Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu » Page 2

পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu

এমনিতে পিকু-এষার এমন নিস্তরঙ্গ জীবন যে পিকুই মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে। সকাল নটায় মিনি ধরে সেন্ট্রাল পার্ক থেকে একজন ডালহৌসি, আরেকজন উত্তর কলকাতা। শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। লম্বা যান-জট ঠেলে ঠেলে, এক ঘণ্টার পথ দু ঘণ্টায়, আড়াই ঘণ্টায়। সকালে চা, সন্ধেয় কফি। কফির পট সামনে রেখে দুজনে গল্প। পত্রিকা পড়া। তারপর টেবিল-চেয়ার, হাতে কলম, টেবিলে খাতা, র‍্যাকে বই। কখনও টাইপ-রাইটার। মস্তিষ্ক-ঠাসা চিন্তা। খাতার পাহাড়, লাল-নীল ডট কলম। পিকু বলে—‘তুই পারিস কি করে? চল ফিল্ম দেখে আসি।’

—‘কি ফিল্ম?’

—‘তা কি জানি? যা পাওয়া যায়। দে কাগজটা। দেখি কি কি হচ্ছে।’

—‘দূর! ফিল্ম দেখার জন্যেই ফিল্ম দেখা? সে বড় বিরক্তিকর! পিকু, তুই প্লীজ অন্য বন্ধু-বান্ধব সংগ্রহ করে ঘুরে আয়।’

পিকু বলে—‘কি জ্বালা! অন্য বন্ধু-বান্ধব কি আর আমার কালেকশনে নেই? তোকে একলা ফেলে যেতে চাইছি না এটাকে পাত্তা দিচ্ছিস না কেন? এষা, তোর মনে হয় না প্রত্যেকটা দিন কেন এমন একই রঙের? একইরকম নিচু শিথিল বেসুরে বাঁধা! কেনই বা জীবন এমন নির্বিশেষ হবে?’

এষা হাসতে থাকে—‘তুই কি জীবনকে রোমাঞ্চকর উপন্যাস ঠাউরে জন্ম নিয়েছিলি নাকি? তাহলে তোর আশাভঙ্গ কেউ আটকাতে পারবে না পিকু। না ভেবে-চিন্তে সিনেমা দেখতে গেলে অবস্থা আরও সঙ্গিন দাঁড়াবে।’

—‘তাহলে কি করা যায়?’

—‘কিছু করার নেই। শুধু প্রতীক্ষা করার আছে। তা-ও ব্যস্ত হয়ে নয়।’

পিকু বলে—‘ধুত্তেরি। তবে আমি গাছে জল দিতে চললুম। হলুদ জবার কুঁড়ি এসেছে। ফুটল কিনা দেখি গে।’

এষা মনে মনে বলে—‘এই তো ঠিক ধরেছিস। সাধারণ তবু অসাধারণ। জবা কিন্তু হলুদ-জবা—মুহূর্তগুলোর ফোটা দেখতে দেখতে গরিমার জন্য লালিত প্রতীক্ষাকে ভুলে থাকা। যদি সে এলো তো এলো, না এলেও ক্ষতি নেই।’

এইরকম চলতে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে ফেলতে ফেলতে। পিকু সিনেমা দেখতে যায়, বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক, বোনঝির জন্মদিনের নিমন্ত্রণে একদিন গিয়ে তিনদিন কাটিয়ে বেশ তাজা হয়ে ফিরে আসে। নতুন করে ভালোবাসে আবার সেন্ট্রাল পার্কের ঘরদুয়ার, দাওয়া, বাগান, গল্পগাছা, নিষ্প্রদীপের রাত্তিরে ঘরে তালা দিয়ে, ছাদে মাদুর পেতে জোনাকি আর তারা, তারা আর জোনাকি, মিঠে ফুলের গন্ধ, গুনগুন গান, ঘুম। এষা তুই কি রে? এক্সকার্শনটাতেও তো যেতে পারতিস! সেদিন একটা নেমন্তন্নের চিঠি এলো, গেলি না তো! মুড নেই রে। আমার এমনিই বেশ ভালো লাগে, সত্যি বলছি। তারপর হঠাৎ একদিন মাঝ সকালে তার মস্তিষ্কের মধ্যে কুমোরের চাক বাঁই বাঁই করে ঘুরতে থাকে। একটা পাখি ডানা ঝাপটায় বুকের মধ্যে, অধৈর্য ঠোঁট দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে লসিকাগুলো। রসক্ষরণ হতে থাকে শরীরের খাঁচায়, স্রোত মুক্তি পেতে চায়। তখন এষা কোথাও না যেতে পারলে মরে যায়। সে বেশ বুঝতে পারে এরই মধ্যে তার পুনর্জন্ম এবং পুনর্পুনর্জন্ম হয়ে গেছে। শুধু কাপুরুষেরাই বারবার মরে না। গভীর আকাঙক্ষা ও অভিজ্ঞতায় যারা বাঁচে তারাও মরে যায়, আবার জন্মায়, একই জন্মের ভেতরে। এষা সেসব সময়ে বুঝতে পারে এইদিনগুলোর মৃত্যু হয়ে গেছে। এখন আবার নতুন জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তার বায়ুভূত নিরালম্ব প্রেতদশা।

গীতাঞ্জলিতে আসতে সবাই বারণ করেছিল। ঘণ্টার হিসেবে কম হলেও, দু দুটো পুরো দিনের বেলা। নতুন গরম পড়ছে। বাংলা পার হলেই লু বইবে। কিন্তু বম্বে মেলে তিলধারণের স্থান নেই। ভি-আই-পি কোঠায় চেষ্টা করেও বিফল হতে হল। ফেয়ারলি প্লেস থেকে ট্যাক্সি নিয়ে এসপ্লানেড। উত্তেজনায় এষা সীটে হেলান দিয়ে বসতে পারছে না। আপাদমস্তক অধৈর্য প্রত্যাশায় ভরা উৎকণ্ঠ দুপুরে গীতাঞ্জলির টিকিট হাতে পেয়ে মাথায় কুমোরের চাক থামল। স্পেস পার হলেই বুঝি কালকেও পার হওয়া যাবে, যে কালকে পার হতে না পেরে মানুষ চিরদিন এমন আকণ্ঠ দুঃখী হয়ে রয়েছে। যাওয়ার এই তাগিদ এ ভেতরের কোনো গূঢ় মৌল প্রয়োজনের তাগিদ। এ রকম হলে একটা ছবি তীব্র তীক্ষ্ণ হয়ে বাজতে থাকে মনের মধ্যে। ছবিটাই তাকে বলে দেয় কোথায় যেতে হবে। এভাবেই সে একটি য়ুক্যালিপটাস বীথি এবং রাস্তার এপার ওপার জোড়া যুগল শিরীষকে পূর্ণিমা রাত্রের স্বপ্নে দেখে রিখিয়া এবং বহুদূর পর্যন্ত খোলা রোদ্দুরে খান খান লালমাটির চেহারা দেখে ডালটনগঞ্জ, তারপর কাচের জানলা থেকে অবাধ অপার নীলকণ্ঠ হিমালয়ান রেঞ্জ বিনোনো দেখে রাণীখেত ঘুরে এসেছে। দিবাস্বপ্নের দৃশ্যে তো রাতের স্বপ্নের মতো ছায়া থাকে না! কখনও কখনও এসব ছবি বাস্তব রোদের চোখ-ধাঁধানো ভ্যান গগ্‌, বাস্তব সর্ষে খেতের হলুদ ফুলঝুরি, বাস্তবনদীর বাঁকে বাঁকে টাল-সামলানো যতীন সেনগুপ্ত দৃষ্ট রূপ নিয়ে প্রচণ্ড ব্যথার মোচড় সমেত উপস্থিত হয়। এষা ছবিটাকে বুক থেকে কোলে নামিয়ে রাখে, আবার বুকে জড়িয়ে ধরে, তারপর টানটান হয়ে ট্রেনের তীব্র হুইসলে ছোট ছেলের কান্নার আওয়াজ শুনতে থাকে। সুদূরের জ্বর গায়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলতে থাকে—কি করি বলো, এই মুহূর্তে আমার ছুটি নেই, বাড়ি করতে আমি সব টাকা ফুরিয়ে ফেলেছি, অথচ নিঠুরদরদী এক শৈলসানু তার গাভরা সোনালি গোধূম, পিঠে বেতের ঝোড়া নিয়ে লেপা পোঁছা মিঠে মুখের ভুটিয়া চা-তুলুনি এসব আমায় প্রবল বেগে টানছে। টানছে শৈশবে মায়ের টানের মতো, বসন্ত রাতের হাওয়ার মতো, প্রাণবঁধুর ডাকের মতো। আমাকে যেতেই হবে। নইলে পিকু নতুন গোলাপি পেয়ালায় নতুন রকমের সুগন্ধ-সোনালি চায়ের রোশনাই করবে আমি খেয়াল করব না। বাগানে হাঁটব অনাগ্রহে, ফুলেরা হয়ত সুপ্রভাত জানাবে, আমি আনমনা—শুনব না। ব্যথা পেয়ে নুয়ে পড়বে ডিসেম্বরের ডালিয়া, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, লিনটেলের ওপর ভোলা লতানে যুঁইয়ের মৃদু মধুর সুরপাত আমি গায়ে না মেখে নিষ্ঠুর উদাসীনতার খই ছড়াতে ছড়াতে চলে যাবো আমার শ্মশানে, ভেতরে, আরো ভেতরে। ওদের অভিমানের কোন মূল্য দেবো না। আমার অভিমানের মূল্যই যেন কেউ কোথাও দিয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্নান করতে কেটে যাবে, পিকু ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যাবে। যন্ত্রের মতো ওয়ার্ডরোব থেকে পিকুর সাজানো হ্যাঙারে জামাকাপড় নামিয়ে নেবো। মনে পড়বে না আমি যাচ্ছি না আসছি। পিকু বলবে—‘এ কি তুই খেলি না?’ যেন খাওয়া না-খাওয়াতে আর কিছু এসে যায়। ঘটা করে খাওয়া-দাওয়ার দিনগুলি তো সেই কবেই উৎসবরজনীর পর-প্রত্যূষে খিড়কি দুয়ারে এঁটো পাত ফেলবার সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে। এখন শুধু খিদে জানান দিলে খেয়ে নেওয়া। যা হাতের কাছে পাওয়া যায় তাই দিয়ে। রুটি-মাখন, আলুভাতে-ভাত, কাঁচা চীনেবাদাম-গুড় ছোলা যা হোক।

এবারের ছবিটা ছিল এই খাদ্য-সম্পর্কিত। ইউনেসকোর অজন্তা অ্যালবামটা দেখতে দেখতে দু চোখ জুড়ে ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি পিঁড়ি পাতলেন। একলা ঘরে বিষাদরূপিণী এক কৃষ্ণাকে দেখতে পেল এষা। ঘরে ছায়া শুধু ছায়া। সখীর হাতে মহার্ঘ খাদ্য-সম্ভার, চোখে অনুনয়। কি এক ব্যাখ্যাতীত বিষাদে স্তব্ধ, স্থাণু হয়ে রয়েছে কন্যা। ছবিটা বারবার তিনবার ধাক্কা দিয়ে দিয়ে ফিরে এলো। ভোরবেলা জানলা দিয়ে প্রজাপতি ঢুকে দক্ষিণের পর্দার ওপর থরথর করে কাঁপছিল, গান না-জানা কিম্বা গান-ভোলা পাখি বাইরের গাছের ডালে বসে ঘুমভাঙা গলায় ডাকছিল—টিকটিক, টুকটুক, টিকটিক, টুকটুক। আগের দিনের না-বাঁধা বাসি চুল কাঁধময় পিঠময়, হাঁটুর ওপর হাত জড়ানো,—পিকু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে এষা বলল—‘আমি অজন্তা যাবো পিকু, অজন্তা দেখে আসি একবার।’

পিকু বলল—‘এক্ষুণি নাকি? তো যা।’

দেয়ালে চোখ। মৃদু হেসে এষা বলল—‘সেভাবে আমি গেছিতো। মনসা মথুরাম্‌। কিন্তু যুধিষ্ঠির যেভাবে স্বশরীরে স্বর্গে যেতে চেয়েছিলেন, তেমনি ভাবে যেতে চাই।’

—‘পথে তোর সঙ্গীরা একের পর এক হত হতে থাকবে।’

—‘হোক, পাছে হোস তাই তোকে নিচ্ছি না।’

—‘সকুকুর যাবি?’

বারান্দা থেকে মুখির ডাক ভেসে আসছিল কৌ কৌ কৌ। সেটা শুনেই বোধহয় পিকুর মাথায় কুকুরের কথাটা আরো এলো।

এষা বলল—‘মুখিয়াটা নিতান্তই তোর। খুব ভালো করেই জানিস সেটা। তোকে উপহার দিয়েছি। তুই ওর বিষয়ে বড্ড এলোমেলো বলে মাঝে-মধ্যে ওকে চান-টানগুলো করিয়ে দিস। তার মানে এই নয় যে তোর মুখি আমার পেছু নেবে।’

‘কুকুর ছাড়া স্বর্গে যাওয়া যায় না জানিস না সেটা!’

‘সে তো পথের কুকুর! পেছন পেছন আসে বেশ দূরত্ব রেখে, গায়ে লেজ বুলোয় না, যেখানে সেখানে আইস-ক্রিম চাটার মতো চাটে না, ঘ্যান ঘ্যান তো করেই না কক্ষণো।’

‘তাছাড়াও নরক-দর্শনের হাঙ্গামাটা আছে।’

‘দ্যাখ পিকু, সারাজীবন ধরে যারা নানা ভাবে নরকদর্শন করেছে তাদের স্বর্গে যাবার জন্যে আরেকবার নরক দেখতে আপত্তি থাকার কথা নয়।’

‘দুর্যোধনদের সপার্ষদ সিংহাসনে বসে থাকতে দেখবি কিন্তু।’

‘এবার তুই সত্যিই ভাবালি। যাক গে ওসব। আমি যাচ্ছিই। বারো বছর বয়সে মাসি-মেসোর সঙ্গে গিয়েছি। খাঁ-খাঁ মাঠ দিয়ে কুলির মাথায় মোট, আমরা তিনজন ফর্দাপুরের ডাকবাংলোয় রাত কাটাতে চলেছি। মেসো বলছেন—“কত দফায় দফায় আবিষ্কার হল অজন্তা, তখন এখানে বাঘ-টাগ চরত বোধহয়। আর আমরা এক দিনেই সে জিনিস দেখে ফেলব।” এখনও আমার মনে আছে কি ভাবে বেঁকে গেছে বাগোড়া নদীর খাতটা! দ্যাখ বৎসরান্তে প্রসারপিনের কাছে সিরিসের ডাকের মতো অজন্তার ডাক আমার কাছে এসে পৌঁছেছে এই হেডিসে।’

‘ইস্‌স্‌। আমাদের এই “কুটিচক” বাড়িখানাকে তুই শেষ অব্দি হেডিস বললি?’

‘তুই যেন জানিস না বাড়িটাকে আমি হেডিস বলতে পারি না। ভেতরটা যখন এরকম জগদ্দল পাথরের মতো ভারি হয়ে ওঠে তখন আমায় সুখের স্বর্গে রাখলেও সেটাকে হেডিসই বলব। এই বিশ্রী মুডের পরাক্রান্ত হাত এড়িয়ে মুক্তির জন্য কত শিখর আরোহণ করতে পারি, অজন্তা তো উচ্চতার দিক দিয়ে কোন ছার। কিন্তু আমাকে স্থানান্তরে গেলেই চলবে না, মনে হচ্ছে অন্য মন, অন্য মেজাজে যেতে হবে।’

পিকু বলল—‘দেখিস আবার।’

বুকিং অফিস থেকে বেরিয়ে এষা সোজা চলে গেল এসপ্লানেড পোস্ট অফিস। তার করল একটা। ‘রীচিং কল্যাণ বাই গীতাঞ্জলি, সেভেনটিন্থ মার্চ।’ পশ্চিম উপকূল একেবারেই অচেনা। বোম্বাই ছাড়া। চেনা-শোনা কেউ নেই। লক্ষ্ণৌতে একা গিয়ে কি অশান্তিই হয়েছিল। লক্ষ্ণৌ শহরে যে অত মস্তানি জানা ছিল না। হিপি মেয়ে পাশেই ঘুরছে গায়ে শততালি পোশাক, কাঁধে রুকস্যাক, হাতে ক্যামেরা, তাকে কেউ বিরক্ত করছে না। কিন্তু শাড়ি-পরা ভারতীয় মেয়েদের একলা বেড়াবার ইচ্ছে হতে নেই। শিবাজির মাওলি সেনার বংশধররা এখন কি করে সময় কাটায় কে জানে। কল্যাণে যদি কাউকে না পাওয়া যায়? কানেকটিং ট্রেনে পুনে চলে যেতে হবে। পৌঁছতে কত রাত হবে কে জানে! রিটায়ারিং রুম কি আর নেই! রাতটা সেখানে কাটিয়ে সকালে খুঁজে বার করতে হবে ট্যুরিস্ট অফিস। ঔরঙ্গাবাদ হয়ে অজন্তা।

অরিত্র চৌধুরীকে কেন টেলিগ্রাম করল জানে না এষা। অরিত্র চৌধুরী পৃথিবীর সেই শেষতম ব্যক্তিদের অন্যতম হওয়া উচিত যাকে এষা টেলিগ্রাম করতে পারে। অথচ কথাটা মনে হল টেলিগ্রামটা করে দেওয়ার পর। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল এষা। তাকে দিয়ে কে এটা করিয়ে নিল সে জানে না। গোটা জীবনটাই তো যা যা সহজভাবে করতে ইচ্ছে করে সে সব ইচ্ছের মুখে পাথর চাপা দেবার অভ্যাস গড়ে তোলার নিখুঁত প্রোগ্রেস রিপোর্ট। মাঝে মাঝে সেইসব গর্ভে-বিনষ্ট ইচ্ছারা এইভাবে শোধ নেয়। এষা বাইরে বেরিয়ে বাস-ডিপোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করল মাঝে মাঝে এমনি হেরে যাওয়া স্বাস্থ্যকর। ছোট ঘোট হার। বড় বড় জিত।

সেই দ্বিধাগ্রস্ত টেলিগ্রাম নতুন উড়তে-শেখা পাখির ছানার মতো দফায় দফায় গন্তব্যে পৌঁছল। এসেছিল অফিসের ঠিকানায়। অরিত্র এখনও অফিসে যোগ দেয়নি। তাই বিকেলবেলায় ঝড়ো স্কুটারে তার পি এ মণ্ডল এসে দিয়ে গেল। তখন টুকরো রোদের যৎসামান্য লনে বসে অরিত্র নীলমের সঙ্গে বৈকালী চা খাচ্ছিল। পেস্ট্রি করেছে আজ নীলম। চকোলেট-ক্রিম। একবাক্স নিয়ে গেছে পুপু। গোয়াতে এক্সকার্শনে গেল বন্ধুদের সঙ্গে। ট্রেনে খাবে। টেলিগ্রামটা টেবিলের ওপর রেখে পায়ে পা ঠুকে মিলিটারি কায়দায় স্যালুট করল মণ্ডল, বলল—‘একটুও বসতে পারছি না ভাবী। পেস্ট্রি রিজার্ভড রইল ফর সাম আদার টাইম। আশা করি ভুলবেন না।’

নীলম হেসে বলল—‘তোমাকে কি আরও টেলিগ্রাম বিলি করতে হবে? তোমার বস বসে গিয়ে কি তোমার ডিমোশন হল নাকি?’

মণ্ডল বলল—‘সুইট আর দা ইউসেস অফ ডিমোশন, যদি প্রত্যেকের বাড়িতে ঠিক বিকেলের টিফিনের সময় গিয়ে উপস্থিত হতে পারি। কিন্তু তা নয় ভাবী। বাড়িতে আজ শ্বশুরবাড়ির গেস্ট আসার কথা, দেরি হলে হাড় কখানা আস্ত থাকবে না।’

—‘শুধু শুধু বউয়ের বদনাম করছ? শীগগির পালাও।’ পেছন ফিরে এক লাফে স্কুটার চড়ল মণ্ডল। মুহূর্তে ধুলোর ঝড় দূরে মিলিয়ে গেল। এ বাড়িতে ওর আদর খুব। শুধু ওরই বা কেন? নীলম ভাবী বিরাট একটি লক্ষ্মণ-দলের মধ্যমণি। অরিত্রর চেয়েও নীলমের প্রভাব সেখানে কার্যকরী বেশি। নীলমের একটা মস্ত গুণ সে জাত-বিচার করে না। পি এ এবং চীফ এঞ্জিনিয়ার তার কাছে এক খাতির পায়, মানুষ হিসেবে যদি তাকে আকৃষ্ট করতে পারে। কোনও শিল্পাঞ্চলেই এই মনোভাব সুলভ নয়। অবশ্য পুনের শিল্পাঞ্চলগুলো এবং তাদের কর্মীরা আরও অনেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করেন। ঠিক একটা—টাটানগর কি আই আই টি কলোনি গড়ে ওঠার এখানে সুযোগ পায়নি। বৃহৎ মেট্রোপলিসের কিছু কিছু গুণ তাই তার আয়ত্ত হয়েছে। না হলে নীলমের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিকতা মার খেতো কি না বলা শক্ত।

প্রিয়লকরনগর তৈরি হচ্ছে আনকোরা নতুন। চারদিকে সাদা ধুলো। এ ধুলোয় ধুলোয় ধূসর হবার ধুলো। মলিন হয় না কিছু। দুদিকে লম্বা লম্বা গাছ একটু এগিয়ে গেলেই। গুল্মও আছে প্রচুর বিল্ডিং ব্লকগুলোকে ঘিরে ঘিরে। এখন উঁচু বেড়া দেওয়া। মণ্ডল চোখের বাইরে চলে গেল, গাছের মধ্যে বিন্দু হয়ে। নীলম বলল—‘দ্যাখো দ্যাখো ও বাড়ির খবর সব ভালো তো? ও কি? কি হল? অরিত্র পাহাড়ি বিছের মতো টেলিগ্রামটা হাত থেকে ফেলে দিয়েছে।—‘এষা আসছে, সতেরই মার্চ। গীতাঞ্জলি।’

নীলমের মুখ অরিত্রর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাংশু হচ্ছে। কোনও কথা বলতে পারছে না। একটু পরে আধ-খাওয়া চায়ের কাপ ফেলে উঠে চলে গেল। অরি নিজের কাপটা নিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তার প্রতিক্রিয়া কেন এমন হল? নীলমের যাই হোক। এ টেলিগ্রাম কি একেবারেই অপ্রত্যাশিত? অফিসের সবুজ গোলাপি অ্যাক্রিলিক পেন্ট করা, হালকা সবুজ টালিছাওয়া মেঝের ওপর, রিভলভিং চেয়ারে বসে দিনের পর দিন যে চিঠি পাঠিয়েছে তার মর্মার্থ হল: এষা, তুমি এসো। তুমি একবার এসে দেখে যাও। অপ্রেমে বা প্রেমে নয়, নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব থাকে। সেই নীরবে বিকশিত হওয়া বৃক্ষ তার পত্রং, পুষ্পম, তার মাথায় সবুজ আশ্রয়ের ঘেরাটোপ, বিশ্বাস করো। এসো এষা। ভস্ম-অপমানশয্যা তোমাকে মানায় না। তবে কেন এষা টেলিগ্রাম করবে না! তবে কি অরিত্র মিথ্যাবাদী! চিরটাকাল এষার কাছে তার মিথ্যাবাদী হওয়ার নিয়তি! অথচ আর আর সম্পর্কগুলো দম দেওয়া ওয়াল-ক্লকের মতো ঠিক ঠাক, ঠিক ঠাক চলছে তো! শুদ্ধু একজনের সঙ্গে তার মিথ্যার সম্পর্ক? যা বলে তা বলতে চায় না! এষা এলে কি অরি তবে তাকে বলবে?—‘তুমি কেন এলে এষা?’ এষা বলবে—‘সে কি তুমি যে আসতে বলেছিলে?’

অরি কি তখন কবুল করবে?—‘আই ডিড্‌ন্‌ট্‌ মীন ইট।’

নাকি এষার সঙ্গে সম্পর্ক যার সে এই অরিত্রর ভেতরে এক অন্য আধো-চেনা অরিত্র। সে নিজেই তাকে সব সময়ে বুঝে উঠতে পারে না। শুকনো মুখে অরিত্র উঠে দাঁড়াল। ঈষৎ পা টেনে টেনে ভেতরে গেল। নীলম বসবার ঘরের ডিভানের ওপর বসে, তার মাথার কাছে আনজুনার নারকোল গাছ আর উচ্ছল সমুদ্র। ভগ্ন কোণাচে তটরেখা। দেয়াল ভর্তি পোস্টারে কিছু হিপিও ভাঙা ভাঙা রেখায় দেখা যায়। আনজুনা বেলাভূমির রোমান্টিক হর্ষের তলায় নীলমের বিষাদ একদম রক্তমাংসের, বাস্তব। সাবয়ব।

অরিত্র বলল—‘কি হল?’

নীলম উত্তর দিল না।

অনেকক্ষণ পরও অরিত্রকে একইরকম শুকনো করুণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল—‘কবে আসতে লিখলে? অপারেশনের পর জ্ঞান-হওয়া মাত্রই? মণ্ডলকেই ডিকটেট করলে, না কি? তোমার বশংবদ পার্সন্যাল অ্যাসিস্‌ট্যান্ট?’

আকাশ থেকে পড়ল অরিত্র—‘আমি কেন লিখব?’

‘মৃত্যুর কথা মনে হলে প্রিয়জনের কথা মনে হতেই পারে।’

অরিত্র গম্ভীর হয়ে বলল—‘নীলম, আমি এষাকে আসতে লিখিনি। ক্যাজুয়্যালি লিখেছি কখনও কখনও, অবশ্য। কিন্তু এখন এই কদিনের মধ্যে তা-ও না। চিঠি দিই মাঝে মধ্যে। সেগুলো তুমি ইচ্ছে করলেই পড়তে পারো। ও কেন আসতে চাইছে আমি জানি না। তোমার যদি খুব খারাপ লাগে, তাহলে বরং আমাদের অক্ষমতা জানিয়ে আমি পাল্টা টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি।’

‘থাক।’ নীলম সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে, উঠে চলে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress