Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নূহর নৌকা || Bani Basu » Page 6

নূহর নৌকা || Bani Basu

মৃগাঙ্ক ঢুকে এল। রবিবার। সন্ধে সাড়ে সাত মতন। শশাঙ্ক দরজা খুলে অবাক।
—আরে, তুমি কখন?
—কাল রাত একটা নাগাদ।
—খবর-টবর দাওনি তো!
—অসুবিধে হল?
—না। অসুবিধে কী? শশাঙ্ক আশ্চর্য হয়ে বলল অসুবিধে তো তোমার। এত দিন বাড়ির বাইরে। হল? ট্রেনিং শেষ?
সে কথার জবাব দিল না মৃগাঙ্ক। ঠাণ্ডা স্বরে রাগ রাগ চোখে চেয়ে বলল—এ তুমি কী করছ দাদা?
—কী করেছি!
—আবার বলছ, কী করেছি! একটা পাগলি মেয়ে, একটা কার না কার ছেলে, গছিয়ে দিয়েছ আমার বউকে? বউটা তো আমার, না কী?
গালে নীলচে দাড়ির আভাস, খোঁচা মারছে একটু একটু। শশাঙ্ক গালে হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ সে তো বটেই। কিন্তু ব্যক্তিটা তো কারও হয় না, নিজেরই থাকে। আমি কঙ্কণাকে জিজ্ঞেস করেই তো….
—রাবিশ!
—বাচ্চা আর মেয়েটির ভরণপোষণ আমি দেখছি লোটন। তোমার কিন্তু কোনও ক্ষতি নেই।
—লাভও কিছু নেই। কার না কার ছেলে একটা শুয়ে আছে আমার বিছানায় হাত পা মেলে।
—কার আবার ছেলে হবে! মানুষেরই ছেলে। তোমার ছেলে থাকলেও শুত!
—কে বলেছে তোমাকে আমার ছেলে হবে না?
—তা বলিনি তো! কঙ্কণা কি তোমাকে বলেছে ও বাচ্চাটাকে দত্তক নিতে চায়।
—বলেছে, আমি রাজি নই।
—কেন? পছন্দ হচ্ছে না? চিনচিন তো খুব লাভলি লোটন!
—তুমি বলছ ওর বাবা-মা নিকট আত্মীয়ের হাতে খুন হয়ে গেছে। খুন হওয়া লোকের বাচ্চা একটা। কী রকম স্টক বোঝাই যাচ্ছে।
শশাঙ্ক আস্তে আস্তে বলল লোটন, তা হলে আমরা? আমরাও তো খুন হওয়া মা বাবার…নিকট আত্মীয় না হলেও বখরাদারদের মধ্যে বাবার চেনাজানা, বিশ্বস্ত, খুব কাছের লোকও ছিল। তার চোখে উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন শুধু। এবং প্রচ্ছন্ন যন্ত্রণা। কথার মধ্যে শুধু যুক্তি।
মৃগাঙ্ক দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করে বেরিয়ে গেল।
‘অনুপমা’র ক্যাম্পাস মোটের ওপর বেশ বড়ই। এখানেই ওরা বেড়ায়। একটু খুঁজতেই শশাঙ্ক ওদের পেয়ে গেল। পুকুর, যেটাকে লেক নাম দেওয়া হয়েছে, তার পাড়ে সুন্দর ছোট্ট পার্কটার মধ্যে খেলছে চিনচিন। আরও কয়েকজন বাচ্চা। মায়াকে নিয়ে মিলি ও-দিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কোনও দোকান টোকানে বোধহয়।
—কঙ্কণা শোনো!
—হ্যাঁ দাদা…
—শোনো, লোটনের এ ব্যাপারটা খুব অপছন্দ। আজ রাতে চিনচিনকে আমার কাছে দিয়ে যাবে। মিলি দেখবে। মায়াও রয়েছে।
কঙ্কণার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।—ও এই কথা বলেছে? সে ঢোঁক গিলল।
—হ্যাঁ। মানতে পারছে না।
—ঠিকই। বাড়ির কর্তা যখন ও। ওর টাকায় যখন খাই, ওর কথাটাই ফাইনাল।
—তা নয়।
শশাঙ্ক গলা নামিয়ে বলল—যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দু’জনে মিলে নেওয়াই ভাল।
—আচ্ছা! কঙ্কণার চোখ চিকচিক করছে
—ও যখন এই মাসে তিন হপ্তা টুর, রাত ১১/১২টায় বাড়ি ফেরার চাকরিটা নিয়েছিল আমাকে বলে নিয়েছিল নাকি? দূর তাও কখনও হয়! আমি একে মেয়ে, তার পর স্ত্রী, তার ওপর রোজগার করি না। আমার কোনও পছন্দ-অপছন্দ, একা থাকার কষ্ট— কিছুই তো থাকার কথা নয়! দাদা আপনি এখনই ওকে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আমি ছাড়া ও ঘুমোতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। বাচ্চাটাও ও-দিকে ঘুমোবে না, আমিও এ দিকে জেগে থাকব। মাঝখান থেকে আমার সাড়ে সাত ঘণ্টার বর জমিয়ে ঘুমিয়ে নেবে।
কিন্তু শিশু কি কারও কথা শোনে? সে কি ভাবে এখন তাকে চুপ করে থাকতে হবে, এখন নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা দরকার! উপরন্তু দিদি দিদিই। খুব ভালবাসার মানুষ। কিন্তু দিদিকে মায়ের জায়গায় বসাতে তার বয়ে গেছে। সুতরাং, অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তবে কঙ্কণা বাড়ি যায়। এবং সকালে মৃগাঙ্ক বেরিয়ে যাবার পর কঙ্কণা আবার এসে বাচ্চাকে নিয়ে যায়, সারা দিন চলে তার পরিচর্যা এবং খেলা। তার সঙ্গে বকবক। চিনচিন এখন একটা রীতিমত চমৎকার গাবদা গোবদা মজাদার আদরকাড়া বাচ্চা। সব্বাই তাকে ভালবাসে। একমাত্র মৃগাঙ্ক ছাড়া। এবং প্রত্যেক দিন সকালে কঙ্কণার চোখ লাল থাকে।
মায়া রান্না করছে, মিলি ঘর গুছিয়ে রাখছে। শশাঙ্ক বাড়ি ফিরে প্রকৃত গৃহস্থের মতো তৈরি খাবার, পরিষ্কার ঘর, বোতলভর্তি জল, ধবধবে বিছানা পাচ্ছে। এরই মধ্যে মিলির সাক্ষ্য শেষ হয়ে গেল নির্বিঘ্নে। সে সমস্ত নীচ, কূট প্রশ্নের উত্তর দিল ঠিকঠাক। শশাঙ্ক তাকে তৈরি করার চেষ্টা করেনি, তাদের পক্ষের উকিল শুধু বলেছিল —তোমাকে কদর্য সব কথা বলবে মা, তুমি তাতে ভড়কে যেও না।
—কে তোমাকে রেপ করেছিল মা? গলায় মধু ঢেলে ও-পক্ষের উকিল বললেন।
—ওই তো… সে আসামির কাঠগড়ায় চার জনের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।
—তুমি রেপ মানে ঠিকঠাক জানো তো?
—আমি রোজ কাগজ পড়ে থাকি।
—(হাসি) কাগজ পড়ে তো রেপ জানা যায় না মা। এই মানে চুমুটুমু খাওয়াকে কিন্তু রেপ বলে না। গায়ে হাতটাত দিলে মলেস্টেশন বলবে।
—আপনি হাসপাতালের ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করুন। কড়া গলায় প্রধান সাক্ষী বলে উঠল।
—ব্যাপারটা আসলে খুব ইন্টারেস্টিং, তোমার মতো বয়সের মেয়েরা আজকাল হামেশাই….
—অবজেকশন মি. লর্ড মিলির পক্ষের উকিল হেঁকে উঠলেন।
—ইনি মেয়েটিকে বিভ্রান্ত করবার, তাকে অপমান করবার চেষ্টা করছেন।
—অবজেকশন সাসটেইণ্ড।
—আচ্ছা ঠিক আছে। নরনারীর সম্পর্কের কথা তুমি কতটুকু জানো?
—আমার মা আমাকে সব বলেছেন। বলতে বলতে তার ঠোঁট ফুলতে থাকে, সে চিৎকার করে ওঠে—
ওই সাইডবার্নওলা শয়তানটা আমার বাবার মাথায় রিভলভারের বাঁট দিয়ে বাড়ি মেরেছিল প্রচণ্ড। বাবা পড়ে গেলেন। আমার মাকে ওই লোকটা, ওই যে দাড়িকামানো শয়তানটা টেনে নিয়ে গেল। আরও দুটো বদমাস ওই মোটাটা আর ওই লিকলিকে মতোটা আমাকে তুলে ধরে জোর করে একটা ফাঁকা কারখানা ঘরে নিয়ে যায়। আমার মার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমার ওপরেও। তিনটে বড় বড় লোক…ওদের লজ্জা করেনি! সাইডবার্নওলা লোকটাই আমার বাবাকে খুন করেছে। এই তিনটে লোক আমার মাকে খুন করেছে। ওদের শাস্তি দিন জজসাহেব। আমার কেউ নেই, আমার মা বাবা সবাইকে… মিলি হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল।
আরও কিছু দিন সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করার পর সাইড-বার্ন অর্থাৎ মন্ত্রীর ছেলের মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেল। অন্য তিন জনের যাবজ্জীবন। সুবিচার। শেষ পর্যন্ত সুবিচার। মিলিকে আগলে নিয়ে ঘরে ফেরে শশাঙ্ক। বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে। শূন্য বাড়ির কোণে ঘুরে বেড়ায় মিলি। চোখ শুকনো। জিনিসপত্র নাড়ে চাড়ে। শশাঙ্ক আস্তে বলে— মিলি এখানে এসে থাকবে?
ঝট করে পেছন ফেরে সে —তুমি থাকবে? কাকিমা থাকবে? চিনে? শূন্য বাড়িতে আসলে শুধু দুঃসহ স্মৃতি। মানুষ চাই, নির্ভর করার ভালবাসার মানুষ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress