পিলসুজ
নিয়নবাতির সহস্র আলোর রশ্মি কোটি নির্বুদ ঝর্ণা কণা হয়ে ঝরে পড়ছে গমগমে উচ্ছ্বল পিচ্ছিল রাজপথে ।
পরিযায়ী পর্যটকগন কলকাতার ফুসফুস থেকে কিছু শুদ্ধ বায়ু এবং আনন্দ – ফূর্তি সঙ্গী করে ঘরমুখো হচ্ছেন ধীরে ধীরে ।
বাকি কিছু আরও প্রমোদ পিপাসু এখনও ঝলমলে ঘোড়াটানা রথে আরূঢ় হয়ে কেউ নিজেকে রাজা , রানী , রাজপুত্র, রাজকুমারী ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে ইতিউতি স্বপ্ন ভ্রমণে ব্যস্ত । পড়ন্ত সন্ধ্যার শেষ হেমন্তের মৃদু ঠান্ডা হাওয়া প্রাণে খুশীর জোয়ার এনেছে ।
বাসস্টান্ডে ভীড় যাত্রীদের ।
ফুচকাওয়ালা খদ্দের সামলাতে – চতুর্ভুজ একেবারে ঘেমে নেয়ে একশেষ !
মনে মনে আওরাচ্ছে — এতো খেতেও পারে এই মোটাসোটা আদুরে দুলালীগুলো । গলে- পড়া ঢলঢলে ছলকে যাওয়া মায়েরাও কিছু কম যাচ্ছে না , লিপস্টিক বাঁচিয়ে
সমানে পাল্লা দিচ্ছে সোহাগীদের সঙ্গে !
শুধু আইসক্রিমওয়ালার ভীড় পাতলা হতে হতে রাত দশটা ।
ঠিক আলোকস্তম্ভের পাদপীঠে উদ্বিগ্ন মুখে বারবার ঘড়ি দেখছেন বছর পঁয়ত্রিশের সুবেশা ‘ দেখতে মন্দ না গোছের ‘ এক মহিলা ।
সঙ্গে আট দশ বছরের এক ছটফটে ছেলে । মাঝে মাঝে এগিয়ে যাচ্ছেন বাসের দিকে । আবার ফিরে আসছেন নিজের জায়গায় । মনে হয় কোনও বাসের অভ্যন্তরীণ অবস্থা তাঁর মনঃপূত নয় ।
ইতিমধ্যে ছেলের পাঁচটা ফুচকা এবং একটা ছোট্ট আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয়ে গেছে । ছেলেকে সামলাবেন না বাসের খালি সিট খুঁজবেন বুঝে উঠতে পারছেন না ! এদিকে ঘড়ি ঠিক জানান দিচ্ছে রাত সাড়ে দশটা কিন্তু !
রুলার – ওয়ালা পুলিশের আনাগোনা শুরু হয়েছে ।
সামনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল , ঠিক পেছনেই বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম , পাশে বিশাল ময়দান ।
— সবমিলিয়ে মাত্র দুজনের কাঁধে পুরো দায়িত্ব । কাঁহাতক আর পারা যায় ! উপরি ইনকামও এখন পর্যন্ত কিছু আহামরি নয় ! কি রে বাপু, আজকাল কি সবাই নীতিনিষ্ঠ নিয়মবাগীশ হয়ে গেল নাকি রে ভাই ! — মনে মনে এইসবই গজরাচ্ছে মনে হয় পুলিশ দুটো ।
এদিকে মহিলাটির স্বযত্নে পরিপাটি করে সাজানো মুখে ঘামের বিন্দু জমতে শুরু করেছে । মাঝে মাঝে রুমাল বের করে মুছে নিচ্ছে চটপট ।
ক্রমশ কমে আসছে যানবাহন । এবারে যেন মরিয়া হয়েই কোনও গাড়ির লিফট চাইবেন মনস্থির করে ফেলেছেন ।
রাত্রি পৌনে এগারোটা প্রায় ।
আশেপাশে মানুষের ভিড়ও বেশ পাতলা হয়ে এসেছে ।
একটা গাঢ় লাল এবং একটা চকচকে কালো গাড়ি একটুখানি দাঁড়িয়েই সাঁ করে বেরিয়ে গেলো । — নাঃ একটাও নিল না ! ক্যাথেড্রিয়াল চার্চের ঢং ঢং ঘন্টা ধ্বনি , কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা। পুলিশ একবার এসে কিছু বলে ঘাড় নেড়ে চলে গেছে ।
— ওইতো সামান্য দূরে একটা ধবধবে সাদা এসি গাড়ি আসছে হেলেদুলে মৃদু মন্দ বাতাসের মতো !
এবারে মহিলাটি যা থাকে কপালে- দানের ঘুঁটি চালার মতো নিজে না গিয়ে
ছেলেটিকে এগিয়ে দিলেন লাইটপোষ্টের সামনেই ব্রেক কষে থেমে যাওয়া গাড়িটার কাছে ।
অটোমেটিক উইন্ডোগ্লাস
খুলে গেলো চিচিং ফাঁকের মতো ।
যেন গোটা এক কালবোশেখী দলা পাকিয়ে আটকে আছে ছেলেটির গলার টাকরার কাছে ! হঠাৎই জ্বলন্ত লাভার টুকরোর মতো , বহুদিনের শেখানো অজীর্ণ বুলির খানিক বমির দমক ছিটকে এলো বাচ্চা ছেলেটির মুখ থেকে — স্যার , আমার মায়ের সঙ্গে একটু বসবেন ?