Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নীলবসনা সুন্দরী || Panchkari Dey » Page 43

নীলবসনা সুন্দরী || Panchkari Dey

দিলজান একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া এক গ্লাস জল আনিতে আদেশ করিল। ভগিনীর মৃত্যু-যে-সে মৃত্যু নহে-খুন, তাহার পর এই সকল জবাবদিহি। দিলজান যেন প্রাণের ভিতরে হাঁপাইয়া উঠিয়াছিল। ভৃত্য জল লইয়া আসিলে দিলজান পর্দ্দার অন্তরালে গিয়া এক নিঃশ্বাসে একগ্লাসে জল পান করিয়া ফেলিল-এবং অনেকটা যেন সুস্থ হইতে পারিল। পুনরায় আসিয়া সে দ্বারপ্রান্তে উপবেশন করিল। বসিয়া দিলজান বলিতে আরম্ভ করিল-প্রথমে স্বরটা কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল-ক্রমে তাহা বেশ সংযত হইয়া আসিল। দিলজান বলিতে লাগিল;-“আমার বাল্য-জীবনী প্রকাশের কোন প্রয়োজন দেখিতেছি না আপনারা তাহা এখন শুনিয়াছেন। মল্লিক সাহেব আমাকে লতিমন বাইজীর বাড়ীতে আনিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি আমাকে বিবাহ করিবেন বলিয়া আশাও দিয়াছিলেন; সেই প্রলোভনে আমি তাঁহার সহিত গৃহত্যাগ করি; কিন্তু আমাকে নিজের করতলগত করিয়া শেষে তিনি বিবাহের কথায় বড় একটা কান দিতেন না-কখন কখন আশা দিতেন মাত্র।
এইরূপে অনেকদিন কাটিয়া গেল। একদিন তাঁহারই মুখে শুনিলাম, কলিঙ্গা বাজারের মুন্সী সাহেবের সঙ্গে আমার ভগিনী সৃজানের বিবাহ হইয়াছে। শুনিয়া প্রথমতঃ সুখী হইলাম-তাহার পর ভিতরের কথা ক্রমে ক্রমে জানিতে পারিয়া নিজের সর্ব্বনাশ বুঝিতে পারিলাম। শুনিলাম আমার ভগিনীও মল্লিক সাহেবের প্রলোভনে মুগ্ধ হইয়াছে। আর রক্ষা নাই-সত্বর ইহার প্রতিবিধান করা দরকার। আমি গোপনে সন্ধান লইতে লাগিলাম। একদিন শুনিলাম, আমার ভগিনী মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগ করিবার জন্য স্থিরসঙ্কল্প। যাহাতে তাহার সঙ্কল্প সিদ্ধ না হয়, সেজন্য প্রাণপণ করিতে হইবে-নতুবা আমাকে একেবারে পথে বসিতে হয়। যেদিন রাত্রিতে আমার ভগিনী গৃহত্যাগের বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া ফেলিয়াছিল, সেইদিন অপরাহ্ণে আমি মল্লিক সাহেবের বাড়ীতে গিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, যেমন করিয়া হউক, তাঁহাকে নিরস্ত করিতে হইবে। পায়ে ধরিয়া পারি-না পারি, তাঁহাকে খুন করিব-এ সঙ্কল্পও আমার ছিল। তাঁহাকে খুন করিয়া সেই ছুরিতে নিজের প্রাণ নিজে বাহির করিয়া ফেলিতে কতক্ষণ সময়ের দরকার? সেজন্য আমি একখানি ছুরিও নিজের সঙ্গে লইয়াছিলাম। দারুণ নৈরাশ্যে, ঈর্ষা-দ্বেষে আমি তখন এক রকম পাগলের মতই হইয়া গিয়াছিলাম-মনের কিছুই ঠিক ছিল না। মল্লিক সাহেব তখন বাড়ীতে ছিলেন না; মজিদ খাঁর সঙ্গেই আমার দেখা হয়-মনের ঠিক ছিল না-আবেগে তাঁহাকে সকল কথা বলিয়া ফেলিলাম। তিনি আমাকে বুঝাইয়া বিদায় করিয়া দিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। আমি কিছুতেই বুঝিলাম না-সে শক্তিও তখন আমার ছিল না। তিনি জোর করিয়া আমার নিকট হইতে ছুরিখানি কাড়িয়া লইতে আসিলেন। আমি কিছুতেই দিব না-তিনিও কিছুতেই ছাড়িবেন না-আমি তখন অনন্যোপায় হইয়া ছুরিখানা ঘরের বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলাম। যেমন তিনি তাহা উঠাইয়া লইবার জন্য ছুটিয়া যাইবেন-দেখিতে না পাইয়া জুতাসুদ্ধ পা সেই ছুরিখানির উপরে তুলিয়া দিতে, সেখানা দুই টুক্রা হইয়া গেল। তিনি সেই ভাঙা ছুরিখানি নিজের জামার পকেটের মধ্যে রাখিয়া দিলেন। আমি হতাশ হইয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম। বাড়ীতে ফিরিয়া মন আরও অস্থির হইয়া উঠিল-আশা ত্যাগ করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইল। আমি আর একটা নূতন উপায় স্থির করিলাম। স্থির করিলাম, আমার ভগিনীর সহিত গোপনে দেখা করিয়া মর্ম্মকথা সমুদয় খুলিয়া বলিল। যাহাতে সে আমার গন্তব্য পথের অন্তরায় না হয়, সেজন্য তাহাকে বুঝাইয়া বলিব-নিশ্চয়ই সে আমার কথা ঠেলিতে পারিবে না-জানিয়া-শুনিয়া সে কখনই আমার সর্ব্বনাশ করিবে না। শুধু আমার নয়-সকল কথা খুলিয়া বলিলে সে নিজের সর্ব্বনাশও নিজে বুঝিতে পারিবে, মনে করিয়া আমি তাহার সহিত দেখা করিতে যাইলাম। যাইয়াই তাহার দেখা পাইলাম না; সে কোথায় নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছিল। আমি তাহার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। যখন আমার ভগিনী ফিরিয়া আসিল, তখন রাত প্রায় এগারটা। আমি তাহাকে নিজের অভিপ্রায় বেশ করিয়া বুঝাইয়া বলিলাম। কিন্তু কিছুতেই সে বুঝিল না-আমার সহিত ঝগড়া আরম্ভ করিয়া দিল। কিছুতেই সে মল্লিক সাহেবকে ত্যাগ করিতে সম্মত হইল না। শেষে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হইল;-সে অগ্রে মল্লিক সাহেবের বাড়ীতে গিয়া, তাঁহার সহিত দেখা করিয়া জানিবে, আমার কথা কতদূর সত্য-তিনি আমাকে আন্তরিক ভালবাসেন কি না-তাহার পর যাহা হয় করিবে। যদি সে বুঝিতে পারে, মল্লিক সাহেব তাহার সর্ব্বনাশ সাধনের জন্য তাহার সহিত এইরূপ প্রণয়াভিনয় আরম্ভ করিয়াছেন, তাহা হইলে সে তাঁহার আশা ত্যাগ করিবে, নতুবা নহে-এইরূপ স্থির হইল। আমিও তাহা যুক্তিযুক্ত বলিয়া বোধ করিলাম! তখনই মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করা দরকার-কিন্তু কিরূপে তেমন সময়ে সে গোপনে তাঁহার সহিত দেখা করিবে, কোন উপায় স্থির করিতে পারিল না। বিশেষতঃ তেমন সময়ে বাটীর বাহির হইয়া একজন অপর পুরুষের সহিত দেখা করা তাহার পক্ষে খুবই দোষাবহ; কিন্তু দেখা করা চাই-ই । আমি একটা নূতন উপায় ঠিক করিয়া ফেলিলাম; তাহাকে আমার কাপড় জামা ওড়্না সমুদয় খুলিয়া দিলাম। সে তাহাই পরিয়া বাহির হইয়া গেল। আমি তাহার পোষাক পরিয়া তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। পাছে কোন রকমে ধরা পড়ি, এই ভয়ে আমি তাহার শয়নকক্ষে গিয়া ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া রহিলাম। মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিয়া, যা’ হয় একটা স্থির করিয়া তাহার শীঘ্র ফিরিবার কথা ছিল; কিন্তু অনেকক্ষণ আমি তাহার অপেক্ষা করিলাম। ক্রমে রাত দুটা বাজিয়া গেল। তখনও