Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu » Page 18

পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu

ছাদে পদ্মফুলের পুকুর করিয়েছে সীমা। পশ্চিমবাংলার হুগলি জেলায় তার বাপের বাড়িতে ছিল পদ্ম, শালুক। বম্বেতে মাটি বড় দামী। তাই গাড়ি বারান্দায় বাগান। অতিথিদের জন্য ওয়ার্ডরোব ভর্তি নতুন রাত-পোশাক, ড্রেসিং গাউন। নতুন চটি। বিক্রম তার দুটো গাড়ি সবসময়ে হাজির রেখেছে। কে কখন কোথায় যেতে চায়!

‘এইভাবে অতিথি-সৎকার, সীমা করেছ কি?’

সীমা বলল—‘যিনি তিথিতে আসেন না, অসময়ে, অপ্রস্তুত হয়ে আসেন তিনিই তো অতিথি। এর পরে আমার বাড়ি হালকা হয়ে আসতে পারবে এষাদি।’

সীমার বাড়ির লাইব্রেরি, ছবি আর ভাস্কর্যের সংগ্রহ দেখে মহানাম অবাক। যে অ্যালবামই চান সীমা বার করে দেয়। অজন্তার তো বটেই। তাঁর নিজেরও এতো নেই। মনের আনন্দে পুপুকে নিয়ে স্কেচ করছেন মহানাম। এই সব স্কেচ তাঁর বইতে ব্যবহৃত হবে, বলছেন ঋণ স্বীকারে সীমা শীল আর সমিদ্ধা চৌধুরী অবশ্যই থাকবে।

দেখতে দেখতে মহানাম জিজ্ঞেস করছেন—‘এসব কার নেশা সীমা!’

সীমা হেসে বলল—‘কারুর নেশা নয় মহানামদা। কালো টাকা খরচ করবার বহুবিধ উপায়ের একটা। আপনি কোনদিন পায়ের ধুলো দেবেন বলে আমাদের হাত দিয়ে এসব কেনা হয়ে আছে। দেখছেন না সোনার জলে দাগ পড়ে না, খোলে না কেউ পাতা।’

পুপু বলল—‘কাকীমা, তোমার এতো হিউমিলিটি কেন? আর ইউ ডেলিবারেটলি কালটিভেটিং ইট? ডক্টর রয়, জানেন সীমা কাকীমার অনেক নেশা, অনেক গুণ, শী ইজ ভেরি ভেরি মাচ অ্যাকমপ্লিশ্‌ড্‌। স্বীকার করতে চায় না কিছুই। শার্লক হোম্‌স্ বলেছিলেন মডেস্টি মোটেই গুণ নয়, মডেস্টি ইজ অ্যানাদার নেম ফর হিপোক্রিসি। এটা সীমাকে বলুন তো!’

সীমা কি করে বলবে, ঠিক ঠিক জায়গা থেকে স্বীকৃতি এবং সাধুবাদ না পেলে সব গুণই ফুটো পয়সা হয়ে যায়। বললেও পুপু বুঝবে না। সে আপন মনে নিজের যা ভালো লাগে করে যায়, কারও স্বীকৃতি, কারো সাধুবাদের তোয়াক্কা করে না। এটা কি পুপুরই চারিত্র্য না নতুন যুগের মেয়েদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য—এটা লক্ষ্য করে দেখা দরকার। যদি শেষেরটা হয় তাহলে সীমা খুব খুশি হবে। বৃদ্ধ বয়সে কোনও করপোরেশনের চেয়ারম্যানের স্ত্রী হিসেবে কোনও সভায়-টভায় গিয়ে গলায় প্রধান অতিথির মালা নিয়ে সে নতুন প্রজন্মের এই গুণের কথা উল্লেখ করবে, এটা যে নিশ্চিত একটা অগ্রগতির ছাপ, সে কথা শতমুখে বলবে।

চৌপাটির ফুচকাঅলা আর ভেলপুরি ধরে ফেলেছে সীমাকে। আইসক্রিম হাতে মহানামের সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে চলেছে পুপু। এষা কিছুতেই পেছনে পড়ে থাকবে না। নীলম একদম সাদা শাড়ি ব্লাউস পরে অরিত্রর পাশে পাশে হাঁটছে, অরিত্র আজকে একটু পা টেনে হাঁটছে। বিক্রম বলছে—‘কি ড্রেস দিয়েছো ভাবী! তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু চৌধুরীদা যে বিধবা হয়ে গেল!’

হাসি চাপতে পারছে না নীলম, বলল—‘তোমারও একটু বিধবা হওয়া দরকার। কাল সীমা এই ড্রেস করবে।’

এষা কথা বলছে না। ঔরঙ্গাবাদ থেকে ফিরে অবধি একটা কথাও বলেনি। প্রশ্ন করলে হুঁ হাঁ জবাব দিয়ে গেছে খালি।

‘শরীর খারাপ নাকি এষা?’

‘না।’

‘মন ঠিক হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ।

‘জাহাজে গোয়া যাবো, দেখবে কি ভালো লাগে। গোয়া তো আগে দেখোনি!’

‘না।’

‘ভালো লাগছে না?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার ওপর রাগ করেছ?’

‘না।’

‘রাগ পড়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ।’

পুপু বলল—‘বাবা, তোমরা ভীষণ আস্তে হাঁটছ। ডক্টর রয় বলছেন গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া দিয়ে ভাইসরয়দের ঢুকতে দেখবেন। এষামাসি বলেছে এলিফ্যান্টা আগে দেখেছে আর দেখবে না, মুড নেই।’

বিক্রম বলল—‘এষাজীকে একবার সমুদ্দুরে চুবিয়ে আনতে হবে জুহু বীচে। বাস মুড ঠিক হয়ে যাবে।’

এষা বলল—‘সমুদ্রে নামলে আর উঠব না, যেখানকার জিনিস সেখানেই ফিরে যাব।’

সীমা বলল—‘সমুদ্রের তলা থেকে এসেছিলে? তুমি লক্ষ্মী না ঊর্বশী? এষাদি!’

এষা বিষণ্ণ গলায় বলল—লক্ষ্মীও নই, ঊর্বশীও নই। আমি বিষের পাত্র সীমা।

‘মাতা নও, বধূ নও, যতদূর শুনেছি তুমি কন্যাও নয়, তাহলে তুমি ঊর্বশী ছাড়া কি?’—বলল বিক্রম মনে মনে।

অরিত্র মনে মনে বলল—‘অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা। নাচে রক্তধারা। হে নন্দনবাসিনী ঊর্বশী।’

মহানাম বললেন—‘ইটস আ ম্যাটার অফ চয়েস এষা। তুমি ঊর্বশী হবে না লক্ষ্মী হবে?

এষা বলল—‘আমি যে কোনটাই হতে চাই না মহানামদা। আপনাদের কল্পনায় আর কোনও বিকল্প নেই?’

‘আছে,’ মহানাম বললেন, ‘বিষের পাত্র না হয়ে তুমি তো অমৃতের পাত্রও হতে পারো। সমিদ্ধা, তুমি কি হতে চাও মা?’

পুপু বলল—‘আমি অমৃতও হতে চাই না। ইট উড বোর মি স্টিফ টু বি ইম্মর্ট্যাল, ইট ইজ মাচ বেটার টু বি বাব্‌ল্‌স্, ফুল অফ কালার অ্যান্ড ডেথ।’

মহানাম বললেন—

‘হে বিরাট নদী,

অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল

অবিচ্ছিন্ন অবিরল

চলে নিরবধি।

দ্যাখো এষা, দ্যাখো নীলম, ঈশ্বরের কোনও দোষ নেই। মানুষ নিজেই মৃত্যু চেয়েছে। অভিমানে নয়, ভালোবেসেই চেয়েছে। ফ্রয়েড-এর থ্যানাটস, যে মৃত্যু-ইচ্ছা ঘৃণার নামান্তর—তেমন নয়, পুপুর মতো রোমান্টিক আবেগে সে শেষকে চেয়েছে। তাই মৃত্যু এল। তারপর একদিন অস্মার রোগে সে ভুলে গেল সে এই-ই চেয়েছিল। ভীষণ রেগে গেল। নানা রকম গল্প বানালো। সেইদিন থেকেই ঈশ্বরের সঙ্গে তার ঝগড়া!’

অরিত্র বলল—‘আপনি তাহলে অ্যানথ্রপোমর্ফিক গড মানছেন মহানামদা! হাত-পা-অলা মানুষের আদলের ভগবান। গড মেড ম্যান ইন হিজ ওন ইমেজ, অ্যান্ড ম্যান রিটার্ন্‌ড্‌ দা কমপ্লিমেন্ট!’

মহানাম হেসে বললেন—‘তুমি আজকাল অলঙ্কার ধরতে পারো না অরি, তুমি কি তবে পুরোপুরিই বাণিজ্যিক সংস্থার আধিকারিক হয়ে গেলে, কবি আর একদম নেই?’

নীলম বলল—‘মহানামদা, অরি কোনদিনই কবি ছিল না। গিফ্‌ট্‌ অফ দা গ্যাব ছিল খানিকটা। আর যৌবনে তো কুক্কুরীও অপ্সরী!’

সীমা বলল—‘অরিদা কবি ছিলেন না কি? হতে পারে। বিক্রমও তো এককালে গায়ক ছিল। এখন ও নিজের ব্যবসা দেখে, অরিদা পরের ব্যবসা দেখেন।’

বিক্রম প্রবল প্রতিবাদ করে বলল—‘বাঃ, আমি তো এখনও গাই।’

সীমা বলল—‘গাও। কিন্তু তুমি আর গায়ক নেই।’

বিক্রম বলল— ‘যা ব্বাবা।’

এষা একটাও কথা বলেনি ঔরঙ্গাবাদ থেকে ফিরে। কথার জবাবে শুধু হুঁ হাঁ করে গেছে। যখন সামান্য কথা বলছে, বলছে পুপুর সঙ্গে, নীলমের সঙ্গে, সীমার সঙ্গে, মহানামের সঙ্গে, এমন কি বিক্রমের সঙ্গে, শুধু অরি বাদ। অরি বাদ।

অথচ কি করেছে সে? কিছুই না। কিচ্ছু না। এক সময়ে সে-ই তো এষার সব ছিল। এষার ওপর তার সম্পূর্ণ অধিকার ছিল। তার বুকের মধ্যে মাখনের মতো গলে যেত এষা-প্রেষা। যেত না? এষার হাত, পা, ঠোঁট, বুক সব নরম মোমের তৈরি ছিল, অরিত্রর উত্তাপে টলটল করত সেই মোম। এষাকে তো এষা করেছে অরিত্রই। অতিশয় রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। এষা বলত—‘জানো অরি, আমার দিদিরা সব কেউ গোলাপফুলের মতো, কেউ কনক চাঁপার মতো ফর্সা, দাদারা এক একজন গৌরাঙ্গ। আমিই একমাত্র কালো, কুৎসিত। ছোটবেলা থেকে পিসিমা আমায় রূপটান মাখাচ্ছেন। টানই হল, রূপ আর হল না।’ আবার কখনও বলত—‘জানো অরিত্র, আমার দাদা-দিদিরা মোটা মোটা বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকে দিনরাত। ‘হিউম্যান ডেসটিনি’, ‘রিলিজন উইদাউট রেভিলেশন,’ ‘দা কসমিক ব্লু-প্রিন্ট’। ওই একটা বাড়ির বিভিন্ন শাখা থেকে যে কত পণ্ডিত বেরিয়েছে ভাবতে গেলে মাথা ঘুরে যায়। আমি সেখানে মূর্খ, একেবারে আকাট, অরিত্র।’ বলতে বলতে হাসত এষা। হাসলেও সেই হাসির মধ্যে একটি নিন্দিত বালিকার কান্না শুনতে পেত অরিত্র।

দূর থেকে দেখেছে খানদের বাড়ি থেকে লম্বা গাড়ি বেরিয়ে গেল, ভেতরে হীরে জহরতে মোড়া কিছু অপ্সরী। ভ্রমরকৃষ্ণ কেশদাম, পদ্মপলাশ নয়ন, তিলফুলজিনি নাসা, পক্কবিম্বাধরোষ্ঠ, এষার যৌথ পরিবারের দিদিরা। আলাদা করে অবয়বগুলো দেখতে হয়, গর্বিত মুখভাব, রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন না। সুন্দর। মুখ চোখের বিচারে কিন্তু তাঁদের নিয়ে কবিতা লেখার কথা কেউ ভাববে না। এষা বেরিয়ে আসছে ওই দ্যাখো। দেওদার এক। খান বাড়ির বিরাট সিংদরজা যেন এই আবির্ভাবকে নমস্কার করে বন্ধ হয়ে গেল। চারপাশে জনতা। গাড়ি ঘোড়া ছুটছে। অথচ অরিত্র দেখছে নেই, আর কেউ নেই। যথাযথ পশ্চাৎপট না হলে ছবি ফোটে না, সরু গলির মধ্যে যেমন জগন্নাথ মন্দির। বার হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচি। অথচ দিগন্তজোড়া ধুধু বালুময় শূন্যতার মাঝেখানে কি সুন্দর দাঁড়িয়ে আছে কোণার্ক। তার পূর্ণ মহিমায়। রক্ষণশীল, অন্ধ বনেদিয়ানার পার্সপেকটিভ। অজস্র, মুখের, গাড়ির অর্থহীন মিছিল পৃষ্ঠপটে। এষা আসছে অর্থময়ী। সেই চিরায়মানা।

সে কি ঘুমাবে একা একা এ ঝড়ের রাত

বুকে হাঁটবে অন্ধগলি প্রত্যাশায়

সে কি থাকবে গর্ভজলে বন্দী মা’র

প্রলয় রাতে কোথায় শল্য চিকিৎসক?

শঙ্খমুখে দাঁড়িয়ে থেকো উঠোন-কোণ

শব্দে ধ্বনি প্রতিধ্বনি মেলাতে দাও

সাধ্য হলে এভাবে বাগ-বিস্ফোরণ

সে কি জাগবে? সে কি আনবে মুক্তি পণ?

অরিত্র কি এষার জন্ম দেয়নি? ঊর্‌র্‌র্‌ নাগিন, লাচ্ নাগিন, লাচ্ নাগিন, লাচ্‌। য়ুনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুটের লোকসংস্কৃতির উৎসবে, সাপুড়ের বাঁশির তালে নাগিন নাচেনি? তার চোখে জন্মান্তরের স্মৃতি উলসে ওঠেনি! তবে? সেই তুলনাহীনা গ্যালেশিয়া যাকে সে নিজের হাতে গড়েছে, সে কি এখন পিগম্যালিয়নের নয়? সমস্ত বিশ্বের হয়ে গেছে?

অরিত্র মনে মনে নিজেই নিজের চুল ছেঁড়ে, হাত পা চিবোয়, কামড়ায় রূপকথার সেই কুমীরটার মতো। তারপর রক্তারক্তি কাণ্ড করে মরে যায়। আর সেই মৃত্যুর ওপর দিয়ে মিছিল করে হাসতে হাসতে গোয়াগামী ‘কনডর’ জাহাজটাতে মোটঘাট নিয়ে উঠে যায় পরাক্রান্ত বিক্রম, উজ্জ্বল হাসিমুখে মহানাম, উদাসীন, অন্যমনস্ক এষা-প্রেষা, এবং কমলারঙের স্ল্যাক্‌স্ পরে, কমলা লিপস্টিক ঠোঁটে, কাঁধে কমলা ব্যাগ, আঙুলে কমলারঙ, লজেন্সের মোড়কে চকচকে সীমা, সর্বশেষে, অবশেষে ঝেড়েঝুড়ে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে অগত্যা অরিত্র চৌধুরী।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress