প্রতীক্ষার পুরুষ
যে ট্রেনের পৌঁছবার কথা বিকেল তিনটেয়, সেটা এল সাতটা দশে। চার ঘণ্টা লেট, অবশ্য ভারতীয় রেলওয়ের খুব স্বাভাবিক আচরণের মধ্যেই পড়ে, কিন্তু জয়দেব ভেবে পাচ্ছিল না কি করবে। শেষ বাস চারটে তিরিশে তারপর আর যাওয়ার কোনও উপায় নেই। অথচ কাল সকাল আটটার মধ্যে হাজির না হলে তিন লাখ টাকার অর্ডারটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। ট্রেন যত লেট করছিল তত উত্তেজনা বাড়ছিল, এখন কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে মাথার ভেতরটা।
প্ল্যাটফর্ম থেকে ওভারব্রিজে উঠে সে চারপাশে তাকাল। বিরাট জংশন স্টেশন। ট্রেনটা যদি ঘণ্টাখানেক লেট করত, এত বড় ক্ষতি হত না। বাসে এখান থেকে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে ছয় ঘন্টা লাগবে। যদি ভোর ছটার বাস ধরা যায় তো বারোটার আগে যাওয়া যাবে না। অথচ। আটটার সময় চোপরা বেরিয়ে যাবে বাগান থেকে। এখন একটিই ভরসা, যদি ট্যাক্সি পাওয়া যায়। অনেক টাকা নেবে, তা নিক, কিন্তু তিন লাখ টাকার যে অর্ডার, তাতে পচাঁত্তর হাজার টাকা নিট লাভ।
ওভারব্রিজে দাঁড়িয়েই ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ পেল জয়দেব। তারপরেই টের পেল গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে। অন্ধকারে আকাশটার চেহারা বোঝা যাচ্ছিল না, এখন মনে হল মেঘ জমে আছে চাপ হয়ে। মনে-মনে বলল সে, সোনায় সোহাগা।
ওভারব্রিজ থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে এসে দেখল বৃষ্টিটা বেশ তরিবত করেই নামছে। এর। আগের বার যখন এই জায়গায় সে এসেছিল, তখন দেখেছিল রিকশা, বাস, ট্যাক্সির বিরাট দঙ্গল গমগম করছে। এখন গোটাদশেক রিকশা আর কয়েকটা ট্যাক্সি ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। সুটকেস হাতে জয়দেব দাঁড়াতেই একটা লোক ছুটে এল, টাউনে যাবেন সাহেব?
ঘাড় নাড়াল জয়দেব, তারপর জিজ্ঞাসা করল, তোমার ট্যাক্সি আছে?
হ্যাঁ সাহেব, পক্ষীরাজ। স্টার্ট নেব আর উড়ে যাবে।
জায়গাটার নাম বলে জয়দেব জিজ্ঞাসা করল, কত নেবে?
মাথা ঝাঁকাল লোকটা, নেওয়া-নেয়ির কথা ওঠে না সাহেব, আমি যাব না।
কেন? কত দিতে হবে বলো না?
দুটো পুল গড়বড় আছে, জল বেড়েছেনদীতে, গেলে ফেঁসে যাব। লোকটা সরে গেল চটপট। জয়দেব ঠোঁট কামড়াল, আজ সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিল কে জানে! নদীতে বর্ষার সময়। জল বাড়তেই পারে কিন্তু পুলটা গড়বড়ে থাকবে কেন? এক-এক করে প্রত্যেকটা ট্যাক্সিওয়ালার কাছ থেকে ওই জবাবটাই শুনল সে। কাল ভোর ছটার আগে বাস নেই। আর যদি সাহেব রাতটা এখানকার কোনও হোটেলে থাকেন তাহলে চারটে নাগাদ ট্যাক্সি স্টার্ট করতে পারে কিন্তু রাস্তা খারাপ বলে চার ঘণ্টার গ্যারান্টিটা দেওয়া যাচ্ছে না। তবে আপ ডাউন ভাড়া দিলে ড্রাইভার প্রাণপণ চেষ্টা করবে পৌঁছে দিতে।
তবু কিছুটা মাটি পাওয়া গেল। চোপরা সাহেবের বেরুবার কথা আটটায়, পাঁচ-দশমিনিট দেরি হতেও তো পারে। তা ছাড়া রাস্তা যে খারাপ তা না দেখলে তো ঠিক বলা যাচ্ছে না। এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হল জয়দেব। যে টাকা লোকটা চাইছে তা হিসেবের থেকে অনেক বেশি, কিন্তু পঁচাত্তর হাজার টাকার কথা ভাবলে নস্যি। আপাতত রাত্রের জন্যে একটা আস্তানা দরকার। যদি সম্ভব হয় চোপরাকে ট্রাঙ্ককলে ধরতে পারলে সবকিছুর সুরাহা হয়ে যাবে। জয়দেব ঠিক করল। ড্রইভারটাকেই বলবে শহরের কোনও ভালো হোটেলে তাকে নিয়ে যেতে। সেখান থেকেই ভোর চারটের সময় যাত্রা শুরু করবে। এই সময় প্রথম লোকটা দৌড়ে তার কাছে চলে এল, সাহেব, আপনার কপাল খুব ভালো। ওই যে সাদা অ্যামবাসাডারটা দেখছেন, ওটা হরিণবাড়ির। ওটায় আপনি চলে যান।
হরিণবাড়ি কোথায়?
আপনি যেখানে যাবেন তার এক ঘণ্টা আগে হরিণবাড়ি।
ও কি যাবে? জয়দেব চিন্তা করছিল দ্বিতীয় প্রস্তাবটা। তারপর বৃষ্টির মধ্যেই এগিয়ে গেল অ্যামবাসাডারটার দিকে। টিপটিপ জলের ফোঁটা কিন্তু তেমন ভেজাচ্ছে না। একটা বুড়ো নেপালি ড্রাইভার স্টিয়ারিং-এ বসে। তাকে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল জয়দেব, কোথায় যাবেন ভাই? হরিণবাড়ি।
পলাশহাট ওখান থেকে কতদূর?
এক ঘণ্টার রাস্তা।
আমাকে পলাশহাটে পৌঁছে দিলে কত নেবে?
আজ আমি পলাশহাটে যেতে পারব না, হরিণবাড়ি অবধি যেতে পারেন।
কেন, এক ঘণ্টার রাস্তা যেতে পারবে না?
না সাব, রাত হয়ে যাবে খুব, তা ছাড়া নদীর জল বেড়েছে।
জয়দেব নিরাশ হল। তাহলে আর কি হবে! সঙ্গে-সঙ্গে তার খেয়াল হল আজ রাত্তিরে যদি হরিণবাড়িতে পৌঁছানো যায় তাহলে কাল ভোরে সেখান থেকে রওনা হলে আটটার অনেক আগেই পলাশহাটে পৌঁছানো যাবে। এখান থেকে ভোর চারটেতে রওনা হয়ে ঝুঁকি নিতে হবে। এতক্ষণে বেশ আরাম লাগল তার। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার গাড়ি কি হরিণবাড়ির?
হ্যাঁ সাব।
তুমি বলতে পারো হরিণবাড়িতে থাকার জায়গা আছে কিনা?
হ্যাঁ সাব, একটা গেস্টহাউস আছে, খালিই পড়ে থাকে।
ঠিক আছে। আমি যাব পলাশহাটে। আজ যদি হরিণবাড়িতে রাত্রে থাকি তাহলে তুমি আমায় কাল সকাল আটটার মধ্যে ওখানে পৌঁছে দিতে পারবে? হ্যাঁ সাব, ও তো মামুলি ব্যাপার। জয়দেব খুশি হল, তোমাকে কত দিতে হবে?
ড্রাইভার একটু ইতস্তত করল, সাব, ভাড়ার ব্যাপারটায় একটু গোলমাল হবে।
কেন?
আমি হরিণবাড়ি থেকে এসেছি দুজন প্যাসেঞ্জারকে নিতে। তারা যদি আসে তাহলে আপনি পঞ্চাশ টাকা দেবেন। আর যদি না আসে তাহলে তিনশো। হরিণবাড়ি থেকে পলাশহাটের ভাড়া আলাদা। ড্রাইভার ভেবেচিন্তে জানাল।
যারা তোমাকে ভাড়া করেছে তারা যদি আমাকে নিতে রাজি না হয়, তাহলে?
ড্রাইভার হাসল, আপনি আমার পাশে বসে যাবেন স্যার, কোনও অসুবিধে হবে না। আমি আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব।
আগের ড্রাইভারকে নিষেধ করে জয়দেব ফিরে এল। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আরাম করে একটা সিগারেট ধরাল, যাঁরা যাবেন তাঁরা হরিণবাড়িতেই থাকেন?
না সাব। বছরে একবার আসেন। তিনদিন থাকেন। আমাকে ও বাড়ির দারোয়ান খবর দিলে আমি এসে নিয়ে যাই। কিন্তু আজ খুব দেরি হচ্ছে দেখছি।
বোধহয় ট্রেন লেট আছে। আমারটাও চার ঘণ্টা লেট ছিল।
আটটা বাজতে যখন মিনিট পাঁচেক বাকি তখন ড্রাইভার সোজা হল, ওই যে ওরা এসে গেছে। বলে গাড়িটা চালু করে এগিয়ে এল সিঁড়ির গা-বরাবর। এতক্ষণে বৃষ্টির ফোঁটা মোটা হয়েছে। টিনের চালে চড়বড়ে শব্দ বাজছে। ড্রাইভার তার মধ্যেই বেরিয়ে পেছনের দরজা খুলে বলল, সেলাম মেমসাব।
শেষ শব্দটা শুনে জয়দেব ঘাড় ফেরাতে গিয়েও সঙ্কুচিত হল। দরজা খোলা থাকায় গাড়ির ভেতরে আলো জ্বলছিল, এখন গাড়ির ভেতরটা সুগন্ধে ভরে গেছে। দুজনেই উঠে পড়ায় ড্রাইভার দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর পেছনের ক্যারিয়ারে মাল তুলে কুলিকে বিদায় করল সে-ই। অর্থাৎ যাত্রীদের সঙ্গে ড্রাইভারের ভালো জানাশোনা।
ইঞ্জিন চালু করে স্টেশন-চত্বর ছাড়াতেই পেছন থেকে একটা সুন্দর গলা ভেসে এল, কেমন আছ মান সিং?
জি মেমসাব, কোনওমতে আছি, ভগবানের দয়ায় বেঁচে আছি। ড্রাইভার খুব সমীহ করে জবাব দিল, আজ গাড়ি লেট ছিল?
হ্যাঁ। অনেকক্ষণ তোমাকে বসে থাকতে হয়েছে।
ঠিক আছে। এরকম তো হয়েই থাকে।
বৃষ্টি পড়ছে বেশ। হেডলাইটের আলোয় জলের ফোঁটাগুলো স্পষ্ট। সামনের পিচের রাস্তায় পড়ে কই মাছের মত লাফিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। জয়দেবের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। এঁরা তাকে কি মনে করেছেন তা সে বুঝতে পারছে না। ড্রাইভারটাও তার কথা বলেনি ওদের। অন্যের ভাড়া করা গাড়িতে এইভাবে যাওয়ায় এখন নিজেরই খারাপ লাগছে।
আমার বাংলোর খবর কি মান সিং?
সব ঠিক আছে মেমসাব।
রোজ বৃষ্টি হচ্ছে এখন?
হ্যাঁ মেমসাব।
এই সময় তো বৃষ্টি লেগেই থাকে। মহিলা যেন নিজের মনেই কথাগুলো বললেন, জয়দেব দেখল শহরটা ডানদিকে রেখে গাড়ি বাঁদিকে বাঁক নিল। বৃষ্টির জন্যে খুব বেশি গতি বাড়াতে পারছে না, তবে রাস্তো খুব ভালো, এইটেই সুবিধে, জয়দেবের আর চুপ করে থাকতে ভালো লাগছিল না। সে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল, নদীর জল বেড়েছে বলেছিলে, এদিকে কি বন্যা হয়?
হয় সাব। তবে দু-একদিন জল থাকে। পাহাড়ি নদী তো। কথাটা বলেই বোধহয় ড্রাইভারের খেয়াল হল। সে মুখ ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলল, এই সাব পলাশহাট যাবেন, গাড়ি পাচ্ছিলেন না, তাই–।
ওপাশ থেকে কোনও জবাব এল না। জয়দেবের অস্বস্তি বেড়ে গেল। ভদ্রমহিলা কি তাকে সঙ্গে নেওয়া পছন্দ করছেন না? ওঁর সঙ্গে যে আছে তার গলা একবারও পায়নি গাড়ি ছাড়ার পর থেকে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মুখ ফেরাল জয়দেব, আমি হয়তো আপনাদের অসুবিধে করলাম কিন্তু এছাড়া কোনও উপায় ছিল না। আমাকে কাল সকাল আটটার মধ্যে পলাশহাটে পৌঁছাতে হবে।
দুই মুহূর্ত চুপচাপ কাটল। অন্ধকারে কোনও মুখই ভালো করে বুঝতে পারছিল না জয়দেব। তবে পেছনের দুজনই যে মহিলা সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না।
মান সিং কি পলাশহাটে যাচ্ছ?
না মেমসাব। এই সাব হরিণবাড়িতে আজ থাকবেন। ভোরে আমি নিয়ে যাব।
আপনি কি ট্রেনে এলেন? হ্যাঁ, আমি কলকাতা থেকে আসছি।
পলাশহাটে প্রথম যাচ্ছেন?
না, এর আগে একবার গিয়েছিলাম।
ওখানে কার কাছে যাবেন?
মিস্টার চোপরা। ব্যাবসার ব্যাপার।
ও। আমি এদিকের লোকজনকে এখন আর তেমন চিনি না। যারা পুরোনো দিনে ছিল তাদের
জানি। চোপরা বোধহয় বেশিদিন আসেননি এদিকে। আগে তো সপ্তাহে তিনদিন আমরা পলাশহাট ক্লাবে গল্প করতে যেতাম। কী নাম আপনার?
জয়দেব সেন।
বদ্যি?
হ্যাঁ।
আমরাও বদ্যি। গুপ্ত।
এতক্ষণে একটা ধারণায় আসতে পারল জয়দেব। গলা শুনে মনে হয়েছিল বছর পঁচিশের মধ্যে বয়স কিন্তু কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে তা নয়। তাঁর পাশের মেয়েটি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছেন। তবে ভদ্রমহিলার অঙ্গে কালো শাড়ি-জামা থাকায় গায়ের ফরসা রং স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অন্ধকারে। কিছুক্ষণ অতিক্রান্ত হওয়ার পর জয়দেব জিজ্ঞাসা করল, আমি একটা সিগারেট খেতে পারি?
স্বচ্ছন্দে। তারপর আচমকা জিজ্ঞাসা করলেন, কী সিগারেট খান আপনি? জয়দেব বেশ অবাক হল, কারণ আজ পর্যন্ত কোনও মহিলার মুখে সে এই প্রশ্ন শোনেনি। ব্রান্ডের নাম বলতেই মহিলার গলা থেকে অস্ফুট আওয়াজ বের হল। তারপর আবার সব চুপচাপ।
বৃষ্টির তেজ মোটেই কমছে না। এর মধ্যে ওরা জঙ্গুলে এলাকায় চলে এসেছে। দু-পাশের খোলা জমিতে জল জমছে। গাড়ির কাঁচ বন্ধ থাকলেও একটু-একটু শীত-শীত ভাব ছড়াচ্ছিল। জয়দেবের মনে হল ধোঁয়া গাড়িতে জমে যাচ্ছে, সে কাঁচ সামান্য নামিয়ে সিগারেটটা ছুঁড়ে দিতেই পেছন থেকে মহিলা বলে উঠলেন, কী হল, ফেলে দিলেন কেন? অনেকদিন বাদে গন্ধটা পেলাম।
জয়দেব কথাটার অর্থ ধরতে পারল না। বলল, ধোঁওয়া জমে যাচ্ছে।
তাতে কিছু হত না। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। সামনের সিটে বসেও সেটা স্পষ্ট টের পেল জয়দেব। তারপর কথা ঘোরাবার জন্যে বলল, হরিণবাড়িতে আপনার বাড়ি আছে নিশ্চয়ই!
হ্যাঁ, রয়ে গেছে। এ জীবনে বিক্রি করতে পারব না। বছরে একবার আমাকে আসতেই হয়, এই দিনটায়। সাধারণত সন্ধের আগেই পৌঁছে যাই। এবার ট্রেনটা–
জয়দেবের কৌতূহল বাড়ছিল কিন্তু বাড়তি প্রশ্ন করতে শিষ্টাচার আটকাচ্ছে। সে রাস্তার দিকে তাকাল। বৃষ্টি এবার একটু ধরেছে। দু-পাশে ঘন জঙ্গল, মাঝখানে সরু পিচের রাস্তা। প্রচণ্ড বেগে গাড়ি ছুটছিল। তারপর একটা বাঁক নিতেই ড্রাইভার স্পিড কমিয়ে আনল। জয়দেব দেখল ঘড়িতে এখন দশটা তিন। অথচ বাইরের স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার প্রকৃতির দিকে তাকালে মনে হয় বিশ্বচরাচর থেকে বহু দূরে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। গতি কমিয়ে গাড়িটা শেষপর্যন্ত থেমে গেল। জয়দেব প্রশ্ন করার আগেই পেছন থেকে ভেসে এল, কি হল?
ড্রাইভার ততক্ষণে একটা টর্চ নিয়ে দরজা খুলছে, সামনে একটা পুল আছে। নদীর জল বেড়েছে। একবার দেখে নেব।
ভদ্রমহিলা যেন আর্তনাদ করে উঠলেন, সে কি! আমাকে আজ রাত্রেই ওখানে পৌঁছাতে হবে।
ড্রাইভার জবাব না দিয়ে অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে এগিয়ে যেতেই জয়দেবের মনে হল তার বসে থাকা শোভন নয়। সে ভেজা মাটিতে পা রেখে পিচের রাস্তায় চলে এল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখন বৃষ্টিটা থমকেছে। কোনও গাড়ি এই পথে এখন যাচ্ছে না। একটু বাদেই ড্রাইভার ফিরে এল, জলদি, জলদি, চলে যেতে হবে।
জয়দেব গাড়িতে বসতেই ইঞ্জিন চালু হল। তারপরেই হেডলাইটের আলোয় নদীটাকে দেখতে পেল সে। জল অস্বাভাবিক উঁচু হয়ে পুলের তলা ছুঁয়েছে। প্রচণ্ড স্পিডে সেটাকে পেরিয়ে। আসতেই ড্রাইভার বলল, আর কোনও ভয় নেই।
তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ ভদ্রমহিলার গলা শোনা গেল, আপনি পাঁচ ফুট নয়?
চমকে ফিরে তাকাল জয়দেব। মহিলার মুখটা দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। গাড়ি থেকে নামবার সময় যে আলো জ্বলেছিল তাতে লক্ষ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মহিলা তখন মুখ নিচু করেছিলেন। হঠাৎ তার উচ্চতা জানতে চাইছেন কেন? সে বলল, সাড়ে নয়। কেন?
আমার মনে হল নয়। বিয়াল্লিশ থেকে চুয়াল্লিশ, তাই তো?
হ্যাঁ তেতাল্লিশ।
অদ্ভুত ব্যাপার।
মানে, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি কি বলতে চাইছেন!
ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন না কথাটার। যেন আরও কিছুটা অন্ধকার টেনে নিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখলেন। জয়দেবের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। মহিলার গলা শুনে বেশ সুস্থই মনে হয়, ড্রাইভারের সঙ্গে যখন কথা বলছেন তখন বেশ স্বাভাবিক, তাহলে তাকে এরকম প্রশ্ন করছেন কেন?
এগারোটা নাগাদ হরিণবাড়িতে পৌঁছে গেল ওরা। বাকি পথে কোনও কথাবার্তা হয়নি। এর মধ্যে গভীর ঘুমে জড়িয়ে আছে হরিণবাড়ি। কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না। আর তখনই বৃষ্টিটা ফিরে এল। ভদ্রমহিলা বললেন, মান সিং, ওঁকে গেস্টহাউসে নামিয়ে দাও আগে। জয়দেব খুশি হল। এই বৃষ্টিতে তাকে গেস্টহাউস খুঁজতে হবে না বলে মনে-মনে ধন্যবাদ দিল মহিলাকে। একটা কাঠের বাংলোর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দু-বার হর্ন বাজাল ড্রাইভার। একটু বাদেই একটা লোক ছাতি মাথায় ছুটে এল। গেট খুলে ড্রাইভার তাকে বলল, এই, সাব আজ রাত্রে থাকবেন।
লোকটা মাথা নাড়ল, হুজুর, কামরা তো খালি নেই। একটা বড় পার্টি এসে বুক করে ফেলেছে। অফিস রুমে পর্যন্ত লোক শুয়েছে।
সর্বনাশ! জয়দেব আঁতকে উঠল। লোকটা আর দাঁড়াল না, গেট বন্ধ করে ফিরে গেল।
আর কোনও জায়গা নেই? কোনও হোটেলে?
ড্রাইভার মাথা নাড়ল, না সাব। তবে ফরেস্টের একটা বাংলো আছে, সেখানে গেলে–
তাই চলো ভাই।
গাড়ি ঘুরল। হরিণবাড়ি ছোট জায়গা। বাজার এলাকা পেরোতে সময় লাগল না। ড্রাইভার বলল, মেমসাহেব কি নেমে যাবেন?
হ্যাঁ।
গাড়িটা বড় রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে একটা বাংলো বাড়িতে ঢুকল। সেই বৃষ্টিতে গেট খুলে ছাতি মাথায় একটা লোক দাঁড়িয়েছিল অন্ধকারে। গাড়ি সিঁড়ির কাছে পৌঁছাতেই সে ছুটে এসে দরজা খুলল, সেলাম মেমসাহেব।
কেমন আছ?
ওঁরা নেমে দাঁড়ালেন। মালপত্র নামানো হচ্ছে। সিঁড়ির ওপর যে হ্যারিকেনটা জ্বলছে তার আলোয় মহিলাকে দেখতে পেল সে। রোগা লম্বা এবং কালো শাড়ির আঁচলে কপাল পর্যন্ত ঢাকা এবং অসম্ভব ফরসা মনে হল। হঠাৎ মহিলা বললেন, এক কাজ করুন, আপনি এখানে বিশ্রাম করুন, মান সিং ঘুরে দেখে আসুক কোথাও জায়গা আছে কিনা!
জয়দেব সসঙ্কোচে বলল, না, না, আপনারা চিন্তা করবেন না–।
চিন্তা তো করছি না। আপনি এখানে নতুন, এক কাপ কফি খেয়ে গেলে আমাদের ভালো লাগবে। এ বাড়িতে কোনও অতিথি এলে কিছু না খেয়ে যেত না।
অগত্যা সুটকেস নিয়ে নামল জয়দেব। বেশ বড় বাংলো। সামনে বাগান আছে। মান সিংট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে যেতেই ওরা ড্রইংরুমে ঢুকল। সেখানে একটা স্ট্যান্ডের ওপর বড় সেজবাতি জ্বলছে। মহিলার আগে দ্বিতীয়জন মালপত্র নিয়ে দোতলায় চলে গেল। দারোয়ানটা হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিল, তার দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন, সব ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ মেমসাহেব।
একটু কফি করো। আপনি বসুন, আমি আসছি। মহিলা ওপরে উঠে গেলেন। জয়দেব একটা সোফায় গা এলিয়ে দিল। খুব ক্লান্ত লাগছে খিদেও পেয়েছে। সে ঘরটাকে দেখল। সুন্দর। সাজানো কিন্তু মহিলা এখানে থাকেন না। কোনও পুরুষমানুষ এই বাড়িতে আছে বলে মনে হচ্ছে না, ওই দারোয়ানকে বাদ দিলে। মুখ দেখেছে সে। মোটেই সুন্দরী নন। মোমের মতো সাদা। লম্বাটে মুখ। কিছুক্ষণ তাকালেই অস্বস্তিকর শিরশিরানি হয়। মিনিট দশেক বাদে মহিলা নেমে এলেন। এবার পরনে একটা কালো ম্যাক্সি, চুলে একটা কালো সিল্ক জড়ানো। আর এই সময় কফিও এল।
এক কাপ। জয়দেব বলল, আপনি খাবেন না?
উঁহু। ও জানে, আজকের রাত্রে আমি কিছু খাই না। উলটোদিকের সোফায় বসলেন মহিলা।
কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে জয়দেব বলল, চমৎকার।
আবার সেইরকম অস্ফুট শব্দ বের হল মহিলার ঠোঁট থেকে। জয়দেব মুখ তুলল। মহিলা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। সেই চাহনি, ঠোঁটের ভাঁজ দেখে শিউরে উঠল জয়দেব। কিছু বলতে হয় এমনভাবে সে বলল, আপনি এখন কোথায় থাকেন?
কানপুরে। তারপর নিজের মনেই বললেন, অদ্ভুত মিল।
এই সময় মান সিং ফিরে এসে জানাল ফরেস্ট বাংলোতেও জায়গা নেই। জয়দেব উঠে দাঁড়াল, ঠিক আছে, আমি তোমার গাড়িতেই রাতটা কাটিয়ে দেব। আর তো ঘণ্টা ছয়েক। তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?
মান সিং বলল, সাহেব যেমন ইচ্ছে করবেন তাই হবে।
ভদ্রমহিলা হাসলেন, আপনি জলে পড়ে গেছেন মনে হচ্ছে! শুনুন, আমার এখানে একতলায় কেউ থাকেন না। আপনি স্বচ্ছন্দে যে কোনও ঘরে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারেন। গাড়ির ভেতরের চেয়ে সেটা বোধহয় মন্দ হবে না।
মান সিং ঘাড় নাড়ল, তাহলে তো ভালোই হল। আমি ছটার সময় আসব। জয়দেব কিছু বলার আগেই মান সিং বেরিয়ে গেল।
ভদ্রমহিলা বললেন, আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এই ব্যবস্থায় খুশি হননি!
না, তা নয়। শুধু-শুধু আপনাকে বিব্রত করা–।
মোটেই নয়। এ বাড়িতে গত পাঁচ বছর কোনও পুরুষমানুষ বাস করেনি, আপনি থাকলে ভালোই লাগবে।বড় একটা নিশ্বাসের শব্দ হল।
অনেকক্ষণ থেকে যে প্রশ্নটা মাথায় পাক খাচ্ছিল এখন সেটা ব্যক্ত করল জয়দেব। গাড়ির তুলনায় ঘরের আরাম অনেক ভালো। একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় যখন পাওয়া গেল তখন প্রশ্নটা করাই যাক, কিছু মনে করবেন না, আপনার স্বামী–।
ও নেই। মহিলার ঠোঁট দুটো নড়ল।
ওঃ। জয়দেব অপ্রস্তুত হল।
পাঁচ বছর আগে ও চলে গেছে। আমার কপাল। আজ ওর মৃত্যুদিন। যেখানেই থাকি আজকের রাতে এখানে না এসে পারি না। আসি, তিনদিন থাকি, চলে যাই। মমির মতো মুখ নিয়ে বসেছিলেন মহিলা।
জয়দেবের আঙুল কামড়াতে ইচ্ছে করছিল, প্রসঙ্গটা না তুলতেই ভালো হত। কিন্তু মুখফসকে বেরিয়ে এল, কত বয়স হয়েছিল?
তেতাল্লিশ। খুব ভালো স্বাস্থ্য। আপনার সঙ্গে বেশ মিল আছে। আপনি যে ব্রান্ডের সিগারেট খান সেটা ওর প্রিয় ছিল। মহিলা স্থির হয়ে বসেছিলেন।
কি হয়েছিল? অস্বস্তি বাড়ছিল জয়দেবের।
জানি না। ডাক্তার বলেছে স্ট্রোক, হবে হয়তো। আমার সঙ্গে সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করেছিল। অভিমান করে নিচের ঘরে এসে শুয়েছিল সে রাত্রে। মাঝরাত্রে শব্দ শুনে ছুটে এসে দেখি মাটিতে পড়ে আছে, ডেড। নিশ্বাস ফেললেন মহিলা, সে রাতেও এমনি বৃষ্টি পড়ছিল। সব শেষ হয়ে গেল আমার। ও প্রায়ই বলত, আমি মরে গেলেও তোমার কাছে আসব। এল না, পাঁচ বছর ধরে এই রাত্রে আমি তাই এখানে ছুটে আসি। সারা রাত জেগে বসে থাকি, ওই বাগানে। মাটির তলায় সে শুয়ে আছে। মাঝে-মাঝে সমাধিটার কাছে যাই। বলতে-বলতে থেমে গেলেন মহিলা।
হঠাৎ ওই মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত শরীরে কাঁটা ফুটল জয়দেবের। এরকম সাদা মোমের মতো নীরক্ত মুখ নিয়ে মহিলা তার দিকে কী অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। তারপরেই যেন চেতনায় ফিরে এলেন উনি, বললেন, ছেড়ে দিন এসব কথা। আপনার খাবার দিতে বলি!
ত্রস্তে বাধা দিল জয়দেব, না, না, কোনও দরকার নেই। আমার খাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই।
সে কি। কেন?
আমি স্টেশনে খেয়ে নিয়েছি। বেমালুম মিথ্যে বলল জয়দেব।
ও। তাহলে রাত করে লাভ কি! ভোরে বেরুবেন যখন তখন শুয়ে পড়ুন। মহিলা উঠলেন। তারপর ওঁকে অনুসরণ করতে বলে এগিয়ে গেলেন কোণার ঘরটির দিকে। শুয়ে পড়লে এঁর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে এই আশায় জয়দেব খুশি হল। তিনটে কাঁচের জানলা। বাইরে সশব্দে বাজ পড়ল একটা। বিদ্যুতের আলোয় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সাদা দেখাল আচমকা। মহিলা বললেন, এখানেই শুয়ে পড়ুন। পাশেইটয়লেট আছে। কোনও অসুবিধে হবে না।
সুটকেসটা খুলল জয়দেব। টয়লেট যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। মহিলা একটা ডিমবাতি এনে দিলেন বড় ঘর থেকে। তারপর জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। মিনিট তিনকে বাদে পরিষ্কার হয়ে পাজামা পরে বেরিয়ে এসে জয়দেব দেখল মহিলা তেমনিভাবে দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল জয়দেবের। কেমন শিরশিরে দৃষ্টি। মহিলা বললেন, আপনি সিগারেটটা ধরান তো, গন্ধটা নিয়ে যাই।
সম্মোহিতের মতো সিগারেট ধরাল জয়দেব। কিছুক্ষণ পরে সেই অস্ফুট শব্দ হল। চোখ বন্ধ করে মহিলা যেন বাতাস নিলেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ঠিক এরকম। তারপর ধীরে-ধীরে। ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। দোতলায় উঠে যাচ্ছেন সেটা সিঁড়িতে ওঁর পায়ের শব্দে বোঝা গেল।
বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকাল জয়দেব। তারপরেই এক লাফে উঠে দাঁড়াল বিছানা থেকে। মহিলার স্বামীকে নিচের ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। আজ সেই মৃত্যুর রাত। পাশের বাগানেই তার কবর। এই রাতে নাকি তিনি উঠে আসতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন। সমস্ত শরীর। অসাড় হয়ে যাচ্ছিল জয়দেবের। তার সিগারেট, বয়স, উচ্চতা সব ওই লোকটার মতো। মাঝরাতে, এই বৃষ্টির রাতে যদি মহিলা নেমে আসেন এ ঘরে! শিউরে উঠল জয়দেব। ওই মড়ার মতো মুখ, অভিব্যক্তিহীন, বয়স্কা–। দৌড়ে ঘরের কোণের একটা চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল সে। রাতের অবশিষ্ট সময়টুকু জেগে থাকা ছাড়া উপায় নেই। নিচে, মাটির নিচে যে শুয়ে আছে তার উঠে আসা আর দোতলার ঘরে যিনি গেলেন তাঁর নেমে আসার মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই।