Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নূহর নৌকা || Bani Basu » Page 7

নূহর নৌকা || Bani Basu

রাত প্রায় এগারোটা। পেরি মেসন বন্ধ করল শশাঙ্ক। বেড সুইচটা নিবিয়ে দিল। ও দিকে চিৎকার কেন! পাঁচ ইঞ্চির দেওয়াল। ও দিকে কঙ্কণাদের শোবার ঘর। দুমদাম, অর্ধস্ফুট চিৎকার, কী এ সব? শশাঙ্ক ছুটে যায়, উপর্যুপরি বেল দেয়। কেউ খোলে না। খালি নির্ভুল চিৎকার ভেসে ভেসে আসে ও দিক থেকে বাঁচাও বাঁচাও।
ছুটে নিজের ড্রয়ার থেকে ও-বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে তীব্র বেগে গিয়ে দরজা খোলে শশাঙ্ক। মৃগাঙ্ক দাঁড়িয়ে তার মুখোমুখি। লণ্ডভণ্ড কঙ্কণা মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে। মৃগাঙ্ক বলল —ওহ্‌, দিস, এই ডুপ্লিকেট চাবি… এই ভাবেই তা হলে ঢুকতে, দিনের পর দিন এই ভাবেই লীলাখেলা চালিয়ে গেছ, দায়িত্বশীল চিরকুমার দাদা আমার। বাঃ! আমি থাকি না সেই সুযোগে বাচ্চাটা বানিয়েছ! এখন দত্তকের গপ্পো বানাচ্ছ শশাঙ্ক সরকার!
—কী বলছ লোটন! এ সব কী! এ সব তোমার মনে হয় কী করে?
—হোয়াট ইজ দ্যাট হোর অব আ গার্ল ডুয়িং ইন ইয়োর ফ্ল্যাট? ভালই চলছে। অ্যাঁ?
—লোটন শি ইজ আ উণ্ডেড চাইল্ড, স্টপ দিস ননসেন্স।
—দাঁড়াও দেখাচ্ছি। মৃগাঙ্ক ছুটে যায় রান্নাঘরের দিকে। তার পরে হাতে একটা লম্বা ছুরি নিয়ে উন্মাদের মতো বেরিয়ে আসে।
—আগে শেষ করব এই বেশ্যাটাকে। তার পর দেখব কত বড় দাদা তুমি।
শশাঙ্ক এক লাফে গিয়ে তার কবজি চেপে ধরে।
—ছাড়ো ছাড়ো, ছাড়ো বলছি। কাম ব্যাক টু ইয়োর সেন্সেজ।
কে কার কথা শোনে! দু’জনে প্রাণপণে দু’জনের হাত পাকড়েছে। ছুরি এক বার বেঁকছে শশাঙ্কর দিকে, আর এক বার মৃগাঙ্কর দিকে। কঙ্কণা উঠেছে কোনও ক্রমে— ছাড়ো, ছাড়ো ফেলে দাও ছুরি। কী পাগলের মতো করছ! বলতে বলতে কঙ্কণা হঠাৎ টাল খেয়ে পড়ে যায় শশাঙ্কর পিঠের ওপর। মুষ্টিবদ্ধ ছুরি তখন মৃগাঙ্কর দিকে ফেরানো ছিল। আমূল বিঁধে যায় এবং ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয় তার হৃৎপিণ্ড দিয়ে। দরজার কাছে বিস্ফারিত চোখে দাঁড়িয়ে মায়া, মিলি ও পাশের ফ্ল্যাটের কয়েকজন। চতুর্দিকে আলো জ্বলে উঠছে। কেয়ারটেকার ছুটে এসেছে। অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাসপাতাল এবং মর্গ। ছুরিটা পুলিশের হাতে চড়ে যেতে যেতে বলে গেল— ড্রয়ারে থাকতুম, মাঝে-মধ্যে মাংস কাটা হত, আজ জানলুম আমার জন্যও কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ জমা ছিল। দেয়ালগুলো পরস্পরকে ফিসফিস করে বলতে লাগল— সব সন্ত্রাসের এক দিন শেষ হয় তখনই, যখন নিজের হাতের ছুরিই অদ্ভুত কোণ তৈরি করে নিজেরই শরীরে বিঁধে যায়।
দীর্ঘ ছ’মাস কেস চলবার পর বেকসুর খালাস পেল তারা। প্রশ্নটা একটা সূক্ষ্ম সুতোর ওপর ঝুলছিল। শশাঙ্ক সম্পর্কে কারও কোনও সংশয় ছিল না। কিন্তু কঙ্কণার ধাক্কাটা? সে তো সেই চিরন্তন স্ত্রীলোক কিনা যে জন্ম ব্যাভিচারিণী। যে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে! আক্রমণকারী অবশ্যই মৃগাঙ্ক। ছুরির হাতলে তার ছাড়া আর কারও হাতের ছাপ নেই। সাক্ষীও যথেষ্ট। কিন্তু স্ত্রী যে মাথা ঘুরে বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ কী! প্রমাণ এই যে, তার দুই রগ ফুলে উঠেছে। মাথার চুল গোছা করে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে গায়ের জোরে। এবং সর্বাঙ্গে মারের ছেঁচা দাগ। দুই গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ।
ভাসুর ভাদ্দরবউয়ের মধ্যে সম্পর্কের মুখরোচক গল্পটাও বাজারে ভালই চাউর হয়। ছেলেটি অবৈধ, এদের দু’জনের, প্রমাণিত হয়ে গেলে কেসটা সহজ হত বেশ। কিন্তু কার্তিক সামন্ত নিজেই কোর্টে এসে কবুল করে গেলেন, শিশুটি তাঁর নাতি। তার জীবনের আশঙ্কা ছিল তাই শশাঙ্ককে চুপিচুপি রাখতে দিয়েছিলেন। এই ভাবে এক কেসের পিছু পিছু কার্তিক সামন্তর ছেলে বউ খুনের ফয়সালা না-হওয়া কেসটি উঠে পড়ল। এবং তারও সুষ্ঠু সমাধান হয়ে গেল।
চিফ বললেন
—বসো শশাঙ্ক, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
—বলুন।
—গৃহদাহর সময়ে সাংবাদিক যদি দমকল হয়ে পড়ে ছবিটা তুলবে কে? দুর্ঘটনার সময়ে অগ্রপশ্চাৎ না দেখে যদি সে ভিকটিমকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটে তা হলে খবরটা পুঙ্খানুপঙ্খ না-ও হতে পারে। কী ঠিক বলছি? সাংবাদিকে সমাজসেবী হলে চলে না। ঠিক তো?
—হুঁ।
—তোমার ক্ষমতায় আমার কোনও অনাস্থা নেই। তোমার জন্যে দু’দুটো কেস এই ভাবে সলভ্‌ড হল। কাগজের বিক্রি তিন গুণ হয়ে গেছে। সম্পাদক সমীপেষুতে বলছে, পুলিশের গোয়েন্দার চেয়ে খবরের কাগজের গোয়েন্দা অনেক অনেক নির্ভরযোগ্য। তুমি তো ইস্ট জোনের চিফ হয়ে যাচ্ছ। অনাস্থা তোমার ক্ষমতায় নয়, অনাস্থা তোমার আচরণে। বড্ড ইনভলভ্‌ড হয়ে পড়ছ। য়ু আর ম্যাড টু ডু দিস।
—চারটে মার্ডার, একটা অ্যাবডাকশন…শাস্তি পেল আট ন’জন ক্রিমিনাল…বলেন কী?
—হ্যাঁ, কিন্তু তার পরেরটা, যেটা তোমার নিজের ঘরে ঘটল! ডোন্ট মাইণ্ড শশাঙ্ক। য়ু সিম টু স্টিক ইয়োর নোজ আউট ফর পিপ্‌ল হু আর ওয়েল এব্‌ল টু টেক কেয়ার অব দেমসেলভ্‌স!
কার কথা বলছেন ইনি? শিশুটি, যে কুয়োয় পড়েছিল? বালিকাটি, যে কারখানায় অর্ধমৃত মায়ের পাশে শুয়ে কাতরাচ্ছিল? না যুবতীটি, প্রচণ্ড প্রহারের পর যে মাংসকাটা ছুরির সামনে পড়েছিল?
সে বলল
—নাঃ। আর হবে না।
—স্টিক টু ইয়োর ডিসিশন ম্যান, ইটস নট হেলদি য়ু সি।
—আপনি একটু ভুল বুঝছেন সার, আমি চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি।
—বলছ কী? কেন? তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ! এটা কি রাগ-অভিমানের সময়? আমি তোমাকে জাস্ট কতকগুলো বেসিক্‌স বুঝিয়ে দিয়েছি। প্রায়রিটিজ ইন জার্নালিজম!
—দ্যাটস অল রাইট। সে জন্যে না। এই চাকরিটা আমি আর করছি না।
—কোথাও বেটার অফার পেয়েছ?
—পেয়েছি। লট্‌স। নিচ্ছি না।
—কেন? আরে আমরা বাড়িয়ে দিচ্ছি তোমার পে, তোমার পার্কস, য়ু ডোন্ট হ্যাভ টু বার্গেইন, আই হ্যাভ ডান দ্যাট ফর য়ু।
উঠে দাঁড়াল শশাঙ্ক
—এই নিন পদত্যাগপত্র। নো অফেন্স মেন্ট স্যর। আমার ভাল লাগছে না।
—ক্‌ কী করবে? কোথায় জয়েন করবে?
—জানি না। সত্যিই এখনও জানি না।
মানুষের পরিবার রক্তের সম্পর্ক মেনে তৈরি হয়। বাবা মা ভাই বোন। বাইরে থেকে যে মেয়েটি স্ত্রী হয়ে আসে পুরুষকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করার প্রক্রিয়া দিয়ে সে রক্তে রক্ত মেশায়। কিন্তু জীবনকে বিরাট ও সনাতন বলে দেখতে গেলে বোঝা যায় সব সমর্থ পুরুষই পিতা, সব নারীই মাতা, এবং সব শিশু বালক বালিকাই সমস্ত মানুষের পুত্র কন্যা। তাদের মধ্যে এই গূঢ় অনাদ্যন্ত সম্পর্ক কখনও কখনও দুর্ঘটনাচক্রে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। রক্তের সংকেত তখন সে অগ্রাহ্য করে, আর তখনই ভাবী কালের, আরও সুসভ্য সুসঙ্গত উন্নততর সমাজের সূচনা হয়।
তাই যখন জল বাড়ছিল আর বাড়ছিল, ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিল যত দূর দৃষ্টি যায় সমস্ত চরাচর, তখন সংকেতটা আমরা বুঝে ফেলি। সবাই মিলে খেটেখুটে তৈরি করি একটি নৌকা। অতঃপর তাতে তুলে নিলাম শস্যবীজ, চারা, খাদ্য, সব রকমের পশু পক্ষীর জোড়া এবং শিশু, বালক বালিকা, যুবক যুবতী, প্রৌঢ়া বৃদ্ধ জীবনের এই সব মূল আয়োজন। তার পর ঘোলা জলে ডুবিয়ে দিলাম দাঁড়, ছেড়ে গেলাম এই ডুবন্ত সভ্যতা।
আমার নামটি কঙ্কণা, আমার ছেলের নামটি চিন্ময়, মেয়ের নামটি রঙ্গনা আর আমাদের সেই তাহার নামটি শশাঙ্ক। আমরা পৌঁছই এক নিঃস্ব হতশ্রী গ্রামে। দত্তক নিই পুরো এলাকাটা। সবাইকে বুঝিয়ে সুজিয়ে চালু করেছি সমবায় কৃষি, খামার। ট্র্যাক্টর চলছে, প্রায় সবটাই জৈব সার। কাছের নদী থেকে নালা কেটে সেচ চলছে, বৃষ্টির জলও ধরে রাখি আমরা। আমাদের সেবাঘর, বিদ্যাভবন, কারিগরি বিদ্যালয় চালান তিনি। হিমঘর, চালকল, গমকলের দায়িত্বে আছেন আমার শ্বশুর কার্তিক সামন্ত ও স্থানীয় বিজ্ঞ মানুষ অক্ষয় মাজি, আমার আর এক শ্বশুর। আলুর পাঁপড়, চিপ্‌স, পোটাটো পাফ, টোম্যাটো সস, নানা ধরনের সুপ, মাশরুম এবং আরও সব রকম উদ্বৃত্ত ফসলের যাবতীয় প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্বে রয়েছেন মায়া দাশ বলে এক মহিলা। ইনি এবং গ্রামের কয়েকজনকে এ বিষয়ে ট্রেনিং দিয়ে আনা হয়েছে। ডেয়ারির কাজকর্ম দেখেশুনে এইমাত্র ফিরছি। ফিরছে আমাদের অনেক মেয়ে, অনেক পুরুষও। কাঁচা তরি তরকারির তিনটে ভ্যান, দুধের ভ্যান সব ছেড়ে গেল। ওরা এখন জাতীয় সড়কে উঠবে। জাতীয় সড়ক অবধি রাস্তাটা পাকা করেছি আমরাই। আমার মেয়ে আরও চারটি ছেলেমেয়ে ডাক্তারি পড়ছে। নার্সিং, ইউনিভার্সিটিতেও আছে অন্তত জনা দশেক। ডাক্তার নার্সের আমাদের খুব দরকার। না না, সরকারি সাহায্য আমরা নিই না তো! ফরেন ফাণ্ড! সর্বনাশ! না। যা যা দরকার শ্রম এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আমরাই করে নিই। সড়ক ছাড়াও পরিষ্কার করা হয়েছে জলা, পুকুর, নদীর খাল। বনাঞ্চল সৃষ্টি হয়েছে খানিকটা। আষাঢ়ের প্রথম দিন না হলেও কোনও এক দিনে তার মাথায় যখন কাজলা মেঘ জমে, চার দিকের সবুজে আর আকাশের কালোয় মিলে বড় সুন্দর দেখায়। আমরা জৈব গ্যাস ও সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি। দেখতে চান? আসবেন? আসবেন বইকী! তবে বেলাবেলি চলেও যাবেন। আমাদের কোনও অতিথি নিবাস নেই তো! পর্যটন শিল্প মাথায় থাক। এটা আসলে আমাদের বাঁচার জায়গা। বিজ্ঞাপন নয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 7 of 7 ): « পূর্ববর্তী1 ... 56 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress