প্রহসন
“না দিদি দোহাই তোমায়, আমার খোকাকে এত কাছে টানবে না , তোমার নিঃশ্বাসে বিষ আছে”-কথাগুলো বিশ্রীভাবে বলে হিড়হিড় করে বিট্টুকে টান মারলো পড়শী মিঠু ।খাটে বাপ্পা, বিট্টুর সঙ্গে লুডো খেলছিলো আর করুণা ওদের জন্য সবে সুজির পায়েস চাপিয়েছে।”একি বলছো গো মিঠু, আমি কিনা তোমার ছেলেকে.…”..কথাটা বলার আগেই ওরা ততক্ষণে বাড়ি। বিট্টুর কান্না গলা শোনা যেতেই থ্রিতে পড়া বাপ্পা হতাশ হয়ে বললো মা, তুমি তো আমার মতোই ওকে ভালোবাসো, কত কি বানাও, কিনে দাও তবু এমন কেন করলো মা! আমরা গরীব তাবলে ঠাকুর বন্ধুকেও কেড়ে নেবে বলে আক্ষেপে লুডো গুটিয়ে কেঁদে ফেলল।
লাগোয়া জানালা ধড়াম করে লাগিয়ে মিঠু বিট্টুকে মারধর করতেই বুকটা মোচড় দিলো করুনার।মাস ছয়েক আগে হার্ট অ্যাটাকে স্বামীর মৃত্যু ওদেরকে খাদের কিনারে এনে দিয়েছে।অদম্য মনের জোরে আয়ার কাজ নিয়ে সংসার টানছে সে। ফিরতে একটু দেরি হলে চিন্তা বাড়ে ছেলেটা একা থাকে , কখনো বাপ্পা খেলতে আসে।মিঠুর আজ যে কি হলো! সব বোঝে করুণা, সংসারের হাল ধরতেই পাড়ায় ফিসফাস গুঞ্জন! কু মন্ত্রণার ঝড়।”কোথায় কাজ করে, কি কাজ, না কোথাও ফুর্তি করতে যায়”-ইস মানুষ পারেও বটে।তবু করুনার মাথা গরম করা উচিত নয় কারণ বিট্টুকে মানুষ করা একমাত্র লক্ষ্য।
নিস্তব্দ রাতে বুক হালকা করে নামা কান্নার স্রোত আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করলো। শুধু ভাবছে ইস তাবলে কিনা আমার নিঃশ্বাসে বিষ! কি অবলীলায় কথাটা বলল মিঠু, যাকে কিনা এত স্নেহ করে। বাপ্পার খুব জ্বরের জন্য দুদিন কাজে যেতে পারেনি করুণা। আজ জরুরী তলব এসেছে আয়া সেন্টার থেকে। “বাবুরে, সোনা আমার, আজ কাজে যেতেই হবে বাইরে চাবি দিয়ে যাচ্ছি কেমন, জলদি ফিরবো আমি। একটা রোগীকে ড্রেসিং করিয়ে বাড়ি মুখো হতেই হঠাৎ প্রকৃতি যেন রুদ্র রূপে হাজির। আকাশ ভেঙে বজ্র বিদ্যুৎ যোগে বৃষ্টি যেন থামতেই চায় না!
আর কত অপেক্ষা করে! কু ডেকে উঠলো মায়ের মন, কি যে করছে একা অসুস্থ বাপ্পা!শহর ডুবেছে অন্ধকারে, এক হাঁটু জল টপকে ফিরতেই কিন্তু একি এত লোকের ভিড় রাস্তায়, তাদের চালা ঘরের সামনে!পাগলের মত চিৎকার করে কাছে গিয়ে দেখে ঝলসে যাওয়া বাপ্পা মাথা গুঁজে।বাজ পরে ঘরটা জ্বলে ঝাঁঝরা। ঘন্টি বাজিয়ে তড়িঘড়ি এলো দমকল।পুলিশ, উৎসাহী উদ্বিগ্ন জনতার ভিড় ।সব শেষ স্বপ্ন, কিসের আর রইল ভবিষ্যত!স্বামী হারিয়ে আজ একমাত্র অবলম্বন সন্তান, বাড়ি ঘর সব তছনছ!হিংসা কদর্যতা যদি ধ্বংস না করতো প্রতিবেশীদের মধ্যে হার্দিক সম্পর্ক, তাহলে আগের মতো অবশ্যই কোলের বাচ্চাটাকে এভাবে সুরক্ষার জন্য চাবি দিয়ে যেতে হতো না হতভাগ্য মা করুনাকে! আহারে আগুনে দগ্ধ হয়ে ছট্ফট্ করেছে তার সোনা, বেরুতে পারেনি প্রাণ বাঁচাতে!
আজ দশ বছর পেরিয়েছে।মোড়ের মাথায় ডাস্টবিনের পাশে যে পাগলিটা আপন মনে বিড়বিড় করে, ঘুরে বেড়ায় , প্রায়শঃ চিৎকার কখনো ডুকরে কেঁদে ওঠে ওটাই করুণা!
“মা কোনো পুরানো চাদর আছে’?বিট্টুর আবদার তার মা মিঠুকে, বন্ধুরা মিলে অসহায় দুঃস্থ দের সাহায্য করবে।মিঠু একটা প্যাকেট বের করে দিতেই , “মা এটা তোমায় করুণা আন্টি গিফট করেছিল, অন্য দাও, আমি তো ওকেই দেব ভাবছিলাম! নাছোড়বান্দা মা ওটাই ঘর থেকে বিদেয় করতে চায় দেখে বিট্টু বললো , “তুমি-বাবা শিক্ষা দিয়েছিলে , উপহার যতই ছোট হোক না কেন তা ফেরাতে নেই!” দুচোখে বেঁচে থাকার ধূলিস্যাৎ স্বপ্নে করুণা পাগলী চাদরটা খামচে কি জেনে ভেবে ফিক করে হেসে ফেলল।কে জানে হয়তো এই চাদর, তার গোছানো সংসারের অতীত ছবিটা হঠাৎ তাজা করে সাময়িক শান্তির প্রলেপ দিলো করুণা ক্ষেপিকে।