অমাবস্যার রাত্রে চলাফেরা
অমাবস্যার রাত্রে চলাফেরা করতে গেলে সঙ্গে টর্চ না রেখে উপায় নেই। নেহাত দরকার না থাকলে বিশেষ কেউ বেরোয়ও না।
তেঁতুলিয়া মোড়ের দিক থেকে একটা টর্চের আলো এগিয়ে আসছে এবাড়ির দিকে। আলোটা এদিক-ওদিক ঘুরছে। কোনো চঞ্চল হাত ধরে আছে সেই টর্চ।
দ্বারিকের শোবার ঘরের জানলা দিয়ে ঠিক তার মুখের ওপর এসে পড়ল সেই টর্চের আলো।
দাদা!
দ্বারিক লাফিয়ে উঠল বিছানা থেকে।
ভুতো! তুই এসেছিস!
অন্ধকারের মধ্যে দরজা খুলতে গিয়ে দ্বারিক গুঁতো খেল দু-বার। তারপর দেখল, দরজা খোলাই ছিল। এমনকী সদর দরজাও বন্ধ করা হয়নি। জুতো দপদপিয়ে ভুতো ঢুকে এল তার ঘরের মধ্যে।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে এর মধ্যেই?
এক্ষুনি ডাকছি, মা, মা–
ভুতো হাত তুলে বলল, দাঁড়া, এখন ডাকতে হবে না। তুই এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? বোস।
তুই এতরাত্রে কী করে এলি? এখন তো কোনো বাস নেই! জানিস, বীথি এসেছে।
আমি মল্লিকপুকুর থেকে হেঁটে এলাম। রবির সঙ্গে দেখা করে এলাম, তাই দেরি হল। তোদের খবর কী?
ভালো! জানিস, বীথি এসেছে। এখানেই আছে!
জানি।
দ্বারিক ভুততর হাত থেকে টর্চটা নিয়ে তার মুখে ও শরীরে আলো ফেলল। ভুতোর মুখ ভরতি দাড়ি, চোখে একটা কালো চশমা। এই অন্ধকারে ও চশমা পরে আছে কেন? একটা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি আর পা-জামা পরা, বোম-খোলা, চওড়া বুকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভুতোর স্বাস্থ্য খুব ভালো হয়েছে।
দ্বারিক ভুতোর কাঁধে হাত রাখল। অতিরিক্ত আবেগে তার নিজের শরীর কাঁপছে। কী কথা বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
চশমাটা খোল! তোকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না।
ভুতোর এক চোখ কানা। আর একটা চোখ যেন বেশি জ্বলজ্বল করছে।
এ কী! তোর চোখ।
তুই খবর পাসনি? এ তো মাস ছয়েক আগেই, আগুনের হলকা লেগেছিল…দুটো চোখ যে যায়নি, তাই যথেষ্ট।
ভুতো তোর একটা চোখ নেই…মা দেখলে…ইস বীথি যখন দেখবে…আমিই তোর দিকে। তাকাতে পারছি না।
তুই কী ছেলেমানুষি করছিস, দাদা! বললাম তো একটা চোখ যে আছে, তাই তো যথেষ্ট, আমার কোনো অসুবিধে হয় না..মানুষের অনেক জিনিসই বেশি বেশি থাকে, দুটো কিডনি, দুটো লাঙস, দুটো কান, দুটো চোখ—এর একটা দিয়েও বেশ কাজ চালানো যায়।
কী করে হল?
আগুনের হলকা লেগে…সেসব পরে বলব।
তোর কথা মাকে বলতে পারছিলাম না, আমি ভেবেছিলাম, মাঝে আমি শুনেছিলাম—
এখন তো আমি এসে গেছি, আর কোনো চিন্তা নেই এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভুতো, আমি একা একা আর পারছিলাম না, এরকম সমস্যা…আমি এত কিছু সামলাতে পারি না..দাঁড়া বীথিকে ডাকি, মাকে ডাকি–
এত ব্যস্ত হওয়ার কী আছে! ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক না।
তুই এখন থাকবি তো? আর চলে যাবি না তো!
না, যাব না, এখন ক-দিন ভালো করে খাব-দাব, আর টেনে ঘুমোব।
কেন এতদিন পালিয়েছিলি, কোনো দরকার ছিল না, এখন তো সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দিচ্ছে, সবাই ফিরে আসছে।
সবাইকে ছেড়ে দিচ্ছে? কে বলল তোকে?
ছেড়েই তো দিচ্ছে, আস্তে আস্তে, অন্য স্টেটে কেসের ঝামেলাগুলো মিটে গেলে–
তুই ছাই জানিস! এখনও এত হাজার হাজার ছেলেকে যে ছাড়ছে না বা ছাড়বেও না, সে খবর রাখিস? অনেকের ঘাড়ে মিথ্যে মিথ্যে ক্রিমিনাল কেস চাপিয়ে দিয়েছে, তারা আর পলিটিক্যাল প্রিজনার নয়, তাদের নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
কলকাতা থেকে রবীন আমাকে চিঠি লিখেছে…ওরা একটা গণ কমিটি করে জেলে জেলে ঘুরে তালিকা তৈরি করছে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তালিকা সাবমিট করে।
ভুতো হাসল। সে এখনো বসেনি। তার শরীরে যেন একটা ছটফটে ভাব। তার হাসিটা নিষ্ঠুর ধরনের।
সেই আবেদন-নিবেদনের রাস্তা! মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন, খবরের কাগজে বিবৃতি ছাপিয়ে আবেদন, আবার সব কেঁচে গন্ডুষ। হে:! তোর কাছে সিগারেট আছে, দে একটা সিগারেট দে।
দেখো, ওই বইয়ের র্যাকে। তুই তো আগে সিগারেট খেতিস না ভুতো। দে
শলাই জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে সেই আলোয় ভুতো হ্যারিকেনটা দেখতে পেল। সেটা ধরিয়ে খাটের পাশের টুলটার ওপর রেখে সে দাঁড়াল জানলায় পিঠ দিয়ে। পাঞ্জা খোলা ডান হাতখানা সে আড়াআড়ি ভাবে রাখল বাঁ-বুকে, দু-তিনবার চাপড় মেরে সে বলল, আমি স্বদেশ হালদার, আমি কখনো ধরা দিইনি, পুলিশ আমার একটা চুলও ছুঁতে পারেনি, কোনো শুয়োরের বাচ্চা আমার গায়ে হাত তুলতে পারেনি এ পর্যন্ত! ওই সব আবেদন-নিবেদন আমি গ্রাহ্য করি না। আমি বিশ্বাস করি, জেলখানা ভেঙে ওদের বাইরে নিয়ে আসা উচিত।
দ্বারিক মন দিয়ে শুনল না ভুতোর কথা। সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। বীথির সন্তান যে বাঁচেনি, সে খবর কি ভুত জানে? হয়তো সে নিজের সন্তানকে দেখবে বলেই হঠাৎ আজ ফিরে এসেছে। লজ্জায় সে-কথা বলতে পারছে না।
ভুতো যেন মনের ভাষা পড়ে নিতে শিখেছে। হঠাৎ কথা থামিয়ে প্রসঙ্গ পালটে সে বলল, বীথিকে দেখে তোরা খুব অবাক হয়ে যাসনি? জাত-ফাতের কথা তুলে মা কোনো ঝামেলা করেনি তো?
না, না, মা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিয়েছে, বীথি খুব ভালো মেয়ে।
…কিন্তু তুই বিয়ের সময় কোনো খবর দিলি না..মাকে অন্তত একটা চিঠি লিখলে পারতিস।
ব্যাপারটা কী হয়েছিল জানিস? তুই মানিকবাবুর হারাণের নাত জামাই গল্পটা পড়েছিস? অনেকটা সেইরকম! হঠাৎ পুলিশ এসে পড়ায় আমি আর কোনো উপায় না দেখে বীথির বিছানায় ওর কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লুম, বীথির বাবাও বেমালুম বলে দিলেন আমি ওঁর জামাই, তখন আমার দাড়ি ছিল না…সে গবেটটা আমায় চিনতে পারেনি…আমি যদি আর দু মিনিটও সময় পেতাম…যাই হোক, বীথির বাবা একবার যখন বলে ফেললেন, তখন আমি ভাবলাম, বিয়েটাই করে ফেলা যাক।
বীথি খুব চমৎকার মেয়ে, আমাদের বাড়ির সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে।
জানিস দাদা, আমার মনে হয়, আমার বদলে অন্য কারুর বিয়ে করা উচিত ছিল বীথিকে। ধর, তোর মতন কোনো ঠাণ্ডা মাথার ভালো ছেলেরই উচিত ছিল বীথিকে বিয়ে করা।
যাঃ কী পাগলের মতন কথা বলছিস!
হ্যাঁ রে, তোর সঙ্গে মানাতো বেশি, আমার মতন ছেলেদের বিয়ে করা উচিত নয়, এটা আমি পরে বুঝতে পেরেছি। আমি যদি হঠাৎ মরে যাই, তুই তা হলে বীথিকে…
ভুতো, তুই এবার মার খাবি আমার কাছে। দাদা, তুই বড্ড রোগা হয়ে গেছিস, চেহারাটা খুব খারাপ হয়ে গেছে…
আমি মনের দিক থেকেও অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছি…এতরকম ঝঞ্ঝাট এক-এক সময় মনে হয় জেলের মধ্যেই ভালো ছিলাম।
ধুৎ এবার আমি এসে পড়েছি, আর কোনো চিন্তা নেই। আমি সব ঠিক করে দেব..আমি আবার দল গড়ব, সবাইকে মিলিয়ে একসঙ্গে…নতুন প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে…আসবার পথে আমি রবির সঙ্গে কথা বলে এসেছি।
দ্বারিক চিৎকার করে বলল, রবিকে তুই বিশ্বাস করিস না। রবি তোর নামে যা-তা বলে বেড়াচ্ছে চারদিকে..ও একটা রেনিগেড।
ভুতো হা-হা করে হেসে উঠল। দাদার তুলনায় সে অনেক বেশি বলিষ্ঠ, অসম্ভব তার মনের জোর, কোনো বাধাই সে গ্রাহ্য করে না।
ভুতো ডান পকেটে হাত দিল রুমাল বার করবার জন্য। একসঙ্গে বেরিয়ে এল আট দশটা রুমাল। হাসতে হাসতে সে বাঁ-পকেটে হাত দিয়ে আবার দশ-বারোটা বার করে আনল। সিল্ক বা রেশমের রুমাল, নানান ঝলমলে রঙের। তার দু-পকেট উপচে আরও অসংখ্য রুমাল বেরিয়ে আসছে। ঠিক ম্যাজিশিয়ানদের মতন। ভুতো দু-হাতে রুমালগুলো ঘোরাতে ঘোরাতে জিজ্ঞেস করল, তুই বলনা, তোর আর কী চাই?
দ্বারিক ভাবল, সে কি স্বপ্ন দেখছে? সে চোখ মেলে তাকাল। না, স্বপ্ন নয় তো, ওই তো জানলায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভুতো, ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায়।
দ্বারিক এরপর দ্বিতীয় স্বপ্নটা দেখতে শুরু করল।
ভুতো, আমি ভাবছিলাম, আমি স্বপ্ন দেখছি—তুই আসিসনি…তুই এতদিন দেরি করলি?
আমি সময় নিচ্ছিলাম…আমি আগে এলে, তুই জানিস না, ওরা ঠিক আমায় ধরে তিন চারটে ফলস মার্ডার কেসে ঝুলিয়ে দিত…জানিস না অনেকের নামে ডাকাতি, রেপ চার্জ পর্যন্ত দিয়েছে।
মা, মা, মা।
সবাইকে জাগিয়ে তুলছিস কেন? বাবার কী খবর?
তুই হঠাৎ বাবার সামনে যাসনি…বাবা প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। তোকে হঠাৎ দেখলে কী যে করবেন…ভালোও হয়ে যেতে পারেন, বেড়েও যেতে পারে।
আমি এসে পড়েছি, আমি সব ঠিক করে দেব।
ভুতো, তুই চশমাটা পরে নে…মা প্রথমেই যখন দেখবে তোর একটা চোখ…
মা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। হাতে একটা বাটি। একটুও অবাক হননি মা, যুবতী মেয়ের মতন ঠোঁট টিপে হাসছেন।
মা বললেন, আমি ঠিক জানতাম আজই ভুতো আসবে। আজ ভুতোর জন্মদিন—আমি মুগের ডাল তৈরি করে রেখেছিলাম।
ভুতো ব্যগ্রভাবে বলল, মুগের ডাল? কই দাও, দাও? কতদিন খাইনি।
মায়ের হাত থেকে বাটিটা নিয়ে ভুত এক চুমুকে সবটা খেয়ে নিল। তারপর আঙুল দিয়ে বাটিটা মুছে মুছে মুখে দিতে লাগল খুব তৃপ্তির সঙ্গে।
কী চমৎকার দৃশ্য। দ্বারিকের মন ভরে গেল। ভুতো না থাকলে এই বাড়িটাই নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, লীলাবউদি ঠিকই বলেছিল, তোমার দুই ছেলেই ফিরে আসবে।
ভুতো জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটি কে?
বীথি ঘরে ঢুকে এসেছে। তার দু-চোখে ঘুম জড়ানো। দ্বারিক এবং মা একসঙ্গেই বললেন, এই তো বীথি!
ভুতো বলল, যাঃ, এ কেন বীথি হবে? বীথিকে আমি চিনি না?
দ্বারিক বলল, এ বীথি নয়? তুই কী বলছিস রে?
মা বললেন, আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, এ ভুতোর বউ হতে পারে না।
ভূতো বলল, বীথি তো এত লম্বা নয়, আরও রোগা ছোট্টখাট্টো চেহারা, গায়ের রং-ও আরও ময়লা।
বীথি কোনো কথা বলছে না, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ভুতোর দিকে।
মা বললেন, এই মেয়েটি এসে তোর পরিচয় দিয়ে থাকতে চাইল আমাদের এখানে…আমি তখনই দ্বারিককে বলেছিলাম।
দ্বারিক বলল, মা, তুমি ভুল করছ। বীথি কখনো মিথ্যেকথা বলে না!
মা বললেন, ভুতোর বউকে ভুতো নিজে চিনতে পারবে না? আমারও মন বলছিল…কালই বাপু এ মেয়েকে অন্য কোথাও রেখে আয়। একেই তো সারাগাঁয়ে নানারকম কথা উঠেছে।
ভুতো বলল, দাদা, তুই এ কোন মেয়েকে এনে বাড়িতে রেখেছিস? এ-রকম একটা সুন্দরী মেয়ে
বীথি এবার তীব্রভাবে এক ধরনের উপহাসের হাসি হাসল ভুতোর দিকে চেয়ে।
দ্বারিকের দারুণ অস্বস্তি লাগছে, বুকের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসার মতন। ভুতো বলছিল, ও সব ঠিক করে দেবে। কিন্তু ও আসামাত্রই তো আর একটা ঝঞ্ঝাট পাকিয়ে উঠল। এতদিন সকলের কাছে যাকে ভুতোর স্ত্রী বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে…
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল দ্বারিকের। ডুবন্ত মানুষ যেন পেয়ে গেল একটা ভাসমান কাঠ। উত্তেজিতভাবে সে বলল, তোর বন্ধু আশিস আর মলয়..ওরা এসেছিল, ওরা বীথিকে চেনে, তোর বউ হিসেবে, ওর ডেলিভারির সময়…
মা বললেন, মেয়েটি আবার এসেছিল পোয়াতি অবস্থায়।
শব্দ হওয়ার কথা নয়, তবু যেন ফট করে একটা শব্দ হল, আর ভুতোর বন্ধ চোখটা খুলে গেল। সে তা হলে কানা হয়নি, ইচ্ছে করে বুজে ছিল এক চোখ।
দ্বারিকের কাছে মুখ ঝুঁকিয়ে এনে সে বলল, শোন দাদা, তোর নিশ্চয়ই কোনো মাথার গোলমাল হয়েছে…আমি বলছি, তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি যাকে বিয়ে করেছিলাম, সেই বীথি মারা গেছে আজ থেকে ঠিক আট মাস আগে…আমি তখন অ্যাবসকণ্ড করে থাকলেও ঠিক হাজির হয়েছিলাম শ্মশানে, আমি নিজের চোখে দেখেছি, আমি তার ডেডবডির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম বলেই আমার চোখে আগুনের ঝলসা লাগে, বেশিক্ষণ খুলে রাখতে পারি না চোখটা।
দ্বারিক চেঁচিয়ে উঠল, আমি আর নিশ্বাস নিতে পারছি না আমার বুকে কষ্ট হচ্ছে, মা, একটু জল, শিগগির শিগগির…মরে গেলাম মরে গেলাম…
দ্বারিক আবার চোখ মেলল। মুখ-চোখ একেবারে ভেজা। সে ভাবল, সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। শরীর আবার সুস্থ লাগছে।
মা আর বীথি বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। ভুত একা রয়েছে তার পাশে। ভুতোর কাঁধে ঝোলানো মস্তবড়ো ব্যাগটা দ্বারিক আগে লক্ষ করেনি।
ভুতো ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রাখতেই ঠং করে শব্দ হল।
দ্বারিক জিজ্ঞেস করল, ওর মধ্যে কী আছে রে?
দেখবি?
ভুতো দুটো ঝকঝকে নতুন রিভলবার বার করল সেই ব্যাগ খুলে।
এ কী, তুই এগুলো সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিস? আবার যদি বাড়ি সার্চ হয়! এখন এসব লুকিয়ে ফেলাই ভালো। রবি বলছিল, তুই নাকি আর্মস বিক্রি করবার চেষ্টা করেছিলি…
রবিটা একটা পাঁঠা। আরও কী কী এনেছি, দেখবি? এই দেখ, এক ডজন ডিনামাইট স্টিক… তিন-শো রাউণ্ড গুলি… হ্যাণ্ড গ্রেনেড…
তুই এসব কেন এনেছিস, ভুতো? এসব দিয়ে এখন কী হবে?
তুই ভয় পেয়ে গেলি নাকি, দাদা? আরও দেখবি? আমার কাছে একটা ডিসম্যানটল করা এল এম জি আছে… বাংলাদেশে থেকে জোগাড় করে এনেছি, এক্ষুনি ফিট করতে পারি।
সাংঘাতিক কান্ড করেছিস। এসব আজই পুঁতে ফেলতে হবে মাটির নীচে।
-–কক্ষনো না! আমি দল গড়ব আবার। চটপট কাজ শুরু করে দিতে হবে, এবার প্রথম থেকেই ডাইরেক্ট অ্যাকশন, আমরা ব্রিজ উড়িয়ে দেব, রেললাইন উপড়ে ফেলব, শ্রেণিশত্রুদের কোনোক্রমেই ক্ষমা করব না…অবিনাশদাদের দল যদি বাধা দিতে আসে একেবারে খতম করে দেব।
না, না! ভুতো তুই ভুল করছিস…আগে দরকার জনসংযোগ…সাধারণ মানুষদের বোঝাতে হবে..সাধারণ মানুষ এখনও…আমাদের দেশে খুনোখুনি পছন্দ করে না,—কতরকম সংস্কার…ওদের বাদ দিয়ে এগোনো যাবে না…ওদের সঙ্গে নিতে হবে।
তুই কিচ্ছু বুঝিস না…সারাদেশ এখন আগ্নেয়গিরির মতন ফুটছে, এখন দরকার বড়োরকমের একটা আঘাত…আমাদের এই মোরামডাঙা থেকেই শুরু হবে লং মার্চ…তুই শুয়ে আছিস কেন? ওঠ, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে।
তুই কি পাগল হয়েছিস ভুতো? বোস চুপ করে, কথা বলি আগে।
ভুতো দু-হাত দিয়ে দ্বারিকের ক্ষীণ শরীরটা টেনে তুলল বিছানা থেকে। হিংস্র গলায় বলল তুই ভয়ে পেছিয়ে যেতে চাস? তাহলে থাক তুই, আমি একাই চললাম।
না, না, ভুতো, যাসনি, দাঁড়া ভুতো, মা মা ওঃ ওঃ।
মা ছুটে এসেছেন ঘুম ভেঙে। শেষরাতের ক্ষীণ জ্যোৎস্না এসে পড়েছে দ্বারিকের বিছানায়। দ্বারিক দৃষ্টিহীনের মতো চোখ মেলে আছে।
মা বললেন, কী হয়েছে? ভয় পেয়েছিস? এই দ্বারিক, কথা বলছিস না কেন? কী
হয়েছে?
মায়ের মুখটা ভালো করে দেখা যায় না। বুকের ওপর মায়ের স্পর্শ অনুভব করে দ্বারিক খানিকটা ধাতস্থ হল। ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল তা হলে। কিন্তু হ্যারিকেন জ্বালা হয়নি। ভুতো আসেনি। আসবেই বা কী করে?
মা বললেন, বুকের ওপর হাত রেখে শুয়েছিলি, কতদিন বারন করেছি, ওরকমভাবে শুলে ওলায় ধরে। পাশ ফিরে শো। জল খাবি? খুব ভয় পেয়েছিলি বুঝি?
দ্বারিক ক্লান্তভাবে নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, মা, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কোনো মানে হয় না অবশ্য–।