Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাগলা সাহেবের কবর || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 8

পাগলা সাহেবের কবর || Shirshendu Mukhopadhyay

ওদিকে কুসুমকুঞ্জের একতলার

ওদিকে কুসুমকুঞ্জের একতলার বাইরের ঘরে পটল দাস ভয়ে আর শীতে গায়ের আলোয়ানটা ভাল করে জড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিল। তাকে ঘিরে মোট ছ’জন লোক। আর-একটা লোক গেছে হরিকে ধরে আনতে। এই ছ’জনের মধ্যে তিনজনের অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। একজনের বাঁ চোখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে। একটা ভেজা রুমাল চোখে চাপা দিয়ে সে গোঙানির শব্দ করছে বসে বসে। আর একজন ডান হাতখানা ভেঙেছে। গদাধর তার হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধছে আর লোকটা যাচ্ছেতাই ভাষায় পটল দাসের উদ্দেশে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে নাগাড়ে। তৃতীয় জনের কী হয়েছে বলা মুশকিল। তবে সে লম্বা হয়ে পড়ে আছে একধারে, চেতনা নেই বললেই হয়। পটল দাসের যতদূর মনে আছে, এই লোকটার মাথায় সে একটু তবলা বাজিয়ে দিয়েছিল। তবে পটল দাসের গাঁটওয়ালা বুড়ো আঙুলগুলোর বোল আলাদা, মাথার মধ্যে কত কী গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠেছে কে জানে।

পটল হিসেব কষে দেখল, এখন বলতে গেলে তার পাহারাদার দু’জন হরিকে ধরে আনতে গেছে। তাকে বাদ দিলে এদের দলের আরও দু’জন আছে বটে, তবে তারা এখন বাইরের দিকটা পাহারা দিচ্ছে।

পটল দাসকে কাঁপতে দেখে বেঁটেটা বলল, “খুব শীত করছে বুঝি?”

“আজ্ঞে। খুব।”

“একটু পরেই গা গরম হয়ে যাবে। চিন্তা কোরো না।”

“আজ্ঞে তা বেশ বুঝতে পারছি। তবে খামোখাই পাপের ভাগী হচ্ছেন, আমি তেমন কিছু জানি না।”

“আমরা মেলা পাপের ভাগী হয়েই আছি। আর দু’একটা পাপ বাড়লে তেমন ক্ষতি হবে না। তবে যদি পেট খোলসা করে সব বলে দাও তা হলে আর পাপটা আমাদের করতে হয় না।”

“তা বটে। কিন্তু কথার আছেই বা কী! ওই হরি ছোঁড়ার বড় গল্প শোনার নেশা। কেবল আমাকে গল্প বলার জন্য যন্ত্রণা করে। তাই বানিয়ে বানিয়ে কী সব যেন বলছিলুম। আর সেই কথাই গদাধরভায়া বাইরে থেকে শুনে ভাবলে আমি বোধহয় গোপন কথা সব ফাঁস করছি।”

“তা আমাদের সেই বানানো গল্পটাই বলল না। শুনি একটু।”

“শুনবেন?” বলে গলা-খাঁকারি দিয়ে পটল দাস কী যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ কী একটু শুনে চমকে উঠে বলল, “ও রাবা, শব্দ কিসের?”

শব্দটা এবার সকলেই শুনতে পেল। খুব কাছেপিঠে, একেবারে ঘরের মধ্যেই একট চাপা ‘ফোঁস!’

এ শব্দ সকলেরই চেনা। মোমের আলোয় মস্ত ঘরটার সিকিভাগও দেখা যাচ্ছে না। আসবাবপত্র, আনাচকানাচ সবই অন্ধকারে ডুবে আছে। এর মধ্যে সাপটা কোথায় গা-ঢাকা দিয়ে আছে কে জানে!

বেঁটে লোকটা বিদ্যুৎ-গতিতে ভোজালিটা বের করে বলে উঠল, “সাপ!”

যে লোকটা এতক্ষণ মূর্ছা গিয়ে পড়েছিল, সেই সবার আগে লাফিয়ে উঠে বলল, “বাপ রে বাপ!”।

চোখের পলকে বাকিরাও গায়ের ব্যথা ভুলে উঠে দাঁড়াল। এবার বেশ জোরালো শব্দ হল, “ফোঁস! ফোঁস! ফোঁস!” গায়ের আলোয়ানটা ফেলে দিয়ে পটল দাস লাফিয়ে উঠে বলল, “ওরে বাবা রে! গেছি রে! আলোয়ানের মধ্যে ঢুকেছে রে বাপ!”

মুহূর্তে একটা হট্টগোল পাকিয়ে উঠল। ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি।

পটল দাস আলোয়ানটা তুলে ঝাড়া দিয়ে বলে উঠল, “ওই যে, ওই যে!”

সঙ্গে-সঙ্গে সাপের তীব্র শিসে ঘর ভরে গেল। বেঁটে আর তার দলবল পড়ি-কি-মরি করে ছুটল বারান্দায়।

পটল দাস খুবই ধীরস্থির ভঙ্গিতে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে হুড়কো তুলে দিল। মোমটা এক ছুঁয়ে নিবিয়ে দিয়ে সে অন্য পাশে ঘরের আর একটা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে অন্ধকারেই হাতড়ে একদম তলার চৌকাঠে খুব ছোট্ট একটা পেরেকের মতো বস্তুতে চাপ দিয়ে দরজাটা ঠেলল। খুব সামান্য একটু ফাঁক হল পাল্লা দুটো। পটল দাস সেই ফাঁকের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে ভিতরে খুব সরু একটা ঝুলন্ত সুতোয় টান দিতেই পাল্লা সম্পূর্ণ খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে পাল্লাটা বন্ধ করে সুতো ফের টেনে দিল পটল।

ওপাশে তখন ধুন্ধুমার ধাক্কা পড়ছে বাইরের দরজায়। চালাকিটা বোধহয় এতক্ষণে ধরতে পেরে গেছে বাছারা। বেচারাদের জন্য একটু দুঃখও হচ্ছিল পটলের। দুধের বাছারা, সবে এই লাইনে এসেছে, এখনও তেমন বুদ্ধি পাকেনি, কান তৈরি হয়নি, চোখের নজর জোরালো হয়নি। ওরা কি আর এইসব টোটকা চালাকি ধরতে শিখেছে। সাপের শিস শুনে বাছাদের ধাত ছাড়বার জোগাড়। পটলের ভারী ইচ্ছে করছিল, ওদের কোলের কাছে বসিয়ে আদর করে সব শিখিয়ে দেয়। সাপের ডাক, বাঘের ডাক, শেয়ালের ডাক, ঝিঁঝির শব্দ। দুনিয়ায় এখনও কত কী শেখার আছে। এদেরও একটু শেখাতে ইচ্ছে করছিল তার। তবে তার ঢের সময় পাওয়া যাবে। আগে একবার হরি ছোঁড়াটার তল্লাশ নিতে হয়। ওদিকে খিচুড়িটাও বোধহয় ঠাণ্ডা মেরে গেল। কী আর করা!

পটল দাস কোনওদিন টর্চ ব্যবহার করে না। ওসবের দরকারও হয় না। সাহেবপাড়ার বাড়িগুলোর অন্ধিসন্ধি তার জানা। সে অন্ধকারেই ঘরটা পেরিয়ে পাশের দরদালানের দিককার দরজা আবার কৌশল করে খুলে ফেলল। তারপর দরদালান পার হয়ে একটা সরুমতো প্যাসেজে ঢুকে সে দাঁড়াল। প্যাসেজটা আড়াই-তিন ফুটের বেশি চওড়া নয়।

একটু দাঁড়িয়ে দম নিয়ে নিল পটল। এবার কাজটা শক্ত। পটল দাসের কাছে শক্ত, কিন্তু অন্যদের কাছে অসম্ভব।

পটল দাস দু’দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়াল দুটো ধরল। তারপর স্রেফ হাত আর পায়ের ভর-এ তরতর করে উঠে যেতে লাগল ওপর দিকে। হাতের ভর দিয়ে পা ছাড়ে, পায়ে ভর রেখে হাত ছাড়ে। চাড় দিয়ে একবারে হাতখানেক করে ওপরে উঠে যায়।

প্রায় বারো-চোদ্দ ফুট উঁচুতে একটা অয়েলপেন্টিং টাঙানো। পটল দাস সেটার কাছ বরাবর পৌঁছে ছবিটা সরিয়ে ছোট্ট একটা গর্তের মধ্যে টিকটিকির মত সেঁধিয়ে গিয়ে ছবিটা ফের টেনে দিল।

বয়সটা বেশ হয়েছে। এইটুকু উঠতেই আজকাল বেশ হাঁফ ধরে যায়। আর হুডযুদ্বুও তো আজ কম হয়নি। ব্যাটারা কম ডলাইমলাই করেছে নাকি তাকে? তবে কিনা পাকা হাড়, ছোঁড়াগুলোর মারের হাতও তেমন তৈরি হয়নি, তাই এখনও পটল দাস খাড়া আছে। ভগবানেরই লীলা!

পটল গর্তে ঢুকে একটু জিরোল।

চোখ বুজে বুক ভরে দম নিয়ে আর ছেড়ে পটল দাস আপনমনেই একটু হাসল। হরি ছোঁড়াকে সুড়ঙ্গের পথ বাতলানো ঠিক হয়নি। ছোঁড়াটা নির্ঘাত ছবি সরিয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকে বেমক্কা ঘুরতে ঘুরতে এবাড়িতে চলে এসেছিল।

পটল সময়মতো ‘প্যালা! প্যালা!’ করে না চেঁচালে একটা কেলেঙ্কারি হতে পারত। ছোঁড়াটা যে ছবির পিছনে দাঁড়িয়ে ঘরের সব কাণ্ড দেখছিল তাতে পটলের সন্দেহ নেই। ঘাবড়ে গিয়ে শব্দসাড়া দিয়ে ফেলতে পারত, নাকে ধুলো ঢুকে হেঁচে ফেলতে পারত, বা কেসেই ফেলল হয়তো। এমনকী দীর্ঘশ্বাস ফেলাটাও অসম্ভব ছিল না। পটল চেঁচানোয় ছোঁড়াটা বুদ্ধি করে পালিয়েছে। ছোঁড়া ধরা পড়লে সুড়ঙ্গের কথাটা জানাজানি হয়ে যেত।

খানিকটা জিরিয়ে পটল উঠল। আরও একটু জিরোলে হত, কিন্তু তার কি উপায় আছে! খিচুড়িটা ঠাণ্ডা মেরে গেলেই গোবর। ঠাণ্ডা খিচুড়ি পটল দাস দু’চোখে দেখতে পারে না। আর প্যালার মা’ও তেমন ভালমানুষের মেয়ে নয় যে, ঠাণ্ডা খিচুড়ি ফের গরম করতে উনুন ধরাবে।

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পটল দাস দেওয়ালের একটা ঘুলঘুলিতে চোখ রাখল। একরত্তি ঘুলঘুলি। ছানিপড়া চোখে বাইরের কুয়াশা আর অন্ধকারে তেমন কিছু ঠাহরও হয় না। এবার ঠাণ্ডাটাও পড়েছে বাপ। হাড় একেবারে ফালি হয়ে গেল।

গ্রিন ভ্যালির দিকটায় একটা টর্চের আলো দেখা গেল না? হ্যাঁ, তাই বটে। জ্বলছে, নিবছে। একটা লম্বাপানা লোক কী একটা বস্তু ঘাড়ে করে যেন ভাঙা পাঁচিলটা বেয়ে নামল।

সর্বনাশ! হরি ছোঁড়াটা ধরাই পড়ল নাকি? কেলেঙ্কারি আর কাকে বলে! আনাড়ি ছেলেমানুষ, একটা-দুটো কোঁতকা খেলেই ভ্যাড়ভ্যাড় করে সব বলে দেবে।

নাঃ, কপালটাই খারাপ। পটল দাস আপনমনেই মাথা নাড়ল।

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা গিয়ে একটা বড় ঘুলঘুলির সামনে থামল। কোনওক্রমে একটা বড় বেড়াল গলে যেতে পারে এমন একটা ফোকর।

‘তা পটল দাস কুকুর বেড়ালের বেশিই বা কী? পটল খুব অভিমানভরে কথাটা বিড়বিড় করে বলল। তারপর দমটা ছেড়ে শরীরটা নরম করে পটল দাস সেই ঘুলঘুলি দিয়ে ঠিক একটা বেড়ালের মতোই গলে গেল। চোদ্দ ফুট নীচে জমি। তা হোক। পটল দাস হাওয়ায় ভর দিয়ে পাখির মতোই নেমে এল নীচে।

লম্বা লোকটা হরিকে কাঁধে নিয়ে অর্ধেক বাগান পেরিয়ে চলে এসেছে। আর দেরি করাটা ঠিক হবে না।

পটল দাস জোর কদমে কোনাকুনি গিয়ে লোকটার একখানা হাত ধরে ফেলল। তারপর অমায়িক গলায় বলল, “দেশলাই আছে বাপু তোমার কাছে? একটা বিড়ি খাব!”

লোকটা পটলকে দেখে এত অবাক হল যে তার কাঁধ থেকে হরি গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে, ধপাস করে।

“তুই! তোকে কে ছেড়েছে?”

পটল একগাল হেসে বলল, “ছাড়বে কী গো? ধরল কখন? আর ধরে হবেটাই বা কী? আমার পেটে যে কথা থাকে না তা সবাই জানে। দুধের বাছারা সব কী যেন খুঁজছে, কবর না কী, ছাইমাটি। তা বাপু, আমার কবরটবর শ্মশানটশানে বড় ভয়। আমি ওসব জানিও না, চিনিও না। তা বাপু, আছে নাকি দেশলাই?”

লোকটার বিস্ময় কেটে এবার হিংস্র রাগ উঠল। বলল, “তোর অনেক চালাকি দেখেছি। ফের কোনও চালাকি করেই বেরিয়ে এসেছিস! কিন্তু এবার তোর খেলা শেষ।”

এই বলে লোকটা তার প্রকাণ্ড দুটো হাতে পটল দাসকে লৌহ-ভীম চূর্ণ করার মতো শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরতে গেল।

পটল একটু সরে দাঁড়াল শুধু।

লোকটা দুহাতে জাপটে ধরতে গিয়ে খানিকটা বাতাস ছাড়া আর কিছু পেল না। কিন্তু এবার আর অবাক হওয়ার অবকাশটুকুও তাকে দিল না পটল। হাত বাড়িয়ে তার গাঁটওলা আঙুল দিয়ে খুব মৃদু একটু তবলা বাজিয়ে দিল তার মাথায়।

লোকটা হাঁ করা অবস্থায় মাটিতে পড়ে গেল দড়াম করে। পড়ে আর নড়ল না।

পটল অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকা লোকটার দিকে চেয়ে ভারী বিরক্তির

গলায় বলল, “দ্যাখো কাণ্ড, একেবারে ফুলের ঘায়ে মূর্ছা গেল! এই বুড়ো আঙুলে কি আর সেই ক্ষমতা আছে রে বাপ, তবু এইটুকুই সইতে পারলি না! ছ্যা ছ্যা। তোরা কী রে?”

লোকটাকে ছেড়ে পটল এবার হরির দিকে তাকাল। কাঁধ থেকে পড়েই হোক, আর হিম লেগেই হোক, হরির জ্ঞান ফিরে এসেছে। ডোম্বলের মতো চোখ পিটপিট করে চাইছিল। পটলকে দেখে উঠে বসে বলল, “ওঃ, মাথাটা ভীষণ ঝিমঝিম করছে।”

“মাথাটা যে এখনও ঘাড়ের ওপর আছে তাই ঢের। কে তোকে সুড়ঙ্গে ঢুকতে বলেছিল শুনি!”

মুখে হাত বোলাতে বোলাতে হরি একটু অবাক হয়ে পটল দাসের দিকে চেয়ে বলল, “ওরা তোমাকে ছেড়ে দিল যে বড়।”

“ছেড়ে দেবে না তো কী? ভাল লোকেদের ওইটেই সুবিধে, ঘোর পাপীরাও তাদের খাতির করে। নে, এখন ওঠ। এ-জায়গাটা এবার তোকে ছাড়তে হচ্ছে।”

“কোথায় যাব?”

পটল দাস মাথা নেড়ে বলল, “সে কি আর ভাল জায়গা রে? প্যালার মা মহাদজ্জাল, উঠতে বসতে কথা শোনাবে। তার ওপর গরিবের ঘর,

সেখানে নুন-পান্তার জোগাড়ই ভাল করে হয় না। কিন্তু এখানে তো আর টিকতে পারবি না। গ্রিন ভ্যালি বেশ বিপদের জায়গা হয়ে পড়েছে।”

হরি উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “কিন্তু এই লোকটা সুড়ঙ্গের কথা জেনে ফেলেছে। একে ফেলে গেলে সব ফাঁস করে দেবে।”

পটল খিঁচিয়ে উঠে বলল, “খুব কেরানি দেখিয়েছ। পাজি ছোঁড়া কোথাকার! তোর জন্যই তো সব ফাঁস হল। এখন কী করা যাবে, এ তো মহা মুশকিল হল।”

হরি লজ্জিত হয়ে বলল, “কিন্তু এ-লোকটার একটা ব্যবস্থা না করে কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। আমি বলি কি, একে হাত-পা বেঁধে সুড়ঙ্গের মধ্যে ভরে রাখলে কেমন হয়।”

“মরে যাবে। শেষে মানুষ খুনের মামলায় পড়বি।”

“তা বটে। তা হলে?”

পটল দাস কিছুক্ষণ মাথা চুলকোতে চুলকোতে ভাবল। তারপর বলল, “খিদেটাও পেয়েছে বেজায়। ওদিকে খিচুড়িটা এতক্ষণে ঠাণ্ডা জল হয়ে গেল। তোকে বলেই বলছি। কথাটা পাঁচকান করিস না।”

কৌতূহলী হয়ে হরি বলল, “কী কথা পটলদা?”

পটল গলাটা নামিয়ে বলল, “ঠাণ্ডা খিচুড়ি কখনও খাস না। ঠাণ্ডা হলে খিচুড়িতে আর গোবরে তফাত নেই।”

“কিন্তু আমি তো বাসী খিচুড়ি খেতে খুব ভালবাসি।”

“সে আমিও বাসি।”

“তা হলে?”

“সেইটেই তো হয়েছে মুশকিল। বুড়ো বয়সে কী যে ভালবাসি আর কী যে ভালবাসি না, সেইটেই ঠাহর পাই না। এই যে এই লম্বা হয়ে পড়ে আরামে জিরেন নিচ্ছে লোকটা, একে নিয়েই বা কী করা যায় কিছু মাথায় খেলছে না। বুড়ো হলে মাথাটারও বয়স বাড়ে কিনা। আপাতত একে চব্বিশ ঘণ্টার মতো ঘুম পাড়িয়ে রাখি। তারপর দেখা যাবে।”

বলে পটল দাস ট্যাঁক থেকে একটা ছোট শিশি বের করল। শিশিটা খুলে লোকটার নাকের কাছে ধরল একটু। ফের ছিপি বন্ধ করে ট্যাঁকে রেখে বলল, “এবার চলল, ওই ঝোঁপটার মধ্যে ঠেসে দিই লোকটাকে।”

হরি চোখ গোল করে কাণ্ডটা দেখছিল। বলল, “ওটা কী শোঁকালে?”

“এও এক টোটকা রে বাপ। চব্বিশ ঘণ্টা টানা ঘুমাবে এখন বাছাধন। গায়ের ওপর দিয়ে মোষে হেঁটে গেলেও টের পাবে না। একটু বেশি শুকিয়ে দিলেই অক্কা। এক নাগা সাধু দিয়েছিল। কিন্তু আর দেরি করা ঠিক হবে না। এদের আসল সর্দার এসে পড়তে দেরি নেই। সে এদের মতো আনাড়ি নয়।”

দু’জনে মিলে লোকটাকে ধরাধরি করে একটা ঘন ঝোঁপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তারপর হরি জিজ্ঞেস করল, “আসল সর্দারটি আবার কে?”

“তা আমি কী জানি।”

“এই যে বললে, সে আনাড়ি নয়। তার মানে তাকে তুমি চেনো।”

“ফুলকপির পোড়ের ভাজা দিয়ে খিচুড়ি তোমার কেমন লাগে? সঙ্গে যদি বেশ মচমচে আলুর চপও থাকে?”

“ভালই। কিন্তু আমার ঘরের সুড়ঙ্গের গর্তটা খোলা রয়েছে সে খেয়াল আছে? আর এই যে লোকটাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখলে, এর স্যাঙাতটা কি একে খুঁজতে আমার ঘরে গিয়ে হানা দেবে না? সুড়ঙ্গটা তো হাঁহাঁ করছে।”

পটল দাস নির্বিকার মুখে বলল, “ও কি আর লুকনো যাবে রে ভাই? যে সুড়ঙ্গের এতগুলো মুখ চারদিকে ছড়ানো রয়েছে তা কি আর বেশিক্ষণ লুকনো যায়? আর এরাও তো ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। খুঁজে বের করতই।”

“তা হলে কী হবে?”

“কী আর হবে? সুড়ঙ্গে আমি নিত্যিদিন ঘুরে বেড়াই। কিছুই নেই। ওরা যদি সুড়ঙ্গে গোলকধাঁধায় ঘুরে মরতে চায় তো মরুকগে। তাতে বরং আমাদের খানিকটা সময় বাঁচবে। খিচুড়িটাকে আর ঠাণ্ডা হতে দেওয়া ঠিক হবে না।”

হরি একটু চিন্তিতভাবে বলল, “সে অবশ্য ঠিক কথা। গোলঘরের সেই লোকটাও দেখলাম সুড়ঙ্গটা বেশ চেনে। আমি জিজ্ঞেস করতেই পথ দেখিয়ে দিল।”

পটল দাস একটা হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করল হঠাৎ। তারপর চাপা গর্জনের মতো স্বরে বলল, “কী বললে? গোলঘর!”

হরি মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। কুয়োর মতো গোল আর অনেকটা গভীর। নীল আলো জ্বলছিল ঘরে। একটা কাঠের বাক্স…”

কথা শেষ করার আগেই তার মুখে একটা থাবড়া এসে পড়ল। পটল দাস হিংস্র একটা গর্জন ছেড়ে বলল, “চোপ!”

হরি কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল পটলের এই আকস্মিক আচরণে। থাবড়ায় তার ঠোঁট কেটে রক্তের নোনা স্বাদ ঠেকছিল জিভে। সে অবাক হয়ে বলল, “ওরকম করছ কেন?”

পটল দাসের চেহারাটা অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছিল হরি। চোখ দুটোয় জ্বলজ্বলে আগুন। খুনির গলায় সে বলল, “মিথ্যে কথা। তুমি বানিয়ে বলছ। গত ত্রিশ বছর আমি সুড়ঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। আনাচকানাচ কিছু বাকি নেই। আমি কখনও ওরকম ঘর দেখতে পাইনি। তুমি পেলে কী ভাবে?”

হরির গা কেমন যেন শিউরে উঠল ভয়ে। শরীরটা হিম। সে আমতা-আমতা করে বলল, “হঠাৎ আমার পা পিছলে গিয়েছিল। পড়ে গড়িয়ে গেলাম অনেকটা ঢালুতে। একটা কাঠের চৌকো দরজায়…”

পটল দাস আচমকাই আবার একটা থাবড়া মারল তার মুখে। তারপর তেমনই হিংস্র গলায় বলল, “তা হলে তোমাকে এখনই নিকেশ করা দরকার। এখনই। নইলে সব ফাঁস হয়ে যাবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে…”

বলতে বলতে দুটো হাত সাঁড়াশির মতো হরির গলা চেপে ধরল।

হরি এত অবাক হয়ে গেল যে, বাধাটুকু পর্যন্ত দিতে পারল না। দমবন্ধ হয়ে চোখ কপালে উঠল তার। কপালে চিনচিন করে ঘাম ফুটে উঠতে লাগল। জিভ বেরিয়ে এল।

মরেই যাচ্ছিল হরি। মনে-মনে সে বুঝতে পারছিল, বাঁচবার আর কোনও আশাই তার নেই। কিন্তু পটল দাস তো মজার লোক। চোর হলেও মানুষটা ভাল। তার সঙ্গে এত ভাব। তবু তাকে পটল দাসের হাতেই মরতে হচ্ছে?

আচমকাই মাটির গভীর থেকে এক গুড়গুড় ধ্বনি উঠে এল। দ্রুত ধাবমান এক ধ্বনি।

নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারকে চমকে দিয়ে এক তেজীয়ান ঘোড়া তীব্র হ্রেষাধ্বনি করে উঠল। তারপরই ঝড়ের গতিতে সাদা একটা ঘোড়া অন্ধকারে বিদ্যুচ্চমকের মতো ছুটে এল তাদের দিকে।

কী যে হল কিছুই বুঝতে পারল না হরি। তার হঠাৎ গলার চাপটা সরে যেতেই সে উবু হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। তারপর কাসতে লাগল। কিছুক্ষণ সে বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো বসে বসেই শুনতে পেল ঘোড়ার পায়ের শব্দ দূর থেকে দূরান্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপর ধীরে-ধীরে ধাতস্থ হয়ে সে চারদিকে চেয়ে দেখল। না, ঘোড়া অদৃশ্য হয়েছে। তারপর পটল দাসও কোথাও নেই। স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে।

কে তাকে বাঁচাল? আবার পাগলা-সাহেব?

হরি উঠে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে এসে ভাঙা পাঁচিল টপকে বাগান পার হয়ে নিজের ঘরে এসে ক্লান্তভাবে বসে পড়ল বিছানায়। মাথার ভিতর বড়ই ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল।

খানিকটা জিরিয়ে সে উঠল। দেওয়ালের গর্তটা বন্ধ করতে হবে। চেয়ার-টেবিল জায়গাতে রাখতে হবে।

ঝুলঝাড়ুনিটাকে নিয়ে ছবিটা সরাতে গিয়ে সে অবাক হয়ে দেখল, ছবিটা নিখুঁতভাবে গর্তটা ঢেকে টাঙানো রয়েছে। তার চেয়ার-টেবিল জায়গামতো সাজিয়ে রাখা। এতক্ষণ উত্তেজনার বশে সে খেয়াল করেনি।

কে করল? কখন করল?

.

শরীরটা বড়ই ক্লান্ত লাগছিল হরির। সে খানিকটা জল খেয়ে শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

সকালে ঘুম ভাঙল ঝুমরির ডাকে। তার জলখাবার নিয়ে এসেছে।

ঝুমরি কথা প্রায় বলেই না। কিন্তু আজ হরি দরজা খুলবার পর ঝুমরি খুব অবাক হয়ে হরির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঘরে ঢুকে থালাটা টেবিলে রেখে তার দিকে ফিরে বলল, “কে তোমার গায়ে হাত দিয়েছে? তার নাম বলো। জগুরাম গিয়ে তার মুণ্ডু ছিঁড়ে আনবে।”

হরি শশব্যস্ত হয়ে বলল, “কেউ মারেনি, আমি পড়ে গিয়েছিলাম।”

“ঝুট বাত। সাচ বোলো, ম্যায় খুদ উস গুণ্ডেকো সিধা বনায়েঙ্গ।” এই বলে ঝুমরি তার আঁচল কোমরে জড়াল। তার চোখমুখ একেবারে ধকধক করছে।

ঝুমরি যে তার জন্য এতটা উতলা হবে, তা হরি স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তবে সে মাথা নেড়ে দৃঢ় গলায় বলল, “আমাকে কেউ মারেনি, বিশ্বাস করো। আমি বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম, তখন একটু চোট লেগেছে মুখে।”

ঝুমরি বিশ্বাস করল কি না কে জানে, তবে চলে গেল। একটু বাদেই জগুরাম এসে ঘরের মাঝখানটায় তার বিশাল চেহারা নিয়ে খাড়া হল। বলল, “ঝুমরি আমাকে খুব বকছে, আমি তোমার দেখভাল ঠিকমতো করছি না বলে। তা কে তোমার দুশমন বলো, তাকে লাঠিপেটা করে দিয়ে আসি।”

হরি জগুরামের ভাবভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল, “তোমাকে ভাবতে হবে না জগুরাম। এখানে আমার কয়েকজন ভাল বন্ধু আছে। কিন্তু একটা কথা। কিছু বদমাশ লোক কুসুমকুঞ্জ আর গ্রিন ভ্যালিতে আনাগোনা করছে। তুমি একটু নজর রেখো।”

“ঠিক আছে।” বলে জগুরাম চলে গেল।

হরি খেয়েদেয়ে স্কুলে গেল আজও। তিনদিন ধরে স্কুলে, রাস্তায়, বাড়িতে বারবার মারধর খেয়ে এবং কাল রাতে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েও সে দমে যায়নি। রহস্য ভেদ করার তীব্র একটা কৌতূহলই তাকে চাঙ্গা রেখেছে।

ফাস্ট পিরিয়ডের পরই বেয়ারা একটা চিরকুট নিয়ে ক্লাসে এল। হেডমাস্টারমশাই হরিবন্ধুকে তাঁর ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন।

দুরুদুরু বুকে হরিবন্ধু বেয়ারার পিছন-পিছন বেরিয়ে এল ক্লাস থেকে।

হেডস্যার যেমন গম্ভীর, তেমনি ব্যক্তিত্ববান রাশভারী মানুষ। আজ তাঁকে একটু বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।

হরি তাঁর অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকবার পর তিনি হরির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি হরিকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে পেল।

কিছুক্ষণ চেয়ে থাকবার পর তিনি খুব নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?”

হরি মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার।”

হেডস্যার কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে খুব ধীরে-ধীরে বললেন, “আমার কর্তব্য প্রত্যেকটি ছাত্রের দিকে নজর রাখা, প্রত্যেকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, প্রত্যেকের উন্নতিসাধনে সাহায্য করা। সবসময়ে আমি তা পেরে উঠি না। তুমি হয়তো জানো, এটা ভাল ছেলেদের স্কুল নয়। রিফর্মেটরি স্কুল হিসেবেই এটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু যতটা করা উচিত, ততটা আমরা পেরে উঠি না। অনেক আজেবাজে ছেলে ছাত্র সেজে এখানে ঢোকে। তারাই নানারকম খারাপ কাজও করে। আমি খবর পেয়েছি, এই স্কুলের কয়েকটা ছেলে তোমার ওপর চড়াও হয়েছিল। তুমি কি তাদের নাম বলতে পারবে?”

হরি মাথা নিচু করে রইল। সহপাঠীরা যত খারাপই হোক, তাদের নাম বলে দেওয়াটা হরি একরকম বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করে।

হেডস্যার মৃদুস্বরে বললেন, “বলতে ভয় পাচ্ছ?”

“ঠিক তা নয় স্যার।”

“বুঝেছি। ইটস এ গুড জেশ্চার। কিন্তু যাদের বাঁচাতে তুমি মহত্ত্ব দেখাচ্ছ তারা বোধহয় তত ভাল নয়। আর-একটা কথা…।”

“বলুন স্যার।”

“এখানে পাগলা-সাহেবের নামে একটা কিংবদন্তি চালু আছে। তুমি কি তা শুনেছ?”

“হ্যাঁ।”

“আমি যদিও ওরকম কিংবদন্তিতে খুব আস্থাবান নই, তবে কোনও সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়াটাও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক নয়। আমি এখানে অনেকদিন আছি, কিন্তু কখনও পাগলা-সাহেবকে দেখিনি। তবে অনেকে দেখেছে বলে শোনা যায়। শুনেছি, তার কবর খুঁজতে মোতিগঞ্জে কিছু পাজি লোক হানা দিয়েছে। সত্যি-মিথ্যে জানি না,…”

হেডস্যারকে কথা শেষ করতে না দিয়েই উত্তেজিত হরি বলে উঠল, “সত্যি স্যার।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ স্যার। আর পাগলা-সাহেবের কিংবদন্তিও সত্যি। আমি নিজে চোখে দেখেছি।”

হেডস্যার অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “খুবই আশ্চর্যের কথা। এবার তোমাকে একটা ছড়া বলি, দ্যাখো তো, কখনও শুনেছ কি না। হেঁটেও নয়, ছুটেও নয়, সাপের মতো। দূরেও নয়, কাছেও নয়, গভীর কত। আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা। আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা।”

হরি মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার, এ-ছড়া কখনও শুনিনি।”

“ছড়াটা খুবই অদ্ভুত এবং মোতিগঞ্জের অনেকেই জানে। ছড়াটা নাকি সাঙ্কেতিক। তবে এই সঙ্কেতের অর্থ আমি কখনও ভেদ করতে পারিনি।

তুমি পাগলা-সাহেবকে দেখেছ শুনেই ছড়াটা তোমাকে বললাম।”

“এ-ছড়ার সঙ্গে কি পাগলা-সাহেবের সম্পর্ক আছে স্যার?” “তাই তো শুনি।”

হরি বিড়বিড় করে ছড়াটা নির্ভুল আওড়াল, “হেঁটেও নয়, ছুটেও নয়, সাপের মতো। দূরেও নয়, কাছেও নয়, গভীর কত। আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা। আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা।”

“বাঃ, একবার শুনেই তোমার মুখস্থ হয়ে গেছে দেখছি! দুখিরামবাবু চিঠিতে জানিয়েছিলেন, তুমি খুব ডাল-হেডেড ছেলে বলে তোমার বাবার ধারণা, কিন্তু তা তো নয়। স্মৃতি এবং গ্রহণক্ষমতা খুব অদ্ভুত জিনিস। মন যেটা চায় সেটা সহজেই শেখা যায়। পড়ার জন্য পড়লে সহজে শেখা যায় না, আবার জানার আগ্রহ নিয়ে পড়লে, টপ করে শেখা হয়ে যায়। তোমার ব্রেন মোটেই খারাপ নয়। শুধু দরকার একটু আগ্রহ।”

এ-কথায় হরি লজ্জায় হেঁটমুণ্ডু হল।

হেডস্যার মৃদু গম্ভীর গলায় বললেন, “ঠিক আছে। এখন যাও। মন দিয়ে পড়াশুনো করবে, নিজের দিকে লক্ষ রাখবে। কোনও সাহায্যের দরকার হলে মাস্টারমশাইদের কাছে বলবে। তোমার আচরণে আমি খুশি হয়েছি।”

হরি আনন্দে ভাসতে ভাসতে ক্লাসে এসে বসল। গোপাল আজও ক্লাসে ছিল না। হরি চোরা চোখে লক্ষ করল, গদাধর, রাজর্ষি, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স কেউই আজ ক্লাসে নেই। না থাকরই কথা। তাদের ক্লাসে দেখলে খুবই অবাক হত হরি। তবে টুবলু এসেছে। পিছনের বেঞ্চ থেকে তাকে একবার হাত তুলে ইশারা করল।

আজ মাস্টারমশাইরাও কে জানে কেন খুবই ভাল ব্যবহার করছিলেন হরির সঙ্গে। ভূগোলস্যার ব্যোমকেশবাবু দুর্দান্ত রাগী মানুষ। তাঁর ক্লাসে হরি হোয়াংহো নদী কোথায় তা বলতে না পারায় ব্যোমকেশবাবু কিন্তু একটুও রাগ করলেন না। শুধু বললেন, “চিনের দুঃখ যেন তোমারও দুঃখের কারণ না হয়, দেখো।”

টিফিনে টুলু আর হরি একসঙ্গে বেরোল বাদাম খেতে। হরি জিজ্ঞেস করল, “গোপাল কেমন আছে টুলু?”

টুবলু মাথা নেড়ে বলল, “ভাল নেই। প্রচণ্ড জ্বর এসেছে আর ভুল বকছে। বারবার তোমার নামও বলছে।”

“আমার নাম করে কী বলছে?”

“ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে-মাঝে বলছে, ‘হরি, ছেড়ো না, তুমিই পারবে।”

“তার মানে কী?”

“প্রলাপের কি মানে থাকে?”

“আর-একটা কথার জবাব দেবে টুলু? এখানকার সবাই পাগলা-সাহেবের কবর নিয়ে এত ভাবে কেন?”

“আমি অত জানি না। তবে যতদূর শুনেছি পাগলা-সাহেবের কবরটা সাধারণ কবর নয়। মাটির তলায় একটা ঘরে তার কফিন রাখা আছে। যদি কেউ সেই ঘরের বাতাস থেকে একটু শ্বাস টেনে নিয়ে আসতে পারে তা হলে তাকে আর পায় কে!”

“কী হবে তার?”

“সে রাজা হয়ে যাবে। মোতিগঞ্জের সকলেই তাই কবরটা খোঁজে। আর কিছু লোক আছে, যারা এ-গল্প বিশ্বাস করে না, কিন্তু তারাও কবরটা খোঁজে ওই ক্রসটার জন্য।”

“তুমি কি সত্যিই পাগলা-সাহেবের গল্প বিশ্বাস করো?”

“করি। কাল তুমিও তো দেখলে।”

হরি মাথা নেড়ে বলল, “এ-পর্যন্ত দু’-দু’বার পাগলা-সাহেব আমাকে বাঁচিয়েছেন। আমি তাঁকে অবিশ্বাস করি না, কিন্তু…”

“কিন্তু কী?”

“থাক সে কথা, পরে হবে। আমি আজ ছুটির পর গোপালকে দেখতে যাব, আমাকে নিয়ে যাবে?”

“নিশ্চয়ই।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress