০২. শশীর চরিত্র
শশীর চরিত্রে দুই সুস্পষ্ট ভাগ আছে। একদিকে তাহার মধ্যে যেমন কল্পনা, ভাবাবেগ ও রসবোধের অভাব নাই, অন্যদিকে তেমনি সাধারণ সাংসারিক বুদ্ধি ও ধনসম্পত্তির প্রতি মমতাও তাহার যথেষ্ট। তাহার কল্পনাময় অংশটুকু গোপন ও মূক। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে তাহার সঙ্গে না মিশিলে একথা কেহ টের পাইবে না যে তার ভিতরেও জীবনের সৌন্দর্য ও শ্রীহীনতার একটা গভীর সহানুভূতিমূলক বিচার-পদ্ধতি আছে। তাহার বুদ্ধি, সংযম ও হিসাবি প্রকৃতির পরিচয় মানুষ সাধারণত পায়। সংসারে টিকিবার জন্য দরকারি এই গুণগুলির জন্য শশীকে সকলে ভয় ও খাতির করিয়া চলে।
শশীর চরিত্রের এই দিকটা গড়িয়া তুলিয়াছে তাহার বাবা গোপাল দাস।
গোপাল দাসের কারবার লোকে বলে গলায় ছুরি দেওয়া। আসলে সে করে সম্পত্তি কেনাবেচা ও টাকা ধার দেওয়া। অর্থাৎ দালালি ও মহাজনি। শোনা যায়, এককালে সে নাকি বার-তিনেক জীবন্ত মামুষের কেনাবেচার ব্যাপারেও দালালি করিয়াছে—তিনটি বৃদ্ধের বউ জুটাইয়া দেওয়া। সে আজকের কথা নয়। বৃদ্ধ তিনজনের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হইয়াছে। এখন যামিনী করিরাজের মরণ হইলেই ব্যাপারটা পুরোপুরি ইতিহাসের গর্ভে তলাইয়া যাইতে পারে। কিন্তু যামিনী কবিরাজের বউ, শশী যাহাকে সেনদিদি বলিয়া ডাকে এবং শশীকে যে অপুত্রবতী রমণী গভীরভাবে স্নেহ করে, স্বামীকে সে এত যত্নে এত সাবধানে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে যে শীঘ্ৰ যামিনী কবিরাজের মরিবার সম্ভাবনা নাই। যামিনী কিন্তু মরিতে চায়। গ্রামের কলঙ্ক রটানোর কাজে উৎসাহী নিষ্কৰ্মা ব্যক্তির সংখ্যা এত বেশি যে, এতটুকু এদিক ওদিক হইলে গ্রামের বউ-ঝিদের কলঙ্ক দিগদিগন্তে রটিয়া যায়। কেহ বিশ্বাস করে, কেহ করে না। যে বিশ্বাস করে সেও সত্যামিথ্যা যাচাই করে না, যে অবিশ্বাস করে, সেও নয়। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটা নির্ভর করে মানুষের খুশির উপর। গ্রামের কলঙ্কিনীদের মধ্যে শশীর সেনদিদির প্রসিদ্ধিই বেশি। গোপালের সঙ্গেই তার নামটা জড়ানো হয় বেশি সময়। লোকে নানা কথা বলাবলি করে। শশী বিশ্বাস করে না। যামিনী করে। সে খুড়খুড়ে বুড়া। সন্দেহের তীব্র বিষে সে দগ্ধ হইয়া যায়। স্ত্রী পাড়ার কারো বাড়ি গেলে রাগে-দুঃখে এক-একদিন সে কাদিয়াও ফেলে। স্ত্রীর কায়েতবাড়ি কাসুন্দি বানাইয়া আসার কৈফিয়তটা সে বিশ্বাস করে না। অথচ শশীর সেনদিদি সত্য কৈফিয়তই দেয়। অতীতে কখনও সে যদি কোনো অন্যায় করিয়া থাকে, তাহা অতীতের সত্যমিথ্যা পাপপুণ্যে মিশিয়া আছে। উন্মাদ ছাড়া আজ শশীর সেনদিদিকে কেহ অবিশ্বাস করিবে না। বুড়া হইয়া যামিনীর মাথাটা খারাপ হইয়া গিয়াছে।
দেখা হইলে গোপালকে শাপ দেয়। বলে, এক কাঁড়ি টাকা নিয়ে তুই আমার খুব উপকার করেছিলি গোপাল। উচ্ছন্ন যাবি তুই, তোর সর্বনাশ হবে, ঘরবাড়ি তোর শ্মশান হয়ে যাবে!
যামিনী কবিরাজের বউ-এর সম্বন্ধে গোপালের বদনাম হয়তো মিথ্যা তবু লোক গোপাল ভালো নয়। তুচ্ছ কতগুলি টাকার জন্য সে-ই তো প্রতিমার মতো কিশোরীকে বুড়ো, পাগলা যামিনী কবিরাজের বউ করিয়াছিল।
শশীই গোপালের একমাত্র ছেলে, মেয়ে আছে তিনটি। বড়মেয়ের নাম বিন্ধ্যবাসিনী। বড়গার নায়েব শ্যামাচরণ দাসের বড়ছেলে মোহনের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইয়াছে। মোহনের একটা পা খোড়া। মেজমেয়ে বিন্দুবাসিনীর বিবাহ হইয়াছে খাস কলিকাতায় বড়বাজারের নন্দলাল অ্যান্ড কোং-এর নন্দলালের সঙ্গে।
গোপালের সে এক স্মরণীয় কীর্তি।
নন্দলালের কারবার পাটের। চারিদিক হইতে পাট সংগ্ৰহ করিয়া জমা করিবার সুবিধা হয় এবং চালান দিবার ভালো ব্যবস্থা থাকে এমন একটি মধ্যবর্তী গ্রাম খুঁজিয়া বাহির করিবার উদ্দেশ্যে বছর-সাতেক আগে সে একবার এদিকে আসিয়াছিল। গোপাল তাহাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছিল নিজের বাড়ি, আদর-যত্ন করিয়াছিল ঘরের লোকের মতো। তারপর কোথা দিয়া কী হইয়া গেল কে জানে,–হয়তো নন্দলালের দোষ ছিল, হয়তো ছিল না,–তিন দিন পরে গোপালের অনুগত গ্রামবাসীরা লাঠি হাতে দাঁড়াইয়া বিন্দুর সঙ্গে নন্দলালের বিবাহ দিয়া দিল। নন্দলালের চাকরটা রাতারাতি বাজিতপুরে পলাইয়াছিল। পরদিন মনিবের উদ্ধারে সে একেবারে পুলিশ লইয়া হাজির! নন্দলাল ইচ্ছা করিলে কিছু কিছু শাস্তি অনেককেই দিতে পারিত,–গম্ভীর বিষন্ন মুখে পুলিশকে সে-ই বিদায় করিয়া দিল। তারপর বউ লইয়া সেই-যে সে কলিকাতায় গেল,–গাওদিয়ার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখিল না।
যাই হোক, নন্দলালের কাছে বিন্দুবাসিনী হয়তো সুখেই আছে। গ্রামের লোক সঠিক খবর রাখে না। সাত বছরের মধ্যে বিন্দু একবার মাত্র তিনদিনের জন্য বাপের বাড়ি আসিয়াছিল। গ্রামের ছেলে-বুড়ো তখন ঈর্ষার চোখে চাহিয়া দেখিয়াছিল,—অলঙ্কারে অলঙ্কারে বিন্দুর দেহে তিল ধারণের স্থান নাই, একেবারে যেন বাইজি। তবু, হয়তো বিন্দু সুখে নাই! নন্দর তো বয়স হইয়াছে, আর একটা স্ত্রী তো তাহার আছে, চরিত্রও সম্ভবত তাহার ভালো নয়। গাওদিয়াবাসী যাহাদের বিবাহিত কন্যাগুলি সারি সারি দাঁড়াইয়া চোখের জলে ভাসে, তারা ভাবে, হয়তো বিন্দু সুখে নাই! ভাবিয়া তাহারা তৃপ্তি পায়। কেহ মুখ ফুটিয়া মনের কথা বলিয়াও ফেলে। গোপাল শুনিতে পাইলে অস্ফুট স্বরে বলে লক্ষ্মীছাড়ার দল!
এমনি বাপের শাসনে শশী মানুষ হইয়াছিল। কলিকাতায় মেডিকেল কলেজে পড়িতে যাওয়ার সময় তাহার হৃদয় ছিল সংকীর্ণ, চিন্তাশক্তি ছিল ভোঁতা, রসবোধ ছিল স্থূল। গ্রাম্য গৃহস্থের স্বকেন্দ্রীয় সংকীর্ণ জীবনযাপনের মোটামুটি একটা ছবিই ছিল ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে তাহার কল্পনার সীমা। কলিকাতায় থাকিবার সময় তাহার অনুভূতির জগতে মার্জনা আনিয়া দেয় বই এবং বন্ধু। বন্ধুটির নাম কুমুদ, বাড়ি বরিশালে, লম্বা কালো চেহারা, বেপরোয়া খ্যাপাটে স্বভাব। মাঝে মাঝে কবিতাও কুমুদ লিখিত। কলেজে সে প্রায়ই যাইত না, হোস্টেলে নিজের ঘরে বিছানায় চিত হইয়া শুইয়া যত রাজ্যের ইংরেজি বাঙলা নভেল পড়িত, কথকতার মতো হৃদয়গ্রাহী করিয়া ধর্ম, সমাজ, ঈশ্বর ও নারীর (ষোলো-সতেরো বছরের বালিকাদের) বিরুদ্ধে যা মনে আসিত বলিয়া যাইত আর টাকা ধার করিত শশীর কাছে। শশী প্রথমে মেয়েদের মতোই কুমুদের প্রেমে পড়িয়া গিয়াছিল; ওকে টাকা ধার দিতে পারলে সে যেন বর্তিয়া যাইত। কুমুদ প্রথমে তাহাকে বিশেষ আমল দিত না, কিন্তু অনেক দুঃখ, অপমান ও অভিমান চুপচাপ সহ্য করিয়া শশী তাহার অন্তরঙ্গতা অর্জন করিয়াছিল।
সেটা তাহার অনুকরণ করার বয়স। এই একটি মাত্র বন্ধুর প্রভাবে শশী একবারে বদলাইয়া গেল। যে দুর্গের মধ্যে গোপাল তাহার মনকে পুরিয়া সিল করিয়া দিয়াছিল, কুমুদ তাহা একেবারে ভাঙিয়া ফেলিতে পারিল না বটে কিন্তু অনেকগুলি জানালা দরজা কাটিয়া দিয়া বাহিরের আলো বাতাস আনিয়া দিল, অন্ধকারের অন্তরাল হইতে মনকে তাহার বাহিরের উদারতায় বাড়াইতে যাইতে শিখাইয়া দিল।
প্রথমটা শশী একটু উদভ্ৰান্ত হইয়া গেল। মাথা ঘামাইয়া ঘামাইয়া জীবনকে ফেনাইয়া, ফাঁপাইয়া মানুষ এমন বিরাট ব্যাপার করিয়া তুলিয়াছে? জানিবার এত বিষয়, উপভোগ করিবার এত উপায়; বিজ্ঞান ও কাব্য মিশিয়া এমন জটিল, এমন রসালো মানুষের জীবন? তারপর গ্রামে ডাক্তারি করিতে বসিয়া প্রথমে সে যেন হাঁপাইয়া উঠিল। জীবনটা কলিকাতায় যেন বন্ধুর বিবাহের বাজনার মতো বাজিতেছিল, সহসা স্বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এইসব অশিক্ষিত নরনারী, ডোবা পুকুর, বন জঙ্গল মাঠ, বাকি জীবনটা তাহাকে এখানেই কাটাইতে হইবে নাকি? ও ভগবান, একটা লাইব্রেরি পর্যন্ত যে এখানে নাই! ক্রমে ক্রমে শশীর মন শান্ত হইয়াছে। সে তো গ্রামেরই সন্তান, গ্রাম্য নরনারীর মধ্যে গ্রামের মাটি মাখিয়া গ্রামের জলবায়ু শুষিয়া সে বড় হইয়াছে। হৃদয় ও মনের গড়ন আসলে তাহার গ্রাম্য। শহর তাহার মনে যে ছাপ দিয়াছিল তাহা মুছিবার নয়, কিন্তু সে শুধু ছাপ, দাগা নয়। শহরের অভ্যাস যতটা পারে বজায় রাখিয়া বাকিটা সে বিসর্জন করিতে পারিল, কুমুদও বইয়ের কল্যাণে পাওয়া বহু বৃহত্তর আশা-আকাঙ্ক্ষাও ক্রমে ক্রমে সে চিন্তা ও কল্পনাতে পর্যবসিত করিয়া ফেলিতে পারিল।
এ সুদূর পল্লিতে হয়তো সে-বসন্তু কখনও আসিবে না যাহার কোকিল পিয়ানো, সুবাস এসেল, দখিনা ফ্যানের বাতাস। তবু, শশীর মনকে কে বাঁধিয়া রাখিবে? দীর্ঘ জীবন পড়িয়া আছে, পড়িয়া আছে বিপুল পৃথিবী। আজ শশী কামিনীঝোপের পাশে ক্যাম্পচেয়ারে বসিয়া বাঁশঝাড়ের পাতা-কাঁপানো ডোবার গন্ধ ভরা ঝিরঝির বাতাসে উন্মনা হোক, কোলের উপর ফেলিয়া-রাখা বইখানার দুটি মলাটের মধ্যে কাম্য জীবনটি তাহার আবদ্ধ থাক, একদিন কেয়ারি-করা ফুলবাগানের মাঝখানে বসানো লাল টাইলে ছাওয়া বাংলোয় শশী খাঁচার মধ্যে কেনারি পাখির নাচ দেখিবে, দামি ব্লাউজে ঢাকা বুকখানা শশীর বুকের কাছে স্পন্দিত হইবে,–আলো পান হাসি আনন্দ আভিজাত্য– কিসের অভাব তখন থাকিবে শশীর?
কায়েতপাড়ার পথটি তিন ভাগ অতিক্রম করিয়া গেলে শশীর বাড়ি। হারুর বাড়ি পথের একেবারে শেষে। এই হারু ঘোষ-খালের ধারে বটগাছের তলে যে সেদিন অপরাহ্লে বজ্রাঘাতে মরিয়া গিয়াছে।
মতির জ্বর কমে নাই। সন্ধ্যার সময় শশী তাহাকে দেখিতে গেল। সারাদিন শশীর সময় ছিল না।
সন্ধ্যার সময় হারুর বাড়িতে প্রদীপ জ্বলে নাই। হারুর বউ মোক্ষদা হারুর ছেলে পরাণের বউ কুসুমের উপর ভারি খাপ্পা হইয়া উঠিয়াছিল। ব্যাপারটা বুঝিয়া দাখো গৃহস্থবাড়ি। সন্ধা আসিয়াছে। বাড়িতে একটা বউ আছে। অথচ সন্ধ্যাদীপ জ্বলে নাই। গলায় গড়ি দিয়া বউটা মরিয়া যায় না কেন?
সে কাপড় ছাড়িল। তারপর জ্বলিতে গেল প্ৰদীপ। তাহার নির্লজ্জ ধীরতা মোক্ষদাকে একেবারে খেপাইয়া তুলিল। কুসুমের হাত হইতে প্রদীপটা ছিনাইয়া লইয়া রান্নাঘরে গিয়া উনানে পাটখড়ি ধরাইয়া সে প্রদীপ জ্বলিল। তারপর তাড়াতাড়ি পার হইতে গিয়া শুকনো উঠানে সে কেমন করিয়া পড়িয়া গেল কে জানে!
কুসুম হাসিয়া উঠিল সশব্দে। তারপর আঁচলটা কোমরে জড়াইয়া মোক্ষদাকে আড়কোলে শূন্যে তুলিয়া শোবার ঘরের সামনে দাওয়ায় নামাইয়া দিল। তেইশ বছরের বাজা মেয়ে, গায়ে তাহার জোর কম নয়।
কিছুক্ষণ বাড়িতে আর কান পাতা যায় না। মোক্ষদা গলা ফাটাইয়া শাপিতে থাকে। ছেলে-কোলে বুঁচি ব্যাপার জানিতে আসিলে ছেলেটা তাহার জুড়িয়া দেয় কান্না। ওদিকের ঘরে বুঁচির মুমূর্ষ পিসি বিছানায় উঠিয়া বসিয়া আর্তস্বরে বলিতে থাকে কী হল রে? ও বুঁচি, ওলো কুসুম, কী হল রে? হেই ভগবান, কেউ কি সাড়া দেবে!
বড় ঘরের অন্ধকারে মতি শুইয়া ছিল, সেও তাহার ক্ষীণকণ্ঠ যতটা পারে উঁচুতে তুলিয়া ব্যাপার জানিতে চায়।
অবিচলিত থাকে শুধু কুসুম। দাওয়ার নিচে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়াইয়া সে মোক্ষদার গাল শোনে।
তারপর রান্নাঘর হইতে একটা জ্বলন্ত কাঠ আনিয়া ঢুকিতে যায় শোবার ঘরে।
আঘাতের বেদনা তুলিয়া মোক্ষদা হাউমাউ করিয়া উঠে।
ও কী লো বউ, ও কী? ঘরে-দোরে আগুন দিবি না কি?
আগুন দেব কেন মা? পিলসুজের দীপটা জ্বালব।
উনুনের কাঠ এনে দীপ জ্বালাবি? দ্যাখ বুঁচি, দ্যাখ মেলেচ্ছ হারামজাদি ঘরের মধ্যে চিতা জেলে দিতে চলল, চেয়ে দ্যাখ!
কুসুম চোখ পাকাইয়া বলে, গাল দিও না বলছি অত করে, দিও না। আমপাতা দেখছ না হাতে? কাঠ থেকে যদি দীপ জ্বালাব, পাতা নিয়ে যাচ্ছি কি চিবিয়ে খাব বলে নাকি?
মোক্ষদা গলা নামাইয়া বলে, গাল তোমায় আমি দেইনি বাছা–বুঁচিকে।
কুসুমকে এ বাড়ির সকলে ভয় করে। এই বাস্তুভিটাটুকু ছাড়া হারু ঘোষের সর্বস্ব কুসুমের বাবার কাছে আজ বাধা আছে সাত বছর। একবার গিয়া কাদিয়া পড়িলেই সে দিবে নালিশ কিয়া, এরা সব তখন যাইবে কোথায়? তাই বলিয়া কুসুম যে সবসময় বাড়ির লোকগুলিকে শাসন করিয়া বেড়ায়, তা নয়। বরং সে অনেকটা নিরীহ সাজিয়াই থাকে। বকবিকি করিলে সবসময় কানেও তোলে না, নিজের মনে ঘরের কাজ করিয়া যায়। কাজ করিতে ভালো না লাগিলে খিড়কির দরজা দিয়া বাহির হইয়া গিয়া তালবনে তালপুকুরের ধারে ভূপতিত তালগাছটার গুঁড়িতে চুপচাপ বসিয়া থাকে।
উনানে ডাল-ভাত একটা কিছু চাপাইয়া হয়তো যায়। বাড়ির লোকে তাহার অনুপস্থিতি টের পায় পোড়া গন্ধে।
মেজাজের কেহ তার হদিস পায় না। কতখানি সে সহ্য করবে, কখন রাগিয়া উঠিবে, আজ পর্যন্ত তাহা ঠিকমতো বুঝিতে না পারিয়া সকলে একটু বিপদগ্রস্ত হইয়া থাকে।
পাড়ার লোক বলে, বউ তোমাদের যেন একটু পাগলাটে, না গো পরাণের মা?
মোক্ষদা বলে, একটু কেন মা, বেশ পাগল-পাগলের বংশ যে। ওর বাপ ছিল না পাগলা হয়ে, দু বছর-শেকল দিয়ে বেঁধে রাখত?
ঘরে ঢুকিয়া কুসুম প্রদীপ জ্বলিল। গাল ফুলাইয়া সবে সে শাখে তিনবার স্কু দেওয়া শেষ করিয়াছে, উঠানে শোনা গেল শশীর গলা।
বিছানার কাছে গিয়া কুসুম বলিল, সন্ধে হতে না-হতে খোঁজ নিতে এসেছে মতি।
মতি কোনো জবাব দিল না। কুসুম আবার বলিল, ওলো মতি, শুনছিস? সন্ধেদীপ জ্বালাতে-না-জ্বালাতে দেখতে এসেছে—দরদ কত?
ভারী জলচৌকিটা অবলীলাক্রমে তুলিয়া লইয়া গিয়া সে দাওয়ায় পাতিয়া দিল। বলিল, জ্বর কমেছে, ঘুমোচ্ছে এখন।
মোক্ষদা বলিল, মতি আবার ঘুমোল বো? এই মাত্তর সাড়া পেলাম যে?
শশী বলিল তোমার শাঁখের শব্দেও মতির ঘুম ভাঙল না পরাণের বউ?–সে জলচৌকিতে বসিল, ঘরের ভিতরে এক নজর চাহিয়া বলিল, পরাণ বিকেলে গিয়ে বলে এল জ্বর নাকি এবেলা খুব বেড়েছে?
কুসুম বলিল, মিথ্যে বলেছে ছোটোবাবু,–একটুতে অস্থির তো? জ্বর কই?
মোক্ষদা বলিল, কী সব বলছ তুমি আবোলতাবোল, যাও না বাছা রান্নাঘরে।
কুসুম বিনা প্রতিবাদে রান্নাঘরে চলিয়া গেল। মুখে কৌতুকের হাসি নাই, গাম্ভীর্যও নাই।
শশী বলিল, সকালে যে ওষুধ পাঠিয়েছিলাম খাওয়ানো হয়নি?
মোক্ষদা বলিল, তা তো জানি না বাবা, দেখি শুধোই মেয়েকে।
রান্নাঘর হইতে কুসুম বলিল, ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে গো হয়েছে। চেঁচামেচি করে মেয়েটার ঘুম ভাঙাচ্ছ কেন?
ঘরের ভিতর হইতে ক্ষীণকষ্ঠে মতি বলিল, আমি ওষুধ খাইনি মা।
মোক্ষদা চোখ পাকাইয়া রান্নাঘরের দিকে চাহিয়া বলিল, শুনলে বাবা, দিবি কেমন মিথ্যে কথাগুলি বলে গেল বউ, শুনলে?
শশী একটু হাসিল, কিছু বলিল না। কুসুমের এরকম সরল মিথ্যাভাষণ সে মাঝে মাঝে লক্ষ করিয়াছে। ধরা পড়িবে জানিয়া শুনিয়াই সে যেন এই মিথ্যাকথাগুলি বলে। এ যেন তাহার একধরনের পরিহাস। কালোকে সাদা বলিয়া আড়ালে সে হাসে।
ঘরে গিয়া শশী মতিকে জিজ্ঞাসা করিল, কি, কষ্ট হচ্ছে রে মতি? মতি তাহা জানে মা। সে আন্দাজে বলিল, গা ব্যথা কচ্ছে ছোটোবাবু, তেষ্টা পেয়েছে।
পিসিকে শান্তি করিয়া বুঁচি আসিয়াছিল, বলিল, আজ বড়ো কেশেছে ছোটোবাবু সারাদিন।
কানে নল লাগাইয়া শশী মতির বুকটা পরীক্ষা করিয়া দেখিল। এ পরীক্ষায় মতির বড় লজ্জা করে, বুকের মধ্যে টিপটিপ করিতে থাকে। স্টেথোস্কোপের নল বাহিয়া তাহা । শশীর কানে পৌঁছায়, সে অবাক হইয়া বলে, নিশ্বাস বন্ধ করে থাকতে তোকে কে বলেছে মতি, জোরে জোরে নিশ্বাস নে! —বুঁচি আলোটা উঁচু করিয়া ধরিয়াছে, শশী মতির মুখের দিকে তাকায়।
ভাঙা লণ্ঠনের রাঙা আলোতে মতির রঙ যেন মিশিয়া গিয়াছে।
নিঃশব্দ পদে কুসুম যে কখন পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল!
বুকে ওর হয়েছে কী? এত পরীক্ষে কিসের?
একটু সর্দি বসেছে বলে মনে হচ্ছে পরাণের বউ। গরম তেল মালিশ করে দিও।
কুসুম ভীরুকষ্ঠে বলে, সর্দি ঠিক তো ছোটোবাবু? পরীক্ষের রকম দেখে ভয়ে বুকে কাপন লেগেছে মা, ক্ষয়রোগেই বা ধরল-গুলো মতি, বলিনি তোকে? বলিনি জ্বরগায়ে হাওয়ায় গিয়ে বসিস নে, ঠাণ্ড লেগে মরবি?
শশী বাহিরে গিয়া একটু বসে। মোক্ষদা তখন সবিস্তারে তাহাকে শোনায় তাহার আছাড় খাওয়ার বৃত্তাত্ত। বলে, বউ আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে বাবা, বউ নিয়ে হয়েছে আমার মরণ।–নিচুগলায় আবোলতাবোল অনেকক্ষণ মোক্ষদা বকে। হারু আজ মরিয়াছে দিনসাতেক, তার কথা উল্লেখ করিয়া সে এখন আর সুর করিয়া কাঁদে না, বারবার শুধু চোখ করে সে কুসুমের,—শুনিয়া মনে হয় সবই বুঝে সত্য বলিতেছে। বুঁচি চুপ করিয়া শোনে, কথাটি বলে না; না দেয় সায়, না করে প্রতিবাদ। আর রান্নাঘরে শশীকে শোনাইয়া কুসুম করে যাত্রার দলের গান, টানা গুনগুনানো সুরে, অস্পষ্ট ভীরু গলায়। সত্য সত্যই পাগল নাকি কুসুম?
তারপর রান্নাঘর হইতে বাহির হইয়া কুসুম কোথায় যায় কে বলিবে।
শশী খানিক পরে বিদায় নেয়। হারুর বাড়ি কায়েতপাড়ার পথটার ঠিক উপরে নয়, দুপাশে বেগুনক্ষেতের মাঝখান দিয়ে হাত তিনেক চওড়া খানিকটা পথ পার হইয়া রাস্তায় পড়িতে হয়।
শশী তাড়াতাড়ি এইটুকু পার হইয়া যাইতেছিল, ডাইনে বেগুনক্ষেতের বেড়ার ওপাশ হইতে কুসুম বলিল, ছোটোবাবু, শুনুন!
শশী অবাক হইয়া বলিল, তুমি ওখানে কী করছ বউ? সাপে কামড়াবে যে?
কুসুম বলিল, সাপে আমাকে কামড়াবে না ছোটোবাবু, আমার অদৃষ্ট মরণ নেই।
শশী হাসিয়া বলিল, কী আবার হল তোমার?
পরাণের বউ বলে যে ডাকলেন আজ? পরাণের বউ বললে, আমার গোসা হয় ছোটোবাবু। পিসি বলত,–বুঁচির ছোট পিসি, ও বছর যে সগ্যে গেল, অমনি গাল তাকে একদিন দিলাম দিলাম–
আমাকেও নাহয় দাও দুটো গাল।
তাই বললাম? হাঁ ছোটোবাবু, তাই বললাম? পূজ্য মানুষ আপনি, আপনাকে পুজো করে আমাদের পুণ্যি হয়–
গড়গড় করিয়া মুখস্থ বুলির মতো একরাশ তোষামোদের কথা কুসুম বলিয়া যায়, শুনিতে মন্দ লাগে না শশীর। কত বছর আজ সে কুসুমের এমনি পাগলামি দেখিতেছে। ওর এইসব খাপছাড়া কথায় ব্যবহারে একটি যেন মিষ্টি ছন্দ আছে।
বাড়ি যাও বউ, ভাত পোড়া লাগবে।
কাল আসবেন ছোটোবাবু মতিকে দেখতে?
আসব। কেমন থাকে সকালে একবার খবর পাঠিও, অ্যাঁ।
রোজ একবার এলেই হয়! জ্বর ভুগছে মেয়েটা, দেখে তো যাওয়া উচিত? কদিন আসেননি বলে বাড়ির সবাই কত কথা বললে ছোটোবাবু। বললেন, শশী আমাদের মস্ত ডাক্তার হয়েছে, না ডাকলে আর আসা হয় না। মতি কী বললে জানেন?–ছোটোবাবুর অহংকার হয়েছে!
শশী আগাইয়া যায়, বলে, আমার কাজ আছে বউ, কাল এসে তোমার মিছে কথা শুনব।
মিছে কথা নয়, সত্যি মিছে নয় ছোটোবাবু!
শশী চলিয়া গেলে অন্ধকারে বেগুনক্ষেতে দাঁড়াইয়া কুসুম একটু হাসিল। সামনে গাছের মাথার কাছে একটু আলো হইয়াছে কুসুম জানে এখানে চাঁদ উঠবে। চাঁদ উঠিবে, চাঁদ উঠিবার আভাস দেখিলে কুসুম যেন শুনিতে পায়।
ভিনদেশী পুরুষ দেখি চাঁদের মতন
লাজরক্ত হইলা কন্যা পরথম যৌবন।
কে সে কিশোরী, ভিনদেশী পুরুষ দেখিয়া যার লজ্জাতুর প্রেম জাগিত? সে কুসুম নয়, হে ভগবান, সে কুসুম নয়।
অন্ধকারে ঠাহর করিয়া দেখিয়া বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, শশী না? ও বাবা শশী তোমায় খুঁজে বেড়াচ্ছি যে ভুতো যেন কেমন করছে শশী। ওর মা কাদা-কাটা লাগিয়েছেন। তুমি এসে একটিবার দেখে যাও।
তো বাড়ুজ্যে-বাড়ি গেলি শশী, পয়সা-কড়ি দিয়েছে কিছু? দুটো একটা কলের টাকা না দিলে তো বিপদে পড়ি ককা? কত মিথ্যে বলব বাবার কাছে? পয়সাকড়ির ব্যাপার জানেন তো বাঘার, একটি পয়সা এদিকে ওদিকে হবার যো নাই।
বাসুদেব লজ্জা পাইয়া বলেন, শশীর টাকা কালই পৌঁছিয়া দিয়া আসিৰেন শশীর বাড়িতে, নিজে যাইবেন। শশী ভাবে, আজ নয় কেন? মুখে সে কিছু বলে না বাসুদেবের বাড়ি কম দূর নয়। শ্রীনাথের দোকান ছাড়াইয়া, রজনী সরকারের পাকা দালানের পাশ দিয়া বামুনপাড়া পর্যন্ত গড়ানো সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথের মাঝখান হইতে দক্ষিণদিকে ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়া পায়ে-চলা যে সংকীর্ণ রাস্তাটুকু পোয়াটক গিয়া মাঠের মধ্যে হারাইয়া গিয়াছে, তার শেষাশেষি। কদিন বৃষ্টি হয় নাই, এ বছরের মতো বর্ষা বোধহয় শেষ হইয়াছে পথের কাদা কিন্তু শুকায় নাই। জুতা হাতে করিয়া বাসুদেবের বাড়ি পৌঁছিয়া শশী পা ধুইল। বাসুদেবের ছোটছেলে ভুতোর বয়স বছর-দশেক, সাত-আট দিন আগে গাছের মগড়াল হইতে পড়িয়া গিয়া হাত-পা দুইই ভাঙিয়াছিল। তার পর জ্বরে-বিকারে অজ্ঞান হইয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিস্থলে আসিয়া পড়িয়াছে। শশী তাহাকে সদর হাসপাতালে পাঠাইতে বলিয়াছিল, এরা রাজি হয় নাই। হাসপাতালের নামে ভুতোর মা ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছিল, ছেলেকে চৌকাঠের বাহিরে নিলে সে বিষ খাইয়া মরিবে। তারপর শশীই প্রাণপণে ভুতোর চিকিৎসা করিতেছে, দিনে দুইবার তিনবার আসে।
ভূতোর শিয়রে তার মা লক্ষ্মমণি মৃদুস্বরে কাঁদিতেছিলেন। বড় দুটি ছেলে, দুটি বিবাহিতা মেয়ে, তিনটি বউ ঘরের মধ্যে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। বড় বেঁটি বিধবা, ঘোমটা দিয়া ভূতোকে সে বাতাস করিতেছিল। মায়ের পরে এ বাড়িতে দুরন্ত ছেলেটাকে সেই হয়তো ভালোবাসে সকলের চেয়ে বেশি,–চোখ দিয়া তাহার দরদর করিয়া জল পড়িতেছে।
ভুতোর অবস্থা দেখিয়া শশীর মুখ ম্লান হইয়া গেল। ছেলেটা বাঁচিবে না এ সন্দেহ তাহার ছিল; তবু দুপুরবেলা ওকে দেখিয়া গিয়া একটু আশা তাহার হইয়াছিল বইকী। একবেলায় অবস্থাটা যে এরকম দাঁড়াইবে সে তাহা ভাবিতেও পারে নাই। ছেলেটার সর্বাঙ্গে সে জড়াইয়া জড়াইয়া ব্যান্ডেজ বাঁধিয়াছিল। নড়িবার উপায় তাহার নাই, এখন থাকিয়া থাকিয়া মুখ শুধু বিকৃত করিতেছে। শশীর গলা এমনি মৃদু, এখন আরও মৃদু শোনাইল–একটু আগুন চাই সেঁক দেবার–গরম কাপড় যদি একটুকরো থাকে?
বিধবা বউটি মালসায় আগুন আনিল। একটা আলোয়ান ভাঁজ করিয়া শশীর নির্দেশমতো ভুতোর বুকে সেক দিতে লাগিল। শশী তাহকে একটা ইনজেকশন দিয়া একটু অপেক্ষা করিল। বারবার চোখের ভিতরটা লক্ষ করিয়া দেখিল, নাড়ি টিপিল, তারপর নীরবে উঠিয়া আসিল। সকলে এতক্ষণ শ্বাসরোধ করিয়া ছিল, শশীর উঠিয়া আসার ইঙ্গিতে ঘরে তাহাদের সমবেত কান্না একেবারে ভাঙিয়া পড়িল।
বিধবা বউটি পাগলের মতো ছুটিয়া আসিয়া শশীর পথ রোধ করিয়া বলিল, না, তুমি যেতে পাবে না শশী, আমার ভূতোকে বাঁচিয়ে যাও! যাও আমার ভূতোকে বাঁচিয়ে? ও যে আমার জন্যে জাম আনতে পাছে উঠেছিল শশী!
শশী কী বলিবে? সে গম্ভীর হইয়া থাকে। তারপর পথ পাইলে বাহির হইয়া যায়। জুতা হাতে করিয়া সে নামিয়া যায় পথে। পায়ে-চলা পথটির শেষেও সে কান্নার শব্দ শুনিতে পায়।
শ্ৰীনাথ দাশের মুদি দোকানের সামনে বাঁশের তৈরি বেঞ্চিতে বসিয়া কয়েকজন জটলা করিতেছিল। বোধ হয় গল্পে মশগুল থাকায় বাসুদেবের সঙ্গে যাওয়ার সময় শশীকে তাহারা দেখিতে পায় নাই। এবার শ্রীনাথ দেখিতে পাইয়া ডাকিয়া বলিল, একটু বসে যান ছোটোবাবু,–টুলটা ছাড় দেখি নিয়োগীমশায়, ছোটোবাবুকে বসতে চাও।
পঞ্চানন চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় গিয়েছিলে শশী?
শশী বলিল, বাসুদেব বাড়ুজ্যের বাড়ি, ভূতো এইমাত্র মারা গেল।
বটে? বাঁচল না বুঝি ছেলেটা? তবে তোমাকে বলি শোনো শশী, ভুতো যেদিন পড়ল আছাড় খেয়ে, দিনটা ছিল বিযু্যদবার। খবর পেয়ে মনে কেমন খটকা বাধল। বাড়ি গিয়ে দেখলাম পাঁজি–যা ভবেছিলাম। ছেলেটাও পড়েছে, বারবেলাও হয়েছে খতম্! লোকে বলে বারবেলা, বারবেলা কী সবটাই সর্বনেশে বাপু? বিপদ যত ওই খতম হবার বেলা। বারবেলা যখন ছাড়ছে, পায়ে কাঁটাটি ফুটলে দুনিয়ে উঠে অক্কা পাইয়ে দেবে।–-নবীন জেলের বড়ো ছেলেটাকে সেবারে কুমিরে নিলে, সেদিনও বিষ্ণুদবার, সেবারও ছেলেটা খালে নামল, বারবেলাও অমনি ছেড়ে গেল–গাওদিয়ার খালে নইলে কুমির আসে?
খালের কুমির শুধু নয়, ভূতোর কথার ভূতের কথাও আসিয়া পড়িল। তার পর বাজারের সন্ন্যাসী, বাজারদর, একাল-সেকালের পার্থক্য, নারীহরণ, পূর্ণ তালুকদারের মেয়ের কলঙ্ক, বিদেশবাসী গাঁয়ের বড়ো চাকুরে সুজন দাস, এই সব আলোচনা। শশী কি এত উঁচুতে উঠিয়া গিয়াছে যে এইসব গ্রাম্য প্রসঙ্গে তাহার মন বসিল না, শান্ত অবহেলার সঙ্গে নীরবে শুনিয়া গেল? তা তো নয়। শুধু আধখানা মন দিয়া সে ভাবিড়েছিল, এতগুলি মানুষের মনে মনে কী আশ্চর্য মিল। কারো স্বাতন্ত্রা নাই, মৌলিকতা নাই, মনের তারগুলি এক সুরে বাঁধা। সুখ-দুঃখ এক, রসানুভূতি এক, ভয় ও কুসংস্কার এক হীনতা ও উদারতার হিসেবে কেউ কারও চেয়ে এতোটুকু ছোট বা বড় নয়। পঞ্চানন জমিদার সরকারের মুহুরি, কীর্তি নিয়োগী, পেনশনপ্রাপ্ত হেডপিয়ন, শিবনারায়ণ গায়ের বাঙলা স্কুলের মাস্টার, গুরুগতির চাষ-আবাদ–ব্যবসা ইহাদের পৃথক,–মনগুলি এক ধাঁচে গড়িয়া উঠিল কী করিয়া? স্বতন্ত্র মনে হয় শুধু ভুজঙ্গধরকে, বাজিতপুরে সি ছিল এক উকিলের মুহুরি, টাকার গোলমালে দুবছর জেল খাঁটিয়া আসিয়াছে। বেশি কথা ভূজঙ্গধর বলে না, ছোট ছোট কুটিল চোখের চাহনি চঞ্চলভাবে । এদিক-ওদিক ঘুরিয়া বেড়ায়, মনে হয় কী যেন সে মতলব আঁটিতেছে, গোপন ও গভীর। কীর্তি নিয়োগীর মাথা জুড়িয়া চকচকে টাক, এতদিন পিয়নের হলদে পাগড়িতে ঢাকা থাকিত, এখন টাকের উপর আলুর মতো বড় আবটি দেখিয়া হাসি পায়। ইহার প্রতি শ্রীনাথের শ্রদ্ধা গভীর, কেন সেকথা কেহ জানে না। কীর্তির কথাগুলি শ্রীনাথ যেন গিলিতে থাকে। কীর্তি একটি পয়সা বাহির করিয়া । বলে ও ছিদাম, সাবু দিও দিকি এক পয়সার। শ্রীনাথ এক পয়সার যতটা সাগু কাগজে মুড়িয়া তাহকে দেয় তাহ দেখিয়া সকলে যেন ঈর্ষ বোধ করে, ভূজলধরের সাপের মতো চোখদুটিতে কয়েকবার পলক পড়ে না। উপরে ঝোলানো কেরোসিনের আলোটাতে শ্রীনাথের দোকানে আলো মস্ত হয় না, দোকানের সাজানো জিনিসগুলিতে যেন একটি লক্ষ্মীশ্ৰী ছড়ানো থাকে। ছোট ছোট চৌকা কাঠের খোপে চাল, ডাল, একটা ময়দার বস্তা, বারকোশ বসানো তেলের গাদমাখা পাত্র, মুড়ি-মুড়কির দুটি জালা, হরিণের ছবি আটা দেশলাই এর প্যাক, একদিকে কাঁচ বসানো হলদে টিনে সাগু-বালি গোল গোল লজেন্স,-ভুজঙ্গধর চারিদিকে চোখ বুলায়, শ্রীনাথের বসিবার ও পয়সা রাখিবার চৌকো ছোট চোকিটি ভালো করিয়া দেখিবার ভূমিকার মতো। সামনে পথ দিয়া আলো হাতে কেহ ছুটিয়া যায়, কেহ যায় বিনা আলোতে, শ্রীনাথের একটি দুটি খদের আসে। উপস্থিত একজন খদেরকে সে ভূতোর মৃত্যুসংবাদ শোনায়। —না, যে । বিষয়েই আলোচনা চলুক ভূতোর কথাটা তাহারা ভোলে নাই।
শশী উঠি-উঠি করিতেছিল, এমন সময় সকলকে অল্পবিস্তর অবাক করিয়া এক হাতে ক্যাম্বিশের ব্যাগ, এক হাতে লাঠি, বগলে ছাতি, পায়ে চটি, গায়ে উড়ানি যাদব পণ্ডিত পথ হইতে শ্রীনাথের দোকানের সামনে উঠিয়া আসিলেন। মানুষ বুড়া, শরীরটা শীর্ণ, কিন্তু হাড় কখানা মজবুত।
বিদ্যা যাদবের বেশি নয়, পণ্ডিত বলিয়া খ্যাতিও তাহার নাই, ধাৰ্মিক ও অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন বলিয়াই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। গৃহস্থ যোগী তিনি, সংসারী সাধক। স্পর্শ করিবার অধিকার যাহাদের আছে, দেখা হইলে পায়ের ধুলা নেয়, অপরে সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করে। সাধনপথের কতকগুলি স্তর যাদব অতিক্রম করিয়াছেন কেহ জানে না; ভক্তি যাদের উচ্ছসিত, তারা সোজাসুজি সিদ্ধি লাভের কথাটাই বলে। যাবদ নিজে কিছু স্বীকার করেন না, প্রতিবাদও করেন না। কায়েতপাড়ার পথের ধারে, যামিনী কবিরাজের বাড়ি ও শশীদের বাড়ির মাঝামাঝি একটি ছোট একতলা বাড়িতে যাদব বাস করেন। এত পুরাতন, এমন জীর্ণ বাড়ি এ-অঞ্চলে আর নাই। বাড়ির খানিকটা অংশ ভাঙিয়া পড়িয়ছে। এককালে চারিদিকে বোধহয় প্রাচীর ছিল। এখন ছড়ানো পড়িয়া আছে শ্যাওলাধরা কালো ইট। যাদব বাস না করিলে বাড়িটা অনেক দিন আগেই ভূতের বাড়ি বলিয়া খ্যাতিলাভ করিত। স্ত্রী ছাড়া সংসারে যাদবের কেহ নাই। পাগলাটে স্বভাবের জন্য গ্রামের ছেলে-বুড়ো যাদবের স্ত্রীকে পাগলদিদি বলিয়া ডাকে।
কয়েক দিন আগে যাদব কলিকাতায় গিয়াছিলেন। আজ তাহার ফিরিবার কথা নয়। সকলে শশব্যস্তে প্রণাম করিয়া বসিতে দিল। পঞ্চানন জিজ্ঞাস করিল, হঠাৎ ফিরে এলেন পণ্ডিত মশায়?
যাদব বলিলেন, গেঁয়ো মানুষ, শহরে মন টিকল না বাবা।
শ্রীনাথ উচ্ছসিতভাবে বলিল, আপনারও মন টেকাটেকি দেবতা!
একথায় যাদব হাসিলেন। উচ্ছসিত ভক্তিকে গ্রহণ করিবার পদ্ধতি তাহার এই ! একে একে সকলের তিনি কুশল প্রশন করিলেন। ভূতোর মৃত্যুসংবাদে দুঃখিত হইয়া বলিলেন, আহা! কিন্তু বিশেষ বিচলিত হইলেন না। জীবন-মরণ যাহার নিকট সমান, দুরন্ত একটা বালকের মৃত্যুতে বিচলিত হওয়ার কথাও তার নয়। তবু শশীর মনে হইল সাধারণভাৰে আরও একটু ব্যথিত হওয়া যাদবের যেন উচিত ছিল! কানে না শুনিতে পান, একটা পরিবারে এখন যে বুকভাঙা হাহাকার উঠিয়াছে, যাদবের কি সে কল্পনা নাই! মিনিট দশেক বসিয়া যাদব উঠিলেন। বলিলেন, যাবে নাকি শশী বাড়ির দিকে?
শশী বলিল, চলুন।
লাঠি ঠুকিয়া যাদব পথ চলেন। শশী জানে এত জোরে লাঠির শব্দ করা সাপের জন্য মরিতে যাদব কি ভয় পান,-জীবন-মৃত্যু যার কাছে সমান হইয়া গিয়াছে? অথবা শুধু সাপের কামড়ে মরিতে তাঁর ভয়!
চলিতে চলিতে যাদব বলিলেন, তুমি তো ডাক্তার মানুষ শশী, চরক সুশ্রুত ছেড়ে বিলাতি বিদ্যে ধরেছে, কেটে ছিঁড়ে গা ফুঁড়ে মরা মানুষ বাঁচাও,–ব্যাপারটা কী বলো দেখি তোমাদের? সত্যি সত্যি কিছু আছে না কি তোমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে?
শশী বলল, আজ্ঞে আছে বইকী পণ্ডিত মশায়,–কারো একার খেয়ালে তো ডাক্তারিশাস্ত্র হয়নি। হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক সারাজীবন পরীক্ষা করে করে সব আবিষ্কার করেছেন, নইলে জগৎসুদ্ধ লোক—
যাদব বললেন, সূর্যবিজ্ঞান না জানা সব বৈজ্ঞানিক তো? আদিজ্ঞান যার নেই পরবর্তী জ্ঞান সে পাবে কোথায় শশী? যেমন তোমরা সব একালের ডাক্তার, তেমনি সব কবিরাজ-দৃষ্টিহীন অন্ধ সব। গাছের পাতার রস নিংড়ে ওষুধ করলে, গাছের পাতায় ওষুধের গুণ এল কোথা থেকে? সূর্যবিজ্ঞান যে জানে সে শেকড়পাতা খোঁজে না শশী, একখানা আতশি কাঁচের জোরে সূর্যরশ্মিকে তেজস্কর ওষুদে পরিণত করে রগীর দেহে নিক্ষেপ করে,–মুহূর্তে নিরাময়। মোটা মোটা বই পড়ে ছুরি কাঁচি চালাতে শিখে কী হয়?
মনে মনে শশী রাগে। গ্রাম্য মনের অপরিত্যাজ্য সংস্কারে সেও যাদবকে ভক্তি কম করে না, তাই সায় না দিলেও তর্ক সে করিতে পারে না। বাড়ির সামনে আসিয়া যাদব বলেন, কলিকাতা থেকে আঙুর এনেছি, দুটি খেয়ে যাও শশী–মুখে বিরুদ্ধ সমালোচনা করিলেও শশীকে যাদব কি স্নেহ করেন, স্নেহ ও বিদ্বেষ যার আছে সমান শশী বলিতে পারে না আঙুর খাওয়ার শখ তাহার নাই। যাদবের সঙ্গে ভিতরে যায়।
ডাইনে বাড়ির ভাঙা অংশের স্তুপ, তার পিছনে সাহাদের দশবছরের পরিত্যক্ত ভিটা। ভারী কাষ্ঠের জীর্ণ কপাটে যাদব লাঠি ঠোকেন। ভিতর হইতে সাড়া লইয়া পাগলদিদি দরজা খুলিয়া বলেন, আজ ফিরলে কেন গো? শশী এয়েছ নাকি সাথে? এসো, ভেতরে এসো।
মুখে একটাও দাঁত নাই, তোবড়ানো গাল, পাকা চুল,-পাগলদিদিকে যাদবের চেয়েও বুড়ো দেখায়। পিঠটাও পাগলদিদির একটু বাকিয়া গিয়াছে। তবু, শীর্ণ জরাগ্রস্ত দেহে ক্ষীণ প্রাণটুকু লইয়া পাগলদিদি ফোকলামুখে অনবরত হাসেন,—এই ভাঙা বাড়ি, । ডোবাজঙ্গল ভরা এই গাওদিয়া গ্রাম, এখানে তাহার বাৰ্ধক্যপীড়িত জীবন, সব যেন কৌতুকময়-ঘনানো মৃত্যুর স্বাদে পাগলাদিদি কৌতুকময়ী।
শশী বসিলে চিবুক ধরিয়া বলেন, বড়কর্তা বাড়ি ছিল না জানতে না বুঝি ছোটকর্তা? এলে না কেন গো? ডুবে শাড়িটি পরে, চুলটি বেঁধে কনেবউটি সেজে যে বসেছিলাম তোমার জন্যে?
আঙুরগুলি যাদব ব্যাগে ভরিয়া আনিয়াছেন। বাহির করিয়া দেখা গেল চাপ লাগিয়া অর্ধেক ফল গলিয়া গিয়াছে। ব্যাগে একটি জামা, দুখানা কাপড়, গামছা এইসব ছিল, আঙুরের রসে সব ভিজিয়া গিয়াছে। যাদব অপ্রতিম্ভ হইয়া হাসেন। পাগলদিদি বলেন : দ্যাখে দাদা বুড়োর বুদ্ধি, ব্যাগে ভরে ফল এনেছেন কেন, গামছাখানা খুলে বেঁধে আনতে পারলে না?–পাগলাদিদিও হাসেন, মুখের চামড়া কুঞ্চিত হইয়া হাজার রেখার সৃষ্টি হইয়া যায়! আঙুর খাইতে খাইতে শশী পাগলদিদির মুখখানা নীরবে দেখিতে থাকে। রেখাগুলিকে তাহার মনে হয় কালের অঙ্কিত চিহ্ন-সাংকেতিক ইতিহাস। কী জীবন ছিল পাগলদিদির যৌবনে? শশী তখন জন্মে নাই। নৃজ বিশীর্ণ দেহটি তখন সুঠাম ছিল, মুখের টান-করা ত্বকে যখন লাবণ্য ছিল, কেমন ছিল তখন পাগলদিদি-মুখের রেখায় আজ কি তাহলে পড়িতে পারবে?
গুছানো সংসার পাগলদিদির। উপুড়-করা বাসনগুলি সাজানো, হাড়ি-কলসীর মুখগুলি ঢাকা, আমকাঠের সিন্দুকটায় গায়ে ধৌত পরিচ্ছন্নতা, পিলসুজে দীপটির শিখা উজ্জ্বল। এখনো ধূপের মৃদু গন্ধ আছে আর শান্ত-সব এখানে শাস্তু। মৃদু মোলেয়েম প্রশান্তি ঘরে ব্যাপ্ত হইয়া আছে। এ ঘরের আবহাওয়ার অমায়িকতা যেন নিশ্বাসে গ্রহণ করা যায়। ভাঙা হাটে যে বিষণ্ণ স্তব্ধতা ঘনাইয়া থাকে এ তা নয়। এ ঘরে বহুযুগ ধরিয়া যেন মানুষের জ্বালা-করা বেদনার হল্লা প্রবেশ করে নাই। এ ঘরে জীবন লইয়া কেহ যেন কোনোদিন হৈচৈ করিয়া বাঁচে নাই,-আজীবন শুধু ঘুমাইয়া এ ঘরকে কে যেন ঘুম পাড়াইয়া রাখিয়াছে। বড় ভালো লাগে শশীর। সে তো ডাক্তার, আহত ও রুগৃণের সঙ্গে তার সারাদিনের কারবার,–দিন ভরিয়া তাহার শুধু মাটি-ছোঁয়া বাস্তবতা,–শ্রান্ত মনে সন্ধার জনহীন মন্দিরে বসার মতো বুড়োবুড়ির এই নীড়ে সে শান্তি ৰোধ করে। শুধু আজ নয়, এখানে আসিলেই তাহার মন যেন জুড়াইয়া যায়। অথচ আশ্চর্য এই এই ঘরখানার এতটুকু আকর্ষণ বাহিরে সে বোধ করে না। এখানে আসিলে সে তো বুঝিতে পারে না মনে তাহার জ্বালা বা অসন্তোষ আছে। এখানে আসিয়া যে সন্তাপ তাহার ধীরে ধীরে জুড়াইয়া আসে, এই ঘরের বাহিরে তাহার দিন সপ্তাহমাসব্যাপী জীবনে তাহা এমনভাবে খাপ খাইয়া মিশিয়া থাকে যে, সন্তাপ সে টেরও পায় না।