আমরা রাঙাটুলি পৌঁছেছিলাম পরদিন
চতুর্থ স্তর
আমরা রাঙাটুলি পৌঁছেছিলাম পরদিন বেলা দুটো নাগাদ। কর্নেলের হাবভাবে কোনও উদ্বেগ বা তাড়াহুড়ো ছিল না। স্টেশনটা মাঝারি ধরনের। অটোরিকশো, সাইকেলরিকশো, ঘোড়ার গাড়ি, এমনকি প্রাইভেট কারও ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা ঘোড়ার গাড়িই ভাড়া করেছিলাম।
অমরেন্দ্র সিংহরায়ের বাড়ি শহরের শেষ প্রান্তে। রাস্তা থেকে বাড়িটা বেশ উঁচুতে। বাউণ্ডারি ওয়ালে ঘেরা পুরনো আমলের দোতলা বিশাল বাড়ি। চারদিকে গাছপালা জঙ্গল হয়ে আছে। নিরিবিলি সুনসান পরিবেশ। গেট থেকে বাড়িটাকে হানাবাড়ি দেখাচ্ছিল। বললাম, এমন ভূতের পুরীতে ভূতেদের কালো বেড়াল সাজার দরকারটা কী? নিজমূর্তিতেই দেখা দিতে পারে।
কর্নেল হাসলেন। ভূতের স্বভাব হালদারমশাইয়ের মতো। ছদ্মবেশ না ধরলে পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ কীভাবে দেবে?
ঠিক বলেছেন। আমার ধারণা, এবার হালদারমশাইও তাঁর পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ দিতে নিশ্চয় ছদ্মবেশে এসেছেন।
কথাটা বলেই চমকে উঠলাম। পাঁচিলের ওপর সত্যিই একটা কালো বেড়াল গুটিসুটি হেঁটে চলেছে। সেই রক্তখেকো কালো বেড়ালটা নিশ্চয়। ব্যস্তভাবে বললাম, কর্নেল! সেই বেড়ালটা।
হ্যাঁ। দেখেছি। কিন্তু গেটে ভেতর থেকে তালা আটকে বাড়ির লোকেরা দুপুরবেলার ভাতঘুম দিচ্ছে নাকি? কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে ফের বললেন, রায়সায়েবের ঘরের জানালা বন্ধ। সুনন্দার ঘরটা দেখা যায় না এখান থেকে। সত্যকামের ঘরের জানালা বন্ধ থাকা স্বাভাবিক। এখন সে অফিসে। কিন্তু বেচু-মাই গুডনেস। কালো বেড়ালটা বেচুর ঘরের জানালা গলে ঢুকে গেল।
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। অমরেন্দ্রর মুখে রক্তখেকো কালো বেড়ালটার কথা শুনেছিলেন। দিনদুপুরে তার এই গতিবিধি ভৌতিক রহস্যকে জমজমাট করে ফেলল দেখছি। নাহ্। চিচিং ফাঁক-রহস্যের সঙ্গে এটার কোনও সম্পর্ক থাকতেই পারে না। বাড়িতে নির্ঘাৎ ভূতপ্রেত আছে। কর্নেল কথাটা বলব ভাবছি, সেই সময় দেখলাম, মধ্যবয়সী একটা রোগাপটকা লোক লাঠি উঁচিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কালো বেড়ালটাকে দেখা যাচ্ছিল না বটে, বোঝা গেল লোকটা বীরবিক্রমে তর্জনগর্জন করে তাকেই তাড়া করেছে।
একটু পরে সে ঘুরে দাঁড়াল এবং আমাদের দেখতে পেয়ে দৌড়ে এল। কর্নেল সহাস্যে বললেন, কী বেচু? দিনদুপুরে ভূত ঢুকেছিল ঘরে?
বেচু সেলাম ঠুকে ফতুয়ার পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলে দিল গেটের। কাঁচুমাচু মুখে বলল, কর্তামশাই দিদিকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়েছেন। বলে গেছেন, আপনি যে-কোনও সময় এসে যাবেন, লক্ষ্য রাখিস। কিন্তু স্যার, এদিকে এক বিচ্ছিরি উৎপাত।
কালো বেড়াল?
আমরা ভেতরে ঢুকলে বেচু গেটে আবার তালা আটকে দিয়ে বলল, হ্যাঁ স্যার। সবে এত ক্ষণে খেয়েদেয়ে উঠেছি, ব্যাটাছেলে কোত্থেকে এসে লুকোচুরি খেলতে শুরু করেছে। রোজ যখন-তখন এসে জ্বালাচ্ছে। কার বেড়াল কে জানে! তবে সাংঘাতিক বেড়াল স্যার। রক্ত খায়।
প্রাঙ্গণ পেরিয়ে বেচু আমাদের হলঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারপর বলল, গতবার এসে যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘরেই আপনাদের থাকবার ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু আমারও ভুল, দিদিমণিরও ভুল। চাবি দিদিমণির কাছে। এখানেই একটু জিরিয়ে নিন বরং। আমি খাওয়াদাওয়ার যোগাড় করি। দেরি হবে না।
সে সুইচ টিপে ফ্যান চালিয়ে দিল। কর্নেল বললেন, আমরা ট্রেনেই খেয়ে নিয়েছি বেচু। তুমি বসো। রায়সায়েব ফেরা না পর্যন্ত গল্প করা যাক।
বেচু মেঝেয় বসল। কর্তামশাই হরনাথবাবুর বাড়ি গেলেন। আপনি তো স্যার চেনেন হরনাথবাবুকে। ওঁকে কাল থেকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনছি, মাঠের ফার্ম থেকে ডাকাতরা ফল নিয়ে গেছে। আজকাল রাঙাটুলিতে ডাকাতদেরই রাজত্ব।
কর্নেল বললেন, কালো বেড়ালটার গল্প শোনা যাক বেচু! বেড়ালটা নাকি রাত্রিবেলা এসে এই ঘরে রক্ত খাচ্ছিল? এ ঘরে রক্ত এলো কোথা থেকে?
বেচু বিবর্ণ কার্পেটের একটা কোণার দিকে আঙুল তুলল। ওইখানে একটুখানি রক্ত পড়ে ছিল। কিসের রক্ত, কী করে ওখানে এল–আর কালো বেড়ালটাই বা কোত্থেকে এসে সেই রক্ত চাটছিল, কিছুই বোঝা যায় না। তবে স্যার, কিছুদিন থেকে বাড়িতে ভূতপেরেতের উৎপাত হচ্ছে, তা-ও ঠিক। সে জন্যেই দিদিমণি কর্তামশাইকে কলকাতা যেতে বলেছিল। আপনি গতবার এসে উড়ো চিঠি লিখে ভয় দেখানোর জন্য যোগেনবাবুকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন। এবার কিন্তু উড়োচিঠি নয় স্যার। রাতবিরেতে নানারকম শব্দ। তারপর ওই বেড়ালটা। এবার স্যার ভূতপেরেতের কাণ্ড।
রোজ রাতেই কি ভূতপ্রেতে জ্বালাচ্ছে? গত রাতে জ্বালিয়েছিল?
বেচু বলল, কদিন থেকে একটু কমেছে। তবে উৎপাত একেবারে বন্ধ হয়নি। কিন্তু ওই কালো বেড়ালটার সাহস খুব বেড়ে গেছে। অবাক লাগে স্যার! চোখের পলকে নিপাত্তা হয়ে যায় ব্যাটাছেলে।
কিন্তু তোমাদের অ্যালসেসিয়ান কুকুরটা কী করে? তাকে তা দেখতে পাচ্ছি না।
বেচু বিমর্ষ মুখে বলল, কুকুরটা গতকাল মারা গেছে স্যার।
সে কী! কী ভাবে মারা গেল?
ভেতর ভেতর অনেকদিন থেকে অসুখে ভুগছিল। আমরা বুঝতেই পারিনি। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল কদিন থেকে। তারপর কাল রাত্তিরে কখন মারা পড়েছে, লক্ষ্য করা হয়নি। বাড়ির পেছনদিকে মরে পড়ে ছিল। ভোরবেলা ওপর থেকে দিদিমণি দেখতে পেয়েছিলেন। কর্তামশাইয়ের আদরের কুকুর। উনি তো কেঁদে কেটে অস্থির। এদিকে ওঁর বন্ধু হরনাথবাবু নিপাত্তা। কর্তামশাই পাগল হতে বাকি। সেজন্যেই দিদিমণি ওঁর সঙ্গ ছাড়ছেন না।
বেচু উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। জিভ কেটে বলল, ভুল হয়ে গেছে। কর্তামশাই আপনার জন্য কফি এনে রেখেছেন। আপনি কফি খেতে ভালবাসেন। আগে কফি করে আনি।
সে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। হলঘরের ভেতরটা লক্ষ্য করছিলাম এতক্ষণ। সেকেলে আসবাবে সাজানো। দেশের বিখ্যাত নেতাদের অয়েল পেইনটিং চারদিকের দেয়ালকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। সিলিঙের লোহার কড়িবরগায় মরচে ধরে গেছে। বাড়িটা খুবই পুরনো তাতে সন্দেহ নেই। প্রকাণ্ড দুটো টিকটিকি লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছে। দেয়াল থেকে বরগা, বরগা থেকে দেয়ালের ছবির আড়ালে তারা ছুটোছুটি করছে। ঘুলঘুলিতে চড়ুইয়ের বাসাও দেখা যাচ্ছিল। এক পাশে তিনটে বইয়ের আলমারি। কারুকার্যখচিত লম্বাচওড়া একটা পেতলের ফুলদানিতে কবেকার ফুলের গোছা শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। সবখানেই অযত্নের ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। পর্দাগুলোও বিবর্ণ এবং জীর্ণ। অমরেন্দ্রবাবুর মেয়ে সুনন্দা কি কিছুতে নজর রাখেন না? মেয়েদেরই নাকি ঘরদোর সাজানোগোছানোর স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে। সুনন্দা হয়তো অন্যরকম।
বরগার খাঁজ বেয়ে একটা টিকটিকি আরশোলাকে তাড়া করেছে। আরশোলাটা ফরফর করে উড়ে নেহেরুজির ছবির ফ্রেমে বসল। ছবির পাশেই সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সেই সিঁড়ি এবং দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় ছাদ থেকে ভেঁড়া বিদ্যুতের একটা কলো তার ঝুলছে। লক্ষ্য করলাম তারটা নেমেছে বরগার খাঁজ থেকে। অথচ আলোপাখার ওয়্যারিং দেয়ালের শীর্ষে আলাদা হয়ে সাঁটা আছে। কালো তারটার দিকে তাকিয়ে ভাবছি, ওটা কিসের জন্য টাঙানো হয়েছিল, এমন সময় কর্নেল আস্তে বললেন, ভূতের কারবার জয়ন্ত।
চমকে উঠে বললাম, কৈ ভূত?
তুমি যাকে মন দিয়ে দেখছ।
হেসে ফেললাম। ছেঁড়া কালো তারটা কি ভূতেরই ছদ্মবেশ?
সম্ভবত। কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ভূতেরা বহুরূপী। ইচ্ছে করলেই যে কোনও রূপ ধরতে পারে। বিশেষ করে কালো রঙ ভূতেদের খুব পছন্দ। কারণ তারা অন্ধকারের প্রাণী।
একটা ছেঁড়া কালো তার নিয়ে মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। কর্নেলের কৌতুকে কান দিলাম না। বললাম, বাড়িতে মানুষ বাস করে বলে মনে হয় না। এত অযত্নের ছাপ কেন?
কর্নেল একটু হেসে বললনে, আগের বার এসে বসকিছু ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন এবং সাজানোগোছানো দেখেছিলাম। এবার দেখছি অন্যরকম। এর কারণ হয়তো ভূত তার মানে, রায়সায়েবের বাড়িকে ভূতে ধরেছে।
বেচু ট্রেতে কফির পেয়ালা সাজিয়ে ঘরে ঢুকছিল। কর্নেলের কথা শুনে বলল, যা বলেছেন স্যার! কতবার কর্তামশাইকে বলেছি, ওঝা ডেকে এর বিহিত করুন। কিংবা বামুন ডেকে শান্তিস্বস্ত্যয়নের ব্যবস্থা করুন। কর্তামশাই কান করছেন না। নিচের ওই কোণার ঘরটাতে একা থাকি। ওঁরা তো ওপরতলায় থাকেন। সারা রাত ঘুমুতে পারিনে। আর কিছুদিন দেখেই আমি কেটে পড়ব স্যার।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, আমি ভূতের মন্ত্র জানি। দেখ না, আজ রাতেই ভূত জব্দ করে ফেলব।
বেচু হাসল। কিন্তু আগে কালো বেড়ালটাকে জব্দ করা দরকার স্যার!
করব। তুমি ততক্ষণ এক কাজ করো। এখনই হরনাথবাবুর বাড়ি গিয়ে তোমার কর্তামশাইকে খবর দাও। আমাকে একবার বেরুতে হবে। রায়সায়েবের সঙ্গে দেখা না করে বেরুতে পারছি না।
বেচু বলল, গেটের দিকে একটু নজর রাখবেন যেন। আমি খবর দিয়ে আসি।
সে চলে গেল হন্তদন্ত হয়ে। কর্নেল বললেন, গেটের দিকে নজর তুমিই রাখো অন্ত। কাকেও আসতে দেখলে আমাকে ডাকবে।
উনি উঠে দাঁড়ালে বললাম, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
ওপরে গিয়ে বাইনোকুলারে বাড়ির চারপাশটা একবার দেখে নিই।
কিন্তু কফি পড়ে রইল যে।
থাক, এখনই আসছি।
কর্নেল সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উধাও হয়ে গেলেন। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। রক্তখেকো কালো বেড়ালটা এসে যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপর? এমন একটা পোভড়া বাড়ির মতো পরিবেশে সবই সম্ভব।
কর্নেলের ফিরতে দেরি হচ্ছিল। আমার অস্বস্তিটাও তত বেড়ে যাচ্ছিল। কতক্ষণ পরে কর্নেল নেমে এলেন। বললাম, কালো বেড়ালটাকে দেখতে পেলেন নাকি?
নাহ্। তবে দুটো ভূত আমি পকেটে পুরে এনেছি।
তার মানে?
কর্নেল সকৌতুকে প্যান্টের একটা পকেটে হাতের চাপ দিয়ে বললনে, মন্ত্রপূত রুমালের ভেতর দু-দুটো ভূত জব্দ হয়ে চুপ করে আছে। বলে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন।
বললাম, হেঁয়ালি না করে বলবেন কি?
কর্নেল বললেন, চুপ! ওই দেখ, কালো বেড়ালটা আবার পাঁচিলে উঠেছে।
জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, পাঁচিলের ওপর ঝুঁকেপড়া গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে কালো বেড়ালটা আবার গুটিসুটি হেঁটে আসছে। আমি উঠতে যাচ্ছিলাম। কর্নেল আমাকে টেনে বসিয়ে দিলেন। বললেন, ওর লক্ষ্য হলো কিচেন। অবশ্য বেড়াল মাত্রেরই লক্ষ্য হলো কিচেন। চুপচাপ বসে থাকো। দেখা যাক, ও কী করে।
কিছুক্ষণ পরেই পাশের কোনও ঘরে থালা-বাসন পড়ার ঝনঝন শব্দ হলো। নিঝুম নিরিবিলি বাড়িতে শব্দটা চমকে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কর্নেল উঠে গিয়ে একটা ঘরের পর্দা তুললেন। ওই ঘর থেকেই বেচুকে কফি আনতে দেখেছিলাম।
কর্নেলকে বলতে শুনলাম, না, না! ভয় কোরো না। কী খুঁজছ, বুঝতে পেরেছি। এক মিনিট।
উনি ঘরে ঢুকে গেলে ব্যাপারটা দেখার জন্য উঠে পড়লাম। পর্দা তুলে দেখি, কর্নেল ফ্রিজ খুলে একটা ছোট্ট বোতল বের করছেন। বেড়ালটা জানালার গরাদের ফাঁকে বসে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে। কর্নেল বোতলের ছিপি খুলে ডাইনিং টেবিলের ওপর কিছু ঢালছিলেন। বললাম, কী খেতে দিচ্ছেন ওকে?
টমাটো সস। বলে কর্নেল ফ্রিজে বোতলটা ঢুকিয়ে রাখলেন। মুচকি হেসে বললেন, চলল! শ্রীমান কালো ভূত খাওয়াদাওয়া করুক। সামনে থাকলে লজ্জা পাবে।
হলঘরে ফিরে এসে সোফায় বসে বললাম, বেড়াল টমাটো সস খায় কস্মিনকালে শুনিনি। তাছাড়া আপনি কেমন করে জানলেন ও টমাটো সস খুঁজছে?
ডাইনিং টেবিলের এঁটো থালায় টমাটো সসের চিহ্ন দেখলাম। চাটতে গিয়েই থালাটা নিচে পড়েছে। আবার থাবায় থালাটা আঁকড়ে ধরে চাটতে যাচ্ছে, সেই সময় আমি গিয়ে পড়েছি। দেখামাত্র বুঝলাম টমাটো সস ওর প্রিয়।
নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস! তা হলে সে রাত্রে এই কার্পেটের ওপর–
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, টমাটো সসই খাচ্ছিল। রাত্রিবেলা দেখলে রক্ত চাটছে বলে ভুল হতেই পারে। তাতে বেড়ালটার রঙ কালো এবং সে-রাত্রে একটু আগেই ভুতের উৎপাত যখন শোনা গেছে।
তাহলে কার্পেট ধুয়ে সাফ করার সময় বেচুর সেটা টের পাওয়া উচিত ছিল।
ছিল বৈকি।
কিন্তু বেচু এখনও বলছে রক্ত।
ভূত ওকে বলতে বাধ্য করেছে। বেঁচুকে ভূতের চেলা বলতেও পারো।
কে ভূত?
যে রাতবিরেতে ভয় দেখায় রায়সায়েবকে।
কেন ভয় দেখায়?
ডিস্কোর হুকুমে?
চমকে উঠে বললাম, ডিস্কো।
হ্যাঁ! ডিস্কো। ডিস্কোর লোক কলকাতায় যেমন, তেমনই রাঙাটুলিতেও আছে। ভুলে যাচ্ছ কেন হালদারমশাইয়ের কথা। তাঁকে ডিস্কোর লোকেরাই বেঁধে বলি দিতে যাচ্ছিল না?
এ বাড়িতে ডিস্কোর লোক আছে তাহলে–যাকে আপনি ভূত বলছেন। কিন্তু কে সে?
কর্নেল চুরুট ধরাচ্ছিলেন। ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আর ও সব কথা নয়। ওই দেখ, রায়সায়েব এসে পড়েছেন।
আস্তে বলালম, একটা কথার জবাব দিন। বেড়ালটার সঙ্গে তাহলে বেচুর ভাব থাকারই কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম, সে লাঠি নিয়ে ওকে তাড়া করেছে।
ভাব থাকলেও সব সময় এসে টমাটো সসের জন্য ম্যাঁও করবে, এটা বেচু বরদাস্ত করবে কেন? তাছাড়া কালো বেড়ালকে অপয়া মনে করা হয়। কর্নেল উঠে বারান্দায় গেলেন। যেন নিজের বাড়িতে বাইরের লোককে অভ্যর্থনা করছেন, এমন ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে বললেন, হ্যালো রায়সায়েব! সুনন্দা কেমন আছ? আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। হাজারটা ঝামেলা নিয়ে থাকি।
অমরেন্দ্র কর্নেলের করমর্দন করলেন। সুনন্দা কর্নেলের পায়ে প্রণাম করলেন। প্রৌঢ়া মহিলা। এখনও আঁচ করা যায়, যৌবনে লাবণ্যময়ী ছিলেন। কিন্তু মুখে কী যেন যন্ত্রণার স্থায়ী ছাপ পড়ে আছে।
অমরেন্দ্র বললেন, ওদিকে এক সর্বনাশ! হরনাথকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না কাল সকাল থেকে। ওর বউ কাল সন্ধ্যায় হরনাথের লেখা চিঠি পেয়েছে। চিঠিটা–কী বলব? বোকা মেয়ে। ভোরে কি এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ এসেছে কলকাতা থেকে। তাকে দিয়েছে বলল। বুঝুন অবস্থা।
কী লেখা ছিল চিঠিতে?
সুনন্দা কর্নেলের পাশ কাটিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়েই হলঘরে ঢুকে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, উনি সোফার দিকের একটা ঘরের দরজার তালা খুলছেন।
অমরেন্দ্র চাপা স্বরে বললেন, হরনাথের বউ বরাবর বোকা। বোকা আর ছিচকাঁদুনি। আসলে সন্তানাদি নেই। বাড়িতে একা থাকে। এদিকে হরনাথ পড়ে থাকে নদীর ধারে ফার্মে। তো চিঠির সব কথা গুছিয়ে বলবে কী, কেঁদেই অস্থির। যেটুকু বুঝলাম, তাতে মনে হলো, হরনাথ লিখেছে, তার জন্য চিন্তার কারণ নেই। আজ রাত্রেই বাড়ি ফিরবে। তবে ওর ফার্মের একটা গাছের ডগায় নাকি মস্ত বড় একটা পরগাছা আছে, সেটা ডাল থেকে উপড়ে থলেয় ভরে সন্ধ্যার পর ভবানীমন্দিরে রেখে আসতে হবে। আমি তো এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না।
কথা বলতে বলতে অমরেন্দ্র হলঘরে ঢুকলেন। সুনন্দা সেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, কর্নেলসায়েবের ঘর খুলে দিয়েছি।
বলে উনি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলেন। অমরেন্দ্র বললেন, চলুন। ঘরে বসে আলোচনা করা যাক। আসুন জয়ন্তবাবু।
.
ঘরটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। জানালার পর্দা সরানো। বাইরে ঘাস আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা প্রাঙ্গণ। তার ওধারে জরাজীর্ণ পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারে বিশাল উঁচু গাছ। ঘরটা বেশ সাজানোগোছানো দেখে ভাল লাগল। পেছনের দিকে দরজা এবং একটুকরো খোলা বারান্দা আছে।
কর্নেল বললেন, হরনাথবাবু লেখেননি কেউ ওঁকে আটকে রেখেছে?
অমরেন্দ্র বললেন, লিখেছে। সেটাই তো আমার অবাক লাগছে। কে ওকে আটকে রাখবে? একটা পরগাছা কেনই বা ভবানীমন্দিরে পৌঁছে দিতে হবে? পুলিশে খবর দিলে নাকি ওর বাড়ি ফেরা হবে না। এই সব কথা লিখেছে। আমার কিন্তু খুব রাগ হলো শুনে। আমার সঙ্গে কনসাল্ট করা উচিত ছিল। কাল বিকেলে খবর নিতে গিয়েছিলাম। হরনাথ, তখনও ফেরেনি শুনে বলে এসেছিলাম, সন্ধ্যার পরও খোঁজ না পেলে খবর দিও? দেয়নি। আজ সকালেও দেয়নি। দুপুরে হরনাথের ফার্মের মদনবাবুর সঙ্গে দেখা হলো রাস্তায়। জিজ্ঞেস করলে বলল, বাবু এখনও বাড়ি ফেরেনি। তাই সুনন্দাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলাম। গিয়েই এইসব কথা শুনে অবাক।
কর্নেল বললেন, বেচুকে কোথায় পাঠালেন?
কোথাও পাঠাইনি। আমরা রিকশোয় এলাম। ও হেঁটে আসছে। অমরেন্দ্র একটু হাসলেন। কফি চাই তো? সুনন্দা আছে, ভাববেন না।
কফি বেচু খাইয়েছে। এখন আর দরকার হবে না।
অমরেন্দ্র আবার চাপাস্বরে বললেন, পরগাছার ব্যাপারটা সন্দেহজনক। আপনার মনে আছে অনাথবন্ধুর কথা? সেই যে পাগলা প্রফেসর–
হ্যাঁ। অনাথবন্ধু রায়। ওর মেয়ে মৃদুলার সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির বিয়ে হয়েছে না?
চেনেন নাকি ওদের? চিনি।
নাটকের দল আছে ইন্দ্রজিৎবাবুর।
অমরেন্দ্র বাঁকা মুখে বললেন, ধানবাদের ছেলে। বটুকের একনম্বর চেলা ছিল। তা হলেই বুঝুন কী জিনিস। আজকাল পলিটিক্স ছেড়ে নাটক করছে বুঝি? খুব ভাল। তো যা বলছিলাম, অনাথবন্ধুর কিন্তু পরগাছার ওপর খুব লোভ আছে দেখেছি। পাগলার কাণ্ড। হরনাথের ফার্মে কোনও ভাল পরগাছা দেখে তারই লোভে ওকে আটকে রাখেনি তো?
কর্নেল হাসলেন। পরগাছার নেশা তো আমারও আছে। তাই বলে—
অমরেন্দ্র বাধা নিয়ে বললেন, আহা! আপনি তো অনাথবন্ধুর মতো উন্মাদ নন।
ভদ্রলোক এখন কোথায় আছেন?
জানি না। রাঙাটুলির বাড়িটাতে মৃদুলার মেলোমশাই আর মাসি থাকেন। নবাদেও নাকি একটা বাড়ি আছে। অমরেন্দ্র সন্দিগ্ধভাবে বললেন, আমার মনে হচ্ছে, এ অনাথবন্ধুরই কীর্তি। বুঝলেন না? সায়েন্টিস্ট লোক। হয়তো সায়েন্সের কোনও গবেষণার জন্য পরগাছাটা দরকার। এমনও হতে পারে, হরনাথের কাছে চেয়েছিল। হরনাথ দেয়নি। তাই ওকে কৌশলে কোথাও আটকে রেখেছে।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, একটা কথা। হরনাথবাবু তো আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু?
ঘনিষ্ঠ মানে? একেবারে হাফ পেন্টুল পরা বয়স থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। কেউ কারও কোনও কথা গোপন রাখি না। আপনি স্বচক্ষে দেখেও গেছেন দুজনের মধ্যে কী সম্পর্ক।
সম্প্রতি হরনাথ কি কোনও জিনিস আপনাকে রাখতে দিয়েছিলেন?
অমরেন্দ্র একটু চমকে উঠলেন। আস্তে বললেন, জিনিস, মানে একটা ভিডিও ক্যাসেট। ওই যে সব বিলিতি অশ্লীল ক্যাসেট পাওয়া যায়–
ব্লু ফিল্মের ক্যাসেট?
তা-ই বলেছিল হরনাথ। ওর বাড়িতে ভি সি পি-টিভি এ সব আছে। বউ বুড়ি হলে কি হবে? হরনাথের আবার একটু-আধটু… হাসলেন অমরেন্দ্র। বলছিলাম না? সন্তানাদি নেই। ওর বউ ওইসব দেখে সময় কাটায়। তো হরনাথ বলেছিল, ভুল করে এই অশ্লীল ক্যাসেটটা কিনে ফেলেছে। পুলিশ নাকি এই সব ক্যাসেট দেখলেই অ্যারেস্ট করবে। আমার বাড়িতে টিভি আছে। সতুর ঘরেই থাকে। আমার ওসব দেখতে ভাল লাগে না। তবে নাহ্। ভি সি পি নেই। সতু বলছিল, শীগগির একটা কিনবে।
সত্যকাম?
হ্যাঁ। অমরেন্দ্র গম্ভীর হলেন। যাইহোক, হরনাথ প্যাকেটে ভরে চুপিচুপি আমাকে রাতে দিয়েছিল।
কতদিন আগে?
এই তো–গত মাসের শেষাশেষি।
এখন সেটা আছে?
না। আজ শুক্করবার। গত শুক্কুরবার সন্ধ্যায় হরনাথ এসে ফেরত নিয়ে গেল। বলল, খদ্দের পেয়েছে। বেচে দেবে।
বাইরে বেচুর সাড়া পাওয়া গেল। অমরেন্দ্র হাঁকলেন, বেচু।
বেচু পর্দা তুলে বলল, দিদিমণি বাজারে যেতে বলছেন। এদিকে সাইকেলের চাকায় লিক। আবার হেঁটে যেতে হবে। বলুন, আপনার কিছু আনতে হবে নাকি।
অমরেন্দ্র পকেট থেকে একটা প্রেসক্রিপশন বের করে দিয়ে বললেন, নবীন বলেছিল–ঢ্যারা দেওয়া আছে দেখবি, ওই ওষুধটা এবেলা আসবে। নিয়ে আসবি যেন।
বেচু চলে গেল। অমরেন্দ্র হাসলেন। ঘুমের ওষুধ যে! সেটা কোনও দোকানে পাওয়া যায় না।
কর্নেল বললেন, ঘুমের ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়।
ডাক্তার বলল, ঠিক ঘুমের ওষুধ নয়। ট্রাংকুলাইজার। আসলে রাতবিরেতে ওই সব ভুতুড়ে কাণ্ডের জন্য শরীরের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। এদিকে আপনিও আসছেন না।
ভৌতিক উৎপাত বন্ধ হয়েছে আশা করি।
অমরেন্দ্র জোরালো হাসলেন। আপনি আসছেন শুনেই হয়তো পালিয়েছে। কদিন থেকে আর কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না।
কালো বেড়ালটা?
বেড়ালটাকে মাঝে মাঝে দেখতে পাই। তবে আমার ধারণা, ওটা বেড়ালই বটে। বলে অমরেন্দ্র আবার গম্ভীর হলেন। সেই কাগজটার রহস্য উদ্ধার করতে পারলেন?
রহস্যের ঘাঁটি তো এখানে। দেখা যাক্। কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনি আপনার শ্যালকের ছেলে রথীনবাবুর স্ত্রীকে কি চিনতেন?
অমরেন্দ্র বাঁকা মুখে বললেন, খারাপ মেয়ে। হরনাথের দোষ ছিল না। হরনাথ এতটুকু থেকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছিল। কিন্তু খারাপকে ভাল করে সাধ্য কার? রথীনকে নিয়ে ভেগে গেল। আর বটুকও এমন লোক, পলিটিক্সই ওকে খেয়েছিল। রথীনকে কলকাতায় ব্যবসা করতে টাকা যোগাত। কিন্তু খবরও নিত না ছেলে সত্যি ব্যবসা করছে, না ফুর্তি মেরে টাকা ওড়াচ্ছে। শেষে হারামজাদি মেয়েটাই রথীনকে লোক দিয়ে মার্ডার করিয়েছিল। বটুক এমন পাপিষ্ঠ যে খবর শুনেও চুপ করে রইল। সাধে কি আমি ওঁকে ঘেন্না করতাম।
চন্দ্রিকাকে রাঙাটুলিতে শেষ কবে দেখেছেন?
অমরেন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, চন্দ্রিকা–আপনি চন্দ্রিকাকে চিনতেন নাকি?
একটু-আধটু।
পরশু হরনাথ এসেছিল। বলছিল, চন্দ্রিকা নাকি মার্ডার হয়েছে। হতোই। জীবন নিয়ে জুয়োখেলা–মেয়ে হয়ে! পাপের শাস্তি। কী বলেন?
কনেল বললেন, চন্দ্রিকা হরনাথবাবুর কাছে সম্প্রতি এসেছিল কি না জানেন? এলে হরনাথবাবু আপনার কাছে নিশ্চয় গোপন কবেন না?
অমরেন্দ্র চাপা শ্বাস ছেড়ে বললেন, মাসখানেক আগে রাত্রে এসে রাত্রেই কলকাতা চলে গিয়েছিল। হরনাথ বলেছিল, বাবা-মায়ের জিনিসপত্র নিতে এসেছিল চন্দ্রিকা।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, এক চক্কর ঘুরে আসি।
অমরেন্দ্র ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিছু খাওয়া-দাওয়া না করে বেরোবেন কী! সুনন্দা হয়তো আপনাদের জন্য খাবার তৈরি করছে। এক মিনিট!
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, পৌনে পাঁচটা বাজে। এখনই না বেরোলে ময়। আপনি সুনন্দাকে বলুন, ফিরে এসে একেবারে ডিনারে বসব। জয়ন্ত, উঠে পড়ো। ….
নিচের রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, তা হলে চিচিং ফাঁক রহস্য ফাঁস হলো।
অবাক হয়ে বললাম, কৈ ফাঁস হলো?
ব্লু ফিল্মের ক্যাসেট।
তার মানে?
তার মানে চিচিং ফাঁক রহস্য। কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন। একটা রিকশো পেলে ভাল হতো। হরনাথবাবুর ফার্ম প্রায় দেড় কিমি দূরে।
কিন্তু ব্লু ফিল্মের ক্যাসেট–
ব্রিটিশ আর্মির গুপ্তধনের নকশা ওটার মধ্যেই আছে। ওটা ক্যাসেট নয়। কোনও শক্ত ধাতু দিয়ে তৈরি একই গড়নের আধার।
কী সর্বনাশ। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
সর্বনাশের মুখে দাঁড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়, ডার্লিং! চটপট হাঁটো!
বেলা পড়ে এসেছে। রোদের রঙ ঝিমধরা। এখনই গাছপালা আর উঁচু-নিচু টিলার মাথায় আবছা কুয়াশা ঘনিয়ে এসেছে। কিছুটা পথ দুধারে ঘন জঙ্গল। তারপর বাঁ দিকে সামান্য দূরে কয়েকটা একতলা ঘর এবং কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া ফসলের খেত দেখা গেল। বেড়াটা রাস্তার সমাালে এগিয়ে গেছে। আরও কিছুটা নার পর একটা ছোট্ট নদী দেখতে পেলাম। রাস্তাটা বাঁক নিয়ে কাঠের পোল পেরিয়ে গেছে। কাঠের পোলে দাঁড়িয়ে কর্নেল বাইনোকুলারে ফার্মটা দেখতে থাকলেন। কোথাও জনমানুষ নেই। ফার্মের জমিতেও কোনও লোক নেই। থাকলেও খালি চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম না।
বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল একটু হেসে বললেন, হালদারমশাই শেষ রক্ষা করতে পারেন কি না দেখা যাক।
কৈ হালদারমশাই?
ফার্ম হাউসের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন আর এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে হাতমুখ নেড়ে গল্প করছেন। হরনাথবাবুর স্ত্রী ছাড়া আর কে হতে পারেন?
দেখি। বাইনোকুলারটা দিন।
কর্নেল বাইনোকুলার দিলেন না। বললেন, ডিস্কোর চেলাদের চোখে পড়ে যাব। চলল, নদীর ধারে নেমে যাই। ফার্মের একটা গেট আছে নদীর ধারে। ভেতরে ঢোকা যায় কি না চেষ্টা করা যাবে।
নিচে বড় বড় পাথর এবং ঝোপঝাড়ের আড়ালে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম। মাঝেমাঝে কর্নেল বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিচ্ছিলেন। কিছুদূর চলার পর ফার্মের কাঁটাতারের বেড়া দেখা গেল। তারপর লোহার গরাদ দেওয়া ছোট একটা গেট চোখে পড়ল। গেটের দুপাশে ঘন ঝোপঝাড়। কর্নেল ইশারায় গুঁড়ি মেরে বসতে বললেন। নিজেও বসলেন। তারপর বাইনোকুলারে চোখ রেখে ফার্মের ভেতরটা দেখতে থাকলেন।
একটু পরে বললেন, হালদারমশাই মই যোগাড় করেছেন। হয়তো ফার্ম হাউসেই মইটা ছিল। কিন্তু উনি সঠিক গাছ এবং সঠিক অর্কিড চিনতে পারবেন কি?
পিঠের কিটব্যাগটি নামিয়ে কর্নেল চেন খুলে একগোছা চাবি বের করলেন। গেটের ওপাশে লটকানো লাটার মধ্যে কয়েকটা চাবি ঢোকানোর চেষ্টা করে বললেন, নাহ্। বেয়াড়া তালা। বরং কাঁটাতার কেটেই ঢোকা যাক।
কিটব্যাগ থেকে বেঁটে এবং চ্যাপ্টা একটা সাঁড়াশির মতো জিনিস বের করে পাশের কয়েকসারি তার কেটে ফেললেন। তারপর তারগুলো দুমড়ে সরিয়ে বললেন, কুইক! গুঁড়ি মেরে এস। বাঁদিকের ঝোঁপের আড়ালে এগোতে হবে।
একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, এই বিশ্রী অ্যাডভেঞ্চার না করে সোজা ফার্ম হাউসের বড় গেট দিয়ে ঢুকলে কী ক্ষতি হতো?
ডিস্কোর লোকেরা ওখানেই নজর রেখেছে। কারণ অর্কিডটা কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কি না, তারা নিশ্চয় দেখতে চাইবে। সেখানে আমার এই মার্কামারা চেহারা হরনাথবাবুর পক্ষে ক্ষতিকর। ভুলে যেও না, ডিস্কো আমাকে জানিয়ে রেখেছে। হরনাথবাবুকে কেন সে কিডন্যাপ করল। কর্নেল দাড়ি থেকে একটা পোকা বের করে একটু হাসলেন। দাড়ির এই সমস্যা! পোকামাকড় নিয়ে একটুআধটু চৰ্চা করি বলেই কি না জানি না, ওরা আমার দাড়িতে ঢুকে থাকতে ভালবাসে।
আলে দ্রুত কমে যাচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে সাপের ভয়ে চমকে উঠছি। কিন্তু এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। আমার বৃদ্ধ বন্ধু নাকি সাপের গন্ধ টের পান। ব্যাপারটা সত্য বা মিথ্যা যা-ই হোক, এ পর্যন্ত কখনো এধরনের অ্যাডভেঞ্চারে সাপের পাল্লায় পড়িনি।
এদিকটায় পাথর পড়ে আছে জায়গায় জায়গায়। পাথরের ফাঁকে ঝোপ গজিয়েছে। পাথরের জন্যই এ দিকটায় চাষবাস করা হয়নি। ক্রমশ একটা দুটো করে গাছ দেখা গেল। তারপর ঘন গাছের জঙ্গল। তবে তলাটা পরিষ্কার। কোনও ঝোপঝাড় নেই। অসমতল মাটি। বড় বড় পাথর। হালদারমশাই ফার্মের এই জঙ্গলটার কথাই বলেছিলেন।
গাছপালায় পাখিরা তুমুল হল্লা জুড়েছে। আবছা আঁধারে গুঁড়ি মেরে এগোতে এগোতে পায়ে আর পিঠে ব্যথা ধরে যাচ্ছিল। অবশেষে কর্নেল থামলেন। চাপা স্বরে বললেন, হালদারমশাই কাছাকাছি কোথাও আছেন। কারও সঙ্গে কথা বলছেন। ফার্মের লোকেদের মধ্যে ডিস্কোর চর আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। না থাকলে ডিস্কো মুক্তিপণ হিসেবে পরগাছা দাবি করত না। সে জেনে ফেলেছে, কোথায় জিনিসটা লুকোনো আছে। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। গাছের গুঁড়ির আড়ালে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেলেন। ওঁকে অনুসরণ করলাম।
এতক্ষণে হালদারমশাইয়ের কথা কানে এল। ভাইটি! দ্যাখবেন য্যান পাও হড়কাইয়া না যায়। ওঠেন! টাইম নষ্ট করবেন না।
কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, হালদারমশাই করছেন কী! নিজে মইয়ে উঠছেন না। লোকটা যদি ডিস্কোর চর হয়, তা হলে কেলেংকারি!
হালদারমশাইয়ের কথা শোনা গেল। ডগায় ওঠেন। এক্কেরে পিকে। কাটারি দিয়া গোড়ায় কোপ মারবেন। নিচে ফ্যালাইবেন। হেভি পরগাছা।
সামনে কোথাও কোনও গাছের ডগায় কাটারির কোপ মারার শব্দ শোনা গেল। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, জিনিসটা ছিটকে পড়ে যেতে পারে। খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। করছেন কী হালদারমশাই? এস তো, দেখি।
আমরা কয়েক পা এগিয়েছি, সামনে গাছের ডালপালার ভেতর সড়সড় শব্দ হলো। তারপর টর্চের আলো জ্বলে উঠল। হালদারমশাই বললেন, যাঃ! আটকাইয়া গেল যে ভাইটি। এক কাম করেন। সিঁড়ি থাক। ডালে পাও দিয়া-হঃ। আমি আলো দেখাইতাছি।
টর্চের আলোয় উঁচু ডালে আটকেপড়া প্রকাণ্ড একটা ফুলন্ত অর্কিডের ঝাড় দেখা যাচ্ছিল। হাফপ্যান্ট গেঞ্জি পরা একটা লোক কাটারি হাতে মই থেকে ডালে পা। রাখার চেষ্টা করছিল। অনেক কসরত করে সে পা রাখল। তারপর কাটারি দিয়ে ঠেলে অর্কিডটা ফেলে দিল। দেখলাম, টর্চ জ্বেলে লম্বা পায়ে হালদারমশাই সেদিকে এগিয়ে গেলেন। গাছ থেকে লোকটা প্রায় চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিল, আলো দেখান! আলো দেখান। নামব কী করে?
হালদারমশাই আলো ফেললেন গাছের ডগায়। তাঁর এক গ্রতে টর্চ, অন্য হাতে অর্কিডের প্রকাণ্ড ঝাড়টা উল্টো হয়ে ঝুলছিল। সেটা একটা বস্তায় ভরলেন। তারপর আলো দেখালেন। লোকটা অনেক চেষ্টার পর মই বেয়ে নেমে এল। হালদারমশাই বললেন, সিঁড়িখান লইয়া যান। মাঠানেরে কইবেন, চিন্তার কারণ নাই। আমি যাই গিয়া।
লোকটা মই নামিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেল। অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল মইটার। হালদারমশাই টর্চের আলো জ্বেলে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, হালদারমশাই বুদ্ধিমান। ওঁর টর্চের আলোয় দেখলাম, গাছটার গায়ে একটা স্বস্তিকাচিহ্ন খোদাই করা আছে। কাজেই সঠিক গাছ এবং সঠিক অর্কিড।
কর্নেল সাবধানে পায়ের কাছে টর্চ ফেলে এগিয়ে গেলেন সেই গাছটার দিকে। তারপর যেখানে অর্কিডটা পড়েছিল, সেখানে আলো ফেললেন। ভেঁড়াখোঁড়া ফুল আর কিছু পাতা পড়ে আছে। কর্নেল মাটির ওপর আলো ফেলে ডানদিকে এগিয়ে গেলেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কর্নেল এদিকে-ওদিকে আলো ফেলতে ফেলতে একজায়গায় থমকে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে বললেন, কানের ভুল হতেও পারে। কী একটা শব্দ শুনেছিলাম-শব্দটা অন্যরকম।
বললাম, আমি শুধু অর্কিড পড়ার শব্দ শুনেছি।
নাহ্। আমি আরও একটা শব্দ শুনেছি। কর্নেল একটু এগিয়ে গেলেন। তারপর সামনে ঝুঁকে কী একটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, পাওয়া গেল। কিন্তু এবার হালদারমশাই বিপদের মুখে পড়লেন। হরনাথবাবুর অবস্থাও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। জয়ন্ত! কুইক!…
.
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গিয়ে দেখলাম, দিনের আলো তখনও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। তবে ফার্মের মাঠে আলো জুগজুগ করছে কাছে ও দূরে। যেখানে বড় বড় পাথর পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, সেখানে পৌঁছে কর্নেল হাঁটু দুমড়ে বসলেন। আমিও বসে পড়লাম। কর্নেলের হাতে ফিকে হলুদ রঙের একটা মোড়ক। ভিডিও। ক্যাসেটের সাইজ মোড়কটার এক দিকে টেপ সাঁটা। কর্নেল টেপ ছিঁড়ে মোড়কটা খুললেন। কালো রঙের চৌকো একটা জিনিস বেরুল। ওটার একদিকে গোল চাকতি বসানো। কর্নেল প্যাকেটের ভেতরপকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন। দেখামাত্র চিনতে পারলাম। এই চিরকুটটাই চন্দ্রিকার পার্সে লুকোনো ছিল।
কর্নেল চিরকুটটা দেখে নিয়ে গোল চাকতিটা ঘোরাতে থাকলেন। আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, তালা খোলার কোড নাম্বার। তাই না?
হ্যাঁ T.L-2. R-3. L-l. R-4, ব্যাপারটা সোজা। কর্নেল শেষবার চাকতিটা ঘোরানোর পর ওপরের ডালাটা খুলে গেল। ভেতরে আবার একটা প্যাকেট দেখতে পেলাম। কর্নেল সেটা তুলে জ্যাকেটের ভেতরপকেটে চালান করে ডালা বন্ধ করে দিলেন। খুট করে শব্দ হলো। কর্নেল বললেন, T হলো Turn. অর্থাৎ ঘোরাও। L হলো Left এবং R হলো Right. তার মানে প্রথমে চাকতিটা বাঁদিকে ২নম্বর পর্যন্ত ঘোরাও। তারপর ডানদিকে ফের ঘোরাও ৩নম্বর পর্যন্ত। আবার বাঁদিকে ১ নম্বর পর্যন্ত ঘুরিয়ে ডানদিকে ৪ নম্বর পর্যন্ত ঘোরালেই তালা খুলে যাবে। মন্দিরে পৌঁছুবার আগেই হালদারমশাইকে ধরতে হবে।
নদীর ধারের ছোট গেটটা এবার ভেজানো দেখতে পেলাম। বোঝা গেল, হালদারমশাই চাবি নিয়ে এসেছেন ফার্ম হাউস থেকে। গেট দিয়ে বেরিয়ে কর্নেল হালদারমশাইকে খুঁজছিলেন। একটু পরে বললেন, ব্রিজের ওধারে দাঁড়িয়ে আছেন দেখছি। কোনও মতলব ভঁজছেন সম্ভবত।
আমরা নদীর ধারে ধারে ঝোপজঙ্গলের আড়ালে হন্তদন্ত এগিয়ে কাঠের ব্রিজে পৌঁছুলাম। ব্রিজের ওপারে একটা প্রকাণ্ড পাথরের কাছে হালদারমশাইয়ের ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছিল। কাছাকাছি গিয়ে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, হালদারমশাই।
গোয়েন্দা ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়ালেন। আইয়া পড়ছেন? ভেরি গুড। বলে সেই পরগাছার ঝাড়টা তুলে ধরলেন। পরগাছা চায় কিডন্যাপার। হরনাথবাবুরে দিয়া চিঠি লিখছে–
কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, পরগাছার ভেতর এই জিনিসটা ঢুকিয়ে নিয়ে যান।
অ্যাঁ? ক্কী কইলেন?
কর্নেল সেই চৌকো কৗটোটা ওঁর হাতের পরগাছার ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর কিটব্যাগ থেকে নাইলনের দড়ি বের করে বেঁধে ফেললেন ওটা। হালদারমশাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্নেল বললেন, সময় হয়ে গেছে। এবার শীগগির ভবানীমন্দিরে চলে যান। পরগাছাটা রেখেই চলে আসবেন কিন্তু।
বাট হোয়াট ইজ দ্যাট থিং কর্নেলস্যার?
টাইমোমা।
অ্যাঁ? খাইছে! খি-খি করে হেসে উঠলেন গোয়ন্দাপ্রবর।
কুইক! রেখেই চলে আসবেন।
পথে বার্স্ট করবে না তো?
নাহ্।
হালদারমশাই আবছা আঁধারে গাছপালার ভেতর দিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেল বললেন, চিলোফেরা যাক।
হাঁটতে হাঁটতে বললাম, গুপ্তধনের নকশা দিলেন না। কিন্তু রাত দশটায় চিচিং ফাঁক অর্থাৎ ওই কোড নাম্বারটা ডিস্কোকে দেবেন। আমার মনে হয় না ডিস্কো এত বোকা যে কোড নাম্বারের সাহায্যে কৌটো খুলেই যখন দেখবে কিছু নেই, তখন ক্ষেপে গিয়ে হরনাথবাবুকে নির্ঘাৎ খুন করে ফেলবে।
কর্নেল বললেন, চুপচাপ এস। ও সব কথা পরে হবে।
অমরেন্দ্র সিংহরায়ের বাড়ির কাছে পৌঁছে কর্নেল বললেন, তুমি গিয়ে রায়সায়েবের সঙ্গে গল্প করো। বলবে, আমার চুরুট ফুরিয়ে গেছে বাজারে আনতে গেছি।
উনি হন হন করে এগিয়ে গেলেন। গেটে উঠে দেখলাম, বাড়ির চারদিকে আলো জ্বলছে। বারান্দায় চেয়ারে একা বসে আছেন রায়সায়েব। আমি সাড়া দেবার আগেই দেখতে পেয়ে হাঁকলেন, বেচু! তালা খুলে দে।
গেটটা সবসময় তালাবন্ধ থাকে দেখছি। বাড়ির চারদিকে আলোর ব্যবস্থা করার কারণ সম্ভবত ভৌতিক উৎপাত। কিন্তু কর্নেল যে বললেন দুটো ভূতকে পকেটস্থ করেছেন, তার মানে কী?
বেচু তালা খুলে বলল, কর্নেলসায়েব কোথায় গেলেন?
বললাম, চুরুট কিনতে।
বেচু বলল, আমাকে বললেই তো এনে দিতাম।
অমরেন্দ্র শুনতে পেয়ে বললেন, কর্নেলসায়েবের চুরুট তুই আনতিস? চিনিস উনি কী চুরুট খান? খালি সবতাতেই ফেঁপরদালালি। যা! জয়ন্তবাবুর জন্য খাবার নিয়ে আয়। খিদে পেয়েছে ওঁর।
বারান্দায় উঠে বললাম, নাহ্। খিদে পায়নি। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।
কতদূর ঘুরলেন?
চেয়ারে বসে বললাম, নদীর ব্রিজ অব্দি। কর্নেলের বাতিক তো জানেন। পাখি প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়ালেন। তারপর হঠাৎ খেয়াল হলল, চুরুট ফুরিয়ে গেছে।
বেচু দাঁড়িয়ে গাল চুলকোচ্ছিল। অমরেন্দ্র বললেন, কী রে? দাঁড়িয়ে থাকবি না এঁর জন্য চা-কফি কিছু আনবি?
বেচু বলল, চা খাবেন, না কফি খাবেন স্যার?
বললাম, বরং কড়া করে এক কাপ চা আনো।
বেচু চলে গেল। অমরেন্দ্র হাসলেন। হ্যাঁ। বাইরে বেড়িয়ে এসে কড়া চা আমারও খুব পছন্দ। কর্নেলসায়েব কেন যে শুধু কফি খেতে ভালবাসেন, বুঝি না।
ওঁর মতে, কফি নাকি নার্ভকে চাঙ্গা করে।
অমরেন্দ্র খুব হাসলেন। কে জানে। যার যাতে অভিরুচি। গম্ভীর মুখে চাপা স্বরে ফের বললনে, কর্নেলসায়েব হরনাথের ফার্মে যাননি।
না তো।
ভবানীমন্দিরে?
নাহ। উনি বলছিলেন, প্রাইভেট ডিটেকটিভ যখন এসে গেছে, তিনিই হরনাথবাবুকে উদ্ধার করে ফেলবেন।
অমরেন্দ্র একটু চুপ করে থেকে বললেন, হরনাথ সেদিন কলকাতার এক ভদ্রলোককে আমার বাড়িতে এনেছিল। লম্বা গড়ন। পেল্লার গোঁফ আছে। ইস্টবেঙ্গলের লোক। আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে, তিনিই কি ডিটেকটিভ? কিন্তু হরনাথ কেন ডিটেকটিভ ভাড়া করবে? কোনও বিপদ আঁচ করেছিল নাকি? অথচ আমাকে কিছু জানাল না, এটাই আশ্চর্য!
বেচু ঝটপট চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আপনার অ্যালসেসিয়ানটা মারা গেছে শুনলাম। বেচু বলছিল।
হ্যাঁ। বিমর্ষ মুখে অমরেন্দ্র বললেন, ভুলটা আমারই। কিছুদিন থেকে কেমন ঝিম ধরে বসে থাকত। রাত্রে অত অদ্ভুত কাণ্ড হতো। সাড়া দিত না। তখন বুঝিনি জনি অসুস্থ। আসলে ওর দিকে ইদানিং তত লক্ষ্য ছিল না। ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা নিয়েই মাথা ঘামাতাম।
অমরেন্দ্র এবার তার প্রিয় কুকুরের জীবনী এবং তার পরিবারের ইতিহাস শোনাতে শুরু করলেন। শেষে নিজের রাজনৈতিক কীর্তিকলাপের কাহিনীর পাতা খুললেন। বটুক চৌধুরী ছিলেন তার বন্ধু। হঠাৎ বটুকবাবু দল বদলে তার ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন। শালা-ভগ্নিপতির এই লড়াই নিয়ে লোকে ঠাট্টা তামাশা করত। তাই রাজনীতি ছেড়ে দেন অমরেন্দ্র।
বারবার ঘড়ি দেখছিলাম। কর্নেল ফিরলেন প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে। ফিরেই বললেন, রায়সায়েব, ডিনার খাব কিন্তু রাত নটায়। তারপর আবার বেরুতে হবে।
অমরেন্দ্র বেচুকে ডেকে তাড়া দিলেন। তারপর আমাদের সেই ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, সুনন্দার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। এদিকে সতুর মতিগতিও ভাল ঠেকছে না।
কর্নেল বললেন, কেন?
অমরেন্দ্র চাপা স্বরে বললেন, কোনওদিন বাড়ি ফেরে, কোনওদিন ধানবাদে থেকে যায়। আজ বলে গেছে বাড়ি ফিরবে না। চেহারা দেখে মনে হয়, নেশা-ভাং ধরেছে। কোনদিক সামলাব ভেবে পাচ্ছি না। আপনারা বিশ্রাম করুন। আমি আসছি। কফি বলব নাকি?
থাক। বাজারে একটা কাফে সেন্টার দেখলাম। সেখানেই কফি খেয়ে নিয়েছি।
অমরেন্দ্র হাসলেন। ভিডিও সেন্টার বলুন! আজকাল এই এরিয়ায় কাফে সেন্টার, কফি হাউস অনেক হয়েছে। সব কিন্তু বুঝলেন তো? ব্লু ফিল্মের বদমাইশি।
.
কর্নেল ঘরের দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসলেন। আমি বাথরুমে গিয়ে মুখহাত রগড়ে লাম। ক্লান্তি চলে গেল। একটু পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, কর্নেল একটা খুদে ক্যাসেট এবং একটা গোল ছোট্ট কী যন্ত্র টেবিলে রেখে খুঁটিয়ে দেখছে। এলাম, কী ওগুলো?
কর্নেল হাসলেন। সেই ভূত দুটো।
ভূত দুটো তার মানে?
তুমি হলঘরে কালো ঘেঁড়া তারটা দেখেছিলে। বরগার খাঁজে গোল দাগটা লক্ষ্য রোনি। এটা একটা খুদে মাইক্রোফোন। আর এটা একটা টেপ। টেপরেকর্ডারে ঢুকিয়ে সুইচ অন করলে নানারকম ভৌতিক শব্দ শোনা যাবে। একটা বিদেশি সাউণ্ডরেকর্ড। আমেরিকায় দেখেছি, হ্যালোউইন পরবের রাত্রে ছোট ছেলেমেয়েরা এটা বাজিয়ে বড়দের ভয় দেখায়।
কোথায় পেলেন ও দুটো?
কালো তারটা সত্যকামের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে দেখে মাস্টার কী দিয়ে ওর ঘরের তালা খুলেছিলাম। বিছানার তলায় পেয়ে গেলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পারছ? আমি আসব শুনেই সত্যকাম খুদে মাইক্রোফোনটা খুলে নিয়েছিল। তাই আর ভূতের উপদ্রব হচ্ছিল না।
শুনে চমকে উঠেছিলাম। বললাম, সত্যকাম ডিস্কোর চেলা হয়েছে?
টাকার লোভে হয়েছে। তাছাড়া ডিস্কো ওর চেনা লোক। একটা চিঠিও উদ্ধার করেছি বিছানার তলা থেকে। ডিস্কো খবর পেয়েছিল নক্সাটা হরনাথ রায়সায়েবের ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু ডিস্কো একটা ভুল করেছিল। চিচিং ফাঁক কথাটা হরনাথ জানেন এবং তার বন্ধুকেও জানিয়েছেন ভেবেছিল ডিস্কো। আমার ধারণা, চন্দ্রিকা নকশাটা জ্যাঠার কাছে গোপনে রেখে গেলেও ওটার সাংকেতিক নাম যে চিচিং ফাঁক, তা বলেনি।
চিঠিটা দেখি।
কর্নেল বললেন, যথাসময়ে দেখাব। ব্যস্ত হয়ো না। বলে চুরুট ধরিয়ে কিটব্যাগ থেকে একটা খবরের কাগজ বের করলেন। সেই কাগজে খুদে টেপ এবং মাইক্রোফোনটা প্যাকেটবন্দি করে সুতো দিয়ে পরিপাটি করে বাঁধলেন। তারপর ডটপেনে বড় বড় হরফে প্যাকেটের ওপর লিখলেন, সত্যকামকে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের উপহার।
বললাম, এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে, কুকুরটাকে সত্যকামই বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে।
হ্যাঁ। সম্ভবত কালো বেড়ালটা এ বাড়িতে আনাগোনা যাতে নির্বিবাদে করতে পারে, সেজন্যই কুকুরটাকে মেরে ফেলার দরকার ছিল। কালো বেড়ালের রক্ত খাওয়া এবং যাতায়াত ভৌতিক রহস্যকে জমজমাট করে ফেলেছিল। অসহায় রোগা কুকুরটা চুপচাপ দেখত। দৃশ্যটা কল্পনা করা যায়! কর্নেল চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। থাক ও সব কথা। এবার শেষরক্ষা কীভাবে হয়, সেই চিন্তা। হালদারমশাই কোনও বিভ্রাট বাধালেই সমস্যায় পড়ব।
কতক্ষণ পরে হলঘরের দেয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে নটা বাজল। বেচু দরজার কড়া নেড়ে ডাকল, খাবার রেডি স্যার!
কর্নেল কিটব্যাগ হাতে নিয়ে দরজা খুললেন। ইশারায় আমাকেও আমার কিটব্যাগটা নিতে বললেন। আমরা ডাইনিং রুমে ঢুকলে বেচু বললু, দিদিমণির হঠাৎ শরীর খারাপ। কর্তামশাই ওনার ঘরে বসে আছেন। বললেন, একটু পরে আসবেন। আপনারা খেয়ে নিন।
কর্নেল বললেন, বেচু! এই প্যাকেটটা তুমি সত্যকামকে, দেবে। খুলো না যেন। মন্ত্র ভরা আছে। বিগড়ে যাবে। অনেক দাম।
বেচু সেই প্যাকেটটা ফ্রিজের মাথায় যত্ন করে রেখে দিল।
খাওয়া সেরে কর্নেল বললেন, কর্তামশাইকে বোলো, বেরুচ্ছি। যদি রাত্রে আর না ফিরি, যেন চিন্তা না করেন।
বেচু গম্ভীর মুখে বলল, এত রাত্তিরে কোথায় যাবেন স্যার?
কলকাতায় যাত্রা শুনতে।
বেচু হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দরজার পাশ থেকে একটা লাঠি নিয়ে হাঁক ছাড়ল, তবে রে! ভারি মজা পেয়ে গেছ। তাই না? সে তাড়া করে গেল।
সেই কালো বেড়ালটাকে জানালা গলিয়ে পালাতে দেখলাম। …
.
জানতাম, কর্নেলের গন্তব্য ভবানীমন্দির। তাই কোনও প্রশ্ন করিনি। নদীর ব্রিজ পৈরিয়ে রাস্তা ডানদিকে মোড় নিয়েছে। কর্নেল বাঁদিকে খোলামেলা মাঠে হাঁটতে থাকলেন। অন্ধকারে উনি নাকি দিব্যি দেখতে পান। আমি পাই না। সাবধানে পা ফেলে ওঁকে অন্ধের মতো অনুসরণ করছিলাম।
মাঠটা ঢালু হয়ে নেমেছে। বারকয়েক হোঁচট খেলাম। তারপর অন্ধকারে জমাট কালো একটা জঙ্গলে ঢুকলাম। কর্নেল আস্তে বললেন, আমাকে ছুঁয়ে এস। নইলে হারিয়ে ফেলবে।
বললাম, আর কতদূর?
কাছেই।
জঙ্গল শেষ হলো। একটা খোলামেলা জায়গায় পৌঁছে কর্নেল আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, সামনে উঁচু চত্বর আছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকব চত্বরের নিচে। তুমি চত্বরের তলায় গুঁড়ি মেরে বসবে। টর্চ রিভলভার তৈরি রেখো।
চত্বরটা নক্ষত্রের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল গিয়ে ধাপের কাছে পড়ালেন। পাশে আমি গুঁড়ি মেরে বসলাম। চারপাশে পোকামাকড়ের ডাক। একটা প্যাঁচা কর্কশ শব্দে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। তারপর দূরে শেয়ালের ডাক শোনা গেল।
কর্নেল লাইটার জ্বেলে চুরুট ধরালেন। তারপর আস্তে ডাকলেন, মিঃ ডিস্কো!
কোনও সাড়া এল না।
আবার কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ডাকলেন, মিঃ ডিস্কো! আর য়ু দেয়ার?
এবার চাপা গলায় সাড়া এল, কর্নেল সরকার!
আসুন। ভদ্রলোকের চুক্তি মিঃ ডিস্কো।
আপনি ওটা ওখানেই এক টুকরো পাথরে চাপা দিয়ে রেখে যান।
কিন্তু হরনাথবাবুকে যে ফেরত চাই।
ফার্ম হাউসে গিয়ে অপেক্ষা করুন। পেয়ে যাবেন।
দুঃখিত মিঃ ডিস্কো! ভদ্রলোকের চুক্তি। এমন তো কথা ছিল না।
কী কথা ছিল?
আপনি যা লিখেছিলেন পড়ে শোনাব?
অত সময় নেই। তাড়াতাড়ি করুন।
আপনি লিখেছিলেন, জিনিসটা আপনার হাতে পৌঁছে দিতে। আপনার হাতেই তা তুলে দিতে চাই।
চালাকি ছাড়ুন। আমাকে ফাঁদে ফেলতে পারবেন না। চারদিকে আমার লোক তৈরি আছে।
আমি চালাকি করছি না। আমি আপনার বুদ্ধির চাতুর্যে মুগ্ধ। তাই আপনার হাতের স্পর্শ পেতে চাই মিঃ ডিস্কো!
দেরি করবেন না। বিপদে পড়বেন তা হলে।
আপনি টর্চের আলোয় দেখুন, আমি নিরস্ত্র। আমার হাতে সেই কোড নাম্বার লেখা কাগজ। আপনার দেখা উচিত, কাগজটা জাল, কি না। আপনি ওটা দেখলেই চিনতে পারবেন। কারণ চন্দ্রিকা আপনাকে নিশ্চয়ই ওটা দেখিয়াছিল!
দেখায়নি।
আই রিপিট মিঃ ডিস্কো, দেখিয়েছিল। কিন্তু তখন আপনি বুঝতে পারেননি ওটা কী।
একটু পরে ডিস্কোর কথা শোনা গেল, কে বলল আপনাকে?
আপনিই বলেছিলেন আমাকে। তবে পরোক্ষ।
ননসেন্স! দেরি করবেন না।
মিঃ ডিস্কো! আপনি কি জিজ্ঞেস করেননি আমাকে চন্দ্রিকার পার্সের কথা?
ড্যাম ইট! এক মিনিট সময় দিচ্ছি।
ঠিক আছে। আপনার কথামতো পাথর চাপা দিয়ে রেখে যাচ্ছি। কর্নেল টর্চের আলো পায়ের কাছে ফেলে এক টুকরো পাথর কুড়িয়ে নিলেন। তারপর উঁচু চত্বরের ওপর হতে বাড়িয়ে সেই চিরকুটটা রেখে পাথর চাপা দিলেন। উত্তেজনায় আমি ততক্ষণে একটু উঠে দাঁড়িয়ে চত্বরের কিনারায় উঁকি দিয়েছিলাম। দেখে নিয়েই বসে পড়লাম।
আলো নিভিয়ে কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে চত্বর থেকে দূরে গেলেন, যেন ফিরে চলেছেন। চত্বরের পিছন থেকে একঝলক টর্চের আলো এসে পড়ল। তারপরই আলোটা নিভে গেল। চাপা শব্দ শুনতে পেলাম চত্বরের ওপর। পাথরটা গড়িয়ে ফেলে দিয়ে কেউ কাগজটা তুলে নিল।
সেই সময় কর্নেলের চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ঠিক সেই কাগজটা তো মিঃ ডিস্কো?
ইউ ব্লাডি ওল্ড হ্যাগার্ড! এখনও চলে যাওনি তুমি?
টর্চের আলো পড়তে থাকল চারদিকে। কিন্তু কোথাও কর্নেলকে দেখতে পেলাম না। বুঝলাম পাথরের আড়ালে বা ধ্বংসস্তূপের পিছনে কোথাও আছেন। আমি চত্বরের নিচে গুটিসুটি বসে আছি। কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না।
হঠাৎ আমাকে স্তম্ভিত করে কর্নেল বলে উঠলেন, ইন্দ্রজিৎবাবু! দা গেম ইজ ওভার। ফায়ার আর্মস্ ফেলে দিন। পুলিশ আপনাকে ঘিরে ফেলেছে।
চারদিক থেকে ঝলকে ঝলকে টর্চের আলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। চত্বরে কেউ নেই। কর্নেলকে ছুটে আসতে দেখলাম। এদিক ওদিক থেকে পুলিশও এগিয়ে আসছিল বন্দুক তাক করে। তারপরই মন্দিরের পেছনদিকে হালদারমশাইয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। কর্নেলস্যার! কর্নেলস্যার! হালারে ধরছি।
কয়েকটা উজ্জ্বল সার্চলাইট জ্বলে উঠল। চত্বরের ধাপ বেয়ে উঠে কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। বিধ্বস্ত বিশাল মন্দিরের গা ঘেঁষে একটা বটগাছ ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার তলায় হালদারমশাই ডিস্কো-কে মাটিতে পেড়ে ফেলে বুকের ওপর বসে আছেন। তাঁর দুটো পা ধরাশায়ী ডিস্কোর দুই হাতের ওপর।
ডিস্কোরর মুখে মুখোশ আঁটা। কর্নেল কাছে গিয়ে বললেন, অশোকবাবু, রথীন চৌধুরী, স্বপন দাশ এবং চন্দ্রিকা রায়ের খুনী ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিকে গ্রেফতার করুন। সাবধান! আগে হ্যাণ্ডক্যাপ পরিয়ে দিন।
কলকাতা থেকে পুলিশের ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অশোক গুপ্ত সদলবলে এসে পড়েছেন, এটা কর্নেলেরই পরিকল্পনা তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। সৌরভ-নাট্যগোষ্ঠীর নাট্যকার পরিচালক-অভিনেতা এবং প্রাক্তন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিই যে স্বয়ং ডিস্কো, এটা আমার কাছে একেবারে অবিশ্বাস্য। একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো? মুখোশের আড়ালে নিশ্চয় অন্য কোনও মুখ আছে।
হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন। তাগড়াই পুলিশেরা হাতকড়া পরিয়ে ডিস্কোকে টেনে ওঠাল। তখন কর্নেল ডিস্কোর মুখোশটা এক টানে খুলে নিলেন। এবার স্পষ্ট ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিকেই দেখলাম। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ইন্দ্রজিৎবাবুর চোখমুখ ফাঁদে পড়া শ্বাপদের মতো। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ছেন।
হালদারমশাই খি-খি করে হেসে বললনে, পরগাছা হেই চত্বরে রাইখ্যা চিন্তা করলাম, কোন হালা আইয়া পরগাছা লয় দেখা উচিত। টাইমবোমা ফাটব কইছিলেন। তাই ঘুর পথে বনবাদাড় দিয়া ফিরিয়া আইলাম। হেই গাছে চড়লাম, কিছুক্ষণ পরে চত্বরে আলো পড়ল। দুইজন আইছিল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ তার দুটো লম্বা আঙুল দেখালেন। একজন কইল, তুমি গাড়ির কাছে যাও। বুড়া রাত্র দশটায় আইব। আমি ওয়েট করি। হঃ। এই হালা! বলে প্যান্টের পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে নস্যি নিলেন হালদারমশাই। ফের চিন্তিতমুখে বললেন, টাইম যোমা ক্যান ফাটল না?
কর্নেল বললেন, বিগড়ে গেছে হালদারমশাই।
অশোকবাবু বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবু! হাইওয়েতে আপনার গাড়িটা আমরা অলরেডি সিজ করেছি। আপনার দুই চেলা ছিল। তারা এতক্ষণ থানার হাজতে। আপনার আরও তিনজন লোককে রাত আটটায় নদীর ব্রিজেই পাকড়াও করেছি। আপনাকে ডি সি ডি. ডি লাহিড়িসায়েব জানাতে বলেছেন, তিনি আর আপনার বন্ধু নন।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির পোশাক হাতড়ে কর্নেল কালো কৌটোটা খুঁজে বের করে ঝটপট তালা খুলে ভেতরটা দেখালেন। বললেন, দেখছেন তো ইন্দ্রজিত্বাবু! এতে কোনও নকশা নেই! কাজেই অযথা হরনাথবাবুকে আটকে রেখে লাভ নেই। বলুন, তাঁকে কোথায় রেখেছেন?
অশোকবাবু একটু হেসে বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবুর গাড়িতেই হরনাথবাবুকে আমরা উদ্ধার করেছি। হাত-পা বাঁধা এবং মুখে টেপসাঁটা অবস্থায় গাড়ির ভেতরে ওঁকে ফেলে রেখে পাহারা দিচ্ছিল দুই চেলা। ডিস্কোসায়েব গিয়ে এবার নিশ্চয় হরনাথবাবুকে মুক্তি দিতেন। চলুন, থানায় ফেরা যাক।
কর্নেল বললেন, আপনারা তো হাইওয়ের দিকে যাবেন। আমি আর ওদিকে যাচ্ছি না। ফরেস্ট বাংলো বুক করা আছে। সেখানেই উঠব। কলকাতা ফিরে দেখা হবে।
অশোকবাবু সদলবলে আসামীকে নিয়ে সার্চ লাইটের আলোয় জঙ্গল প্রায় জ্বালিয়ে দিতে দিতে চলে গেলেন।
.
ব্রিজের কাছে এসে হালদারমশাই বললেন, আমি আমার ক্লায়েন্টের ফার্মে যাই গিয়া। ওনার ওয়াইফেরে দিদি কইছি। বোঝলেন না? নিজের হাতে রান্না কইরা খাওয়াইবেন কইছেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ তার অনবদ্য খি-খি খুশির হাসি হেসে লম্বা পায়ে এগিয়ে গেলেন। দেখতে দেখতে টর্চের আলো মিলিয়ে গেল।
কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলাম, ফরেস্ট বাংলো কত দূর? আমার ঠ্যাং দুটোয় জ্যাম ধরে গেছে।
কর্নেল বললেন, কাছেই। ওই দেখ, আলো জ্বলছে। নদীর ধারে টিলার ওপর অসাধারণ একটা রিসর্ট।
চড়াই ভেঙে বাংলোয় পৌঁছুতে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। চৌকিদার প্রতীক্ষা করছিল কর্নেলের। আমরা বারান্দায় বসার পর সে শীগগির কফি করে আনল। কর্নেলের সঙ্গে তার কতাবার্তা শুনে বুঝলাম আজ রাত্রে যে কোনও সময়ে কর্নেল পৌঁছুবেন বলে খবর পেয়েছিল সে। তাই বাড়ি চলে যায়নি। এ-ও বুঝলাম, কর্নেল তার সুপরিচিত।
কফি খাওয়ার পর চাঙ্গা হয়ে বললাম, ডিস্কো নামের আড়ালে যে ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিই আছেন, কী করে বুঝলেন?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, প্রথম খটকা বাধে, চন্দ্রিকা খুন হওয়ার পর তার পার্স সম্পর্কে ইন্দ্রজিতের আগ্রহ দেখে। কিন্তু কী অসাধারণ ধূর্ত আর নিষ্ঠুর লোক এই ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি। চিন্তা করে দেখ। ডিস্কোর অস্তিত্ব আমার কাছে সত্য বলে প্রমাণের জন্য সে কত কাণ্ড করে বসল। চন্দ্রিকাকে খুনের অস্ত্র উদ্ধার করে দিল। নিজের এক চেলা স্বপনকেও খুন করল। শেষে নিজেকে নিজেই কিডন্যাপ করল। এক লক্ষ টাকা নিজের স্ত্রীর হাত দিয়ে নিজেই নিল। মৃদুলার অবশ্য এটা জানার কথা নয়। তবে মৃদুলার কথায় আভাস পেয়েছিলাম, অত নগদ টাকা নিশ্চয়ই ঘরে আছে। আসলে ইন্দ্রজিৎ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে রেখেছিল। ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে চেক করে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। আসলে ইন্দ্রজিৎ চন্দ্রিকার কাছে কোড নাম্বারটা হাতাতে না পেরে একটা বড় রকমের প্ল্যান ফেঁদেছিল। আমার হাত দিয়ে সে ওটা হাতানোর উদ্দেশ্যেই ডিস্কোর হুমকির কাল্পনিক ধুয়ো তুলে অরিজিতের মাধ্যমে আমার দ্বারস্থ হয়। সত্যকামই তাকে আমার পরিচয় দিয়ে থাকবে। এবার পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ওর প্ল্যানটা লক্ষ্য করো। পরগাছা নাটক মঞ্চস্থ করার রাত থেকে ইন্দ্রজিতের অভিযান শুরু। দিন ধরে ডিস্কোর ব্যাকগ্রাউণ্ড তৈরি করার পর সে গত রবিবার অ্যাকশনে নেমেছিল।
বললাম, অপারেশন ডিস্কো বলুন।
কর্নেল হাসলেন। বলতে পারো। কিন্তু তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আমারই সাহায্যে কোড নাম্বারটা হাতানো। এই লক্ষ্য নিয়ে সে ছকটা সাজিয়েছিল। কিন্তু নকশার আধার যে ধাতুতে তৈরি, তা ভেঙে ফেলা কঠিন। তাছাড়া তাতে নকশার ক্ষতি হবে। কাজেই কোড নাম্বারের সাহায্যে ওটা খোলা একান্ত দরকার।
নকশাটা কী করবেন?
কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের হতে তুলে দেব। এবার দ্বিতীয় অপারেশন অর্কিড শুরু হবে।