Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

এই নিয়ে পর পর চার সপ্তাহ হল। একমাস। বাজ একটি সপ্তাহান্তেও আসেনি। ওদের সপ্তাহে সপ্তাহে মাইনে হয়। নিজে যখন আসতে পারেনি নীলকমলকে বলে দিয়েছে অথবা সিউড়ি বা দুবরাজপুর বা কীর্ণাহার থেকে কারোকে না কারোকে দিয়ে সংসার-খরচের টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গত তিনসপ্তাহে টাকাও পাঠায়নি। গতবুধবারে মাত্র তিন-শো টাকা পাঠিয়েছিল একজন ড্রাইভারের হাতে। একটি চিঠিও পাঠিয়েছিল। তাও সতেরো-আঠারো দিন হয়ে গেছে। চিঠিটা যেন আর এক হেঁয়ালি। তবে চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই সল্লির মনটা শান্ত হয়েছিল অনেকটা। মিছিমিছি কীসব দুশ্চিন্তা করছিল এতদিন! কিন্তু সেই হেঁয়ালি হেঁয়ালি চিঠির প্রলেপও আর এখন তাকে শান্ত করতে পারছে না। বাইরে যেমন গরম, তার ভেতরেও।

বাজ লিখেছিলঃ

সল্লি,

আমি খুবই লজ্জিত।

বিশেষ কারণে টাকা পাঠাতে পারছি না। জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে খরচ চালিয়ে নাও। আগামী সপ্তাহ থেকে নিয়মিত পাঠায় যাতে, তোমার ও পিপির কোনো কষ্ট না হয়।

বেশ কয়েকমাস আমার পক্ষে কলকাতাতে যাওয়া সম্ভব নয়। নতুন পাইপ লাইন বসছে। আরও একটি আমেরিকান কোম্পানি আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। আমাদের কোম্পানিও তো মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি। অন্য কোম্পানিটি যেন, দরজাতে ঘোড়া বেঁধে রেখেছে। কত তাড়াতাড়ি ‘ফুরোনে’ কাজ সেরে সবচেয়ে বেশি প্রফিট করে ফিরে যেতে পারে, তাদের এই একমাত্র উদ্দেশ্য। অনেক ডলার তাদের দিতে হয়েছে আমাদের কোম্পানিকে। তাই তাদের কাছ থেকে কাজ কড়ায়-গন্ডায় বুঝে না নিলে এবং মেইনটেনেন্সের কাজও শিখে না নিলে, চলবে না।

এ-বছরে যা গরম পড়েছে তাতে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ না করলেও চলবে না। বৃষ্টি থেমে গেলে আবার আমাদের কাজের অসুবিধে হবে।

চাড্ডা সাহেব আমার ওপরে কতখানি নির্ভর করেন তা তো তুমি জানোই। সকলেই ঈর্ষাকাতর হয়ে বলে, আমি নাকি ডিরেক্টরদের Blue eyed boy। যে যা, বলে বলুক। এই কাজটা ভালোভাবে এবং সময়মতো শেষ হলে আমার ওপরে উনি আরও খুশি হবেন।

আমার ভালো হওয়া মানেই তোমার-ই ভালো। পিপিরও ভালো। খুব রোদ আর লু-এর মধ্যে এমন ঝাঁঝাঁ-পোড়া হওয়ার সেইটেই তো সবচেয়ে বড়ো সান্ত্বনা। এ-বছরে এরইমধ্যে ‘লু’ বইতে শুরু করেছে। নামেই পশ্চিমবঙ্গ, আবহাওয়া বিহারকেও হারিয়ে দিয়েছে।

অযোধ্যা পাহাড়ে জেঠ শিকারের সময়ে যে-মেলা বসেছিল, সেই মেলাতে গিয়ে তোমার জন্যে খুব সুন্দর রুপোর গয়না কিনেছি। আদিবাসী ডিজাইনের। পিপির জন্যেও কিনেছি পাঁয়জোর। নিজহাতে নিয়ে যাব বলেই কারোকে দিয়ে পাঠাইনি। যখন যাব তখন-ই নিয়ে যাব।

তুমি মনে কোরো না যে, এখানে আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে। ধরসাহেব, আমাদের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর তো এখানেই থাকেন সপরিবারে। মিসেস ধর আমাকে প্রায় তোমার মায়ের-ই মতন আদর-যত্ন করেন। আমার মাকে তো কবেই হারিয়েছি সেই শিশুকালে তাই মায়ের মতন কারোকে পেলে মন ভারি নরম হয়ে যায়। ওঁদের একটিমাত্র মেয়ে ঝিঁঝি। তোমার-ই বয়েসি। আহমেদাবাদের ইন্সটিক্ট অফ ডিজাইনস থেকে পাশ করে সবে এসেছে। অনেক চাকরির অফার পেয়েছে ইতিমধ্যেই। পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা মাইনে শুরুতেই। কিন্তু কোনটা নেবে, কোথায় যাবে তা ঠিক করতে পারছে না। সব চাকরিই মুম্বই, দিল্লি, ব্যাঙ্গালুরু, চেন্নাইয়ে। কলকাতাতে চাকরি-টাকরি আর নেই।

ধরসাহেব খুব-ই চাইছেন ঝিঁঝির বিয়ে দিতে। কিন্তু ঝিঁঝি এক্ষুনি বিয়ে করতে চায় না। তা ছাড়া, চাইলেই বর-ই বা কোথায় পাওয়া যাবে বলো? তারও তো সত্তর হাজার টাকা মাইনে পাওয়া চাই। নইলেই স্বামীর নানা ধরনের হীনম্মন্যতা জাগবে। পুরুষেরা এত যুগ ধরে মেয়েদের খাইয়ে পরিয়ে এসেছে সেই গর্ব বা অহং-এ আঘাত লাগলে এদেশীয় অনেক শিক্ষিত পুরুষেরও বিষম প্রতিক্রিয়া হয়। এই মানসিকতা হাস্যকর মনে হলেও, এর পেছনে বহুযুগের অভ্যেস থাকাতে এই মানসিকতা ত্যাগ করতে আমাদের অনেক সময় লাগবে।

এবারে যা গরম পড়েছে এদিকে তা সত্যিই বলার নয়। অবশ্য কাগজে এবং টিভিতে দেখি, যে সবদিকেই পড়েছে। কলকাতায় তো খুব-ই গরম। গরমে প্রাণ বাঁচাতে ইলেকট্রাল খাচ্ছি, যবের ছাতুর শরবতও আমার মজুর আর ফিটারদের সঙ্গে। এবং মাঝে মাঝে বিয়ারও। বিয়ারের দাম এখানে খুব বেশি। তা ছাড়া Flat-ও হয়ে যায় অধিকাংশই।

বোলপুরের একটিমাত্র মদের দোকানের অসভ্য দোকানির পোটকা মাছের মতন মুখ আর তিরিক্ষি ব্যবহার দেখলে তালু এমনিতেই শুকিয়ে যায়। বিয়ারে কিছুই হয় না। তবু মাঝে মাঝে ওইখান থেকেই আনতে হয়। ওই দোকানিকে দেখলে রক্ত এমনিতেই মাথায় চড়ে যায়। একসাইজ ডিপার্টমেন্ট কেন যে, ওই দোকানির লাইসেন্স ক্যানসেল করে না বা অন্য নতুন দোকানের লাইসেন্স দেয় না তা জানি না। সৎ সুড়ি এবং সুভদ্র মাতালদের জন্যে অবিলম্বে এবাবদে ভাবনাচিন্তা করা দরকার।

ধরসাহেবদের বাড়ি গেলে কোল্ড বিয়ার বেকন অ্যাণ্ড ফিঙ্গার চিপস (আলুর) এবং ঝিঁঝির হাসি ও সঙ্গ বটগাছের ছায়ার মতন শরীর-মনকে স্নিগ্ধ করে। তোমার কোনো বোন নেই। নেই কেন? আপন বোন তো নেই-ই এমনকী কাজিনসও নেই–তাই মাঝে মাঝে মনে হত, এই শালিহীন দাম্পত্য বৃক্ষহীন অরণ্যের-ই মতন। ঝিঁঝি-ই আমার শালির অভাব পূরণ করেছে।

ভালো থেকো।

প্রচন্ড গরমের রাতে নির্মেঘ তারাভরা আকাশের নীচে নেয়ারের খাটে ছটফট করতে করতে পাগল পাগল লাগে। তখন তোমার চান-করে-আসা স্নিগ্ধ, ঠাণ্ডা শরীরের কথা মনে করি। তুমিই এই মরুভূমিতে আমার একমাত্র মরূদ্যান।

ভালো থেকো। জলপিপিকে সাবধানে যেন, রাস্তা পার করায় হাসি, হাসিকে বোলো। মেয়েটা কেবলি আছে। কলকাতা শহরে বাড়ি থেকে বেরোবার পরে যতক্ষণ-না, কেউ বাড়ি ফিরছে ততক্ষণ-ই দুশ্চিন্তা হয়।

ইতি–তোমার বাজ, যে সল্লি হাঁস-এর যম

হেঁয়ালি মনে হওয়া সত্ত্বেও চিঠিটা হাতে পাওয়ার পরেই সল্লি ফোন করেছিল তার মাকে। চিঠির যেসব অংশ মাকে শোনানো যায় না, সেইসব অংশ বাদ দিয়ে প্রায় পুরো চিঠিটিই পড়ে শুনিয়েছিল।

কুসুম বলেছিলেন, সত্যি! বাজ-এর মতন ছেলে হয় না। তোর তো বুদ্ধি বলে কোনোদিনই কিছু ছিল না। নিজের বিয়ের ব্যাপারে যাহোক বুদ্ধিটা খুলেছিল। তোর চেয়ে সবদিক দিয়ে ভালো কত মেয়ে ভালোবেসে বিয়ে করার সময়ে, কত আজে-বাজে ছেলেকে বিয়ে করে বসে। আজকালকার ছেলেদের মধ্যে ভালো বাছতে তো গাঁ উজাড় হয়ে যায়।

সল্লি হেসে বলে, যাই বলো আর তাই বলে মা, যদি বলো যে, বিয়েটা ভালোই করেছিলাম তবে বলব ও-ব্যাপারে আমার কোনো বিশেষ কৃতিত্ব ছিল না। বিয়েটা একটা কপালের ব্যাপার। সব বিয়েই। সেটা অঙ্ক আদৌ নয়। বিয়ের আগে অঙ্ক মিলে গেলেই বিয়ের পরেও যে, মিলবে সে-কথা কেউই বলতে পারে না। এইজন্যেই তো বলে যে, ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভেন’।

নীলকমল কি তাহলে সত্যিই খারাপ ছেলে? না হলে ও আভাসে ইঙ্গিতে বাজ-এর চরিত্র সম্বন্ধে কিছু কথা কেন চালাচালি করবে?

ভাবছিল সল্লি।

ঠিক সেই সময়েই কুসুম বলেছিলেন, আমার কিন্তু ছেলেটিকে মোটেই ভালো মনে হয় না।

সেদিন-ই নীলকমল কলকাতার অফিস থেকে ফোন করেছিল যখন, তখন বাজ-এর চিঠির কথাটা বেশ একটু শ্লেষের সঙ্গেই বলেছিল, সল্লি, নীলকমলকে।

মনে পড়ে গেল সল্লির।

নীলকমল হয়তো আহতও হয়েছিল একটু। কিন্তু তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে সল্লিকে বলেছিল, বাঃ। এ তো খুবই ভালো খবর। সত্যি খুব ভালো খবর। এই খবরে আমি সত্যিই খুব খুশি হলাম।

তারপর বলেছিল, তা বাজ এখানে আসছে কবে, তা কি লিখেছে কিছু?

না। তা লেখেনি।

যাইহোক, আবার কিছু ভালো রান্নাটান্না করলে আমাকে ফোন কোরো, পাঠাবার বন্দোবস্ত করে দেব। আমার নিজেরও যেতে হবে, এ-মাসের শেষে একবার। অডিটরেরা নাকি কীসব কোয়্যারি করেছেন। আমার পাশ-করা কিছু ভাউচার সম্বন্ধে। তারমধ্যে বাজ নিশ্চয়ই এক-দু বার ঘুরে যাবে এখানে। যদি কোনো কারণে না আসতে পারে তাহলেই আমার কিছু বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন উঠবে। তবে, সংকোচ কোরো না কোনোরকম। যা ইচ্ছে করে, পাঠিয়ো।

সল্লি নীলকমলের কথার উত্তর দেয়নি কোনো। চুপ করেই ছিল। মাঝে মাঝে মনে হয় সল্লির যে, নীলকমল বড়োবেশি কথা বলে। এবং এমন সব কথা, যেসব কথাতে সল্লির কোনো ঔৎসুক্য নেই।

পরমুহূর্তে সল্লি বলল, এবারে ছাড়ি ফোন। মা আসবেন দুপুরে তাঁর নাতনির সঙ্গে খাবেন বলে। এঁচড়ের তরকারি বসিয়ে এসেছি।

শুধুই এঁচড়?

তা কেন? ধোকার ডানলা, পাবদা মাছ, ধনেপাতা, কালোজিরে-হলুদ, কাঁচালঙ্কা দিয়ে।

আর বাবা? বাবা আসবেন না?

বাবার কলেজের রি-ইউনিয়ন আছে, সেখানেই কাটাবেন সারাদিন।

এই ‘রি-ইউনিয়ন’ শব্দটাই একটা মিসনমার। ছেলেমানুষদের রি-ইউনিয়ন অবশ্যই হতে পারে। কলেজ ছাড়বার পরে পরে হলেও হতে পারে। বৃদ্ধবয়সে রি-ইউনিয়ন কখনোই হয় না। প্রত্যেক মানুষের জীবনের গতি ও গন্তব্য আলাদা আলাদা। গ্র্যাণ্ড কর্ড আর মেইন লাইন একে অন্যকে কেটে হয়তো যায় কখনো কখনো, কিন্তু তাদের মিলন কখনোই হতে পারে না। আর মিলন-ই যদি না হয়, তবে আর পুনর্মিলন হবে কোত্থেকে!

কী জানি! অত জানি না। ছাড়লাম এখন।

আচ্ছা।

সল্লি ছেড়ে দিল বটে, মানে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল কিন্তু নীলকমল অনেকক্ষণ কানে ধরে রাখল রিসিভারটা। সল্লির গলার মিষ্টিস্বর যেন, তখনও তার কানে মধুর মতন গলে গলে পড়ছিল। সল্লিই তার জীবনের একমাত্র আনন্দ। নির্মল আনন্দ। সল্লি কি সে-কথা জানে? ভাবছিল, নীলকমল।

অফিসের অপারেটর বলল, নীলবাবু, আপনার কথা কি হয়ে গেছে লোকাল লাইনের সঙ্গে?

চমকে উঠে নীলকমল বলল, না, হ্যাঁ, কেন?

না, দুবরাজপুর থেকে কল আছে।

স্যরি।

আপনি রিসিভারটা নামিয়ে রাখুন, আমি ট্রান্সফার করে দিচ্ছি কলটা। ধরসাহেবের কল।

আজকাল সব অফিসেই এই ‘ঝিং-চ্যাক’ এক্সচেঞ্জ লেগে গেছে। “টুং-টাং টাং-টাং’ নয়তো কবে সাহেবরা চলে গেলেও তাদের নানারকম সাইকেডিলিক, বাজনা, নয়তো পিয়ানোর টুংটাং আর ভালো লাগে না। তার চেয়ে রথীন ঘোষ বা ব্রজেনবাবুর কেত্তন টেপ করে বাজালে পারে। ‘মাথুর’ কিংবা ‘নৌকাবিলাস’। আহা, চার আনাতে হবে না, চার আনাতে হবে না। পাঁচ আনা দিব কড়ি, পার করো তাড়াতাড়ি। এই ‘কীর্তন’ জিনিসটা বাঙালির একেবারে নিজস্ব ছিল সেটাই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। বাঙালির নিজস্ব জিনিস বলতে ক-টা জিনিস-ই বা আছে? কে আর ভাবে এসব নিয়ে। ওদের অফিসের সহকর্মী জিকু জোয়ারদারকে এ-প্রসঙ্গে একদিন বলতে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল, কোন যুগে বাস করছেন নীললোটুদা? কেত্তন-ফেত্তন এখন কোনো ভদ্দরলোকে শোনে। নাকি? এখন মডার্ন শুনবেন তো ঊষা উথুপ, নয় নচিকেতা। আর রবীন্দ্রসংগীত শুনবেন তো পীযূষকান্তি। পুরোনোরা তো সব তামাদি হয়ে গেছে। বস্তাপচা মাল সব।

নীললোটুদা মানে, নীলকমলদা। নীল-লোটাস।

হ্যালো। বাজনা থেমে গেল। মাথার মধ্যের চিন্তার জালও ছিঁড়ে গেল।

ধরসাহেবের ফোন। ঘোষ?

বলুন স্যার। বলছি।

ধরসাহেব নীলকমলকে বিশেষ পছন্দ করে না। সে বাজ-এর মতন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েনি। অমন স্মার্টও নয়। আর সে-কারণেই যেন, ধরসাহেব ফোন করলেই আরও ক্যাবলা বনে যায় নীলকমল। অথচ ও-ও যাদবপুর থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল। বাজও তাই। এক-ই স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরোনো ছেলেদের মধ্যেও অনেক সময়ে আকাশ-পাতাল তফাত থাকে। পারিবারিক পরিবেশ, নিজের নিজের বড়ো হওয়ার জেদ-ই, সম্ভবত আলাদা আলাদা করে দেয় মানুষদের। সত্যজিৎ রায় বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের ছাত্র হয়েও বি.বি.সি রেডিয়ো শুনে কী দারুণ ইংরেজি বলতেন। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় তো শেখায় সকলকেই। সমানভাবেই। কিন্তু সকলে যে, সমানভাবে বা পুরোপুরি সেই শিক্ষা নিতে পারে না। ভালো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান যেমন জরুরি, সেই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিংড়ে নেওয়াটাও তেমন-ই জরুরি। –এই কথাটা বোঝে নীলকমল। বাজ-এর তুলনাতে সে যে, অনেক-ই নিষ্প্রভ, আনস্মার্ট, অ-চটপটে সে-কথা ও স্বীকার করে নিয়েছে জীবনে অথচ বাজ-এর চেয়েও রেজাল্ট অনেক-ই ভালো করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাতে। বাজ ছিল যাদবপুরের ক্রিকেট ব্লু, ভালো ইংরেজি গান গাইত, পিয়ানো বাজাত, অভিনয় করত লিটল থিয়েটারে, অ্যাংরি কবিতা লিখত লিটল ম্যাগ-এ-যাদবপুরের মেয়েদের কাছে ও হিরো ছিল। আর নীলকমল ছিল…বোকা বোকা বোকার-ই মতো। তার সাধারণ কেরানি বাবা, স্কুলমাস্টার মা, তাদের ভবানীপুরের গলির মধ্যের অতিসাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনযাত্রাই তাকে এই মালটি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে বাজ-এর তুলনাতে এমন নিষ্প্রভ করে রেখেছে।

এখন নীলকমল বোঝে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাই আসল পরীক্ষা নয়, জীবনের পরীক্ষা, Battle of Life-ই আসল। যারা সেই পরীক্ষাতে সফল হয়, তারাই সফল হয় জীবনে। নাথিং সাকসিডস লাইক সাকসেস।

ধরসাহেব বললেন, তোমার অ্যাকাউন্ট্যান্ট কোথায়? এ-সপ্তাহের স্টেটমেন্ট পাঠায়নি কেন? কীরকম ম্যানেজারি করো তুমি?

ভীষণ লোডশেডিং হচ্ছে স্যার, আর যা গরম। পোখরান-এর জন্যেই হয়তো হয়েছে। তার ওপরে আবার লোডশেডিং শুরু হয়েছে। কম্পিউটার কাজ করছে না স্যার।

সে তো জানা কথাই। গোয়েঙ্কারা যখন নিয়ে নিলেন ‘সি. ই. এস. সি.’ তখন-ই জানা ছিল কী হবে। ফুয়েল সারচার্জ দিচ্ছ তো? বাঙালিদের আর কলকাতাতে থাকতে হবে না। শুধু ইলেকট্রিসিটিই নয়, এখন ক্ল্যাসিকাল গান বাজনা, রবীন্দ্রসংগীত এইসব কিছুর-ই মালিক হয়ে গেছে গোয়েঙ্কারা। শুনতে পাই যে, তাঁদের নাকি এক বাঙালি অ্যাডভাইসার আছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সংগীতের জগতের ‘শেষকথা’ নাকি তিনিই! তাঁর উপদেশেই কি হচ্ছে সব কিছু?

পরক্ষণেই ধরসাহেব সিংহগর্জনে বললেন, তবে তোমাকে বলছি নীলকমল, স্টপ দিস টিপিক্যালি বেঙ্গলি ‘এক্সকিউজেস’। এনাফ ইজ এনাফ। কম্পিউটার কাজ করলেই বা তোমাদের ওয়েস্ট বেঙ্গলে হবেটা কী? কম্পিউটারে গারবেজ ফিড করলে তো গারবেজ-ই বেরোবে। ইন্টারভিউর সময়েই বলেছিলাম যে, ওই অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছোঁড়াটাকে নিয়ো না। তা তুমি দয়ার অবতার হয়ে বললে, স্যার রোজগেরে বাবা সদ্য মারা গেছেন। দু-টি বোন। বিধবা মা। এটসেটরা এটসেটরা।

একটু চুপ করে থেকে ধরসাহেব বললে, শোনো নীলকমল, কাজের লোক যখন নেবে, তখন শুধু কাজটাই কনসিডার করবে। দাঁতব্য করতে চাও তো পাড়ার মোড়ের গ্যারাজে হোমিয়োপ্যাথি ক্লিনিক করো। নইলে, মাসোহারা দাও ওইসব ভিখারিদের। ইনএফিশিয়েন্ট, ইনডিসিপ্লিনড ছোঁড়াগুলোকেঢুকিয়ে কোম্পানিটাকে অচল কোরো না। ফর গডস সেক। আমি ওকে স্যাক করে দেব। পিল্লাই বলে যে-ছেলেটাকে ইন্টারভিউতে ডেকেছিলে তার ঠিকানা কি রেখেছ? থাকলে, দেখো, সে যদি এখনও অন্য জায়গাতে চাকরি না পেয়ে থাকে তো তাকেই ডেকে পাঠাও। একে দিয়ে চলবে না। কম্পিউটার চলুক আর না-ই চলুক হাতে তৈরি করে স্টেটমেন্ট পাঠাতে বলো। আমাদের ট্রানজাকশানের কী এমন ভলিউম যে, প্রয়োজনে এবং ইচ্ছে থাকলে হাতে করা যায় না?

হ্যাঁ স্যার।

কী ‘হ্যাঁ স্যার’?

পিল্লাই-এর খোঁজ করব স্যার।

তার আগে তোমার এই লগনচাঁদা ভোঁদা ঘোষ অ্যাকাউন্ট্যান্টটাকে বলো যে, স্টেটমেন্ট তৈরি করে, কাল সকালেই যেন ফ্যাক্স করে দেয়। নইলে আমি ওকে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দূর করে দিয়ে পিল্লাইকে নেব।

হ্যাঁ স্যার।

সে আছে?

না স্যার।

কোথায় গেছে?

ওর মায়ের ক্যান্সার হয়েছে স্যার। হাসপাতালে গেছে। আজ অপারেশন।

মাই গড! কোথায় ক্যান্সার?

লিভারে।

লিভারে! ওঃ শিট! মদ খাই আমি আর সেই বিধবার হল লিভারে ক্যান্সার!…তুমি কী করছ, ওই ইনএফিশিয়েন্টটার মায়ের জন্যে?

স্যার ও তো সবে ঢুকেছে। এখনও তো এনটাইটেলমেন্ট…

হ্যাং ইট। শোনো লালকমল, স্যরি, নীলকলম, আমি এই তোমাকে একটা ফ্যাক্স পাঠাচ্ছি। তিরিশ হাজার টাকা তুমি আজ-ই দেবে ওকে।

স্যার! আমাদের তো মেডিক্যাল বেনিফিটস নেই। এই চেক কোথায় অ্যাডজাস্ট করব?

কোথাও-ই নয়। ইনকমপিটেন্টটাকে আমার সাহায্য। আমার পার্সোনাল ড্রয়িংস-এ ডেবিট করবে। নাথিং টু ডু উইথ দি ফার্ম। যাইহোক, তোমার পেয়ারের অ্যাকাউন্ট্যান্টকে মেসেজটা দিয়ো। আজ তিনি ফিরবেন তো? কোন রত্নগর্ভা মায়েরা যে, এরকম ব্যাঙাচি আর ম্যালামাণ্ডার গর্ভে ধরেন।

না স্যার।

মানে?

মানে, সই করেই চলে গেছে অপারেশন যদি শেষ না, হয় তবে আজ আর আসবে না।

সত্যি! আনথিঙ্কেবল। ফার্মটাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপিস করে তুললে যে! নাঃ, আমি ওকে স্যাক-ই করব। তুমি পিল্লাইকে খবর দাও। আজ-ই।

ইয়েস স্যার।

নীলকমল ভাবছিল, কতরকমের পাগল হয়। মনে মনে বলছিল, পাগল ভালো করে মা’! অ্যাণ্ড রিপোর্ট ব্যাক টু মি। ইয়েস স্যার। বাজ কেমন আছে? অফিসে আছে না, সাইট-এ আছে জিজ্ঞেস করবে ভাবল একবার নীলকমল, কিন্তু ধরসাহেবের সঙ্গে কথা বলতেই যে, ভয় করে। হাওড়ার ব্যাটরার দুর্যোধন কুন্ডুর বড়োমেয়ের ছোটোছেলে নিস্তারণ ধর যে, এতবড়ো আমেরিকান হবেন, তা কি তাঁর ঘরজামাই বাবা ননিগোপাল-ই জানতেন? না, মা কৃষ্ণভামিনী? হাওড়ার সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্য রাখেন না ধরসাহেব কিন্তু তাঁকে তো সারস অথবা হেলিকপ্টার সোজা ফিলাডেলফিয়াতে নিয়ে গিয়ে ওপর থেকে ধপ করে ফেলেনি। নীলকমল নানা মানুষের কানাঘুসোতে শুনেছিল যে, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পাঁচবারেও পাশ করতে না পেরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পরেই ক-বন্ধুতে মিলে জাহাজে করে প্রথমে জার্মানিতে চলে যান। পশ্চিম জার্মানিতে। শীতে জমে-যাওয়া টেলিগ্রাফের তারে নুন ছিটিয়ে বরফ পরিষ্কার করে জীবন আরম্ভ করেন। তারপর সেখান থেকে ইংল্যাণ্ড, তারপর স্টেটস। শ্রীহাদিদোয়ানিয়া ধর। ওরফে হেরর এইচ. ডি. ধর। তবে সেসব কোনো ব্যাপার নয়। নাথিং সাকসিড লাইক সাকসেস’ এ-কথা নীলকমল জানে। জীবনে যে, সফল হতে পেরেছে সে কী করে সফল হল– তা নিয়ে অন্য কেউ তো বটেই, সে নিজেও মাথা ঘামায় না। কিছুক্ষণ আগে বাজ-এর কথা মনে পড়াতেও এই প্রবাদটি মনে পড়েছিল।

সেল্ফ-মেড মানুষেরা একটু ‘দাম্ভিক’ হয়েই থাকেন আর সেই দম্ভ তাঁদের মানিয়েও যায়। বলরাম ঘোষ ঘাট রোডের নীলকমল বোস সে-কথা অবশ্যই মানে। সব-ই ভালো। কিন্তু বড়োভয় পায় ও জয়েন্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর ধরসাহেবকে।

ম্যানেজিং ডিরেক্টর চাড়া সাহেবকে কিন্তু ভয় করে না অত, যদিও তিনি স্টেটস-এই জন্মেছেন, সেখানেই বড়ো হয়েছেন। তিনি অবশ্য কলকাতার হেড অফিসে বসেন। নীলকমলের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ হয় না। তবে ন-মাসে, ছ-মাসে হেড অফিসে গেলে এবং হঠাৎ করিডোরে দেখা হয়ে গেলে হেসে কুশল জিজ্ঞাসা করেন। মানুষে মানুষে তফাত তো হয়-ই। আর ভাগ্যিস হয়।

ফোনটা ছেড়ে, ইন্টারভিউর ফাইলটা বের করে জন এম. পিল্লাই-এর অ্যাপ্লিকেশন, ইন্টারভিউ লেটার ইত্যাদি বের করল। কনফিডেনশিয়াল বলে সব নিজের ঘরেই রাখা ছিল। তারপরেই কী মনে করে, সেগুলো আবার ফাইলে যথাস্থানে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর নীলকমল, তার পি.এ. নমিতা বাগচিকে ডেকে পাঠাল।

নমিতা এলে বলল, আমার ঘরটা কী হয়ে আছে বলুন তো? কবে থেকে বলছি যে, অপ্রয়োজনীয় কাগজ-এর ফাইল সব ডেস্ট্রয় করে দিন। আমরা কি ইট-কাঠ বা চাল-ডালের ব্যবসা করি? আমরা ব্যবসাদার নই, পেশাদার, প্রফেশনালস। এটা ভুলে যাবেন না মিস বাগচি। রেফারেন্স-বই রাখার জায়গা নেই আমার ঘরে। কী যে, করেন আপনারা! আমি তো একটা অফিস-অর্ডারও করে দিয়েছিলাম। করিনি? তা ছাড়া আমার ঘরেও আগামী সপ্তাহে কম্পিউটার বসবে। এখনও যদি এসব জঞ্জাল সাফ না করান তো কী করে কী হবে?

হ্যাঁ স্যার।

কই? অর্ডারটা আনুন তো? কোন ডেট-এর অর্ডার?

গতমাসের পাঁচ তারিখের?

তা ডেস্ট্রয় করেননি কেন?

ভেবেছিলাম, আপনাকে দেখিয়ে করব। তা আপনি তো ট্যুরের ওপরেই আছেন।

তার মানে? ট্যুরে যাওয়া মানে কী হানিমুনে যাওয়া?

স্যার, আমি কী তাই বলছি?

মুখে মুখে কথা বলবেন না।

না।

আজকেই ডেস্ট্রয় করুন। স্যার, আমার মাসতুতো দিদির বিয়ে পরশু। তাই নিয়েই গত পনেরো দিন খুব ব্যস্ত আছি।

বাঙালির আর কাজ কী বলুন? বিয়ে করা আর সন্তান উৎপাদন করা।

বলেই বুঝল, ‘জাত’ তুলে কথা বলাটা ঠিক হয়নি, যা দিনকাল পড়েছে। কেন যে, মেয়ে হয়ে জন্মায়নি তা ভেবে বড়োই মনস্তাপ হয় আজকাল নীলকমলের। তাই সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘুরিয়ে বলল, চাচ্ছাসাহেব ফোন করেছিলেন বইগুলোও আজ-ই এসে যাবে। যা-হয় আজ করুন। করা হয়ে গেলে আমার অর্ডারের ওপরে ‘এগজিকিউটেড’ লিখে, ব্যাক ডেট দিয়ে সই করে ফেরত দেবেন। ধরসাহেব আমার অফিস ইন্সপেকশন-এ আসবেন শিগগির।

তারপর-ই বলল, ওই ফাইলটাতে আছে কী?

ওই ইন্টারভিউ-এর কাগজপত্র।

মিস বাগচি বললেন। লোক তো সব পোস্টেই নিয়ে নিয়েছেন সাহেবরা ইন্টারভিউ করেই। এগুলোর আর কি কোনো দরকার আছে?

আমি কী করে বলব স্যার?

কমনসেন্স-এ বলবেন। দ্যা most uncommon quality common sense-এ। আর কী করে?

আজ-ই সব পুড়িয়ে দিচ্ছি রামলগনকে বলে।

সাবধান! রেকর্ডে যেন থাকে যে, গতমাসের পাঁচ তারিখেই পুড়িয়েছেন নইলে ধর। সাহেব…

বুঝেছি, স্যার, বুঝেছি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।

বলেই, চলে যেতে গিয়ে বললেন, আজ তিনটেতে যাব স্যার?

কেন?

হবু জামাইবাবুকে নিয়ে ওঁর ঘড়ি আর জুতো কিনতে নিয়ে যাব।

এই গরমের দুপুরে? সেদ্ধ হয়ে যাবেন যে।

কী করা যাবে স্যার? জামাইদের বাড়ি কেষ্টনগরের নেদেরপাড়াতে। দুপুর দুপুর না-হলে সাড়ে চারটের লোকালে কেষ্টনগরে ফিরবেন কী করে? ওদিকেও তো কাজ কম নেই।

যান যান, যা-খুশি করুন।

একেবারে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল নীলকমল।

ভাবল, নাঃ! একজন বাঙালিকেও আর চাকরিতে নেব না। সত্যি! দে ডোন্ট ডিসার্ভ। দে ডোন্ট ডিসার্ভ এনিথিং। আজকে সি পি এম-এর বনধ, কালকে ই. কংগ্রেস-এর, পরশু ও কংগ্রেস-এর, তার পরদিন ভাজপার, তারপরদিন তৃণমূলের, তারপর দিন কন্দমূলের, তারও পরদিন সাপের পাঁচ পা-র। আজ ওয়ার্ল্ড কাপ, কাল ওয়ান ডে ক্রিকেট, পরশু ভীষণ গরম, তারপর দিন গরম কম কিন্তু হিউমিডিটি বেশি, তারপরের দিন অসম্ভব বৃষ্টি, তারপর দিন জব্বর ঠাণ্ডা, তারপর দিন রেল রোকো, তারপর দিন বাস রোকো। তারপর দিন লোকাল ট্রেনে মোষ কাটা পড়েছে। আর তাও যদি না থাকে, তো পিসতুতে দিদির বিয়ে, জামাইষষ্ঠী, তারপর নিজের বিয়ে, ডেলিভারি। উইমেন্স লিব-এর পরাকাষ্ঠা! পুরুষদের পেট যে, ভগবান কেন ফোলালেন না, তা তিনিই জানেন! কী অবিচার! ভাবছিল, নীলকমল।

পরক্ষণেই নীলকমলের মনে পড়ে গেল যে, নমিতা বাগচি ধরসাহেবের-ই এক বন্ধুর শালির মেয়ে না ভায়রাভায়ের মেয়ে যেন। তাঁর রেকমোশনেই আধুনিক ইতিহাসে ফর্টি-টু পার্সেন্ট নম্বর পেয়ে পার্ট টু পাশ করেও এই ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম-এ ঢুকেছিল।

সর্বনাশ! যদি ধর সাহেবকে বলে দেয়! চিন্তিত মনে, তাই কথা ঘোরাবার জন্যে বলল, তাড়াতাড়ি বলল, তখনও দাঁড়িয়ে-থাকা নমিতা বাগচিকে, আপনার হবু-জামাইবাবু খুব-ই বোকা বলতে হবে।

কেন?

একটু অবাক হয়ে নমিতা বলল।

এই গরমে কেউ বিয়ে করে? তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বউকে আদর করবে? তা ছাড়া লেপও তো পাবেন না শ্বশুরবাড়ি থেকে একটিও। লেপ-ই না পেলে, বিয়ে করে লাভ

কী?

আপনি কি বিবাহিত স্যার?

কে, কে?

চমকে উঠে বলল নীলকমল।

আপনি?

না, না।

আপনি যখন বিয়ে করবেন তখন শীতকালে করবেন। নমিতা বলল।

আর আপনি? আপনি কি বিবাহিত?

ধমকের সুরে বলল নীলকমল।

না।

তাহলে আপনিও।

মানে?

মানে, শীতে।

.

০৪.

এখন খর সকাল।

পথপাশের প্রাচীন নিমগাছটার ফিনফিনে পাতারা হাওয়ায় নড়ছে। কাক ডাকছে কা-খা-কা।

শিরীষ গেছেন পাশের বাড়ির চিরন্তনবাবুর কাছে। উনিও রিটায়ার্ড তবে ভদ্রলোকের নানা বিষয়ে শখ আছে। গান-বাজনা-সাহিত্য। তবে খেলাধুলোতে নেই। বলেন, যার যা গড়ন। কোনোদিন যা করিনি আজ বুড়োবয়সে টিভি-র দৌলতে ঘরে বসে দেখা যায় বলেই যে, সময় নষ্ট করে খেলা দেখতেই হবে তার কী মানে আছে? প্রত্যেকের জীবনেই একটা priority-র ব্যাপার থাকা উচিত। মানুষের জীবন তো নদী নয়, কী সমুদ্র নয় যে, চিরদিন বয়ে যাবে! জীবন বড়ো ছোটো বলেই এই জীবন নিয়ে কী করব আর কী না করব, সে বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন থাকা উচিত ছেলেবেলা থেকেই।

আসলে চিরন্তনবাবুর সঙ্গে কুসুমের-ই বন্ধুতা বেশি। ঘণ্টার পর ঘন্টা চা-মুড়ি আর তেলেভাজা খেয়ে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হয়। বিদেশি সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, জয় গোস্বামী, হর্ষ দত্ত, অনীতা অগ্নিহোত্রী, অনিল ঘড়াই, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, শিবতোষ ঘোষ, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় এবং আরও নানা আধুনিক বাঙালি সাহিত্যিকের নানা বই নিয়ে।

বেশ মানুষটি।

আনাজ কেটে দিয়েছে গীতা। রাতে পাতলা করে কালোজিরে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে মুসুর ডাল করবেন। পোস্তবাটা। ডিম সেদ্ধ। কড়কড়ে করে আলু ভাজা আর কুচো চিংড়ি দিয়ে লাউ। মধ্যে ধনেপাতা পড়বে। লোক তো দু-জন। বেশিকিছু করতে ইচ্ছে যায় না। প্রথমত, সামর্থ্য নেই, দ্বিতীয়ত, ইচ্ছেও করে না। খেতে হয়, তাই খাওয়া। সব-ই গোছানো আছে। করতে আধঘণ্টাও লাগবে না।

কুসুম ভাবলেন, ওই ফাঁকে একবার নাতনির সঙ্গে কথা বলেন। নিজের জন্যে মনোমতো করে এককাপ চা বানিয়ে নিয়ে ফোনের কাছে গেলেন। ডায়ালের বোম টিপতেই যথারীতি তিনি

হ্যালো।

জলপিপি পাখি আছে?

নেই। পাথি তো নেই, আমি আথি।

তুমি কী? আমি মানুথ। কিন্তু পাখিও। ও-ও বুদেথি, বুদেথি। তুমি দিদা! তাই-না? তুমি দে বলেথিলে আমাকে অবন টাকুলেল ‘লাদকাহিনী’ পুলে থোনাবে আর বিভূতিভূষণের ‘তাঁদের পাহাড়’ তার কী হল দিদা?

শোনাব, শোনাব। তুমি আমাদের বাড়ি এসো, তবে-না।

আমি তো ক-দিন তোমাল কাথেই তাকব। মা তো নীলকমলকাকুর সঙ্গে বেলাতে দাবে।

বেড়াতে যাবে? কোথায়?

ভুরু কুঁচকে গেল কুসুমের। ভীমরতি ধরেছে মেয়ের। নিজের গর্ভের সন্তান-ই দিনে দিনে হেঁয়ালি হয়ে উঠছে যেন।

তা তো দানি না দিদা। তবে বলেথে, আমাকে লেখে দাবে। এখন কুব গলম কিনা।

চিন্তান্বিত গলাতে কুসুম বললেন, তাই?

তারপর বললেন, তোমার মা কোথায়?

মা তান কলতে গেথে। দানো দিদা, মা-না, আদকাল আর তানঘলে গান গায় না তান কলার থময়ে। থবথময়ে গম্ভীল হয়ে থাকে। আমাল থঙ্গেও ভালো করে কথা বলে না।

কেন? কী হয়েছে তোমার মায়ের, পিপি?

কী হয়েথে তা আমি কী কলে দানব? তোমাল তো মেয়ে হয় আমাল মা, তুমি দানো না? আমাল মা তো আমাল থব কথাই দানে।

গম্ভীর হয়ে গেলেন কুসুম।

কী করে বলবেন, চার বছরের জলপিপিকে যে, মেয়েরা বড়ো হয়ে গেলে, তাদের বিয়ে হয়ে গেলে, তারা পরের বাড়িতে পরের বউ হয়ে গেলে, মায়েরা মা হওয়া সত্ত্বেও, মেয়েদের সব কথা জানতে পারেন না। তারা বড়ো হলে তাদের ব্যক্তিত্বের কারণেই সব কথা বলতেও চায় না। নিজের মনকে কোটরে ঢুকিয়ে ফেলে। মায়ের পক্ষেও সব জানা সম্ভব হয় না।

কুসুমকে চুপ করে থাকতে দেখে জলপিপি বলল, আমাল মন বালো নেই দিদা।

কুসুম নিজের কোটরে-ঢাকা মনকে বাইরে এনে বললেন, কেন গো দিদা? মায়ের জন্যে?

না না। যে দন্যে নয়, তবে থে দন্যেও একতু বতে। আথলে হাথিদি না, আজ কাকের বাথাটা ভেঙে দিমগুলো থব নীচে ফেলে দিয়েথে। পাথেল বাড়ির হুলো বেড়ালটা কচকচ কলে দিমগুলো কেয়ে ফেলল দিদা। দিম-এর মধ্যে যে-বাত্তাগুলো থিলো থেগুলো আর তো উড়তে পালবে না, দাকতে পালবে না, তাই-না?

তাই তো। কিন্তু হাসি এমন করল কেন? ভারি অসভ্য তো! নিষ্ঠুর! মায়াদয়া নেই একটুও। ভারি নিষ্ঠুর! মেয়ে হয়ে কেউ এমন করে?

মা-ই তো বলল, ভাঙতে। হাথিদিদি তো ভাঙতে তায়নি।

মা! তোমার মাই ভাঙতে বলল?

হ্যাঁ তো।

কেন?

মা বলল, বাথা বানাবার আর দায়গা পেল না হতচ্ছালি! পাখিল নীল! ফুঃ! দত্তসব নোংলা ব্যাপাল। বাজে ব্যাপাল।

বাজে ব্যাপার? তোমার মা বলল পিপি?

হ্যাঁ তো। মা তান করে বেরোলে মাকে দিগগেথ কোলো তুমি।

হাসি কোথায়? বা

দালে গেথে। তোমার দন্যে মাংথ আনতে গেথে। তুমি তো কাল আথবে আমাদের একানে, দুপুলে কাবে। আমি থব জানি। কাল তো বেথপতিবার, মাংথ পাওয়া যায় না।

কুসুম বললেন, আচ্ছা দিদা, এখন আমি ফোনটা ছাড়ি। পরে আবার কথা বলব কেমন? তোমার মাকে বোলো বাথরুম থেকে বেরিয়ে একটা ফোন করতে আমাকে।

হ্যাঁ হ্যাঁ। নিততই বলব।

কুসুম রিসিভারটা নামিয়ে রেখে চা-টা একচুমুকে শেষ করে বিষণ্ণ মুখে রান্নাঘরে গেলেন। মনটা ভালো লাগছিল না ওঁর। সল্লি যে, কেন ডিমসুষ্ঠু কাকের বাসাটা ভাঙতে গেল? যত্তসব অলক্ষুণে কান্ড। পাখিও তো মা। নিজে মা হয়েও…। সত্যি! আজকালকার মেয়েদের বোঝ যায় না। দাম্পত্যর ওপরে, নীড়ের ওপরেই কী তার ঘেন্না জন্মে গেল? নতুন করে আবার কী হল কে জানে!

রান্নাঘরে গেলেন কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না। গ্যাসের উনুনের সামনে যে, লম্বা টুলটি বানিয়েছেন বসে বসে রান্না করার জন্যে তাতে গিয়ে বসলেন। মেঘ জমেছে যেন, আকাশে। হাওয়াও আছে একটা মৃদুমন্দ। পাশের বাড়িটাই চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বসাহেবের। মস্ত লন আছে। সেই লনে নানারকম ফুলের গাছ। সব গাছ তো চেনেন না কুসুম, সব ফুলও নয়। অথচ মা-বাবা তাঁর নাম দিয়েছিলেন কুসুম। সেই হাওয়াতে মিশ্র ফুলের ও পাতার ও গাছের গায়ের গন্ধ ভাসছে। কিসকিস করে আলতো চুম খাওয়ার মতন শব্দ করে পাখি ডাকছে কোনো। কুসুম, পাখিও চেনেন না তেমন। চেনেন শুধু শালিখ, কোকিল, চড়াই এবং কাক।

আলস্য ও বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠে কাঁচালঙ্কা, কালোজিরে সম্বার দিলেন মসুর ডালে। ফুলের গন্ধর-ই মতন সম্বারের গন্ধে বাড়ি ম-ম করে উঠল। কুসুম ভাবছিলেন, সল্লি কেন জলপিপিকে তাঁর কাছে রেখে নীলকমলের সঙ্গে দুবরাজপুরে যাবে? আবার কী হল? দুবরাজপুরেই কি যাবে, না নীলকমলের সঙ্গে ফুর্তি করতে অন্য কোথাও? তাঁর-ই মেয়ে হয়ে এমন কুরুচি হল কী করে সল্লির? মনটা ভারি খারাপ হয়ে আছে তাঁর নাতনির সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই। ঠিক এমন-ই সময়ে দুর্গাবাড়ির আলসের ওপর থেকে কালচে কবুতরেরা যেমন অলক্ষুণে স্বরে ডাকে ভরদুপুরে তেমন-ই স্বরে ফোনটা কিরিরিং করে উঠল। অমন আওয়াজ হলে বোঝা যায় যে, এস টি ডি কল এল কোথাও থেকে। অলক্ষুণে স্বরে বাজলেই কুসুমের ভয় করে। কোনো খারাপ খবর নিয়ে আসেই ওইরকম আওয়াজের দূরাগত ফোন।

ডালটা কড়াইতে বসিয়েই গেলেন ফোন ধরতে। শিরীষের আর কী? বাড়িতে থেকে রান্নার সময়ে ফোনটা ধরে যে, একটু সাহায্য করবেন তাও কী করেন। অধিকাংশ রিটায়ার্ড বুড়োগুলোই একরকম। কুচুটে। রামগড়রের ছা। প্রসাদের কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকলে হয়তো বদলাতেন একটু। এঁরা সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অপাঠ্য খবরের কাগজ পড়বেন পত্রিকার নাম থেকে শুরু করে ‘প্রিন্টেড অ্যাণ্ড পাবলিশড বাই’ পর্যন্ত। তারপর ব্রেকফাস্টের পর ছাতা হাতে করে পাড়া বেড়াতে বেরোবেন, গেজেট অফ ইণ্ডিয়ার চলমান সংস্করণ হয়ে। ফিরে এসে, স্ত্রীর রান্না করা নানা পদ তরিবত করে খাবেন আর খুঁত গালবেন।

তারপর শিবা-ভোগ খেয়ে দিবা-শয়নে পদ্মনাভ। তারপরে বিকেলে চা এবং টা। ছাতা হস্তে বৈকালিক ভ্রমণ। গুচ্ছের রিটায়ার্ড বুড়োদের সঙ্গে পার্কের বেঞ্চে বসে ছেলে-বউ-এর শ্রাদ্ধ করবেন আর মেয়ে-জামাই-এর প্রশংসা। তারপর বাড়ি ফিরে এসে, বগলতলিতে সাবান মেখে চান করে টি.ভির সামনে বসে সর্বজ্ঞ সর্বজ্ঞ মুখ করে রাজনীতি থেকে গল্ফ, টেনিস থেকে রবীন্দ্রসংগীত, নৃত্য থেকে ক্রিকেট, সর্ববিদ্যা বিশারদ হবেন। রাতের কথা আর না বলাই ভালো। সাধ্য নেই অথচ সাধ অসীম! বাজ্জে! এবং বর্জ! এরা সবাই-ই কি একইরকম? কে জানে!

আসলে যেসব মানুষ জীবিকা নিয়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেন, জীবিকাকেই ‘জীবন’ বলে ভেবে নেন, জীবিকা যে, জীবনের কারণেই শুধু দরকার এই সরল সত্যটা না বোঝেন, জীবিকা ছাড়া অন্য আর কোনো ব্যাপারেই যাঁদের কোনো ঔৎসুক্য না থাকে, সেই মানুষেরাই অবসর নেওয়ার পরে ফেটে-যাওয়া টায়ারের মতন ঘষে ঘষে জীবনের পথে চলেন। পরনিন্দা-পরচর্চা আর ছিদ্রান্বেষণ ছাড়া তাঁদের আর কিছুই করার থাকে না। তাই কুসুমের মনে হয়, প্রসাদকে দেখে শিরীষদের শেখা উচিত। জীবিকাতে নিমজ্জিত থাকার সময়েই যাঁরা অবসর জীবনের স্বপ্ন না দেখেন, তখন কী করবেন, না করবেন তা না ভাবেন, তাঁদের মাথার গোলমাল আছে বলেই মনে হয়। অথচ এইসব মানুষের অধিকাংশই অত্যন্তই উচ্চশিক্ষিত। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আর্কিটেক্ট, আর্মি-অফিসার। শিক্ষার সঙ্গে সাধারণ বুদ্ধির সাযুজ্য কেন যে, একেবারেই থাকে না, তা ভেবে পান না কুসুম।

চিরন্তনবাবু অন্যরকম। মানুষটাকে খারাপ লাগে না। তিনি সত্যিই সাহিত্য-বোদ্ধা। তাঁর সঙ্গে বসে সহজ আনন্দে সময় কেটে যায়। কিন্তু হলে কী হয়! রোমান্টিক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে করতে মেয়ের ঘর এবং ছেলের ঘরে নাতি-নাতনি থাকা বুড়ো, কুসুম বাড়িতে একা থাকলেই ব্লাউজের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেন। ঘেন্নায় মরেন কুসুম। যখন বারোমাসেই ফুল ফুটত গাছে, যখন সুগন্ধে ম-ম করত পাড়া, পাখি ডাকত সর্বাঙ্গে তখন-ই এলি না আর এখন মরা এবং শুকনো গাছে হাত ঘষে লাভ কী?

আসলে পুরুষমাত্রই বোধহয় শরীর-সর্বস্ব। যাহা পাই তাহা খাই ভাব ছুকছুকুদের। ‘ভালোবাসা’ যে, কাকে বলে তা প্রসাদের মতন খুব কম পুরুষ-ই বোঝেন। “প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ, প্রেমের বেদনা থাকে সমস্ত জীবন।” –এই পঙক্তি দু-টির তাৎপর্য ক জনে বোঝেন? বিশেষ করে পুরুষেরা?

চিরন্তনবাবুর স্ত্রী চামেলি অত্যন্ত সুন্দরী, ব্যক্তিত্বসম্পন্না এবং বয়সেও চিরন্তনবাবুর চেয়ে বছর দশেকের ছোটো। তবুও কেন যে, অমন করেন চিরন্তনবাবু! কে জানে! হয়তো বৈচিত্র্যের প্রতি সব পুরুষের-ই এক দুর্নিবার আকর্ষণ থাকে। জানেন না কুসুম। কুসুম ভাবেন যে, চামেলি যদি জানতে পারে কখনো, তবে চিরন্তনের সর্বনাশ হবে। তবে কুসুম কখনো বলেননি। জীবনে অনেক বসন্ত পার করে এসে এখন বোঝেন কোন মানুষের যে, কোথায় দুঃখ তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। স্ত্রী-পুরুষ সকলের বেলাতেই এই কথা খাটে। কে যে, কেন কার কাছে আসে, তা শুধু সেই জানে। শরীরকে নিয়ে ভয়ের আজ আর কিছু নেই বলেই বুদ্ধিমতী কুসুম সহজে মমতাময়ী হতে পারেন। ‘আনন্দম। আনন্দম। আনন্দম।’ দু দিনের পৃথিবী। অত অল্পেতেই যদি কেউ সুখী হন তো করলেন-ই বা তাঁকে একটু সুখী। তাঁর তো হারাবার কিছু নেই। ভালোত্ব, খারাপত্ব, সতীত্ব, এসব কথার মানে বদলে গেছে। প্রেক্ষিত বদলে গেছে। তা ছাড়া, এই শব্দগুলি আপেক্ষিকও বটে।

কুসুম ফোন তুলে বললেন, হ্যালো।

মা তুমি ফোন করেছিলে?

হ্যাঁ কীসব বলল পিপি। তুই নাকি নীলকমলের সঙ্গে বাইরে যাচ্ছিস? কোথায় যাচ্ছিস?

হ্যাঁ মা। দুবরাজপুরে।

এই আগুন-গরমের মধ্যে?

কী করা যাবে? আমার ঘরেও যে, আগুন মা!

তার মানে?

সেসব অনেক কথা। ফিরে এসে তোমাকে সব বলব।

তা বলে নীলকমলের সঙ্গে কেন? তোর বাবার সঙ্গে যা। আমিও তো যেতে পারি। তোর বাবা দু-তিনদিন চিরন্তনবাবুদের বাড়ি খেয়ে নেবেন।

না মা। বিয়ে তো আমিই করেছিলাম তোমাদের মতের বিরুদ্ধে। লুকিয়ে রেজিস্ট্রি করে এসেছিলাম। পরে তোমরা না-হয় জাঁকজমক করে ফর্মাল বিয়ে দিলে। বিয়ে করার সময়ে যখন তোমাদের কথা শুনিনি, বিয়ে ভাঙার সময়েই বা তোমাদের জড়াতে যাব কেন?

বিয়ে ভাঙবেই, সে-বিষয়ে তুই এখানে বসেই এমন নিশ্চিন্ত হলি কী করে? নীলকমলের দুর্বুদ্ধিতে তুই এখনও চলছিস?

ওর বুদ্ধিই নেই মা। তার সুবুদ্ধি আর দুর্বুদ্ধি! তা ছাড়া, ধরসাহেব নিজে ফোন করেছিলেন। উনি চান যে, আমি নিজে একবার যাই। উনিই নীলকলমকে অর্ডার করেছেন, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। এটাও নীলকমলের অফিসের কাজ। সে শখ করে যাচ্ছে না আমার সঙ্গে।

ধরসাহেব ডাকলেন কেন? তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবেন নাকি বাজ-এর? কী জাহাঁবাজ মানুষ। অঢেল টাকা থাকলে আর এন. আর. আই. হলেই কি যা-খুশি তাই করা যায়?

মা-মা-মা! তুমি কেন না জেনে, ভদ্রলোককে দোষারোপ করছ! ভদ্রলোক কতখানি ভালো হলে…। এইসব ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কি অন্য কেউই, এত কনসার্নড হতেন? ওঁর কী প্রয়োজন ছিল!

নাঃ তুই কতটুকু বুঝিস? কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ হয়েছেটা কী?

তা তো আমি নিজেও জানি না। গিয়েই দেখব।

ওই নীলকমলও জানে না? আমি বিশ্বাস করি না।

হয়তো ও জানে কিন্তু ও হয়তো চায় না যে, ওর মুখে শুনে আমি বায়সড হই। ও আমার সঙ্গে বাজ-এর সম্পর্কটা যাতে না ভাঙে তাই চাইছে হয়তো।

জানি না। যা খুশি কর। কিন্তু মাত্র কদিন আগে এরকম একটি চিঠি যে-ছেলে তার স্ত্রীকে লিখতে পারে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাবে কেন, তা আমার বুদ্ধির বাইরে। তোর কি কমনসেন্সও নেই।

কে জানে মা? হয়তো নেই। কমনসেন্স-ই তো সবচেয়ে আনকমন। শোনো মা! কাল বিকেলে গিয়ে আমি পিপিকে তোমার কাছে রেখে আসব। ওকে আদর দিয়ে গোবর কোরো না। এমনিতেই তো যা, পাকা হয়েছে তা বলার নয়।

না, না, তোর চিন্তা নেই। আর কারোকেই আদর দেব না। একমাত্র কন্যাসন্তানকে আদর দিয়ে কী লাভ যে, হল আমার তা কী আর বুঝছি না।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সল্লি বলল, একটা স্যুটকেস-এ ওর প্যান্টি, নিমা, জামা, পাউডার, ক্রিম সব দিয়ে আসব ওর সঙ্গে। বড়োজোর তিনদিন লাগবে আমার ফিরতে। সম্ভব হলে ফোন করে জানাব যাতে, সোজা তোমাদের ওখানেই ফিরতে পারি। যেদিন যাব সেদিনও ফিরে আসতে পারি।

ঠিক আছে। কাল রাতে পিপি কী খাবে? তুই-ও আসবি যখন এখানেই খেয়ে যাস। রাতে থাকবি তো?

হ্যাঁ রাতটা তোমার ওখানেই কাটাব মা–-খুব ভোরে ট্যাক্সি নিয়ে হাওড়াতে যাব। গণদেবতা ধরে শান্তিনিকেতন। সেখানে স্টেশনে ধরসাহেব গাড়ি পাঠাবেন।

‘গণদেবতা’? সেটা আবার কী? ‘শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস-এর কথাই তো জানতাম।

হয়েছে। নতুন গাড়ি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নামে গাড়ির নাম। তারাশঙ্কর তো বীরভূমের-ই মানুষ ছিলেন।

ও। আর নীলকমল?

সে আমার জন্যে হাওড়া স্টেশনের বড়োঘড়ির নীচে অপেক্ষা করবে। টিকিটও তো ওর-ই কাছে।

ঠিক আছে।

কুসুম বললেন।

তারপর বললেন, হ্যাঁরে নিজে সন্তানের মা হয়ে কোন আক্কেলে তুই কাকের বাসাটা ভেঙে দিলি? ডিম পাড়বার আগে যদি, ভাঙতিস তাও বুঝতাম।

কত নীড়-ই তো ভেঙে যায়। মানুষের যদি এত ভাঙে তো কাকের নীড়ও না-হয় ভাঙল কিছু। তিক্ত গলাতে বলল, সল্লি।

কিন্তু ডিম পাড়ার পর! তুই কীরকম মা?

সল্লি একটু চুপ করে থেকে বলল, আমিও তো ডিম পেড়েছিলাম মা। ডিম ফুটে বাচ্চাও…। তবে আমার নীড় কেন ভাঙল? কেউ তো ভাঙল। নীড়-এ আমার আর বিশ্বাস নেই। কী মানুষের নীড়ে আর কী পাখির।

কুসুমের গলা কান্নাতে বুজে এল। কথা বলতে না পেরে চুপ করে রইলেন। সন্তানেরা আর কতটুকু বোঝে তাদের কষ্টে তাদের মা-বাবার কতখানি কষ্ট হয়! সল্লিও বুঝবে না। হয়তো জলপিপিও বুঝবে না বড়ো হয়ে।

তারপর কুসুম নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললেন, রোদ পড়লে তবে আসিস। এ-বছর যা গরম পড়েছে, মানুষ আর বাঁচবে না।

হুঁ।

বলল, সল্লি।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress