নীলবসনা সুন্দরী : চতুর্থ খণ্ড – অষ্টম পরিচ্ছেদ – তাহার পর কি হইল?
দেবেন্দ্রবিজয় মহাবিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। এই হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত সমগ্র ঘ্টনা মনে মনে তোলপাড় করিতে লাগিলেন। শেষে ভাবিয়া স্থির করিলেন, মনিরুদ্দীন ‘উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে’ চাপাইতে চাহেন। নিজের দোষক্ষালনের জন্য তিনি এই হত্যাপরাধটা মুন্সী সাহেবের স্কন্ধে তুলিয়া দিতে পারিলেই এখন নিশ্চিন্ত হইতে পারেন। লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে বিপথে চালিত করিবার চেষ্টা করিতেছে। যাহা হউক, দেবেন্দ্রবিজয় সহসা কিছু বলিতে পারিলেন না।
মনিরুদ্দীন দেবেন্দ্রবিজয়কে নীরব থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, “কি ভাবিতেছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি এখন মুন্সী সাহেবের উপরে এই হত্যাপরাধটা চাপাইতে চাহেন, দেখিতেছি, আপনার এইরূপ দোষারোপের কারণ যে আমি না বুঝিতে পারি, এমন মনে করিবেন না।”
মনিরুদ্দীন ক্রোধভরে বলিলেন, “না, আমি কাহারও উপরে দোষারোপ করিতেছি না; সে ইচ্ছাও আমার নাই। আমি মুন্সী সাহেবের মত একজনকে দেখিয়াছিলাম, এইমাত্র। ইহাতে আপনি দোষারোপের কথা কি পাইলেন? যাক্, আপনার সহিত আমার আর কোন কথা নাই। আপনি এখন নিজের পথ দেখিতে পারেন।” বলিয়া মল্লিক সাহেব রাগে অস্থির হইয়া একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
দেবেন্দ্রবিজয়ও তখনই চকিতে দাঁড়াইয়া উঠিলেন; এবং অন্তর্ভেদী বক্রদৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। মনিরুদ্দীনও তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাঁহার মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। এমন সময়ে তাঁহাদিগের পশ্চাতে কক্ষদ্বারে নিঃশব্দে ঈষন্মুক্ত হইল তখন কেহই তাহা লক্ষ্য করিলেন না।
প্রশান্তস্বরে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আর দুই-একটি প্রশ্নের সদুত্তর পাইলেই আমি নিজের পথ দেখিব। যে একঘন্টাকাল আপনি অন্ধকারে তাহাদের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন, তাহার মধ্যে আর কোন কাণ্ড ঘটে নাই? আপনি কি আর কিছুই দেখেন নাই?”
মনি। না-কিছু না।
দে। তাদের অনুসন্ধান ছাড়া আপনি আর কিছুই করেন নাই?
মনি। না।
দে। অনুসন্ধানে কোন ফল হয় নাই?
মনি। কিছুই না। আমি সে দু’জনের কাহাকেও আর দেখিতে পাই নাই।
দে। কাহাকেও না-দিলজানকেও নয়?
মনি। না।
দে। বাঃ! কেহ ইহা বিশ্বাস করিবে?
মনিরুদ্দীন আরও রুষ্ট হইলেন; ক্রোধে তাঁহার আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল; এবং হস্তদ্বয় দৃঢ়রূপে মুষ্টিবদ্ধ হইল। অত্যন্ত কঠিনকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহা হইলে আপনি কি এই হত্যাপরাধে আমাকেই দোষী সাবুদ্ করিতে চাহেন?”
দে। না-সে ইচ্ছা আমার আদৌ নাই। আমি আপনাকেই একবার আপনার নিজের কথা ভাবিয়া দেখিতে বলি; তাহা হইলে আপনি আমার মনের ভাব বেশ বুঝিতে পারিবেন। ভাল, আমিই আপনাকে বুঝাইয়া দিতেছি। মনে করুন, কোন ভদ্রলোক একটি স্ত্রীলোককে লইয়া একেবারে নিরুদ্দেশ হইবার চেষ্টায় আছেন। তাঁহার আর একটি প্রণয়িনী তখন বর্ত্তমান। তাহাকেও সেই ভদ্রলোকটি পূর্ব্বে গৃহের বাহির করিয়া আনিয়াছিলেন। কোন রকমে সে তাহার প্রণয়ীর এই নূতন প্রেমাভিনয়ের কথা জানিতে পারিয়া সেই রাত্রিতেই সে তাহাতে বাধা দিবার জন্য তহাদিগের বাড়ীতে আসে। সেই ভদ্রলোকটি তখন বাড়ীতে ছিলেন না; কিন্তু স্ত্রীলোকটি যখন হতাশ হইয়া বাহির হইয়া যায়, গোপনে থাকিয়া তিনি তাহাকে দেখিতে পাইয়া তখন তাঁহার অনুসরণ করেন। তাহার পর পথিমধ্যে কোন নির্জ্জন স্থানে অবশ্য তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইয়া থাকিবে। পরস্পর সাক্ষাতে স্ত্রীলোকটি সুমিষ্ট প্রেমসম্ভাষণের পরিবর্ত্তে নিজের অন্তর্দাহের বেগে তাঁহাকে যখন অনেকগুলি কটূবাক্য শুনাইয়া দিতে আরম্ভ করিল, তখন সেই ভদ্রলোকটি-”
মনিরুদ্দীন বাধা দিয়া বলিলেন,-“তাহাকে খুন করিল, এই ত আপনি বলিতে চাহেন? আপনার ধারণা, আমিই তাহাকে খুন করিয়াছি। ইহা আমি অনেকক্ষণ বুঝিয়াছি; কিন্তু আপনার এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক-আমার সঙ্গে সেই স্ত্রীলোকের আর দেখা হয় নাই। যদিই বা পরে দেখা হইয়া থাকে, তহা হইলে আমি আমার বাঞ্ছিত সৃজানকে দেখিতে পাইতাম-প্রকৃত পক্ষে সে দিলজান নহে।”
দেবেন্দ্রবিজয় মহা-অপ্রতিভ হইলেন। এ জীবনে তিনি আর কখনও অপ্রতিভ হন্ নই। মনে ভাবিলেন, এই খুনের কেসটা ভয়ানক বিশ্রী। কয়েকদিন হইতে অনবরত ভাবিয়া ভাবিয়া, ঘুরিয়া ঘুরিয়া, তাঁহার মাথা যেন একেবারে বিগ্ড়াইয়া গিয়াছে; নতুবা তিনি নিজে আজ সহসা এমন একটা ভুল করিয়া ফেলিতেন না। তিনি ইহাও সহজে বুঝিতে পারিলেন, মনিরুদ্দীন বড় ধূর্ত্ত, তাঁহারই সমকক্ষ বুদ্ধিমান্-সহজে হটিবার পাত্র নহেন। নিমেষের মধ্যে অনেক কথাই তাঁহার মনে পড়িল-সেই বেনামী পত্রাবলী-ঘুষ দেওয়ার প্রলোভন, নির্জ্জন গলিপথে অলক্ষিতে লগুড়াঘাত-সেই সকল ক্রিয়ার কর্ত্তা-এই কি সেই লোক? সন্দেহে দেবেন্দ্রবিজয়ের মস্তিষ্ক বড় চঞ্চল হইয়া উঠিল। তিনি সহসা অতি কঠিনকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ, কথাটা বলা আমার ভুল হইয়াছে-স্বীকার করি; কিন্তু আপনি নিশ্চয় জানিবেন কি ভয়ানক বিপদের বজ্র আপনার মাথার উপরে উদ্যত রহিয়াছে। সহজে আপনি নিষ্কৃতি পাইবেন না। দিলজান মনে করিয়া আপনি ভ্রমক্রমে সৃজানকেও খুন করিতে পারেন-তাহাই ঠিক। আপনি খুন না করিলে এরূপ ভাবে, এরূপ সময়ে কে তাহাকে খুন করিল?”
“দিলজান।”