Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নৃসিংহ রহস্য || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 4

নৃসিংহ রহস্য || Shirshendu Mukhopadhyay

দারোগা বজ্রাঙ্গ বোস

পরদিন দারোগা বজ্রাঙ্গ বোস তদন্তে এলেন। খুবই দাপুটে লোক। লম্বা-চওড়া চেহারা। প্রকাণ্ড মিলিটারি গোঁফ। ভূত আর আরশোলা ছাড়া পৃথিবীর আর কাউকেই ভয় পান না। তিনি এ-অঞ্চলে বদলি হয়ে আসার আগে এখানে চোর আর ডাকাতদের ভীষণ উৎপাত ছিল। কেলো, বিশে আর হরি ডাকাতের দাপটে তল্লাট কাঁপত। গুণধর, সিধু আর পটলা ছিল বিখ্যাত চোর। এখন সেই কেলো আর বিশে বজ্রাঙ্গ বোসের হাত-পা টিপে দেয় দুবেলা। হরি দারোগাবাবুর স্নানের সময় গায়ে তেল মালিশ করে। গুণধর কুয়ো থেকে জল তোলে, সিধু দারোগাবাবুর জুতো বুরুশ করে আর পটলা বাগানের মাটি কুপিয়ে দেয়।

বজ্রাঙ্গ বোস গয়েশবাবুর বাড়িটা ঘুরে-ঘুরে দেখলেন। বিরাট বাড়ি। সামনে এবং পিছনে মস্ত বাগান। তবে সে বাগানের যত্ন নেই বলে আগাছায় ভরে আছে। নীচে আর ওপরে মিলিয়ে দোতলা বাড়িটাতে খান আষ্টেক ঘর। তার বেশির ভাগই বন্ধ। নীচের তলায় শুধু সামনের বৈঠকখানা আর তার পাশের শোবার ঘরটা ব্যবহার করতেন গয়েশবাবু। বৈঠকখানায় পুরনো আমলের সোফা, কৌচ, বইয়ের আলমারি, একটা নিচু তক্তপোশের ওপর ফরাস পাতা, তার ওপর কয়েকটা তাকিয়া। শোবার ঘরে মস্ত একটা বাহারি খাট, দেওয়াল আলমারি, জানালার ধারে লেখাপড়ার জন্য টেবিল চেয়ার। জল রাখার জন্য একটা টুল রয়েছে বিছানার পাশে। খাটের নীচে গোটা দুই তোরঙ্গ। সবই হাঁটকে-মাটকে দেখলেন বজ্রাঙ্গ। তেমন সন্দেহজনক কিছু পেলেন না।

গয়েশবাবুর রান্না ও কাজের লোক ব্রজকিশোর হাউমাউ করে কেঁদে বজ্ৰাঙ্গর মোটা-মোটা দু’খানা পা জড়িয়ে ধরে বলে, “বড়বাবু, আমি কিছু জানি না।”

বজ্ৰাঙ্গ বজ্ৰাদপি কঠোর স্বরে বললেন, “কী হয়েছিল ঠিক ঠিক বল।”

ব্রজকিশোর কাঁধের গামছায় চোখ মুছে বলল, “আজ্ঞে, বাবু রাতের খাওয়ার পর একটু পায়চারি করতে বেরোতেন। হাতে টর্চ আর লাঠি থাকত। সেদিনও রাত দশটা নাগাদ বেরিয়েছিলেন। বাবু ফিরলে তবে আমি রোজ শুতে যাই। সেদিনও বাবুর জন্য বসে ছিলাম। সামনের বারান্দায় বসে ঢুলছি আর মশা তাড়াচ্ছি। করতে করতে রাত হয়ে গেল। বড় ঘড়িতে এগারোটা বাজল। তারপর বারোটা। আমি ঢুলতে-দুলতে কখন গামছাখানা পেতে শুয়ে পড়েছি আজ্ঞে। মাঝরাতে কে যেন কানে কানে ফিসফিস করে বলল, এখনও ঘুমোচ্ছিস আহাম্মক? গয়েশবাবুকে যে কেটে দুখানা করে ধড়টা নদীর জলে ভাসিয়ে দিল আর মুণ্ডুটা ঝুলিয়ে দিল গাছে। সেকথা শুনে আমি আঁতকে জেগে উঠে দেখি সদর দরজা খোলা। বাবু তখনও ফেরেনি। তখন ভয় খেয়ে আশপাশের লোকজন ডেকে দু’চারজনকে জুটিয়ে বাবুকে খুঁজতে বেরোই। ভোররাতের আলোয় ভাল ঠাহর পাইনি বড়বাবু, তাই

নদীর জলে যা ভাসছিল, সেটাকেই বাবুর ধড় আর গাছের ডালে যেটা ঝুলছিল সেটাকেই বাবুর মুণ্ডু বলে ঠাহর হয়েছিল আমাদের। কিন্তু বাবুর যে সত্যি কী হয়েছে তা জানি না।”

বজ্ৰাঙ্গ ধমক দিয়ে বলেন, “টর্চ আর লাঠির কী হল?”।

ব্রজকিশোর জিব কেটে নিজের কান ছুঁয়ে বলল, “একেবারে মনে ছিল না আজ্ঞে। হাঁ, সে দুটো আমরা কুড়িয়ে পেয়েছি, টর্চটা নদীর ধারে পড়ে ছিল, লাঠিটা সেই অলক্ষুণে শিমুলগাছের তলায়।”

“আর লোকটা নিরুদ্দেশ?”

“আজ্ঞে।”

কথাবার্তা হচ্ছে সামনের বারান্দায়। বজ্রাঙ্গ চেয়ারের ওপর বসা, পায়ের কাছে ব্রজকিশোর। পুলিশ এসেছে শুনে বিস্তর লোক জড়ো হয়েছে সামনে। রামরিখ, সুমন্তবাবু, সান্টু, মঙ্গল, মৃদঙ্গবাবু, নেপাল, কে নয়? বজ্রাঙ্গ তাদের দিকে চেয়ে একটা বিকট হাঁক দিয়ে বললেন, “তাহলে গেল কোথায় লোকটা?”

বজ্ৰাঙ্গের হাঁক শুনে ভিড়টা তিন পা হটে গেল।

বজ্ৰাঙ্গ কটমট করে লোকগুলোর দিকে চেয়ে বললেন, “নিরুদ্দেশ হলেই হল? দেশে আইন নেই? সরকার নেই? যে যার খুশিমতো খবরবার্তা না দিয়ে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলেই হল? এই আপনাদের বলে দিচ্ছি, এরপর থানায় ইনফরমেশন না দিয়ে কারও নিরুদ্দেশ হওয়া চলবে না। বুঝেছেন?”

বেশির ভাগ লোকই ঘাড় নেড়ে কথাটায় সম্মতি জানাল।

শুধু পরেশের ভাগ্নে কলকাতার সেই ফাজিল ছোঁকরা পল্টু বলে উঠল, “বজ্রাঙ্গবাবু, খুন হলেও কি আগে ইনফরমেশন দিয়ে নিতে হবে?”

বজ্রাঙ্গবাবুর কথার জবাবে কথা কয় এমন সাহসী লোক খুব কমই আছে। ছোঁকরার এলেম দেখে বজ্রাঙ্গবাবু খানিকক্ষণ হাঁ করে রইলেন। পরেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে হাতজোড় করে বলে, “আমার ভাগ্নে এটি। সদ্য কলকাতা থেকে এসেছে, আপনাকে এখনও চেনে না কিনা।”

একথায় বাঙ্গবাবুর বিস্ময় একটু কমল। বললেন, “তাই। বলল। কলকাতার ছেলে। তা ওহে ছোরা, খুনের কথাটা উঠল কিসে? কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ খুন-খুন করে গলা শুকোচ্ছ কেন?”

পল্টু ভালমানুষের মতো বলল, “খুনের কথা ভাবলেই আমার গলা শুকিয়ে যায় যে! তার ওপর অপঘাতে মরলে লোকে মরার পর ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেদিন রাত্রে–থাক, বলব না।”

বজ্রাঙ্গবাবু কঠোরতর চোখে পল্টুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কেউ যদি “সেদিন রাত্রে–” বলে একটা গল্প ফাঁদবার পরই “থাক, বলব না” বলে বেঁকে বসে তাহলে কার না রাগ হয়। বজ্রাঙ্গবাবুরও হল। গাঁক করে উঠে বললেন, “বলবে না মানে? ইয়ার্কি করার আর জায়গা পাওনি?”

পল্টু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “আপনারা বিশ্বাস করবেন না। বললে হয়তো হাসবেন। কিন্তু সেদিন রাত্রে–উরেব্বাস!”

বজ্রাঙ্গবাবু ধৈর্য হারিয়ে একজন সেপাইকে বললেন, “ছেলেটাকে জাপটে ধরো তো! তারপর জোরসে কাতুকুতু দাও।”

এতে কাজ হল। পল্টু তাড়াতাড়ি বলতে লাগল, “সেদিন রাত্রে আমি গয়েশবাবুকে দেখেছি।”

“দেখেছ? তাহলে সেটা এতক্ষণ বলোনি কেন?”

“ভয়ে। আপনাকে দেখলেই ভয় লাগে কিনা।”

একথা শুনে বজ্রাঙ্গবাবু একটু খুশিই হন। তাঁকে দেখলে ভয় খায় না এমন লোককে তিনি পছন্দ করেন না। গোঁফের ফাঁকে চিড়িক করে একটু হেসেই তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাত তখন ক’টা?”

“নিশুতি রাত। তবে ক’টা তা বলতে পারব না। আমার ঘড়ি নেই কিনা। মামা বলেছে বি-এ পাশ করলে একটা ঘড়ি কিনে দেবে। আচ্ছা দারোগাবাবু, একটা মোটামুটি ভাল হাতঘড়ির দাম কত?”

গম্ভীরতর হয়ে বজ্রাঙ্গবাবু বললেন, “ঘড়ির কথা পরে হবে। আগে গয়েশবাবুর কথাটা শুনি।”

“ও হ্যাঁ। তখন নিশুতি রাত। হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম, একটা লোক নিজের কাটা মুণ্ডু হাতে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই দেখে ভয়ে”

বজ্রাঙ্গবাবুর মুখটা একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ভূত তিনি মোটেই সইতে পারেন না। সামলে নিয়ে বললেন, “দ্যাখো ছোঁকরা, বেয়াদবি করবে তো তোমার মুণ্ডুটাও–”

“আচ্ছা, তাহলে বলব না। “ বলে পল্টু মুখে কুলুপ আঁটে।

বজ্রাঙ্গবাবু একটু মোলায়েম হয়ে বলেন, “বলবে না কেন? বলো। তবে ওইসব স্বপ্নের ব্যাপার-ট্যাপারগুলো বাদ দেওয়াই ভাল। ওগুলো তো ইররেলেভ্যাণ্ট।”

পল্টু মাথা নেড়ে বলে, “আপনার কাছে ইররেলেভ্যাণ্ট হলেও আমার কাছে নয়। স্বপ্নটা না দেখলে আমার ঘুম ভাঙত না। আর ঘুম না ভাঙলে গয়েশবাবুকেও আমি দেখতে পেতাম না।”

“আচ্ছা বলো।” বজ্রাঙ্গবাবু বিরস মুখে বলেন।

“আমি শুই মামাবাড়ির ছাদে একটা চিলেকোঠায়। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমার আর ঘুম আসছিল না। কী আর করি? উঠে সেই শীতের মধেই ছাদে একটু পায়চারি করছিলাম। তখন হঠাৎ শুনি, নীচের রাস্তায় কাদের যেন ফিসফাস কথা শোনা যাচ্ছে। উঁকি মেরে দেখি, গয়েশবাবু একজন লোকের সঙ্গে খুব আস্তে-আস্তে কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছেন।”

“লোকটাকে লক্ষ করেছ?”

“করেছি। রাস্তায় তেমন ভাল আলো ছিল না। তাই অস্পষ্ট দেখলাম। তবে মনে হল লোকটা বাঁ পায়ে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে।”

“কতটা লম্বা?”

“তা গয়েশবাবুর মতোই হাইট হবে।”

“চেহারাটা দেখনি? মুখটা?”

“প্রথমটায় নয়। ওপর থেকে মনে হচ্ছিল, লোকটার হাইট স্বাস্থ্য সবকিছুই গয়েশবাবুর মতো।”

“তাদের কথাবার্তা কিছু কানে এসেছিল?”

“আজ্ঞে না। তবে মনে হচ্ছিল তাঁরা দুজন খুব গুরুতর কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। গয়েশবাবুকে দেখে আমি ছাদ থেকে বেশ জোরে একটা হাঁক দিলাম, গয়েশকাকা-আ-আ…”

পল্টু এত জোরে চেঁচাল যে, বজ্ৰাঙ্গ পর্যন্ত কানে হাত দিয়ে বলে ওঠেন, “ওরে বাপ রে! কানে তালা ধরিয়ে দিলে!”

পল্টু ভালমানুষের মতো মুখ করে বলে, “যা ঘটেছিল তা হুবহু বর্ণনার চেষ্টা করছি।”

“অত হুবহু না হলেও চলবে বাপু। একটু কাটছাঁট করতে পারো। যাক, তুমি তো ডাকলে। তারপর গয়েশবাবু কী করলেন?”

“সেইটেই তো আশ্চর্যের। গয়েশবাবুর সঙ্গে আমার খুব খাতির। উনি আমাকে নিয়ে প্রায়ই বড় ঝিলে মাছ ধরতে যান, চন্দ্রগড়ের জঙ্গলে আমি ওঁর সঙ্গে পাখি শিকার করতেও গেছি। ইদানীং দাবার তালিম নিচ্ছিলাম। যাঁর সঙ্গে এত খাতির, সেই গয়েশবাবু আমার ডাকে সাড়াই দিলেন না।”

“কানে কম শুনতেন নাকি?”

“মোটেই না। বরং খুব ভাল শুনতেন। উনি তো বলতেন, গহিন রাতে আমি পিঁপড়েদের কথাবার্তাও শুনতে পাই।”

“বলো কী! পিঁপড়েরা কথাবার্তা বলে নাকি?”

“খুব বলে। দেখেননি দুটো পিঁপড়ে মুখোমুখি হলেই একটু থেমে একে অন্যের খবরবাতা নেয়? পিঁপড়েরা স্বভাবে ভারী ভদ্রলোক।”

“আচ্ছা, পিঁপড়েদের কথা আর-একদিন শুনিয়ে দিও। এবার গয়েশবাবু…?”

“হ্যাঁ। গয়েশবাবু তো আমার ডাকে সূক্ষেপ করলেন না। আমার কেমন মনে হল, আমি ভাল করে গয়েশবাবুর হাঁটাটা লক্ষ করলাম। আমার মনে হল, উনি খুব স্বাভাবিকভাবে হাঁটছেন না, কেমন যেন ভেসে-ভেসে চলে যাচ্ছেন।”

“ভেসে-ভেসে?”

“ভেসে-ভেসে। যেন মাটিতে পা পড়ছে না। শুনেছি অনেক সময় লোকে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে হাঁটে। সে হাঁটা কেমন তা আমি দেখিনি। কিন্তু গয়েশবাবুকে দেখে মনে হল, উনি বোধহয় ঘুমিয়ে-ঘুমিয়েই হাঁটছেন, তাই আমার ডাক শুনতে পাননি। আমি তাড়াতাড়ি নীচে নেমে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম।”

“পড়লে?”

“উপায় কী বলুন? ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে হাঁটা তো ভাল অভ্যাস নয়। হয়তো খানাখন্দে পড়ে যাবেন, কিংবা গাছে বা দেয়ালে ধাক্কা খাবেন।”

“সঙ্গে একটা খোঁড়া লোক ছিল বলছিলে যে!”

“ছিল। কিন্তু দুজনেরই হাঁটা অনেকটা এরকম। দুজনেই যেন ভেসে-ভেসে যাচ্ছেন। দুজনেই যেন ঘুমন্ত।”

“গুল মারছ না তো?” বজ্রাঙ্গ হঠাৎ সন্দেহের গলায় বলেন।

“আজ্ঞে না। গুল মারা খুব খারাপ। কলকাতার ছেলেরা মফস্বলে গেলে গুল মারে বটে, কিন্তু আমি সে-দলে নই।”

“আচ্ছা বলো। তুমি তো বাড়ি থেকে বেরোলে–”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। বেরিয়েই আমি দৌড়ে গয়েশবাবুর কাছে পৌঁছে গিয়ে ডাক দিলাম, গয়েশকা–”।

“থাক থাক, এবার আর ডাকটা শোনাতে হবে না।”

পল্টু অভিমানভরে বলে, “কাছে গিয়ে তো চেঁচিয়ে ডাকিনি। আস্তে ডেকেছি।”

“ও। আচ্ছা, বলো।”

“ডাকলাম। কিন্তু এবারও গয়েশবাবু ফিরে তাকালেন না। তখন আমার স্থির বিশ্বাস হল, গয়েশবাবু জেগে নেই। আমি তখন ওঁদের পেরিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লাম। দাঁড়িয়ে যা দেখতে পেলুম তা আর বলার ভাষা আমার নেই। ওঃ…বাবা রে…”

বজ্রাঙ্গ নড়েচড়ে বসে পিস্তলের খাপে একবার হাত ঠেকিয়ে বললেন, “কাতুকুতু দিতে হবে নাকি?”

“না না, বলছি। ভাষাটা একটু ঠিক করে নিচ্ছি আর কি। দেখলাম কি জানেন? দেখলাম, খোঁড়া লোকটাও গয়েশবাবু, না–খোঁড়া লোকটাও গয়েশবাবু।”

“তার মানে?”

“অর্থাৎ দুজন গয়েশবাবু পাশাপাশি হাঁটছে।”

ফের গাঁক করলেন বাঙ্গ, “তা কী করে হয়?”

“আমারও সেই প্রশ্ন। তা কী করে হয়। আমি চোখ কচলে গায়ে চিমটি দিয়ে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, চোখের ভুল নয়। দুজনেই গয়েশবাবু। এক চেহারা, এক পোশাক, শুধু দুজনের হাঁটাটা দুরকম।”

“ঠিক করে বলো। সত্যি দেখেছ, না হ্যালুসিনেশান?”

“আপনাকে ছুঁয়ে দিব্যি করতে পারি। একেবারে জলজ্যান্ত চোখের দেখা।”

“তুমি তখন কী করলে?”

“আমি তখন বহুবচনে বললাম, গয়েশকাকারা, কোথায় যাচ্ছেন এই নিশুতি রাত্তিরে? কিন্তু তাঁরা তবু ভূক্ষেপ করলেন না। আমাকে যেন দেখতে পাননি এমনভাবে এগিয়ে আসতে লাগলেন।”

“আর তুমি দাঁড়িয়ে রইলে?”

“পিছোনোর উপায় ছিল না। রাস্তা জুড়ে আমার পিছনে একটা মস্ত ষাঁড় শুয়ে ছিল যে! আমি বললাম, কাকারা, থামুন। আপনারা ঘুমের মধ্যে হাঁটছেন। কিন্তু তাঁরা আমাকে পাত্তাই দিলেন না। সোজা হেঁটে এসে আমাকে ভেদ করে চলে গেলেন।”

“ভেদ করে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। ভেদ করা ছাড়া আর কী বলা যায়? আমার ওপর দিয়েই গেলেন কিন্তু এতটুকু ছোঁয়া লাগল না। গয়েশবাবু খোঁড়া গয়েশবাবুকে তখন বলছিলেন…”

অস্ফুট একটা ‘রাম-রাম’ ধ্বনি দিয়ে বজ্রাঙ্গ হুহুংকারে বলে উঠলেন, “দ্যাখো, তোমাকে সোজা বলে দিচ্ছি, সরকারি কাজে বাধার সৃষ্টি করা রাজদ্রোহিতার সামিল।”

পল্টু অবাক হয়ে বলে, “আমি আবার সরকারি কাজে কখন বাধা দিলাম?”।

বজ্ৰাঙ্গ চোখ পাকিয়ে বললেন, “এই যে ভূতের গল্প বলে তুমি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ এটা সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কী হতে পারে? আমি ভয় পেয়ে গেলে তদন্ত হবে কী করে?”

সকলেরই একটু-আধটু হাসি পাচ্ছে, কিন্তু কেউ হাসতে সাহস পাচ্ছে না। পল্টু করুণ মুখ করে বলল, “ঘটনাটা ভৌতিক নাও হতে পারে। হয়তো ও দুটো গয়েশকাকুর ট্রাই ডাইমেনশনাল ইমেজ।”

বজ্রাঙ্গ হুংকর দিলেন, “মানে?”

পল্টু ভয়ে-ভয়ে বলে, “ত্রিমাত্রিক ছবি।”

“ছবি কখনও হেঁটে বেড়ায়? ইয়ার্কি করছ?”

“কেন, সিনেমার ছবিতে তো লোকে হাঁটে।”

বজ্ৰাঙ্গ দ্বিধায় পড়ে গেলেন বটে, কিন্তু হার মানলেন না। ঝড়াক করে একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “যথেষ্ট হয়েছে। তোমার স্টেটমেন্ট আর নেওয়া হবে না।”

পল্টু মুখোনা কাঁদো কাঁদো করে বলে, “আমি কিন্তু গুল মারছিলাম না। বলছিলাম কী, ঘটনাটা আরও ভাল করে ইনভেসটিগেট করা দরকার। এর পিছনে হয়তো একটা বৈজ্ঞানিক চক্রান্ত আছে।”

কিন্তু তাকে পাত্তা না দিয়ে বজ্রাঙ্গ চতুর্দিকে বার কয়েক চোখ বুলিয়ে ভুকুটি করে হুংকার ছাড়লেন, “আর কারও কিছু বলার আছে? কিন্তু খবর্দার, কেউ গুলগপ্পো ঝাড়লে বিপদ হবে।”

কারও কিছু বলার ছিল না। সুতরাং আর একবার কটমট করে চারদিকে চেয়ে বজ্ৰাঙ্গ বিদায় নিলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress