অফিস ও মানুষ (নূহর নৌকা)
অফিসে জয়েন করেছে শশাঙ্ক। চিফ ডাকলেন।— বসো শশাঙ্ক, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
— বলুন।
— তুমি যে আমাদের অ্যাসেট, সেটা জানো নিশ্চয়।
শশাঙ্ক চুপ করে রইল।
— তুমি অল্প কথার মানুষ। বিনয়ী না হলেও উদ্ধত নও জানি। কিন্তু এটা তো মানবে, তুমি সাংবাদিক!
— তা তো বটেই!
— তুমি আজকাল তোমার প্রাথমিক দায়িত্বটাকে একটা ট্যানজেন্টের মতো ছুঁয়ে বার হয়ে যাচ্ছ। সংবাদ কভার করতে গিয়ে এত ইনভলবড্ হয়ে যাচ্ছ কেন? ওই মেয়েটার কেসে পুলিশ যত না, তুমি তো তার চেয়ে বেশি গোয়েন্দাগিরি করলে। ক্রমাগত বুনো হাঁসের পেছনে দৌড়ে কত সময় নষ্ট করলে বল তো!
— সময় নষ্ট! আঅ্যাম ব্রিংগিং দা ক্রিমিন্যালস টু বুক।
— ঠিক। কিন্তু প্রমাণ সংগ্রহ, উকিল নিয়োগ, মেয়েটার কাউন্সেলিং, এগুলো কি তোমার দায়?
সে অবাক হয়ে রইল। বলতে ভুলে গেল চোদ্দো বছরের হতভাগ্য বালিকা, তার কোনও যাবার জায়গা ছিল না। কাউকে না কাউকে তো করতে হয়।
— কিন্তু দিনের পর দিন স্টোরিটা আমাদের বিক্রি বাড়িয়েছে। একটা ঘটনাকে প্রথম থেকে শেষ অবধি তাড়া করে গেছি তাই-ই তো স্টোরিটা এ ভাবে তৈরি হতে পারল!
— ডোন্ট মাইণ্ড শশাঙ্ক। চিফ বললেন— আর য়ু রানিং আফটার দা গার্ল অর হার মানি?
শশাঙ্ক বজ্রাহত হয়ে বসে রইল।
— কী হল?
— আপনার কী মনে হয়?
— কিছু মনে হয় না। দিস ইজ নো অ্যালিগেশন। সম্ভাব্য মোটিভগুলোর কথা বললাম। উত্তর দেওয়া না দেওয়া তোমার ইচ্ছে।
— দেব। একটু ভাবি। ভেবে দেখি।
মোটিভ? সম্ভাব্য মোটিভ? মেয়ে? টাকা? ফিরতে ফিরতে ধূমকেতুর মতো এই প্রশ্ন তার লেজের আগুনে বিষ ঢেলে দিতে দিতে চলে গেল। কী চায় সে? কেন? অনেক ভেবেও একটা সঙ্কট এবং তার জন্য একটা তাৎক্ষণিক করণীয় ব্যবস্থা, এর চেয়ে বেশি সে কিছুই মনে করতে পারল না। ঘটনাচক্রে দুর্ঘটনায় পতিত দুটি বাচ্চাই ধনী। কিন্তু তাদের উত্তরাধিকারের কথা তো সে জানতই না। অনেক পরে জেনেছে। সত্যি কথা বলতে কী, সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অমন বহু ধনী লোকের সংসর্গে তাকে আসতে হয়। জোচ্চোর, জালিয়াত, হামলাকারী, হুলিগান, এরা সকলেই লাখ লাখ কোটি কোটি টাকার কারবারি। এরা যে তাকে নানা ভাবে ঘুষ-টুষ দিতে চায়নি, তা-ও তো নয়। ইচ্ছে করলে সে ধনী হয়ে যেতে পারত। সততার বিনিময়ে, নৈতিকতার বিনিময়ে। কত লোকেই তো হচ্ছে। ঠিক যেমন কত লোকে হচ্ছে খুনি, ধর্ষক, জোচ্চোর। সরকারি লোক জনগণের টাকা বেমালুম লুঠ করছে, বন্যাত্রাণের কোটি কোটি টাকা কী ভাবে নয়ছয় হয়ে যায়, আর্ত মানুষগুলির কাছে পৌঁছয় না। সে প্রত্যক্ষ দেখেনি, শুনেছে। প্রত্যক্ষ দেখা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে কিছু না কিছু করতই। তার বাবাও করেছিলেন, কয়লার চোরা-কারবারিদের থামাতে চেয়েছিলেন। মা বলেছিলেন— চলো, এখান থেকে আমরা চলে যাই। বাবা বললেন— শশাঙ্ক, তোর কী মত? সবাই যদি করাপশন দেখে পালাই তা হলে শেষ পর্যন্ত কী হবে? শশাঙ্ক তো বাবার মতেই মত দিয়েছিল। খালি বলেছিল— তোমার রিভলভারটা সব সময়ে কাছে রাখবে, কোম্পানির কাছ থেকে প্রোটেকশন দাবি করো। তা সেটা দেখা গেল যথেষ্ট হয়নি।
চিনচিনকে নিরাপদে রাখার দায়িত্ব তার দাদুই তাকে দিয়েছেন। তিনি যে ইচ্ছাপত্র, ব্যাঙ্কের পাশবই, চেক ইত্যাদি পাঠাবেন সে কি জানত? জানার পর, পাওয়ার পর এখনও পর্যন্ত সে তো টাকাটাও তোলেনি। উঁহু, টাকাটা তোলা দরকার। ভাল মনে করিয়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক। রাতদিন সে মৃগাঙ্কর টাকায় একটি অনাত্মীয় শিশুর ভরণপোষণ করবে? সে নিজেও দিতেই পারত! কিন্তু চিনচিনের নিজস্ব টাকা আছে। তার দাদু দিচ্ছেন। তাকে অন্যের অর্থের ওপর অন্তত নির্ভরশীল করে রাখাটা অন্যায্য। আর মিলি? মিলির রক্ষণাবেক্ষণ, চিকিৎসার ব্যাপারে উদ্যোগটা তারই। একশো বার। কিন্তু মিলিও তো একটা বাচ্চাই। তার ওপর দিয়ে একটা দিনে যে তাণ্ডব হয়ে গেছে, তা তো প্রলয়ের চেয়েও ভয়ংকর। কেউ ছিল না তো ওর পাশে দাঁড়াবার। সে কী করে একটি ট্রমাগ্রস্ত নিঃসহায় বাচ্চা মেয়েকে ফেলে দিয়ে আসবে? যদি ওর বাড়ি-টাকা না থাকত! তা হলে শশাঙ্ক ওর চিকিৎসা করাত, রক্ষণাবেক্ষণ করত নিজের সাধ্য অনুযায়ী। এবং মূলত সে জন্যই সে আবারও কঙ্কণার শরণার্থী হয়েছে। তার বাবা-মার রক্তাক্ত মৃতদেহ সে যখন দেখেছিল, তার চব্বিশ বছর বয়স তখন। মিলির চোদ্দো, ঠিক দশ বছরের তফাত। সে আজও সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেনি। মিলি কি পারবে? কিন্তু না, এ ভাবে চলে না। এ তো সত্যিই ছেলেমানুষির শামিল।
বাড়ি ফিরে সে কঙ্কণাকে প্রথম কথাই জিজ্ঞেস করল— চিনচিনের ব্যাপারে লোটনের সঙ্গে কথা বলেছ?
— হ্যাঁ দাদা।
— তুমি কি বলেছ ওকে তুমি দত্তক নিতে চাও!
— না।
— কেন?
— মুখোমুখি কথা হওয়াই তো ভাল!
কঙ্কণার নিজস্ব কতকগুলো ধারণা ও পদ্ধতি আছে। মৃগাঙ্ক আসুক। একটা বাচ্চার কথা ফোনে শোনা, আর তাকে, তার লীলাখেলাগুলো সামনা-সামনি দেখার মধ্যে তফাত আছে। আসুক, দেখুক। মৃগাঙ্কর মন সে ভাল করে জানে না ঠিকই, কিন্তু চিনচিনের জাদুর ওপর তার বিশ্বাস আছে।
একমাত্র শিশুই পারে মানুষের কঠিন মনকে দ্রব করতে। কিন্তু, যে লোকগুলো তাকে কুয়োয় ফেলে দিয়েছিল, তারাও তো মানুষই ছিল? ওহ্ আজকেই সে কাগজে কতকগুলো পরিসংখ্যান দেখেছে। শতকরা কত জন শিশুকে অমানুষিক মার, অন্ন কেড়ে নেওয়া, হাড়ভাঙা খাটুনি, নির্যাতন, যৌন নির্যাতন সইতে হয়। একটি বাচ্চা মেয়ের ছেঁড়া ফ্রক পরা ছোট্ট ছবি, তার কষ্টবিকৃত মুখ তো আজই….! ওহ্, কী করে পারে? মা-বাবা সুদ্ধ খুন করছে, ছ্যাঁকা দিচ্ছে, মারণ প্রহার, বেচে দিচ্ছে, বিক্রি করে দিচ্ছে স্রেফ নিজের সন্তান!
কঙ্কণা মুখ ঢেকে উপুড় হয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারে কোথাও জল বাড়ছে। বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে জল। তবে কি কোনও আশা নেই? ডুবিয়ে ভাসিয়ে দেবে সব ওই ঘোলা জল? ঘুমন্ত চিনচিনের অদ্ভুত মিষ্টি ফোলা ফোলা ঠোঁট আর চিকণ গাল, তার দেয়ালা দেখতে দেখতে সে তার মাথার ওপর হাত রাখে। বিশ্বের সমস্ত নির্যাতিত শিশুর জন্যে হঠাৎ তার দু’চোখ ফেটে অকূল জল ঝরে। সে আঙুল দিয়ে দেখায় ওদের—দেখো দেখো বাঘিনি কী রকম শাবকের সঙ্গে খেলা করছে। হস্তিযূথ মাঝখানে কচিগুলোকে নিয়ে কেমন পার হয়ে যাচ্ছে অরণ্য। একটা শালিকছানা মাটিতে পড়ে গেছে, বাচ্চাটার মা-বাবা সেখান থেকে নড়ছে না। কী করুণ ডানা ঝাপটানি! করো, তোমরা কিছু করো— সারা প্রকৃতিকে, পৃথিবীকে ডেকে ডেকে বলতে চাইছে যেন। এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতি শিশু দিয়েছে আমাদের মধ্যে স্নেহ ও করুণা জাগিয়ে রাখতে। এই জায়গায় অন্তত প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেও না তোমরা।
—কী করছ কাকিমা?
মিলির টিচার চলে গেছেন। অমনি মিলি লাফিয়ে এ ফ্ল্যাটে এসে গেছে। টিচার বলছেন ওর মনোযোগ নাকি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। কত মেধাবী মেয়ে ছিল।
— এই বারে রাঁধব।
— কী রাঁধবে?
— দেখি কী আছে।
— আমিও রাঁধব। আমায় শিখিয়ে দেবে?
আসলে, মিলি তার পরিচিত টেক্সট, পরিচিত রুটিনের মধ্যে তার বিভীষিকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে একটা যোগাযোগ ছকে ফেলেছে। ওগুলো দেখলেই তার সব মনে পড়ে যায়। ৩১ ডিসেম্বরের রাত, মোটরবাইক এবং এবং এবং!
তার সাইকি এই সব অনভ্যস্ত কাজ-কর্মে ভুলতে পারছে সে সব।
কঙ্কণা বলল— শিখবি বইকী! সবাইকে সব শিখতে হয়।
— তুমি লেখাপড়া শিখেছিলে?
— কেন আমাকে দেখে কি তোর মূর্খ মনে হয়!
— সো কল্ড লেখাপড়া, ডিগ্রি-টিগ্রি….
— আমি বি এসসি পাস করেছিলুম এককালে। খারাপ করিনি।
— সত্যি? তা হলে তো তুমিই আমাকে সায়েন্সটা দেখিয়ে দিতে পারো।
— পারি। কিন্তু কতটা ভাল পারব তা তো জানা নেই!
— পারতে হবে না। আমি পারব না। কিচ্ছু পারতে পারব না আমি। পারব না পারব না, হঠাৎ মিলি চিৎকার করে ওঠে—আমার মা-বাবাকে এনে দাও। দিতেই হবে, দিতেই হবে! ও মা! ও বাবা! চিৎকার করে কাঁদতে থাকে মিলি। মায়া ছুটে আসে। কঙ্কণা তাকে জড়িয়ে ধরে— মিলি মিলি, কাঁদ, কত কাঁদবি কেঁদে নে। কিন্তু এত আওয়াজ করলে চিনেটার ঘুম ভেঙে যাবে যে!
মন্ত্রবলে শান্ত হয়ে যায় মিলি। দু’হাতে মুখ ঢেকে সে ফোঁপায়। এই আত্মসংবরণের ক্ষমতাটা তার এখন এসেছে। চিনচিন আর শশাঙ্ক, এদের কোনও অসুখ বা অসুবিধে হলে মিলি একদম স্বাভাবিক।
ফ্ল্যাটের দেওয়ালগুলো পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকে। ব্যথার দেওয়াল। চিন্তার। মেঝেটা বলে ওঠে— আহা মেয়ে! আহা রে মেয়ে! পাখা চিকচিক করে চলতে চলতে বলতে থাকে— এর চেয়ে আমাকেই মানুষ করে দাও না হে। এই সামান্য ভূমিকাতেই তোমাদের কত আরাম দিচ্ছি, মানুষ হলে না জানি আরও কত পারতুম! দুপুরের কাক বলে— ক্যা? ক্যা? কে তোকে এমন করে কাঁদায় রে! অনুপমা হাউজিং-এর চত্বরে ঘাসগুলো খাড়াখাড়া হয়ে উঠেছে। আকাশে রোদ ঝিমিয়ে গেল, বাড়িগুলো অবসন্ন, একটি বালিকা আর্তনাদ করছে বলে ফেটে চৌচির হচ্ছে আকাশের সাদাটে ধূসর বুক।
কঙ্কণা ভাবে, আমিই সেই ভাগ্যবানদের এক জন, একমাত্র এখানে যার বাবা মাকে কেউ খুন করেনি, যাকে কেউ ধর্ষণ করেনি, যে অনাথ নয়, শোকে, দুঃখের ধাক্কায় যার মানসিক ভারসাম্য খানখান হয়ে যায়নি। যে এমন ভাবে নিঃসম্পর্ক অনাত্মীয় মানুষদের মর্জির ওপর নির্ভর করে বেঁচে নেই। এত দিন সে ভাবত, সে যাকে বলে ভাগ্যহীনা। ভুল বিয়ে, ভুল স্বামী, ভুল ঘরসংসার তার। আমার বাচ্চা নেই। সারা জীবন উষর, নীরস বেঁচে থাকব এমন করে। মৃগাঙ্ক পয়সা কামাতে যাবে, আমি পিশ প্যাশ কিংবা সাবুর খিচুড়ি রেঁধে খেয়ে নেব, খুব অনিচ্ছেয় শাড়িতে ট্রেসিং পেপার ফেলে ডিজাইন তুলব, তার পর রেশম বাছতে বসব। কোনওটাই আমাকে জীবন দেয় না। আনন্দ দেয় না। একমাত্র যখন সাকচিতে গিয়ে থাকি, কিছু দিন বাঁচি। কিন্তু সেও সীমাবদ্ধ, সময়বদ্ধ স্বর্গ। আবার ফিরতে হয় এই নিরানন্দ গৃহেই। কারণ এখানেই আমাকে রাখা হয়েছে।