সৃজানকে ফিরিতে না দেখিয়া আমার মনে নানারকম সন্দেহ হইতে লাগিল। মনে ভাবিলাম, সে নিশ্চয়ই আমাকে বড় ফাঁকি দিয়া গিয়াছে; তথাপি নিরাশ হইলাম না-গোপনে আমিও সেখানে হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। আমি বরাবর মনিরুদ্দীনের বাড়ীর দিকে গেলাম। বাড়ীর পশ্চাতে একটা গলিপথে দেখি, একখানা গাড়ী তখনও সেখানে দাঁড়াইয়া আছে। দেখিয়া অনেক ভরসা হইল; বুঝিতে পারিলাম, সৃজান আমাকে ফাঁকি দিতে পারে নাই। মল্লিক সাহেব সৃজানের জন্য গাড়ী লইয়া অপেক্ষা করিতেছেন। তখন আমার মাথায় আর একটা মতলব উপস্থিত হইল; আমি সেই গাড়ীর দ্বার-সম্মুখে গিয়া দ্বারের হাতলে হাত দিয়া দাঁড়াইলাম। ভিতরে মনিরুদ্দীন সাহেব বসিয়াছিলেন। তিনি আমার হাত ধরিয়া গাড়ীর ভিতরে উঠাইয়া লইলেন। অন্ধকারে আমাকে তিনি চিনিতে পারিলেন না। গাড়ীর ভিতরে আরও অন্ধকার-আমার আরও সুবিধা হইল। আমি গাড়ীর ভিতরে উঠিয়া বসিলে, তিনি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এত রাত হ’ল? আমি তাঁহার অপেক্ষা মৃদুস্বরে-পাছে ধরা পড়ি-খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর করিলাম, ‘হাঁ।’ তখনই গাড়ী ছাড়িয়া দেওয়া হইল। পথে তিনি অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, পাছে কণ্ঠস্বরে আমাকে চিনিতে পারেন, সেইজন্য আমি খুব মৃদুস্বরে তাঁহার প্রশ্নের ‘হাঁ’ ‘না’ ‘হুঁ’ বলিয়া উত্তর দিতে লগিলাম। ক্রমে গাড়ী শিয়ালদহ ষ্টেশনে আসিয়া পৌঁছিল। ষ্টেশনে অনেক লোকের ভিড়-দীপালোকে চারিদিক্ আলোকিত। অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকিয়া গাড়ী হইতে নামিয়া পড়িলাম; না ঢাকিলেও ক্ষতি ছিল না-সহজে তিনি আমাকে চিনিতে পারিতেন না; তথাপি সাবধান হওয়া দরকার। যাহা হউক, আমার একটা খুব সুবিধা ছিল। আমার পরিধানে সৃজানের পোষাক-সৃজানের জাফ্রাণ রঙের সিল্কের কাপড় জামা ওড়্না-তিনি আমাকে সন্দেহ করিতে পারিলেন না। এদিকে ট্রেণ ছাড়িবার বিলম্ব ছিল না; তিনি তাড়াতাড়ি প্রথম শ্রেণীর টিকিট কিনিয়া আমাকে লইয়া ট্রেণে উঠিলেন। তৎক্ষণাৎ সে ট্রেণ ছাড়িয়া দিল। তখন আমি অবগুণ্ঠন উন্মুক্ত করিয়া দিলাম। প্রথমে তিনি আমাকে চিনিতে পারিলেন না; তাহার পর যখন তিনি নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিলেন, তখন যেন একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন। তখন আমি তাঁহাকে সমুদয় কথা খুলিয়া বলিলাম। শুনিয়া তিনি আমার উপরে একেবারে খড়গহস্ত হইয়া উঠিলেন- অনেক তিরস্কার করিতে লাগিলেন। আমি তাহাতে কর্ণপাত করিলাম না। তিনি পরের ষ্টশনে নামিয়া পুনরায় কলিকাতায় ফিরিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। তাহা হইলে আমি ট্রেণ হইতে লাফাইয়া পড়িয়া আত্মহত্যা করিব বলিয়া তাঁহাকে আমি ভয় দেখাইলাম। তিনি আর বাড়াবাড়ি করিলেন না। ষ্টেশনের পর ষ্টেশন পার হইয়া ট্রেণ চলিতে লাগিল। তিনি আর উচ্চবাচ্য করিলেন না; আমাকে এই বাগানে আনিয়া রাখিলেন।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress