প্রেমিক
কলেজে প্রবেশের পর থেকে মৌসুমী একটু অন্যরকম জীবনযাত্রা করবার চেষ্টা করত। ওদের রক্ষনশীল পরিবার। সেখানে প্রেম দূরের কথা, বাইরে একা বেরোনোর অধিকার ছিল না। সকালে কলেজ ছিল, ভোর হলেই কলেজে চলে আসা। ওটাই ওর মুক্তি কিংবা স্বাধীনতা। ভালবেসে ছিল ওদের কোচিং ক্লাসের জয়কে। জয় এবছর আর জি কর এ ডাক্তারি পড়ছে। মৌসুমী পড়াশোনায় খুব ভালো। কিন্তু জয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য ও কলেজে প্রায় ক্লাস করত না। সেজেগুজে কলেজে আসে, দুটো ক্লাসের পড় চলে যায়। এভাবে নিজের পড়াশুনার প্রতি একটা ছেদ আসে। সঙ্গীতা অনেক বুঝিয়ে ছিলো, প্রিয় বন্ধুর জন্য অনেকটাই ভাবত। একদিন মৌসুমী ঠিক করল জয়ের হাতে সিঁদুর পরবে। এরকমই পাগলি মেয়ে হয়ে উঠেছিল। সেদিন সকালে সঙ্গীতা কে জানালে ও চিৎকার করছিল। কেন এত তাড়াতাড়ি তুই এইসব করছিস। ভালো লাগতেই পারে। তোর সবেমাত্র বয়স উনিশ বছর। নিজের কেরিয়ার তৈরি করে নে। এভাবে জীবনটাকে নষ্ট করিস না। অপেক্ষা কর। জয় তোর জন্য ঠিক অপেক্ষা করবে। তুই এত ভালো স্টুডেন্ট, কিছুদিন পরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তারপর বিয়ে করবি। জানিনা কেন সেদিন সঙ্গীতার কথাগুলো মৌসুমীর ভালো লাগেনি। বন্ধুত্বে চির আসছিল। ওর কথা ভেবে সঙ্গীতা পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছিল না। এইভাবে দুজনের পড়াশোনা ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। অনার্সের নাম্বার কমলো। মৌসুমির বাড়ি থেকেও একটু বুঝতে পেরেছিল। ওর মা অনেক বুঝিয়েছে। আজ মৌসুমী নিজেকে একা করে নিয়েছে। কারোর সাথে ভালো করে কথা বলে না। জয় ওর জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত হরণ করে নিয়েছে। জয়ের বাবা-মা জয়কে বোঝাবার চেষ্টা করল। ডাক্তারি পড়া যথেষ্ট কঠিন। জয় তুমি কেন পড়াশোনায় মন দিচ্ছ না? মাঝে মাঝে দেখা কোরো। এভাবে সময়টাকে নষ্ট করতে দিও না। এই ক’টা বছর তোমাদের দুজনকে অনেক মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। যখনই জয় পড়তে বসে, বা ক্লাসে যায় মন পড়ে থাকে মৌসুমির জন্য। অন্যমনস্ক হয়ে ওর কথা ভাবতে থাকে। একটা একটা করে দিন এগিয়ে চলেছে। সামনে পরীক্ষা। কোন প্রিপারেশন হয়নি। অনেক ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে। এসব চিন্তা করে জয় ভেঙে পড়েছে। কি করে পরীক্ষায় বসবে বুঝতে পারছেনা। মৌসুমীর সামনে অনার্স পরীক্ষা। প্রচুর পড়া। আজ দিন হল জয় ওর সাথে দেখা করছে না। সামনের পরীক্ষাটা ভালো করে দিতে হবে। দুজনের বাড়ি থেকে বোঝাতে শুরু করলো। জয় কোনভাবেই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে উঠতে পারছে না। হঠাৎ করে পনেরো দিনের কথায় মৌসুমীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল একজন স্কুল মাস্টারের সঙ্গে। সানাই এর শব্দে মৌসুমির বিয়ে সুসম্পন্ন হল। বাধা দিয়েছিল, কিন্তু বাবা-মার সাথে মৌসুমী পেরে ওঠেনি। কোন দিন তাদের সাথে বিরূপ আচরণ করেনি। আজ তাই নীরবেই মেনে নিল। অথচ জয়ের কি পরিমান ক্ষতি হলো জয় বুঝলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে। যে ভালোবাসা স্থায়ী নয় তার জন্য নিজের কেরিয়ার শেষ হতে চলেছে। ধীরে ধীরে জয় অসুস্থ হয়ে পড়ল। না, মৌসুমী আর খোঁজ নিতে আসেনি। জয়ের মা কান্নাকাটি করে ছেলেকে কোনরকম সুস্থ করল। একটা বছর ভয়ংকর ক্ষতি হয়ে গেছে। জয় এবার উপলব্ধি করলো নিজের কেরিয়ারের ঊর্ধ্বে কোন কিছুকে প্রাধান্য দেওয়া ঠিক হয়নি। তবু মন মানে না। মৌসুমিকে ভোলার চেষ্টা করতে লাগল। প্রতিটি ভালোবাসার ক্ষণ যেন তার কাছে বারেবারে ছুটে আসে। ও নিজের মনকে বোঝাতে লাগলো, আগে পড়াশোনা তারপর ভালোবাসা তারপর প্রেমিক হওয়া। পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর। কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করতে পারে না। সকলে নিজের ভালো নিয়ে ব্যস্ত। যাকে এত ভালবাসো তো যার জন্য সে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিল, একবারও তার খোঁজ নিলোনা। এটাই হয়তো একজন ব্যর্থ প্রেমিকের জীবন।