পুরুষ বাদ
মানুষের পুরুষ প্রজাতির জীবনে গভীর এক সংকট ঘনাইয়া আসিতেছে। আসিতেছে বলি কেন, আসিয়াই গিয়াছে। নিজেদের নিয়তি তাহারা হাজার হাজার বছরের প্রচেষ্টায় নিজেরাই রচনা করিয়াছে। বহু প্রচলিত প্রবাদেই আছে কাষ্ঠ ভক্ষণ করিলে অঙ্গার রূপ মল ত্যাগ করিতেই হইবে। পক্ষতন্ত্রে কথিত হইয়াছে, যেমন কর্ম তেমন ফল।
সেদিন এক গ্রন্থে মানবজাতির অতীত ইতিহাস পাঠ করিতেছিলাম। উক্ত গ্রন্থে একটি চিত্র মুদ্রিত দেখিলাম। দেখিয়া লজ্জায় অধোবদন হইলাম। কিয়দুরে আমার আধুনিকা স্ত্রী রাত্রির আহারের। জন্য ‘মাগি’ নামক ‘চটজলদি’ একটি আহার্য প্রস্তুত করিতেছিলেন। সুস্বাদু না হইলেও উদরপূর্তির পক্ষে যথেষ্ট। স্বসঞ্চালিত পিচ্ছিল কিঞ্চলুক জাতীয় পদার্থ।
জিহ্বাগ্রে স্থাপন করিবামাত্র হড়াস করিয়া হড়কাইয়া উদরে সাঁদ হইয়া যায়। অতীতে আমার মাতার কালে বহু জাতীয় অপ্রয়োজনীয় ব্যঞ্জনে তিতিবিরক্ত হইতাম। অতি সুস্বাদু সেই পদ আমাদিগকে জিহ্বার দাসে পরিণত করিয়াছিল। প্রাতে নিদ্রাভঙ্গ হইতে রাত্রে শয়নের পূর্ব পর্যন্ত কেবলই আহার কেবলই আহার। বাল্যকাল হইতেই যুগপৎ আহার ও বেধড়ক প্রহারের পথ ধরিয়া যৌবন প্রাপ্ত হইয়াছি। তৎকালে আমার পিতৃদেব সুযোগ পাইলেই আমার মাতাকে মসৃণ করিবার জন্য বলিতেন—’সুধাকে আমি একটি মাত্র কারণে বিয়ে করেছি, সে হল ওর রান্না। মহাভারতের কুন্তী মরে সুধা হয়ে জন্মেছে।’
এই সামান্য শুল্ক প্রশংসায় আমার মাতৃদেবী মার্জারের মতো ঘড়ঘড় শব্দ করিতেন ও কঠিন কোনও বিশেষ একটি পদ প্রস্তুত করিয়া এই প্রশংসার প্রতিদান হিসাবে আমাদের রসনাকে। উল্লসিত করিতেন। উদাহরণস্বরূপ বলিতে পারি, সামান্য পটলের অসামান্য রূপান্তর। পটলের আকৃতি ‘মিনিয়েচার’ মৃদঙ্গের মতো। আপনারা অবশ্যই লক্ষ করিয়া থাকিবেন। তাহার একটি দিক সামান্য ছেদন করিয়া গর্ভস্থ আবর্জনাদি শলাকা সহায়ে বাহির করিয়া, অত্যন্ত সুকৌশলে। সেই শূন্য উদরে বিশেষ কায়দায় প্রস্তুত পুর ভরিতেন। এই পুর ডাল অথবা মৎস্য দ্বারা তৈয়ার হইত। পুর ভরিবার পর পটলের কর্তিত অংশে সেই কর্তিত চাকলাটিই ‘প্লাস্টিক সার্জারি’-র কায়দায় সংযুক্ত করা হইত। অতঃপর কড়াইয়ে সরিষার তৈলের উত্তপ্ত প্রস্রবণে নিমজ্জিত ভর্জনে মুচমুচে করিয়া পাতে পাতে পরিবেশন করিতেন। এক-একজনে প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করিয়া, দুই-দশটা খাইয়া ফেলিতেন। দুই কুড়ি দশ এই প্রকার অ্যাটমবোমা তৈয়ার করিতে আমার। মাতাকে কী পরিমাণ শ্রম ও সময় নিয়োগ করিতে হইত তাহা সহজেই অনুমান করা যায়।
পটলের গর্ভ উৎপাটন করিয়া গর্ভ স্থাপন। ‘হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট’-ও বলা যাইতে পারে। আমাদের পরিবারস্থ সকলের এবম্বিধ সুখ সঞ্চারে নিজেকে অকাতরে নিবেদনের ফলে নৈবেদ্যটি অকালে অসুস্থ হইয়া সকাল সকাল পরলোকে প্রস্থান করিলেন। মাতৃহীন শোকসন্তপ্ত পরিবার অতঃপর চরম বিশৃঙ্খলার শিকার হইয়া স্বীকার করিল রবার টানিলে বর্ধিত হয় অবশ্যই; কিন্তু বেশি টানিলে ফটাং করিয়া ছিড়িয়া যায় ও ভিটায় মহানন্দে ঘুঘু চরিতে থাকে।
মনু মহারাজ একালের, জিনস স্ন্যাক্স ফতুয়া পরিহিতা, ওষ্ঠে সিগার ধারিণী বিদূষী রমণীদের আগমন বার্তা শ্রবণ না করিয়া মহানন্দে এক বিধান দিয়া আমাদের গালাগালি খাইবার পথ আরও প্রশস্ত করিয়া গেলেন। মনু ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়। একাধিক মনুকে লইয়া দূর দূর। অতীতে একটি সংস্থা স্থাপিত হইয়াছিল। ‘It is the designation of an office.’ তাঁহারাই অরণ্যের অনগ্রসরতায় বসিয়া যাবতীয় বিধান দিতেন। আর তৎকালের মানুষ ‘ঋষিরুবাচ’। বলিয়া মানিতে বাধ্য হইতেন। যেমন একালের গ্রামপঞ্চায়েতের বিধানে নারীকে ডাইনি আখ্যা দিয়া কিলাইয়া, ঢিলাইয়া, পুড়াইয়া মারার সংবাদ দৈনিকে প্রকাশিত হয়। আইনের প্রতিবাদ একালেও মহা অপরাধ বলিয়া গণ্য হয়।
মনু নারী সম্পর্কে কী কহিলেন!–
বালয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি ঘোষিতা।
ন স্বাতন্ত্রোণ কর্তব্যংকিঞ্চিং কার্যং গৃহেস্বপি।।
বাল্যে পিতুর্বশেতিষ্ঠেৎ পাণিগ্রাহস্য যৌবনে।
পুত্ৰাণাং ভর্তরি প্রেতে না ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম।।
আমি ব্যাখ্যা করিতেছি, ‘নারী বালিকাই হউন, যুবতিই হউন, বৃদ্ধাই হউন, গৃহের কোনও কার্যে স্বাতন্ত্র অবলম্বন করিবেন না। নারী বাল্যে পিতার বশে, যৌবনে স্বামীর বশে এবং স্বামী মৃত হইলে পুত্রের বশে থাকিবে-কদাচ স্বাতন্ত্র অবলম্বন করিবে না। অন্যত্র এই একই কথা পুনরায় আবার বলিলেন অন্যভাবে–
পিতা রক্ষতি কৌমারে, ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষতি স্থবিরে পুত্রান স্ত্রী স্বাতন্ত্রমহতি।।
নারীকে কৌমারে পিতা, যৌবনে পতি, এবং স্থবিরে পুত্রেরা রক্ষা করিবে। স্বাতন্ত্র নারীর পক্ষে ভালো নহে।
ধোলাইকৃত এই মগজ লইয়া পরিবারে পরিবারে কন্যাদেরও মগজ ধোলাইয়ের ব্যবস্থা প্রবাহের মতোই চলিয়া আসিতেছে। আশ্চর্যের বিষয় মাতারাই কন্যাকে সর্বাধিক শাসন করিয়া থাকেন। নারী স্বাধীনতার ঘোরতর বিরোধী মাতারাই। বাল্যে দেখিয়াছি আমার জ্যেষ্ঠা ভগিনী পেয়ারাতরুতে আরোহণ করিয়া ডালপালা ভাঙিয়া, কোনও একটি শাখায় শাখামৃগীর মতো পদদ্বয় প্রলম্বিত করিয়া মনের সুখে কষকষ করিয়া পেয়ারা চিবাইয়া থুথু করিয়া ফেলিত, তখন আমার মাতা রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করিয়া বলিতেন, ‘মনে রাখিস শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। মদ্দা মেয়েকে কেউ নেবে না। বছর না ঘুরতেই নড়া ধরে বাপের বাড়িতে বসিয়ে দিয়ে যাবে।’ পরবর্তীকালে সবিস্ময়ে লক্ষ করিলাম দিদি মা হইবার পর তাহার কন্যাকে ধিঙ্গি বলিয়া তিরস্কার করিতেছে ও ভবিষ্যতে শ্বশুরালয়ে তাহার কী দুরবস্থা হইবে, তাহা ভাবিয়া কপাল চাপড়াইতেছে। পব্রিতা পতিরতা অবিরত সুশীলতা এই ছিল নারীর আদর্শ।
প্রসঙ্গে ফিরিয়া আসি, যে পুস্তকটি উলটাইতেছিলাম, তাহা হইল মানুষের ইতিহাস। যে চিত্রটি দেখিয়া অধোবদন হইয়াছিলাম, তাহা এইরূপবল্কলধারী এক ভয়ংকর অমার্জিত পুরুষ, অর্ধোলঙ্গ এক নারীর কেশ আকর্ষণ করিয়া হিড়হিড় করিয়া টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। রমণী ভূপাতিত। পুরুষটি বন্য। শ্মশ্রু, গুম্ভ ও কেশের জটাজালে মুখ প্রায় অদৃশ্য। দুইটি দন্ত বাহির হইয়া আছে। এক হস্তে প্রস্তরনির্মিত কুঠার। প্রস্তর যুগের দৃশ্য। পুরুষটির শরীরের বন্য দুর্গন্ধ। আমার ঘ্রাণে আমি পাইতেছি। কোলনযুক্ত আধুনিক সাবানে গাত্রমার্জনা করিয়া একটি জিন্সের প্যান্ট ও ঢিলাঢালা টি-শার্ট পরাইয়া হাতে একটি গিটার ধরাইয়া দিলে একালের বিটলস হইতে পারিত। রমণীটিকে তেমনভাবে সাজাইতে পারিলেই একালের ব্লকবাস্টার হিন্দি ছায়াছবির ধর্ষিতা নায়িকা। সামান্য রকমফের করিতে পারিলেই চরিত্র দুটি আর্টের মর্যাদা পাইত অবশ্যই। আমাকেও অধোবদন হইতে হইত না; কিন্তু উহা তো আর্ট নহে। আদি মানবের জীবন। ক্ষণকাল পূর্বে কাঁচা শূকরের মাংস ভক্ষণ করিয়াছে। তাহার পরে কাম তাড়িত হইয়া কোনও এক গোষ্ঠীর স্ত্রীলোকটিকে বাহুবলে ঘষড়াইতে ঘষড়াইতে লইয়া চলিয়াছে। ইহা রিরংসা। ওই পুরুষটিই তো কালের পথ ধরিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে নরসুন্দর সেলুনে আসিয়া চুলে ‘দশ আনা ছ আনা’, অথবা স্ট্র কাট মারিতে বলিতেছে। ‘টুইন ব্লেড’ দিয়া দাড়ি কামাইয়া ‘আফটার শেভ’ মাখিতেছে। ‘ব্যাগি’। চড়াইয়া ‘মোটর বাইক’ হাঁকাইয়া বহুতল বাড়ির উচ্চতলে, শীতল কক্ষে বসিয়া ‘কম্পুটার’ নামক যন্ত্রে দশ আনা, ছ আনা করিতেছে। ওই পুরুষটিই তো মাঘের শুভসন্ধ্যালগ্নে যদিদং মদিদং বলিয়া কোনও এক তন্বী শ্যামা শিখরী দশনাকে কেশাকর্ষণে না হউক গাঁটছড়া বাঁধিয়া যন্ত্রনে গাদাই করিয়া ‘ফ্ল্যাট’ নামক খাঁচায় আনিয়া চিরকালের জন্য বন্দি করিতেছে। ‘লক-স্টক ব্যারেল’ সহ উৎপাটন। সমস্ত ‘আইডেনটিটির’ উৎসাদন। দত্ত বসু হইয়া যাইতেছে, বসু বন্দ্যোপাধ্যায় হইতেছে। পূর্বের পরিবেশ ভুলিয়া শ্বশুরালয়ের পরিবেশে অভ্যস্ত হইবার কসরত চালাইতেছে। সঙ্গে আনিয়াছিল ভরি ভরি স্বর্ণালঙ্কার তাহা শাশুড়ি নামক এক আপাত মধুর কিন্তু আসলে একটি ‘বিষকুম্ভ পয়োমুখম’-এর কবজায় চলিয়া গিয়াছে। নগদ কেতার নোট সমূহে। বাবাজীবন সানাইয়ের ফাটা রেকর্ড বাজাইয়া ভূতভোজন করাইয়া ফুলশয্যা করিয়াছেন। জুই ও রজনীগন্ধার মালা শুকাইতে না শুকাইতেই নিজ অরণ্যমূর্তি ধারণ করিয়া, এই লে আও, সেই লে। আও, বলিয়া হুংকার ছাড়িতেছেন। বিএ পাঠরতা কুঁদুলে ননদিনী লাল পিঁপড়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া দংশন করিতেছে। ব্যবসায় আরও টাকা ঢালিতে হইবে, অতএব আইস। কন্যাটিকে আচ্ছা করিয়া ধোলাই দেওয়া যাউক তাহা হইলে শ্বশুমহাশয় সোনার ডিম্ব পাড়িবেন। যদি দেখা যায় তাঁহার ‘কনস্টিপেনশান’-এর ফলে ডিম্ব বাহির হইতেছে না কিছুতেই, তখন একপাত্র কেরোসিন বধূর গায়ে ঢালিয়া দেশলাই মারিয়া দাও, উল্লাস নৃত্য করো—আজ। আমাদের ন্যাড়া পোড়া কাল আমাদের দোল। আদিম মানব প্যান্ট-শার্ট পরিয়াছে মাত্র, স্কচ সহযোগে বোনলেস খাইতেছে মাত্র, বায়ুযানে চড়িয়া বিলাতেও যাইতেছে, অঙ্গে বিলাতি পারফিউম ফ্যাঁস করিতেছে, ট্রেনের আপার বাঙ্কে শুইয়া ইংরেজি পেপারব্যাক পড়িতেছে, চিবাইয়া ইয়াঙ্কি ইংরেজি বলিতেছে, কিন্তু জিপ ফাস্টনার’ টানিলেই বিপদ, বরাহ বাহির হইয়া। পড়িবে। সংস্কার যাইবে কোথায়! রাক্ষসরা সাধে বলিত, হাঁউ মাঁউ খাঁউ মনিষ্যি গন্ধ পাঁউ। পুরুষ প্রজাতির মনুষ্যের উগ্র পাশব গন্ধ ইরানের সহস্র গোলাপের নির্যাসেও যাইবার নহে। বরাহ ‘ডকটরেট’ হইলেও ডক্টর বরাহ ভিন্ন কিছু নহে। অবতার হইলেও বরাহ বরাহই।
আমার কথাতেই আবার ফিরিয়া আসি।
আমার ভবিতব্য স্ত্রী-র সহিত বিশ্ববিদ্যালয়ে একদা পঠিতব্য অবস্থায় ছিলাম। যৌবনের স্বাভাবিক ধর্মে প্রথমে চক্ষুতে চক্ষুতে ঠোকাঠুকি, তৎপরে ঠোঁটের কোণে কোণে ফিচিক ফিচিক হাসি। অবশেসে সাহস কিঞ্চিত বাড়িবার পর ‘ক্লাসে প্রবেশ ও প্রস্থানের সময় অঙ্গে অঙ্গ ঘর্ষণ।
বলিতে দ্বিধা নাই কসরত আমিই অধিক করিয়াছিলাম। জীবজগতের তাহাই নিয়ম। এক বর্ষার দ্বিপ্রহরে শান্তিনিকেতনে এক ময়ূরকে সারাবেলা পেখম মেলিয়া নাচিতে দেখিয়াছিলাম। নাচিতে নাচিতে তাহার পেখম খুলিয়া পড়িতেছিল, ময়ূরী কিন্তু দৃকপাত করিতেছিল না। নিষ্ঠুর রমণী ‘চিউইংগাম’ চিবাইতেছিল। ময়ূরের কষ্ট দেখিয়া আমিই বারকতক বলিলাম—’আই লাভ ইউ।’ উদ্যানপালককে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মহাশয়! কবে মিলন হইবে! আদৌ হইবে তো!’
তিনি বলিলেন, ‘হবে না মানে। আলবাত হবে। ছলা, কলা, ছোমা—এই হল মেয়েদের ধর্ম। না হলে ময়ূর, বাঘ, সিংহ, বেড়াল, সব তো লোপাট হয়ে যেত। জন্তু শ্রেণির স্ত্রী জাতির উদ্দেশে উদ্যানপালকের এবম্বিধ মন্তব্যে একটি ক্ষোভ ছিল। পরে আমি রহস্য উদ্ধার করিতে সক্ষম হইয়াছিলাম। তাঁহার এই আকাট উত্মার লক্ষ্যে ছিলেন এক নারী। গত তিন বছর ধরিয়া সেই মোহিনী ল্যাজে খেলিতেছেন, বিবাহবন্ধনে ধরা দিতেছেন না। সন্নিকটে আসিয়া আবার সরিয়া যায়। সন্ধ্যাকালে পেটে দু-একপাত্র পড়িবামাত্র তাঁহার হৃদয়ের দুয়ার খুলিয়া গেল। তাঁহার প্রেমিকার নাম রোহিণী। আমি সেই নায়িকাকে দর্শনও করিয়াছিলাম। বলিতে দ্বিধা নাই, দেহবোধে আমিও অতিশয় কাতর হইয়াছিলাম। তখন আমার ঠোঁটে কবিতার পর কবিতা খেলা করিত। তখন আমিও প্রেম নামক দ্বাপরীয় দুর্বলতায় কাতর। নারীকে চিনিতে ও গ্রহণ করিতে শিখিয়াছি। এই বোধে উপনীত হইয়াছি—পৃথিবী মানে শ্যামল, সবুজ বৃক্ষরাজি, কলস্বনা নদী, নীল আকাশ, চন্দ্রকিরণ ও নারী। প্রেমের কারণেই আগমন। জমিয়া গেলে সংসার, ভাঙিয়া। গেলেই আত্মহত্যা অথবা সমাজসেবা। সেই কারণেই রোহিণীকে দর্শনমাত্রেই রাম বসুর এক চরণ কবিতা ভিতরে গুড়গুড় করিয়া উঠিল, ‘দেখল ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ফলসা রঙা মেয়ে।’ সেই মেয়েটি কেমন! না, ‘জোয়ার-লাগা নদীর মতো ভরাট কূলে কূলে।’ আমার মনে হইতেছিল, উদ্যানপালক গাজন মালীকে দ্বৈরথে পরাস্ত করিয়া রোহিণীকে লইয়া পলায়ন করি, পর্বতের সানুদেশে কুটীর নির্মাণ করিয়া, মেষপালন করি ও বজরার রুটি খাই। তাহার কবরীবন্ধন, ‘দাওয়ার খুঁটি দুহাতে ধরে স্বপ্ন দেখা মেয়ে।’ শরীরের তরঙ্গ ভঙ্গ। তির ছুড়িবার কায়টা, মদ্য না পান করিয়াও দেহসুরায় মাতাল হইলাম,
‘বুকের মধ্যে পেঁকির পাড়, বাজল দূরে শাঁখ
নদীর বাঁকে শুনতে পেল চোদ্দ জয়ঢাক।
চমকে দিয়ে বললে তারে, ‘কনে,
চন্দ্রহার গড়িয়া দেব পৌষ-পারবণে।
নদীর কাছে দান চাইলাম, তোমায় পেলাম বৌ
তুমি আমার পদ্মবিলের মৌ।’
আমার সহপাঠিনীর প্রতি অন্যান্য সহপাঠীদেরও খর দৃষ্টি ছিল। থাকিতেই পারে। পুরুষ জাতি মক্ষিকার ন্যায়। কর্তিত ফল অথবা নিবেদিত মিষ্টান্ন অথবা মুদির দোকানে ভেলি গুড়ের বস্তার চারিপার্শ্বে ভ্যান ভ্যান করিবেই। এই মক্ষিকাদের অনেকেই পুঁজির জোর বেশি থাকায় আমার ওপর ‘অ্যাডভানটেজ’ লইবার চেষ্টায় ত্রুটি করে নাই। জোড়া জোড়া কাটলেট, ডবল ডবল আইসক্রিম ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী সহায়ে তাহারা একটা কিছু করিতে চাহিতেছিল। একটি এলোকেশী বার্তাকু, অথবা অলাবতে, কিংবা পেয়ারায় কীট প্রবেশ করিবেই। করিয়া, প্রেম। করিবে না, কুরিয়া কুরিয়া খাইবে। ভোগ করিবে। নারী পুরুষদের এবম্বিধ লম্পট প্রকৃতির কথা সৃষ্টির মুহূর্ত হইতেই অকাত আছে। একালের নারীবাদী কবিরা প্রাবন্ধিকরা যাহা লিখিতেছেন তাহা শতকরা একশো ভাগ সত্য। পুরুষ শুণ্ডধারী জলশুক্তির ন্যায়, রোঁয়াধারী শুককীটের ন্যায়, গুম্ভ বাহিয়া, পদদ্বয়ের মসৃণ ত্বক বাহিয়া কিলিবিলি করিতে করিতে, জঘনে আসিয়া যাবতীয় জঘন্যকার্য করিবার জন্য আকুলিবিকুলি করিতে থাকে। দুর্গন্ধী রোমশ ঋক্ষের ন্যায় দেহকাণ্ড জড়াইয়া ধরিয়া অন্ধ উল্লুকের ন্যায় নাভিদেশে, গ্রীবায়, কর্ণমূলে ঠোকরাইতে থাকে। উল্লুকের ন্যায় উকু উকুশব্দে কোমল বক্ষদেশ খাবলাইতে থাকে। কমঠের ন্যায় যত্রতত্র দংশন করিতে করিতে একসময় ক্লান্ত সারমেয়ের ন্যায় ল্যাতকাইয়া পড়ে। নগরপাল, ধর্মপাল, রাজ্যপাল, রাষ্ট্রপাল, ক্ষেত্রপাল—সকলেরই এক অবস্থা। রমণীর রমণীয় শরীর দেখিবামাত্র ‘দুই চক্ষু জিনি নাদান ঘুরের যেন কড়ি ভাঁটা।’ ডেমোস্থেনিস উত্তম বলিয়াছিলেন, আমারও বলিতে বাসনা হইতেছে,
Man has the hetaire for erotic enjoyment, concubines
for daily use, and wives of his own rank to bring up
childern and to be faithful housewives.
পাঠদ্দশায় আর যাহাই হউক, কনকুবাইনই বা কোথায় ওয়াইফই বা কোথায়! পাশ করিব, চাকরি করিব, তৎপরে পিতামাতা আমার জন্য বধূ ধরিয়া আনিবেন। চড়াই পাখির মতো সামান্য প্রেমই ভরসা। আমার ভবিতব্য স্ত্রীকে ঘিরিয়া যখন হলুদ বোলতারা উড়িতেছিল, তখন প্রশ্ন আসিয়াছিল, রমণীরা কি সত্যই প্রেমে পড়েন? একই সঙ্গে এতগুলি ছাগলকে যিনি চরাইতে পারেন, তিনি তো রাখাল। রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে। উচ্চাঙ্গের একটি উপমা মনে আসিয়াছিল—যথা, ‘নারী কি সরোবর?’ জলে মানুষ পড়ে। পড়িয়া, সন্তরণবিদ্যা আয়ত্তে না থাকিলে, হাবুডুবু খাইয়া, পেট ফুলিয়া, লাংস ফাটিয়া মরিয়া যায়। জল কি কখনও মানুষে পড়ে! তখন শেকসপিয়ার পড়িতেছিলাম, দেখিলাম ক্ষুব্ধ হ্যামলেট বলিতেছেন,
‘Frailty, thy name is woman’ বিশ্বস্ত না থাকাটাই নারীর ধর্ম। ইহা অবশ্য নারীর কথা নহে; পুরুষের দর্শন।
একটি লোককাহিনি এই প্রসঙ্গে মনে আসিতেছে। অনেকটা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী অথবা শুক-শারির কাহিনির মতোই। হিন্দি ভাষায় প্রচলিত এই নামে—কিসসা তোতা ময়না। সারা দিবস ওড়াউড়ি করিয়া, ক্লান্ত শুক একটি বৃক্ষশাখায় আসিয়া রাত্রির বিশ্রামের জন্য বসিল। সেই বৃক্ষে একটি স্ত্রী। ময়না বসবাস করিত ও সেই পক্ষীটি ছিল ঘোরতর নারীবাদী, যাহাকে একালে আমরা বলিতেছি, ‘ফেমিনিস্ট’। ময়না গালগলা ফুলাইয়া, পুরুষ শুককে বলিল, ‘ওহে শুক, এখান থেকে কেটে পড়ো। মদ্দাদের আমি সহ্য করতে পারি না। তারা অসভ্য, ইতর, চামার, নিষ্ঠুর, অবিশ্বাসী। দেখলেই আমার পিত্তি চটে যায়, গা রি রি করে। তোমার সঙ্গে একই গাছে রাত কাটাতে আমার ঘেন্না করবে।’
শুক তখন পুরুষদের পক্ষে লড়াই করিবার জন্য বলিল, ‘ময়নাসুন্দরী, মেয়েরাও কিছু কম যায় না, তাহলে শোনো বলি, ‘কাঞ্চনপুরায় অঙ্গধ্বজ নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর রানির নাম ছিল চন্দ্রপ্রভা। রানি খুব ধার্মিক আর পতিপরায়ণ ছিলেন। একদিন এক ব্রাহ্মণ কোথা থেকে এসে রাজা অঙ্গধ্বজকে দু-টুকরো কাগজ দিয়ে চলে গেলেন। একটাতে লেখা রয়েছে যে রাজা সারারাত জেগে থাকতে পারে, সে খুব ভালো ফল পায়। দ্বিতীয় টুকরোয় লেখা আছে—যে। শত্রুকে সম্মান জানাতে পারে তার সমস্ত অপরাধ খণ্ডন হয়ে যায়।
দিন যায়, হঠাৎ রাজার মনে হল, দেখাই যাক ব্রাহ্মণের নির্দেশ পালন করলে কী হয়! ঠিক করলেন, সারা রাত জাগবেন সেদিন। রাজপ্রাসাদে জেগে বসে আছেন রাজা। গভীর রাত। হঠাৎ কানে এল, প্রাসাদের বাইরে কোনও মহিলা কাঁদছে। আমি মানুষের দুঃখ দূর করতে পারিনি। আমি ব্যর্থ। রাজা ছুটলেন। কান্নার শব্দ অনুসরণ করে গিয়ে দেখলেন, এক বৃদ্ধা কাঁদছে। রাজা দুঃখের কারণ জানতে চাইলেন। বৃদ্ধা বললেন, পথিক তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও, ভগবানেরও ক্ষমতা নেই আমার দুঃখ দূর করেন। শেষে রাজার ঝোলাঝুলিতে বৃদ্ধা বললেন, একটি শর্তে তোমাকে বলতে পারি, তুমি যা শুনবে কারও কাছে বলবে না। যদি বলো, তাহলে তুমি পাথর হয়ে যাবে। রাজা বললেন, ঠিক আছে মা, তুমি বলো, আমি কারওকে বলব না। বৃদ্ধা তখন। বললেন, পুত্র! আগামীকাল রাত দশটার সময়, রাজা অঙ্গধ্বজকে সাপে কামড়াবে। রাজা মারা যাবেন। এমন ধার্মিক রাজা আর আমরা পাব কোথায়। তাই আমি কাঁদছি পুত্র! রাজা জিগ্যেস করলেন, মা সাপটা আসবে কোথা থেকে? বৃদ্ধা বললেন, এই নগরের পশ্চিমদিকের সিংহদুয়ারের বাইরে যে শিবমন্দির আছে, তার পাশেই আছে একটা বটগাছ। সেই বটের কোটরে সাপটা থাকে। সাপটার সঙ্গে রাজার পূর্বজন্মের শত্রুতা। এইবার সে বদলা নেবে! রাজা প্রশ্ন করলেন, মা, সাপের সঙ্গে রাজার কীসের শত্রুতা? বৃদ্ধা তখন রাজার পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত বললেন। পুত্র! আমাদের রাজা পূর্বজন্মে এক বণিক ছিলেন, নাম ছিল মণিসেন। তাঁর স্ত্রী-র নাম ছিল কেশর। কেশরের বয়েস তখন কুড়ি, আর পরমাসুন্দরী। মণিসেন একদিন বাণিজ্যে গেলেন। স্ত্রীকে রেখে গেলেন আঠেরো বছর বয়সের এক ভৃত্যের তত্বাবধানে। মণিসেন বাণিজ্যে গেলেন। বাড়িতে কেশর আর গৃহভৃত্য। হঠাৎ কেশরের একদিন ভীষণ দেহ-বাসনা জাগল। কিছুতেই নিজেকে। আর ধরে রাখতে পারে না। শেষে শোবার ঘরে ভৃত্যকে ডেকে বললে, বিছানায় বোসো। আমার পাশে বোসো। তারপর পরিষ্কার বললে, আমি তোমাকে চাই। এখুনি চাই। ভৃত্য প্রস্তাব শুনে কেঁদে ফেলেছে, হাতজোড় করে বলছে, আমি পারব না। আপনি আমার মা। আমি বড়দের কাছে শুনেছি, যিনি অন্নদাতা তিনিই পিতা অথবা মাতা। প্রভুপত্নীর সঙ্গে গর্হিত কাজের পরিণাম, নরকবাস। কেশর তো তখন ভীষণ কামার্ত। ভৃত্যকে বলছে, যা বলছি, তা যদি না করি, তাহলে ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে। ছেলেটিকে খুব ভয় দেখাল, সে কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না। কিছুদিনের মধ্যেই বণিক মণিসেন ফিরে এলেন। কেশরের খুব চিন্তা হল, ছেলেটা যদি স্বামীকে সব কথা বলে দেয় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এমন একটা কিছু করতে হবে, যাতে ছেলেটার মুখ বন্ধ হয়, আর তাকে প্রত্যাখানের জন্যে যেভাবে অপমানিত হয়েছে তার উচিত সাজা পায়। ছেলেটা কেশরকে অপমান করেছে।
‘মণিসেন বিষণ্ণ স্ত্রীকে জিগ্যেস করলেন, প্রিয়ে! তোমার কী হয়েছে, ফিরে এসে দেখছি, সদাই বিষণ্ণ, কীসের দুঃখ তোমার, আমাকে বলো।’ কেশর বলছে প্রভু! তোমার বাড়িঘর তুমি বুঝে। নাও, আমি আত্মহত্যা করব। মণিসেন বলছেন, সে কী! কী হয়েছে! তুমি আমাকে খুলে বলল। কেশর একেবারে উলটো কথাটি বললে, আপনি যখন ছিলেন না, তখন একদিন রাতে, ছাতে বিছানা পেতে শুয়ে আছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, দেখি, আপনার চাকর আমার বুকে চেপে বসে আসে। আর বেশি দূর এগোবার আগেই আমার চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে এল। আমি লজ্জায় তাদের আর কিছু বলিনি। বলেছিলুম, ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছি। মণিসেন সেইরাতেই। ভৃত্যকে খুন করে মাটিতে পুঁতে দিলেন। এই জন্মে সেই মণিসেনই অঙ্গধ্বজ, আর সেই গৃহভৃত্যই সাপ হয়ে জন্মেছেন।
‘বৃদ্ধার কথা শুনে রাজা অঙ্গধ্বজ প্রাসাদে ফিরে এলেন। শুক বললে, তাহলে দেখো ময়না, মেয়েরা কী সাজ্জতিক। নিরপরাধ, প্রকৃত ধার্মিক একটি ছেলের মৃত্যুর কারণ হল। ময়না বললে, মানতে পারলুম না। তোমার এই কাহিনিতে, নারী ও পুরুষ দুজনেই সমান অপরাধী। মণিসেন স্ত্রৈণ ছিল। সুন্দরী স্ত্রী-র ভেড়ুয়া। তার উচিত ছিল স্ত্রী-র কথা যাচাই করা। শুক বললে, তোমার এই কথায় আমার কথাই জোরদার হচ্ছে। মেয়েরা কত ভয়ংকর বোঝো একবার। কীভাবে মোহজাল বিস্তার করে। পুরুষকে কীভাবে বশ করে ফেলে বিচারবুদ্ধি লোপ পায়। গলা জড়িয়ে ধরে, মিষ্টি কথা বলে, দেহের ফাঁদে ধরে যে-কোনও কাজই করাতে পারে।’
ময়না বললে, এরও জবাব আছে। শুক বললে, দাঁড়াও, আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি। রাজা প্রাসাদে ফিরে এসে ভাবছেন, কী করা যায়! মরতে যখন হবে তখন মরতেই হবে, তবু দেখে যাব ব্রাহ্মণের দেওয়া দ্বিতীয় কাগজের নির্দেশ পালন করে কী হয়! শত্রুকে সম্মান জানাতে বলেছেন। সাপই এখন পরম শত্রু। সকালে প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। রাজা বললেন, আজ রাত দশটার সময় একটা সাপ আসবে আমাকে কামড়াতে। শিবমন্দিরের পাশের বটগাছের কোটরে সাপটা থাকে। সেই গর্ত থেকে আমার বিছানা পর্যন্ত গোটা পথটা আপনি আপনার কর্মচারীদের দিয়ে পরিষ্কার করান। আতর ছড়িয়ে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ঢেকে দিন, আর পথের দু-পাশে সারি সারি সুন্দর বাটিতে সুগন্ধী দুধ রাখুন।
‘রাত দশটার কিছু আগে সাপ বেরিয়ে এল গর্ত থেকে। ভীষণ তার রাগ। পূর্বজন্মের হত্যাকারীর আজ শেষ দিন। কিন্তু সাপ তো অবাক। এ কী ব্যাপার! যেদিকেই তাকাচ্ছে, গোলাপ আর গোলাপ, সুগন্ধ। সার সার বাটিতে সুগন্ধী দুধ। শত্রুকে কি এইভাবেই সম্মান জানাতে হয়!
‘রাজবাড়ির ঘড়িতে ঠিক রাত দশটা। সাপ এসে ঢুকল রাজার শয়নকক্ষে। বিছানায় প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন রাজা। সাপকে দেখে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনার অপেক্ষাতেই বসে আছি, আসুন দংশন করুন।
‘সাপ সমস্ত শত্রুতা ভুলে রাজাকে বললে, মহারাজ! সব শত্রুতা আমি ভুলে গেছি। এমন উদার, অপূর্ব ধার্মিক রাজা পৃথিবীতে সম্ভব! ধন্য আপনার পিতামাতা। আপনি সুখে রাজত্ব করুন। সাপ তুষ্ট হয়ে রাজাকে ক্ষমা করে চলে গেল।
‘রানি তখন অবাক হয়ে জিগ্যেস করছেন—মহারাজ! আপনি আগেই কীভাবে জানলেন, সাপ আপনাকে কামড়াতে আসবে! রাজা বললেন, রানি সেই কথাটা তুমি জানতে চেয়ো না। আমি যদি তোমাকে বলি, তাহলে আমি পাথর হয়ে যাব। রানি কিন্তু নাছোড়বান্দা। ভীষণ তাঁর কৌতূহল। রাজাকে বলছেন, সে আপনি পাথর হোন আর যাই হোন, আপনাকে বলতেই হবে। তা হলে, আমি আত্মহত্যা করব।
রাজা বললেন, বেশ, তাই যখন তোমার ইচ্ছে, তখন সকাল না-হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকো। পাথর আমাকে হতেই হবে। কাল সকালে গঙ্গার ধারে পবিত্র জায়গায় দাঁড়িয়ে তোমাকে বলব। সেইখানেই আমি পাথর হয়ে থাকব।
‘রানিকে সবাই খুব বোঝালে, রাজা যদি পাথরই হয়ে যান, তাহলে শুনে আপনার লাভটা কী হবে! ক্ষতিই তো হবে! রানি বলে আপনাকে কে আর তখন সম্মান করবে! রাজাকেও বোঝানো হল। তিনিও বুঝতে চাইলেন না। রানির প্রেমে অন্ধ। রানিকে ছেড়ে তিনি এক মুহূর্তও থাকতে পারবেন না। তার আত্মহত্যার চেয়ে নিজের পাথর হয়ে যাওয়া ভালো। রানিকে তিনি বলতেই পারলেন না, কেন তুমি এমন অবুঝ হচ্ছ। আসক্তি এমনই জিনিস, বুঝেছ ময়না।
‘সকালবেলা গঙ্গার ধারে দৃশ্য প্রস্তুত। রাজ্যসুদ্ধ লোক সেখানে এসে গেছে। তাদের প্রিয় রাজার কী হয় দেখার জন্যে। পাথর হয়ে যাওয়া মানেই রাজার মরে যাওয়া। প্রধানমন্ত্রী তখনও রানিকে বোঝাচ্ছেন, পাথর হয়ে গেলে এমন সুন্দর রাজা কি আর দুটো হবেন, তিনি তো সিংহাসনে। বসেই আপনাকে দূর করে দেবেন। জেদি, একগুঁয়ে মেয়েদের জীবনে কিন্তু অনেক দুঃখ লেখা থাকে।
‘রানি বললেন, তেমন কোনও উদাহরণ আমার জানা নেই মহামন্ত্রী।
‘মন্ত্রী বললেন, তাহলে শুনুন, সুরসেন নামে এক নগরের রাজার নাম ছিল রূপদত্ত। তিনি নিজে যেমন সুন্দর ছিলেন, তাঁর স্ত্রী চন্দ্রকান্তাও ছিলেন ভীষণ সুন্দরী। সুন্দরী হলে কী হবে। মেয়েটির স্বভাব-চরিত্র মোটেই ভালো ছিল না। বিয়ের আগে থেকেই তার একজন প্রেমিক ছিল। চন্দ্রকান্তা সেই প্রেমিককে হিজড়ে সাজিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে এল। রাজা রূপদত্তের কোনও সন্দেহ হল না। রানির সেবার জন্যে একজন হিজড়ে আসতেই পারে। কিন্তু তা তো নয়। রাজা রাজকার্যে বাইরে গেলেই চন্দ্রকান্তা তার প্রেমিকের সঙ্গে রপ্টারপ্টি কাণ্ড করে। দু-নম্বরী তো বেশি দিন চাপা থাকে না। রূপদত্ত একদিন জড়াজড়ি অবস্থায় দুজনকে ধরে ফেললেন। বউকে বললেন, একে তুমি ছাড়তে পারবে? বউ বললে অসম্ভব! ওকে আমি আমার হৃদয় দিয়েছি। রূপদত্ত বললেন, বহত আচ্ছা! তুমি তাহলে আমাকে তোমার নাক আর কান দুটো দিয়ে বনে চলে যাও। নাক-কান কাটা চন্দ্রকান্তা গেল বনে, আর তার সোহাগের প্রেমিককে চড়ানো হল শূলে।
‘প্রধানমন্ত্রী কাহিনি শেষ করে বললেন, তা হলে একবার ভেবে দেখুন, শাস্ত্র বলছে, রাজা আর যোগী, আগুন আর জল বিপরীতধর্মী, যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো। কারণ তাদের পিরিতি খুব অনিশ্চিত।
‘মন্ত্রীর কথায় কোনও পাত্তাই দিলেন না রানি। যা হয় হবে, আমি জানবই। রানির প্রেমে রাজা অন্ধ। শেষ মুহূর্তে অনেকেই অনেক রকম বোঝাল! মন্ত্রীরা বলতে লাগলেন, মহারাজ! আপনি এমন বিচক্ষণ, প্রজাদরদি, জ্ঞানী, ধার্মিক, আপনি একটি মেয়ের কথায় নাচছেন! এই রানি আত্মহত্যা করলে, এর চেয়ে ভালো আরও দশটা রানি আপনাকে এনে দেব। আপনি বিবেচকের মতো কাজ করুন। রাজা রানির মোহেবুদ। পরিষ্কার বললেন, ওকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা অসম্ভব! সবাই তখন হাল ছেড়ে দিলেন। যা হতে চলেছে তাই হোক।
‘রাজা গেলেন গঙ্গাস্নানে। স্নান করে পবিত্র হয়ে চিরকালের মতো পাথর হয়ে যাবেন। শেষবারের মতো গঙ্গাদর্শন করবেন প্রাণ ভরে। তাই বসলেন তীরে। এমন সময় কোথা থেকে একপাল। ছাগল এল জল খেতে। সব ছাগলই জল খেয়ে চলে যাচ্ছে, কেবল একটা ছাগল জলের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়েই আছে। তখন দলের কর্তা ছাগলটা এসে জিগ্যেস করছে, তোর আবার কী হল! ছাগলীটা স্রোতে একটা ফল ভেসে যাচ্ছে দেখছে। সে বললে, ওই ফলটা আমাকে না এনে দিলে যাব না। ছাগল কর্তা বলছে, এনে তো দেব; কিন্তু আমি যদি ডুবে যাই! ছাগলীর। বায়না, তোমার যাই হোক, ফলটা না এনে দিলে আমি নড়ব না। ছাগল কর্তা তখন খেপে আগুন। চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল। কর্তা ছাগল বলছে, শোন, আমাকে তুই রাজা অঙ্গধ্বজের মতো বোকা পাঁঠা ভাবিসনি, যে বউয়ের কথায় নাচতে নাচতে চলে এল গঙ্গার ধারে জীবন। দিতে। তুই তাহলে এখনও আমাকে ঠিকমতো চিনতে পারিসনি। ওই সব ছেনালি রাখ। চল। দামড়া ছাগল ছাগলীটাকে গুতোতে গুতোতে দলের দিকে নিয়ে চলল।
রাজামশাই কান খাড়া করে কথাটা শুনলেন। ভয়ংকর একটা ধিক্কার এল রাজার মনে। আমি একটা ছাগলেরও অধম। নারীর প্রতি প্রবল আসক্তির ফলে আজ আমার এই অবস্থা। যে রানিকে আমি এত ভালোবাসি, সে আমার প্রাণ নিতে চাইছে, আর আমি বোকার মতো আমার মূল্যবান। জীবন নষ্ট করতে চলেছি। আমি ছাগলেরও ছাগল।
‘রাজা স্নান সেরে ফিরে মন্ত্রীমণ্ডলী ও রানিকে ডেকে বললেন—কথাটা হল এই, আমি সেই গোপন কথাটি বলে পাথর হয়ে যাব, মানে সরে যাব, তা রানি তুমি কি তাই চাও! রানি বললেন, মহারাজ! আপনার যাই হোক আমি রহস্যটা জানতে চাই।
‘রাজামশাই তো আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ছাগলের কথায় তাঁর বোধোদয় হয়েছে। তাঁর মনে পড়ে গেছে, কবির কথা, সন্তানের জন্ম দিয়ে নারী মা হয়, বালিকা অবস্থায় সহবাস, কখনও সে দেবী, পূজিতা, আবার কখনও সেই নারীই স্বয়ং মৃত্যু, জীবন ছিনিয়ে নেয়। রাজা কিছু আগেই নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন, এত নির্বুদ্ধি আমি! শত ধিক্কার সেই রমণীকে যে মিষ্টি কথায় পুরুষকে ভেড়া বানায়, ধিক্কার সেই পুরুষকেও যে সব খুইয়ে দুষ্ট নারীর কথায় দাসে পরিণত হয়।
‘রাজা বললেন, রানি এইবার তাহলে দেখো আমি কী করি। একটা চাবুক চেয়ে নিয়ে প্রিয় রানিকে বেধড়ক পেটাতে লাগলেন। রানি পায়ে ধরে তখন ক্ষমা চাইছেন। রাজার তখন পৌরুষ জেগেছে। কোটালকে ডেকে বললেন, একে নিয়ে যাও, চোখ দুটো তুলে নিয়ে বনে ছেড়ে দিয়ে এসো।
শুক বললে, ‘ময়নাসুন্দরী আমার যা বলার তা বলা হয়ে গেল। মোদ্দা কথা হল, নারী জাতিকে বিশ্বাস করা কখনওই উচিত নয়, করেছ কী মরেছ। এই গল্পটি বলিবার উদ্দেশ্য, নারীরা পুরুষকে বাদ দিবার জন্য ঘোরতর আন্দোলনে নামিয়াছেন, মাগি-রন্ধনে নিযুক্ত আমার অধ্যাপিকা স্ত্রীও সেই আন্দোলনে শামিল হইয়াছেন। কাগজের মণ্ড হইতে প্রস্তুত বীভৎস একটি রাক্ষসের মুখোশ আনিয়া বসিবার ঘরের দেয়ালে। ঝুলাইয়া বুঝাইতে চাহিতেছে উহা আমারই ভিতরের মুখ। পুরুষকে তাঁহারা কী বাদ দিবেন, বহু পূর্ব হইতেই পুরুষ তাহার জীবন হইতে নারীকে বাদ দিবার জন্য বহুবিধ প্রচেষ্টা চালাইতেছে। পারিতেছেন না, কারণ ষণ্ডের স্বভাব উপদেশের মণ্ডা খাইলেও শোধরাইবার নয়। পূর্বে যখন শহরে ষণ্ডদের অবাধ বিচরণের সুযোগ ছিল তখন দেখিয়াছি, বাঁধাকপির পাতা চিবাইতে চিবাইতে বিশাল ষণ্ড ধিতিং ধিতিং করিয়া গাভীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়াছে। লাজলজ্জা নাই। স্মরণে নাই, কোন দেবতার বাহন!
তাহা হইলে সমর সেন মহাশয়ের ‘বাবু বৃত্তান্ত’ হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতে হয় পুরুষের মানসিকতা স্পষ্ট করিবার জন্যে। ‘উত্তরদিকে অস্বচ্ছল ব্রাহ্মণ পরিবারের একটি মেয়েকে দেখার জন্যে সন্ধেবেলায় আমাদের চারতলার নেড়া ছাদে ভিড় হতো। মেয়েটির নাম ইতি, পাকা সোনার মতো রং, দেহের গড়ন দেখার মতো, বিশেষ করে সাঁঝের বেলায় গা ধোওয়ার পর যখন শাড়ি মেলে দিতে আসতো। দাদার বন্ধু বড়লোক ব্রাহ্মণ যুবক বিয়ের প্রস্তাব পাঠান, কিন্তু কৌলীন্যের দাপটে কন্যাপক্ষ রাজী হননি। পশ্চিম দিকের বাড়িতে তেতলা ঘরে রাত্রে নীল আবছা আলোয় একজন অ্যাটর্নি তার নধর স্ত্রীর সঙ্গে ভারতচন্দ্রীয় রতিরঙ্গে মত্ত হতেন, বড়োরা বলতো, ‘rolling stone gathers no moss.’
বিভিন্ন গ্রন্থাদি পাঠ করিয়া নিজেকে আবিষ্কার করিবার চেষ্টা করিয়াছি। নারীর আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। পজেটিভ ও নেগেটিভের ব্যাপার। প্লাস ঘুরিতেছে মাইনাসের জন্যে। প্লাস ষণ্ড, মাইনাস প্রকৃতি। যতক্ষণ না মাইনাস জুটাইতে পারিতেছে ততক্ষণ নানা অনাসৃষ্টি করিয়া বেড়াইবে। ছাতে উঠিয়া রমণীর স্নানদৃশ্য দেখিবে, বাসে চড়িয়া ঘনিষ্ট হইবার চেষ্টা করিবে। বন্ধুর বিবাহে বরযাত্রীর সঙ্গী হইয়া বিবাহবাসরে নেগেটিভ দেখিয়া আবোলতাবোল বকিবে। শেকসপিয়ার তথার্থই লিখিয়াছিলেন—
She’s beautiful and therfore to be wood/ she is a
woman, therfore to be won.
আমি আমার স্ত্রীকে জয় করিবার জন্য যাহা করিয়াছিলাম তাহা ভাবিতে এই প্রবীণ বয়সে কামরাঙা হইয়া যাই। ময়দানের বিশাল বৃক্ষমূলে বসিয়া সোহাগের কথা বলিতাম। কবিতা আবৃত্তি করিতাম। ঘষড়াইয়া তাহার সহিত ঘোঁতঘোঁতে অবস্থায় আসিবার চেষ্টা করিতাম। পুলকে আমার শরীর শিহরিত হইত। আবেগে চক্ষুদ্বয় অশ্রুসজল হইত। ভাবিতাম—
Love is an activity, not a passive affect; it is ‘standing in’, not a ‘falling for রাসেল হইতে উদ্ধৃত করিতাম, I regard love as one of the most important thing in human life, and I regard any system as bad which interferes unnecessarily with to free development. বলিয়াই তাহার হাত খামচাইবার চেষ্টা করিতাম, আর সে সঙ্গে সঙ্গে বলিত, ‘ছিঃ ছিঃ, কমিট নো নুইসেন্স ইন দি পাবলিক প্লেস।’ তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল, ওই নারীর মধ্যে নারীবাদ সুপ্ত আছে। কালে উগ্ররূপ ধারণ করিবে। তথাপি শেকসপিয়ার যাহা বলিয়াছেন, Love looks not with the eyes, but with the mind / And therefore is cupid painted blind. মন ওই রমণীতে এমনই মগ্ন হইল যেন কালীদহের কে হাতি পড়িয়াছে। বৃক্ষমূলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়া, থাকিয়া। থাকিয়া বলিতাম, ‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো!’ প্রত্যুত্তরে রমণী কিছুই বলিত না। দন্ত্যাগ্রে দুর্বাদি তৃণখণ্ড কাটুসকুটুস করিয়া কাটিত ও থুকুস থুকুস করিয়া ছিটাইত। কখনও বলে নাই, ইয়েস, আই অলসো লাভ ইউ। আমার সুহৃদরা আমাকে এই বলিয়া আশ্বস্ত করিয়াছিল, রমণীরা মুখে প্রেম শব্দটি উচ্চারণ করিতে লজ্জা পায়। লাভ ও টয়লেট-দুটি শব্দই তাহাদের কাছে। সমার্থক। তাহাদের ভিতরে প্রেম থাকে, যেমন কচুরির মধ্যে ডালের পুর থাকে। বাহির হইতে ফসকা লুচি মনে হইলেও রমণীরা আসলে কচুরি জাতীয় প্রাণী। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, সেবা, আনুগত্য, সহমর্মিতার পুঁটলি। যথা নিয়মে ব্যবহার করিতে পারিলে অপার শান্তি। উলটো দিকে ঘর্ষণ করিলেই অনর্থ। স্বামী বিবেকানন্দ বলিলেন, ‘একটি পবিত্র নূতন। জীবকে জগতে আনিবার জন্য স্বামী ও স্ত্রী-র মিলন—সুতরাং ভগবানের নিকট উহা তাহাদের এক সৰ্বোচচ মিলিত প্রার্থনা।’ এ কি কৌতুক? এ কি শুধু ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তি না পশুপ্রবৃত্তির চরিতার্থতা? হিন্দু বলে, ‘না, না, কখনওই না।’
স্ত্রী হিসেবে তাহাকে অর্জন করিয়া সংসারে প্রবেশের মুহূর্তে স্বামীজিকে আর একবার পাঠ করিলাম চেতনাবাণী হিসাবে, ‘ভারতের দুই মহাপাপ—মেয়েদের পায়ে দলানো, আর জাতি জাতি করে গরিবগুলোকে পিষে ফেলা। শাক্ত মানে ঈশ্বরকে সমস্ত জগতে বিরাজিত মহাশক্তি বলে জানেন এবং সমগ্র স্ত্রী জাতিতে সেই মহাশক্তির বিকাশ দেখেন।…মনু মহারাজ বলিয়াছেন যে, যত্র নার্যস্তু পূজন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ—যেখানে স্ত্রীলোকরা সুখী, সেই পরিবারের ওপর। ঈশ্বরের মহাকৃপা। এরা (পাশ্চাত্যের লোকেরা) তাই করে। আর এরা তাই সুখী, বিদ্বান, স্বাধীন, উদ্যোগী। আর আমরা স্ত্রীলোককে নীচ, অধম, মহা হেয় অপবিত্র বলি। তার ফল—আমরা পশু, দাস, উদ্যমহীন, দরিদ্র। আমাদের দেশ সকলের অধম কেন, শক্তিহীন কেন? —শক্তির অবমাননা সেখানে বলে।’
দেখিয়াছি, প্রেমিক এক জীব আর স্বামী আর এক জীব। স্বামী শব্দটি ‘ভালগার’। তাহার মধ্যে লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরা লোমওলা একটি দানব বসিয়া দাঁত খুঁটিতেছে ও মাংসজাতীয়। ভুক্তাবশেষের ‘ফাইবার’ বাহির করিতেছে। সচেতন আমি চিরপ্রেমিক থাকিবার চেষ্টা করিলাম। সংসারটিকে ময়দানের সেই বৃহত্যক্ষ ভাবিলাম। দুজনে পাশাপাশি বসিয়া আছি তাহার মূলে। সুমিষ্ট স্বরে, কবিতার ভাষায় কথা বলিতেছি। দিবা আটটা পর্যন্ত বিছানায় গোঁত্তা মারিয়া পড়িয়া থাকিয়া নিদ্রাজড়িত কণ্ঠে ক্ষণে ক্ষণে বলিতেছি না—’হ্যাঁ গা চা কি হল!’কখনওই বলিতেছিনা, ব্যঞ্জন নুনে যবক্ষার, কি ঝালেপোড়া। সম-মর্যাদা বিশিষ্ট দুই প্রাণী। একই পক্ষীর দুইটি ডানা, পুরুষ ও প্রকৃতি। অনুমতি ভিন্ন কোনও কাজই করি না। হায়! উলটা বুঝিলি রাম! আমার স্ত্রীই আমাকে একদিন মধ্যরাত্রে অতিশয় তিরস্কার করিলেন, ‘তোমার আদিখ্যেতা আর ন্যাকামিটা কমিয়ে একটু পুরুষ হওয়ার চেষ্টা করো না। পায়ে পায়ে ল্যাজ খাড়া করে বেড়ালের মতো ঘুরো না। মা বলছিলেন, ছেলেটাকে আঁচল চাপা দিয়ে রেখেছে, উঠতে বললে ওঠে, বসতে বললে বসে। মেনিমুখো পুরুষ মেয়েদের অসহ্য লাগে।’
তৎক্ষণাৎ আমার বিল্বমঙ্গলের কথা মনে পড়িয়া গেল। প্রেমিক এইভাবেই প্রেমিকার দ্বারা তিরস্কৃত হয়। যাহার জন্য চুরি করা হয়, সেই বলে চোর। আমি ইচ্ছা করিলেই হাঁড়িমুখো হুলো হইতে পারিতাম কিন্তু। প্রথম রাত্রেই বিড়াল কাটিবার পরামর্শ উপেক্ষা করিবার ফল ফলিতে বিলম্ব হইল না। সংসার বলিতে লাগিল স্ত্রৈণ, স্ত্রী বলিতে লাগিল, পার্সোনালিটি নাই।
ইদানীং নারীবাদে উদ্বুদ্ধ হইয়াছেন। জ্বালাময়ী প্রবন্ধাদি পাঠ করিয়া তিনিই এখন স্বামী আমি এখন সপ্তম্ভ স্ত্রী। ক্ষীণ কণ্ঠে বলিয়াছিলাম, সেই শৃগালটির মতোই, ‘আমি তো তোমার জল ঘোলা করিনি।’ উত্তরে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘তুমি করো নাই সত্য, কিন্তু তোমার বাপ তো করিয়াছে।’
জিগ্যেস করিলাম, আমাকে তাহলে বিবাহ করিলে কেন! ঝাঁক হইতে প্রেমের বঁড়শিতে গাঁথিয়া এই মাছ অথবা মালটিকে তুলিলে কেন? জবাব শুনিয়া গলদেশেরঙ্কু পাইবার বাসনা হইল। এমত উত্তর শুনিবার চেয়ে উদবন্ধনে প্রাণত্যাগই শ্রেয় ছিল। তিনি স্পষ্টই কহিলেন, মেয়েরা মর্কট পুষিতে ভালোবাসে।
সম্প্রতি এমন সব কথা বলিতেছেন, যাহার প্রতিবাদে আমার কিছু বলার নাই। সেদিন প্রশ্ন করিলেন, ‘নারী কাহাদের চক্রান্তে এই দেশে বারো হাত শাড়ি পরিয়া তলায় সায়া পরিয়া। জড়ভরত হইতে বাধ্য হইয়াছে। ইহা পুরুষেরই আদিম চক্রান্ত। দ্রৌপদী যদি জিনস পরিয়া কৌরব সভায় প্রবেশ করিত, তাহা হইলে দুর্যোধন দুঃশাসনের বাপের ক্ষমতা থাকিত বস্ত্রহরণ করিবার! বুদ্ধিমতী পশ্চিমী রমণীরা সেই কারণে কেহ হরণ করিবার পূর্বে নিজেরাই নিজেদের পোশাক হরণ করিয়া ফেলিয়াছে। ক্ষুধার্ত পুরুষসমাজকে তাল ঠুকিয়ে বলিতেছে, দ্যাখ ব্যাটারা দ্যাখ, শরীর কত দেখবি দ্যাখ। দেখিতে দেখিতে ক্লান্ত হইয়া, তাহারা আর দেখিয়াও দেখে না। সমর সেন কথিত সেইব্রাহ্মণ যুবতিটিকে চক্ষুদ্বারা লেহন করিবার জন্য তাহার চারতলার ন্যাড়া ছাতে’ গুঁতোগুতি করে না। শয়নকক্ষে নীল আলোতে অ্যাটর্নি চন্দ্রের ভারতচন্দ্রীয় প্রেম দেখেনা। সমুদ্রসৈকতে সারি সারি বিবসনা শায়িত, যেন ‘হোলোকেস্টে’ মৃতা নগরীর যত সুন্দরী।
পাশ্চাত্যের কোথাও সেকরার ঠুকঠক নাই, কামারের এক ঘা। তাহারা মিনমিনে প্রেমিকার ছদ্মবেশে সুচ হইয়া প্রবেশ করিয়া ফল হইয়া বাহির হয় না। তাহাদের পৌরুষ অন্য ধরনের। যাহা নাই, অথবা ছিল কোনও কালে, মরিয়া ভূত হইয়াছে, সেই প্রেম নামক ন্যাকামিটি জীবন হইতে ছাঁটিয়া ফেলিয়া দিয়াছে। এদেশের রমণীরাও জানে প্রেম নাই, ছিল না কোনওদিন। আছে প্রয়োজন। কচি কচি মেয়েরা প্রথমে প্রেমে পতিত হয় তাহার পর অধিকাংশ পতিতা হইয়া যায়। হইয়া বুঝিতে পারে To us, all customers are pretty much alike. Always the same categories। পাশ্চাত্যের পুরুষরা ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ মন্ত্রে বিশ্বাসী। মুক্তিপ্রাপ্তা নারী। বলিতেছেন, আমার প্রয়োজন হইলে, তু তু করিয়া ডাকিব, প্রয়োজন ফুরাইবা মাত্র লাথ মারিয়া। বিদায় করিব। কয়েক ঘণ্টার প্রয়োজনের নিমিত্ত গাঁটছড়া বাঁধিয়া দামড়াটির সহিত দরমার খাঁচায় প্রবেশ করিব ও হুঁকোমুখো শ্বশুর, থ্যাবড়া নাকি শাশুড়ি, খোন্ত-দাঁতী ননদিনী, দলপাকাইয়া নিপীড়ন যন্ত্র চালু করিবে, তাহা হইতে দিব না। এতকাল ফাঁদ দেখাইয়াছ, এইবার আমরা ঘুঘু দেখাইব। পাশ্চাত্যের মানসিকতা আমদানি করিয়া এই সিদ্ধান্তে আসিয়াছি—ক্ষুধা পাইলে মানুষ আহার করিবে, ধূমপান করিবার ইচ্ছা হইলে ধূমপান করিবে, গান গাহিবার ইচ্ছ হইলে আ-আ করিবে, পড়িবার ইচ্ছা হইলে বই খুলিবে, করিবার ইচ্ছা হইলে করিবে। তাহার জন্য স্ত্রী নামক ব্যবহারযোগ্য সম্পত্তিটিকে চিরস্থায়ী মোকরুরী ব্যবস্থায় আনিবার কোনও প্রয়োজন নাই। যখন আমরা সন্তানধারণ আর পরিবার পালনের শিক্ষা ছাড়া আর কোনওরূপ শিক্ষা পাইতাম না, তখন পতি পরম গুরু জ্ঞানে হেঁচকি তুলিতাম। এখন গা-এর তলা হইতে উ-টি উৎপাটিত করিয়াছি। এলিস সাহেব আমাদের পুরুষের স্বরূপ বুঝাইয়া দিয়াছেন—
Even men who are happily married to women in all chief respects fitted to them, are apt to fell, after some years of married life, a mysterious eraving for variety. তোমরা আমাদের এতকাল খাইয়াছ, এইবার আমরাও তোমাদের খাইব। কৃষ্ণের অপরাধের বদলা লইব। শ্রীরাধিকার প্রেম লইয়া ছিনিমিনি খেলিয়াছেন। যমুনাপুলিনে কড়কড়ডুমা করিয়াছেন। রাসলীলার নাম করিয়া, কুঞ্জকাননের দুয়ার রুদ্ধ করিয়া অরগিয়্যাস্টিক সেক্সের প্রচলন করিয়াছিলেন সেই দ্বাপরেই। তাঁহার জীবনকাহিনি যেহেতু পুরুষের হাতের নির্মাণ সেই হেতু তিনি অবতার। তিনি সখা অর্জুনকে ‘ইলোপ’ করিতে শিখাইয়াছিলেন।
উত্তম প্রস্তাব। দুই রিপাবলিকে পৃথিবী দ্বিধাবিভক্ত হইয়া যাউক। মধ্যে বার্লিন ওয়াল। এপার্শ্বে নারী সাম্রাজ্য, ওই পার্শ্বে পুরুষ সাম্রাজ্য। জনসংখ্যা যাহা আছে তাহাই রহিল। পুরুষদের দিকের জনসংখ্যা ক্রমেই তো কমিবে। অসুখে মরিবে, যুদ্ধে মরিবে, বয়সে মরিবে। বাড়াইবার উপায়। তো প্রাচীরের ওই পার্শ্বে, নারী সাম্রাজ্যে। উপায় কী হইবে! নারীর সংখ্যাও তো কমিতে থাকিবে। তখন চুক্তি হইবে। একালের ‘গ্যাট’ চুক্তির ন্যায়। ‘ডাংকেল’ প্রস্তাব যাইবে। পুরুষ রিপাবলিকেই। তো থাকিবে ‘স্পার্ম ব্যাঙ্ক’। প্রাচীর টপকাইয়া ওইপার্শ্বে যাইবে ‘স্পার্ম’। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, সন্তান পুরুষ হইলে পুরুষদের দিকে চলিয়া আসিবে। এখন প্রশ্ন হইল পশুদের কী হইবে। গাভী সকল ওই দিকে চলিয়া গেলে, ষণ্ড সকল এই দিকেই থাকিবে। উভয় রিপাবলিকের তত্বাবধানে সীমানা বরাবর এই পার্শ্ব ও ওই পার্শ্বেমিলিয়া একটি মুক্তাঞ্চল তৈয়ার হইবে, সেই স্থানে। প্রয়োজন অনুযায়ী গাভীদের সহিত ষণ্ডের, ঘোটকের সহিত ঘোটকীর, সরমার সহিত সারমেয়র মিলন হইবে। হটকারী হইলে চলিবে না। সৃষ্টিকে তো রক্ষা করিতে হইবে।
আর একটি বিষয়ও ভাবিতে হইবে। পূর্বে দেখিয়াছি স্বাস্থ্যের কারণে যাঁহারা অহিফেন সেবন করিতে বাধ্য হইতেন তাঁহাদের জন্য আবগারি বিভাগ ‘ওপিয়াম পারমিট’ দিতেন। প্রয়োজনে চিকিৎসকগণ ব্যবস্থাপত্রে ‘ভাইনাস গ্যালেসিয়া’ লিখিয়া দিতেন। সেইরূপ, যদি এমন হয় নারী রিপাবলিকে কোনও নারী পুরুষের সহিত সহবাসে বঞ্চিত হইয়া উন্মাদিনীর ন্যায় আঁচড়াইতেছেন, কামড়াইতেছেন, কোনও ভাবেই শান্ত করা যাইতেছে না এবং ওই মানসিক ব্যাধি ক্রমশই মহামারির আকার ধারণ করিতেছে, যেমন প্লেগের সময় হইয়াছিল, তখন রেডক্রসের অনুকরণে স্থাপিত একটি সংস্থা পুরুষ রিপাবলিক হইতে স্বেচ্ছাসেবক লইয়া যাইবে। যুদ্ধের সময় তো উলটোটাই হয়। ফ্রন্টে যোদ্ধাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখিবার জন্য। সেক্সওয়ার্কার পাঠানো হইয়া থাকে। জৈবক্ষুধা তো প্রকৃতিরই দান। কে কী করিবে বাবা! রেমার্কের গ্রন্থে পাঠ করিয়াছি, আহত সৈনিককে হাসপাতালে দেখিতে আসিয়াছে তাহার স্ত্রী। দীর্ঘ অদর্শনের পর মিলনের সৌভাগ্য। সৈন্য তাহার আঘাত যন্ত্রণা উপেক্ষা করিয়া সেই রমণীকে সাপটাইয়া ধরিয়াছে। সেবিকা তাহাদের ওপর একটি চাদর ফেলিয়া দিয়াছেন। চাদর উঠিতেছে চাদর পড়িতেছে।
এলিয়েট সাহেব তাঁহার বিষণ্ণতায় লিখিয়াছিলেন, মানবজীবনের আর কোনও অর্থ খুঁজিয়া পাইলাম না, একটিই অর্থ দেখিতেছি, birth copulation and death তৎপূর্বে বঙ্কিমচন্দ্রও একই কথা বলিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রশ্ন করিয়াছিলেন, মানুষের কর্তব্য কী? বঙ্কিম সহাস্যে। বলিয়াছিলেন, আজ্ঞা, তা যদি বলেন, তাহলে আহার, নিদ্রা ও মৈথুন। শ্রীরামকৃষ্ণ বিরক্ত হইয়া বলিয়াছিলেন—এঃ! তুমি তো বড় ছ্যাঁচড়া!
নারী ও পুরুষকে শ্রীরামকৃষ্ণ ঘৃত ও অগ্নির সহিত তুলনা করিয়াছেন। একত্রে থাকিলে বিপর্যয়। কলিন উইলসন সাহেব একই কথা অন্যভাবে বলিলেন, …Sexual desire, in its simplest form, is a demand of the sexual organ, associated with it in exactly the same way that magnetion is associated with a magnet অর্থাৎ চুম্বকের চুম্বকত্বের মতোই। ইন্দ্রিয়কে উৎপাটিত করা অসম্ভব। অতএব রাষ্ট্রপুঞ্জের ন্যায় একটি সংস্থা রাখিতেই হইবে, তাহা না হইলে প্রাচীরের উভয়পার্শ্বে উন্মাদ আর উন্মাদিনীদের নৃত্য শুরু হইবে।
নারীশূন্য জীবনে পুরুষদের খুব একটা অসুবিধা হইবার কথা নয়। ‘মাগি’ আমিও প্রস্তুত করিতে পারি। প্রাচীনেরা পরলোকে চলিয়া যাইবার পর সুপ্ত ব্যঞ্জনের বিলাসিতা ঘুচিয়া গিয়াছে। প্রাতের প্রথম কাপ চা নিজেই প্রস্তুত করি। ফিলটার হইতে জল গড়াইয়া খাই। প্রেসারকুকারে এক আঙুল পরিমাণ জল দিয়া ঝরঝরে ভাত রাঁধিতে পারি। আলুর খোসা পর্যন্ত ছুলিতে শিখিয়াছি। সমস্যা মৎস্য লইয়া, তবে বলিতে দ্বিধা নাই, অখণ্ড মাংসের ‘অ্যানাটমি’ আধুনিকারাও সম্যক অবগত নহেন। কোথায় পায়ু, কোথায় পিত্তস্থলী। ‘কাটাপোনা’ ভিন্ন পৃথিবীতে আরও যে বহুবিধ মৎস্য আছে, ইহা তাঁহারা ভুলিতে বসিয়াছেন। এই সমস্যার সমাধান বাজারের পুরুষ মৎস্য ব্যবসায়ী আজও যেভাবে করিতেছেন ভবিষ্যতেও সেইভাবেই করিবেন। আমার এক পুরুষবাদী বন্ধু একথা সগর্বে বলিয়াছিলেন—’মেয়েরা আবার কবে রাঁধিতে শিখলে! দৌড় তো ওই মাছের ঝোল, ভাত, আলুভাতে, তেঁড়সভাতে, আলুভাজাটাও শিখলে না। টেস্টলেস ডাল। বললেই, বলবে সুপের কায়দায় রান্না। শিল-নোড়ার ধারে কাছে যায় না, তো বাটি পোস্ত! আলো চালের পিণ্ডি পাকিয়ে বলবে, পিসপাস। দেখ গে যা, যত পাঁচতারা হোটেলের শেফ, পুরুষ।’
নারীবিদ্বেষী পুরুষবাদী বন্ধুটি যাহা বলিয়াছিল তাহা আংশিক সত্য। নারীরা তাহাদের রিপাবলিকে প্রস্থান করিলে অসুবিধা তো কিছু নাই। কামার, কুমার, ছুতোর, মজুর, মিস্ত্রি সবই তো পুরুষের কর্ম। এ দৃশ্য তো ভাবিতে পারি না, ভারা বাঁধিয়া চার তলার ছাতে উঠিয়া নারী রাজমিস্ত্রি সেন্টারিং করিতেছে, কী ধপাং ধপাং করিয়া ঢালাইয়ের মশলা পিটিতেছে।
যাহাই হউক তাহারা ভিন্ন হইয়া গেলে তাহাদের অসুবিধা অবশ্যই হইবে। বলা হয় অসুস্থ। পুরুষের পার্শ্বে সারারাত্রি নারীই জাগিয়া থাকিয়া সেবা করেন। সুধীরলাল আবেগভরা কণ্ঠে গাহিলেন—’মধুর আমার মায়ের হাসি’। প্রশ্ন করিলেন, ‘কে জেগে রয় দুখের রাতে!’ অতীতের চিত্র। বর্তমানের ব্যবস্থা অন্যরূপ। পয়সা থাকিলে নার্সিংহোম, তাহা না থাকিলে সাধারণ হাসপাতাল। সেখানে সেবিকাদের সেবার নমুনা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। আজ বেডপ্যান। চাহিলে, পরের মাসে পাওয়া যাইতে পারে। রোগী ‘ট্রাবলসাম’ হইলে কিলাইবার ব্যবস্থাও আছে। বাস্তব দেহত্যাগ করিতেছেন, পুরাকালের চিত্র। মা-জাতি অন্তর্ধান করিয়াছে। যামিনী রায়ের চিত্র। মাসির কোলে বাচচা রাখিয়া হাত নাড়িতে নাড়িতে ‘ফ্লাইং কিস’ ছুড়িতে ছুড়িতে, স্বামীর স্কুটারের পশ্চাদ্দেশে তাহার ভূঁড়িতে আঁকড়াইয়া ধরিয়া বসিয়া, অফিসে যাইতেছে। মস্তকে একটি উপুড় করা গামলা।
মানবগোষ্ঠী স্ত্রী পুরুষে সত্যই যদি বিভক্ত হয়, তাহা হইলে দেবী সকলকে প্রমীলা রাজ্যেই পাঠানো হইবে। দুর্গা, মা কালী, চণ্ডী, মনসা, শীতলা সব ওই দিকে। নারীকে দেবী রূপে আরাধনা করিয়াও আমাদের স্বভাব পালটাইল না। নারীশূন্য শ্মশানে আমরা ভোলা মহেশ্বরকে লইয়াই থাকিব। তিনিও প্রথম সতীদাহে খণ্ড বিখণ্ড হইতে দিয়া আমাদের পুরুষবাদ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন।
আমাদের প্রধান সমস্যা হইবে নারীর প্রতি আগ্রাসী আকর্ষণ। ইরেজিস্টেবল। হরমোন ঘটিত হাঙ্গামা। কণ্ঠে ‘বয়সা’ ধরিয়া মাত্র নারীসঙ্গের জন্য ধড়ফড় করিবে প্রাণ। করিবেই করিবে। ছবি দেখিতে ইচ্ছা করিবে। প্রেমের উপন্যাসে মগ্ন হইতে ইচ্ছা করিবে। ইহার হাত হইতে রক্ষার উপায় খুঁজিতে হইবেই। হিন্দি ছবির ডায়ালগ উদ্ধৃত করিলে বলিতে হইবে—ইজ্জত কা সওয়াল।
শাস্ত্রের শরণ লইতে হইবে। আকর্ষণকে বিকর্ষণে আনিবার জন্য ঘৃণা উক্ত হইবে। সাধকগণ দুইটি পথ অবলম্বন করিতেন, একটি পথ পূজার পথ। নারী মাতা, নারী দেবী, বেদিতে বসাইয়া পূজা করো। বলল, স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু।
নারীর মুখপানে তাকাইও না। পদদ্বয়ে দৃষ্টি রাখখা। মনে কু-ইচ্ছা আসিলেই কুস্তি করো। মহাত্মা গান্ধি বলিতেছেন—মনে কুবাসনা জাগিলেই, জোর করিয়া তাড়াইবার চেষ্টা না করিয়া অন্য কর্মে ব্যাপৃত হও, অধ্যয়ন করো, অথবা শ্রমসাধ্য এমন কোনও কর্ম করো, যাহাতে মন নিবিষ্ট হয়। দৃষ্টিকে প্রবণতার পথে যাইতে দিয়ো না। নারীর প্রতি পতিত হইলে তৎক্ষণাৎ সরাইয়া লও। সরাসরি কোনও মহিলা বা পুরুষের দিকে তাকাইবার প্রয়োজন কী!
তুলসীদাসজিকে স্মরণ করিতে পারি। তিনি বলিতেছেন,
রাজা করে রাজা বশ, যোদ্ধা করে রণ জই।
আপনা মনকো বশ করে সো, সবকো সেরা ওই।
পথটি সহজ নয়। লোলচর্ম বৃদ্ধ যুবতি দেখিয়া হাঁচড় পাঁচড় করিয়া মরিল। রাজা দশরথের কী হইয়াছিল। যাঁহার ‘হার্টের অবস্থা শোচনীয়, ‘বাইপাস’ করিলেই হয়, তিনি টঙ্কার মারিয়া চক্ষু। উলটাইলেন। মহাভারতের মুনিদের কথা স্মরণ করিতে লজ্জা হয়। ধূম্রজাল বিস্তার করিয়া রমণী রমণ করিতেছেন। স্নান করিতে গিয়া লিত রেতঃ হইতেছেন।
দ্বিতীয় পথ, আত্মরক্ষার পথ। নারী আমাদের দুশমন। পিয়ারী দুশমন। রাজা অঙ্গধ্বজের কাহিনি পূর্বেই বলিয়াছি। তুলসীদাস পুরুষের স্বীয় আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিকে উসকাইয়াছেন। তোমাকে তিল তিল করিয়া মারিবার চেষ্টা করিতেছে ছলনাময়ী মোহময়ী। সেই গ্রাস হইতে নিজেকে মুক্ত করো। সাবধান হও। ‘সাইলেন্স কল’। সংযমের মাস্তুলে নাবিককে বাঁধিয়া রাখা।
তুলসী বলিতেছেন—
দিনকা মোহিনী, রাতকা বাঘিনী পলপলক লহ চোষে।
দুনিয় সব বাউরা হোকে, ঘর ঘর বাঘিনী পোষে।।
এই ঘৃণার ভাব আরও দৃঢ় করিবার মানসে শাস্ত্র পুরুষকে ‘পোস্টমর্টেম’-এর ডাক্টর হইতে বলিতেছে। বিশ্বসুন্দরীকে ছুরি দিয়া ফালা করো। দেখো লালায়িত হইবার মতো কিছু আছে কি?
অমেধ্যপূর্ণে কৃমিজালসঙ্কুলে স্বভাব দুর্গন্ধ নিরন্তকান্তারে।
কলেবরে মূত্রপুরীষভাবিতে রমন্তি মূঢ়া বিরমন্তি পন্ডিতাঃ।।
ইহার মধ্যে নারীবিদ্বেষ নাই। এই সবই নারীর অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ হইতে দুর্বল পুরুষের বাঁচিবার প্রয়াস, রক্ষাকবচ।
শ্রীরামকৃষ্ণ বিচারের পথ দেখাইয়াছেন, বলিতেছেন, বস্তুবিচার—’সুন্দর দেহেই বা কি আছে! বিচার কর, সুন্দরীর দেহতেও কেবল হাড়, মাংস, চর্বি মল, মূত্র।’ তিনি গৃহীদের পৌরুষ জাগাইবার জন্য যৎপরোনাস্তি গালমন্দ করিতেন, বলিতেন সব মাগের দাস। ‘লোকে মাগ ছেলের জন্য একঘটি কাঁদে, ঈশ্বরের জন্যে কে কাঁদছে বল!’ বিজয়কৃষ্ণকে একদিন বলিয়েছেন, ‘কামিনী কাঞ্চনে জীবকে বদ্ধ করে। জীবের স্বাধীনতাই যায়। কামিনী থেকেই কাঞ্চনের দরকার। তার জন্য পরের দাসত্ব। স্বাধীনতা চলে যায়। তোমার মনের মতো কাজ করতে পার না।’
শ্রীরামকৃষ্ণই একালের আমাদের ‘ফাইন্যাল সলিউশান’। ইহা আমি মনে করিয়া থাকি সেই। কারণেই বলিলাম। তিনি সন্ন্যাসী হইতে বলেন নাই। সংসারে থাকিয়া স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের প্রতি সমস্ত কর্তব্য সম্পাদন করিতে বলিয়াছেন; কিন্তু একটি রক্ষাকবচ ধারণ করিতে হইবে। মাগের দাস হইয়ো না। স্বরূপ ভুলিও না। নারীর দুই রূপ—বিদ্যারূপিণী আর অবিদ্যারূপিণী। ইহার পর তিনি আমাদের চৈতন্যকে এই বলিয়া খোঁচাইতেছেন, ‘দেখ না, মেয়েমানুষের কি মোহিনী শক্তি, অবিদ্যারূপিণী মেয়েদের (বিদ্যারূপিণী নয়)। পুরুষগুলোকে যেন বোকা অপদার্থ করে রেখে। দেয়। যখনই দেখি স্ত্রীপুরুষ একসঙ্গে বসে আছে, তখন বলি আহা! এরা গেছে—হারু এমন সুন্দর ছেলে, তাকে পেতনীতে পেয়েছে! ওরে হারু কোথা গেল, ওরে হারু কোথা গেল, আর হারু কোথা গেল। সব্বাই গিয়ে দেখে হারু বটতলায় চুপ করে বসে আছে। সে রূপ নাই, সে তেজ নাই, সে আনন্দ নাই! বটগাছের পেতনীতে হারুকে পেয়েছে। স্ত্রী যদি বলে, ‘যাও তো একবার’—এমনি উঠে দাঁড়ায়, ‘বসো তো’—অমনি বসে পড়ে।
তাঁর বিখ্যাত সেই উক্তি এই প্রসঙ্গে, ‘গোলাপকে ধর।’ বড়বাবুকে ধরিলে কাজ হইবে না, ধরিতে হইবে তাঁহার রক্ষিতা গোলাপকে। খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বৎসরে লিখিত ‘গিলগামেশ’ উপাখ্যানে দেখা যাইতেছে, শাসক গিলগামেশ বন্যবীর এনকিভুর সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হইবার পূর্বে, তাহার। শক্তি হরণের জন্য এক রূপসিকে পাঠাইল। তাহার পর! যাহা হইবার তাহাই হইল, the whore untied her lion-cloth and spread her legs, and her tooks possesion of her beauty. ছয়দিন ছয়রাত এনকিভু তাহাকে সম্ভোগ করিল। ইহার পর সে যখন উঠিয়া দাঁড়াইল যুদ্ধের জন্য, তাহার পদদ্বয় কাঁপিতেছে, দেহ টলিতেছে, নয়নে সরিষার ফুল দেখিতেছে। আজীবন ব্রহ্মচারী ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি, যিনি কখনও নারী দর্শন করেন নাই, নিরন্তন সাধনায় ব্রতী, অঙ্গদেশের রাজা লোমোদ প্রেরিত চিত্তোম্মাদক ইন্দ্রিয়ভোগ্য বারাঙ্গনার রূপে মুগ্ধ হইয়া নাচিতে নাচিতে আশ্রম, সাধনা, সব ভুলিয়া অঙ্গরাজ্যে চলিয়া গেলেন। পরে কৌপিন ছাড়িয়া, বিবাহ করিয়া, স্কন্ধে বাচ্চা চড়াইয়া ঘুরিতে লাগিলেন। তপস্যার বারোটা বাজিয়া গেল।
শ্রীরামকৃষ্ণ আদৌ নারীবিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি পুরুষকে পথে আনিতে চাহিয়াছিলেন। শূকরের সংসারকে শিবের সংসার, বিদ্যার সংসার করতে চাহিয়াছিলেন। পুরুষ যদি আত্মবোধে জাগ্রত হয়, তাহা হইলে নারী ভোগ্য সামগ্রীই হইয়া থাকিবে। মিনিটে একটি করিয়া ধর্ষণ হইবে। তিন হইতে তিয়াত্তর কোনও মহিলাই রেহাই পাইবে না, বিলাতে যাহা হইতেছে। আর কয়েক বৎসরের মধ্যেই অর্থে না হউক, যৌন অপরাধ সংঘটনে ভারত আমেরিকা হইয়া যাইবে। দাসত্বের যন্ত্রণা হইতে পুরুষকে মুক্তি দিবার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ প্ল্যানড ফ্যামিলির কথা অবিরত বলিয়া গিয়াছেন। চোখে আঙুল দিয়া দেখাইতেছেন—’দেখ অত পাশ করা, কত ইংরাজি পড়া পণ্ডিত, মনিবের চাকরি স্বীকার করে তাদের বুট জুতার গোঁজা দুবেলা খায়। এর কারণ কেবল কামিনী। বিয়ে করে নদের হাট বসিয়ে আর হাট তোলার জো নাই। তাই এত অপমানবোধ, অত দাসত্বের যন্ত্রণা।’তুলসীদাস এই একই কথা বলিলেন,—’তিন বাতসে লটপাট হেয়, দামড়ি চামড়ি পেট।’
মাতা যেমন শিশুপুত্রকে বলিয়া থাকেন, ‘চকোলেট খাচ্ছ খাও, পেছন চুলকু করলে, মাঝরাতে কেঁদো না।’ তাহার ব্যাখ্যা এই নহে, মাতা চকোলেট বিদ্বেষী। ভিষক যখন বলেন, ‘খাওয়াটা একটু কমান, ফ্যাট না কমালে হার্টটা যাবে।’ তাহার অর্থ এই নহে যে, অনাহারে শুষ্ক হইয়া যান। মাতা যখন যুবতি কন্যাকে বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ওই লোফার ছেলেটার পাল্লায় পড়লি’ তাহার অর্থ এই নহে যে তিনি পুরুষবিদ্বেষী! পুরুষদের মধ্যে যাহারা লোফার, তিনি তাহাদের বিদ্বেষী। পুরুষ প্রজাতির আধ্যাত্মিক মানবেরা, নিজ প্রজাতির গৌরব বর্ধনের জন্যই কামকে সংযত করিবার শত উপদেশ, শত কাহিনি বলিয়া গেছেন। নিজ কন্যার সহিতও একই শয্যায় শয়ন করিতে নিষেধ করিয়াছেন। মুনিদিগেরও মতিভ্রম হইয়া থাকে। বরাহনগর মঠে বসিয়া রাখাল মহারাজ মাস্টার মহাশয়কে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলিতেছেন—’অনেকে মনে করে মেয়েমানুষ না দেখলেই হল। মেয়েমানুষ দেখে ঘাড় নীচু করলে কী হবে? নরেন্দ্র কাল রাত্রে বেশ বলল, যতক্ষণ আমার কাম, ততক্ষণই স্ত্রীলোক, তা না হলে স্ত্রী-পুরুষ ভেদবোধ থাকে না।’
কামটিকে ঝাড়মূলে বিনষ্ট করিতে না পারিলে নারীদের দুর্গতি বাড়িতেই থাকিবে। আমরা পারিলাম না। তুলসীদাস বলিয়াই গিয়াছেন :
শাকট সূকট কুকুরা, তিনেক মত এক।
কোটি ভাঁতি সমঝাও, তৌ ন ছোড়ে টেক।।
পাষণ্ড, শূকর ও কুকুর এই ত্রিবিধ প্রাণীই এক জাতির। উহাদিগকে কোটি কোটি সদুপদেশপূর্ণ নম্র প্রিয়বাক্য বলল, তথাপি কোনও মতেই নিজ স্বভাব সংশোধন করিবে না। এরিক ফ্রম বলিলেন, Most people see the problem of love primarily as that of being loved rather than that of loving, of one’s capacity to love. আমরা ভালোবাসা চাহিলাম। পাইলাম। খামচাইয়া-খুমচাইয়া শেভ করিলাম। ভালোবাসিতে পারিলাম না। এখন পদাঘাতে জর্জরিত অপমানিত। নারীরা পুরুষকে বাদ দিবেন। উত্তম প্রস্তাব। জীবন হইতে সরিয়া
গেলে কিঞ্চিৎ ভারমুক্ত হইব। ‘লোহারি বাঁধনে বেঁধেছে সংসার, দাসখত লিখে নিয়েছে হায়’— বলিয়া রামপ্রসাদী ভাঁজিতে হইবে না। বরং প্রাতে মুগুর ভাঁজিব। স্ত্রীর ভরণপোষণের অর্থে চিকেন তন্দুরি খাইব। তাকত বাড়াইব। ব্রহ্মানন্দে মশগুল হইব। স্ত্রীর এমত উপদেশে নাচিতে হইবে না—’আমার মা তোমার মা, তোমার মা ভাগের মা।’
দুঃখের বিষয় তাহা হইবে না। দুইটি ‘রিপাবলিক’ হইতে পারে না। ‘উটোপিয়া’। টমাস বোর যাহার স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন তাহা স্বপ্নই, যাহা হইবে, বিবদমান দুই গোষ্ঠীর সহাবস্থান ও ‘রোল রিভার্সাল’—ভূমিকা বদল।
মধ্যরাত্রে তোয়ালের দ্বারা আবৃত নবজাতকটিকে কোলে ফেলিয়া, উঁহুঁহুঁ-উঁহুঁহুঁ করিতেছি, ক্ষুদ্রকায় মনুষ্যশাবকটি তারস্বরে ওঁয়া ওঁয়া করিতেছে। কোমল থাকিবার চেষ্টা করিয়াও ক্ষিপ্ত হইয়া, শিক্ষা ভুলিয়া গ্রাম্য ভাষায় বলিয়া ফেলিতেছি, ‘শালার ব্যাটা শালা।’ পরক্ষণেই বুঝিতে পারিতেছি, আমার গাত্রে মাতৃগন্ধ নাই, আমার স্তন নাই। স্তন্যদায়িনী এই বলিয়া নিদ্রা গিয়াছেন —’এইবার বোঝো, কত ধানে কত চাল!’ তখন আমি নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া বলিব—হে ঈশ্বর! আমার এই চাতালের মতো বক্ষদেশে পুরুষের দুটি চির দুর্বলতা জুড়িয়া দাও। তাহা হইলে আমি আরও স্বাবলম্বী হইতে পারিব। আমেন!