Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে অবাক

তৃতীয় স্তর

কিন্তু পরদিন কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম, ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি উষ্ক খুষ্ক পোড়খাওয়া চেহারায়, কতকটা ঝড়ে বিধ্বস্ত কাকতাড়ুয়ার মতো বসে আছেন এবং রহস্যভেদী বৃদ্ধ তাঁকে একটু আধটু নয়, বেশি রকমেরই পাত্তা দিচ্ছেন। হাসিখুশি মুখে তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন। সমবেদনাসূচক ভঙ্গি করছেন। আমি থমকে দাঁড়িয়েছি দেখে বললেন, জয়ন্ত। আমারই ভুল। ডিস্কো ইন্দ্রজিৎবাবুকে কিডন্যাপ করতে পারে, এটা কেন আমার মাথায় এল না বুঝতে পারছি না। আসলে বয়স–আমার এই বয়সে বাহাত্তুরে ধরা বলে একটা কথা আছে। স্বীকার করছি, আমাকে বাহাত্ত্বরে ধরেছে।

বললাম, ইন্দ্রজিৎবাবু! আপনাকে কীভাবে কিডন্যাপ করেছিল ডিস্কো?

ইন্দ্রজিৎবাবু ক্লান্তভাবে একটু হাসলেন। ওলসনের বাড়িতে ডিস্কোকে মিট করতে গিয়েছিলাম। শয়তানটা ফোনে আমাকে ডেকেছিল বোঝাঁপড়া করার জন্য। আমার জেদ চেপেছিল মাথায়। গাড়ি পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে রেখে পায়ে হেঁটে যাব ভাবছিলাম। গাড়ি থেকে নামছি, একটা লোক হাতে চাঁপাফুল নিয়ে এসে বলল, ফুল কিনবেন স্যার? এঁকে দেখুন, দারুণ সেন্ট। সে ফুল নাকের কাছে আনতেই মাথাটা কেমন করে উঠল। তারপর দেখি, আমি একটা ঘরে শুয়ে আছি। খাটের সঙ্গে আমার হাত-পা বাঁধা। মুখে টেপ বাঁধা। মুখোশ পরা দুজন লোক আমাকে পাহারা দিচ্ছে।

কর্নেল বললেন, যাক। আপনি আর বেশি কথাবার্তা বলবেন না। আপনার বিশ্রাম করা দরকার। এভাবে চলে আসাও ঠিক হয়নি।

ইন্দ্রজিৎবাবুর চোখের তলায় কালো ছোপ। ক্রোধের ছটা চোখের তারায় ঠিকরে পড়ল। এক লাখ টাকা কম কথা নয়, কর্নেলসায়েব। মৃদুলা তার গয়নাগাঁটি বন্ধক রেখে ধারদেনা করে অতগুলো টাকা যোগাড় করেছিল। কিন্তু ডিস্কোর জাল কতদূর ছড়ানো দেখুন। কোথায় রাঙাটুলিতে জঙ্গলের ভেতর পুরনো একটি মন্দির। তার মানে, ডিস্কোর লোক সেখানেও আছে।

সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কর্নেল সায় দিয়ে বললেন, যাই হোক, আপনি আবার ফোন করে জেনে নিন, আপনার স্ত্রী রাঙাটুলি থেকে ফিরলেন কি না।

ইন্দ্রজিৎ উঠে গিয়ে ফোন তুলে ডায়াল করলেন। বোঝা গেল এনগেজড টোন। আবার ডায়াল করলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, বোঝা যাচ্ছে না। তখন থেকে খালি এনগেজড টোন। ডিস্কোর লোক গিয়ে ফোনের লাইন কেটে রেখেছে কি না কে জানে। আমি চলি, কর্নেল।

ইন্দ্রজিৎবাবু বেরিয়ে গেলে বললাম, আবার ওঁকে ডিস্কোর লোকেরা রাস্তায় কিডন্যাপ করতে পারে। পুলিশকে আপনি বলে দিলেও পারতেন।

কর্নেল হাসলেন। শেষরাতে ইন্দ্রজিৎবাবুকে ওরা তাঁর বাড়ির গেটে রেখে গিয়েছিল। বাড়িতে সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর ছেলেরা পাহারায় ছিল। কোনও অসুবিধে হয়নি। সাতটা নাগাদ উনি সঙ্গে দুজন ছেলেকে নিয়ে সোজা আমার বাড়িতে হাজির। গাড়িতে ওরা আছে। কাজেই ডিস্কো দ্বিতীয়বার কিডন্যাপ করতে চাইলেও পারবে না। ডিস্কো অত বোকা নয়।

বললাম, রাঙাটুলির ভবানীমন্দিরে টাকা পেয়েই তা হলে ডিস্কোর লোক ট্রাঙ্ককলে ডিস্কোকে জানিয়েছিল। তাই ইন্দ্রজিৎবাবুকে ছেড়ে দিয়েছে?

হ্যাঁ। ডিস্কো কথা রেখেছে। গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত দেয়নি। অথচ নাকি ইন্দ্রজিৎবাবু তাঁর ঘোর শত্রু! ডিস্কোকে ভদ্রলোক বলা উচিত।

আপনি চন্দ্রিকার সঙ্গে ইন্দ্রজিৎবাবুর আলাপের ব্যাপারটা তোলেননি?

নাহ্। তুমিও তো দেখলে কী অবস্থা! এই অবস্থায় ওসব কথা তোলা কি উচিত? কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে দুষ্টমির হাসি হাসলেন। এবার ডিস্কোর রিঅ্যাকশন দেখা যাক। এক লাখ টাকা হাতিয়ে শত্রুকে জব্দ করা নয় শুধু, হাতে মাতে বুঝিয়ে দিয়েছে, সাবধান! আমার সঙ্গে লড়তে এসো না।

কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। জিজ্ঞেস করলাম, এনগেজড?

নাহ্। রিং হচ্ছে। কেউ ধরছে না।

আজকাল টেলিফোনের ওই এক রোগ। আবার ডায়াল করুন বরং।

কর্নেল আবার ডায়াল করলেন। তারপর বললেন, রিং হচ্ছে। সাড়া নেই। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর টেলিফোন রেখে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। ষষ্ঠী আমার জন্য কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম, আমার কথাটা আপনি শুনছেন না। আমি বলছি, লাহিড়িসায়েবের সাহায্যে টেলিফোন দফতর থেকে এই গোপন নাম্বারের নাম ঠিকানা যোগাড় করার অসুবিধে কী? নামঠিকানা পেয়ে গেলেই তো ডিস্কোকে পাকড়াও করা যাবে।

কর্নেল চোখ বুজে চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে শুললেন, তুমি ঠিক বলেছ।

নাম্বার থেকেই তো এলাকা বোঝা যাবে। কোন এলাকার নাম্বার?

টু ফোর।

উৎসাহে নড়ে বসলাম। ধৰ্ম্মতলা স্ট্রিট, তালতলা এলাকা। আমাকে নাম্বারটা দিন না।

কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন, ডিস্কোর টেলিফোন নাম্বার ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত আমার মাথাব্যথা নেই। আমি চিন্তিত হালদারমশাই সম্পর্কে। উনি রাঙাটুলি থেকে ফেরেননি। ট্রাঙ্ককলও করছেন না সেখান থেকে। কোনও বিপদে পড়েননি তো?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদারের কথা ঘটনার পর ঘটনার ধাক্কায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কর্নেলের কথায় টনক নড়ল। এযাবৎ গোয়েন্দা ভদ্রলোকের ক্রিয়াকলাপের প্রবণতা যা লক্ষ্য করে আসছি, তাতে ওঁর এমন চুপচাপ উধাও হয়ে থাকাটা অস্বাভাবিক। চন্দ্রিকা ছিল ওঁর ক্লায়েন্ট। তার নির্দেশ মতো রাঙাটুলিতে হরনাথবাবুকে বিপদের খবর দিতে ছুটে যাওয়া হালদারমশাইয়ের পেশাগত নীতি অনুযায়ী স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর ওঁর পক্ষে আরও স্বাভাবিক ছিল ক্লায়েন্টের হত্যারহস্য উদঘাটনে আদাজল খেয়ে নেমে পড়া। অর্থাৎ খবর দিয়েই কলকাতা ফেরা এবং গোয়েন্দাগিরিতে নেমে পড়া–যা কি না অনেকসময় রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের সামিল। তবে এ-ও ঠিক, অভিজ্ঞতায় জানি যে উনি গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে প্রায়ই ফেঁসে যান। এমন সাংঘাতিক বিপদে পড়েন যে প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়। অবশ্য শেষ মুহূর্তে কর্নেলস্যার গিয়ে ত্রাণকর্তার ভূমিকা নেন।

উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, তা-ই তো! হালদারমশাইয়ের পাত্তা নেই কেন? কর্নেল। রাঙাটুলিতে আপনার জানাশোনা লোক আছে। আপনিই ট্রাঙ্ককলে খবর নিন।

কর্নেল তুষোমুখে বললেন, কার কাছে নেব?

রাঙাটুলি থানায় যোগাযোগ করুন। কিংবা কলকাতায় পুলিশের মিসিং স্কোয়াডে জানান।

কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। হাত বাড়িয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ভাঁজকরা দোমড়ানো কাগজ বের করলেন। ভাঁজ খুললে দেখলাম অমরেন্দ্রবাবুর দেওয়া সেই চিচিং ফাঁক।

কাগজটা টেবিলের ওপর পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রেখে উনি পাশের ঘরে গেলেন। আবছা কানে এল আলমারি খোলার শব্দ। ফিরে এলেন আরেকটা কাগজের চিরকুট নিয়ে। দেখলাম, এটা চন্দ্রিকার পার্সে আমার খুঁজে পাওয়া সেই কোড নম্বর লেখা কাগজটা।

দুটো চিরকুট পাশাপাশি রেখে আতশ কাচ দিয়ে কী পরীক্ষায় বসলেন কর্নেল। একটু পরে স্বগতোক্তি করলেন, হুঁ!

জিজ্ঞেস করলাম, কিছু উদ্ধার করলেন নাকি?

কর্নেল দুটো কাগজই ভাঁজ করে টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে বললেন, এই নিয়ে প্রায় পনের বার পরীক্ষা করলাম জয়ন্ত। প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে দুটোর মধ্যে প্রশ্নোত্তরের সম্পর্ক আছে। রায়সায়েবেরটা যদি প্রশ্ন হয়, চন্দ্রিকারটা তার উত্তর।

আপনাকে কেউ চাই চিচিং ফাঁক বলে টেলিফোন করছে বলেছিলেন।

গতরাতেও বার দুই করেছিল। অগত্যা বলেছি, চিচিং ফাঁক দেব। তবে একটা শর্তে। ডিস্কো কে আমাকে জানাতে হবে।

কী বলল?

