Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাখির গীত-বিজ্ঞান || Purabi Dutta

পাখির গীত-বিজ্ঞান || Purabi Dutta

পাখির গীত-বিজ্ঞান

বিজ্ঞান মানেই নগ্নতা, আর সবচেয়ে বড়ো– অংকের সত্যতা। তাহলে সুচারু পেলব রোমান্সসুর কোথায়– কোথায় রোমাঞ্চ শিহরণ। বসন্ত পার করেও কুহুরব, ভরা বর্ষায় দর্দুর ধ্বনি, ঝি ঝি ঝিল্লির এক অর্গান রড, অথবা নিদাঘ দুপুরে ঘুঘু ডাক— পতঙ্গ পাখি সব প্রজাতি এককার। কেমন বিচিত্র মধুর মন উদাসীন নানা তরঙ্গ কম্পন । এসব না থাকলে কি মন বিস্তারে– পেখম পেতো, অথচ– বিজ্ঞান চেঁচিয়ে বলবে এর মূল রহস্য শোনো— প্রকটভাবে বিজ্ঞান বুঝিয়ে দেবে, পাখির শীষ বা গান আর কিছু নয়– এ তাদের নির্দিষ্ট ভাষা, জানো এর কারণ? থাক না কারণ । তত্ত্ব কথা জেনে কি লাভ হবে, না জেনেই ত মন থাকে মাধুরী সুরের বশে । কিন্তু এ এক মোহমায়া– বিজ্ঞানই ত বলে দেয় জগৎসংসার টিকে থাকবার গূঢ় রহস্য । অংক বলবে, আগেই বলেছি দুই হলেই তিন তারপর চার তারপর পাঁচ…. আহা থাক থাক, আর নয়। আইন, না , ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স বাঁচাতে হবে ত !!! দুটি কারণে তাদের আপনজনকে ডাক, মাত্র দুটি কারণ, অবশ্য ভয় পেলে বা মনখারাপ হলেও তারা অন্য সুরে ডাকে। প্রেম ব্যতীত কাম কেমন যেন কদর্য কর্দম। কেমন এক কালচে রঙ অথচ মৃত্তিকা দেখো লালচে, কমলা হলদে সবুজ বা মাটি রঙ, মনে রামধনু, গলায় সহস্র সুর। তারপর সেখানেই পাখনা বিস্তার, কতদূর– যতদূর উড়ে চলে।

গোটা বিশ্বে মোট প্রায় আঠারো হাজার প্রজাতির পাখী বিদ্যমান। তাদের রঙ, চলন বলন সব ভিন্ন ভিন্ন। ভিন্ন তাদের চরিত্র, কিন্তু এক জায়গায় তারা সব এক, তাদের ঘরবন্ধন, সাথী নির্বাচন। ভাষার ব্যবহার মূলত সেখানেই। কতজনকেই বা চিনি।

ছোটবেলার পাখিদের স্মৃতিগুলো ভারী সুন্দর আর অর্বাচীন ত বটেই। তাদের ডাক তখন গীত, বা বোল শুধু মানুষদের আকৃষ্টের জন্য যেন। আমার জন্যই তাদের যত কথা আর গান তথা শীষ। অর্থাত, সেই চূড়ান্ত তত্ত্ব–“আমি আছি তাই জগৎ সত্য, আমি নেই ত জগৎ মিথ্যে”।

শীতের সকালে সে ডাকত আমায়—- ” ঠাকুরগোপাল, ওঠো, ওঠো, ওঠো ” মা বলতেন, ঐ ঘুঘু ডাকছে, উঠতে বলছে, উঠে পড়ো। আমার একটু অভিমান হতো মনে মনে, ও তো ছেলেদের ডাকছে, মেয়েদের ত নয়। ভর দুপুরে টিনের চালে বসে ডাকত গম্ভীর সুরে — ” ঘু…..ঘু” ঘুঘু ধরা নাকি খুব কঠিন, সে লোকালয় পছন্দ করে না, মানুষদের এড়িয়ে চলে। প্রবাদ ও এসেছে তাই–‘ ” ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখো নি” , শত্রুকে চরম প্রতিশোধে ” ভিটেতে ওর ঘুঘু চড়াব” ঘুঘুর বাসা ভাঙাও কঠিন, কারণ তাদের বাসা খুঁজে পাওয়াই যায় না। তাই দুষ্ট লোকের কর্মনাশে ” ঘুঘুর বাসা ভাঙা”। ঘুঘু দেখতেও ভারী সুন্দর, কার প্রতি তাদের ঐ ডাকাডাকি, আর সাবধানবাণী? থাক সে কথা, বিজ্ঞান তুমি এর মধ্যে এসো না।

“হলদে পাখি” বা “বেনে বউ” রোজ সকাল থেকে দুপুর অবধি থেকে থেকেই ডেকেই যেতো চিকন কণ্ঠে—
“একটি খোকা হোক”, বা “একটি খুকু হোক”
আবার হঠাৎই বলে উঠত ” ইষ্টিকুটুম”
বেনে বউকে বলা হয় আবার ইষ্টিকুটুম পাখি। কেমন এক বৈবাহিক সম্পর্ক ও সন্তান সন্ততিদের জন্য তার যেন সেই সুরকথা। অথচ তাকে দেখাই যেতো না, বড়ো গাছের কোন সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকত, হঠাৎই স্থান পরিবর্তনে তার উজ্জ্বল হলদে রঙ ঝলসে উঠত। আমার স্থির বিশ্বাস ছিল পাখিটা আমাদের সংসারের জন্যই কথা বলছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? আরও কত পাখি ছিল আমার সাথী, ঝোপঝাড় বনজঙ্গল ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই আশা যেন কিছু অপার্থিব প্রাপ্তির বাসনা—
পাখিরা আমায় ভালবাসত, সক্কলে ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় পর্যবেক্ষণে নজরে রাখত, — “কাঁদা খোচা”, তার ল্যাগবাগারনিস পা টিপে টিপে হাঁটত আর দেখত, ছিল হাঁড়িচাচা, পানকৌরী, কাঠঠোকরা, ট্যা ট্যা করা টিয়া, সাথে চিল ও বায়সকুল আর আর মানুষঘেষা পায়রা, চড়ুই দল।

সকলেই আমায় দেখত, আমিও।

নামটা ভারী সুন্দর, ” সাতভাই চম্পা” একটা ডাক নামও আছে “ছাতারে”। ঝাক বেঁধে উঠোনে নামত কিছু শষ্য ছড়ালে। রঙ ধুসর কিন্ত ছন্দ চমৎকার। এক ঝাক এক সাথে খেয়ে একসাথে উড়ে যেতো। সাত ভাইয়ের সাথে থাকত চম্পা। পক্ষীকুলের কলঙ্ক, এক স্ত্রী ও তার সাত স্বামী, — না তখন জানতাম সাতভাই আর এক বোন চম্পা। সেই জানাই ছিল স্বপ্নঘড়ার মধুস্মৃতি।

কি মন খারাপ না হতো এক শালিক দেখলে— দুটি শালিকের কিচিরমিচির, আর কি ঝগড়া না করতে পারত। এখনও আমায় দরজায় বসে সকালে ঘুম ভাঙায়। থাক সে কথা, কলকাতার পাখি সে হবে পরে। ছোটবেলাতে ফিরে যাই। এক বিঘৎ গান গাইত , দোয়েল– ওমন লম্বা সুরেলা শিষ আর কোন পাখির গলায় শুনি নি। তার দিকে দৃষ্টি নজর দিলেও নেই কোন ভ্রুক্ষেপ বা ভয়……. তার মতো সে বার্তা পাঠিয়েই যেতো দূরের প্রিয়ার কাছে।

বড়ো অনীহা ঘর সংসার করার মেয়ে কোকিলের— কত সুমিষ্ট কুহু রবে না ডেকে যায় চিরকাল, ছোকরা কোকিল, অস্থির হয়ে কুহু রব চড়া রাগের মাত্রারও সীমা ছাড়াত মাঝে মাঝে। মেয়ে কোকিল কোনমতেই কাছে আসত না। সে সুন্দরী , বসন্তের ব্রততী সে, কিন্তু পুষ্পাণ্বিত হতে সে চায় না !!! সন্তান পালনে অনাগ্রহী, চিরকালই তাই, মা দিদিমার ট্রাডিসন, সে নিজেও যে বায়স মাতার কোলে বড়ো হয়েছে।

না থাক, ওসব ত দুষ্টু বিজ্ঞানের কথা। ছোটবেলাতে ভাবতাম কোকিলের কাছে গানের তালিম নেবো। কোকিলকণ্ঠী কথাটিতে একটু যেন অসূয়া অনুভব।

অংকের দৃঢ় সত্যের কাছে আছে ধরা , প্রকৃতি হিসাব সেই কবে আবিষ্কার করেছিলেন বারো শ শতাব্দীতে ইতালীয় গণিতবিদ— “Fibonacci” নামক এক সংখ্যাতত্ত্বের সত্য খেলা, মেলে ধরে আছে ফুলের পাপড়ি হিসাব, বা আকাশপথে হংসবলাকার সংখ্যাতত্ত্ব, ইত্যাদির…..
০,১,১,২, ৩ ,৫ ,৮,১৩,২১,৩৪…..
সন্ধ্যাবেলার আকাশে দেখতে পেতাম সেই সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে কুলায় ফিরে যাচ্ছে ঐ পক্ষীকুল দল।

ছোট্ট সবজে টুনটুনির কথা আর কি বলবো, ভুলতে পারি না, গোলাপ গাছে তার বাটির মতো ছোট্ট বাসা, তাতে ছোট্ট ছোট্ট ঈষৎ নীলচে ডিম আর পাতা সেলাই করা বাড়ির দেয়াল—- অবিকল দরজিপাখিই বটে।

একদিন দেখতে পেলাম বাতাবী লেবুর গাছে বসন্ত শেষে যখন মোহময় বাতাবী ফুলের গন্ধ কমে দেখা দিয়েছে গুটিদানা—একটি পাখির বাসা— ছোট্ট পাকাপোক্ত ঘরে, দরজা বিহীন, এক রহস্য—- ফুটোতে চোখ রেখে দেখি, ছোট্ট ছোট্ট ডিম, কি সুন্দর। অদূরে গাছের ডালে বুলবুলি পাখি দম্পতি নিঃশব্দে আমাকে নজরে রেখেছে, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে— একদিন ডিম ফুটে বাচ্চা হলো, দিনগতে ঠিক বড়ো হতে লাগল, তারপর—— নির্জন ভরদুপুরে বুলবুলির সুমিষ্ট গীত নয়, এক অন্য সুরের আকুতি, দেখতে পেলাম, ছোট্ট ছোট্ট বুলবুলি ছানাদের রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন দেহ উঠোনে, আর আছে এক দুষ্টু কাক।
কিছু দূরে, না— বুলবুলির সুমধুর গীত নয় !!!

ছানাদের মা -বাবার বেদনার প্রতিবাদের আর্তনাদ, অসহায়তার কান্নায় আকুল– আমার চোখের বন্যায় শীতল নয়, উষ্ণ জল। সময় যায় ঐ নিষ্ঠুর অংকের খেলায়। বারোবছরের আমি বারান্দার সিঁড়িতে বসে স্তব্ধ , মৃত্যু শোকের সত্যতায় !!! আর সারাদিন মূকবধির হয়ে বুলবুলি দম্পতি বসে রইল গাছের ডালে। ব্যস্ … শোক ত শেষ হয় ঐ একই অংকের নিয়মের খোলে। সব শেষ হয়, হয় না শেষ শুধু , সময়। তাহলে একই প্রশ্নের ধাঁধা রইল মনে— মানুষের মনোরঞ্জনের জন্যই কি এতো সম্ভার এতো বিহঙ্গ গীত-কথন— না, শুধুই জগৎ সৃষ্টি স্থিতি লয়ের ইতিকর্তব্য-পালন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress