মেয়ে মরিয়মের সাথে বাল্যবন্ধু নুরুজ্জামানের প্রেমলীলার সিন-সিনারি দেখে জমশের আলীর নিজেকে খুব দুর্ভাগা মরদ মনে হয়। হোকনা মরিয়মের গায়ের রং ময়লা। চোপড়া ভাঙ্গা। এক চোখ ট্যারা। সামনের দাঁত উঁচু। তবুও প্রেমিকা তো! প্রেমিকাকে বগলদাবা করে পাবলিকের নাকের ডগার ওপর দিয়ে বেড়ানো খেলানোর মজার সাথে কি আর কিছুর তুলনা হয় ? একদিন পরম কৌতুহলে জমশের আলী শাকিল বদরুদ্দিনের কাছে জানতে চেয়েছিল,
– আইচ্ছা আপনে যে এত প্রেম ভালবাসার সুপারিশ করেন, প্রেমিকারা মোদের কি দ্যায় মিঞাভাই ?
– কী দেয়না তাই ক, ছাগল!
বিজ্ঞের স্বরে ধমকে ওঠে জমশের আলীর চাচাত ভাই শাকিল বদরুদ্দিন, যিনি স্বয়ং একজন সফল পেশাদার প্রেমিক। এবং জমশের আলীর প্রেমবিষয়ক ব্যাক্তিগত উপদেষ্টাও বটে।
– প্রেমিকারা সুখ দেয়। প্রেমিকারা জান্নাত দেয়। সারাবান তহুরায় তৃষ্ণার নিবারণ দেয়। কনকনা ঠান্ডায় ওম দেয়। ঠনঠনা রোদে ছায়া দেয়। প্রেমিকা রমণীর গায়ের রং যদি অয় কুচকুইচ্চা কালা, হেরে তর কাছে মনে অইবে হুর পরীর নাহাল ধলা। প্রেম অইলে তোর চোখের রং বদল অইয়া যাইবে। সান গেলাসের জরুরত নাই।
শাকিল বদরুদ্দিনের মুখে প্রেমের ইত্যাকার নিগুঢ় মাহাত্ন্যের বর্ণনায় জমশের আলী ভাবে – আহারে! না জানি কী জান্নাতি জিনিষ এই প্রেম! দিবা নিশি সুগভীর প্রেম ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকে আযৈাবন প্রেম পিয়াসী জমশের আলী হাওলাদার।
লতা মঙ্গেশকরের একখানি গান জমশের আলীর বড় পেয়ারের। প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে। স্যানিও টেপ রেকর্ডারে জমশের আলী বার বার এই গানটি শোনে আর মনে মনে বলে –
– মনে কষ্ট নিয়েননা গো লতা আফা। তবু তো আপনার জীবনে প্রেম একবার আইসেছিল। আমারতো কোন দিন কপালই খুললোনা। আহারে! প্রেম এক্কেরে উডান তক আইসা ফিরা চইলা গেল আর আপনি ইট্টুও টের পাইলেননা! কী যে বেখেয়ালী আপনে লতা আফা! জমশের আলী মনে মনে তার প্রিয় শিল্পীর ওপর বিরক্ত হয়। তয় মনে অয় হেইডা আপনের পোলাপান কালের কথা। আহারে! অত অল্প বয়সে পরাণে কি আর সাহস থাকে ? প্রিয় শিল্পীর জন্য জমশের আলীর মন দরদী হয়ে ওঠে। তয় পরে আপনে ক্যামনে গাইছিলেন, পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া? বুচ্ছি লতা আফা, আপনে তহন ডাঙ্গর অইয়া গেছিলেন।
প্রেমের ব্যাপারে জমশের আলীর অভিজ্ঞতা বড় একটা সুখকর কিছু নয়। তবে চেষ্টার ত্রুটি সে করেনি। প্রেমের কারণে মেয়ে মানুষের মুখ ঝামটা, মহল্লার মাস্তানদের লাথি গুঁতা আর মসজিদের ইমাম সাহেবের জুতার বারি কম তো আর যায়নি এই শরীরটার ওপর দিয়ে! কিন্তু কোথাও তো ক্লিক করল না এই পর্যন্ত। কী কপাল নিয়ে যে এই দুনিয়াতে জনম হয়েছে! শালার বয়সে ভাটি লেগে যায় তবু প্রেম হয় না। প্রেমের প্রতীক্ষায় থেকে অধৈর্য হয়ে ওঠে জমশের আলী। সকাল বিকাল শাকিল বদরুদ্দিনের কানের কাছে প্যানপ্যান করে,
– মিয়াবাই, অখনোতো প্রেমের কোন আলামত দ্যাখতাছি না। প্রেম কি আর অইবে আমার ?
– ধৈর্য হারাইলে তো কাম অইবে না জমশের মিঞা ! এত সহজে কি প্রেম হয় ? দিবা নিশি মাইয়াগো পেছনে লাইগা থাকা লাগে। নানান পদের নানান রসের আলাপে তাগোর মন জয় করতে হয়। তোরে না কইছিলাম গার্মেন্টের গেটের সামনে গিয়া সকাল- বিকাল মাইয়াগো লগে ফিল্ডিং মারতে?
– আপনার কথায় তো লাগাতার লাইগা আছি মিঞাবাই! কোন ফলাফল নাই! আপনের সেলামী দিতে দিতে পকেটের পাত্তি সব শ্যাষ!
– অইবেরে মনু, প্রেম অইবে তোর দেখিস। একটু ধৈর্য ধর বাইডি আমার। প্রেম একবার অইয়া গেলে মধুর চাকে মুখ লাগাইয়া চুক চুক কইরা প্রেমের মধু খাইবানে। তখন আমার কথা মনে অইবে, দেইখ।
মাথা নিচু করে খিক্ খিক্ হাসে জমশের আলীর পেশাদার পরামর্শদাতা শাকিল বদরুদ্দিন। জমশের আলীর স্বপ্নীল চোখের সামনে লাইন ধরে ভাসতে থাকে রাশি রাশি মৌমাছি, মধুর চাক, মধুর ফোঁটা। ফুল লতা পাতা। চাঁদ তারার রাত। নদীর কুলে ফুরফুরে হাওয়া। কোলে এলায়িত সোনালী প্রেমিকা। আহারে! দুনিয়াডাইতো জান্নাত মিয়া ভাই!
ঘরের কাজ কর্মের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথা বলে জমশের আলী বাড়ির মালকিন প্রফেসর ইশরাত জাহানের সাথে।
– আপনের পরানে অনেক মহব্বত গো আফা বেগম! আইজ কত বছর ধইরা মানইষের বাসায় কাম করি। কোন মেম সাহেব আপনের মতন এমন আদর মহব্বতের সাথে কথা কয় না।
– কেন, কি বলে তারা ?
– কথায় কথায় ধমক মারেগো আফা বেগম। পান থনে চুন খসলে বইকা ঝারা ঝারা করে। সামান্য গলতি অইলে চাকরি থনে ফায়ার করে।
Ñ K_vq K_vq agK gv‡i †Mv Avdv †eMg| cvb †_BKv Pzb Lm‡j eBKv Svov Svov K‡i| mvgvb¨ Aciv‡a PvKwi _‡b dvqvi K‡i|
– তুমি কখনো চাকরি থেকে ফায়ার্ড হয়েছ, জমশের?
– অইছি না তয় ? ধানমন্ডির এক মেম সাবের শুচিবাই ছেল। এক কাম দশবার করলেও তেনার মনে ধরে না। মাছ ধোয়ানের সময় ধুইতে ধুইতে মাছের কাঁটা বাহির অইয়া যায় তবু বলে হয় নাই আরো ধোও। একদিন একটু ঠাট্টা কইরে কয়েছিলাম- এক কাম করেন মেমসাব। মাছগুলাইনরে লন্ড্রি থনে ধুইয়া আনেন।
– তোমার মেমসাহেব তখন কী বলল ?
– হ্যায় তো খুব চইটে গেলেন। আামারে শুয়োরের বাচ্চা কুত্তার বাচ্চা বইলে গালি দেলেন। তারপরও দেহি উনার শরীলের জেদ কমে না। শ্যাষে কিচেন থনে বাইরে ধাক্কা দিয়া মোরে কইলেন-
– আউট আউট! ইউ ফায়ার্ড! চাকরি চইলা গেল।
জমশের আালীর চাকুরী হারানোর গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং। ইশরাত জাহান বেশ মজা পেলেন।
– এই সমান্য কারণে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করাটা অবশ্য তোমার মেম সাহেবের একটু বাড়াবাড়িই হয়েছিল। কিন্তু দোষ তো তোমারও কিছু ছিল জমশের। লন্ড্রি থেকে কেউ মাছ ধোয় নাকি ?
– ঠিকই কইছেন আফা বেগম। ওনার দিগদারিতে মাথায় দুষ্টামি এয়ে গেছল।
– আচ্ছা জমশের তুমি আমাকে আফা বেগম বল কেন ? এটা কেমন ডাক?
– কি কমু তয়! আপনের নাহাল জোয়ান জাহান জেনানারে খালাম্মা কইলে মানায়না গো। আবার খালি আফা কইলে যে পোলাপান পোলাপান লাগে! সাথে বেগম কথাডা থাকলে অনেক মূল্য হয়। কত বড় মানুষ আপনে। কত মানসম্মান আপনের আফা বেগম!
অকাট্য যুক্তি বটে! ইশরাত জাহান ভাবেন জমশের আলীর মতো বোকা সোকা মানুষদের প্রকাশ শৈলীটা জলো হলেও চিন্তা ভাবনা ওদের কত সরল আর নিষ্কলুষ। প্রকাশে অতিরঞ্জনের প্রলেপ নেই। ডিসেপশনের চোরাই মারপ্যাঁচ নেই। এরা যা বলে তা এদের অন্তর্নিহিত অনুভব আর মননেরই সৎ প্রকাশন। অতএব প্রশংসার দাবীদার অবশ্যই। প্রফেসর ইশরাত জাহানের ঠোঁট টেপা হাসির প্রশ্রয়ের মধ্য দিয়ে জমশের আলীর আফা বেগম সম্বোধনটি অনুমোদন পেয়ে যায়। জমশের আলী অবশ্য সেটা লক্ষ্য করে না। যুক্তিটি পেশ করেই কী একটা কাজে যেন কিচেনের দিকে চলে যায়।
প্রফেসর ইশরাত জাহানের বাসায় সপ্তাহে তিন দিন গৃহ পরিচারকের চাকরি জমশের আলীর। একদিন ডিউটিতে এসে দেখে বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছেন ইশরাত জাহান।
– ইশ! জ্বরে গা পুইড়া যাইতাছে গো! জমশের আলী হাতের তালু ইশরাত জাহানের কপালে ঠেকিয়ে জ্বর দেখল একবার। জমশেরের হাতে সিগারেটের গন্ধ। নাক সিঁটকে অন্যদিকে মুখ ফেরালেন ইশরাত জাহান।
– এত বড় বাড়িডায় একলা একলা থাহেন। আত্মীয়স্বজনের সাথেও সম্বন্ধ রাখেন না। অসুখে বিসুখে আপদে বিপদে কে দ্যাখে আপনেরে ? আমারেও তো একটা খবর দিতে পারতেন আফা বেগম!
জমশের আলীর কন্ঠে প্রচ্ছন্ন অভিমান। মনে মনে হাসেন ইশরাত জাহান। জমশের আলীর এই অননুমোদিত শাসনটুকু তার কাছে এই মুহূর্তে ঔদ্ধত্য নয় বরং আন্তরিক এবং প্রগাঢ় মমতাবহ বলেই মনে হয়। এমন প্যামপার্ড হওয়ার মতো কোনও ঘটনাতো তার জীবনে আর ঘটে না।
– স্যরি জমশের আলী। দু‘দিন খুব জ্বর যাচ্ছে। স্টামাকটাও ভালো নেই। সকালে দু’বার বমি হয়েছে। তোমার তো আজ আসার কথা ছিল না জমশের ?
– আইজ সকাল থনেই আপনার কথা খুব মনে অইতাছিল আফা বেগম। মনডা কেমন য্যান গাওয়া দিতাছিল আফা বেগমের কোন বিপদ আপদ অইলনাতো ? তাই আটতে আটতে চলিয়া আসি।
অতঃপর জমশের আলী নিপুন হাতে নিবেদিত সেবিকার মতো কিছু কাজ করে গেলো। বাথরুম থেকে বালতি করে পানি নিয়ে এলো। বিছানায় শোয়া অবস্থায়ই ইশরাত জাহানের ঘাড়ের নিচে একটি প্লাস্টিক শীট বিছিয়ে মাথা ধুইয়ে দিল। টাওয়েল দিয়ে খুব যত্নের সাথে মাথা মুছে দিল। ড্রেসিং টেবিল থেকে একটা চিরুনি এনে ইশরাত জাহানের হাতে দিয়ে বলল-
– মাথাডা একটু ঠিকঠাক করেন আফা বেগম। আয়নাডার মইদ্দে চাইয়া দ্যাহেন চেহারাডারে কি বানাইয়া রাখছেন!
তারপর বিছানার পাশে দেয়ালে একটা বালিশ ঠেকিয়ে খুব লো স্পীডে পাখা ছেড়ে দিয়ে বলল-
– আপনি এখানে একটু আরাম কইরা বসেন আফা বেগম। আমি আপনার জন্যে গরম দুধ পাকায়ে আনি। কতদিন পেটে দানাপানি পড়ে নাই কে জানে! অযত্নে অবহেলায় শরীলডারে পাখির নাহাল পাতলা বানাইয়া ফালাইছেন।
গজ গজ করতে করতে জমশের আলী কিচেনের দিকে চলে গেল। ইশরাত জাহান জমশের আলীর এইসব গায়ে পড়া কর্মকাণ্ডে একটু বিরক্তিই বোধ করছিলেন। দু‘একবার বাধা দিতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত চুপ করে গেলেন। ইশরাত জাহান দেখলেন ঘরের কাজ সেরে জমশের আলী দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে হাতে কিছু একটা নিয়ে আবার ফিরে এলো জমশের।
– আবার যে ফিরে এলে জমশের!
জমশের আলী এক গাল হেসে বলল-
– আপনের জন্যে দাওয়াই নিয়া আইলাম আফা বেগম। ডাক্তার সাহেব আসলেন না! অষুদ দিলেন। হোমিপ্যাথিক অষুদ। দিনে একটা কইরা পুরিয়া আর দুইটা বড়ি যত্ন করিয়া খাইবেন। রোগবালাই তফাত! নিয়মিত সেবনে যেন অন্যথা না হয় আফা বেগম। আমি আবার কাইল আইমুনে। এখন তাইলে আমি যাই আফা বেগম?
– একটু বসে যাওনা জমশের। তোমার সাথে একটু গল্প করি।
খুব একাকী লাগছিল ইশরাত জাহানের। জমশের আলী কিচেন থেকে একটা মোড়া এনে মেঝের উপর যুত করে বসল।
– তয় বলেন আফা বেগম। তয় আমেরিকার গল্প করেন।
– আরে ধূর! আমেরিকার গল্প খুব কঠিন। ওসব তুমি বুঝবে না।
অসুস্থতার সময় খুনসুটি করতে ইশরাত জাহানের খুব ভালো লাগে। মাথার দুষ্টুমি বুদ্ধিগুলো বেশ খোলতাই হয়ে ওঠে। হেসে জিজ্ঞেস করলো,
– আমাকে তোমার কেমন লাগে জমশের আলী ?
– খুবই বালা লাগে আপনেরে আফা বেগম। কত সুন্দর মানুষ আপনে! দ্যাখতে শুনতে কত বাহারের। মনটাও কী পরিষ্কার! আপনার মতন মানুষ অয়?
– সুন্দর হলাম কেমন করে? দেখছ না আমার গায়ের রং কেমন কালো?
– কী যে কন আফা বেগম! কে কইছে আপনার গায়ের রং কালা ? আপনার গায়ের রঙ অইল সেগুন কাঠের নাহাল দুআসলা। কালাও না আবার দলাও না। আলাদা রকম রোশনাই। গায়ের রঙ দিয়া কি অয় আফা বেগম? মানুষের মনের রঙডাই অইল আসল জিনিষ।
প্রফেসর ইশরাত জাহান অনেক কষ্টে হাসি দমন করেন। জমশের আলী তার মনের রঙের সন্ধান পেল কেমন করে? অ্যাডমায়ারারদের মুখে নিজের রূপের প্রশংসা অনেক শুনেছেন এক কালে। তিনি জানেন তার গাত্রবর্ণটুকুকে টেনে টুনে বড় জোর উজ্জল শ্যামলা পর্যন্ত নেয়া যায়। তবে সেগুন কাঠের সাথে এই অভিনব তুলনা এই প্রথম। মনে মনে শমশের আলীর কাব্যিক প্রতিভার প্রশংসা করেন প্রফেসর ইশরাত জাহান।
এই জমশের আলী কবি পুরুষটি কি কোনও লীলাবতী রমনীর প্রেমিক ? কৌতূহলী হয়ে ওঠেন ইশরাত জাহান। উৎসাহী হয়ে জানতে চান –
– তোমার কি কোন ভালোবাসার মানুষ আছে জমশের ?
– নাগো আফা বেগম, অহনও আমার কারো সঙ্গে প্রেম হয় নাই। জমশের আলীর অবয়বে একটা অভাবী ছায়া ভেসে উঠে।
– তয় চেষ্টায় আছি আফা বেগম। শাকিল বাই কথা দিছেন। ইনশাআল্লাহ প্রেম হবে আমার। তারপর বিবাহ। প্রেম বিনা বিবাহ ঠিক নয়। শাকিল বাইয়ের নিষেদ আছে।
– খুব ভলবাসবে বুঝি প্রমিকাকে ?
– বাসবোনা তয়? আমার সাথে যার ভালবাসা হবে তারে আমি খুব মহব্বত করব। তারে আমি চখে চখে রাখব। তার বিপদে আপদে পাশে থাকব। আমি তারে কোনদিন ছাইড়ে যাব না।
ক্লাস রুমের মাপা কথার লেকচার নয়। অফিসে এক্সিকিউটিভ মিটিংয়ের এটিকেটের অনুশাসন নেই। নিজ গৃহের অবাধ স্বাধীনতায় ভালই লাগছে গৃহ পরিচারকের সাথে এই তরল কথোপকথন। জ্বরটা বুঝি আবারও ধেয়ে আসছে জোরে সোরে। কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নেন ভালো করে। এই অসুস্থতায়ও দুষ্টামি এসে ভর করে মাথায়।
– আচ্ছা জমশের, আমার সাথে তোমার প্রেম হলে কেমন হয় ?
– কী যে কন আফা বেগম কোথায় আপনে কোথায় আমি! আপনার প্রেম হবে সুট কোট আলা শিক্ষিত রইস আদমীগো লগে। আমারে কি আপনার সাথে মানায় আফা বেগম ? তেলে জলে কি মিশ খায় ?
মাথাটা বুঝি আবার ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। ধাই ধাই করে বাড়ছে জ্বরের ঘোর। জমশেরের কথার প্রতিবাদ করে ইশরাত জাহান।
– জমশের আলী, এটা যতটা না কালচারাল কিংবা ইকনমিক ম্যাচিংয়ের ব্যাপার তার চেয়েও অনেক বেশি রিলেশনশীপের কেমিস্ট্রির। পারস্পরিক সহমর্মিতা বন্ধুত্ব কেয়ার অ্যান্ড কনসার্নের। একজনের জন্য আরেক জনের রেসপেক্ট আর নির্ভরতার। আই ক্যান সি ইউ উড মেক আ গ্রেট লাভার জমশের! তোমার মানস জগতের কল্পিত প্রেমিকাটির জন্য তোমার অনুভব খাঁটি সোনার মত খাঁটি । তুমি ঠিকই বলেছ জমশের। ইউ আর এ্যাবসলিউটলি কারেক্ট! ইটস অ্যা ম্যাটার অব হাউ মাচ ইউ কেয়ার অ্যাবাউট হার। হোয়েদার ইউ আর প্রিপ্রেয়ার্ড টু বি দেয়ার হোয়েন শী নিডস ইউ। দ্যাট ইউ উইল নেভার লিভ হার। নো। নট ফর অ্যানাদার উইম্যান! নট ফর হার বেস্ট ফ্রেন্ড! নট ফর রিটা মল্লিক! অ্যান্ড ইউ উইল নেভার ইনসাল্ট হার লাইক দ্যাট। ইউ নো জমশের আলী, ভার্সিটিতে পড়ার সময় আই ইউসড টু স্টিল মানি ফ্রম মাই ড্যাডস পকেট টু পে ফর দ্য টুইশন ফিজ অব দ্যাট ফকিন্নী রিটা মল্লিক!
জমশের আলীর সাথে শুরু করা চটুল সংলাপ প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে ততক্ষণে প্রলাপের রূপ নিয়েছে। বিড়বিড় করে বকে চলেছেন ইশরাত জাহান। জমশের আলী বোকাটে মুখে অবাক চোখে চেয়ে থাকে। আফা বেগম কী বলছে কিছুই সে বুঝতে পারছে না। মনে হয় জমশের আলীর কথায় আফা বেগমের রাগ হয়েছে। রেগে গেলে শিক্ষিত মানুষরা নাকি ইংরাজিতে কথা বলে। আফা বেগমের মেজাজ পত্র এখন ঠিক নাই। এই সময় মানে মানে থাকাই ভালো। ইশরাত জাহানকে খুশি করার জন্য
– সান্ত্বনার স্বরে সে বলে –
– ঠিক আছে আফা বেগম। আপনার প্রস্তাব আমি বিবেচনা করব। শাকিল মিঞা বাইয়ের সাথে পরামর্শ করে আপনাকে জানাবো।
আস্তে ক’রে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বের হয়ে যায় জমশের আলী।
ইশরাত জাহান জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন ক’দিনের অঝোর বর্ষণের বন্দীত্ব কাটিয়ে সকাল বেলার শহর ঝিলমিলে সূর্যের নিচে মুক্তির শ্বাস নিচ্ছে। বাইরে যেতে লোভ লাগছে, কিন্তু শরীরে কুলোবে না। এমনিতেও আজকাল তেমন আর বাইরে বেরোন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ আর প্রয়োজনের কেনাকাটা ছাড়া বাইরে যাবার দরকারই হয় না। মনটা আজ একেবারই ভালো নেই। নির্বাসিত জীবনের এই অন্তহীন পর্যটন আর কত কাল বয়ে বেড়ানো যায়! ছুটি চাই, ঈশ্বর! সব কিছু থেকে এককালীন দীর্ঘ ছুটি চাই আমার! আব্বু বেঁচে থাকলে সময় এমন দুর্বহ হয়ে যেত না। আব্বুর ছায়াটা কাছে পাশে থাকলেই আর কিছু লাগে না। সবচেয়ে অবাক লাগে আম্মুর আচরণ।
মায়েরাও কি এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? ভাই বোনেরাও কি ? শিহাবকে নির্বাচন করা কি এতই অপরাধের ছিল ? ওদের কারো অনুমোদন ছিল না চাল চুলোহীন মফস্বলী গোবরের পদ্ম শিহাব সরকারে। শুধু আব্বু একদিন আড়ালে ডেকে বলেছিলেন –
– তোর আম্মুকে রাজী করানো যাবে না। কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে নে তোরা।
বিয়ের পর আমূল বদলে যেতে বেশি সময় লাগেনি শিহাবের। একটা মেয়ের শরীরী অভিযানের ক্লাইমেক্সে পৌঁছুতে একজন পুরুষের আর কতদিন লাগে ? শিহাবের সংসারে আমেরিকার জীবনটা ক্রমশই দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। ততদিনে রীটাও আমেরিকায় পৌঁছে গেছে ভাগ্যের অন্বেষণে। শিহাবদের বোস্টনের বাড়ির বেসমেন্টে আশ্রিতা রীটা মল্লিক ইশরাত জাহানের বন্ধুত্বের মসৃণ সিঁড়ি বেয়ে একদিন অবলীলায় পৌঁছে গেল শিহাব সরকারের বেডরুম অবধি। আর থাকা হলো না আমেরিকায়। আম্মু জানে ইশরাত ঢাকায় ফিরে এসছে। ভাইবোনেরাও জানে। কেউ এসে দেখা করেনি। বাসায় না উঠে ভালই হয়েছে। হয়তো অপমানিত হয়ে বেরিয়ে আসতে হতো। আব্বুটা তো আর বেঁচে নেই। মুনির স্যারের সাথে দেখা করতেই একেবারে আদরে লুফে নিলেন। বললেন তোমাদের মতো ট্যালেন্টেড মেয়েদের পেলে ডিপার্টমেন্ট সমূহ উপকৃত হবে। কাল থেকেই জয়েন কর। সেও তো সেই কত বছর আগের কথা! শিহাব চ্যাপ্টারটা এখনো আঁঠার মতো পিছু লেগে আছে। সেই দগদগে ক্ষতের বাইরেটায় চুমটি পড়লেও অন্তঃসলিলার মতো বয়ে যাওয়া ভেতরের রক্তক্ষরণ এখনও টের পায় প্রফেসর ইশরাত জাহান।
প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে ঝিম মেরে বিছানায় পড়ে আছেন ইশরাত জাহান। জ্বর যেন পাগলা কুকুরের মতো পিছু নিয়েছে। সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কিছুতেই ছেড়ে যাচ্ছে না। ডাক্তার ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। এমনি তো ইদানিং প্রায়ই হচ্ছে। মেডিকেল চেক আপ নিতে ভয় হয়। শেষে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যদি সাপ বেরিয়ে আসে! শরীরের ভেতরে কোন্ ঘূণ পোকারা বাসা বেঁধে রয়েছে কে জানে! জমশের আলীর হোমিওপ্যাথির পুরিয়া খাটের নীচে গড়াগড়ি যাচ্ছে। কখন বুঝি সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বাতি
জালানো হয়নি। বাইরের লাইটপোস্টের আলো এসে ঘরের ভেতরে একটা ভূতুরে আলো আঁধারি তৈরী করেছে। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। কে যেন অনেকক্ষণ অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় কড়া নাড়ছে। আজ তো জমশের আলীর আসার কথা নয়। তবু ইশরাত জাহানের মনে হলো জমশের আলী নয়তো? অনেক কষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে দরজা খুলে দিলেন। জমশের আলীকে খোলা দরজার সামনে রেখে ফিরে যাচ্ছিলেন ঘরের ভিতর। ঘরের মাঝখানে যেতেই হঠাৎ মাথা ঘুরে মেঝের উপর উপর লুটিয়ে পড়লেন ইশরাত জাহান। জমশের আলী দৌড়ে এসে এই মুহূর্তে মাথায় যা বুদ্ধি এল তাইই করল। ত্রস্তে ইশরাত জাহানকে মেঝে থেকে তুলে পাঁজা কোলে করে বেডরুমের দিকে এগিয়ে চলল সে।
অসাড় অনিয়ন্ত্রিত দেহ। একফোঁটা শক্তিও যেন অবশিষ্ঠ নেই শরীরে। চেতনায় আধো ঘুম আধো জাগরণ। মাথার ভিতরে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছে দুর্বহ যন্ত্রণার ঢেউ। কানের ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকার মাতন। সবল দু’হাতে ইশরাত জাহানকে পাঁজা কোলে করে বিছানার দিকে এগোচ্ছে জমশের আলী। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছেন ইশরাত জাহান। শুকনো পাণ্ডুর ঠোঁটে বিড় বিড় করছেন ইশরাত জাহান –
– তুমি কত ভাল মানুষ জমশের। শিহাবের মত নিষ্ঠুর পুরুষ তুমি নও। আমাকে তুমি অনেক দূরে নিয়ে যাও জমশের। এখন থেকে বেড রুমের এই সংক্ষিপ্ত দূরত্বে মোটেও যেন থেমে যেয়োনা। এক প্রলম্বিত দীর্ঘ যাত্রায় আমাকে তোমার সঙ্গী কর জমশের!
জমশের আলীর বিশাল শরীর সজোরে পেঁচিয়ে রেখেছে ইশরাত জাহানের দুই শীর্ণ বাহু। জমশেরের বুকের সাথে লেপটানো মুখ। নাকে পুরুষের গন্ধ। পুরুষ শরীরের এই পরিচিত গন্ধ কতকাল আগের অভিজ্ঞতা! কতোকাল ধরে চলছে শরীরী উপবাস?
এই অসুস্থতায়ও এমন হয় ? এই নির্জীবতায়ও এমন তীব্র ইচ্ছে বোধ জাগে? এই কি সেই সময় যখন মানুষের সংস্কার শাসিত পরিশীলিত মনন অজানা ঝড়ের কবলে মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে যায় ? হয়ে যায় এমন বিহ্বল? এমনই বেপথু ?