কর্নেল হাসলেন। বলল, আমিই ডিস্কো। তখন বললাম, ঠিক আছে। কিন্তু আপনার আসল নাম এবং ঠিকানা জানান। আমি আপনাকে চিচিং ফাঁক পৌঁছে দেব।

তারপর? তারপর?

রাজী হলো না। বলল, রাঙাটুলির ভবানীমন্দিরে রাত্রিবেলা রেখে আসতে হবে। তার বদলে আমার রাহাখরচ বাবদ পাঁচশো টাকা যে কোনও ভাবে আমাকে পৌঁছে দেবে।

অবাক হয়ে বললাম, আবার সেই রাঙাটুলির ভবানীমন্দির?

হ্যাঁ। জায়গাটা গোপন লেনদেনের উপযোগী।

আপনি রাজী হলেন না কেন? ভবানীমন্দিরে পুলিশের ফাঁদ পেতে ডিস্কোকে পাকড়াও করা যেত।

কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, কিন্তু যে ফোনে কথা বলছে, সে-ই যে ডিস্কো তার প্রমাণ কী? আমি রিং করে যখন ডিস্কো বা তার কোনও ডামির সঙ্গে কথা বলেছি, তখন কিন্তু চিচিং ফাঁক প্রসঙ্গ সে তোলেনি। কাজেই একজন তৃতীয় ব্যক্তির কথা এসে যাচ্ছে। অরিজিৎও এই তৃতীয় ব্যক্তির কথা বলছিল, মনে পড়ছে না তোমার?

একটু ভেবে বললাম, তা-ও তো বটে। ডিস্কো চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি পাঠিয়েছিল স্বপন দাশের হাতে। স্বপনকে খুন করে চাবিটা হাতিয়ে চন্দ্রিকাকে খুন করেছে কেউ এবং সেই খুনের উদ্দেশ্য চন্দ্রিকার পার্সে লুকিয়ে রাখা ওই অদ্ভুত চিরকুট হাতানো। কাজেই তৃতীয় একজনের কথা এসে পড়ছে। সে-ই দেখা যাচ্ছে নাটের গুরু।

কর্নেল দাড়ি নেড়ে সায় দিলেন, তোমার বুদ্ধি খুলেছে ডার্লিং।

উৎসাহে উদ্দীপ্ত হয়ে বললাম, এর সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ বনাম ডিস্কোর বিরোধ সম্পর্কহীন। তার মানে ইন্দ্রজিতের সঙ্গে ডিস্কোর লড়াই নেহাত প্রেসটিজের লড়াই।

এই সময় ডোরবেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী এসে বলল, একটা মেয়েছেলে এয়েছেন বাবামশাই। বললেন, খুব দরকার। আমি বললাম, একটু রোয়েট করুন–

রোয়েট না করিয়ে নিয়ে আয়।

ষষ্ঠী কর্নেলের ভেংচিকাটা বুঝতে পারে। বেজায় গম্ভীর হয়ে চলে গেল। তারপর এক যুবতী ঘরে ঢুকে নমস্কার করে বলল, আমি কর্নেলসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

কর্নেল বললেন, বসুন।

একটু দ্বিধার সঙ্গে সে বলল, কথাগুলো কনফিডেনশিয়্যাল।

স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী। আপনি?

আমার নাম দীপ্তি রাহা। লিন্টন স্ট্রিটে থাকি।

যা বলতে চান, জয়ন্তের সামনে বলতে পারেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনার কোনও গোপন কথাই আমি আমার এই তরুণ বন্ধুর কাছে গোপন রাখতে পারব না।

দীপ্তি রাহাকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সাদামাটা গড় বাঙালি মেয়ের মতো চেহারা। আস্তে বলল, আমার বাবা গোপেন্দ্রনাথ রাহার নাম শুনেছেন কি না জানি না। এক সময় ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর ছিলেন। ধর্মতলায় ওঁর অফিসটা এখনও আছে। ডিস্ট্রিবিউশন কারবার বন্ধ হয়ে গেলেও মাঝে মাঝে কোনও দিন বিকেল থেকে সন্ধ্যাঅব্দি অফিসে গিয়ে বসে থাকেন। ওঁর চেনাজানা লোকেরা আড্ডা দিতে আসেন। কিন্তু কিছুদিন থেকে বাবা লক্ষ্য করছেন, ওঁর অফিসের মেঝেয় দামি বিদেশি সিগারেটের খালি প্যাকেট পড়ে থাকে। অ্যাশট্রে পোড়া সিগারেটের টুকরোয় ভর্তি। দুদিন আগে মেঝেয় মদের খালি বোতল পড়ে আছে দেখে বাবা ভীষণ রেগে যান। বাড়ির কেয়ারটেকার চাঁদুবাবুকে খুব বকাবকি করেন। চাঁদুবাবু বলেছিলেন, কিছুই জানেন না। রাতবিরেতে এরিয়ার মস্তানরা হয়তো ও-ঘরে এসে আড্ডা দেয়। ডুপ্লিকেট চাবি যোগাড় করা তো সহজ। অত বড় তিনতলা বাড়ি। ডাক্তারের চেম্বার এবং অনেকগুলো ছোটখাটো কোম্পানির অফিস আছে। কখন কে কী কাজে বাড়িতে যাতায়াত করছে, চাঁদুবাবুর পক্ষে জানা সম্ভব নয়।

কর্নেল অভ্যাসমতো চোখ বুজে হেলান দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, আপনার বাবার ওই অফিসে টেলিফোন আছে?

দীপ্তি বলল, আছে। বাবা ওখান থেকে টেলিফোন খুব কদাচিৎ ব্যবহার করেন। অথচ এ মাসের বিলে চারশোর বেশি কল উঠেছে। মস্তানরা নিশ্চয় টেলিফোনও ব্যবহার করে। কিন্তু এসব তুচ্ছ ব্যাপারের জন্য বাবা আমাকে আপনার কাছে। পাঠাননি। কাল বিকেলে র‍্যাকে পুরনো ফাঁইলগুলো থেকে ময়লা ঝুলকালি সাফ করছিলেন। হঠাৎ দেখেন ফাঁইলের তলায় একটা ড্যাগার লুকোনো আছে। রক্তমাখা ড্যাগার।

টাটকা রক্ত নয় নিশ্চয়?

না।

গোপেনবাবু পুলিশকে জানিয়েছেন কিছু?

দীপ্তি বিমর্ষমুখে মাথা নাড়ল। বলল, পুলিশে জানানো মানেই ঝামেলা। বাবা তাঁর বন্ধুদের নিষেধ করেছেন। ড্যাগারটা যেমন ছিল, তেমনই রেখে দিয়েছেন। বাবার এক বন্ধু প্রণব চ্যাটার্জি আপনার নাম ঠিকানা জানেন। তাঁর পরামর্শেই বাবা আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।

প্রণব চ্যাটার্জি? হ্যাঁ–একসময়কার বিখ্যাত ইমপ্রেসারিও। আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বটে। তো আপনার বাবা এলেন না কেন?

বাবা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন। ওঁর ধারণা, উনি নিজে আপনার কাছে এলে ওঁকে ফলো করবে মস্তানরা। আসলে বাবা প্রচণ্ড ভীতু মানুষ। তাছাড়া আজকাল মস্তানদেরই রাজত্ব। ওরা যা খুশি করতে পারে। দীপ্তি পাংশুমুখে হাসবার চেষ্টা করে ফের বলল, আমি বাবার পরামর্শে অনেকটা ঘুরে আপনার এখানে এসেছি। প্রথমে গেলাম শ্যামবাজারে পিসিমার বাড়ি। সেখান থেকে এসপ্ল্যানেড। তারপর ট্রামে চেপে এখানে।

এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলাম। এবার বললাম, কর্নেল! সম্ভকত ওটাই চন্দ্রিকাকে মার্ডারের উইপন। এবার ডিস্কোর ফোন নাম্বারের সঙ্গে গোপেনবাবুর অফিসের ফোন নাম্বার মিলিয়ে নিন।

দীপ্তি তখনই তার বাবার অফিসের ফোন নাম্বার বলল।

কর্নেল বললেন, আমি আপনার বাবার অফিসে যেতে চাই। অফিসের চাবি দরকার হবে।

দীপ্তি তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে রিঙে ঝোলানো একটা চাবি বের করল। চাবিটা কর্নেলকে দিয়ে সে বলল, বাবা চাবিটা আপনাকে দিতে বলেছেন। কিন্তু– সে কুণ্ঠার সঙ্গে আস্তে বলল ফের, আমাকে আপনার সঙ্গে যেতে নিষেধ করেছেন। চাবিটা আপনার কাছে থাক। পরে আমি এসে নিয়ে যাবখন।

অফিসের ঠিকানা চাই যে। কর্নেল টেবিল থেকে ছোট্ট একটা প্যাড আর ডটপেন দিলেন। দীপ্তি ঠিকানা লিখতে ব্যস্ত হলো। কর্নেল বললেন, আপনাদের বাড়ির ঠিকানা এবং ফোন নাম্বারও লিখুন। দরকার হলে আপনার বাবার সঙ্গে কথা বলব।

দীপ্তি প্যাড এবং কলম কর্নেলকে ফেরত দিয়ে বলল, আমাদের বাড়ির ফোনটা অনেকদিন থেকে ডেড। একটা কথা কর্নেলসায়েব। বাবা তো ভীষণ ভীতু মানুষ, তাই বলছি, বাবার সঙ্গে যদি দেখা করার দরকার হয়, বরং প্রণবকাকুর বাড়িতে অ্যারেঞ্জ করা যায়। প্রণবকাকুর ঠিকানা আমি জানি না। আপনি হয় তো জানেন?

নাহ্। কর্নেল প্যাড থেকে ঠিকানা লেখা পাতাটা ছিঁড়ে নিলেন। আমার সঙ্গে ভদ্রলোকের বছর আগে আলাপ হয়েছিল। উনি যে আমার কথা মনে রেখেছেন, এতেই আমি খুশি। আপনি ঠিকানা যোগাড় করে আমাকে জানিয়ে দেবেন।

দীপ্তি রাহা চলে যাওয়ার পর বললাম, ডিস্কোর ফোন নাম্বারের সঙ্গে মিলল তো?

মিলবে বৈকি। কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন। তবে মনে হচ্ছে, ডিস্কো আর ওই ফোন ব্যবহার করছে না কিংবা করবে না।

কেন?

কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে সেই চিরকুট দুটো বের করলেন। তারপর পাশের ঘরে চলে গেলেন। আলমারি খোলা ও বন্ধ করার আবছা শব্দ হলো। কর্নেল ফিরে এসে বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছ। গোপেনবাবুর পোড়ো অফিসে ফাঁইলের তলায় যে ড্যাগারটা আছে, ওটা দিয়েই চন্দ্রিকাকে খুন করা হয়েছিল।

ব্যস্তভাবে বললাম, এখনই ওটা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। বলা যায়, ইতিমধ্যে ওটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে কি না!

হয়নি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

কর্নেল ফোনের কাছে গেলেন। ডায়াল করে কার সঙ্গে চাপা স্বরে কী সব কথাবার্তা বলার পর ফোন রেখে চুরুট ধরালেন। বললাম, রহস্য কিন্তু আরও জট পাকিয়ে গেল। কারণ ডিস্কো যার হাতে চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের চাবি পাঠিয়েছিল, সেই স্বপন দাশকে গুলি মেরে চাবিটা হাতিয়ে অন্য কেউ চন্দ্রিকার ঘরে ঢুকেছে এবং তাকে খুন করেছে। কিন্তু মার্ডারউইপন ডিস্কো পেল কী করে? চন্দ্রিকা খুন হওয়ার পর নিশ্চয় সে-ও ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। নাহ! কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

কী বোঝা যাচ্ছে না?

ডিস্কো বা তার ডামি বলুন, কী চেলা বলুন–গোপেনবাবুর অফিসের ফোন ব্যবহার করেছে। কাজেই গোপেনবাবুর অফিস ডিস্কোর একটা ডেরা। সেখানে মার্ডারউইপন লুকিয়ে রাখল কে? কেনই বা রাখল? যদি ডিস্কো ওটা চন্দ্রিকার ঘরে পেয়ে থাকে, সে তার ওই ডেরায় রাখতে গেল কেন?

একটু অপেক্ষা করো। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অশোক গুপ্ত আসছেন সদলবলে। তাঁদের নিয়েই আমরা মার্ডারউইপন উদ্ধার করতে যাব। আশা করি, তারপর ডিস্কোর এই খেলার উদ্দেশ্য বোঝা যাবে…

.

ধর্মতলা স্ট্রিটে একটা গলির পাশে বিশাল পুরনো বাড়িটা হঠাৎ চোখে পড়লে দিনদুপুরে কেমন গা ছমছম করে। গলি দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়। সিঁড়ির পাশে অগুনতি লেটার বক্স। অনেক কোম্পানি এবং লোকের নাম লেখা প্ল্যাস্টিক বা কাঠের ফলকও আছে। কোনও আলোর বালাই নেই। পুলিশের গাড়ি খানিকটা দূরে একটা চার্চের কাছে উল্টোদিকে পার্ক করা হয়েছিল। লক্ষ্য করলাম, সাদা পোশাকের পুলিশ একজন-দুজন করে বেরিয়ে আনাচে-কানাচে এসে দাঁড়াচ্ছে।

অশোকবাবু, কর্নেল এবং আমি তিনতলায় পৌঁছে করিডরে কাউকে দেখতে পেলাম না। করিডরে ঘুরে গিয়ে বাড়ির কোণার দিকে শেষ হয়েছে। একটা ঘরের দরজায় বেরঙা এক টুকরো ফলকে লেখা আছে পরমা ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটার্স লিঃ। কর্নেল তালা খুললেন। ঘরের ভেতর থেকে ভ্যাপসা গন্ধ বেরিয়ে এল। কর্নেল ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। দক্ষিণের একটা জানালা খুলে দিলেন।

ঘরটা বেশ বড়। কয়েকটা টেবিল এবং অনেকগুলো চেয়ারে সাজানো অফিস। টেবিলগুলো খালি। একপাশে একটা বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল এবং চারদিকে গদিআটা চেয়ার সাজানো আছে দেখে বোঝা গেল, এটাই গোপেনবাবুর আড্ডাস্থল। টেবিলে ফোনও আছে। কর্নেল প্রথমে ফোন তুলে পরীক্ষা করে বললেন, ফোনটা চালু আছে।

অশোকবাবু র‍্যাকের কাছে গিয়ে বললেন, ফাইলের পাহাড় দেখছি! সব নামাতে হলে আমার লোকজনকে ডাকতে হবে।

কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বললেন, নাহ্। চোখে পড়ার মতো জায়গায় ভ্যাগারটা রাখা হয়েছে।

কৈ? কোথায়?

কর্নেল একটা থাকের মাঝখান থেকে কাগজের একটা মোড়ক টেনে বের করে বলেন, এই নিন। খুলে দেখুন।

অশোকবাবু মোড়কটা টেবিলে রাখলেন। তারপর সাবধানে খুললেন। রক্তের কালচে ছোপমাখা একটা ছোরা দেখা গেল। আমি আঁতকে উঠেছিলাম ছোরাটা দেখে। বললাম, ছোরার বাঁটে খুনীর আঙুলের ছাপ থাকতে পারে।

কর্নেল হাসলেন। পুলিশের গোয়েন্দারা সেটা জানেন। তবে তুমি একটু ভুল করছ জয়ন্ত। খুনীর আঙুলের ছাপ সম্ভবত এতে পাওয়া যাবে না। ডিস্কো বা তার আমি কিংবা তার চেলাদের আঙুলের ছাপও পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। কারণ ছোরার বাঁটে গোপেনবাবু হাত দিয়ে থাকতে পারেন।

অশোকবাবু বললেন, যাই হোক। ফরেনসিক ল্যাবে এটা পাঠাতেই হবে।

অবশ্যই পাঠাবেন। বলে কর্নেল আঙুল দিয়ে মোড়কের ভেতর একটা জায়গা দেখালেন। তবে অশোকবাবু, মার্ডার উইপনটা আমাকেই উপহার দিয়েছে ডিস্কো। দেখুন, লেখা আছে : কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে উপহার। ইতি–ডিস্কো।

অশোকবাবু পড়ে দেখে বললেন, আশ্চর্য স্পর্ধা এই লোকটার।

কর্নেল বললেন, স্পর্ধা কি না বলতে পারছি না। তবে সে নিজের অস্তিত্ব বোষণা করেছে।

অশোকবাবু অবাক হয়ে বললেন, ডিস্কো বলে তো কেউ আছেই। পুলিশমহলেও সবাই জানে। নতুন করে তাকে অস্তিত্ব ঘোষণা করতে হবে কেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, কিন্তু আমার কাছে তাকে বারবার নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে হচ্ছে। সম্ভবত সে আঁচ করেছে, তার প্রকৃত পরিচয় জানার কোনও নয় আমার হাতে এসে গেছে।

কী সূত্র?

এটাই সমস্যা অশোকবাবু। মানুষ অনেক সময় জানে না যে সে কী জানে। আমি নিজেই এখনও জানি না যে আমি এমন কী জানি, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে ডিস্কোর প্রকৃত পরিচয়।

অশোকবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আপনার হেঁয়ালি বোঝার সাধ্য আমার মেই।

কর্নেল মেঝেয় দৃষ্টি রেখে ঘরের ভেতর চক্কর দিতে শুরু করলেন। এই সময় হঠাৎ আমাকে ভীষণ চমকে দিয়ে টেলিফোনটা বেজে উঠল। অশোকবাবু ফোন তুলে সাড়া দিলেন। তারপর গম্ভীরমুখে বললেন, কর্নেল। আপনাকে চাইছে কেউ।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। সে লক্ষ্য রেখেছে আমি এখানে এসেছি। এগিয়ে এসে উনি টেলিফোন নিলেন অশোকবাবুর হাত থেকে। বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। মিঃ ডিস্কো নাকি? ধন্যবাদ। আপনার উপহার পেয়ে খুশি হয়েছি।…না, না। গোপেনবাবুকে ঝামেলায় ফেলব না। কেন এ কথা ভাবছেন?… নাহ্। আপনার সহযোগিতা ভবিষ্যতে আরও চাইব। আশা করি পাব। …. ধন্যবাদ, ছাড়ছি।

অশোকবাবু আরও গম্ভীর মুখে বললেন, ডিস্কোর অনেক ডামি আছে শুনেছি। আপনি যদি ভাবেন ডিস্কো নিজে কথা বলল আপনার সঙ্গে, তা হলে ভুল করবেন।

হ্যারি ওলসন ডিস্কোর যে কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন, তাঁর সঙ্গে মিলে গেল এবার। এর আগে তার ডামির গলা শুনেছি। ওলসন বলেছিলেন, খুব মিঠে অমায়িক স্বরে কথা বলে ডিস্কো। বলে কর্নেল আবার ঘরের মেঝে পরীক্ষায় ব্যস্ত হলেন।

ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর কাগজেমোড়া ছোরাটা একটা কিটব্যাগে ঢোকালেন। বললেন, আপনি কি কিছু খুঁজছে কর্নেল?

কর্নেল সহাস্যে বললেন, জানি না কী খুঁজছি। তবে বলা যায় না, ওই যে পদ্যে আছে : যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন। স্বভাব অশোকবাবু! আমার এই বিদঘুঁটে স্বভাব কিছুতেই ছাড়তে পারি না।

ঠিক আছে। আপনি ছাই উড়িয়ে দেখুন অমূল্য রতন পান কি না। আমি এটা এখনই গিয়ে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।

অশোকবাবু বেরিয়ে গেলেন। দরজার ওধারে দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা অশোকবাবুর সঙ্গে চলে গেল।

আমি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। কর্নেল এবার হাঁটু গেড়ে আতশ কাচ দিয়ে মেঝেয় কী দেখছিলেন। একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঘরের মেঝে পরিষ্কার করা হয়েছে। তবু লাল সুরকি জিনিসটা এমন যে, মেঝেয় এঁটে যায়।

লাল সুরকি খুঁজছিলেন নাকি?

হ্যাঁ। ওলসন হাউসের গলিতে উল্টোদিকে একটা বাড়ি হচ্ছে। গলিতে বৃষ্টিধোয়া লাল সুরকি পড়ে আছে। কাজেই চন্দ্রিকাকে খুনের রাতে যে ওই ছোরা এখানে এনে রেখেছিল, তার জুতোয় সুরকির ছাপ আছে। কাজেই ডিস্কো সত্যিই সহযোগিতা করছে।

কর্নেল দরজার দিকে ঘুরেছেন এবং আমি চেয়ার থেকে উঠেছি, একজন কালো রোগাগড়নের লোকের আবির্ভাব হলো। বড়বাবু নাকি? বলে উনি উঁকি দিলেন ঘরের ভেতর। তারপর কর্নেলকে বললেন, বড়বাবু কোথায় গেলেন স্যার?

কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, একটু বেরিয়েছেন। কিছু বলতে হবে?

আজ্ঞে না স্যার। শুনলাম, বড়বাবুর ঘরে কারা কথাবার্তা বলছে। তাই—

আপনিই কি এ বাড়ির কেয়ারটেকার চাঁদুবাবু?

হ্যাঁ স্যার! চাঁদুবাবু বিনীতভাবে বললেন। বড়বাবু তো আজকাল বিশেষ আসেন না। এলেও বিকেলের দিকে। সেইজন্যে খোঁজ নিতে এলাম, যদি কিছু দরকার-টরকার হয়।

গোপেনবাবুকে আপনি বুঝি বড়বাবু বলেন?

আজ্ঞে। এই কোম্পানির দুই পার্টনার। গেপেনবাবু আর রথীনবাবু। রথীনবাবুকে বলতাম ছোটবাবু। কবছর আগে রথীনবাবু মারা যাওয়ার পর থেকে কারবার বন্ধ হয়ে গেল। ছোটবাবু ভেতর ভেতর কোম্পানিকে ফাঁসিয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন। বড়বাবু সরল লোক। রথীনবাবুকে বিশ্বাস করেই সর্বস্বান্ত হওয়ার দাখিল।

রথীন চৌধুরী? বেহালায় থাকতেন শুনেছি?

আজ্ঞে! আপনি চিনতেন? চাঁদুবাবু প্রশ্নটা করে নিজেই উত্তর দিলেন, চিনবেন বৈকি স্যার। বড়বাবুর চেনা যখন, তখন নিশ্চয় সব শুনেছেনও বটে।

আমি চমকে উঠেই সামলে নিয়েছিলাম। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসা একেই বলে। তবে বরাবর দেখে আসছি, যে-কোনও রহস্যেরই জাল বহু বহু দূর পর্যন্ত ছড়ানো থাকে।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। গোপেনবাবু গেলেন তো গেলেন।

চাঁদুবাবু বললেন, এসে পড়বেন। একটু অপেক্ষা করুন। চা-ফা খেতে চাইলে বলুন, এনে দিচ্ছি।

কর্নেল একটা চেয়ার টেনে বসলেন। আমিও বসলাম। কর্নেল বললেন, নাহ্। চা খাব না। আপনার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাই। আপনি তো বহু বছর এ বাড়িতে আছেন।

তা কুড়ি একুশ বছর হবে স্যার।

বাড়ির মালিক কে?

পুরনো মালিক ছিলেন মোহনপুরের মহারাজা। তাঁর কাছ থেকে কিনেছিলেন আগরওয়ালবাবু। মারোয়াড়ি বিজনেসম্যান স্যার। তাঁরই ছেলে এখন মালিক। শুনেছি, বাড়িটা ভেঙে মাল্টিস্টেরিড বিলডিং হবে। কিন্তু হবে কী করে কে জানে! এতগুলো কোম্পানি ভাড়াটে হয়ে আছে। তাদের ওঠাবেন কী করে। ঝামেলা আছে। অনেক ঝামেলা!

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, বড়বাবু বলছিলেন, রাতবিরেতে নাকি এই ঘরে পাড়ার মস্তানরা এসে আড্ডা দেয়।

চাঁদুবাবুর চোখ গুলিগুলি হয়ে উঠল। ফিসফিস করে বললেন,আমি ঠেকাব কী করে। জেনেশুনেও চুপ করে থাকি স্যার। ওরা যখন আসে, বুঝতে পারি। কিন্তু যদি বলি, কে? অমনই বলবে, তোর বাপ। শাসাবে। কী করব বলুন স্যার?

আপনি ওদের দেখলে চিনতে পারবেন?

চাঁদুবাবু আঁতকে উঠে বললেন, ওরে বাবা! আমার বডি ফেলে দেবে।

না। এমনি কথার কথা বলছি। চেহারা নিশ্চয় মনে আছে? চাঁ

দুবাবু করজোড়ে বললেন, না স্যার! ওসব কথা আলোচনা করবেন না। বড়বাবুও আমাকে নিষেধ করেছেন।

আপনি ডিস্কোর নাম শুনেছেন?

ডিস্কো?

হ্যাঁ, ডিস্কো।

চাঁদুবাবু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, একটু-একটু মনে পড়ছে। একদিন রাত নটা নাগাদ ছোটবাবুর সঙ্গে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। ছোটবাবু তাঁকে ডিস্কো বলছিলেন। তখন বড়বাবু ছিলেন না। ছোটবাবু আমাকে মদ এনে দিতে হুকুম করলেন। অত রাত্রে কি উৎপাত দেখুন স্যার! তা–

সেই ভদ্রলোকের চেহারা মনে আছে?

ফর্সা সুন্দর মতো– চাঁদুবাবু আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই স্যারের বয়সী হবেন। একেবারে সায়েবি চালচলন। তা ছ-সাত বছর আগের কথা। স্পষ্ট মনে পড়ছে না। তবে আপনি ডিস্কো বললেন–ওই কথাটা আজকাল খুব চালু কি না! তাই মনে পড়ে গেল।

বলে চাঁদুবাবু পা বাড়ালেন। যাই স্যার! রান্নার যোগাড় করতে হবে। একা মানুষ। বড়বাবুকে বলবেন যেন স্যার, আমি এসেছিলাম।

চাঁদুবাবু চলে যাওয়ার পর বললাম, ব্যস! অনেক সূত্র পেয়ে গেলেন।

কর্নেল একটু হেসে উঠে দাঁড়ালেন। চলো! কেটে পড়া যাক। তবে খুব আস্তে হাঁটবে। চাঁদবাবুর মুখোমুখি পড়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না।

যদি নিচে দেখা হয়ে যায়?

হওয়ার চান্স নেই। তবে নেহাত দেখা হয়ে গেলে চুপচাপ গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যাব।

.

পাড়ি স্টার্ট দিতেই কর্নেল বললেন, সোজা মৌলালি সি আই টি রোড হয়ে গিন্টন স্ট্রিট। গোপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করা দরকার।

বারোটা পনের বাজে। এখনই না গেলে নয়!

ডার্লিং। আজও আমার বাড়ি তোমার লাঞ্চের নেমন্তন্ন।

তারপর বলবেন, আজও অফিস কামাই করো।

কর্নেল হাসলেন। অফিস কামাই করছ কোথায়? তুমি অফিসে জানিয়ে দাওনি একটা এক্সক্লসিভ ক্রাইম স্টোরির পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছ? না জানিয়ে থাকলে

দ্রুত বললাম, জানিয়েছি। কিন্তু এখনও তো স্টোরির লেজটুকু ধরে আছি!

লেজ ধরলেই মাথা দেখতে পাবে।

মৌলালির ট্রাফিক জট ছাড়িয়ে যেতেই আধঘণ্টা লেগে গেল। লিন্টন স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছে কর্নেল বললেন, চাঁদুবাবু সম্পর্কে মুখ বুজে থাকবে কিন্তু।

বললাম, আমি সবসময় মুখ বুজে থাকব।

সংকীর্ণ রাস্তাটাকে গলি বলাই চলে। এঁকেবেঁকে কিছুদূর এগিয়ে কর্নেল বললেন, পেয়ে গেছি।

একপাশে গাড়ি রেখে আমরা বেরোলাম। একটা বাড়ির দরজায় বেল টিপলেন কর্নেল। একটি কমবয়সী মেয়ে দরজা খুলে কর্নেলের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, কাকে চাই?

গোপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

দাদু তো নেই। ঠাকুমা দাদু পুরী বেড়াতে গেছেন।

তোমার দীপ্তিপিসিকে ডাকো!

মেয়েটি ঘুরে প্রায় চিৎকার করে ডাকল, ছোটপিসি! ছোটপিসি! তোমাকে ডাকছে।

বছর কুড়িবাইশ বয়সী এক তরুণী এসে বলল, আপনারা কোত্থেকে আসছে?

কর্নেল বললেন, দীপ্তি রাহার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

তরুণী অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, আমার নাম দীপ্তি। আপনারা—

জাস্ট আ মিনিট! আপনার বাবা-মা পুরী গেছেন কবে?

এক সপ্তাহ আগে। সামনের মাসে ফিরবেন। কিন্তু আপনারা কোত্থেকে আসছেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমি তোমার বাবার একজন বন্ধু। তুমি নিশ্চয় প্রণব চ্যাটার্জিকে চেনো? তোমার বাবার কাছে আসতেন। ওঁর ধর্মতলার অফিসেও যেতেন।

প্রণবকাকু-ফাংশন-টাংশন করতেন, তাঁর কথা বলছেন?

হ্যাঁ। বিখ্যাত ইমপ্রেসারিও প্রণব চ্যাটার্জি।

প্রণবকাকু এখন বোম্বেতে থাকেন শুনেছি।

তুমিই তা হলে আদি-অকৃত্রিম দীপ্তি রাহা?

তার মানে?

কিছু না। আমার এই কার্ডটা রাখো। দরকার বুঝলে রিং কোরো।

কর্নেল তার হাতে কার্ডটা দিয়ে হন্তদন্ত গাড়িতে উঠে পড়লেন। আমিও দেরি করলাম না। স্টার্ট দিয়ে বললাম, সোজা বেরিয়ে যাই? বেনেপুকুর রোড হয়ে ট্রামডিপোর পাশ দিয়ে এলিয়ট রোড।

কর্নেল সায় দিলেন। একটু পরে বললেন, ডিস্কো বারবার আমাকে বোঝাতে চাইছে, হি ইজ জাস্ট নট আ নেম, হি রিয়্যালি এজিস্টস। হ–সে আছে।

আশ্চর্য! কিন্তু দীপ্তি সেজে যে-মেয়েটা চাবি দিয়ে এল, সে কে?

ডিস্কোর দলে মেয়েও আছে বোঝা গেল।

কিন্তু তারা তো কলগার্ল! ওই মেয়েটিকে কলগার্ল বলে মনে হয়নি।

কিছু বলা যায় না।

কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিলেন। বাকি পথ একেবারে চুপ। সানিভিলার লনে গাড়ি ঢুকলে চোখ খুলে আপন মনে শুধু বললেন, ডিস্কো অসাধারণ ভাল খেলছে!

ষষ্ঠী দরজা খুলে মুচকি হেসে চাপাস্বরে বলল, হালদারমশাই এয়েছেন!

কর্নেল বললেন, বাঃ! খাসা খবর!

ড্রয়িং রুমের সোফায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ প্রায় লম্বা হয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। কর্নেল হালদারমশাই বলে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে সোজা হলেন। তারপর কাঁচুমাচু মুখে বললেন, রাত্রে ঘুম হয় নাই। তারপর লং ট্রেনজার্নি! স্টেশন থিক্যা সোজা আপনার হাউসে-ওঃ! হেভি রহস্য কর্নেলস্যার! আপনাগো আশীর্বাদে প্রাণ লইয়া ফিরছি, এই যথেষ্ট।

কর্নেল বললেন, খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম আপনার জন্য। আজ সকালেই জয়ন্তর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম, আপনার কোনও বিপদ হলো নাকি। ট্রাঙ্ককলও করছেন না আপনি।

হালদারমশাইয়ের মুঠোয় নস্যির কৌটো ছিল। এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, বিপদ কইলেন! হেভি বিপদ। হরনাথবাবুর ফার্ম আছে জঙ্গলের কাছে। এগ্রিকালচারাল ফার্ম। তারপর রাত্রিকালে আমারে কিডন্যাপ করল–কী য্যান কয়? হঃ! ডিস্কো।

ডিস্কো! বলেন কী!

আমারে বাঁধতাছে, তহন জিগাইলাম, হু আর ইউ? বান্ধো ক্যান? কয় কী, ডিস্কোর হুকুমে তোমারে বাঁধছি। এবারে মা ভবানীর মন্দিরে তোমারে বলি দিমু।

কর্নেল বললেন, এক মিনিট! কফি খেয়েছেন তো?

হঃ!

তাহলে নিশ্চয় আপনার নার্ভ চাঙ্গা হয়েছে। এবার গোড়া থেকে বলুন, শোনা যাক।

এবার গোয়েন্দা ভদ্রলোক তাঁর অনবদ্য মিশ্রভাষায় যে বিবরণ দিলেন, তা মোটামুটি এই : রাঙাটুলি পৌঁছুতে সেদিন হালদারমশাইয়ের রাত দশটা বেজে যায়। ট্রেন লেট করেছিল। অত রাতে খোঁজখবর নিয়ে উনি জানতে পারেন, মাইল তিনেক দূরে জঙ্গলের কাছে নদীর ধারে হরনাথ সিংহের কৃষিখামার আছে। হরনাথবাবু রাতে সেখানেই থাকেন। অনেক চেষ্টা করে হালদারমশাই একটা এক্কাগাড়ি যোগাড় করেন। ফার্মে গিয়ে হরনাথবাবুকে চন্দ্রিকা রায়ের শোচনীয় মৃত্যুর খবর দেন। হরনাথবাবু প্রথমে কেঁদে ফেলেন। বলেন, হতভাগিনী নিজেই নিজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া কী বলব? তবে হালদারমশাইয়ের মতে, হরনাথবাবু শক্ত মনের মানুষ। হালদারমশাইয়ের খাওয়াদাওয়ার। ব্যবস্থা করেন। খাওয়ার পর ফার্মের একটা ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থাও করেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, চন্দ্রিকা হালদারমশাইকে কোনও জিনিস রাখতে দিয়েছিল কি না। দেয়নি শুনে গম্ভীর হয়ে চলে যান।

অচেনা জায়গায় হালদারমশাইয়ের ঘুম আসতে চায় না। ফার্মে বিদ্যুৎ আছে। ফ্যানও আছে। জানালার বাইরে আবছা আলোয় একটা ফুলবাগান দেখা যাচ্ছিল। তার একধারে উঁচু কয়েকটা গাছ। হঠাৎ হালদারমশাই দেখতে পান, গাছে ফাঁকে টর্চের আলো ফেলে কে চলাফেরা করছে।

গোয়েন্দাগিরি যাঁর পেশা, তাঁর কাছে এটা সন্দেহজনক মনে হওয়া স্বাভাবিক। উনি চুপিচুপি দরজা খুলে বেরিয়ে যান। ফুলবাগানের ভেতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে হালদারমশাই দেখেন, ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কে এগিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা পুঁড়ি মেরে তাকে অনুসরণ করেন। একটু পরে লোকটা গাছের ডগার দিকে টর্চের আলো ফেলে। তখন অবাক হয়ে যান হালদারমশাই। লোকটা স্বয়ং হরনাথ সিংহ।

এত রাতে হরনাথবাবু একটা ঝাঁকড়া গাছের ডগায় আলো ফেলে কী দেখছেন, এটা রীতিমতো রহস্য। একটু পরে উনি এদিকে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে এলে হালদারমশাই চুপিসাড়ে চলে এসে ঘরে ঢোকেন এবং দরজা আটকে শুয়ে পড়েন।

রহস্যটা জানার জন্য হালদারমশাই পরদিন রাঙাটুলিতে থেকে যাওয়াই ঠিক করেন। সকালে চা খেয়ে হরনাথবাবুর সঙ্গে ফার্মের চাষবাস দেখতে বেরোন। কিন্তু তাঁর মন পড়ে আছে সেই গাছগুলোতে। ফার্মের উত্তর প্রান্তে ওটা একটুকরো জঙ্গল বলা চলে। জঙ্গলটা কেন কাটা হয়নি জিজ্ঞেস করলে হরনাথবাবু বলেন, অর্কিডের চাষ করার জন্য গাছগুলো রেখেছে।

হরনাথবাবু তাঁকে অর্কিড দেখাতে নিয়ে যান। প্রত্যেকটি গাছে প্রচুর অর্কিড রঙবেরঙের পাতায় ঝলমল করছে। হালদারমশাই কর্নেলের কথা তোলেন। কারণ কর্নেলের অর্কিডের হবি আছে। হরনাথবাবু বলেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। অমরেন্দ্র সিংহরাযের বাড়ি এসেছিলেন। সেখানেই আলাপ হয়। (কর্নেলের মন্তব্য : হুঃ) পরে কর্নেল সায়েব তাঁর ফার্মে এসে অর্কিড দেখে গেছেন। যাইহোক, হালদারমশাই কথায় কথায় বলেন, জায়গাটা তাঁর ভাল লেগেছে। একটা দিন কাটিয়ে যেতে চান। হরনাথবাবু কোন মুখে না বলেন তাঁকে?

(ইতিমধ্যে চন্দ্রিকার জীবনকাহিনী হালদারমশাই জেনে নেন। আমরা যতটা জানি, তার বেশি কোনও তথ্য নেই।)

হালদারমশাই সেই বিশেষ গাছটা দিনের বেলায় চিনতে পারেননি, যেটার ডগায় হরনাথবাবু আলো ফেলে কী খুঁজছিলেন। বিকেলে হরনাথবাবু হালদারমশাইকে রাঙাটুলির বিখ্যাত ভবানীমন্দির দেখাতে নিয়ে যান। ফার্মের পশ্চিমে নদী। নদীর ওপারে জঙ্গলের ভেতর প্রাচীন ঐতিহাসিক একটা মন্দির। চারপাশে অজস্র ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরও ভেঙে পড়েছে। শুধু সামনের উঁচু চত্বরটি পাথরের বলে অটুট আছে। তার নিচে হাড়িকাঠ পোঁতা। বৈশাখী পূর্ণিমায় পুজোর সময় বলিদান হয়।

মন্দিরে প্রণাম করে সবে দুজনে উঠেছে, ফার্মের একটা লোক হন্তদন্ত এসে হরনাথবাবুকে একান্তে ডেকে চুপিচুপি কী বলে। অমনই আশ্চর্য ব্যাপার, হরনাথবাবু এক্ষুণি আসছি বলে লোকটার সঙ্গে চলে যান।

হালদারমশাই ভেবেছিলেন, ফার্মে চুরি-টুরি হয়েছে। কারণ প্রায় নাকি ফার্মে চোর পড়ে। গুদামঘরে প্রচুর ফসল মজুত আছে। হালদারমশাই অ্যালসেসিয়ান কুকুর পোষার পরামর্শও দিয়েছিলেন।

মন্দিরচত্বরে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও হরনাথবাবু ফেরেননি। তখন হালদারমশাই নদীর দিকে হাঁটতে থাকেন। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে দুটো মস্তানমার্কা লোক চুপিচুপি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মন্দিরের দিকে যাচ্ছে। তাঁকে দেখেই তারা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।

গোয়েন্দার চোখে এ-ও খুব রহস্যময় ঘটনা। কাজেই হালদারমশাই হনহন করে নদীর দিকে যাচ্ছেন, এমন ভঙ্গিতে এগিয়ে ঝোঁপের আড়ালে বসে পড়েন। সেখান থেকে মন্দিরটা দেখা যাচ্ছিল। লোক দুটো মন্দিরের কাছে যায়। তারপর মন্দিরের পেছনে গিয়ে বসে পড়ে।

ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। অন্যদিক থেকে টর্চের আলো ফেলে কারা আসছে দেখে হালদারমশাই ভেবেছিলেন হরনাথবাবু। কিন্তু না–এক ভদ্রমহিলা এবং একজন যুবক আলো ফেলে কথা বলতে বলতে আসছে।

হালদারমশাই ভেবেছিলেন পুজো দিতে আসছে ওরা। কিন্তু চত্বরের সামনে প্রণাম করে ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এই রইল টাকা। আমার স্বামীকে তোমরা ফিরে দাও।

মন্দিরের পেছন থেকে সম্ভবত সেই লোক দুটোর একজন হেঁড়ে গলায় বলে, কত আছে?

ভদ্রমহিলা বলেন, গুনে দেখ। পুরো টাকা আছে।

হেঁড়ে গলায় আওয়াজ আসে, ঠিক আছে, চলে যান। আপনার হাজব্যান্ডকে বাড়িতে পেয়ে যাবেন।

ভদ্রমহিলা এবং যুবকটি চলে যায়। ততক্ষণে হালদারমশাই গুঁড়ি মেরে মন্দিরের চত্বরের কাছে পৌঁছেছেন। তোক দুটো টাকাভর্তি প্লাস্টিকের ব্যাগটার দিকে এগিয়ে আসতেই হালদারমশাই উঠে দাঁড়ান। হাঁক ছাড়েন, ডোন্ট টাচ!

সঙ্গে টর্চ ছিল না, রিভলভার ছিল। কিন্তু রিভলভার বের করার আগেই ব্যাগ তুলে নিয়ে ওরা উধাও হয়ে যায়। অন্ধকারে আর কী করা যাবে? টর্চ নিতে ভুল হয়েছে। মনমরা হয়ে হালদারমশাই ফিরে আসছিলেন। নদীর ধারে পৌঁছতেই কাঠের ব্রিজে দুজন লোককে কথা বলতে শোনেন। কাছাকাছি হওয়ামাত্র লোক, দুটো হালদারমশাইয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে, এমন লোকেরা যে একই দলের, সেটা কেমন করে বুঝবেন হালদারমশাই? তারা ওঁকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে। (হালদারমশাইয়ের ভাষায় আমারে বান্ধো ক্যান?) তারপর তারা ওঁকে ধরে নিয়ে যায় জঙ্গলের ভেতর সেই মন্দিরের সামনে। তারা হাড়িকাঠে হালদারমশাইয়ের মাথা গলিয়েছে, সেই সময় টর্চের আলো এসে পড়ে এবং হরনাথবাবুর চিৎকার শোনা যায়, এই ব্যাটাচ্ছেলেরা! লোক দুটো হালদারমশাইকে ফেলে পালিয়ে যায়।

হরনাথবাবু তাঁকে মুক্ত করে ফার্মে নিয়ে যান। সব ঘটনা শুনে উনি খুব গম্ভীর হয়ে বলেন, আপনি শিগগির চলে যান রাঙাটুলি থেকে। রাত বারোটা নাগাদ একটা ট্রেন আছে। আপনি আর এখানে থাকলে আমিই এবার বিপদে পড়ব।

কথা শেষ করে হালদারমশাই আবার নস্যি নিয়ে বললেন, হেভি রহস্য। আর হরনাথবাবুর বিহেভিয়ারও মিসটিরিয়াস। কী কন জয়ন্তবাবু?

হালদারমশাইয়ের ভঙ্গিতে বললাম, হঃ!….

.

সে-বেলা হালদারমশাইকে বাড়ি ফিরতে দিলেন না কর্নেল।

হালদারমশাই স্নান করে ধাতস্থ হয়েছিলেন। ব্যাগ থেকে প্যান্টশার্ট বের করে নোংরা পোশাক বদলে ফিটফাট হয়ে চুল আঁচড়ে খাওয়ার টেবিলে বসেছিলেন। খেতে খেতে তাঁর রাঙাটুলি-অ্যাডভেঞ্চার আবার একদফা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল কোনও প্রশ্ন বা মন্তব্য করেননি। কর্নেলকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।

খাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে এলাম আমরা। হালদারমশাই সোফায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বললেন, কর্নেলস্যারের রাঙাটুলি যাওয়া উচিত। আমিও যামু। বাট ইন ডিসগাইজ।

হাসতে হাসতে বললাম, আপনার তো সাধুবাবার ছদ্মবেশ ধরার অভ্যাস আছে। ভবানীমন্দিরে গিয়ে ধুনি জ্বেলে বসবেন।

তা কর্নেলস্যার কইলে আপত্তি নাই।

কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। বললেন, হালদারমশাই কি হরনাথবাবুকে চাই চিচিং ফাঁক কথাটা বলেছিলেন?

হালদারমশাই সোজা হয়ে বসে বললেন, ইয়েস। রিঅ্যাকশন বুঝতে চাইছিলাম।

কী বললেন হরনাথবাবু?

শুধু কইলেন, বুঝছি ক্যান চন্দ্রিকারে মারছে। কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার কর্নেলস্যার। বলে হালদারমশাই হঠাৎ গুম হয়ে গেলেন।

কর্নেল বললেন, কী আশ্চর্য ব্যাপার?

ডিস্কোর লোকেরা আমারে কিডন্যাপ করছিল শুনিয়াই হরনাথবাবু কইছিলেন, সেই ডিস্কো হারামি আবার রাঙাটুলিতে ফিরছে? অরে গুলি করিয়া কুত্তার মতন মারব। জিগাইলাম, ডিস্কো কেডা। শুধু কইলেন, অরে চিনবেন না।

আপনি অমরেন্দ্র সিংহরায়ের কথা শুনেছেন বলছিলেন। হরনাথবাবুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন বুঝলেন?

ভাল। হরনাথবাবু কইলেন ওনার বেস্ট ফ্রেন্ড। আলাপ করতে চাইছিলাম। কিন্তু চান্স পাইলাম না।

হরনাথবাবুকে আপনি চন্দ্রিকা এবং ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির সম্পর্কের কথা বলেছিলেন?

হঃ। ডিটেলস সবকিছু কইছি ওনারে। কী বুঝলেন? মানে ইন্দ্রজিৎবাবুকে উনি চেনেন?

চেনেন। রাঙাটুলি ইন্দ্রজিৎবাবুর শ্বশুরবাড়ি। আর কী কইছিলেন য্যান? হালদারমশাই স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। একটিপ নস্যি নিয়েই মনে পড়ল। বললেন, হঃ! ধানবাদের লোক ইন্দ্রজিৎবাবু। পলিটিকস করতেন। নাটকও করতেন। লোকাল এম এল এর রাইটহ্যান্ড ছিলেন। হরনাথবাবু চন্দ্রিকার সঙ্গে ম্যারেজের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু চন্দ্রিকা এম এল এর পোলার লগে পলাইয়া গেছিল।

কিন্তু ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে চন্দ্রিকার মেলামেশা সম্পর্কে হরনাথবাবুর কী রিঅ্যাকশন?

হালদারমশাই মাথা নেড়ে বললেন, ভাল না। কইলেন, হতভাগিনী বুদ্ধির দোষে মারা পড়েছে। এক্সপ্লেন করলেন না। শুধু বুঝলাম, একসময় ইন্দ্রজিৎবাবুরে লাইক করতেন। এখন আর করেন না। আপনি রাঙাটুলি যান কর্নেলস্যার! হেভি মিস্ট্রি। তাছাড়া কোন ভদ্রমহিলার হাজব্যান্ডরে কিডন্যাপ করল কেডা, বুঝি না। মন্দিরে টাকার ব্যাগ রাখল। তারপর তারে ছাড়ল কি না– শ্বাস ছেড়ে চুপ করে গেলেন হালদারমশাই।

কর্নেল বললেন, ডিস্কো ইন্দ্রজিৎবাবুকে কিডন্যাপ করেছিল। এক লাখ টাকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।

অ্যাঁ? কন কী?

ভবানীমন্দিরে যে ভদ্রমহিলাকে দেখেছেন, তিনি ইন্দ্রজিত্যাবুর স্ত্রী মৃদুলা দেবী।

খাইছে। হালদারমশাই গুলি গুলি চোখে তাকিয়ে রইলেন। গোঁফের ডগা তিরতির করে কাঁপতে লাগল।

কর্নেল হাসলেন। আপনি রাঙাটুলি যাওয়ার পর অনেক ঘটনা ঘটেছে। সময়মতো বলব।

টেলিফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। বলছি। …হা মিঃ ডিস্কো! বুঝতে পারছি আপনার প্রবলেম।…..শুনুন। চিচিং ফাঁক আমার কাছে আছে তা তো জানেন। আমি আপনার কথায় রাজী।… হ্যাঁ। রাঙাটুলির ভবানীমন্দিরেই ফেরত দেব। শুধু একটা শর্ত।…না। আপনার প্রকৃত পরিচয় জেনে আমার কোনো লাভ আছে বলে এখন মনে করছি না। তবে শর্তটা হলো, আপনাকে আমি নিজের হাতে চিচিং ফাঁক তুলে দেব। … নাহ্। আমি একা যাব এবং আপনিও একা আসবেন। ভদ্রলোকের চুক্তি।– ঠিক আছে। আগামী শুক্রবার রাত দশটা?…. তা-ই হবে। রাখছি।

হালদারমশাই শুনছিলেন। বললেন, ডিস্কো?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ।

অরে চিচিং ফাঁক দেবেন কইলেন। হোয়াট ইজ দ্যাট থিং?

একটা কোড নাম্বার।

কিসের কোড নাম্বার।

জানি না। তবে ওটা ডিস্কোর দরকার। ওটার জন্যই চন্দ্রিকাকে খুন হতে হয়েছে।

হেভি রহস্য। বলে গুম হয়ে গেলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে হালদার।

কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। সাড়া পেয়ে বললেন, অরিজিৎ! …. হ্যাঁ অশোকবাবুকে …… জাস্ট আ মিনিট! স্বপন দাশের ব্যাকগ্রাউন্ড…ঠিক আছে। ওর দোকানের ঠিকানাটা চাই। …হ্যাঁ, বলো। … কর্নেল প্যাড টেনে ঠিকানা লিখে নিলেন। তারপর বললেন, হালদারমশাই বহাল তবিয়তে ফিরেছেন। বলছেন, হেভি মিস্ট্রি। … সন্ধ্যার পর এস বরং। ডিটেলস আলোচনা হবে। ছাড়ছি।

হালদারমশাই বেজার মুখে বললেন, ডি সি ডি ডি সায়েব আমারে পাত্তা দিতে চান না। ওনারে আমার সাংঘাতিক এক্সপিরিয়েন্সের কথা বললে জোক করবেন।

নাহ্‌। তবে আপনি এবার বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিন। সকাল সকাল শুয়ে পড়বেন। আপনার লম্বা একটা ঘুম দরকার।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর যথারীতি যাই গিয়া বলে বেরিয়ে গেলেন।

বললাম, আপনি ডিস্কোকে চন্দ্রিকার রাখা কাগজটা সত্যি দেবেন?

কর্নেল চোখ বুজে বললেন, দেব। ভদ্রলোকের চুক্তি, ডার্লিং।

কিন্তু তার আগে ওটা কিসের কোড জানা দরকার নয় কি? ফোনে একটি মেয়ে বলছিল, চন্দ্রিকা নার্কোটিকসের একটা পেটি আত্মসাৎ করেছিল। সেটার সঙ্গে এই কোডের সম্পর্ক থাকতে পারে।

তা পারে।

তাহলে আগে–

আমাকে বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, কিছুক্ষণ জিরিয়ে নাও। আবার বেরুতে হবে।

কোথায়?

স্বপন দাশের নিউমার্কেটের দোকানে।

নিউমার্কেটের ভেতর ভিড় ঠেলে অনেক গলিঘুঁজি ঘুরে একটা ছোট্ট দোকানের সামনে দাঁড়ালেন। টেপরেকর্ডার বিক্রি হয় দোকানটাতে। ভিডিও ক্যাসেট ভাড়ায় পাওয়ার কথা খুদে ফলকে লেখা আছে। সাইনবোর্ডে দোকানের নাম জয় মা কালী ইলেকট্রনিকস। কাউন্টারে ব্যাগি প্যান্ট আর আই লাভ ইউ লেখা ফতুয়াগোছের গেঞ্জি পরা তাগড়াই এক যুবক ক্যাসেট গোছাচ্ছিল। কর্নেলকে বলল, বলুন স্যার।

কর্নেল বললেন, স্বপনবাবুকে দেখছি না? বেরিয়েছেন কোথাও?

যুবকটি ক্যাসেটগুলো র‍্যাকে রেখে এসে বলল, স্বপনদা নেই।

কর্নেল হাসলেন। নেই তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আসেননি, নাকি—

স্বপনদা মারা গেছে।

সে কী! এই তো কদিন আগে দেখলাম। হঠাৎ কী অসুখ হয়েছিল?

ফুড পয়েজন।

ভেরি স্যাড। কর্নেল মুখে প্রচণ্ড দুঃখের ছাপ ফুটিয়ে বললেন, আহা! অত ভাল ছেলেটা অকালে ঝরে গেল। আমার সঙ্গে কতদিনের চেনাজানা ছিল। আপনি কি স্বপনের আত্মীয়?

হ্যাঁ।

স্বপন আমাকে একটা ভিডিও ক্যাসেট যোগাড় করে দেবে বলেছিল।

আপনি মেম্বার?

না। স্বপনের সঙ্গে আমার অন্য সম্পর্ক ছিল। আপনার নাম কী ভাই?

তরুণ, সে ব্যবসাদারী ভঙ্গিতে বলল, আমি তো আপনাকে চিনি না। মেম্বার হতে হবে। দুশো টাকা ডিপোজিট। স্বপনদাকে যে ক্যাসেট চেয়েছিলেন, পেয়ে যাবেন।

পারবেন দিতে?

চেষ্টা করব। কী ক্যাসেট বলুন?

চিচিং ফাঁক।

মুহূর্তে তরুণের মুখের ভাব বদলে গেল। ভুরু কুঁচকে বিকৃত মুখে বলল, কী ফালতু কথা বলছেন স্যার। ওই নামে কোনও ক্যাসেট নেই।

কর্নেল অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, সে কী! স্বপন বলেছিল–

স্বপনদার চালাকি। আপনাকে ভুল বলেছে।

ভুল নয়। আসলে ওটা একটা থিয়েটারের নাটকের ক্যাসেট। স্বপন ওতে অভিনয় করেছিল। আপনি নিশ্চয় জানেন স্বপন থিয়েটারে অভিনয় করত?

তরুণ একটু দ্বিধায় পড়ে গেল যেন। স্বপনদা বলেছিল চিচিং ফাঁক নামে নাটক করেছে?

হ্যাঁ। দারুণ নাটক নাকি।

বোগাস। স্বপনদা স্টেজের কাজকর্ম করত।

তা-ই বুঝি? কিন্তু স্বপন বলেছিল, কী যেন নাটকের দলটার নাম—হুঁ, সৌরভ, নাট্যগোষ্ঠী।

হবে। আমি জানি না। স্বপনদার মুখে শুনেছি, নাটকে নামার ইচ্ছে ছিল। একটা দলের সঙ্গে ভিড়েছে। স্টেজ ম্যানেজ করে-টরে।

আপনি ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিকে চেনেন?

নাহ্।

ডিস্কোকে?

তরুণের মুখের ভঙ্গি আবার পলকে বদলে গেল। গলার ভেতর বলল, নাহ্। তারপর সে নার্ভাস মুখে একটু হাসবার চেষ্টা করল। তাই বলুন! আপনি সি আই ডি অফিসার। দেখুন স্যার, দফায় দফায় এসে আমাকে আপনারা জ্বালাতন করছেন। এতে আমার বিজনেসের লস হচ্ছে। স্বপনদা আমার পার্টনার ছিল। সে কী কাজ করে ফেঁসে গেছে-মার্ডার পর্যন্ত হয়ে গেছে, আমি তার কিছুই জানি না। মিছিমিছি আমাকে হ্যাঁরাস করছেন।

কাউন্টারে ইতিমধ্যে কয়েকজন খদ্দের এসেছিল, তারা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। তরুণ তাদের দিকে ঘুরল। কর্নেল মুখে সেই অবাক ভঙ্গিটি রেখেই শ্বাস ছেড়ে বললেন, ভুল করছে তরুণবাবু!

তরুণ হাত নেড়ে বলল, থানায় গিয়ে দেখা করব। বড়বাবু আমার চেনা। আপনি এখন আসুন স্যার।

কর্নেল ভিড় ঠেলে হাঁটতে থাকলেন। রাস্তায় গিয়ে মুচকি হেসে বললেন, অনেক সময় অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে দেখেছি, ঠিক জায়গায় লেগেছে। কী বুঝলে বলো এবার?

বললাম, স্বপন দাশ ইন্দ্রজিৎবাবুর দলে ছিল। আর এই তরুণচন্দ্র ডিস্কোর এক চেলা।

কর্নেল গাড়িতে ঢুকে বললেন, আর কিছু বুঝলে?

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে ডিস্কোর তো শত্রুতা আছে। ইন্দ্রজিৎবাবুর নাটকের দলে স্বপন দাশ সম্ভবত ডিস্কোর চর হয়ে ঢুকেছিল। ইন্দ্রজিৎবাবুই তো বলছিলেন, তাঁর দলে ডিস্কোর চর আছে।

স্বপনকে কে খুন করল বলে মনে হয় তাহলে?

ইন্দ্রজিৎবাবুকে সন্দেহ করা চলে।

কর্নেল হাসলেন। তা হলে তোমার ধারণা অনুসারে চন্দ্রিকার খুনী ইন্দ্রজিৎবাবু?

হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, চন্দ্রিকাকে উনি খুন করবেন কেন? মোটিভ কী? চন্দ্রিকার লুকিয়ে রাখা ওই কাগজটা তো আপনাকে ডিস্কোই চাইছে। ডিস্কোই ইন্দ্রজিৎবাবুকে কিডন্যাপ করে এক লক্ষ টাকা আদায় করল। কাজেই অরিজিৎবাবুর থিওরি অনুসারে একজন তৃতীয় ব্যক্তি এই রহস্যের পিছনে আছে। সে ডিস্কোকে টেক্কা মেরে ওই কাগজটা অর্থাৎ চিচিং ফাঁকের কোড নাম্বার হাতাতে স্বপনকে দিয়ে চন্দ্রিকাকে মেরেছে। চন্দ্রিকা টের পেয়েছিল থিয়েটার থেকে সে তার পিছু নিয়েছে। এবং আপনার থিওরি অনুসারে চন্দ্রিকা তাই তার পার্স আপনার জিম্মায় পৌঁছে। দিয়েছিল। তাই না?

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে শুধু বললেন, হুঃ!

হেমেন্দ্র সে রাতে ওলসন হাউসের কাছে ছিলেন। কাজেই তৃতীয় ব্যক্তি হেমেন্দ্র।

তুমি বলেছিলে হেমেন্দ্রের ডিস্কো হওয়ার চান্স আছে।

নাহ্। ডিস্কো অন্য কেউ। হি ইজ আ বিগ গাই। পুলিশের কথা এটা।

কর্নেল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পৌঁছে মুখ খুললেন। ওলসন হাউসে ঢুকব। একটু দরকার আছে।

বাড়িটার কাছে একটা পুলিশ ভ্যান দেখে বুঝলাম, কড়া পুলিশ পাহারা বহাল আছে। সাদা পোশাকের পুলিশ দেখলে আমি চিনতে পারি। তারা দুদিকের ফুটপাতেই দাঁড়িয়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কেউ খৈনিওয়ালার কাছে বসে গল্প করছে আর খৈনি ডলছে।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির মুখে একজন সাদা পোশাকের অফিসার কর্নেলকে দেখে হাসলেন। কর্নেল তাঁর পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। দেখলাম, ছোট্ট লনের ওপাশে বেঞ্চে কজন সশস্ত্র কনস্টেবল বসে আছে।

বারান্দায় হ্যারি ওলসন বেতের চেয়ারে বিমর্ষমুখে বসেছিলেন। কর্নেলকে দেখে হাত তুলে অভিনন্দন জানালেন। আমরা বসলাম। কর্নেল বললেন, আশা করি কোনও অসুবিধে হচ্ছে না মিঃ ওলসন?

ওলসন বললেন, হচ্ছে। তাছাড়া পুলিশ আমার বাকি জীবনকাল পর্যন্ত আমাকে পাহারা দেবে না। তখন ডিস্কো আমাকে খতম করবে। কাজেই ঠিক করেছি, বাড়ি বেচে দেব। বোম্বে চলে যাব, আমার এক আত্মীয়ের কাছে।

আপনার ভাড়াটেদের খবর কী?

ওরা আছে। বাইরে শিকার ধরতে যাচ্ছে আগের মতো। তবে কাউকে সঙ্গে আনতে পারছে না। ওলসন ফিসফিস করে বললেন ফের, একজন পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছেন, ডিস্কো ওপরতলায় খুব চাপ দিচ্ছে পুলিশ তুলে নিতে। কাজেই আপনি যতই চেষ্টা করুন, পুলিশ চলে যাবে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, বাড়ি যে বেচবেন বলছেন, কিনবে কে ভেবেছেন?

মেয়েগুলোকে বলেছি, ডিস্কোকে বলো, সে কিনে নিক। কিন্তু ওরা বলছে, ডিস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। আমিও ফোন করেছিলাম। রিং হচ্ছে। কেউ ধরছে না।

ডিস্কো যদি বাড়ি না চায়?

ওলসন একটু চুপ করে থেকে বললেন, পড়ে থাকবে। আমি চলে যাব।

কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন মিঃ ওলসন।

ওলসন হাসবার চেষ্টা করে বললেন, অপেক্ষা করে লাভ কী?

ডিস্কোকে আমি ঢিট করে ফেলব। সে যে-ই হোক।

ওলসন মাথা নাড়লেন। বিশ্বাস করি না। রাজনীতিওলারা তার মুরুব্বি।

আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি। ঠিকঠাক জবাব পেলে আমার সুবিধে হবে।

বলুন। আপনাকে আমি কিছু গোপন করিনি। করব না।

আপনি তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তো–

ওলসন কর্নেলের কথার ওপর বললেন, ওঃ! সে এক সুখের দিন গেছে। এ নিয়ে আপনার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেছি। স্মৃতি সুখের। আপনার সঙ্গে ডিগবয়ে আলাপ হয়েছিল। যাই হোক, এখন আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। স্মৃতি সুখের বটে, তবে এ মুহূর্তে কষ্টের।

মিঃ ওলসন! আপনি বর্মাফ্রন্টে থারটিনথ ডিভিসনে ছিলেন।

সাধারণ সৈনিক মাত্র।

রিট্রিটের পর ডিভিসন ভেঙে দিয়ে যে দলটাকে রাঁচি ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়, আপনি সেই দলে ছিলেন।

হ্যাঁ। আপনাকে তো কতবার সে-সব কথা বলেছি।

আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি এতদিন, আপনার কি অপারেশন অর্কিডের কথা স্মরণে আছে?

ওলসন একটু নড়ে বসলেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ। অপারেশন অর্কিড! বিহারে তখন রাজনৈতিক আন্দোলন চলছিল। প্রচণ্ড অন্তর্ঘাত শুরু করেছিল ওরা। ট্রেনের লাইন ওপড়ানো। অস্ত্র লুঠ। আর্মি কনভয়ের ওপর পর্যন্ত হামলা।

১৯৪২সালের আগস্ট আন্দোলন বলা হয়। বিহারে সেই আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ আর্মি অপারেশন অর্কিড শুরু করে। যাই হোক, আপনি কি রাঙাটুলি সেনাঘাঁটি–

ওলসন দ্রুত বললেন, হ্যাঁ। মনে আছে। ওখান থেকে যে সেনাদল অপারেশন অর্কিডে যোগ দেয়, তাতে আমিও ছিলাম।

সামরিক রেকর্ডের একটা বইয়ে পড়েছি, একটা পরিত্যক্ত খনির ভেতর প্রচুর সোনাদানা মজুত রেখেছিলেন ব্রিটিশ সরকার। খনির মুখ পাথর দিয়ে সিল করে স্বাভাবিক রাখা হয়েছিল। সেই জায়গার একটা ম্যাপ তৈরি করেন লেফটন্যান্ট জেনারেল হেনরি প্যাটার্সন। ম্যাপটা তাঁর ক্যাম্প থেকে পরে কীভাবে চুরি যায়।

ওলসন মাথা নাড়লেন। আমি জানি না। শুনিনি। কিন্তু অপারেশন অর্কিডের আর একটা উদ্দেশ্য ছিল জায়গাটা খুঁজে বের করা। কারণ ম্যাপ চুরির পর হেনরি প্যাটার্ন আত্মহত্যা করেছিলেন।

ওলসন একটু অবাক হয়ে বললেন, আমাদের যেখানে সেখানে নিয়ে মাটি খোঁড়ানো হতো। মনে পড়ছে। কেন খোঁড়ানো হতো, ভেবেই পেতাম না। আমাদের প্রশ্ন করা নিষেধ ছিল।

কর্নেল আস্তে বললেন, রাঙাটুলির আর্মিবেসের কন্ট্রাক্টর অজয় রায়কে আপনি চিনতেন। ম্যাপ চুরির সঙ্গে জড়িত সন্দেহেই তাঁর জেল হয়েছিল। তাই না?

ওলসন তাকয়ে রইলেন কর্নেলের দিকে।

কর্নেল পকেট থেকে পুরনো একটা খাম বের করে বললেন, পুলিশ চন্দ্রিকার ফ্ল্যাট সার্চ করে এই চিঠিটা পেয়েছে। এটা আপনি চন্দ্রিকার মা স্নেহলতা রায়কে লিখেছিলেন।

ওলসন জড়ানো গলায় বললেন, কনডোলেন্স লেটার।

এ হ্যাঁ। অজয়বাবুর মৃত্যুর পর সান্ত্বনা দিয়ে লেখা চিঠি। কিন্তু এতে প্রমাণ হচ্ছে, আপনি অজয়বাবুকে ভাল চিনতেন। তিনি আপনার বন্ধু ছিলেন। এবার আমার প্রশ্ন, ডিস্কো বা তার লোকের চাপে, নাকি চন্দ্রিকা এই চিঠি আপনাকে দেখিয়ে পরিচয় দেওয়ায় আপনি তাকে চার তলার ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়েছিলেন? আশা করি, সঠিক জবাব দেবেন।

ওলসন আস্তে বললেন, চন্দ্রিকা আমাকে চিঠি দেখিয়েছিল। ওকে বলেছিলাম, এখানে তুমি থাকতে পারবে না। এখানে খারাপ মেয়েরা থাকে। কিন্তু চন্দ্রিকা বলেছিল, তার আশ্রয় নেই। সে কান্নাকাটি করছিল। তাই তাকে ফ্ল্যাটটাতে থাকতে দিয়েছিলাম। পরে বোকা মেয়েটা ডিস্কোর পাল্লায় পড়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে ওলসন আবার বললেন, কথাটা অপ্রাসঙ্গিক ভেবেই আপনাকে বলিনি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, মিঃ ওলসন! অনেক সময় আমরা জানি না যে আমরা কী জানি! এটাই সমস্যা আপনি কি জানেন, অজয়বাবু সত্যিই সেই গোপন নকশা চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন?

ওলসন গম্ভীর মুখে বললেন, আমার সন্দেহ, নকশা উনিই চুরি করেছিলেন। লেফটন্যান্ট জেনারেল প্যাটা জয়ন্তবাবুকে পছন্দ করতেন। বিশ্বাস করতেন খুব। এ কথা অজয়বাবুই আমাকে বলতেন। আমি তো ছিলাম সাধারণ সৈনিক মাত্র।

অজয়বাবুর সঙ্গে কথাবার্তায় তেমন কিছু নিশ্চয় টের পেয়েছিলেন আপনি?

সম্ভবত। এত কাল পরে কিছু মনে নেই।

ধন্যবাদ! উঠি মিঃ ওলসন।

হ্যারি ওলসন গম্ভীর মুখে রইলেন। গেটের কাছে সেই পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়েছিলেন। চাপা স্বরে বললেন, কী বলছে বুড়ো?

কর্নেল বললেন, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন।

অফিসার হাসলেন। গেলে আমরাও ঝামেলা থেকে বেঁচে যাই।

গাড়িতে আসতে আসতে বললাম, অপারেশন অর্কিড! আপনি সেইজন্যই পরগাছারহস্য বলছিলেন? কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা গুপ্তধনরহস্য হয়ে দাঁড়াল যে! ছ্যাঃ! যত সব চাইল্ডিশ ব্যাপার!

কর্নেল বললেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু আড়ালের রহস্যময় ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হয় না। কথাটা ঠিকই। বিশাল একটা সাম্রাজ্য। অসাধারণ তার ভৌগোলিক বিস্তার। যুদ্ধের সময় ব্যাঙ্ক এবং ট্রেজারি থেকে কত কোটি কোটি টাকার সোনাদানা শত্রুপক্ষের হাতে পড়ার ভয়ে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারকে, কল্পনা করতে পারবে না। শত্রুপক্ষের বোমায় কত জায়গায় কত সোনাদানার গুপ্তভাণ্ডার চাপা পড়ে গেছে। পরে আর তা খুঁজে বের করা যায়নি। এখনও মাটির ভেতর সেগুলো রয়ে গেছে। যক্ষের দল সেগুলো পাহারা দিচ্ছে।

মাই গুডনেস! চিচিং ফাঁকের সঙ্গে সেই যখের ধনের সম্পর্ক আছে? চুপ! চুপ! কর্নেল সকৌতুকে অট্টহাসি হাসলেন।

যষ্ঠী দরজা খুলে দিলে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, কেউ এসেছিল?

আজ্ঞে না তো।

কেউ ফোন করেছিল?

দুবার ফোং করেছিল। বললাম, বাবামশাই বেইরেছেন। এখনও ফেরেননি।

নাম জিজ্ঞেস করেছিলি?

আপনি বেইরেছে শুনেই ফোং কেটে দিল। হ্যালো হ্যালো করলাম—

হ্যালো হ্যালো করেছিস। এবার শিগগির কফি কর।

যেতে যেতে হঠাৎ ষষ্ঠী বলে গেল, একই নোক বাবামশাই। গলা শুনেই বুঝেছি।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে টুপি খুলে টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে ষষ্ঠী কফি নিয়ে এল। কফিতে চুমুক দিয়েছি, সেইসময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! ফোনটা ধরো!

ফোন তুলে সাড়া দিলাম। কেউ বলল, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?

আপনি কে বলছেন?

আপনার লেটার বক্সে একটা জরুরি চিঠি আছে।

লাইন কেটে গেল। হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ লোকটার কণ্ঠস্বর কেমন ভারী এবং কর্কশ। তাছাড়া লেটার বক্সে চিঠি থাকার কথা টেলিফোনে বলাও অদ্ভুত।

কর্নেল তাকিয়েছিলেন। একটু হেসে বললেন, ডিস্কো?

কে জানে? আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কি না জিজ্ঞেস করেই বলল, আপনার লেটার বক্সে একটা জরুরি চিঠি আছে। কেমন বিশ্রী কণ্ঠস্বর।

কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! ষষ্ঠী পর্দার ফাঁকে উঁকি মারল। বললেন, লেটার বক্সে এটা চিঠি আছে। নিয়ে আয়। ষষ্ঠী হন্তদন্ত চলে গেল।

বললাম, লোকটা যে-ই হোক, আপনার গলার স্বর ওর কাছে অপরিচিত। আমাকেই আপনি বলে ধরে নিল। এটা একটা পয়েন্ট। নিশ্চয় ডিস্কোর কোনও বোকাসোকা ডামি।

কর্নেল শুধু বললেন, হুঁ!

একটু পরে ষষ্ঠী ফিরে এল একটা খাম নিয়ে। কর্নেল খামটা টেবিলল্যাম্প জ্বেলে দেখে নিয়ে খুললেন। ভাঁজকরা ছোট্ট একটি চিঠি বের করলেন। তারপর চোখ বুলিয়েই আমাকে দিলেন। দেখলাম, ইংরেজিতে টাইপকরা চিঠি। বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায় :

ভদ্রলোকের চুক্তি। ঠিক আছে। কিন্তু কোনও চুক্তিই শূন্যে হয় না। একটা ভিত্তি থাকা উচিত। তাই চন্দ্রিকার জ্যাঠামশাই রাঙাটুলির হরনাথ সিংহকে অপহরণ করেছি। কথামতো সময়ে জিনিসটি আপনি যথাস্থানে আমার হাতে দিলেই তাঁকে ছেড়ে দেব। ফাঁদ পাতবেন না। তা হলে একটি প্রাণ যাবে।–ডিস্কো

পড়ার পর রাগে মাথায় আগুন ধরে গেল। বলালম, শয়তানটার কী স্পর্ধা আপনাকে এভাবে চিঠি লিখতে সাহস পেয়েছে?

কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, ডিস্কো দুঃসাহসী তো বটেই।

উত্তেজিতভাবে বললাম, একটা কথা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। ইন্দ্রজিৎবাবু ডিস্কোর হুমকিতে ভয় পেয়ে আপনার সাহায্য চেয়েছিলেন। অথচ ওঁকে ডিস্কো কিডন্যাপ করে এক লাখ টাকা দিব্যি আদায় করল। আপনি চুপচাপ থাকলেন। আবার শয়তানটা চন্দ্রিকার জ্যাঠামশাইকে–

হাত তুলে আমাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, খামোকা উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই জয়ন্ত। তোমার কফি হয় তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। কফি খাও। নার্ভ চাঙ্গা হবে।

কিছুক্ষণ পরে কলিং বেল বাজল। কর্নেল বললেন, অরিজিৎ এল হয়তো। তুমি কিন্তু মুখ বুজে থাকবে।

কিন্তু ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ির বদলে হন্তদন্ত আবির্ভূত হলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে হালদার। ধপাস করে সোফায় বসে হাঁসফাঁস করে বললেন, হরনাথবাবু কিডন্যান্ড। ওনার ওয়াইফ আমারে ট্রাংকলে খবর দিলেন। হরনাথবাবু ওনারে আমার নেমকার্ড দিয়া কইছিলেন, আমার কোনও বিপদ বাধলে জানাই। বলেই তড়াক করে সোজা হলেন। চাপা স্বরে বললেন, রাত্রি সওয়া নয়টার ট্রেনে রওনা দিমু। কর্নেলস্যার। জয়ন্তবাবু। কাইন্ডলি ফলো মি।

তারপর ঘড়ি দেখে সটান উঠে দাঁড়ালেন এবং জোরে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল তুন্বেমুখে বললেন, জয়ন্ত। এবার আর হালদারমশাইকে ফলো করা ছাড়া উপায় নেই।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress